প্রজিত জানা-র গুচ্ছ কবিতা
মায়া ইতিহাসে
আজও হাওয়া ফিরে গেলে , জারুলগাছের নীচে
সব যেন ফাঁকা হয়ে আসে । প্রকৃতির এইসব
ছায়া ঘেরা সন্ধ্যা থেকে বহুদূরে, তাচ্ছিল্যভরে
ছদ্ম-গাম্ভীর্যের পর্ব শেষ করে , সম্পাদক বাণিজ্য সফল
লম্বা কোনও সিগারেট ধরাবে আবার । মেতেরোপলিসে ।
কিম্বা সে নিতান্তই না যদি ধরায় , গাছতলা থেকে দূরে
গঞ্জের সবজি বাজার ,তাড়ির ঠেকের পাশে , ঘুমচোখে
ঠিক বসবে যথারীতি, ঘড়ি ধরে বিকেল পাঁচটায় …
তোমার তো তাড়া নেই আর, নেই আর দায়। জীবিকার
ব্যস্ত পর্ব চুকে গেছে, অধ্যয়নও বহুকাল
হয় না তেমন। অধ্যবসায় নেই, নাছোড়বান্দার মতো
শুধু কিছু লেখালেখি, অক্ষরের কুটাভাস আছে
কেন আছে ! কেনই বা আছে ! নিয়ত নিবিষ্ট অচেতনে
তুমি তো মরণই তার কামনা করেছো কত বার ।
তবু তাকে না পেরে এড়াতে, সটান অর্গল আটকে
ভিতর প্রবেশ পথ রুদ্ধ করার ছল খুঁজেছ অনেক…
হাওয়া ফিরে গেলে তাই জারুলগাছের নীচে
কবেকার হিমে ঢাকা ইতিহাস, মায়া নেমে আসে।
ভনিতা পেরিয়ে
আনতোনিয়নি নয়, জাঁ মঁরো বা মনিকার জন্য আমি
বার বার চলে যেতে পারি , সুনীল সাঁতার পুলে, হাঁটুজলে
দূরে কোনও খেলনার রকেট ওড়াতে। লা নট্টে থেকে
আমি দেবদূত হয়ে ফের বাসনার ডানা মেলে উড়ে যাবো
দিকশূন্য, বিষাদনগরে। উইম ওয়ান্ডার্স যেন , অথবা রেঁনোয়া
এই পৃথিবীর কোনও খেলাঘরে , মেঘের মিনারে
বিপর্যস্ত দেবদূত আর না নামিয়ে ফের…
জাঁ মঁরো বা মনিকার মতো কোন মানবীকে
কিছুটা কৈশোর আর অধিক যৌবন দিয়ে
প্রেতলোকে নামান আবার…
সকল শিশুরা যেন কখনও কখনও ফের
বিকেল ফুরিয়ে গেলে অপার বিস্ময়ে
সব চেয়ে উঁচু এক আকাশপথের দিকে
চেয়ে দেখে রঙে রাঙা আগুনের মেঘ ও ফানুস
দেখে সব ঝরে পরা পালকের আগে আগে
আরও সব রঙিন সারস উড়ে যায়
প্রেমভঙ্গি , রঙ্গমঞ্চ, সুনিপুণ বাগিচার ভুলে ভরা
গন্ধফুল, রক্তকাঁটা , বুদ্বুদের মরলোক ছেড়ে
ফিরে যায় দেবদূত পৃথিবীর পথ ধরে
আদি সেই মায়ার বন্দরে
ছায়া- আভরণে ঢাকা, লাবণ্যের
ভনিতা পেরিয়ে বহুদূর …..
যে চোখে শিশির মাখা
যে শরীরে মাখা সুবাতাস
নিরেটের ভীড়ে ঠিক
শিশুরা তবুও তাকে চিনে ফেলে আজও….
মনীষার ঘরে
মনীষার ঘরে আমি দেখেছি মেঘের আনাগোনা
শিয়রে শিশির বিন্দু , দরজায় ভোরের নিঃশ্বাস
সামান্য হাওয়ায় জানলা খুলে যায়। রোমাঞ্চিত কেঁপে ওঠে মেঝে
মাথার ওপরে দোলে একাকার আকাশ ও আকাশের ছাদ
মনীষার বারান্দাটি শূন্যে ভাসে নিজের খেয়ালে
একবার সেখানে দাঁড়ালে , অনেক নীচের এক পৃথিবীকে
কেমন অজানা মনে হয়। মনে পড়ে? এইখানে একদিন
মনীষাও বলেছিল একাকী দাঁড়িয়ে, চলে যাওয়া খুব সোজা
নিতান্তই যদি যেতে হয়, একটু হালকা করে
এ শরীর ভাসিয়ে দিলেই যাওয়া যাবে।
বলেছিল।তাই বলে কে জানত এইভাবে কথা রাখবে
অক্ষরে অক্ষরে। আগে তো রাখে নি কোনও দিন।
মনীষার ঘরে তাই একমাত্র মনীষাই থাকে না অনেক কাল হলো।
বাকিরা সবাই আছে, শিশিরবিন্দুরা, মেঘ
হাওয়ায় ভাসতে থাকা ওই শূন্য মেঘের বারান্দা …আর
ক্রমশ অনেক নীচে ভেসে যাওয়া মনীষার সুখবাষ্প, স্মৃতি ….
পৃথিবীর ভোজনের শেষে
লেখার টেবিল থেকে সরে আসি
অন্য এক পীতাভ কবরে। সেখানে পাতারা
ঝরে অবিরাম । পরিত্যক্ত, বাসি শব্দ
বাতিল ফুলের মতো পাশ ফেরে
কবরের কিছুটা তলায় , কবেকার সুগন্ধির
ফেলে আসা নীলিমার দিকে
পৃথিবীর ভোজনের শেষে
আমাকে এলাচি দিও জাসমিন
রঙিন মশলা ভরে রাংতা জড়িয়ে
রেখো পানপাতা। বাহারি সুপুরি
বসন্ত বিগত প্রায় । অস্থি জুড়ে
জরার তীক্ষ্ম দাঁত বিস্তারিত যেন
মাথার ভিতরে এক
অবিরাম পত্রহীন পত্রের মর্মর
বৃক্ষটি ন্যাড়া ও রুগ্ন । শুকনো ডালে
তবু কোন্ হাওয়ার পাখিরা
উড়ে আসে । তাদের শরীরে মেঘ
তাদের ডানায় যেন
নিভতে নিভতে ফের জ্বলে ওঠে
অস্তগামী আলো ও প্রলাপ
সিন্দবাদ
ফিরে যাও মেহফিলে আঙুলে জড়াও বেলমালা
আরব্যরজনী থেকে উঠে এসো সিন্দবাদ, জাহাজডুবির
গান গাও। বাতিঘর কেঁপে ওঠে, সাজঘরে একা দানিবাবু
অসম্পূর্ণ ইতিহাসবোধ নিয়ে মধ্যযুগ মঞ্চে আনিবেন
হ্যালোজেন জ্বলে ওঠে। সাজঘরে নামে অসময়
শুধু তো কন্ঠে নয় শরীরের প্রতিটি মুদ্রায়…
জাগে দেহ , জাগে অভিনয়
এ যদি নাটক হয় জীবনের কটা ড্রপসিন
দর্শক কিই বা বলবে, সে তো অন্ধ, নেশায় বিলীন
তবু সেই সবকিছু তবু সেই নাটকের প্রাণ
সেই নাকি শেষ কথা, সেই নাকি জ্যান্ত ভগবান
অ্যালিয়েনেশন না কি ক্যাথারসিস, এই নিয়ে সংবর্ত রোজ
স্বর্গের সাজঘরে ব্রেখট আর অ্যারিস্টটল মুখোমুখি
দুজনের মাঝখানে পিরান্দেলো বড়ই বিব্রত
মনে মনে চাইছেন শেকসপিয়র একবারটি এখানে আসুন…
মনে পড়ে দানদিন, মনে পড়ে ভারবির নান্দনিক গোপন সংশয়
সিন্দবাদ সিন্দবাদ জাহাজডুবির কথা বলো।
মাঝদরিয়ার সেই শেষ দৃশ্যে মেঘেদের ইন্দ্রজালে
ঢেকে যাওয়া অজানা চরের কথা বলো….
ঢেউয়ের মঞ্চ থেকে ডুবোজাহাজের গ্রিনরুমে
ফের রিহার্সাল হোক আমাদের শেষ মেহফিলে …
দুঃখ থাকে না বেশী দিন
একদিন যাবো। আমার জন্য শুধু রেখো
মেঘের মিনারে এক
জানলা খোলা বাতাসের বাড়ি।
যাবো একদিন। সন্ধ্যা নামলেই
পাহাড়ে পাহাড়ে, দেখো
জ্বলে উঠবে ছায়া ঘেরা আলো
দেখবে, মৃত্তিকা ফুঁড়ে
অকস্মাৎ , আমিও এলাম
তোমার বাতাসবাড়ির জানলায়
এভাবেই চলে গিয়েছিলাম একদিন
নিমেষে হারিয়ে যাওয়া
জুনিপোকাটির মতো একা !
ফিরেও এলাম। হয়তো নিজেরই কাছে
আলো আর অন্ধকারের ফাটলে
সেভাবেই, অপ্রত্যাশিত।
কখন ? তারিখ কত, কে বলতে পারে !
ঘড়ির কাঁটার সাথে
বহুকাল যোগ নেই আর।
শূন্যপুরে আমি এক সামান্য নাবিক
এও সেই নৈরাজ্য, মধ্যসায়রের
পেরিয়ে এসেও তীর, খুঁজে আর পাইনি কখনও
ডুবোজাহাজের সাথে বার বার ডুবে গেছে আমাদের
শেষ কবিতারা। সমুদ্র ফিরিয়ে দেয়… দেবে , বলেছিল যারা
তাদের হাড়ের ডিঙি ভেসে গেছে মায়ার বন্দরে….
যাব একদিন। তোমার বাতাসঘরে
মেঘের জানলায় । দু চার দণ্ড থেকে
আবার উধাও হয়ে যাবো।
দুঃখ পেও না তাতে।
দুঃখ থাকে না বেশী দিন
তুমিও প্রলাপ, বানানো
কি ফেরত চাও ? কেউ এসে সেই নিশীথেই
জানলায় টোকা দিয়ে বলে, গতকাল কি ?
কিম্বা পড়শু? আরও যেতে চাও পিছনে
স্মৃতিরও একটা চিলেকোঠা আছে জানো তো !
আছে নাকি ! আমি কিই বা জেনেছি মনীষা !
নীলিমায় কবে উড়েছে ধূসর চাঁদিয়াল
কবে যেন শেষ … গতকাল ? না কী পড়শু
না কি কোনও দিনই ছিল না সে এই পৃথিবীর
এই পৃথিবীরই ছিল না বুঝি সে কখনও
মেঘের মিনারে কেন তবে শুধু আসে যায়
না কি চিলেকোঠা, তুমিও প্রলাপ বানানো
যা কিছু সত্যি তা এই নিরেট প্রদাহের…
যা কিছু সত্যি তা শুধু ঊষর ভষ্ম
অলীক তোমাকে রেখেছি অশনি ইশারায়
আমাদের দিন সবই গেছে ? কিছু বাকি নেই !
না কি কিছু আজও রয়ে গেছে সংবেদনে !