পেরি পেট্টিনা রোজু / নামকরণের দিন
অনুবাদ , ভূমিকা ও টীকা– গৌতম বসু
পেণ্ডিয়ালা ভ়ারাভ়ারা রাও
[ ভ়ারাভ়ারা রাও-এর তৃতীয় কারাবাসের সময়ে (১৯৮৩-৮৮) রচিত এবং ১৯৯০ সালে ‘মুক্তকণ্ঠম্’ শীর্ষক কবিতার বইয়ে গ্রন্থভুক্ত এই কবিতাটি ইন্দ্রভেলী-র শহীদদের প্রতি নিবেদিত তাঁর শ্রদ্ধার্ঘ্য।
গোন্দ্ উপজাতির সুপ্রাচীন জনগোষ্ঠীগুলি ছড়িয়ে রয়েছেন দক্ষিণ-মধ্য ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে; প্রধানত মধ্যপ্রদেশ, চত্তিসগড়, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা ও ওড়িষায়। রাষ্ট্রদ্বারা নিরন্তর নিপীড়িত হলেও, তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্রপ্রদেশের বিভাজন-পূর্ববর্তী ভূখণ্ডে, তাঁরা বলহীন ছিলেন না। তাঁদের অন্যতম প্রধান সংগঠন ‘গিরিজানা রুথু কুলি সংঘম্’-এর সংগঠকরা ২০এ এপ্রিল ১৯৮১-তে (সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে), ইন্দ্রভেলী-তে (জেলা: আদিলাবাদ, তেলেঙ্গানা) এক সুবিশাল জনসমাবেশের আয়োজন করেন। দূর-দূরান্ত থেকে বহু মানুষ, যাঁদের মধ্যে কেউ-কেউ ২০০ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে এসেছিলেন, নির্দিষ্ট দিনে ইন্দ্রভেলী পৌঁছোনর পর জানতে পারেন যে, শেষ মুহূর্তে পুলিশের অনুমতি প্রত্যাহৃত হওয়ার কারণে, অকস্মাৎ ওই জনসমাবেশ বেআইনি ঘোষিত হয়েছে। স্বভাবতই, প্রতিবাদ-সমাবেশ অশান্ত চেহারা নেয় এবং ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে’ জনসমাবেশের উপর গুলিবর্ষণ করা হয়; মৃতের সংখ্যার দু’টি হিসাব, ১৩(সরকারি) ও ন্যূনতম ৬০(অসমর্থিত, বেসরকারি)। নিহতদের নামধাম কোথাও প্রকাশিত হয় নি। পরবর্তীকালে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন যে, কর্তৃপক্ষ গণ শবদাহের ব্যবস্থা করেন, এবং যেহেতু কতজন মানুষ সেদিন ইন্দ্রভেলী এসেছিলেন তার কোনও হিসাব নেই, সেহেতু হতাহতের সংখ্যাও অজ্ঞাত। ঘটনাটির কয়েক বছর বাদে ‘গিরিজানারুথু কুলি সংঘম্’-এর পক্ষ থেকে সেখানে একটি স্মৃতিসৌধ গ’ড়ে তোলা হয়, কিন্তু ১৯৮৬ সালে কর্তৃপক্ষ তা ভেঙে ফেলেন। কবিতাটিতে সেই অনুষঙ্গও এসেছে। তেলেঙ্গানা-অন্ধ্রপ্রদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে এই ঘটনাটি ‘ইন্দ্রভেলী গণহত্যা’ নামে পরিচিত।
এই কবিতাটি প্রধানত ইন্দ্রভেলী-র শহীদদের প্রতি নিবেদিত শ্রদ্ধার্ঘ্য হলেও, বিভিন্ন স্থাননামের উল্লেখের ভিতর দিয়ে পরোক্ষ ভাবে স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী আদিবাসী আন্দোলনকেও স্মরণ করা হয়েছে। যেমন, কোমুরাম ভীম, গোন্দ্ সম্প্রদায়ভুক্ত অতীতকালের একজন গোষ্ঠীপ্রধান, যিনি নিজ়াম ও ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়ে, অবশেষে ১৯৪০-এ মৃত্যুবরণ করেন। কোমুরাম ভীম-এর সঙ্গে জড়িয়ে-থাকা স্থানগুলি যথাক্রমে এইরকম: জোদেনঘাট – কোমুরাম-এর জন্মস্থান, পিপল্ধারী – আক্রমণকারীদের কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যেখানে কোমুরাম সাময়িক আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং বাবেঝরী – কোমুরাম-এর মৃত্যুস্থল। গোন্দ্ জনগোষ্ঠীর লোক-ইতিহাসে কোমুরাম ভীম একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার ক’রে আছেন।
ভা়রাভ়ারা রাও-এর কবিতার অনুবাদকগণ আরও একটি সূক্ষ্ম অনুষঙ্গের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এই কবিতায় ‘নাম’, ‘নামকরণ’, ‘পরিচয়’ প্রভৃতি শব্দগুলির বিশেষ তাৎপর্য আছে। ইন্দ্রভেলী-র শহীদদের কোনও নাম নেই, এটিই তাঁদের মুক্তির অভিজ্ঞান। ব্যক্তির নাম ও পরিচয়ের সঙ্গে তাঁর তফসিলী উপজাতির ছাপটা স্থায়ী ভাবে জুড়ে দেওয়ার একটা চেষ্টা ভক্ষক-রাষ্ট্রের কার্যকলাপে সর্বদা লক্ষ করা যায়, কারণ মালিকানার সঙ্গে ব্যক্তিপরিচয়ের এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। এর বিপরীতে, নিপীড়িত মানুষের কাছে, তাঁর নামই তাঁর অবদমনের অন্যতম প্রধান প্রতীক।
পেরি পেট্টিনা রোজু / নামকরণের দিন
৷৷ ১ ৷৷ পুনর্লিখন ২.১১.২০ ১৬ কার্তিক ১৪২৭ সোমবার
অভ্যুত্থান যদি
অজ্ঞাতকুলশীল ও গৃহহীনকে
ভয়শূন্য ক’রে তোলে,
সাম্রাজ্য কি তার কাছে নতিস্বীকার করে কখনও?
বীরের চাই উচ্চবংশপরিচয়!
অরণ্যের মানুষ একত্রিত হয়ে,
চুনসুরকি, বালি, কাঠ আর পাথর
সংগ্রহ ক’রে যদি স্মৃতিসৌধ গ’ড়ে তোলে,
তাকে কি বীরগাথা আখ্যা দিতে পারি?
ইতিহাসের একটা বুনিয়াদ চাই৷
বুলেটের ছিদ্রে ছিন্নভিন্ন
গোন্দ্দের পরনের ন্যাকড়া জ্বালিয়ে
কি আর পাহাড়চূড়া জুড়ে প্রদীপ জ্বালানো যায়?
প্রদীপশিখার অধিকার কেবল রাজবংশের জন্য সুরক্ষিত৷
৷৷ ২ ৷৷
তাদের পল্লীজীবন বিষয়ে
আমায় প্রশ্ন করা হলে
আমি কী-ই বা উত্তর দিতে পারতাম?
বলতাম কি, অন্যের শহর পত্তন করার পর,
তারা নিজেরা ফিরে গিয়েছিল অরণ্যগর্ভে ─
আমায় যদি সংখ্যা গুনতে বলো,
ষাট অথবা তেরো,
আমি তোমাদের দেখাতে পারি সারা আকাশের সব তারা।
আর তোমরা? তোমরা তুলে ধরো ক্ষতিপূরণের তালিকা।
কে কেটেছিল নাড়ি, অরণ্যে ভূমিষ্ঠ ও পরিত্যক্ত
নবজাতকের নামকরণ করেছিল কে?
হয়তো তোমরাই পৌঁছেছিলে সবার আগে,
আদমশুমারিতে নথিভুক্ত করেছিলে তাকে,
অথবা ভোটার তালিকায়;
উপাধিলাভ যাদের জন্য নিষিদ্ধ,
আদিলাবাদ হাসপাতালের খাতা থেকে তাদের নাম সরিয়ে ফেলা হয়েছে,
অথবা, কীর্তিস্তম্ভের স্থানে ঝাড়ু দিয়ে সাফ ক’রে ফেলা হয়েছে সব পরিচয়।
ওদিকে,
লাঠি আর ব্যাধের ফাঁদ, উপত্যকা আর শিখর,
পাখি আর সরীসৃপ, জল আর আগুন,
মানুষ এবং পশু, পরিষ্কৃত জঙ্গল থেকে খাদ্য আহরণ করে,
ঘর বাঁধে,
অন্ধকার আর আলো
উভয়েরই কেবল একটি নাম :
অরণ্য।
অরণ্য, একই সাথে নিজের মা আর শিশুসন্তান৷
অরণ্যের ভাঁজে-ভাঁজে আদিম মানুষের বিবর্তন,
এবং আদিম মানুষের কোলে
নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে-থাকা অরণ্য;
এদের ভয়ে তোমরা সন্ত্রস্ত,
তাই, তাদের পরিচয়ে
একটা তক্মা সেঁটে দিয়েছ৷
জোদেনঘাট আর পিপল্ধারী
জুড়ে আতঙ্ক,
ইন্দ্রভেলী, বাবেঝরী,
এবং সাতনালা ১ ;
বাঁশের খোঁচায়-খোঁচায়
তাদের জীবন তোমরা নষ্ট ক’রেছ,
ক্যানেস্তারায় আর কার্তুজে,
খনি থেকে রক্তের আর গন্ধক-বাষ্পের উদ্গিরণে,
মাটির ভাঁজের জোড়রেখায়,
তোমরা আয়োজন করেছিলে নামকরণ আচারানুষ্ঠানের;
এত সাফল্যের পর,
নতুন ক’রে আর তাদের কোনওদিন হত্যা করা যাবে না৷
৷৷ ৩ ৷৷
এই ইতিহাসের গর্ভ থেকে উঠে এসে
বীরগণ মাথা তুলে দাঁড়ান,
প্রথম আদিবাসী কবে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন
সেই দিবস কি শনাক্ত করা যায়?
বছরের পর বছর এপ্রিলের কুড়ি তারিখের গায়ে
ছাপ মেরে তোমরা বর্তমানের খাতা
কালিমালিপ্ত করতে পারো,
কিন্তু এবার,
ইতিহাস ঝল্সে উঠেছে উনিশে মার্চ ২ ,
আর তখনই, তোমরা ছুটেছ দেবকের কারাগারের ৩ দিকে৷
৷৷ ৪ ৷৷
সেখানে সেই বনপুষ্পগন্ধবাহী ঝড়ো বাতাস
আমার ভিতরে পাক খেয়ে,
চক্রাকারে উঠে বয়ে চলে পর্বতচূড়ার উপর দিয়ে,
নক্ষত্রলোকের দৃষ্টি অরণ্যে নিবদ্ধ,
সেইখানে, ধুলোয় সে যেন কাকে অবিরাম খুঁজে ফিরছে৷
তার দেখা পায় না গোদাবরী,
শুকিয়ে যায় নদী, প’ড়ে থাকে নিজের বিছানায়, অবসন্ন৷
৷৷ ৫ ৷৷
পরশুদিনের মানুষ হয়তো গতকাল হতে
নিরুদ্দেশ,
গতকালের পাথরখণ্ডের ঢিবি হয়তো আজ আর নেই৷
তবু, রয়ে গেছে ইন্দ্রভেলী, আজ, গতকাল, এবং
তারও আগে
ইন্দ্রভেলী হয়তো অতীতের
একার সম্পদ নয়,
হয়তো তার উপর গতকালের স্মৃতিসৌধের পূর্ণ অধিকার নেই,
তবু, যারা তাকে আজ ধুলোয় মিশিয়ে দিল,
তাদের কোনওদিন সঙ্গ দেবে না ইন্দ্রভেলী৷
উপজাতির রক্তমাংসে পুষ্ট,
অরণ্য বেঁচে থাকবে,
আদিম প্রাণশক্তির সাথে চিরবদ্ধ আত্মা
অপরাজেয়;
শহীদের চুম্বন অবিনাশী
গঙ্গা আর তার জীবনপ্রবাহ রয়ে যাবে,
অরণ্যকে সম্পূর্ণ বিনষ্ট করা হলেও
তাকে রক্ষা করবে একটি কুঠার, একটি যষ্টি,
ছাইয়ের নিচে আগুন ধিকি–ধিকি জ্বলছে৷
এই সেদিন, তাকে সাজিয়ে-গুছিয়ে শহর ক’রে ফেলা হল
তবু, ইন্দ্রভেলী
সেই দ্রোহের প্রতীক, অক্ষয়;
গতকালের কীর্তিস্তম্ভ
আজ, স্মৃতির ফিকে দাগ৷
যারা তাকে ধ্বংস করেছে,
আগামীদিনে তাদের গলায় ভারি পাথর হয়ে সে ঝুলে থাকবে৷
ইন্দ্রভেলী দাঁড়িয়ে থাকবে, ঋজু,
যুদ্ধরত মানুষের
দৃষ্টিপথের শিখরদেশ৷
টীকা :
১।সাতনালা : সরকারী সেচ প্রকল্পের সঙ্গে আদিবাসী সম্প্রদায়ের উচ্ছেদের একটা সম্পর্ক আছে। নদীতে বাঁধ-দেওয়ার কারণে স্বাভাবিক জলপ্রবাহ শুকিয়ে-যাওয়া ছাড়াও, কৃত্রিম জলাধারের জায়গা ক’রে দেওয়ার জন্য, আমরা জানি, আদিবাসী পরিবারদের তাঁদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে আর্থিক ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা এই উচ্ছেদকে একরকম মান্যতাও হয়তো এনে দেয়। এই রকম একটি প্রতিবেশ-বিরোধী,‘উন্নয়নমুখী’ উচ্ছেদ-অভিযান ঘিরে ১৯এ মার্চ ১৯৮৪-এ সাতনালা-য় আদিবাসীদের ও পুলিশের মধ্যে খণ্ডযুদ্ধ ও তৎসংক্রান্ত ধরপাকড়ের খবর, সেই সময়ের জাতীয় স্তরের সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। সাতনালা-সেচপ্রকল্পের তথ্য – জেলা : আদিলাবাদ, নদী: গোদাবরী(মধ্যাংশ), সাব-বেসিন:পেনগঙ্গা। আয়তন: ২.০৫ টি এম সি (থাউসাণ্ড মিলিয়ন কিউবিক ফীট)। ১৯,২০০ একর কৃষিজমি এই সেচপ্রকল্পের অধীনে আনা হয়েছে।
২। উনিশে মার্চ : ১৯.০৩.১৯৮৪। সাতনালা-সেচপ্রকল্প সংক্রান্ত আদিবাসী প্রতিরোধ ও পুলিশের প্রহারের তারিখ।
৩। দেবক-এর কারাগার : এখানে শ্রীকৃষ্ণ-র জন্ম বৃত্তান্তের অতিকথাটি ব্যবহার করা হয়েছে ।
উৎসনির্দেশ ও ঋণস্বীকার :
মূল কবিতা: কাব্যগ্রন্থ ‘মুক্তকণ্ঠম্’। প্রকাশক : সমুদ্রম্ প্রচুরানিলু, বিজয়ওয়াড়া, ১৯৯০।
ইংরেজি অনুবাদ : ‘ওয়াসাফিরি’, ষষ্ঠ খণ্ড, ত্রয়োদশ সংখ্যা, অনুবাদক : ডি. ভ়েনকাট্ রাও
প্রকাশক : রুট্লেজ, লন্ডন ১৯৯১। বর্তমান বঙ্গানুবাদ শ্রী ডি. ভ়েনকাট্ রাও-কৃত ইংরেজি অনুবাদ অনুসরণ করেছে।
কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপন ও ঋণস্বীকার:
১. শ্রী এন. ভ়েনুগোপাল
২. শ্রী ডি. ভ়েনকাট্ রাও
৩. শ্রীমতী মালবিকা গুহ মুস্তাফী ।
গৌতম বসু
পুনর্লিখন: ২০২০
ভারভারা রাওয়ের কবিতাগুলি পড়লাম। ভালো লেগেছে। কবি বতর্মানে কেমন আছেন খবর পাওয়া যাচ্ছে না।
লেখাটি পড়েছি। ভালো লেগেছে।