পরশ পাথর
উজ্জ্বল ঘোষ
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মেলবন্ধন তাঁর রক্তে। প্রথম দুটি ছবি ( “পথের পাঁচালী” ও “অপরাজিত”) ইতিমধ্যেই সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে। কিশোরবেলা থেকে পাশ্চাত্য সিনেমা দেখার ও বোঝার নেশা এবং শিক্ষা, বিভূতিভূষণের গল্প, পাশ্চাত্য টেকনিক, মানবিকতার স্পর্শ এবং অবশ্যই তাঁর নিজস্ব শৈল্পিক ভাবনার মিশ্রণ এক অসামান্য রূপ নেয় প্রথম দুটি সিনেমায়। তার আগেই তিনি সান্নিধ্য ও পরামর্শ পেয়েছেন প্রিয় ফরাসি চলচ্চিত্র পরিচালক জাঁ রেনোয়ার(Jean Renoir), যিনি "The River" ছবির জন্য অভিনেতা অভিনেত্রী ও জায়গা নির্বাচনের কারণে ১৯৪৯-এ ভারতে আসেন। মুগ্ধ ও প্রভাবিত হয়েছেন ইতালীয় নিও রিয়ালিস্ট Vittorio De Sica'র "Bicycle Thieves" দেখে। "পরশ পাথর" তাঁর প্রথম বিশুদ্ধ কমেডি, সঙ্গে অন্তঃসলিলা বেদনার ফল্গু ; humour with humanity। এখানেও আছে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের নিপুণ সিন্থেসিস। আছে কলকাতার কেরানিকুল, নব্য বাবু শ্রেণী, সুকুমার ও চ্যাপলিনের আশ্চর্য সংমিশ্রণ।
১
যিনি ‘আন্তর্জাতিক’ তাঁর গভীরে নিশ্চয়ই গ্রথিত থাকে ‘জাতীয়’, ‘স্থানীয়’, ‘পারিবারিক’, এবং ‘ব্যক্তিগত’ বা ‘প্রাতিস্বিক’-র এক স্বতঃস্ফূর্ত ও সচেতন সংমিশ্রণ। অন্যদিকে প্রাতিস্বিককে যিনি নৈর্ব্যক্তিক বা ব্যক্তিগতকে বিশ্বজনীন করে তুলতে পারেন তিনিই আন্তর্জাতিক। এই বিশ্বাসের যদি কয়েকটি বাঙালি মূর্তি গড়ি তবে তার একটি অবশ্যই হবে সত্যজিৎ রায়ের। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতাদের অন্যতম এবং একাধারে চিত্রনাট্যকার, শিল্প নির্দেশক, গীতিকার, সঙ্গীত পরিচালক, ক্যালিগ্রাফার, ইলাস্ট্রেটর, চিত্রশিল্পী (শান্তিনিকেতনে নন্দলাল বসুর কাছে প্রায় আড়াই বছর শিখেছেন) ও পিয়ানিস্ট এই স্রষ্টার ছায়াছবিগুলি যে কারণে আমাকে তাঁর ভিতরের প্রকৃতিতে ডেকে নিয়ে গিয়ে আত্মিক সম্পর্কে সংযুক্ত করে, তা হল তাঁর স্থানীয়তা। বাঙালি জীবনকে, তা সে নাগরিক হোক কিংবা গ্রামীণ, তিনি গভীর একাত্মবোধে উপলব্ধি করেছেন এবং প্রকাশ করেছেন এক অনাবিল সারল্যে ও সহজতায়, শিল্পের কাঙ্ক্ষিত দূরত্ব বজায় রেখে। অপু ট্রিলজি, “মহানগর”, “জন অরণ্য” “অশনি সংকেত” সহ প্রায় সমস্ত ছায়াছবিতেই তা স্পষ্ট। বাংলা সাহিত্য নির্ভর বা মৌলিক, যেকোনো বিষয়কেই তিনি স্থানীয় থেকে বিশ্বজনীন করে তুলেছেন তাঁর শিল্পচেতনার গুণে, যে চেতনায় মিশে আছে প্রতীচ্যের টেকনিক এবং প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মিশ্রিত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বোধ, যার সাহায্যে নির্মিত হয়েছে আবহসংগীতের সামগ্রিকতা। মতামতের ভারে তিনি তাঁর ছবিগুলিকে ক্লান্ত করেননি, কিন্তু দৃঢ়তার সঙ্গে তাঁর সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থানকে সূচিত করেছেন, কখনো “ঘরে-বাইরে”-র সূক্ষ্মতায়, কখনো-বা গুপি-বাঘা সিরিজের সহজ গভীরতায়। অন্যদিকে অনন্য কৌতুকবোধটি তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন, যার অলোকসামান্য প্রয়োগ আমরা দেখতে পাই “পরশ পাথর” ছবিতে; যা ততটা আলোচিত না হলেও আমাদের অন্যতম প্রিয় ছবি। এখন আমরা ওই ছবিটি নিয়েই কথা বলব।
২
“হলদে সবুজ ওরাং ওটাং
ইঁট পাটকেল চিৎ পটাং
মুস্কিল আসান উড়ে মালি
ধর্মতলা কর্মখালি”–
যে গল্পে “শ্রীশ্রীশব্দকল্পদ্রুম” নাটকের এই মন্ত্রের অংশবিশেষটি ব্যবহৃত হয় সেই গল্পের নাম “দ্রিঘাংচু”, যেটি সত্যজিতের কাছে তাঁর বাবা শ্রীসুকুমার রায়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। সুকুমার সাহিত্য সমগ্রের প্রথম খণ্ডের ভূমিকায় তিনি বলছেন এটি ননসেন্স সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ এবং জিনিয়াস ছাড়া এর উদ্ভাবন সম্ভব নয়। যদিও তা Edward Lear (১৮১২ – ১৮৮৮) ও, বিশেষত, Lewis Carroll (১৮৩২ – ১৮৯৮) দ্বারা প্রভাবিত তবুও তা সুকুমারের স্বাতন্ত্র্যে অতুলনীয় এবং অননুকরণীয়। সত্যজিৎ রায় তাঁর অন্যান্য সমস্ত সহজাত প্রতিভার সঙ্গে কৌতুকের সম্পদটিও উত্তরাধিকার সূত্রেই পেয়েছেন এবং এই প্রাপ্তিযোগের গুরুত্বপূর্ণ ফসলটির নাম “পরশ পাথর”, সত্যজিতের নির্মিত তৃতীয় চলচ্চিত্র, যেখানে উপরোক্ত মন্ত্রটি একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে হাজির হয়েছে পরশ পাথর তৈরির ‘সংস্কৃত ফর্মুলা’ হিসেবে। বস্তুত “পরশ পাথর” রাজশেখর বসু ওরফে পরশুরামের ওই একই নামের একটি গল্প অবলম্বনে নির্মিত । (“মহাপুরুষ”-ও পরশুরামের “বিরিঞ্চিবাবা” অবলম্বনে তৈরি)। পরশুরাম তাঁর গল্পের গরুটিকে গাছে তুললেও সত্যজিৎ তাঁর ‘ছায়াচিত্র’র গরুটিকে বেঁধে রেখেছেন গাছের গোড়ায়। কিন্তু দু’জনেই গেরস্ত বাঙালির স্বপ্নের পক্ষীরাজটিকে আকাশ পরিক্রমা করিয়ে আবার নামিয়ে এনেছেন মাটিতে।
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মেলবন্ধন তাঁর রক্তে। প্রথম দুটি ছবি ( “পথের পাঁচালী” ও “অপরাজিত”) ইতিমধ্যেই সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে। কিশোরবেলা থেকে পাশ্চাত্য সিনেমা দেখার ও বোঝার নেশা এবং শিক্ষা, বিভূতিভূষণের গল্প, পাশ্চাত্য টেকনিক, মানবিকতার স্পর্শ এবং অবশ্যই তাঁর নিজস্ব শৈল্পিক ভাবনার মিশ্রণ এক অসামান্য রূপ নেয় প্রথম দুটি সিনেমায়। তার আগেই তিনি সান্নিধ্য ও পরামর্শ পেয়েছেন প্রিয় ফরাসি চলচ্চিত্র পরিচালক জাঁ রেনোয়ার(Jean Renoir), যিনি “The River” ছবির জন্য অভিনেতা অভিনেত্রী ও জায়গা নির্বাচনের কারণে ১৯৪৯-এ ভারতে আসেন। মুগ্ধ ও প্রভাবিত হয়েছেন ইতালীয় নিও রিয়ালিস্ট Vittorio De Sica’র “Bicycle Thieves” দেখে। “পরশ পাথর” তাঁর প্রথম বিশুদ্ধ কমেডি, সঙ্গে অন্তঃসলিলা বেদনার ফল্গু ; humour with humanity। এখানেও আছে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের নিপুণ সিন্থেসিস। আছে কলকাতার কেরানিকুল, নব্য বাবু শ্রেণী, সুকুমার ও চ্যাপলিনের আশ্চর্য সংমিশ্রণ।
“অরণ্যের দিনরাত্রি”, অপু ট্রিলজি, গুপী বাঘা সিরিজ, ফেলুদা সিরিজ প্রভৃতি অনেক চলচ্চিত্রেই সত্যজিতের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত কৌতুক বোধের স্বাক্ষর পাওয়া গেলেও, “মহাপুরুষ” ও “পরশ পাথর” হল তার চূড়ান্ত রূপ। Marie Setonকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি “পরশ পাথর” সম্পর্কে বলেছেন : ‘(It is a) sort of combination of comedy, fantasy, satire, farce and a touch of pathos’। পরশুরামের মূল গল্প সত্যজিতে একই। ‘যা হয় না’ তার ওপর নির্ভর করেই যা হ’ত বা হয় তা-ই দেখানো হয়েছে। তথাকথিত অবাস্তবের ওপর নির্ভর করে বাস্তবতাকে সামনে আনা হয়েছে এক অনাবিল হাস্যরসের মধ্যে দিয়ে, যার মধ্যে বিদ্রূপ থাকলেও কোনো অহেতুক তীব্র শ্লেষের আঘাত নেই। গল্প এবং সিনেমা দুয়েই কেন্দ্রীয় চরিত্র পরশ পাথর কুড়িয়ে পেয়ে, লোহাকে সোনায় পরিণত ক’রে, জীবনে অনেক ঘাতপ্রতিঘাত, আরাম ও ব্যারাম পেরিয়ে পুনরায় আটপৌরে জীবনটি ফিরে পান।
অবশ্যই নিজস্ব শিল্প মাধ্যমের দাবি মেনে সত্যজিৎ বেশ কিছু পরিবর্তনও ঘটান। তাঁর পরেশ চন্দ্র দত্ত উকিল নয়, অফিসের কেরানি, যিনি সবেমাত্র ছাঁটাইয়ের নোটিশ পেয়েছেন, যাঁর ভিতর দিয়ে বঙ্গের কেরানিকুল তথা সামগ্রিক চাকুরিজীবী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কাহিনিই (ছায়া)চিত্রিত হয়েছে। তাঁর ‘ম্যাজিক পাথর’টিতে তিনি সুকৌশলে তাঁর পিতৃদেবের সৃষ্ট ‘খেয়াল রস’-এর উৎকৃষ্ট নির্যাসটিকে মিশিয়ে দেন পরশ পাথর তৈরির (উপরোক্ত) ফর্মুলা হিসেবে, যে ফর্মুলাতেই হয়তো লুকোনো আছে জীবনের জটিল অংক সহজে কষে ফেলবার আশ্চর্য উপায়। জনৈক ব্যবসায়ী কৃপারাম কাচালুর বাড়িতে ‘ককটেল পার্টি’র দৃশ্যে তিনি বঙ্গের নব্য বাবুদের অনুকরণপ্রিয়তাকে কটাক্ষ করেছেন। এই দৃশ্যের শুরুতেই পরেশবাবু, আগমনে কিঞ্চিৎ দেরির জন্য, ক্ষমাপ্রার্থনা করলে কাচালুকে বলতে শোনা যায় : “better never than late”, যে ফ্রয়েডিয়ান স্লিপটি আসলে ফার্সিকাল এই দৃশ্যের একটি যথাযথ গৌরচন্দ্রিকা। এই দৃশ্যেই তিনি নিরীহ সৎ পরেশকে লোভী এবং আত্মসম্ভ্রম বিসর্জন-দেওয়া সঙে পরিণত করেছেন। সদ্য বাবু-হওয়া পরেশ অন্যের কাছে উপেক্ষিত হয়েও নিজের সংসদৃশ প্রতিবিম্বের কাছে প্রশ্রয় পান এবং শেষমেশ যৎপরোনাস্তি লাঞ্ছিত হয়ে ফিরে যান। পরেরদিন ঘোরলাগা সকাল পেরিয়ে সংবিৎ ফিরে পান।
কেউ কেউ এই দৃশ্যটির সমালোচনাও করেছেন কারণ, তাঁদের মতে, তা সিনেমার গতিকে ঈষৎ শ্লথ করে দিয়েছে। সত্যজিতের ঘনিষ্ঠ বংশী চন্দ্রগুপ্ত পর্যন্ত বলেছেন দৃশ্যটিতে সত্যজিতের নব্য বাবু সম্পর্কিত ও মদ্যপানকেন্দ্রিক কুসংস্কার (prejudice) প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু ভুললে চলবে না দৃশ্যের চরিত্রগুলি আসলে নিজের শেকড় ভুলে-যাওয়া ও অন্ধ অনুকরণপ্রিয় শ্রেণীর প্রতীক। এখানে পরেশ দত্তর জন্য আমাদের মনে কিছুটা কষ্টও অনুভূত হয়। হয় কেবল তার অন্তরে নিহিত সারল্যের এ হেন পরিণাম দেখে এবং দর্শক হয়তো নিভৃতে বুঝতে পারে কোনটা আসলে খাঁটি সোনা- যে সোনা সে পেল, না কি, যে সোনার জীবন সে হারালো।
এই দৃশ্যই শুধু নয় পুরো সিনেমাটিকেই অনুধাবন করতে গেলে বঙ্গজীবনকে জানতে হবে, চিনতে হবে। তাদের ছোটো ছোটো দোষগুণ ও হাসিকান্নার অন্দরমহলে প্রবেশ করতে হবে। নচেৎ আমাদের কুটুম দেশগুলির দর্শকগণ Eric Rhode-র সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলতে পারেন ‘mannered facetiousness’। তাঁদের বুঝতে হবে পরেশ দত্তর(তথা সমস্ত বাঙালির) লোভের(বিশেষত সোনার প্রতি)আড়ালেই লুকিয়ে আছে তাঁর সারল্য- তিনি বড়লোক হতে চান শুধুমাত্র খ্যাতির লোভে, তাঁর স্মৃতির উদ্দেশে নির্মিত একটি মূর্তির লোভে ; তাঁর উদ্দেশ্য প্রচুর দানধ্যান করা আর যুগান্তর পত্রিকায় নিজের একটি ফোটো দেখা বই কিছু নয়।এখানে লক্ষপতির স্বর্ণালংকারে ভূষিতা স্ত্রী’র মন ‘ছত্রিশ নম্বর ছাতু ময়রা লেনে’র ‘চাটুজ্যে গিন্নি, নেবু, টেবু, পলটু, হরেনের মা’দের মতো পুরোনো পড়শিদের জন্য কাঁদে এবং প্রয়োজনে তিনি “টাকার মুখে মারি ঝ্যাঁটা” বলতেও পিছপা হন না।সর্বোপরি আমাদের কুটুম দেশগুলি যদি বুঝতে পারে, যে হাজার ত্রুটি বিচ্যুতি সত্ত্বেও পরেশ দত্তের মতো বাঙালির মনই আসলে পরশ পাথর এবং তার সহজ সরল বা উদ্ভট আজগুবি যাপনের সঙ্গে একাত্ম হয়েই “পরশ পাথর” তৈরি করেছেন সত্যজিৎ, তাহলে তাঁরা বঙ্গজীবনকেও বোঝবার জন্য সচেষ্ট হবেন। তাঁরা নিশ্চয়ই বুঝবেন “হলদে সবুজ ওরাং ওটাং… “– এই উদ্ভট ‘দ্রিঘাংচু’ মন্ত্রের ভিতর লুকোনো ‘খেয়াল রস’টিই আসলে, জীবনের পাথরটিকে বঙ্গবাসীর (শুধুই কি বঙ্গবাসীর?) হাসিমুখে ঠেলতে পারার চাবিকাঠি।
৩
তুলসী চক্রবর্তী একজন অসামান্য অভিনেতা এবং পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কমেডিয়ানদের একজন। তাঁর অলোকসামান্য অভিনয়কে কেন্দ্র করেই এই চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে। তাঁর চেহারা, অঙ্গসঞ্চালন, চোখের ব্যবহার, টাইমিং, স্বর পরিবর্তন এবং হাসি, যা বাঙালির চির চেনা, এই সিনেমাটিকে সার্থকতা দিয়েছে। এবং তাঁর অভিনয়ের গুণেই “পরশ পাথর” সত্যজিতের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির অন্যতম হয়ে থাকবে। হ্যাঁ, তুলসীর চরিত্র চার্লি চ্যাপলিনকে স্মরণ করিয়ে দেয়। নিশ্চয়ই চ্যাপলিনের প্রভাব আছে, কিন্তু সে প্রভাব অনেকটা সুকুমারের ওপর Lewis Carroll -এর প্রভাবের মতোই। অনুকরণ নয়, আত্তীকরণ। তুলসীর স্বাতন্ত্র্য তাই এই চলচ্চিত্রেরও স্বাতন্ত্র্য।
শুধু তুলসীই বা কেন, জহর রায়, পরেশের পুরাতন ভৃত্য, যাকে বিভিন্ন ভূমিকায় অবতীর্ণ করে এবং শেষে টাঙ্গার পিছনে খুশির অবিচ্ছেদ্য অংশ রূপে উপস্থাপন ক’রে সত্যজিৎ, হাস্যরসের সূক্ষ্মতম ব্যবহারে, আসলে মনিব-ভৃত্যের একটি নিবিড় রসায়নকে ধরে ফেলেছেন, যে রসায়নকে চেনে না এমন বাঙালি নেই। আবার সত্যজিৎ তার ছায়াচিত্রের পাথরটিকে প্রিয়তোষ হেনরি বিশ্বাসের ‘সেমিকোলনে’ আটকে রেখে ডাক্তার ও পুলিশ অফিসারকে একটি ‘এমেজিং কেস’-এর অভিজ্ঞতা দেন। ছোটো ছোটো চরিত্রের অদ্ভুত অভিনয় আমাদেরকে নির্মল আনন্দ দেয়। কখনো আবার হাসির ফাঁকে ফাঁকে স্মৃতিচারণের বেদনাকে স্পষ্ট করে পণ্ডিত রবিশংকরের অসামান্য আবহসঙ্গীতের আয়োজন। এটা অনস্বীকার্য যে, আবহসঙ্গীতের মধ্যে দিয়ে ফুটে ওঠা হাসি-মজা-বিদ্রূপ-বেদনা সহ বিভিন্ন মুড এই চলচ্চিত্রের মূল ভাব এবং ভাবনাটির মর্যাদা রক্ষা করেছে।
৪
“পরশ পাথর” ছায়াচিত্রটি ঘরোয়া বাঙালির মননেরই ছায়া, পরেশ দত্ত’র মুখই হয়তো, (এমনকি বর্তমান অতিমারীর সময়ে ছাঁটাইয়ের মুখোমুখি-হওয়া), অধিকাংশ বাঙালির মুখ। জীবনানন্দ যখন লেখেন “বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ/ খুঁজিতে যাই না আর…”, তখন কি তার মধ্যে পৃথিবীকে দেখার অনীহা, অনাকাঙ্ক্ষা ধরা পড়ে? তা মনে হয় নয়। হয়তো ধরা পড়ে বাংলার এই শ্যামল মায়াময় প্রাকৃতিক মুখটিতে কবির গভীর পরিতৃপ্তির অনুভব, আত্মার শান্তি। প্রকৃতপক্ষে বাংলার প্রকৃতির এই মুখ পৃথিবীর প্রাকৃতিক মুখেরই এক ক্ষুদ্র রূপ। আবার এই ক্ষুদ্রের মধ্যেই আছে অসীমতার সন্ধান। রূপে আবরণে যা ভিন্ন, আলাদা; অরূপে অনুভবে তা-ই অভিন্ন, এক। সত্যজিতের “পরশ পাথর”, বোধ হয়, বাঙালির অন্তর্মুখের প্রকাশ, বাঙালির অন্তরের পরশ পাথরের রূপ, যার ভিতর নিহিত আছে বেঁচে থাকার খেয়াল রসের অরূপ। এই অরূপ আর কেবল বাঙালির বা ভারতের নয়, বরং আমাদের সমস্ত আত্মীয় দেশের, সমগ্র বিশ্বের। একটি দৃশ্যে প্রিয়তোষের কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের “সোনার তরী” কাব্যগ্রন্থের “পরশপাথর” শীর্ষক কবিতার দুটি লাইন– “সেই সমুদ্রের তীরে শীর্ণদেহে জীর্ণচীরে/ খ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফিরে পরশপাথর”– উদ্ধৃত ক’রে সত্যজিৎ বোঝাতে চেয়েছেন, যে পরশ পাথরকে খুঁজে পেয়েও সন্ন্যাসী চিনতে পারেনি, তার সন্ধান হয়তো লুকিয়ে আছে মানুষের জটিল মনেরই সহজ একটি কোণে। তখন এই পরশ পাথরের খোঁজ আর স্প্যানিশ অভিযাত্রীদের এলডোরাডোর খোঁজ মিশে একাকার হয়ে যায়। মনের মধ্যে আমরা, বিশ্বনাগরিকগণ, অনুভব করতে পারি ক্রমজায়মান conquistador-দের অভিযান। হয়তো বঙ্গের কেরানিকুলের অন্তরেও এই অভিযান ভিন্ন রূপে বর্তমান, যা পৌঁছাতে চাইছে সোনার দেশে। অন্তরের পরশ পাথরের সাহায্যেই তারা, স্বতঃস্ফূর্ত সংগ্রাম করেও, বাঁচতে চাইছে। “জীবনবিমুখ হচ্ছে না”। সত্যজিৎ এভাবেই ব্যাক্তিগত বা পারিবারিক বা স্থানীয়কে আশ্রয় করেই হয়ে উঠছেন বিশ্বজনীন। আন্তর্জাতিক।
তথ্য ঋণ :
“Satyajit Ray The Inner Eye”, Andrew Robinson, I.B.Tauris.
ভূমিকা, “সুকুমার সাহিত্য সমগ্র” প্রথম খণ্ড, আনন্দ পাবলিশার্স।
“দ্রিঘাংচু”, “সুকুমার সাহিত্য সমগ্র” প্রথম খণ্ড, আনন্দ পাবলিশার্স।
“শ্রীশ্রীশব্দকল্পদ্রুম”, “সুকুমার সাহিত্য সমগ্র” তৃতীয় খণ্ড, আনন্দ পাবলিশার্স।
“সাক্ষাৎকার সমগ্র”, সম্পাদনা : সন্দীপ রায় ও সোমনাথ রায়, পত্রভারতী।
বিশেষ কৃতজ্ঞতা : বন্ধু, কৌশিক মণ্ডল (শিক্ষক ; ঋতুপর্ণ ঘোষ বিষয়ে বিশ্বভারতী থেকে PhD)।
সত্যজিৎ রায়ের সমস্ত সৃষ্টি ই চির প্রাসঙ্গিক, চিরন্তন বাঙালি মননকেই প্রকাশ করে। এই লেখা “পরশপাথর”
সিনেমা র সেই চিরন্তন বাঙালী র স্বরূপটাই সযত্নে প্রকাশ করেছে।
Thank you 😊
খুব সুন্দর লেখা।।পরিশ্রম ক’রে লেখা।
এক লেখায় অনেকটা সত্যিজিৎ জানা হয়ে গেলো।।
খুব উৎসাহ পেলাম 😊
ভালো লাগলো। তথ্যনিষ্ঠ আলোচনা।
ধন্যবাদ, শুভম 😊
Osadharon.. Tui bangla sahityo r amader k eivabei somridho kor. Onek ovinondon
thank you re 😊
ভীষন ভালো লেখা… পড়ে অনেক কিছু জানতে পারলাম…
Thank you 🌼
দারুণ
সত্যিই স্যার এটা লিখতে গিয়ে যে পরিশ্রম করতে হয়েছে আপনাকে, তাকে আমি কুর্নিশ জানাই। বাঙালির অন্যতম Nostalgia সত্যজিৎ রায় সম্বন্ধে এই লেখাটি পড়ে আমি অনেক কিছু অজানা তথ্য কে জানতে পারলাম। এই তথ্য আমাকে অত্যন্ত সমৃদ্ধ করলো। সাহিত্য বিষয়ে আগ্রহ সৃষ্টির ক্ষেত্রে আপনি সত্যিই অদ্বিতীয়। অনেক অনেক ধন্যবাদ স্যার…..। আমার প্রণাম নেবেন। ভালো থাকবেন 🙏🏻🙏🏻🌼
ভালো থেকো 🌼
সত্যিই স্যার এটা লিখতে গিয়ে যে পরিশ্রম করতে হয়েছে আপনাকে, তাকে আমি কুর্নিশ জানাই। বাঙালির অন্যতম Nostalgia সত্যজিৎ রায় সম্বন্ধে এই লেখাটি পড়ে আমি অনেক কিছু অজানা তথ্য কে জানতে পারলাম। অনেক অনেক ধন্যবাদ স্যার…..। আমার প্রণাম নেবেন। ভালো থাকবেন 🙏🏻🙏🏻🌼
অসাধারণ লেখা হয়েছে স্যার। প্রত্যেক বারের মতোই। এত পড়াশুনা তো আমারও করতে লোভ হয়। খুব সুন্দর স্যার।
Thank you 😊🌻
অসাধারণ লেখা হয়েছে স্যার। প্রত্যেক বারের মতোই।এত পড়াশুনা তো আমারও করতে লোভ হয়। খুব সুন্দর স্যার।
বেশ ভালো লাগলো স্যার..
Thank you 😊🌻
চমৎকার তথ্যনিষ্ঠ লেখা। প্রিয় এবং একাধিকবার দেখা ছায়াছবিটি নিয়ে এভাবে ভাবা যেতে পারে জেনে চমৎকৃত হলাম।
ধন্যবাদ অমর্ত্য। জেনে আনন্দ পেলাম গো।