নিকারাগুয়ার কাব্য
পর্ব-৪
অনুবাদ ও ভূমিকা- শ্যামশ্রী রায় কর্মকার
জায়কান্দো বেলি (প্রথম পর্ব)
রুবেন দারিও এবং আর্নেস্তো কার্ডেনালের মধ্যবর্তী সময়ে বিপুল সংখ্যক কবি লেখালেখি করেছেন। তাঁদের কেউ কেউ নিজদেশে বরেণ্য ও সমাদৃত। কেউ কেউ আন্তর্জাতিক পরিচিতি লাভ করেছেন।প্রথমদিকের কবিদের মধ্যে ভ্যানগার্ড আন্দোলনের কবি হোজে কোরোনল উর্তো সর্বাপেক্ষা সুপরিচিত। ঠিক তারপরেই চল্লিশের দশকে আর্নেস্তো কার্ডেনালের উদ্ভব। সোমোজা স্বৈরতন্ত্র এবং তৎপরবর্তী বিপ্লবের সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগাযোগের কথা আমরা আগেই জেনেছি। পঞ্চাশ, ষাট এবং সত্তরের দশকের যেসব কবি বয়স, লিঙ্গ, শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং রাজনৈতিক মতাদর্শগত গণ্ডির পরোয়া না করে সোমোশিজমো তথা সোমোজা তন্ত্রের নৈঃশব্দে ফাটল ধরাতে ছদ্মনামে লিখে চললেন, তাঁদের সংখ্যা অগুনতি। কেউ কেউ অবশ্য সেই লিগাসি বেশিদিন ধরে রাখতে পারেননি, বা বলা ভালো চাননি। যেমন আর্নেস্তো কার্ডেনালের কথায় “রোবার্তো কুয়াদ্রা তাঁর নিজের প্রজন্মের সবচাইতে সাহসী এবং প্রতিভাবান কবি। কিন্তু নিজের স্বাধীনতার পাশাপাশি নিজের কবিতাকেও বিসর্জন দিয়েছে বলে বোধ হচ্ছে”। সোলেন্টিনেম নামে একটি দ্বীপে ধীবর-কৃষক-কবি-যোদ্ধাদের সম্মিলিত উদ্যোগ পাঁচ থেকে সাত বছরের শিশুদেরও কবিতায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। সোমোজা সরকারের পতনের পর সেই কৃষক বিদ্যালয় কবিতার কর্মশালায় রূপান্তরিত হয়, যা পরবর্তীকালে নিকারাগুয়ার পাড়ায় পাড়ায়, শহরে শহরে এমনকি পুলিশথানাগুলিতেও ছড়িয়ে পড়ে। সেই সব সাহসী এবং জীবন্ত শব্দের অরণ্যে ১৯৭০ একটি দিকচিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যারা যারা বীজ ছিল, উপ্ত হল। পরবর্তীতে যারা এল, তারা সেই বীজদলের ছায়াবৃক্ষ হয়ে বেড়ে উঠল। বিশ বছর বয়সী তরুণ কবি লিওনেল রুগ্যামাকে মানাগুয়ার একটি বাড়িতে গুলি করে হত্যা করা হল। ‘পৃথিবী চাঁদের উপগ্রহ’ কাব্যগ্রন্থের কবি রুগ্যামা গুলিবিদ্ধ অবস্থায় জাতীয় প্রহরীর বিরুদ্ধে চিৎকার করে বললেন, “তোর মা গিয়ে বশ্যতা স্বীকার করুক”। ঠিক যেমনটি সর্বকালেই সর্ব দেশে প্রতিবাদী এবং নিন্দার্হ শপথ হিসেবে প্রযোজ্য হয়ে এসেছে।
এই ঘটনার ঠিক দু-তিন সপ্তাহ পরে সাহিত্যের আঙিনায় প্রবল বিক্রমে আছড়ে পড়ল জায়কান্দো বেলির কবিতা ‘এবং ঈশ্বর আমাকে নারী হিসেবে সৃষ্টি করলেন ‘। আশ্চর্য সমাপতনের মতো ১৯৭৪ সালের জায়কান্দো বেলির ‘সোব্রে লা গ্রামা’ বা ‘ঘাসের ওপরে’ কাব্যগ্রন্থটির প্রকাশকালে কবি হোজে করোনল উর্তো বললেন, “বিদ্রোহ এবং উদ্ভেদ হাত ধরাধরি করে চলে”। বিশেষণহীন এই প্রতিভাস ধর্মীয় না হয়েও স্বর্গীয়। আবরণ ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা আদি মানবীর মতো আকস্মিক এই পবিত্র নগ্নতা। কী এমন বললেন জায়কান্দো বেলি? বললেন,
“আমি তোমার হরিণী, যে বশ্যতা স্বীকার করে না
আমি সেই নারী, যে ভালোবাসে”
‘ যারা গর্ভে স্বপ্ন ধারণ করে’ কবিতায় বেলি বললেন- নারীর আদি স্বপ্ন পাশে থাকা, সঙ্গী হয়ে ওঠা, শ্রদ্ধাস্নেহ ও কোমলতার শিকড় হয়ে ওঠা। সেই স্বপ্নের পৃথিবী ভাই ও বোনের, নারী ও পুরুষের, যারা পরস্পরের প্রকৃত বন্ধু, যারা পরস্পরকে পড়তে শেখায়, প্রিয়জনের মৃত্যুতে পরস্পরের স্বান্তনা হয়ে ওঠে, পরস্পরের সুখের রাজ্যে অতন্দ্র প্রহরী হয়ে থাকে।
এবং ঈশ্বর আমাকে নারী হিসেবে সৃষ্টি করলেন
জায়কান্দো বেলি
এবং ঈশ্বর আমাকে নারী হিসেবে সৃষ্টি করলেন
লম্বা চুল দিয়ে
চোখ
এবং নারীর মুখ
বক্ররেখা দিয়ে
ভাঁজ
নরম গহ্বর
এবং খনন করে প্রবেশ করলেন
মানুষ গড়ার কর্মশালা হিসেবে
গড়ে তুললেন আমাকে
কোমল হাতে জুড়লেন আমার স্নায়ু
সযত্ন পরিমাপে দিলেন হরমোন
রক্ত প্রস্তুত করে
সন্তর্পণে দিলেন আমাকে
যাতে তা ছড়িয়ে যায়
সেচ ব্যবস্থার মতো
আমার শরীরে
জন্ম নিল ভাবনা
স্বপ্নেরা
প্রবৃত্তি। অতি যত্নে
মানুষের শ্বাসের হাতুড়ি দিয়ে
ভালোবাসার খনন যন্ত্রে
আরও হাজার একটা যন্ত্রে
গড়লেন, যা আমাকে
প্রতিদিন নারী করে তোলে
আমার গর্ব হয় প্রতিদিন ঘুম ভেঙে গেলে
প্রতিটি সকালে আমি নিজের জাতির
মহিমাকীর্তন করি
জায়কান্দো বেলির জন্ম ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর নিকারাগুয়ার মানাগুয়ায়। ফিলাডেলফিয়া থেকে বিজ্ঞাপন এবং সাংবাদিকতা নিয়ে শিক্ষাজীবন শেষ করার পর পেপসি-কোলা প্রতিষ্ঠানে অ্যাকাউন্ট এক্সিকিউটিভ হিসাবে যোগদান করেছিলেন বেলি। ১৯৭০ নাগাদ সোমোজা স্বৈরতন্ত্রবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭৫ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন।’লা মুঘের অ্যাবিতাবা’ বা ‘অধিষ্ঠাত্রী নারী’ নামক একটি অর্ধ আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস লেখেন ১৯৮৮ সালে। সেই প্রথম নিকারাগুয়ার ইতিহাসে এমন বৈপ্লবিক ভাষায় লিঙ্গ বৈষম্যের ওপর কোনও উপন্যাস লেখা হল। আলোচক এবং পাঠকদের সম্পূর্ণ মনোযোগ কেড়ে নিলেন বেলি। নানা ভাষায় অনূদিত এই উপন্যাসটি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে অন্তত চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত হল। দুটি সমান্তরাল গল্পরেখায় গড়া এই উপন্যাসটি আধুনিক ইনসার্জেন্সি নিয়ে কথা বলে, বিপ্লব নিয়ে মেয়েদের আবেগ এবং নিষ্ঠার কথা বলে। ২০০০ সালে বেলি তাঁর আত্মজীবনী প্রকাশ করলেন, যাতে তাঁর বিপ্লব জীবনের কথা আরও সবিস্তারে ধরা আছে। ‘ত্বকের নিচে যে দেশ’ নামের সেই উপন্যাস ২০০৩ সালে লস এঞ্জেলস টাইমস বুক প্রাইজের চূড়ান্ত তালিকাভুক্ত হয়। উপন্যাসের বিরাট সাফল্য সত্ত্বেও মনে মনে বেলি বরাবর কবিতার দিকেই ঝুঁকেছিলেন। ২০০৮ সালে নন্দনকাননবাসী আদম এবং ইভকে নিয়ে লেখা রূপক উপন্যাস ‘করতলে অসীম’ এর জন্য ‘প্রেমিও বিবলিওতেকা ব্রেভে’ (Premio Biblioteca Breve) পুরস্কার লাভ করলেন বেলি। ২০১০ সালে প্রকাশিত হল তাঁর ‘এল পাইজদ লাজ মুঘেরেস’ বা ‘মেয়েদের দেশ’। এই উপন্যাস এমন এক বিশ্বের কথা বলে, যা নারী পরিচালিত। এই উপন্যাসে নারীদল যে পার্টির মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে তার নাম ‘পার্তিয়েদো দে লা ইজকিয়ার্দা ইরোতিকা’ বা ‘যৌন বাম বাহিনী’। আশির দশকের ঠিক এই নামেই একটি নারী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। বেলি ছিলেন সেই আন্দোলনের অংশ। ১৯৭০ সাল থেকে বেলি এবং তাঁর সমসাময়িক বুদ্ধিজীবির দল কবিতা লেখার পাশাপাশি গোপনে স্যান্দিনিস্তা জাতীয় মুক্তি মোর্চার সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন, সোমোজা সরকারের পতনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছেন, গোপনে অস্ত্রপাচার করেছেন, ইউরোপ এবং লাতিন আমেরিকায় ঘুরে ঘুরে সম্পদ সংগ্রহ করেছেন। ২০১৮ সালে বেলি তৎকালীন শাসক ড্যানিয়েল ওর্তেগার বিরোধিতা করে সান্দিনিস্তা পুনরভ্যুত্থান আন্দোলনে যোগ দিলেন।
(অনুবাদ- লেখক)
(ক্রমশ)