নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা প্রসঙ্গে
শুভম চক্রবর্তী
জনপ্রিয় ব্যাপারের প্রতি আমার অনীহা আছে। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখেছি জনপ্রিয় মানেই জনমনোরঞ্জক, গোদা, বোদা, অন্তসারশূন্য, অসার আয়োজন। এবার এই অতি সাধারণীকৃত ধারণার কিছু ভ্রান্তিও নিশ্চিতভাবেই আছে। তবে আলোচনার সুবিধার্থে পরিসরটিকে কিঞ্চিৎ ছোটো করে বলি যে সাম্প্রতিক বাংলা কথাসাহিত্যে যা জনপ্রিয় তার অধিকাংশই হয় নজরুল এখানে ঢোল বাজাননি গোছের হযবরল অথবা ভূত-প্রেত-দৈত্য-দানব নিয়ে একধরণের নিরলস গদ্যময় ছ্যাবলামি বিশেষ অথবা এলিটের বাচ্চাদের আমেরিকা ফেরত প্রেম প্রেম ভাবালুতার জোলাপ, এইসব লেখকদের না আছে গদ্যভাষা, না আছে অন্তর্লীন কোনো ভাবুক প্রত্যয়। তবে সম্প্রতি(কিঞ্চিৎ কয়েকবছর আগে ‘মধ্যবর্তী’তে পড়েছিলাম) ‘নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা’ পড়ে জনপ্রিয় মাত্রই অন্তসারশূন্য এই অতি সাধারণীকৃত ধারণার গরিমা ধূলিসাৎ হলো।হয়তো এমন করে সব গরিমাকেই ‘কালাকালের কর্তা’ এসে ধূলিসাৎ করে দেবেন।
উপন্যাসটির উপজীব্য বৌদ্ধ শ্রমণ, দার্শনিক, লেখক অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের জীবন। তবে সরলরৈখিক কোনো জীবনের সালতামামি নয়, বরং অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের যে বিমিশ্র স্বরূপ যা আমাদের বোধে, বোধাতীতে থেকে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া টুকরো টুকরো চিন্তাস্বেদবিন্দু, তাই এই উপন্যাসের ঘট ও পট। আখ্যানতাত্ত্বিক পরিভাষায় এই উপন্যাসটির কথক শাওন ‘সর্বজ্ঞ কথক’ হয়েও ‘সর্বজ্ঞ কথক’ নয়, কারণ Stanzel-এর মতে ‘সর্বজ্ঞ কথক’ কাহিনিকে বাইরের থেকে নিরীক্ষণ করে বলেই বহিঃপ্রেক্ষিতের জন্ম হয়(দাস, আখ্যানতত্ত্ব)।কিন্তু এই উপন্যাসে কথক সম্পূর্ণভাবে বাইরের নিরীক্ষক নন, কাহিনির ভেতরে থেকেই তিনি কাহিনিকে বাইরে থেকে দেখছেন, দেখায় ও ভাবায় উপচে যাচ্ছে বাঁধাগতের পরিসর। এইসূত্রে মনে আসে মিখাইল বাখতিনের ‘Chronotope’-এর ধারণাটি। যেখানে পরিসর ও সময়ের দ্বান্দ্বিক সন্দর্ভ রচিত হয়। অমিতায়ুধ তাঁর ঘটমান বর্তমান নিয়ে সেঁধিয়ে যায় যুগপৎ অমিতায়ুধের অতীত ও চাগ লোচাবার ঘটমান বর্তমানে। উপন্যাস এভাবেই বিচিত্র সময় ও পরিসরগত মাত্রাকে ধারণ করে থাকে। চরিত্ররা ‘Heteroglossia’ বা ‘ভিন্ন ভাষিকতা’ দিয়ে বুঝে নেয়, বুঝিয়ে দেয় স্বরূপ। যেমন উপন্যাসটির কথক শাওন আগাগোড়াই জানেন যে আসলে চাগ লোচাবা, অমিতায়ুধ বাস্তবে Exist করেননা। আর উপন্যাসটির পাঠক তা জানতে পারবেন একেবারে শেষের দিকে ‘উত্তরপীঠিকা’র আগের পাতায়। এই যে জানার সময়ভেদে অস্তিত্ব ও অনস্তিত্বের ভিন্ন মাত্রা, যা উপন্যাসটিকে বহুমাত্রিক কাঠামো দিয়েছে। এবং অস্তিত্বের যে অহংবোধ তাকে তাত্ত্বিকভাবেও মোকাবিলা করা গেছে। যেমন স্বয়ংবিদার প্রগাঢ় চুম্বনে চাগ লোচাবা সীমিত অস্তিত্বের পরপারে ভিন্ন অনেক অস্তিত্বের মাত্রায় নিজেকেই জেনেবুঝে নিয়েছেন। দেবেশ রায় একবার লিখেছিলেন– “উপন্যাস শেষ হয়, কিন্তু সম্পূর্ণ হয় না।” এই অসম্পূর্ণতার পরিসরটি উপন্যাসের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, তা যেন গ্রন্থ শেষের সাদা অংশটি যা পাঠকের কল্পনায় আখ্যানটিকে অনিঃশেষ করে তোলে। তাই লেখক যখন জানান যে চাগ ও অমিতায়ুধ আসলে নেই তখন তা দার্শনিক মর্যাদা পায় হয়তো কিন্তু গ্রন্থ শেষের সাদা অংশটির অনিঃশেষ সম্ভাবনা ব্যহত হয়।
‘নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা’ উপন্যাসটিতে যেমন আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক বিবিধ প্রতর্ককে আমরা সরাসরি প্রত্যক্ষ করি, তেমনই আখ্যানের অন্দরেও এই উপন্যাসের লেখক সেঁধিয়ে রাখেন দার্শনিক ভাবনার Hidden reference. যেমন তিরস্কৃত ও অপমানিত ‘পর’ দৌবারিকের বেদনাকে ‘আত্ম’র বেদনা ভেবে নেওয়ার প্রতীতি আমাদের মনে পড়ায় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও মহাযান বৌদ্ধ তান্ত্রিক শান্তিদেব-এর ‘পরাত্মপরিবর্তন’ তত্ত্বটির কথা। এই তত্ত্বটি তাঁর ‘বোধিচর্যাবতার’ গ্রন্থে বিধৃত হয়েছে। এই তত্ত্বের প্রতিফলনে চন্দ্রগর্ভ যেমন কুন্তলার পিতার বেদনাকে নিজের বেদনা হিসেবে অঙ্গীকার করে মানবিক প্রত্যয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন তেমনই নিজের বেদনার অপরীকরণ ঘটিয়েছেন। এই বিন্দুতে এসে Heteroglossia এর অপরতাবোধ ও পরাত্মপরিবর্তনের অপরতাবোধ মিলেমিশে যায়, যদিও প্রথমটির তাৎপর্য ‘সাহিত্যিক’ আর শেষেরটির তাৎপর্য ‘দার্শনিক’ তবে উপন্যাস তার বয়ানের গুণে এই সীমা যা মিশেল ফুকো কথিত ‘Limit attitude’, তাকে ছাপিয়ে যায়। করুণা ও শূন্যতার সমুদ্রে ঝাপ দেবার আগে জ্বরা ও বেদনাবিধুর মানুষের কোলাহলে ফেরত আসা ভগবান অবলোকিতেশ্বরের মতোই অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানও ব্যক্তিগত নির্বাণের পূর্বে অন্যের নির্বাণের মহতি ‘মহা’যান প্রচেষ্টায় অনিঃশেষ ছিলেন যা আমাদের ‘নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা’ মনে পড়িয়ে দেয়।
সন্মাত্রানন্দকে কৃতজ্ঞতা জানাই এই কারণে যে বাঙালি মানেই শুধু কলোনিয়াল পিরিয়ডের হাতে গোনা কয়েকটি নামই শুধু নয়। বাঙালি মানে অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান, বাঙালি মানে মধুসূদন সরস্বতীও এই ধ্রুবসত্যটিকে আরেকবার মনে পড়িয়ে দেওয়ার জন্য। এই উপন্যাসটি পাঠ করা আমার কাছে অন্যতম শ্রেষ্ঠ পাঠঅভিজ্ঞতা। এই উপন্যাসটি পড়ে মনে হলো আছে আছে, বাংলাভাষায় এখনও সেই শ্রম ও দরদ আছে, শ্রমণের কাছে যা শূন্য, পাঠকের কাছে তাই পূর্ণ।
এরকম গবেষণানিষ্ঠ আলোচনা উপন্যাসটির প্রাণিত করল। ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা জানাই শুভম চক্রবর্তী ও আবহমান ওয়েবজিনকে এই মেধাবী আলোচনাটির জন্য। এসব বৃষ্টির সকালে অনেক কথা মনে উঠে আসে।