ধারাবাহিক উপন্যাস
স্রোত
প্রথম পর্ব
যশোধরা রায়চৌধুরী
কয়েক বছর আগে আরম্ভ পত্রিকায় কিস্তিতে কিস্তিতে প্রকাশিত হয়েছিল যশোধরা রায়চৌধুরীর অন্য নামে একটি উপন্যাস, যার উপজীব্য হল, সমসাময়িক কালখন্ড আর কিছু তরুণ তরুণীর লড়াই । গ্রন্থাকারে 'স্রোত' নাম দিয়ে একটি অতি সীমিত প্রকাশনা প্রচেষ্টাও হয়েছিল। তবে প্রকাশক সব কপিশুদ্ধু গায়েব হয়ে যাওয়াতে, স্রোতকে পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত আকারে এবার আবহমানের পাঠকদের কাছে ধারাবাহিকভাবে হাজির করার প্রচেষ্টা । "সম্পূর্ণ ভাবে নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা এমন উপন্যাস আমি আগে পড়িনি। নারীবাদী লেখকের লেখা উপন্যাস পড়েছি। কিন্তু তাতে পুরুষের লোলুপতা কে কাঠগড়ায় দাঁড়করানো আর নারীকে শিকার প্রতিপন্ন করার চেষ্টায় প্রায়শই অবজেকট্ভিটি থাকেনি। এই উপন্যাসের শিকড় গেছে নারী জীবন যাপনের নানা স্তরে । এর মধ্যে আছে যে ভাষায় পুরুষতন্ত্র জীবনের ন্যারেটিভ এমনকি সাহিত্য ও রচনা করে , তার ইন্টারপ্রিটেশন। এতে স্পষ্ট কথা আছে, অভিমান আছে, হাস্যরস এবং অসহায়তাও আছে । এবং সর্বোপরি পুরুষকে নিজের জীবনে জড়িয়ে নেওয়ার আকাঙ্খা।..এখনকার ছেলে মেয়ে দের হাতে ই তুলে দেওয়া কাহিনীর ব্যাটন, এদের স্পস্ট করে দেখা, বলতে পারা ও অতীতের বোঝা নামিয়ে রেখে পথ চলার সাহস কে কুর্ণিশ জানিয়েছেন যশোধরা। মুক্তি এরাই আনবে। যৌনতার রহস্যময়তার আবরণ উন্মোচন করে তথ্যের নিরপেক্ষতার মধ্যে উত্তরণ।যশোধরার Clarity of perspective অতি তীক্ষ্ণ। সবমিলিয়ে উপন্যাস টি মনোভংগি ভাষা ও কাহিনী সর্ব অর্থে আধুনিক। একে বারে রিয়েল টাইমে দাঁড়িয়ে লেখা। দেশ কাল সময় ও ব্যক্তি সত্ত্বার বিশাল ব্যাপ্তিকে বিন্দুতে এনে কিভাবে প্রতিবাদের ভাষা নির্মান করেছেন যশোধরা। নির্য্যাস হয়ে মনে রয়ে যায়, পুরুষকে বিযুক্ত করার অভিপ্রায় নয়, তার সংগে আবার প্রথম থেকে পড়া জীবনের পাঠ।" ( অনিতা অগ্নিহোত্রী) "লেখক যশোধরা রায়চৌধুরী, তাঁর চাকুরি প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরের, তাঁর গল্পের ভুবন প্রচলিত ভাবনাচিন্তার একেবারেই বাইরে। তিনি তাঁর লেখায় অণুবীক্ষণ দিয়ে মানুষের জীবনযাপনকে দেখতে চান, তাঁর গল্পে সেন্টিমেন্ট কম, বাস্তবতা বেশি। যেমন তাঁর গল্পে এক চাকুরে তরুণী মেল ট্রেনের নাইটজার্নি করে উপরের সিটের কাউকে অনুরোধ করে বার্থ বদলাবদলি করে পট করে উঠে যায় ও ঘুমিয়ে পড়ে। ...তাঁর শেষ উপন্যাস স্রোত -এ নারীস্বাধীনতার চূড়ান্ত ছবি। প্রতিটি নারীচরিত্র স্রোতের বাইরে গিয়ে কথা বলে। পুরনো ধ্যানধারণা ভেঙেচুরে ফেলতে চায়। সাম্প্রতিক কালে কলকাতার কোনও এক বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েরা প্রতিবাদ করেছিল তাদের অন্তর্বাসের ওপর প্রতিবাদের কথাগুলো লিখে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে একের পর এক টাঙিয়ে দিয়ে। স্রোত এমন আধুনিক সব বিষয়ে আলোকপাত করেছে যা কিছুকাল আগেও কল্পনা করা যেত না। এ যুগের নারীসত্তার এক অনন্য প্রতিফলন। " ( তপন বন্দ্যোপাধ্যায়-এর "ইদানীঙ কার বাংলা গল্প উপন্যাসে লেখিকাদের নারীসত্তার উপস্থিতি" প্রবন্ধ থেকে, প্রকাশিত আরাত্রিক পত্রিকা ২০২১)
অজ্ঞানতিমির
কাঁধের ব্যাগ বুকের কাছে টেনে এনে, দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করেছিল
অলক্তিকা। বাস থেকে নেমে এটুকু ত হাঁটাপথ। নির্বিঘ্নে পেরিয়ে যেতে পারলে
বাঁচা যায়। বাস স্টপের কাছে চায়ের দোকান পানের দোকান গ্যাঞ্জাম ভিড়
জ্বলানেভা চাইনিজ এল ই ডি আলো…চেঁচিয়ে ওঠা হুল্লোড়ে মাতাল বা চ্যাঁ করে
ওঠা নতুন হর্নের টোটো… লটারির দোকানে গান… টুম্পাসোনা…তারপরই
নির্জন শান্ত গলি… বড় রাস্তা থেকে নেমে, বেঁকে যাওয়া নিরিবিলিতে।
অলক্তিকার পরনে খাটো প্যান্টস, যেটাকে বলে হটপ্যান্টস। প্রায় শর্টসের মত
ছোট সবুজ খাকি প্যান্টসের তলে ওর স্পোর্টস করা দুটো পেশল অনাবৃত উরু
অনেকটা একটা কিশোরের কথা মনে করায়। অবশ্য রোমহীন। কারণ নিয়মিত রোম তোলার
সরঞ্জাম ব্যবহার করে ও। ছোট প্রিন্টের লাল কালো ডট দেওয়া ঈষৎ ঝলঝলে
টিশার্ট পরে আছে ও।
গলিতে ঢোকার আগেই ও একবার ব্যাগ থেকে ফোন বার করে টাইমটা দেখে নেয়। ঘড়ি ও
কোনকালেই পরেনা। ফোন থেকেই সময় দেখে। একটা মেসেজ চেকও করে নেয় তাড়াতাড়ি।
কাল একটা মিটিং আছে ওদের। হোয়াটস্যাপে তাই নিয়েই চলছে।
গলিতে ঢুকেই চোখে ধাক্কা দেয় অন্ধকার। আজ আবার কোন আলোটা ফুটে গেল! এই
আলোগুলো এক একদিন জ্বলে এক একদিন জ্বলে না। নির্জন রাস্তা, একদুটো
বাঁদিক ডানদিকে বাঁক নিয়ে নিয়ে এগিয়েছে, সারি সারি বাড়ির সবার দরজা
জানালা বন্ধ। এই রাস্তায় বড় গাড়ি ঢোকে না বিশেষ। এখন নটা চল্লিশ। আরো
শুনশান। বাইক বা স্কুটারও যাচ্ছে না। লোক না থাকাটা বিপদের নয়, লোকজনই
বিপদের, অলক্তিকা জানে। তবু, কিন্তু নির্জনতা তো নির্জনতাই হয়, না?
ইউনিভার্সিটিতে যাবার বছর থেকে একটু বেশি যেন রাস্তাঘাটের ভয়। স্কুল থেকে
অবশ্য বিকেলেই আসত, অন্ধকার নামার আগেই। তবু বাস থেকে নেমে এই পথ দিয়েই
আসত, বছর কয়েক আগেও। মাথা না ঘামিয়ে বড় বড় পায়ে ফিরে আসত ।
এই তিন চার বছরে সব পালটে গেল নাকি? অবশ্য মায়ের বক্তব্য, মায়েদের
ছোটবেলায় কলকাতা ছিল এক স্বর্গ, মেয়েদের রাস্তাঘাটে হাঁটার জন্য। এখন ভয়
আর ভয়। বাস থেকে নেমেই খানিক দূর অব্দি দোকানগুলো আছে বলে ওখানটা জমজমাট।
গলিতে ঢুকলেই কেউ কারো নয়। বড় জোর একজন দুজন পেরিয়ে যাচ্ছে ওকে।
ও কোনদিন ভয় পেতই না। অলক্তিকা জানত, ভয় একটা মেন্টাল ব্যাপার। ভয়কে জল
মাটি দিয়ে যারা পেলেপুষে বড় করে, তাদের একদল হল মাতৃস্থানীয় মহিলারা,
অন্যদল, মিডিয়া। সদ্য সদ্য ঘটে যাওয়া কয়েকটা ধর্ষণের ঘটনায়, চারিদিকে
তোলপাড় হয়েছে। সম্প্রতি এক মেমসাহেবকে তাদের পাড়ার থেকে দু পা দূরে,
যোধপুর পার্কে রাত দশটায় আক্রমণ করা হয়েছে, বাইক আরোহী একদল যুবক এই
কান্ডটি ঘটায়। ফ্রান্সের মহিলাটি কোনমতে পালিয়ে একটা বাড়ির গেটের ভেতর
ঢুকে লুকিয়ে বাঁচেন । টানা দুদিন টিভিতে দেখাচ্ছিল ফল আপ নিউজটা…
এই সব মিলিয়ে কেমন একটা তলপেটে খিঁচ ধরা অনুভূতি, যখনই এইরকম শুনশান
রাস্তায় ও। বা ওর মত আরো কেউ কেউ। জীবনে একবার দুবার কোন অসভ্যতার শিকার
হয়নি এমন তো কোন মেয়ে নেই। সেটা আলাদা। সেবার সল্ট লেকে রিনির বাড়ির থেকে
বেরিয়ে নির্জন রাস্তায় একটা এমন ঘটনা ঘটেছিল। পাশ দিয়ে যেতে যেতে বাইক
থেকে হাত বাড়িয়ে ওকে ছুঁয়ে গেছিল দুটো লোভী হাত। ছ্যাঁক করে উঠেছিল গা।
খুব বিশ্রি একটা শিরশিরে অসহ্য লাগা নেমে গেছিল গা দিয়ে।
তবে এখন অনেকটাই গা সওয়া। বিশেষত বাজারের ভেতর দিয়ে হেঁটে আসার সময় সার
সার চোখ। রাস্তার ছেলেদের। “রাস্তার ছেলে” এই শব্দবন্ধ আবিষ্কার করেছিল
কোন উচ্চবর্গীয় ভদ্দরলোক কে জানে। বাবা বা মায়ের ক্লাসের লোকেরা, যতই
কম্যুনিজম কপচাক , অন্যমনস্কভাবে ওই শব্দ ব্যবহার করেই ফেলে। সেখানে
থেকেই অলক্তিকার মাথাতেও ঢুকেছে। আসলে বাজারে, দোকানে, সাইকেল চালিয়ে,
রিকশা চালিয়ে, যেসব হাড় বের করা, ডিগডিগে চেহারার পুরুষেরা ওর দিকে
জ্বলন্ত চোখে তাকায়, তাদের সবাইকে লেচার ভাবার, রেপিস্ট ভাবার কোন হক নেই
ওর। তবু এভাবেই ভাবতে শেখায় সমাজ। দিল্লির বাসের ঘটনাটার পর সমস্ত বাসের
সব ড্রাইভার হেল্পাররা একা মেয়েদের কাছে সম্ভাব্য ভয়াবহ আক্রমণকারীর
বেশি কিছু নয়।
আজো, ওর হটপ্যান্টস পরা পায়ের দুমদাড়াক্কা হেঁটে যাওয়া একটু আগেই রকে বসা
দুটো ছেলের উঃ আঃ আওয়াজের সঙ্গে কোইনসাইড করে গেছে।
হঠাৎ সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে ওঠে অলক্তিকার। এই নির্জন গলিতেই, ওর ঠিক
কয়েক কদম পেছনে, একটা কেউ হেঁটে আসছে না? কনটিন্যুয়াসলি, একই পেসে
হাঁটছে। বোঝাই যাচ্ছে ওকে ফলো করছে।
ভয়গুলো সত্যি হয়ে যাবে আজ। কোন বদমাশ লোক ইচ্ছে করে ওকে বিরক্ত করবে বলে
ওর পেছনে পেছনে আসছে। ওর গতির তালে তাল রেখে। ভেতরটা কাঁটা কাঁটা হয়ে
উঠতেই সেটাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করার একটা তীব্র রাগ ওর ভেতর দিয়ে খেলে
যায়।
অলক্তিকা বাঁই করে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে লোকটার দিকে ভীষণ আচমকা
এগিয়ে যায়। ওর মুখের ডগায়, এ্যাই বাঞ্চোত! টাইপের একটা গালাগাল এলেও
সেটাকে ও খসতে দেয়না। যদি সত্যি খুব ভয়ংকর কোন খারাপ লোক হয় ! অতটা খাপ
খোলা ঠিক হবে না বোধ হয়।
লোকটা, থুড়ি, ছেলেটা , সত্যি ওর ওই হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ানোয় হকচকিয়ে যায়, থমকে
দাঁড়ায়। আধো অন্ধকারে ও ছেলেটার মুখ দেখতে পায়না।
একবার ওইভাবে র্যালা নিয়ে ঘুরে দাঁড়াবার পর আর থেমে থাকা যায়না, ও সটান
এগিয়ে যেতে থাকে। দু পা এগোতেই , ওর মাথায় ধাক্কা দেয় একটা তথ্য। এটা আর
কেউ নয়। ওর হাড়বজ্জাত বি এফ। টুবান। একটু আগেই এস এম এস করেছে, আজ আসতে
পারছি না। মাথা ধরেছে। শুয়ে আছি।
টুবান! পাজি , ছুঁচো, আজ এক থাপ্পড়ে তোর থোবড়টা যদি না পাল্টেছি!
প্রায় সিংহ বিক্রমে টুবানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে অলক্তিকা। রোগা ডিগডিগে
টুবান খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসে। কেমন সারপ্রাইজ দিলাম, বল্? আচ্ছা, তুই
কি সত্যি ভয় পেয়েছিলি?
বাড়ির ছোট লোহার গেট খুলে ঢুকতে ঢুকতে টের পেল অলক্তিকা, দু তিনতলার
জানালায় অন্য ফ্ল্যাটের কাকিমা আন্টিদের চোখ তার ওপর। রাত দশটায় রোজ ফেরা
এই ঝাঁকড়া চুল, ছোট প্যান্টস পরা, সঙ্গে এক বা একাধিক ছেলে লটকে নিয়ে
ফেরা মেয়েটাকে নজরে রেখেই চলেছে গোটা পাড়া। ওই সব কাকি আন্টিদের সঙ্গে মা
যতই প্র্যাক্টিকাল সখ্য রেখে চলুক, আজেবাজে ছুতো করে দেখা করুক, কারুর
বাড়ির সত্যনারায়ণের সিন্নি বা লক্ষ্মীপুজোর প্রসাদ হাসি হাসি মুখ করে
সাঁটাক, অলক্তিকা কাউকে পাত্তাই দেয়না।
একটা হু হু হাওয়া বয়ে যায়, নীরব , অথচ বিপজ্জনক আড়ি পাতার। গসিপের।
অলক্তিকা নিজের কাছে রাখা চাবি দিয়ে নিচের দরজার ইয়েল লক খুলে, আস্তে
আস্তে উঠে যায় ওপরে। পেছনে পেছনে টুবান। তারপর ক্লিক শব্দে বন্ধ হয়ে যায়
ঘরের দরজা। নিরাপত্তার ঘেরাটোপে ঢুকতে ঢুকতে, একটু অন্যমনস্ক হয়ে হাঁপ
ছেড়ে বাঁচে ও।
চল, চল, টুবানকে তাড়া দেয় ও। হাসে এবার। এতক্ষণ সব কটা স্নায়ু টানটান হয়ে ছিল।
মা দরজা খোলে, টুবান আর ওকে দেখে একটুও অবাক হয়না। বাথরুমে ঢুকে যায়
অলক্তিকা। মা-কে বলে, মা, খিদে পেয়েছে। টুবান স্ট্রেট ওদের বসার ঘরে গিয়ে
বসে।
বাবা অন্য ঘর থেকে বলে, বিবি এসেছে? এবার খেতে দাও।
মা খুব আলগোছে বাবাকে – খাবার টেবিলেই আছে, খেতে চলে এসো। বিবি , টুবান, খেতে আয়।
ওরা চুপচাপ রুটি তরকারি খায়। বাবা ফ্রিজ খুলে মিষ্টির কৌটো বার করে।
অন্যরা খায় না, বাবা খাবার পর একটা মিষ্টি খায়। আর প্রতিবার মা অপাঙ্গে
বাবাকে দেখে বলে, তোমার সুগারটা অনেকদিন চেক করান হচ্ছে না কিন্তু।
প্রতিবার বাবা মুখের একটা ভঙ্গি করে মাকে উপেক্ষা জানায়। ভেতরে ভেতরে
হাড়ে চটে যায়। মিষ্টি খাওয়ার সুখটায় মা দিল চোনা ফেলে!
টুবানের দিকে তাকিয়ে অলক্তিকার মা বলে, আজ বাড়ি ফিরতে হবে না। এখানেই থেকে যা।
পাড়ার কাকিমাদের সঙ্গে মায়ের জেল করে কী করে? ভাবে অলক্তিকা। যাকগে, একটা
সি পি এম মা থাকা অনেক দিক থেকে ভাল। যদিও সবকিছুর শেষে লাল টুকটুকে
সূর্য দেখতে চায় মা।
অলক্তিকা নিজের একটা ঘর পেয়েছে, সেটা অবশ্য মা সিপি এম বলে না। বাবা এল
আই সি র অফিসার বলে, আর সঠিক সময়ে যাদবপুর অঞ্চলে একটা ফ্ল্যাট বুক
করেছিল বলে। থ্রি বি-এইচ-কে। সেই ফ্ল্যাটটার মাঝারি বেডরুমে অলক্তিকা
ডেরা করে থাকে। টিনেজের প্রাপ্তি তার। বছর দশ এগারো বয়স থেকেই এ ঘর তার,
কিন্তু এখন সে একাকিত্বের মোউতাত আলাদা।
টুবান আর ও সেই ঘরে ঢুকে যায়, এবং অলক্তিকা নির্বিবাদে দরজা বন্ধ করে
দিয়ে বিছানায় ধড়াম করে বডি ফেলে।
টুবান ঘরের এক কোণে মেঝেতে থেবড়ে বসে নিজের স্মার্টফোনে মেসেজ চেক করতে থাকে।
ও টুবানকে ডাকে, বলে শুতে চলে আয় টুবান।
ও পাশে নিজেদের মাস্টার বেডরুমে আলমারি, বুকশেলফ , আয়না সবকিছু রাখার পর
মায়ের চলাফেরার যে রাস্তা তোইরি হয় , তা বেশ সরু। এত জিনিস এত জিনিস।
তবু তারই মধ্যে নৈশ ট্যাবলেট গুছিয়ে, মাথা আঁচড়ে, নিজের চোখের তলার গোল
কালি পর্যবেক্ষণ করে শুতে যায় মা।
বাবা মুখ গোমড়া করে বিছানায় উঠে গেছে।
কী হল? একটু সাবধানে, একটু যত্নে , বাবাকে প্লিজ করার ভঙ্গিতে বলে মা।
বাবা বলে, এইসব অ্যালাউ করছ কেন। এইসবের দরকার কী ছিল। টুবান থাকতেই
পারে, কিন্তু একটা গেস্ট রুম তো রয়েছে। আমি কিছু বুঝিনা বাপু। একটা আঠার
বছরের মেয়ের এত বেশি প্রাইভেসিই বা দরকার কেন, প্রেমের এত ঘটা কেন, যে
বয়ফ্রেন্ড এলেই দোর দিতে হবে?
আহা, ওরকম বলছ কেন? মা একটু কৈফিয়তের ভঙ্গিতে বলে, বড় তো হয়েছে। গলায়
প্রশ্রয় টের পায় বাবা।
বাবা বলে, তোমার আস্কারা পেয়ে তো আরো ধিঙ্গি হচ্ছে মেয়ে। তোমাদেরও না
বাড়াবাড়ি। নিজেদের কৈশোরে কী কী পারোনি, সেগুলো সব মেয়েকে করতে দেবে, এত
পারমিসিভ না তোমরা। অদ্ভুত! যাক গে, তোমার মেয়ে , তুমি বোঝ।
-আহা , ওরকম করে বলছ কেন, তোমারও তো মেয়ে।
-মেয়ে আমার কথা শোনে, না আমাকে জিগ্যেস করে এ বাড়িতে কিছু চলে?
হঠাৎ ঝাঁঝিয়ে ওঠে মা।
-শোন প্রবীর, তোমার মা যতদিন বেঁচে ছিলেন, তাঁর কথামতই সব চলত। ভুলে যেও
না, আমি এ বাড়িতে বহিরাগত হয়েই কাটিয়েছি আঠার বছর। আমি ত চাকরি করি,
সারাদিন বাড়ি থাকিনা। তোমার মা তো গর্ব করে করে লোককে বলতেন, বিবি আমাদের
বাড়ির মেয়ে , আমাদের হাতেই মানুষ। লিখিত ইতিহাসে বিবির মা কিন্তু কোনদিনই
বিবিকে “মানুষ” করার ক্রেডিটের ভাগিদার ছিল না। এটা ভুলে যেও না! আজ
বিবির কোন ত্রুটির জন্য আমাকে দোষারোপ করছ? আমি ত সেই দায় নেব না। আমি
তো ওকে বড় করিনি। ও তো এইবাড়ির রুলস মেনে বড় হয়েছে। হ্যাঁ, আমার কাজ ছিল
শুধু খাতা বই পেন্সিল কিনে দেওয়া। স্কুল ড্রেসে বোতাম লাগিয়ে দেওয়া,
ছিঁড়ে গেলে।
-উফ, আবার শুরু হয়ে গেলে ত।
-আগেই বলেছিলাম, আমার মুখ খুলিয়ো না।
বাবা ওপাশ ফিরে শুয়ে পড়েন। কথা না বাড়িয়ে।
রাত নেমে আসে ছোট পরিবারে।
অন্য এক যৌথ পরিবারে তখন ঘনিয়ে উঠেছে অশান্তি।
(ক্রমশ)