ধারাবাহিক উপন্যাস <brf></brf>  কেদার <br /> (১-৭ম পর্ব) <br /> শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী

ধারাবাহিক উপন্যাস কেদার
(১-৭ম পর্ব)
শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী

শুরু হল শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তীর নতুন ধারাবাহিক উপন্যাস 'কেদার'। উপন্যাসটির প্রথম থেকে সপ্তম পর্ব প্রকাশিত হল। এর পর থেকে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হবে সাত দিন অন্তর।

এক

ভোগৈশ্বর্যপ্রসক্তানাং তয়াপহৃতচেতসাম
(জড় জগত ইন্দ্রিয়সুখের। অতি ইন্দ্রিয় আসক্তি মায়াময়।গীতা।২/৪৪)

সন্ধ্যা হলেই মন কেমন করে অলোকানন্দার। আনমনে তাকিয়ে থাকে স্টেশনপাড়ার টিউবলাইটগুলোর দিকে। ঘড়ি অল্প দেখতে জানে সে। তুলনায় অস্তমান সূর্য তার কাছে ঢের বেশি বিশ্বাসযোগ্য। মন বলে বারবার। ও তো যন্ত্র। যদি ভুল করে! যন্ত্রর কলকব্জায় কি জঙ ধরতে নেই। আর ধরলে যদি কাঁটার গতি মন্থর হয়ে পড়ে। স্টেশন পাড়ার আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে গোকুলঘরিয়া গ্রামের আবাদে বৌ অলোকানন্দা। এখনও যে ফিরল না কৃষ্ণেন্দু। সন্ধ্যা ছ’টা সাতের ডাউন ট্রেনটাও যে বেরিয়ে গেল। ভাবতে ভাবতেই মন ঘোরাতে চেষ্টা করে সে।বিকেল থেকেই আকাশ কালো করে আছে। বৃষ্টি পড়বে বোধহয়।মুরগীগুলোকে ভালো করে চাপা দিতে হবে। গেল মাসে দুটো মুরগীছানা মরেছে।কলকাতার মহাজন মহেশ সিঙহানিয়া। একবার কৃষ্ণেন্দুর বাবা বেঁচে থাকতে তার বাড়িতে গিয়েছিল সে। সেই বাড়ি গেলে চোখ ধাঁধিয়ে যাবে। রাধাকৃষ্ণর মূর্তির সমস্ত আভূষণে হীরে জহরত।ওসব দেখলে চোখ পুড়ে যায় তার। মহেশজির পোলট্রির কারবার এই অঞ্চলে দেখভাল করে রণজয় সেন। কৃষ্ণেন্দুর বাবা অরিন্দম আর রণজয় প্রায় এক বয়সী। কিন্তু ভাগ্যবিধাতার গোপন সুঁড়িপথে তাদের গন্তব্য ভিন্ন মার্গের। রণজয়কে অরিন্দমের মতো মালায়শিয়া যেতে হয়নি কারণ সে ঠিক সময়মতো তার নীতির সঙ্গে আপোশ করে উঠতে পেরেছিল। অরিন্দম পারেনি। ইদানিং মহেশজীর নির্দেশে খুব কড়াকড়ি হয়েছে। মুর্গিছানা মরলে চলবে না। রণজয় সেনকে অলোকানন্দার ভালো লাগে না। লোকটার ভিতর একটা অন্ধকার আছে। কিন্তু কৃষ্ণেন্দুর কলেজের পড়া শেষ করতে হলে এই পোলট্রিটা টিকে যাওয়া খুব জরুরি। তাই অলোকানন্দা তড়িঘড়ি তৎপর হয়ে উঠল।
ওদিকটা পেছল আছে সামান্য। সেই পেছল পথেই তো পা হড়কে সেই গত বছর আগে হারাতে বসেছিল সবটুকু। কতো বার হারাতে হয়েছে তাকে। মুরগির ঘর তেরপলে ঢাকতে ঢাকতে দূর থেকে ভেসে আসা পালাকীর্তন শুনতে পেল অলোকানন্দা। অদ্বৈত গোঁসাইয়ের আখড়ায় আগামী কয়েকদিন এই কীর্তন পালা করে চলবে। কথক সুর করে গাইছে।”এখানে গোলোকে হরি ভাবিয়া মনেতে। আর এক পুত্র দেন দেবকী গর্ভেতে।” অলোকানন্দার ঘরের পাশেই আমের বন। সেখানে ইতিউতি দু একটি শিরীষ গাছের চুড়োও দেখা যায়। সেই বন পেরিয়ে অশ্বত্থ গাছ। তার পর হরিসভা। অলোকানন্দা পড়াশোনা করেনি তেমন। চোদ্দ বছরেই বিয়ে হয়ে গেল অরিন্দমের সঙ্গে। স্বামীহীনা অলোকানন্দা সারাদিন কৃষ্ণেন্দুর কলেজফিরতি পথের দিকে চাতকের মতো তাকিয়ে থাকে। তারই ভিতর মাঝেমাঝে সে ওই গাছগুলোর সঙ্গে কথা বলে। আহা। যদি সত্যিই দেবকী হতো সে। বা যশোদা! অদ্বৈত গোঁসাইয়ের স্ত্রী শচীমাতা তাকে মাঝেমধ্যে বুঝিয়ে বলে। ধরাধাম আসলে এক গোলক বৃন্দাবন। সেখানে জীবজগত এক একটি রাধারাণীর অংশ। কিন্তু অলোকানন্দা যে দেবকী হতে চায়। যশোদা হতে চায়। তাই তো তার মনের ভিতর এতো উৎকণ্ঠা। এই শচীমাতা নিয়ে গোকুলঘরিয়া গ্রামে মুহুর্মুহু আলোচনার শেষ নেই। কেউ কেউ বলে সে অদ্বৈত গোঁসাইয়ের বিয়ে করা বৌ নয়। সাধনসঙ্গিনী।পাড়ার মুদীদোকানে মাসকাবারি রেশনের চাল আনতে গিয়ে অলোকানন্দা শুনেছে। বিবাহ না করে সহবাস! মা গো। সে যে কলঙ্কের গো! কলঙ্ক শব্দটি ভাবলেই অলোকানন্দার কালচে রক্তের দাগের কথা মনে হয়। কতোবার গর্ভপাত হলো তার। শহরের ডাক্তার, সদরের ডাক্তার, স্পেশালিস্ট ডাক্তার, কেউ কিছুই করতে পারলনি। প্রতিবার বসন্তর মতো কোকিলের কুহু বয়ে উঠত জঠোরে। তারপর গ্রীষ্মের দাবদাহের মতোই ঝড়ে যেত অজানা কারণে। এইভাবেই একদিন কৃষ্ণেন্দু এল তার জীবনে। মুরগিদের মহাজনের দেওয়া ট্যাবলেট দিতে দিতে অলোকানন্দা শুনতে পেল সে কথক গাইছে।”সপ্তম মাসেতে হয় রক্তপিণ্ড প্রায়। গর্ভস্রাব হৈল বলি বাজারে জানায়।।দেখিয়া হরিষ কংস আপন অন্তরে। বলে এত দিনে শঙ্কা চলি গেল দূরে।।”
সবটুকু বলতে তো ওই কৃষ্ণেন্দুই। কতোই বা বয়স তখন অলোকানন্দার। বাইশ কি তেইশ। অরিন্দম তখন মালয়শিয়াতে কাজ করছে। শনি রবি নিয়ম করে ফোন করে। বাকি সময়টা ব্রেনস্ট্রোকে কাবু শাশুড়ির সেবাযত্নে কাটতো অলোকানন্দার। পেটে পাঁচ মাসের কৃষ্ণেন্দু। অরিন্দম বেঁচে থাকতে পোলট্রির কারবারটা সংসারে এতোটা জরুরি ছিল বুঝতে পারেনি সে। অবহেলায় দু’ একটা মুরগি বাচ্চা মরে যেতই। গ্রামের সুকুমারী শহরে আয়ামাসীর কাজ করে। সেই প্রথম বলেছিল অলোকানন্দার।
-ও অবস্থায় মুরগির কাজ করোনি বাপু। শরীরে মুরগির হাওয়া লাগবে। সোনাবাবুর ক্ষতি হবে।
-বুঝলে কীকরে ছেলে হবে?
-ও সব বোঝা যায় গো। নার্সিং হোমে রোজ দেখি। বুঝব না? ছেলে না হলে অতো বড় পেট হয় বুঝি।
পেট বেশ হাতির মতোই হয়েছিল অলোকানন্দার। সেই নিয়ে শাশুড়ির টাওয়েল কলঘরে কাচতে কাচতে মন কেমন করত তার। ওই তো। ওই বুঝি পা ছুঁয়ে দিল কৃষ্ণেন্দু। পা হড়কে গেলে সেদিন তাই অলোকানন্দা ঘাবড়ে গিয়েছিল খুব। বাথরুমে সরু এক চিলতে রক্তের দাগ পড়তে অলোকানন্দা খেয়াল করেছিল তার কোলে কৃষ্ণেন্দু নড়ছে না।তারপর সবকিছু অন্ধকার।

ঘোর কাটল গোকুলঘরিয়া হাসপাতালের বিছানায়। দুই হাতে লম্বা সুতলির মতো দুটো স্যালাইনের টিউব। সুকুমারী উদ্বিগ্ন হয়ে বসে আছে পাশে। ডাক্তার বলেছে ছবি করতে হবে পেটের। বাচ্চার বর্তমান অবস্থা জানা দরকার। অলকানন্দা মনে মনে বিড়বিড় করছিল। গ্রামের অদ্বৈত পণ্ডিত তাকে বলেছে। এর আগে সাত সাতবার ভ্রুণ নষ্ট হয়েছে তার। কিন্তু এ গর্ভ অষ্টম গর্ভ। এই গর্ভ নষ্ট হবার নয়। কিছুতেই হবেনি। ভাবতে ভাবতে আবার অবসন্ন হয়ে উঠেছিল তার হাত পা। অলোকানন্দা যেন নিধুবনে হারিয়ে গিয়েছিল। সেখানে মেশিনের বিপবিপ যেন রাধারাণীর পায়ের নূপুরের ছমছম। ডাঃ সতপতির গলার স্বর ভেসে আসছিল দূর থেকে।
-বাচ্চা ঠিক আছে। অ্যাবসোলিউটলি ফাইন। শুধু মায়ের একটু রেস্ট দরকার।
সুকুমারী মায়ের মতো বুঝে নিচ্ছিল সব। পেটেধরা মা যে সেই ছোটবেলা থেকেই নেই অলোকানন্দার। মরেনি। অন্য লোকের সঙ্গে পালিয়ে ঘর বেঁধেছে। মরেছে বোকা বাবাটা। ওস্তাদ বিষ গিলে। তখন সে ছোট। সুকুমারী তার থেকে বছর দশেক বড়। মাঝেমাঝে মনে হয়, তার গড়ন রক্তমাংস দিয়ে নয়। মায়া দিয়ে তৈয়ার করা।
গোকুলঘরিয়ার হাসপাতাল নেহাতই ছোট। পঞ্চাশটা বেড। পঁচিশটা পুরুষ। পঁচিশজন মহিলাদের জন্য বরাদ্দ। এর ভিতর একটা ছোট ঘরে প্রসূতি মহিলার জন্য পাঁচটা বেডের বন্দোবস্ত করেছে বিএমওএইচ। আগে হাসপাতালে চব্বিশ ঘন্টা আল্ট্রাসোনোর বন্দোবস্ত ছিল না। নতুন ডাক্তার সুপার এসে তা চালু করেছেন। চব্বিশ ঘন্টা নয় অবশ্য। সকালে ছয় ঘন্টা। সপ্তাহে তিনদিন। তাই তো রক্ষে। না হলে পেটের ছবি করতে সেদিন অলোকানন্দাকে নবগঞ্জ দৌড়োতে হতো। এখনও সেই রাস্তা নানান খানাখন্দে ভরা। একটানা গেলে পেটে ব্যথা ধরে যায়।
অলোকানন্দার ঘরে সেদিন অন্য প্রসূতি মায়েরা ছিল। তাদের কেউ তার সমবয়সী। কেউ কেউ তার চেয়েও ছোট। সারারাত অলোকানন্দা তাদের এক এক করে মা হতে দেখেছিল। যেন এক লহমায় সহস্র যদুশিরোমণি পৃথিবীর বুকে নেমে এলেন। ছবি আঁকতে ভালোই পারত অলোকানন্দা। কেউ শেখায়নি। এমনি এমনিই। পরে সেই ছবি বদলে গেল সেলাইএ। কখনও কাঁথা। কখনও শাড়ি। গ্রামের মেয়েমানুষেরা মাঝেমাঝে ব্লাউজ শাড়ি দিয়ে যেত পিকো করানোর জন্য। বাপ মা হারা মেয়েটার যখন অরিন্দমের সঙ্গে বিয়ে হল, শাশুড়ির তখন স্ট্রোকটা হয়নি। চ্যাটাং চ্যাটাং কথা। শাশুড়ি বলেছিল।
-ভালোই হল। বৌমা এল। ঘরে ঝিয়ের খরচ বেঁচে যাবে।
ঝি গিরি করতে আপত্তি করেনি অলোকানন্দা। কিন্তু তার ফাঁকে ফাঁকে ওই পিকো করবার নেশা ছিল তার নিশ্বাস। রাতে এক এক করে শিশুর কান্না শুনতে শুনতে সে অনুভব করতে পেরেছিল, তার পেটে কৃষ্ণেন্দু আবার নড়েচড়ে উঠছে। সকালে অলোকানন্দা হাসপাতালের জানলা দিয়ে দেখতে পেয়েছিল দেয়াল ঘিরে একদল তিতপল্লা আর আলকুশি তার দিকে চেয়ে আছে। আ মল। অতো চেয়ে থাকার কী আছে শুনি? সেই চোদ্দ বছর থেকে বাইশ। আটবছরে লোকে বুড়ি হয়ে যায়। সে নয় মা হয়েছে। তো? তাতে কী অমন তাকিয়ে থাকতে আছে। গোকুলঘরিয়ার মেয়েমানুষদের বূঝি লজ্জাশরম করতে নেই!সেইদিন হাসপাতাল থেকে ছুটি হয়ে ফেরার পথে সে ভেবেছিল ওই জানলা থেকে দেখা ছবিখানা কাপড়ে এঁকে রাখবে। কিন্তু সেটুকু আর হতে পারল কৈ। তার যে শেখানো হাত নেই। বরং রাতে অরিন্দমের ফোনের অপেক্ষা করতে করতে সে সেদিন দূর থেকে শুনতে পেয়েছিল দূর থেকে ভেসে আসছে গান।”কৃষ্ণময়ী কৃষ্ণ যাঁর ভিতরে বাহিরে। যাঁহা তাঁহা নেত্র পড়ে তাঁহা কৃষ্ণ স্ফুরে।।” অলোকানন্দা সেইদিন থেকেই ঠিক করেছিল। ছেলে হলে নাম হবে কৃষ্ণেন্দু। আর মেয়ে হলে কৃষ্ণা। আর বড় হলে তাদের সে শিল্পী বানাবে। বানাবেই। যা হয় হোক।
মুরগির ছানাগুলো খাঁচার ভিতর ঝোলানো লাল নীল শস্যদান থেকে খুদ খুঁটে খাচ্ছে। অলোকানন্দা আলো জ্বালিয়ে তেরপলে ঢেকে দিতে দিতে ভাবল। ছেলেটা এলো না এখনও। বুকের ভিতর দুড়দুড় করতে থাকে তার। সাতটা বাজে বাজে। দোর দিয়ে অলোকানন্দা সুকুমারী মাসির জন্য তৈরি করা কাঁথা নিয়ে বসল। শহরের আয়ামাসির কাজে সুকুমারী সদ্যোজাত বাচ্চাগুলোর দেখভালের সময় এই কাঁথাগুলো ব্যবহার করে। বিক্রি হলে অর্ধেক তার হয়, অর্ধেক অলোকানন্দার। কাল তার আসার কথা গ্রামে। এলে এই আটটা কাঁথা তাকে দিতেই হবে। কাঁথায় মনের অজান্তেই আঁকিবুকি কাটে সে। দু একবার নিজেরই অন্যমনস্কতায় আঙুলে ছুঁচ ফুটে গেল যেন। শহরে আজ কয়েকমাস কৃষ্ণেন্দু আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছে। শহরের কথা ভাবলে তার ভয় হয়। তার ছেলে যে অতো চালাক চতুর নয়। কোনও মেয়েমানুষের খপ্পরে পড়ল না তো? শহরের মেয়েগুলো কেমন যেন। অদ্ভুত পোশাক পরে। সিগারেট খায়। তার ছেলেটাকে কেউ বিগড়ে দিল কি? এমন সব আবোল তাবোল চিন্তার ফাঁকেই দরজায় কড়া নাড়ে কেউ। পাল্লা খুলতেই কৃষ্ণেন্দু এক মুখ হাসি নিয়ে বলে,”দেখ মা। কি এনেছি তোর জন্য”!
-কথা বলব না তোর সঙ্গে। খুব পাখনা গজায়েছে তোর। খালি উড়ি বেড়ানো। এতো রাত করে কেউ।
-আরে। একবার শুনবি তো মা আমার। গেল মাসে যে এক্সিবিশনটা হলো, তাতে আমার ওই নাগচম্পা ফুলের ছবিটা সাত হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। ভাবতে পারিস? সাত হাজার টাকা। তাই দিয়ে তোর জন্য জিনিস এনেছি।
-কি জিনিস?
-দেখ দিকি।

একটা বাক্স বের করে অলোকানন্দার হাতে দিল কৃষ্ণেন্দু। সে দেখল কৃষ্ণেন্দুর জিব শুকনো। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। তার মায়ের মন। দেখেই সে বুঝতে পারছিল ছেলেটা সারাদিন কিছুই খায়নি।
-আগে খেয়ে নে। তারপর।
কৃষ্ণেন্দু তার ব্যাগ, তুলির বক্স আর ক্যানভাসগুলো ঘরের কোণে রেখে হাতমুখ ধুতে কলপাড় গেল। অলোকানন্দা সেই সময়ে ডিম ভাজা করে দিল কৃষ্ণেন্দুর জন্য।

রাতের খাবার তাড়াতাড়ি সেরে তক্তপোশে বসে কৃষ্ণেন্দু তার মায়ের জন্য আনা বাক্সটা খুলে দেখালো। একটা মাঝারি আকারের মোবাইল ফোন।
-আর তোকে আমার জন্য রাত দুপুর চিন্তা করতে হবে না। একটা কল দিবি। ব্যাস।
-আর তোর ফোন?
-পেয়েছি। একটা বন্ধু দিয়েছে। পুরনো অবশ্য। ঘরে পড়ে ছিল। দিয়ে দিল।
-বন্ধু? নাম?
কৃষ্ণেন্দু একটু আমতা আমতা করে বলে,”সহেলী।”
-শহরের মেয়ের খপ্পরে পড়লি তুই?
-শহর কেন হতে যাবে। আগের স্টেশনের গ্রামেই ওর বাড়ি। নতুনগ্রাম।ওগ্রামের রেশনের ডিলার সনাতনকাকার মেয়ে। খুব ভালো মেয়ে। আলাপ করিয়ে দেব তোমার সঙ্গে।
-ও ফোন নিয়ে নে তুই। আমার লাগবেনি।
ঘরের ভিতর প্লাস্টারহীন দেয়ালের ইঁটগুলো যেন কংসের কারাগারের এক একটি অচলায়তন পাথর। তারা উৎকর্ণ হয়ে শোনে এক দেবকী ও এক যদুশিরোমণির কথোপকথন।
-কেন নিবি নে?
-এটা তুই নিয়ে ও ফোন তুই ফেরত দে দে।
-কেন?
-আমি পেয়ে যাব। কাল সুকুমারী আসবে। কাঁথা নে যাবে। তখন ওর কাছে কিছু টাকা চেয়ে কেনি নেব।
-কিন্তু কেন?
-জানি না।

কী করে বোঝাবে অলোকানন্দা? তার মনের ভিতর বদ্ধ ধারনা হয়েছে। ও মেয়ে তার ছেলেকে বশ করেছে। ওই ফোন দিয়ে। ছেলে শহরের জল হাওয়া খেয়ে ওসব শুনে হাসবে। কিন্তু সে জানে। ওই অদ্বৈত গোঁসাইয়ের বৌ শচীমাতা একদিন তাকে বলেছিল। মন্ত্র পড়ে জিনিস দিয়ে মানুষকে বশ করা যায়। অলোকানন্দার এই হঠাৎ বিরূপতায় এইবার কৃষ্ণেন্দুর অভিমান হয়। তার মনে হয়েছিল তার মা যেন কারাগারে শিকলে আটকে আছে। ফোনটা এলে কথা বলা যেত। তবে কি সহেলীর কথা শুনে মা রেগে গেল? সেটা হলে হোক। সে তো লুকোয় না কিছুই।তাছাড়া সহেলীকে তার ভালো লাগে। সহেলীরও তাকে। আলো নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে সকালে লেকচার ক্লাসে শোনা ফ্লোরেন্সের সেই কিংবদন্তী ভাস্কর গিওটোর কথা ভাবছিল।কীভাবে তাকে নানান ষড়যন্ত্র করে আটকে দেবার চেষ্টা করছিল তার সহশিল্পীরা। কিন্তু গিয়োটো হারেনি। এই কয়েকমাসে আর্ট কলেজে ঢুকে সে বুঝেছে, এখানকার সহশিল্পীরাও ফ্লোরেন্টাইনদের থেকে কিছু কম হিংস্র নয়। অনেক বাঁধা টপকে আজ তার ছবি একষট্টি জনের ভিতর বিক্রি হয়েছে। দাম যতোই নগণ্য হোক,তবু এই বিক্রি হওয়াতে অনেকের হিংসার নজরে পড়ে যাবে সে। কিন্তু সে বদ্ধপরিকর। হার মানবে না। এর মধ্যে মায়ের এই অদ্ভুত আচরণ তাকে কেমন যেন দুর্বল করে দিল। এইসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়ল কৃষ্ণেন্দু। দূর থেকে ভেসে আসছিল পালাকীর্তনের সুর।”দ্বাপরেতে কৃষ্ণ জন্মিবেন নন্দালয়। কংসকে করিবে বধ গিয়া মথুরায়।”

দুই।

“হস্তে গৃহীত্বা সহরামমচ্যুতং/নীত্বা স্ববাটং কৃতবত্যথোদয়ম//”শ্রীমদ্ভাগবতম//২০//(ঐশ্বর্যচূড়ামণি শ্রীকৃষ্ণও মা যশোদার মমতার অধীনে সামান্য শিশুমাত্র। মায়ের মমতা সর্ববশবর্তিনী)

সকাল সকাল কিছু না খেয়েই কলেজে বেরিয়ে পড়ল কৃষ্ণেন্দু। দেখেও না দেখার ভান করতে করতে সেই দৃশ্য দেখে ফেলল অলোকানন্দা। না দেখে উপায় কি। সারারাত ঘুম আসেনি তার। সরু রাস্তা ধরে ব্যাগ হাতে ছেলেটা হেঁটে যাচ্ছে। দু পাশে আকাশমণিগাছের সারি। দুই একটি সিপাহি শালিক অলোকানন্দার বুকের ভিতরের শূন্যতাকে নাড়িয়ে দিয়েই যেন চলে গেল। ভিতর থেকে অরিন্দমের মায়ের গোঙানির শব্দ ভেসে আসছে। সকালে গুমুত পরিষ্কার করতে হবে। তারপর নল দিয়ে লিকুইড খাবার। ভোর ভোর মুরগিদের পোলট্রিখানার উপর থেকে তেরপল সরিয়ে এসেছে সে। কলপাড়ে বাসনকোসন রয়েছে সামান্য। আর আছে রান্নাবাটি। দুটি মানুষ আজ। ছেলেটা তো অভিমান করে চলে গেল। কী হবে রান্না করে? ডাল সিদ্ধ আর গলা ভাত। ব্যাস।
অরিন্দম চলে গেছে আজ তিন বছর হয়ে গেল। কী হয়েছিল কে জানে? কেউ বলে ব্রেনস্ট্রোক। কেউ বলে মেরে দিয়েছে। কে মেরে দিল? কে জানে। বাসনে কয়লার গুল আর তার ঘসতে ঘসতে অলোকানন্দা ভাবে। শত্তুরের তো অভাব নেই গ্রামে। চার বিঘে জমি। অরিন্দম আর অলোক। দুই ভাই। ছোটভাইটাও তো গতবছর চলে গেল বিষ খেয়ে। এতো বিষ চারিদিকে। কেন বিষ খেল দেওর। সে তো নিপাট ভালোমানুষ । সাত চড়ে রা কাটে না। আলাদাই থাকত। কলকাতার দিকে। লোকে বলে খায়নি। খাইয়েছে। বৌ টা তেমন ভালো ছিল না নাকি ।হোটেলে গান করত শুনেছে সে। ভালোবাসাবাসি করে বিয়ে। অনেক পরপুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল নাকি। অলোক মরতেই এক মারোয়ারি ব্যবসাদারকে ধরে সিঙ্গাপুর চলে গেছে। একসঙ্গে একঘরে থাকে লোকটার সঙ্গে। বিয়ে করেনি। এমনি এমনিই থাকে। ভাবা যায়। এমনটা হয় বুঝি? ভাবতে ভাবতেই ভিতরে ভিতরে শিউরে ওঠে অলোকানন্দা। অরিন্দম ছাড়া আর কোনও পরপুরুষের কথা ভাবলেই কেমন যেন হয় তার মনের ভিতর। অথচ তান বছর অরিন্দম নেই। যখন ছিল, তখনও তো আসত দুই বছরে একবার। অলোকানন্দার তাতে মনেমনে কষ্ট হলেও বুঝতে পারত না। কৃষ্ণেন্দুকে পড়ার সময় গরম জল করে দেওয়া, কৃষ্ণেন্দুকে ঘুমোবার সময় বালিশ এগিয়ে দেওয়া, কৃষ্ণেন্দুকে আঁকার কাগজ গুছিয়ে দেওয়া। তখন সারাটা দিন শুধু কৃষ্ণেন্দু আর কৃষ্ণেন্দু। অলোকানন্দার জীবনে তখন বরং অরিন্দমই দ্বিতীয় পুরুষ। একটিবার মাত্র বৌকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি এসেছিল অলোক। কী যেন নাম মেয়েটার। মোনালিসা না কীই যেন। টানাটানা হরিণের মতো পটলচেড়া চোখ। মিষ্টি স্নিগ্ধ হাসি। অলোকানন্দাকে ঘরের কাজে সেদিন হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল নির্দ্বিধায়। আর সন্ধ্যায় গান শুনিয়েছিল। আহা। ভারি মিষ্টি গলা মেয়েটার। শুনলে মন জুড়িয়ে যায়। ও গান শুনলে বিশ্বাস হতে চায় না এই মেয়ে কারোকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতে পারে!
শাশুড়িকে টিউবে ডালসিদ্ধ আর ওষুধ খাইয়ে অলোকানন্দা ভিতরের ঘরে কাঁথা সেলাইয়ের বাকি থাকা কাজটা সেরে নিচ্ছিল। ছুঁচ ফুটে যাচ্ছে আঙুলে বারবার। অসাবধানতায়? নাকি চোখের আলো কমে আসছে তার? হাসপাতালে গিয়ে একবার চোখটা দেখিয়ে এলে হয়। কিন্তু অরিন্দমের মাকে ঘরে একা ফেলে অলোকানন্দা যাবে কী করে? কৃষ্ণেন্দু এখন বড় হয়ে গেছে। তার কি আর সময় আছে! মুখ ভার করে এক বুক অভিমান নিয়ে অলোকানন্দা কাঁথা বুনে চলে।
বেলার দিকে সুকুমারী মাসি এল। গতরাতে তার নাইটডিউটি ছিল। আজ তাই ‘ডে অফ’।অলোকানন্দাকে দেখে সেও বুঝতে পারে যে তার মন ভালো নেই।
-কী হয়েছে বল দিকিনি?
-কিছু না।
-কিছু তো একটা হয়েছে।আমাকে ফাঁকি দিতে পারবিনি। আমি রোজ এতোগুলো বাচ্চা দেখছি। ছেলে কিছু বলেছে।
-না।
-তাহলে? খাসনি সারাদিন। তাইতো?
অলোকানন্দা চুপ করে রইল। সে সারাদিন যে একমুঠো অন্নও মুখে দেয়নি, একথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি।
-ছেলে না খেয়ে গেলে মা কি খেতে পারে দিদি?
-খায়নি কেন? মা বেটায় খুব ঝগড়া করেছিস বুঝি?
কাঁথা দেখতে লাগল সুকুমারী।
-কী সেলাই করেছিস দেখি!
কাঁথা উল্টে পাল্টে দেখতে থাকে সুকুমারী। ছোট্ট শ্রীকৃষ্ণর হাঁমুখের দিকে তাকিয়ে মা যশোদা আশ্চর্যচকিত হয়ে গেছেন। সারা বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড জগত সংসার, সবকিছুই যে এই ছোট্ট শিশুর মুখের ভিতর!
-ভারি সুন্দর আঁকিস তুই। তোর থেকে তোর ছেলেটা অমন সুন্দর আঁকার হাত পেয়েছে।
অলোকানন্দা বলে না কিছু। গোকুলঘরিয়া গ্রামের ভিতর এমন অমরাবতীর মতো নাম রাখল কে তার! দাদু বোধহয়। মা তো ছিল না। বাপ মরে যাবার আগে গল্প করত। দাদু পদাবলী লিখত। ওপার বাংলায় সুনাম ছিল অনেক। একটিবার তাকে দেখেছিলেন। দেখেই যেন দেবপ্রয়াগের মতো অশ্রু বর্ষিত হলো তার মনের ভিতর। বাপ বলেছিল। এ নাম তারই রাখা।
-কিছু বললি নে যে বড়।
-ছাড়ো দিদি ওসব কথা। একটা কথা কও দিকি। এই কাঁথা বেচে একটা ফোন কিনতে পারব আমি?
সুকুমারী মুচকি হাসে।
-কেন রে?নাগর ধরলি বুঝি?
অলোকানন্দা কথা বলল না।রঙ্গরসিকতা করবার সময় তার নেই। সুকুমারী সে কথা বুঝতে পারল।
-কাঁথা তো এতো সুন্দর নকশা করে বুনিস। কিন্তু দেখে কয় জনা? বড়বাবুদের বাচ্চার গুমুত মুছে ফেলে দেয়। কলকাতার পার্টি ধরলে একটু লাভ বেশি ছিল। কিন্তু সেখানে মেড়োরা সেঁধিয়ে বসে আছে। তবু কিস্তিতে দিলে হয়ে যাবে। অতো ডেজাইন করিস নে। কেউ দেখবেনি। রান মেরে ছেড়ে দিবি।
-না দেখুক।
অলোকানন্দার চোখ দিয়ে টপটপ জল গড়িয়ে পড়ল কাঁথার উপর। সুকুমারী এবার তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।তারপর বুকের ওমের ওপর অলোকানন্দাকে টেনে আনে। অলোকানন্দা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। সুকুমারী দেখে তার চোখও টলমল করছে উজান জলে।
-কী হয়েছে বলবি আমায়?এতো অভিমান কার উপর?
-ছেলে আমার বড় হচ্ছে গো। ওর নাম কৃষ্ণেন্দু রেখিছি। তখন কি জানতাম একদিন কৃষ্ণ গোকুল ছেড়ে চলে গেলে একা আমি কী নিয়ে থাকব!
-কে বলল ও চলে যাবে? আগে থেকে সব ভেবে নেতে হয় সব!
-আমি জানি।
-হ্যাঁ। তুই সব জানিস।
মনে মনে ভাবে সুকুমারী। মেয়েটার ভিতর আকুল ভাব। মাহারা বরমরা মেয়ে। অদ্বৈত গোঁসাইয়ের আশ্রমে ওকে একবার নিয়ে গেলে বেশ হতো। ওখানে গেলেই যেন সব শান্ত হয়ে আসে ভিতর ভিতর। যখন সুর করে করে গোঁসাইঠাকুর গেয়ে যায়। আহা। কী গলা। শচীমাতার সঙ্গত। “সই,পিরিতি বিষম মানি।সুরের লাগিয়া পিরিতি করিনু শ্যাম বঁধুয়ার সনে।পরিণামে তত দুখ হবে কোন অভাগিনী জানে।।”অলোকানন্দাকে সান্ত্বনা দিতে দিতে সুকুমারী ভাবছিল।জড়জগতে মা যশোদার মতো শক্তিধর আর কে আছে?তার শক্তি তার মমতায়। মমতার বন্ধন বড় বিষম বন্ধন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণও যে তার বশবর্তী না হয়ে পারেন না। ভাবতে ভাবতেই হু হু করে ওঠে তার বুকের ভিতর।এই মেয়ে খুব চাপা স্বভাবের।তবু এই মেয়ের ভয়ের কারণ সে অনুভব করতে পারে। কী করছে আজ তার ছেলেটা কে জানে?কোথায় আছে?কী করছে?আছে তো?আছে হয়তো!

কাঁথা নিয়ে চলে যেতে যেতে সুকুমারী বলে,”ছেলে তোর কোথাও যাবে না রে।”
-একটা কথা বলবে সুকুমারীদি?
-বল না।
-তুমি নতুন গেরাম গেছ?
সুকুমারী খানিক ভেবে বলে।
-গেছি দু এক বার। একটা পার্টি ড্রেসিং করাত। কেন বল দিকি?
-না। ওখানে রেশন ডিলার। সনাতন কী যেন। কেমন লোক। বলতে পারো?খোঁজ নেবে?
-বেশ নেব। এখন খেয়ে নে। তোর ছেলেকে আমি বকে দেব। হয়েছে?

সুকুমারীর সঙ্গে কথা বলে খানিক হাল্কা লাগছিল অলোকানন্দার।অলোকানন্দা সুকুমারীর মনের কষ্টর কথা জানে। সুকুমারীর একটা ছেলে ছিল। তার বর আগেই তাকে আর ছেলেকে থুইয়ে অন্য মেয়েমানুষের সঙ্গে চলে গিয়েছে। ছেলেটাকে বড় করবে, মানুষ করবে, অফিসার বানাবে। অনেক আশা ছিল তার। সেই আশাতেই গ্রামে রাখবে না বলে শহরের এক মিশনে রেখে পড়াশোনা করাতো সুকুমারী। মিশন পড়ালেখা খাওয়াপড়ার খরচ দিত। আর বাকি টুকটাক সুকুমারী দিত আয়ামাসির কাজ করে। কিন্তু সকলের কপালে যে সুখ লেখা থাকে না। সুকুমারীর কপালেও সে লিখন ছিল না। একদিন শহর থেকে ফোন এল তার মোবাইলে। তার ছেলে নিখোঁজ। পালিয়ে গেছে। বাপহারা পনেরো বছরের একটা ছেলে। কোথায় পালিয়ে যাবে! থানাপুলিশে লাভ হল না। নেতা ধরেও কিছু হিল্লে হলো না। অনেক ঘুরবার পর সুকুমারী হাল ছেড়ে দিল। অলোকানন্দার এইসব কথা মনে এলেই বুক দুড়দুড় করে। এমন ঘটনা তার সঙ্গে ঘটলে! কীই হতো! সে তো মরেই যেত। শ পাঁচেক টাকা দিয়ে গেছে আজ। সে টাকা দেরাজে রাখতে রাখতে আড়চোখে সে দেখতে পায়, বিছানার উপর কৃষ্ণেন্দুর দেওয়া মোবাইল ফোনটা অবহেলায় পড়ে আছে। দেখামাত্র মন কেঁদে ওঠে ভিতর ভিতর। আহা। এতো অল্প কারণে বড় কঠোর হয়েছে সে ছেলেটার উপর। অতোটা ঠিক হয়নিকো। আজ ফিরুক। পায়েস বানাবে সে। কনকচূড় চাল আনবে বদরির দোকান থেকে। ছেলেটা কতোদিন আশ ভরে খায়নি। যাবার সময় সুকুমারী বলে গেছে।কে জানে আজ জীইয়ে থাকলে তার ছেলেও হয়তো কৃষ্ণেন্দুর বয়সীই হতো। সুকুমারী বলেছে তাকে।
-উঠতি বয়সের ছেলেকে বেশি বকিসনি বাপু।
অলোকানন্দা মাথা নেড়েছে শুধু। মোবাইলের বা সহেলীর কথা কিছুই বলেনি। মা বেটার কথা। যতোই হোক সুকুমারী। সে তার ভিতর ঢুকবেনি।

মুরগিদের খাবার দিইয়ে বিকেলে এক গ্লাস জল খেয়ে তক্তপোশে শুয়ে পড়ল অলোকানন্দা। দূর থেকে ভেসে আসছে হরিনাম। তিনদিনের অনবরত সংকীর্তনের শেষ দিনে যেন কথকও ক্লান্ত। সুকুমারী একদিন কথায় কথায় তাকে বলছিল কৃষ্ণেন্দুর জগতকে চিনতে। যে ছোট্ট গোপালকে সে তিলতিল করে এতো বড় করে তুলেছে সে, তাকে আবার নতুন করে চিনতে কেমন ভিতরভিতর ভয় লাগে অলোকানন্দার। অদ্বৈত গোঁসাইয়ের বলা এই কথাকাহিনী সে প্রথম শুনেছে সুকুমারীর মুখে।একদিন মা যশোদা কৃষ্ণর মুখের ভিতর ব্রহ্মাণ্ড দেখে মূর্ছা গিয়েছিলেন।সেকথা সে কাঁথায় সেলাই করেছে তার নিজের মতো করে। এখন মাঝেমাঝে ভয় হয়।সেও যদি অমন মূর্ছা যায়!সে তো আর মা যশোদারাণী নয়।
এইসব ভাবতে ভাবতে অলোকানন্দা উঠে পড়ল। পাশের ঘর থেকে শাশুড়ি মায়ের বুকের ভিতর থেকে সাঁইসাঁই শব্দ আসছে। বসিয়ে দিতে হবে খাটে। বালিশ গোজ করে আধবসা করিয়ে তার মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে দিল অলোকানন্দা। আহা। দুই ছেলে এভাবে চলে গেল। এই দুঃখ তাদের অভাগা মা সইবে কীকরে? কথা বন্ধ হয়েছে আগেই। কিন্তু দুই চোখের কোণা দিয়ে চোখের জল পড়া বন্ধ হয়নি। সেই জল গোকুলঘরিয়ার উত্তর সীমানায় বয়ে যাওয়া শুকনো ময়নাসোঁতার মতো। তার চলন নিস্তব্ধ। কিন্তু তার সেই চলনকে উপেক্ষা করা যায় না কিছুতেই। মাকে বসিয়ে কি মনে হল অলোকানন্দার। মোবাইলটা ওভাবে খোলা ফেলে আসা ঠিক নয়।হাজার হোক কষ্টর পয়সায় কেনা।জীবনের প্রথম কামাই। আশপাশে চোর ছ্যাচোড়ের কমতি নেই। পাশেই ঘন বাঁশবন। সেটুকু টপকে এলেই অলোকানন্দাদের ঘর। আজকাল বেপাড়ার দু একটা ছেলে উৎপাত করছে খুব। মুরগি ছানা চুরি করতে আসে। অলোকানন্দা তাদের সঙ্গে একা পেড়ে ওঠে না। বুক ঢিবঢিব করে। জানলার কবাট তুলে ভিতর থেকে ‘কে রে কে রে’ হাঁক পাড়ে শুধু। মোবাইলটা ঢুকিয়ে রাখতে সে পাশের ঘরে এসে কৃষ্ণেন্দুর কাঠের দেরাজটা খুলে ফেলল। দেরাজের প্রথম খোপেই একটা বাক্স।সেই বাক্সে মোবাইলটা রেখে দিল সে।তারপর ছেলের জামা প্যান্টগুলো গুছিয়ে রাখতে রাখতে নাকের কাছে এনে গন্ধ নিতে লাগল। মনে হচ্ছিল এই কৃষ্ণেন্দু যেন সেই বাচ্চাবেলার দিনের মতোই তার মাতৃস্তনের জন্য কেঁদে চলেছে অনবরত। চোখ মুছে অলোকানন্দা নিচের তাকে কৃষ্ণেন্দুর আঁকা ক্যানভাস পেপারের শিটগুলো বিছানায় পেতে রাখল। এক এক করে পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে আবার তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল।ক্যানভাসপেপারের ছবিগুলো যেন তার সঙ্গে কথা বলছে। ওই তো পাশের বাঁশঝাড়ের গাছগুলো। তার সঙ্গে ফিসফিস করে বলছে কতোকিছু। তারপর কালিধরা রান্নাঘরের অ্যালুমিনিয়ামের হাড়িটা। কলপাড়ের পাশে কৃষ্ণচূড়া গাছ। দেখতে দেখতে হঠাৎ শিউরে উঠল অলোকানন্দা। প্রথম কাগজগুলোর নীচে কয়েকটা রাফ খসরা রয়েছে। সেখানে নানান ভঙ্গিতে বসে থাকা নারীশরীর। নগ্ন। কখনও দুই হাঁটুর ভিতর মাথা গুঁজে অপেক্ষারত। কখনও বা উদাস চোখে বাইরের ধানখেতের দিকে তাকিয়ে থাকা। পেনসিল স্কেচ। ছবিতে মেয়েগুলোর মুখাবয়ব একরকম। ভারি চতুর।রহস্য ভরা।অল্প বয়স। তবে কি এই মেয়েটিই সহেলী! বুকের ভিতর ঢিবঢিব করতে শুরু করে দিল তার। এ সে কীই দেখল! আর্টিস্ট বনতে গেলে এমন নির্লজ্জ বনতে হয় জানতোই না অলোকানন্দা। এই কথা সে এখন কাকে জানাবে! ভাবতে ভাবতে অলোকানন্দা তক্তপোশের একপাশে কোলের ভিতর মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে আবার কাঁদতে লাগল। সেই শব্দ গোকুলঘরিয়ার কেউই শুনতে পেল না।

//তিন//
“কলেবরং পরশুভিশ্চিত্ত্বা তত্তে ব্রজৌকসঃ। দূরে ক্ষিপ্তাবয়বশো ন্যদহন্ কাষ্ঠবেষ্ঠিতম্ ।।”শ্রীমদ্ভাগবতম/স্কন্ধ ১০/অধ্যায় ৬/ ৩৩//
(ব্রজবাসীরা পুতনার বিশাল দেহ খণ্ড খণ্ড করে কেটে আলাদা কাঠে রেখে জ্বালিয়ে দূরে নিক্ষেপ করছিল।)

বড় হলঘরটার এক কোণে টুলের ওপর আলো ফেলা হয়েছে। স্কেচশিট ইজেলবোর্ডে রেখে চারকোল দিয়ে আঁকছিল কৃষ্ণেন্দু। টুলের উপর বসা মহিলাটি সামান্য ঝুঁকে রয়েছেন সামনে। এই ঝুঁকে যাবার ফলে তার স্তন সামান্য নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে উঠছিল। সেই প্রবণতা তিনি সুদক্ষভাবে তাঁর বাম হাতের কনুই দিয়ে সংযত করেছেন। তার হাঁটু মুড়ে বসেছেন টুলের উপর। তাঁর নিটোল নগ্ন উরুসন্ধিতে আলো আঁধারি একস্দ্ভুত রহস্যময় লাইট অ্যাণ্ড শেড তৈরি করেছে। মহিলাটিকে কৃষ্ণেন্দু এই গেল কয়েক সপ্তাহের ওয়ার্কশপে চিনেছে। ওনার নাম অতসীদি। পদবী জানে না কেউ।সকলে অতসীদিই বলে। দীর্ঘ ছয় বছর এই আর্ট কলেজে অতসীদি ন্যুড স্টাডির মডেল হচ্ছেন। প্রথম যেদিন এই ক্লাসে কৃষ্ণেন্দু ছবি আঁকতে বসেছিল, তার হাতে আঙুল উত্তেজনায় কাঁপছিল। এমন উন্মুক্ত নগ্নতা সে আগে কখনও দেখেনি। গোকুলঘরিয়ার পুকুরঘাটে আলুথালু বেশে স্নানরতা নারীশরীরের ভিতর সে কখনও নগ্নতা খোঁজেনি। কারণ সেই নারীপুরুষের ভীড়ের ভিতর তার মা অলোকানন্দাও ছিল। বরং কৃষ্ণেন্দুর জীবনে নগ্নতা অনেক বেশি করে আরক্ত করেছিল গোকুলঘরিয়ার ‘শ্রীরামকৃষ্ণ পাঠাগার’। সেইখানে বিকেলে স্কুলফেরত সে পড়তে শুরু করে সমরেশ বসুর ‘দেখি নাই ফিরে’। বালক রামকিঙ্করের চোখে দেখা সেই অভূতপূর্ব বর্ণনা।বইয়ের পাতায় পাতায় সেই পূর্বগামিনী গন্ধেশ্বরীর উত্তরের বালুচরে কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গে পরিচয় হয় নগ্নতার। আদুরে গা ভিজে টপটপ করে জল চুঁইয়ে পড়ছে নীচে। আকাশের রক্তাভ ছটায় ওদের মেদহীন নাভিস্থল, উদ্ধত নম্র বুক, ক্ষীণ কটি, গুরু নিতম্ব কৃষ্ণেন্দুকে রঙ চেনাত। ভারি সুন্দর লিখেছিলেন কথক।’কঠিন শ্রম দিয়ে গড়া ওদের শরীর। শ্রমই দিয়েছে লালিত্য। দিয়েছে ঔদ্ধত্যের শ্রী।’পড়তে পড়তে কৃষ্ণেন্দুর মনে হতো ঠিকই বলেছিলেন রামকিঙ্কর। প্রকৃতির প্রতিটি অনুভূতি, আরক্তভাবের ভিতর কোথাও না কোথাও কোনও না কোনও রঙ নিবিষ্ট হয়ে আছে। সেই রঙ গন্ধেশ্বরীর উপতটে মানসচক্ষুতে দেখা বোনো শালুকের পাতায় দেখতে পেয়েছিল কৃষ্ণেন্দু। সেই রঙ গোকুলঘরিয়ার ঘাটজুড়ে নেই কোথাও। তারপর বহু বছর পর একদিন পড়ানোর সময় বেনভেন্টো সেলিনির কথা বললেন সুদাম স্যার। সেলিনির কথা অনুযায়ী মানুষের দেহই হল পৃথিবীর সবচেয়ে নিখুঁত ‘ফর্ম’। সেলিনির কথা বলতে বলতে সুদামস্যার সেদিন ক্লাসে পড়াতে পড়াতে হঠাৎই চলে গিয়েছিলেন বৈষ্ণব দেহতত্ত্বে।
-নগ্ন মডেলের সঙ্গে শিল্পীর মিলন আবশ্যিক। মিলন নাহলে নগ্নতা নগ্নতা থেকে যায়। তার ভিতর পূজার্চনার বিভা ফুটে ওঠে না।
কিন্তু সে মিলন কেমন? কৃষ্ণেন্দু জার্নালে পড়েছিল পাবলো পিকাসোর কথা। শিশুর মতো ছবি আঁকতে আঁকতে পিকাসো নাকি তার আটজন ন্যুড মডেলের সঙ্গেই সম্ভোগ করেছিলেন। তেমন সম্ভোগ কি আবশ্যিক?সেদিন সুদামস্যার বলছিলেন।
-সে সম্ভোগ ক্ষণিকের। শিল্পীর মিলন হবে রাধারাণীর বিপ্রলব্ধ শৃঙ্গারের মতো ।সেখানে পূর্বরাগ সাদা ক্যানভাসে আউটলাইনিং বা লে আউট। মান প্রাথমিক গ্রাফাইট বা চারকোলের স্কেচ। প্রেমবৈচিত্র্য রঙ বা আলোছায়া। আর মাথুর হলো ফিনিশিং।

কৃষ্ণেন্দু এই শব্দগুলো ভাসাভাসা শুনেছিল মায়ের কাছে। গ্রামের অদ্বৈত গোঁসাই আর শচীমাতা নাকি এসব বলে। কে জানে আর্ট কলেজের রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত সুদাম গোস্বামীও আসলে মনে মনে বিষ্ণুউপাসক কিনা! কিন্তু সেইদিনকার ক্লাসের পর অতসীদির নগ্নতা আঁকতে গিয়ে কৃষ্ণেন্দুর হাত আর কাঁপেনি।
-কী রে? কতো দূর।
দুই হাত দূরে ইজেলের আড়াল থেকে কৃষ্ণেন্দুর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল সহেলী। তার আঁকা প্রায় শেষ। আঁকায় বেশি রেখা ব্যবহার করে না সে। অন্যদিকে কৃষ্ণেন্দুর পছন্দ ডিটেলিং। অতসীদির পিঠ বেয়ে উরু বেয়ে যে ঘামের রেখা ফুটে উঠছে, সেটা সে তার স্মাজ পেনসিল দিয়ে ধরতে চাইছিল।
-এই তো। আর একটু।
-জলদি কর।এখন না বের হলে ছটা আঠাশ পাবো না কিন্তু।
কৃষ্ণেন্দুদের ক্লাসে মোট বারুজন শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে শ্রাবন্তী সবচেয়ে ভালো আঁকে। দ্রুতও। এইটুকু সময়ে সে তার ছবিতে ফিগারের স্তনের নিচের পাঁজরের রেখা, চুলের আড়ালে ঢেকে যাওয়া চোখে লুকিয়ে থাকা সামান্য উৎকণ্ঠা ফুটিয়ে তুলতে পেরেছে। সেইসব দেখে সুদামস্যার বলল,”সবাই দেখ। এটাই হচ্ছে পেইন্টিং। ছবি কথা বলবে তোমার সঙ্গে। ”
ক্লাস শেষ হলে অতসীদি পাশে ভাঁজ করে রাখা একটা সাদা চাদর জরিয়ে উঠে যায়। ঠিক সেই মুহূর্তে তার গালে গোলাপী আভা ফুটে ওঠে। কৃষ্ণেন্দু প্রতিদিন এইসময়টুকু বিভোর হয়ে দেখে তাঁকে। সে দৃশ্য অবশ্য সহেলীর নজর এড়ায় না।শিয়ালদা স্টেশনের নয়ের এ প্ল্যাটফর্মের দিকে যেতে যেতে সহেলী জোরে কৃষ্ণেন্দুর বাম হাতে চিমটি কেটে দিল।
-খুব মজা?না তোদের পুরুষমানুষদের?
-কেন? আবার কী হলো?
-শরীর মানেই তো শুধু নারী।তাই তো?রোজ তোরা অতোগুলো ধেড়ে ধেড়ে ছেলে অতসীদির শরীরটাকে গিলে গিলে খাস। বেশ মজা পাস। তাই না?
-কেন? তোরা আঁকিস না বুঝি?এতে মজার কী আছে? এটা তো স্টাডি। সিলেবাসে আছে।
-শুধু মেয়েমানুষের শরীর নিয়েই সিলেবাস?
তিন নম্বর কামরাটায় পিঁপড়ে গলার জায়গা নেই। কৃষ্ণেন্দু আর সহেলী চার নম্বর বগিতে কোনওরকমে উঠে পড়ল।

নতুন গ্রাম আসতে এখনও ঘন্টা দেড়েক। দরজার পাশে ধাতব ঝাঝরির উপর পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সহেলী। তাকে আগলে দাঁড়িয়ে ছিল কৃষ্ণেন্দু। ট্রেন চলতে শুরু করলেও ভিতরে বাতাস আসছে না তেমন। কৃষ্ণেন্দুর এই ঘর্মাক্ত ঘন্ধটা যেন মায়াধরানো। সহেলী দেখছিল একমনে। পুরুষ্টু পেকটোরালিস মিলিয়ে যাচ্ছে কৃষ্ণেন্দুর আলুথালু টিশার্টের বোতামের নীচে। দুই হাতের বাইসেপস আধফোটা রজনীগন্ধার তোড়ার মতো আগলে রেখেছে তাকে। ভাবতে ভাবতে আরক্ত হয়ে লজ্জায় চোখ বন্ধ করল সে।
-কী?
-কী কী?
-পারবি আঁকতে?
-কী আঁকতে?
-আনতোনেলা দে মেসিনার মতো সেন্ট সেবাস্তিয়ান আঁকতে?
-সেন্ট সেবাস্তিয়ান কে হবে শুনি?
-আমি হলে?
-অতসীদির মতো?
-জো হুজুর। সবাই দেখবে কিন্তু।
-না।
-কী না?
-সবাই দেখবে না। শুধু আমি দেখব।
-পিকাসোর মতো করবিনে তো?
-টিপিকাল গাই অ্যাটিটিউট। করলেও তো আর কি।
-না। সত্যিই বলছি।আঁকবি আমায়।
নতুনগ্রামে নেমে পড়ল কৃষ্ণেন্দু। আজ গোকুলঘরিয়া ফিরতে কেন জানি মন করছে না। কিন্তু উপায় নেই। একসঙ্গে দেখলে সহেলীর বাবা সনাতনকাকার কাছে খবর চলে যাবে। আধা ঘণ্টা পরে পরের ট্রেন। মার কথা একবার ভেবেই অভিমানে সেই দৃশ্য সরিয়ে দিল কৃষ্ণেন্দু।
-আমি তোকে আঁকতে চাই কৃষ্ণেন্দু। নগ্ন।
-বেশ। আঁকিস।
-তুইও আঁকবি আমাকে। বল।
-আঁকব।
স্টেশনে ফুটকরাইয়ের দোকানে দশ টাকার ছোলাভাজা খেতে খেতে হঠাৎ কৃষ্ণেন্দু বলল।
-আমার শরীরের সঙ্গে আমার গলায় বাম পায়ে বিদ্ধ হয়ে থাকা তিরগুলোকেও ভালো করে আঁকিস সহেলী।
-কেন এমন বলছিস কৃষ্ণেন্দু?
-সেন্ট সেবাস্তিয়ান দেখেছিস সহেলী?
-না। দেখিনি তো।
-আজ ঘরে গিয়ে দেখিস। আমার জন্য আরও কয়েকটা বিষতির রেখে দিস আলাদা করে। যন্ত্রণা কমবে।
সহেলী বলে না কিছু। বাবা নেই কৃষ্ণেন্দুর। সে জানে সে কথা। ওর জীবন তার নিজের জীবনের মতো সরলরেখায় আঁকা নয়। হঠাৎ খুব জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে করছিল তার,”তুমি কিচ্ছু ভেবো না কে
কৃষ্ণেন্দু। আমি আছি তো। তোমার সব বিষতির বুক পেতে সয়ে নেব আমি।”কিন্তু বাস্তবে তা সে বলতে পারল না। শুধু বলল।
-চল। কাল দেখা হবে। ঘোষণা হয়ে গেছে। ট্রেন ঢুকছে তোর।
সহেলী চলে যেতেই বিপ্রলব্ধ রাধার মতো কৃষ্ণেন্দু প্ল্যাটফর্মের প্রান্তে জ্বলে থাকা লাল সিগনালটার দিকে তাকিয়ে রইল।

//চার//

“একোহপাস্যৌ রচয়িতুং জগদণ্ডকোটিং/ যচ্ছক্তিরস্তি জগদণ্ডচয়া যদন্তঃ।অণ্ডান্তরস্থপরমাণুচয়ান্তরস্থং/ গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি//” (ব্রহ্মসংহিতা; ৫/৩৫)
(ভগবান তার পরমাংশে শতসহস্র ব্রহ্মাণ্ড রচনা করার পরেও তার ভক্তর বশ।ধরা পড়তে না চাইলেও মা যশোদা অনায়াসে তাকে ধরে ফেলেন। সে শক্তি মাতৃত্বপ্রেমের।)

অলোকানন্দার হাতের আঙুল স্পর্শ করেই থমকে গেল সুকুমারী। ভিতরভিতর অলোকানন্দা তিরিতিরি কাঁপছে। গোকুলঘরিয়ার গোঁসাইবাড়িতে জনা কুড়ি ভক্তমণ্ডলীকে নিয়ে গান শোনাচ্ছেন অদ্বৈত গোঁসাই। মাঝেমাঝে কথা বলছেন।
-কৃষ্ণ পাওয়া বড় সহজিয়া পথ। বুঝলে দিদিভাইয়েরা। শ্রীমদ্ভাগবতম বলছে “এবং সন্দর্শিতা হ্যঙ্গ হরিণা ভৃত্যবশ্যতা।
স্ববশেনাপি কৃষ্ণেন যস্যেদং সেশ্বরং বশে।” সমগ্র জগত যার বশীভূত, সেই কৃষ্ণ তোমার বশীভূত হবেন, যদি তুমি তার ভক্ত হয়ে ওঠো।
অদ্বৈত গোঁসাইয়ের পাশেই একতারা হাতে গেরুয়াথান পরে বসে রয়েছেন এক মধ্যবয়সী রমণী। হঠাৎ তার চোখদুটি দেখলে মনে হবে সরোবরে যেন একজোড়া পদ্মফুল ফুটে রয়েছে। ওই মহিলাকে গোকুলঘরিয়ার মানুষ শচীমাতা বলেই চেনে। অদ্বৈত গোঁসাইয়ের সাধনসঙ্গিনী। আজ বিকেল বিকেল অলোকানন্দাকে জোর করেই এখানে নিয়ে এসেছে সুকুমারী।
-গোঁসাইবাড়িতে গেলে তোর মন শান্ত হবে। চল।
সমবেত ভক্তের ভিতর অলোকানন্দা ছাড়াও আরও একজন নিঃশব্দে হাপুশনয়নে কাঁদছিল।তার কপালের সিঁদুর টিপ ধেবড়ে যাবার পরেও এক অপূর্ব লালিমা দিয়েছে যেন। ভিতরের পুঞ্জীভূত জ্বালা উনুনের আঁচের মতোই বের হয়ে আসছে সেই লালিমার ভিতর। সুকুমারী চেনে ওকে। ওর নাম সুলোচনা। রণজয় সেনের ঘরের লোক। অদ্বৈত গোঁসাই বলছিলেন।
-আমাদের শরীরের ভিতরেই লুকিয়ে আছে যোগীদেহের চার চক্র। বৌদ্ধরা তেমনটাই বলে। আর আমরা বলি ত্রিবেণী। ইড়া-পিঙ্গলা-সুষুম্না। সুষুম্না পথে অবধূতিকা। তাকে উর্ধ্বপথে চালনা করলে অধরচাঁদ।
অতোসতো বোঝে না অলোকানন্দা। অতো সব শক্ত শক্ত শব্দ শুনলে তার মাথা ভনভন করে। সুকুমারী তাকে বলে এনেছে যদিও। ‘ওখানে গিয়ে ঘরের কথা কিছু ভাববিনি। সব ভুলবি কিছুক্ষণের জন্য।’ বলেছে বটে। তবু অদ্বৈত গোঁসাইয়ের কথা শুনতে শুনতেই ঝলকদর্শনের মতো তার মনে পড়ে যাচ্ছে শাশুড়ির সন্ধ্যার বড়ি দেবার সময় হয়ে এল। কৃষ্ণেন্দু ফিরল না এখনও। আজ রাতে মোহনপোলাও করলে কেমন হয়! আর ওই ছাউনির ভিতর মুরগীছানাগুলো ! অদ্বৈত বলে চলে।
-বৌদ্ধমতে যা বোধি, বাউলমতে তা অধরচাঁদ। মিলনের সময় তাকে একঝলক অনুভব করা যায়। কুবীর কী বলে জানো? শোনো তবে মা বোনেরা।
গোঁসাই সুর ধরে। শচীমাতা একতারায় তান ধরে। দুজনের কপালেই বিন্দুবিন্দু ঘাম। ছিলা অছিলায় দুজনের ত্বক স্পর্শ করছে একে অপরকে। আর ভিতর থেকে শিউড়ে উঠছে অলোকানন্দা। একবার কারেন্ট খেয়েছিল সে মুরগীখানার তারে। অজান্তে তারের ভিতরের তামা বের হয়ে গিয়েছিল হয়তো। বুঝতে পারেনি। এই শিউড়ে ওঠা অনেকটা সেইরকম। কে যেন ভিতর থেকে ডুকড়ে কেঁদে উঠছে। কচিশিশুর মতোই যেন বলে উঠছে তার ক্ষিদে পেয়েছে। একী অলুক্ষুণে কথা! একথা বলতে আছে। ভাবতে ভাবতেই তিরি কেঁপে উঠছে সে। গোঁসাই গাইছেন।-নাভি পর্দ্দ পাদ পদ্দ হৃদি কর পদ্দ আছে আর মুখপদ্দ পদ যুগল নয়নে। আর রয়েছে প্রফুল্লপদ্দ ব্রহ্ম রন্দ্র সহস্রারে…
অলোকানন্দা দেখল সুকুমারীর চোখে জল। গোঁসাই উঠে দাঁড়িয়ে ঘুরে ঘুরে গাইছেন, ” যে অধর সেই তো হরি, ভাবঘরে নেই করতে চুরি, ধরতে অধরচাঁদ।”
অদ্বৈত গোঁসাইয়ের বাঁধনদাররা খোল করতাল মৃদঙ্গ সহযোগে ততক্ষণে গোঁসাইবাড়ি আনন্দে মাতোয়ারা করে তুলেছেন। ভক্তরা একে একে উঠে নাচতে শুরু করেছে। সুকুমারী অলোকানন্দার হাত ধরে টেনে বলল,”ওরে চল। নাচবি চল।” ‘উঠব না উঠব না’ করেও উঠে পড়তে হল তাকে। সুকুমারীর আঁচল খসে পড়ছে। আলুথালু ভিতরবাসে উঁকি দিচ্ছে শরীর। তবু তার ভ্রুক্ষেপই নেই। গোঁসাই বলে চলেছেন, “অধরচাঁদ রে আমার বালক কৃষ্ণ। ওর কাছে সবাই বশ। ত্রিবেণীসঙ্গমে।” অলোকানন্দা দেখল সুকুমারী একা নয়। সমবেত ভক্তবৃন্ত আলুথালু বেশে মৃদঙ্গের তালে তালে দুই হাত তুলে ‘হরিবোল’ ধ্বনি তুলে নেচে চলেছে।নারীপুরুষ কারোর কোনও হুঁশ নেই যেন।নেশাগ্রস্থর মতো ভেসে আসছে কৃষ্ণধ্বনি। গোঁসাই গাইছেন,”চরণে নূপুর দিলা তিলক কপালে।
চন্দনে চর্চিত অঙ্গ রত্ন হার গলে।” সকলে নাচতে নাচতে ঘুরে চলেছে ঘূর্ণায়মান ব্রহ্মাণ্ডের মতো।অলোকানন্দাও সামান্য হাত তুলেই নামিয়ে আনল। তার লজ্জা করছে। এমনটা সে আগে কখনও করেনি তো। কেমন যেন মনে হচ্ছে তার দুই হাত তুলে ধরলে সে কৃষ্ণেন্দুর হাত ধরবে কীকরে। যদি ছেলেটা বলে বসে,” মাগো আমার। ভয় করছে গো। হাত ধরো গো।”
হাত নেমে আসে ছোট্ট গৌড়ের জন্য। আর ঠিক সময় গোঁসাইবাড়িতে একটি অঘটন ঘটে গেল। তুলসীমঞ্চর দিকে যে জনা সাতেক সংকীর্তন করছিলেন তারা হঠাৎ নাচ থামিয়ে মৃদু গুজগুজ করতে শুরু করলেন। সে দৃশ্য দেখে অদ্বৈত গোঁসাই আর শচীমাতা গান থামিয়ে দিলেন। জটলার ভিতর অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে আছে সুলোচনা। রণজয় সেনের বৌ!

ঘটনার আকস্মিকতায় হঠাৎই সংকীর্তনে ছেদ পড়ল। গোঁসাইবাড়ি থেকে অলোকানন্দার ঘর পায়ে হেঁটে মিনিট কুড়ি। অন্ধকার সে পথে একটি বাঁশবন ও আমবাগান পড়ে। সারা সকাল ওই রাস্তায় ট্রেকার দাপাদাপি করলেও সন্ধ্যা নামলেই ও পথে আর কেউ সচরাচর যাতায়াত করে না। ট্রেকার চলাচলও বন্ধ হয়ে যায় ছটার পর। আমবাগানের জায়গাটা রহস্যে ঘেরা। গ্রামের ছোট ছোট মুদীচাদোকানের জটলায় কান পাতলেই শোনা যায় নানান জাগতিক অতিজাগতিক গুজব। কেউ কেউ বলে ওই আমবাগান অভিশপ্ত। মাস তিনেক আগে একটা ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করেছিল পুলিশ। লাশের মেয়েটির বয়স মেরেকেটে চোদ্দ। পুলিশ প্রমাণ অভাবে ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিলেও গ্রামের মানুষের মন তাতে ভরেনি। লাশে তখনও টাটকা পাটভাঙা স্কুলের নীলসাদা পোশাক। মুখে আঘাত চিহ্ন। অত্যাচারের চিহ্ন সারা দেহে। মেয়েটা মা মরা ছিল। বাপ কাজ করত কাঠের কারখানায়। একমাত্র মেয়েকে ডাক্তার বানানোর স্বপ্ন দেখেছিল। মেয়েটা মরে যাবার একসপ্তাহ কাটতে না কাটতেই বাপটা বিষ খেয়ে মরল। তারপর থেকেই আমবাগানে কারা যেন ঘোরাফেরা করছে আজকাল। কেউকেউ বলে অসামাজিক কাজকর্ম। কেউ বলে অতৃপ্ত আত্মা। এইসব ভাবনা নিয়ে অলোকানন্দাকে একলা ছাড়তে মন করল না সুকুমারীর।
-চল তোকে ঘরে ছেড়ে দে আসি।
-কী বলো সুকুমারী মাসি। তোমাকেও তো ফেরতে হবে। চিন্তা করো না। আমি ঠিক পৌছে যাব।
-মেলা বকিসনে তো। চল।
অন্ধকারে দুজনেই দুজনের হাত ধরে চলতে থাকে। কথা বললে আত্মারা ভয় পা। পা থপথপ করে পথে ফেললে সাপখোপ আসে না তেমন।
-কী হলো গো ওই বৌটার মাসি?
-কার?ওই সুলোচনা মাগীটার? নাম খানা কী বাহারে গো। কিন্তু যেমন দ্যাবা। তেমনি দেবী। বরটাকে তো তুই হাড়ে হাড়েই চিনিস।
-কে গো ওর বর?
-হা কপাল। তাও জানিস না। ওর বর রণজয় সেন। অবশ্য না চেনারই কথা। বরডা তো আসলে একটা জানোয়ার। বৌডাকে শিকল পরিয়ে রেখেছে যেন। ঘর থেকে বার হতেই পারে না।
-শিকল?
রণজয় সেনকে অলোকানন্দা পছন্দ করে না তেমন। কিন্তু তার বৌটার জন্য হঠাৎ মনের ভিতর মায়া বসছিল তার। কোথায় যেন একটা কোনও সূক্ষ্ম যোগাযোগ আছে। নামখানাও তো ভারি সুন্দর। তার নামের মতোই অমন সুন্দর নাম এই হাঘরে গ্রামেগেঞ্জ নেহাতই বেমানান। সুকুমারী কৌতূকে খিলখিল করে হেসে ওঠে।
-ওরে এ শিকল কি সে শিকল নাকি? পুরুষমানুষের শিকল হলো তার খোরপোষ। আর মাইয়া মানুষের তার সন্দেহ।
-রণজয় সেন ওকে খেতেপরতে দেয় না?
-দেয় বৈকী। কিন্তু শুধু খেতে দিলেই হলো। মেয়েমানুষের শরীর। আর কিছু চায় না বুঝি। একটু সোহাগ। একটু মিঠে কথাও ঘরের ভিতর জোটে না হতভাগীর।
-বলো কী!
আমবাগানের ভিতর ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভিতর সুকুমারী আর অলোকানন্দা একে অপরকে জাপটিয়ে ধরে ভয় ভুলতে চায়। হঠাৎ পায়ের কাছে কটকটিপোকা ডেকে ওঠে। পায়ের পাশে আলকুশিপাতা লেগে সামান্য কুটকুট করে ওঠে সুকুমারীর।
-গেল বছর ফিনাইল খেয়েছিল হতভাগীটা। রণজয় সেন খবরটা পাঁচকান না করলেও আমি জানি। আমার ডাক পড়েছিল ওর হাগামোতা পরিষ্কার করার জন্য।
-তারপর?
-তারপর আর কি? ও মেয়ের জান কৈমিছের জান।সহজে যাবেনি। বেঁচে গিয়ে এখন বোষ্টমী হয়ে ভুলে থাকতে চাইছে।
-কিন্তু কেন গো মাসি?
-ও রণজয় লোকটার থেকে দূরে থাকিস। লোকটার চরিত্র ভালো না। শহরে ওর মাগী ধরা আছে। গোকুলঘরিয়ার কেউকেউ বলে সে মাগীকে ফ্ল্যাট, গাড়ি কিনে দিয়েছে। একজোড়া যমজ মেয়েও নাকি আছে।
-কী বলো গো?
বুকের ভিতর ঢিবঢিব করতে থাকে অলোকানন্দার। আমাবাগান শেষ হয়ে যাবার পরেও যেন সে ভয় কাটতেই চায় না। লোকটার চাহনি ভালো না। হোক অরিন্দমের বন্ধু। সে নিজে একজন মেয়েমানুষ। সে বোঝে। খুব বোঝে। সুকুমারী বলে চলে।
-তাছাড়া কেউকেউ বলে ওই লোকটার নাকি মেয়েছেলের ব্যবসা আছে শহরে। কীসব ‘অ্যাপ ট্যাপ’ না কি যেন। মোবাইলে খুটখুট করবে আর মেয়েছেলে চলে আসবে তোমার বিছানায়। পুরো আলুকুমড়োর মতো।
মাথা ভনভন করছে তার। একবার কথায় কথায় বলেছিল বটে তাকে লোকটা। শহরে যাবার কথা। শহরে নাকি অনেক কাজ। ভাগ্গিস সে যায়নি। রাধামাধব বাঁচিয়ে দিয়েছে।
কথা বলতে বলতে ঘরের কাছাকাছি চলে এসেছে দুজনেই। রাস্তায় সোলার আলো জ্বলছে। কিন্তু অলোকানন্দার ঘর ঘুটঘুটে অন্ধকার। খুব ছোটবেলায় মাসিদের কাছে শুনতো সে। দাদু নাকি অমন শক্ত নাম দিয়ে বলেছিল,”দেখিস তোরা। ও মেয়ে শুধু নামের জোরেই সব অন্ধকার মিটিয়ে দেবে।”
-আমি বাকি পথ একা ফিরতে পারব মাসি। তুমি চিন্তা করো না।
ঘরে ঢুকে অলোকানন্দা দেখল অন্ধকার শাশুড়ির ঘর থেকে ‘ওঁ ওঁ’ আওয়াজ ভেসে আসছে। আহা। অন্ধকারে মানুষটা বাথরুম করে ফেলেছে। তারই ভুল। তবু যেন ভিতরটা কেমন খিটখিট করে উঠল তার। ঘরের আলোগুলো জ্বালাতে জ্বালাতে আপনমনে বিড়বিড় করতে করতে শাশুড়িকে মেঝে থেকে টেনে বিছানায় তুলল সে। তারপর ন্যাতা নেড়ে নেড়ে মেঝে পুছতে পুছতে ভাবতে লাগলো। ঘড়ি না দেখতে জিনলেও রাতের ঘনত্ব সে বোঝে। ট্রেনের আওয়াজে বোঝে শেষ ট্রেন যেতে আর মোটে দুই ভোঁ বাকি। এখনও ছেলেটা ঘরে ফিরল না। কীভাবে আগলে রাখবে সে ছেলেটাকে। চারপাশে রণজয় সেনের মতো লোক। তার বৌ সুলোচনা হতভাগী হলেও সেও কী কম? যদি কৃষ্ণ ওই কী যেন মোবাইল খুটখুটের পাল্লায় পড়ে! মেয়েছেলের অমন ছবি বাপের জন্মে সে কারোকে আঁকতে দেখেনি বাপু। ঘা ঘিনঘিন করে ওঠে তার। ছবির পাতায় কৃষ্ণেন্দুর করা স্কেচগুলো হঠাৎ মনে পড়ে গেল তার। মনে পড়তেই মনে হলো সেও কেন ওই বৌটার মতো মূর্চ্ছা গেল না।

//পাঁচ//

“তং দৃষ্ট্বা ব্রীড়িতা দেব্যো বিবস্ত্রাঃ শাপশঙ্কিতাঃ।
বাসাংসি পর্যধুঃ শীঘ্রং বিবস্ত্রৌ নৈব গুহ্যকৌ ।।” (শ্রীমদ্ভাগত
বত,স্কন্ধ ১০,অধ্যায় ১০,শ্লোক ৬)
(নারদমুনিকে হঠাৎ দেখতে পেয়ে নগ্ন দেবকন্যারা লজ্জিত হলেন। অভিশাপের ভয়ে তড়িঘড়ি পরিধান পরে নিলেন। কিন্তু কুবেরের দুই পুত্র অবিচল থাকলেন। তারা বস্ত্রও পড়লেন না। বিচলিতও হলেন না। তাই তাদের ভাগ্যে জুটল অভিশাপ। সেই অভিশাপ বালক কৃষ্ণর এক অবিস্মরণীয় লীলার ভীত স্থাপন করল।)

কৃষ্ণেন্দু ঘুমিয়ে পড়েছিল। প্রথমে ভেবেছিল জেগে থাকবে। মা এতো রাতে কোথায় গেছে কে জানে! ওই আমবাগানের দিকটা কেমন যেন গা ছমছম করা। ভয় করে। ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমের ভিতর সে দেখতে পেল ঘাসজমি। মাইলের পর মাইল। অমন ঘাসের মাঠ কোনও একসময় দাদু বলত, ওপার বাংলায় ছিল। এই ঘাসজমি সে দেখেছে কলেজে আধুনিক ইয়োরোপীয় তৈলচিত্রে। সেই ঘাস জমি বেয়ে দৌড়ে আসছে একদল সাদা ঘোড়া। তাদের উন্মুক্ত পেশীবহুল পা। দৃপ্ত চলন। তুষার ধবল সেই ঘোড়ার দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছে যে ঘোড়াটি, তার মুখাবয়ব কৃষ্ণেন্দু স্পষ্ট দেখতে পেল না কিছুতেই। ঘোড়াগুলি গ্রামের পথ বেয়ে শহরে ঢুকে আসছে। রেড রোড, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, মেয়ো রোড, এলগিন, কলেজস্ট্রিট রাস্তাঘাট শুনশান। কেউ নেই। শুধু একদল সাদা ঘোড়া। ধেয়ে চলেছে কোথাও। কোথায় কে জানে! ভাবতে ভাবতেই ঘুম ভেঙে গেল তার। জানলায় ভোরের আলো। সকাল হতে বেশি বাকি নেই। তড়িঘড়ি বিছানা থেকে নেবে হ্যাণ্ডমেড কাগজের একটা শিট বোর্ডে লাগালো কৃষ্ণেন্দু। তারপর চারকোল বের করে আঁকতে লাগল। ঠিক যেমনটি দেখেছে। ময়দান, শহীদ মিনার আর চওড়া রাস্তা। শুনশান। সেখানে দৌড়ে চলেছে একদল সাদা ঘোড়া। প্রথম ঘোড়ার ঘোড়সওয়ার আঁকতে গিয়ে থেমে গেল কৃষ্ণেন্দু। ঠিক এতোটুকুই তো সে স্বপ্নে দেখেছিল। কাগজে আঁকার সময় চারকোল হাতে নিলে তার আর আশপাশের দিকে কোনও হুঁশ থাকে না। আঁকা শেষ হতে সে দেখল নিঃশব্দে কখন যেন তার মা তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
-কী আঁকছিস এটা?
-জানি না। হঠাৎ ইচ্ছে হলো।
-ওহ। ভারি সুন্দর হয়েছে।
-ধুর। এটা তো একটা হিজিবিজি।
অলোকানন্দা চুপ করে যায়। সে জানে চিত্রকরকে ‘কেন আঁকছেন?’ বা ‘কী আঁকছেন?’ জিজ্ঞেস করা একধরনের বাতুলতা। তবু যেন কোনও অমোঘ প্রতিক্রিয়ার মোহে সে জিজ্ঞানা করে ফেলেছিল ।গতকালের দূরত্ব যেন আর নেই।
-কলেজ যাবিনে?
-যাবো তো।
কৃষ্ণেন্দু ধড়মড় করে উঠে পড়ে। আজ কলেজে যাওয়াটা খুব জরুরি। ফাইন আর্টসের ডিপার্টমেন্টাল হেড বসন্ত সমাদ্দার আজ ক্লাস নেবেন।এই সেমিস্টারের শেষে প্রোজেক্টের বিষয় বলবেন। গেল বছরগুলোয় এই বিষয়গুলি অদলবদল হয়েছে নানাভাবে। সিনিয়রদের মুখে শুনেছে কৃষ্ণেন্দু। এই প্রোজেক্টের নম্বর ফাইনালে যোগ হয়।
সকালে মাকে দেখে মন ভালো হয়ে গেল তার। মা ডাল ভাত মাছের ঝোল হাতে করে খাইয়ে দিয়েছে। কতো বছর বাদে। কলেজে যাবার পথে সাধারণত চতুর্থ কামরায় সহেলী ওঠে। কিন্তু আজ দেখা হলো না। সহেলী খি তবে আজ কলেজ যাবে না। ফোনে তেমন কিছু জানালো না তো! কলেজের গেটে পৌছে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল কৃষ্ণেন্দু। গেটের সামনে জটলা। ক্যামেরা, মোবাইল ফোন, সেলফিস্টিক নিয়ে পুলিশ, মিডিয়া আর মানুষের জটলা। বুকের ভিতর ছ্যাঁত করে উঠল তার। দুর্ঘটনা ঘটল কোনও? জটলার ভিতরেই উদ্বিগ্ন সহেলীকে আবিষ্কার করল সে। সঙ্গে তার ক্লাসের অন্যান্য ছাত্রছাত্রীরাও।
-কী হয়েছে রে?
-দেখ।
জটলা সরিয়ে সামনের দিকে এসে থমকে গেল কৃষ্ণেন্দু। জটলার ঠিক মধ্যিখানে অতসীদি ও আরও দুইজন সমবয়স্ক নারী ব্যানার হাতে গেট আটকে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁরা তিনজনেই নগ্ন। ব্যানারে লেখা, “আমাদের নগ্ন প্রতিবাদ”। এমন ঘটনা এর আগে কখনও প্রত্যক্ষ করেনি কৃষ্ণেন্দু। তিনজন নারীর চুল খোলা। সেই খোলা চুলে উন্মুক্ত স্তন খানিকটা ঢেকে আছে। প্রতিবাদ জানানো ভিনাইল ব্যানার কটিদেশ ঢেকে রেখেছে। উৎসুক জনতা উঁকি মারছে। কয়েকটা খয়েরি চুলের ফচকে ছেলে পাশ থেকে ফিকফিক করে টিটকিরি মারছে। কৃষ্ণেন্দু চোখ কটমট করে বিরক্তি আর রাগ প্রকাশ করতেই তারা সবে গেল। কিন্তু ব্যাপারটা কী? সহেলীকে জিজ্ঞেস করতে সে গম্ভীর হয়ে বলল, “ভিতরে চল। বলছি।”
অতসীদির সঙ্গের দুইজনের নাম শিখা নস্কর ও নমিতা সামন্ত। অতসী রায়ের মতোই তারা এই কলেজের ন্যুড মডেল।যদিও বাকি দুজনকে আঁকবার জন্য কৃষ্ণেন্দুরা পায়নি। দীর্ঘ কিছু বছর কাজ করবার পরেও তাদের মজুরি ঠিক মতো দিচ্ছিল না কর্তৃপক্ষ। টালবাহানা চলতেই থাকছিল। কিন্তু তাদের সেই সহ্যর সীমা অতিক্রান্ত হলো যখন কলেজের সিনিয়র অধ্যাপক সন্দীপন মণ্ডল দিনের পর দিন তাদের যৌন হেনস্থা করতে শুরু করলেন। এই সন্দীপন মণ্ডলকে কৃষ্ণিন্দু এর আগে দেখেছে। কষ্টিপাথরের মতো গায়ের রঙ। কপালে লম্বি চন্দনের তিলক পরে আসেন রোজ। গলায় কণ্ঠি। সুভাষগ্রাম থেকে আসেন। তার কাজ মূলত গ্রামীন বৈষ্ণবদের নিয়ে। মূলত পেন অ্যাণ্ড ইঙ্কে কাজ করেন। কৃষ্ণেন্দুর ওঁর কাজ ভালোই লাগত। কলেজের ঢোকার শুরুর দিকে একটা প্রদর্শনী চলাকালীন কথা বলেছিল যেচে গিয়ে। কথা বলে ভালোই লেগেছিল তার। ঠিক যেন মাটির মানুষ। এই মানুষ এমন কাজ করবেন ভাবা যায় না। অথচ অতসীদি মিথ্যে বলেন না। ওঁদের ওই প্রতিবাদ নির্ঘাত আগামীকাল সারা শহরজুড়ে খবরের প্রথম পাতায় উঠে আসবে। মণিপুরের ইম্ফলে যেমন হয়েছিল। সেদিন মণিপুরের বত্রিশজন মা নগ্ন হয়ে পথে নৈমেছিল আসাম রাইফেলসের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে। প্রতিবাদের ব্যানারে লেখা ছিল ‘ইণ্ডিয়ান আর্মি রেপ আস।’
সহেলীকে সন্দীপন মণ্ডল সম্পর্কে তার ধারণা বলতেই সহেলী গুম হয়ে বলল,”সব পুরুষমানুষই আসলে একরকম, জানিস কৃষ্ণেন্দু। ওরা শুধু শরীর বোঝে।”
-সবাইকে দায়ী করছিস কেন? তাছাড়া সিস্টেমও তো দায়ী। দিনের পর দিন মাইনে আটকে রাখা।
-ওই সিস্টেমটাও তো পুরুষতান্ত্রিক। মেয়েদের শরীরের দাম সেখানে কোথায়!
নারী পুরুষের এই সংঘাত কৃষ্ণেন্দু মন থেকে মানে না। কিন্তু সে বুঝতে পারছিল ভিতরভিতর সহেলী খুব বিচলিত রয়েছে। ক্লাসও তেমন হলো না আজ। শুধু বসন্ত স্যার তড়িঘড়ি এসে বলে গেলেন,”তোমরা প্রজেক্ট তৈরি করো। তোমাদের বিষয় হবে ‘প্রতিবাদ’।কাল পড়শু কলেজ হবে না। তোমরার সামনের সপ্তাহে এসে খসড়া দেখাবে।”
কলেজ ছুটি হতে গেটের বাইরে এসে কৃষ্ণেন্দু দেখল ভীড় সরে গেছে। অতসীদিরাও আর নেই। কীই হলো কে জানে! সারাটা রাস্তা সহেলী কোনও কথা বলল না তার সঙ্গে। ভাবখানা এমন যেন সব দোষ তারই। এই নিশ্চুপ থাকাই সহেলীর প্রতিবাদের ভাষা। কৃষ্ণেন্দু রেগে গেল না। বরং হঠাৎ সে আবিষ্কার করল রেগে গেলে সহেলীর চোখগুলো আরও বড় বড় দেখায়। সরোবরের মতো গভীর। সেখানে জল জমলে চাঁদের জোছনার মতো সেই জলকণা চিকচিক করে। ডুব দিতে ইচ্ছে হয়।নতুনগ্রাম স্টেশনে নেমে যাবার সময় সহেলী শুধু বলল,”বাই।” ট্রেন ছেড়ে দিল। কৃষ্ণেন্দু ভাবছিল অতসীদির কথা। তার ওই নগ্নতা তার দুর্বলতা নয়। শক্তি। নারীর নগ্নতা নারী নিজেই যখন স্বেচ্ছায় পণ্যবস্তু হিসেবে ব্যবহার করে, তখন সভ্যতা বড় অসহায় হয়ে পড়ে তার সামনে। এক্ষেত্রে কিন্তু অতসীদি তার নিজস্ব নগ্নতাকে আগুনের মতো তুলে ধরেছে আজ।সে নগ্নতায় স্পর্ধা আছে, পবিত্রতা আছে। আর আছে দহন। মনে মনে প্রজেক্টের ছবির বিষয় তৈরি করে ফেলল কৃষ্ণেন্দু।উন্মুক্ত ধানক্ষেত। ফসল কাটা হয়ে গেছে। ফসলের জায়গায় জায়গায় ফোসকা পড়ে যাবার মতোই নাড়া জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেন সভ্যতার পোড়া ক্ষত। আকাশে কৃষ্ণাভ মেঘ। দূরে একদল হাঁস উড়ে যাচ্ছে। ক্ষেতের বুকে একটি বাদামি ঘোড়া। তার চোখেমুখে আদিম গতি। তার উপরে সওয়ার হয়ে আছে এক নারীমূর্তি। সে সম্পূর্ণ নগ্ন। ঘোড়ার দৌড়ের গতির সঙ্গে তার নগ্ন উরুর পেশি, হাতের মুঠি নড়ে উঠছে। তার আলুলায়িত কেশ তাকে আবৃত করে রাখতে পারছে না। তার দুই স্তন উন্মুক্ত। তার চোয়াল শক্ত, মুখের ভঙ্গিতে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা। তার দুই চোখে অসীম সাহসিনী।কৃষ্ণেন্দুর ক্যানভাসে এই সাহসিনী হলেন অতসী রায়। গোকুলঘরিয়ার ঘরে ফিরতে ফিরতে কৃষ্ণেন্দু বুঝতে পারে। স্বপ্নে দেখা সেই সাদা ঘোড়ার সওয়ারীও অতসীই ছিলেন। তার সাহস প্রতিবাদের সাহস। তার নগ্নতা প্রতিবাদের নগ্নতা।

//ছয়//

“যদবধি মম চেতঃ কৃষ্ণপদারবিন্দে/ নবনবরসধামন্যুদ্যতং রন্তুমাসীৎ //তদবধি বত নারীসঙ্গমে স্মর্যমানে/ ভবতি মুখবিকারঃ সুষ্ঠু নিষ্ঠীবনং চ //” (শ্রী যমুনাচার্য গীতি)
(যবে থেকে মন কৃষ্ণ প্রেমে আপ্লুত, তবে থেকে মনের ভিতর নবনব রসসঞ্চার ।সেখানে যৌনচিন্তা দুঃসহ, বিষদৃশ্য, অসহনীয়)

কোনও কোনও দিন এমন হয়। শরীর গরম হয়ে ওঠে অলোকানন্দার। সেইদিন মনে হয় নদীর ভিতর ডুব দিয়ে আসি। নদী বলতে গোকুলিয়া নদী। এককালের নদী আজ মরা সোঁতা। সে সোঁতার ওই পারে নতুনগ্রামের শ্মশান। সেই শ্মশান থেকে চিতার ধোঁয়া ভেসে আসে। স্নানের সময় স্বল্প জলে বড়জোর কোমর ডোবানো যায়। সেখানে ধুনোর গন্ধে এক অদ্ভুত বৈরাগ্য এলেও আর জলকেলির জো থাকে না। অলোকানন্দা তাই আজকাল আর নদীতে স্নান করতে যায় না। ঘরের ভিতরেই টিউবকল। পাম্প করলে জল উঠে আসে। একসময় গোকুলিয়া নদীর পাশে পসরা বসত। বসত গাজনের মেলা। দাদুর কাছে শুনেছে অলোকানন্দা। বড় বড় বজরা করে বড় মানুষের বাণিজ্যসামগ্রী ঢুকত গোকুলঘরিয়ায়।তখন এ নদীতে বান ডাকত।জোয়ারভাঁটা হতো। তখন সদ্য বিয়ে হয়েছে অলোকানন্দার। তার ঘর থেকে গোকুলিয়া না দেখা গেলেও ঘরের দেওয়ালে কান পাতলে নদীর জলের আওয়াজ শোনা যেত। চারপাশে এতো যানবাহন ছিল না তখন। নদীর বানের মতো তখন অলোকানন্দার শরীরেও বান আসত। সেই বানের আকুতির মতো অলোকানন্দার শরীরের সেই ছটফটানি শুষে নিত অরিন্দমের শরীর। অরিন্দম আজ নেই কতো বছর!নেই নেই করে প্রায় সাড়ে তিন চার বছর। শেষ দিকের বছর গুলো নিজের শরীরে গোকুলিয়ার বানের উথলিপাথলি অলোকানন্দা একলা সয়েছে। উপায় ছিল না। অরিন্দম তখন বিদেশে। তারপর ধীরে ধীরে গোকুলিয়ার বুকেও জলের উথালপাথাল স্তব্ধ হয়ে গেল। কে জানে কেন! হাটের মানুষ নানান কথা বলে। অলোকানন্দা মাঝেমাঝে মুরগীর খাবার কেমিক্যাল কিনতে গিয়ে শুনতে পায়। শুনতে শুনতে সে জানতে পেরেছে গোকুলিয়া শুকিয়ে যাবার রহস্য।গোকুলিয়া অমরাবতীর শাখানদী। অমরাবতী ভাগীরথীর অববাহিকা। অমরাবতীর মুখের কাছে নবাবগঞ্জ। সেখানে সড়ক তৈরীর সময় নদীর উপর জঞ্জাল ফেলে সেই যে উপনদীর মুখ প্রায় আশি শতাংশই বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে শুকিয়ে গেছে অমরাবতী। জলশূন্য সোঁতা বনে গেছে গোকুলিয়া। সেখানে পা ভিজানোটুকুই রয়ে গেছে।
গোকুলিয়াতে বান না এলেও অলোকানন্দার শরীরে আজও মাঝেমাঝে বান আসে। তখন সে অসহায় হয়ে পড়ে। শরীরের ভিতর আগুন জ্বলে ওঠে। সে আগুন কিছুতেই নিভতে চায় না। আজ তেমনই এক দিন। কৃষ্ণেন্দু কলেজ চলে যেতেই তাই সে স্নানঘরে ঢুকে টিউবকলে চাপ দিচ্ছিল। আজকাল আর তেমন জল আসছে না কলে। অনেক চাপলে এতোটুকু। কৃষ্ণেন্দু একদিন তাকে বুঝিয়েছিল। মাটি থেকে জল নেবে যাচ্ছে ক্রমশ। একদিন এমন আসবে যখন জল মিলবে না কুথাও। জল শুকিয়ে গেলে মানুষে মানুষে জল নিয়ে কলহ বাঁধবে। মহা কলহ সেইসব। জল থাকবে না! ভাবতে ভাবতে শিউরে ওঠে অলোকানন্দা। আজ অবশ্য খানিক পাম্প করতেই জল উঠে এল হাতে। বালতি ভর্তি করতে করতে তার সুলোচনার কথা মনে পড়ে গেল। আহা। এই গ্রামের সুকুমারী, সুলোচনা, সব যেন এক একটি গোকুলিয়া নদী। জল নেই, মরা সোঁতা। তবু বেঁচে আছে কোনওমতে। তার নিজের মতো। একে একে পরণের শাড়ি ব্লাউজ খুলে রেখে নিজের তপ্ত শরীরে জল ঢালতে থাকে সে। শরীর ফুটিফাটা মাটির মতোই সে জল নিমেষের ভিতর আকণ্ঠ শুষে নেয়। জল তার আলুলায়িত কেশ ভিজিয়ে দেয়। নিজেকে এক জলকন্যা মনে হয় তার। কৃষ্ণেন্দুর ক্যানভাসে নগ্ন শরীরগুলো ঠিক যেমন হাঁটু মুড়ে উপুড় হয়ে হুটোপুটি খায়, অলোকানন্দা ঠিক তেমনই জলে ভিজতে ভিজতে স্নানঘরে হুটোপুটি খেতে থাকে। ঠিক যেন সেইখানে সময়ক্ষণ দ্রাঘিমাঅক্ষরেখা ঋতুবৈচিত্র তার এই অপরূপ জলস্নান দেখতে স্তব্ধ হয়ে আছে। ঠিক সেই মুহূর্তে হঠাৎ দরজার দিকে যেতেই শিউরে উঠল অলোকানন্দা। তার এই উত্তুঙ্গ মুহূর্ত একনিমেষে সে দৃশ্য দেখা মাত্র স্তব্ধ হয়ে গেল।
অরিন্দমের বাড়ির বাথরুম বাইরের বাগানে। সে বাথরুমের দরজার কাঠের পাটাতন আলগা হয়ে আসছে বেশ কিছুদিন। আলগা হতে হতে তার ভিতর দিয়ে বাইরের আলো ঢুকে আসে মাঝেমাঝে ।করাব করাব করেও সারানো হয়নি। অসুবিধাও তেমন হয়নি কখনও। সদরদরজা বন্ধ থাকলে এখানে তেমন কেউ আসেনি কখনও। কিন্তু অলোকানন্দার আজ মনে হল, দরজার ঠিক বাইরে একজোড়া লোলুপ চোখ তাকে আপাদমস্তক গিলে খাচ্ছে যেন। দেখামাত্র আড়ষ্ট হয়ে পড়ল সে। তড়িঘড়ি গামছা দিয়ে সে তার দেহ ঢেকে ভয়ে ভয়ে উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠল,”কে? কে ওখানে?”কিন্তু বাইরে খানিক শুকনো পাতার মষমষ ছাড়া তেমন কিছু শোনা গেল না। আলুথালু শরীর থেকে জল মুছে অলোকানন্দা কোনও মতে আবার কাপড় জড়িয়ে নিল গায়ে। তারপর আধভেজা চুলেই দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে দেখল খানিক দূরে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে রণজয় সেন। দেখামাত্র তার সমস্ত শরীর যেন বিষের জ্বালায় রিরি করে উঠল।
-আপনি? কখন এলেন? এভাবে হঠাৎ। না জানিয়ে…
রণজয় কিছু না বলে লাইটার জ্বেলে সিগারেট ধরিয়ে অলোকানন্দাকে অভুক্ত শেয়ালের মতো দেখছিল। অলোকানন্দার অস্বস্তি হচ্ছিল। তাই সে কাটকাট বলল।
-বসুন। আমি আসছি।

আয়নার সামনে নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছিল অলোকানন্দা। দরজার আড়ালে সত্যিই কি কোনও চোখ ছিল! নাকি সে তার মতিভ্রম! কিন্তু ওই রণজয় সেনের চাহনি আজ ভালো লাগছিল না তার। শাড়ি আটোসাঁটো বেঁধে চুলে গার্ডার দিয়ে অলোকানন্দা বেরিয়ে এসে দেখল রণজয় মুরগীর ফার্মের দিকে তাকিয়ে সিগারেট খাচ্ছে।
-বলুন কী বলবেন?
-দেখতে এলাম।
-কী?
-ভয় নেই বৌদিদি। তোমাকে নয়। সিঙহানিয়ার মুরগিদের। আগামীমাসে সাহেবদের একটা বড় দল কলকাতা ঢুকছে। অনেক মুরগির জোগান দরকার। সিঙহানিয়া তাই হিসেব চেয়েছে। সামনের মাসে ওদের চালান করতে হবে।
-কিন্তু ওরা তো এখনও কচি। বড় হতে আরও কয়েকমাস লাগবে।
রণজয় সেন রোদ্দুর থেকে বাঁচতে আশির সময়ের হিন্দিসিনেমার ভিলেন প্রেম চোপড়ার মতো একটা সোনালী ফ্রেমের গগলস পরে নিল চোখে। তারপর দাঁত বের করে মুখের সিগারেটটা মাটিতে ফেলে দিয়ে পা দিয়ে আগুন নেভাতে নেভাতে বলল,”সাহেবদের কচি মাংস বেশি পছন্দ। বুঝলে বৌদিদি? চলো। দেখাবে!”
অলোকানন্দা থতমত খেয়ে মাথা নামিয়ে নিজেরই অজান্তে ঘোমটা মাথায় দিয়ে মুরগির খাঁচাগুলোর দিকে এগিয়ে গেল। খাঁচার উপর সরাসরি রোদ যাতে না পড়ে, সেই কারণে কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেছিল অলোকানন্দা। সেই কাপড় সরাতে সরাতে তার মনে হল রণজয় সেনের চোখ যেন চঞ্চল চড়ুইয়ের মতো ঘোরাঘুরি করছে। কী চায় লোকটা? এর আগে তো কখনও এমন করেনি। যদিও ওর বদনাম শুনেছে সে অনেক। তবু।
-ভিটামিন বড়িগুলো রোজ গুঁড়ো করে দাও তো বৌদিদি?
ঘাড় নেড়ে অলোকানন্দা দেখলো ক্ষুদে ক্ষুদে মুরগীগুলো যেন অনায়াসে তার উপস্থিতি টের পেয়ে অস্থির হয়ে উঠেছে। ওদের ভাষা অলোকানন্দা বুঝতে পারে না ঠিকই, কিন্তু ওদের চাহনি পড়তে পারে সে। তার মনের ভিতর মায়ের চোখ দিয়ে পড়তে পারে। ওরা তাকে আশ্রয় ভাবে। তার কাছে যেন আবদার করতে দৌড়ে আসছে অজস্র খোকাখুকু। অথচ আগামী সপ্তাহেই ওরা সাহেবদের প্লেটে কিমা হয়ে যাবে।
-কী ভাবছ বৌদিদি?
-কিছু না। বলুন। আর কী দেখবেন?
-দেখেছি তো আজ। পরাণ ভরি গেল দেখে। কী বাঁধন বৌদিদি। কষ্ট হয় না?
কানের ভিতরটা ঝাঁঝা করছে এবার তার। এর অর্থ তার অনুমান সত্যি। রণজয় তাকে স্নান করতে দেখেছে! ছিঃ।
-কী বলছেন যা তা। সরুন পথ থেকে। নাহলে লোক ডাকব।
রণজয় নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,”কী বললাম আর? আমি তো মুরগিছানাদের কথা বলছিলাম। ওদের রোজ ভিটামিন দিও বৌদি। আমি আবার আসব। সিঙহানিয়া বলেছে রোজ একবার করে দেখে যেতে।
রণজয় চটুল হেসে চলে গেলেও সেই হাসির রেশ অলোকানন্দার সারা শরীরে সে যেতে যেতে ছড়িয়ে দিয়ে গেল। লোকটা চলে যেতেই সে আবার বাথরুমের দিকে ছুটল। তার সমস্ত গা ঘিনঘিন করছে। অরিন্দমের ঘর থেকে তার মা ‘বৌমা বৌমা’ ডাক দিচ্ছে। ডাকুক। সদর দরজা কোনও মতে আটকে সে স্নানঘরের দরজায় শিকল তুলে জল ঢালতে শুরু করল। গোকুলঘরিয়া গ্রামবাসীদের বিশ্বাস, তাঁদের কোনও পূর্বপুরুষ গোকুলে শ্রীকৃষ্ণের সহচর সহচরী ছিলেন। এই গোকুলিয়া নদীর জল আসলে পতিতপাবন যমুনার জল। এতোদিন সেকথা বিশ্বাস না করলেও আজ যেন সে প্রাণপণে সেই কথা বিশ্বাস করতে চাইছিল। সাবান দিয়ে নিজের নগ্ন শরীর থেকে রণজয় সেনের বিষ নজরের আঠা তুলছিল যেন। সেই শব্দে যেন সকালের উষ্ণ স্পন্দন স্তব্ধ হয়ে গেল।
-কীরে? উঠবি না হতভাগী? কী হয়েছে তোর?
সুকুমারীর ডাকে চোখ খুলে দেখল সে তক্তপোশে শুয়ে। বেলা গড়িয়ে গেছে। কখন সে স্নানঘর থেকে এল। কখনই বা ঘরে এল। কিছুই যেন হুঁশ নেই। মাথা তুলতে গিয়ে সামান্য টলে যাওয়ায় অলোকানন্দা বুঝতে পারল তার সারাদিন খাওয়া হয়নি। আর শাশুড়িমা? সর্বনাশ।
-ভাবিস না। আমি ওনাকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি।
-কখন এলে তুমি?
-মেলাক্ষণ। তুই অঘোরে ঘুমোস। তাই তোকে ডাকিনি। তোর শাশুড়ি ‘বৌমাবৌমা’ করছিল। ওকে হাগামোতা খাইয়ে তবে তোকে ডাকতে এলাম। এখন বল। কী হয়েছে তোর?
-কিছু না।
-বলবি নে আমায়?
সুকুমারীর দুই চোখের সামনে অলোকানন্দা কেমন অসহায় হয়ে যায়। মনে হয় যা কিছু তার বলার ছিল, সে সন্তর্পণে লুকিয়ে রেখেছে ,এই সুকুমারী যেন আগে থেকেই সেসব জেনে বসে আছে।
-বল।
-কেন এমন হয় মাসি। মনে হয় শরীরের ভিতর গরম ভাতের ফ্যান বয়ে যাচ্ছে?
সুকুমারী ম্লান হাসে।
-হবেই তো সোনা। তুই যে আমার বাছা। কতোই বা বয়স!
-আজ রণজয় সেন এসেছিল।
-কী বলেছে লোকটা?
-কিছু সরাসরি বলেনি। কিন্তু মন বলছে লোকটা আড়ি পেতে আমাকে নাইতে দেখেছে।
-হুম।
সুকুমারী গম্ভীর হয়ে গেল। এই লোকটাকে সে সহ্য করতে পারে না। ও লোকটা সব পারে। অলোকানন্দা মেয়েটা বড় নিরীহ। সরল,গোবেচারা। কিছু একটা করতেই হবে। ভাবতে ভাবতেই সামান্য সহজ হবার চেষ্টা করে সুকুমারী বলল, “চল। অদ্বৈত গোঁসাইয়ের ঘরে চল। কীর্তন শুনলে তোর মন ঠাণ্ডা হবে। চল”।
অলোকানন্দা তৈরি হয়ে নিল দ্রুত। তারপর গোঁসাইবাড়ির দিকে রওনা দিল। সুকুমারীর কথা সে ফেলতে পারে না কিছুতেই। হয়তো ও ঠিক বলেছে। গোঁসাই আর শচীমাতার কীর্তন হয়তো তার ভিতরের আগুনকে নেভাতে পারবে।
গোঁসাইবাড়িতে আজ ভীড় সামান্য কম। মাঠে তিল বুনতে গিয়ে সারাদিন খেটে মাবৌরা অনেকে ঘরে ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছেন। তবু কিছু চেনামুখ আশপাশে দেখতে পেল অলোকানন্দা।তবে সেই মুখের ভিতর সুলোচনা নেই। দাওয়ায় হারমোনিয়াম বাজাচ্ছেন শচীমাতা। আর অদ্বৈত গোঁসাই চোখ বুজে গাইছেন,”মম নিবেদন শুনো গোপীনাথ, মম নিবেদন শুনো। বিষয় দুর্জন সদা কাম রত, কিছু নাই মোর গুণ। মম নিবেদন শুনো।” কী এমন আছে ওই সুরে? অলোকানন্দা দেখল তার দেহভার হাল্কা হয়ে আসছে। সে যেন বাতাসে ভেসে যাবে পালকের মতো তনু নিয়ে। গোঁসাই গান শেষে বলেন, “দেহ আমাদের নৌকা। তার ভিতর কখনও জোয়ার।কখনও ভাঁটা। কখনও গ্রীষ্ম কখনও বরষা। তবু গোপীনাথের কাছে তার সবটুকুই এক ছোট্ট পালকের মতো।”
এক বোষ্টমী গুণগুণ করে হরিনাম গাইতে গাইতে অলোকানন্দার কপালে চন্দন তিলকের শ্রীচরণ এঁকে দিয়ে গেল। গোঁসাই বলে চলেন।
-এই দেহ এক শকট। সে শকটে মনের বাস। পঞ্চ উপাচার সেখানে আবশ্যক। সেই দেহের আভরণ আভূষণ কৃষ্ণর সামনে তুচ্ছ। কিন্তু পথ বড়ো পিছেল গো দিদিভাই। লোভে পড়লেই দেহের জ্বালা কুড়ে কুড়ে খাবে তোমাকে। কৃষ্ণের কথা ভাবতেই দেবে না। বিদ্যাপতি কি বলেছেন শুনবে দিদিভাইরা? “সহজ ভজন সহজাচরণ এ বড় বিষম দায়। স্বকাম লাগিয়া লোভেতে পড়িয়া মিছা সুখ ভুঞ্জে তায়।”
গোঁসাই গান ধরেন আবার। “কেমনে শোধিবে মোরে গোপীনাথ। কেমনে শোধিবে মোরে।” শচীমাতা বাদ্যযন্ত্র বাজান। শ্রীখোলে বসেন আশ্রমের এক গুরুভাই। অল্প বয়স। কৃষ্ণেন্দুর বয়সী। নাম সুদাম। অলোকানন্দার ওকে দেখে ছেলের কথা মনে পড়ে যায়।
-এই সুকুমারী। ঘরে ফিরি চলো।
-যাবি? চল।
আমবাগানের ভিতর দিয়ে আসতে আসতে একপলক যেন অলোকানন্দার মনে হল রণজয় সেনের চোখদুটোর কথা। কিন্তু সে ভয় মুহূর্তে কেটে গেল। মনের ভিতর সুর ভেসে আসছে। “মম নিবেদন…” ।গোঁসাই আজ বলেছেন।গোরাচাঁদের দর্শন হলে পৃথিবীকে মনে হবে ধূলিকণার মতো।সমুদ্রের জলরাশি হয়ে উঠবে বিন্দুর মতো। সূর্য একটুকু স্ফুলিঙ্গ। বায়ু সামান্য শ্বাস। এমনভাবে ভাবলে রণজয় সেনের লালসা আর তাকে ভয় দেখাতে পারে না।
-আমি জানি মেয়ে। তোর কী চাই?
-বল না সুকুমারী?
আমবাগানের ভিতর হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে দুজনেই।
-আয়।
অলোকানন্দা সুকুমারীকে জড়িয়ে ডুকড়ে কেঁদে ওঠে। সুকুমারী বোঝে অলোকানন্দার শরীরে জ্বর।নির্জন পথে আর কেউ নেই। গভীর পাতার আড়ালে দোদুল্যমান অপঘাতে মরা নারীমূর্তির অতৃপ্ত আত্মার ভয় বা হন্তারকের শ্বাপদসূলভ রসনা দুজনকে বিচলিত করতে পারল না। আকাশে মঘা নক্ষত্র ছেড়ে অনুসূয়া জেগে উঠেছে। সুকুমারী বলে।
-আয়।
চোখ মুছিয়ে অলোকানন্দার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট রাখে। চোখ বন্ধ হয়ে আসে দুজনেরই। অলোকানন্দা শুনতে পায় দূর থেকে ভেসে আসছে অদ্বৈত গোঁসাইয়ের গানের সুর। “ক্ষুদ্রা রুদ্রপিতামহপ্রভৃতয়ঃ কীটাঃ সমস্তাঃ সুরা। দৃষ্টে যত্র স তারকা বিজয়তে শ্রীপাদধূলীকণা…”।

//সাত//

“তমশ্মানং মন্যমান আত্মনো গুরুমত্তয়া।
গলে গৃহীত উৎস্রুষ্টুং নাশক্নোদদ্ভুতার্ভকম ।। ২৭।।”
(তৃণাবর্ত অসুরের মনে হল সে যেন এক বিশাল পর্বত বা লৌহপিণ্ড আঁকড়ে রয়েছে। সে লৌহভার বালক শ্রীকৃষ্ণর। ভারবৃদ্ধি হবার ফলে সে তাকে পরিত্যাগ করতে গিয়েও পারল না। সে ভার তার গলায় জরিয়ে যেন এক অদ্ভুতভাবের সৃষ্টি করল।//শ্রীমদ্ভাগবতম )

কৃষ্ণেন্দুর এঁকে আনা ছবিটা ওলটপালট করে দেখছিল বসন্ত সমাদ্দার। কলেজের সামনে অতসীদের করা প্রতিবাদের খবর এখন আন্তর্জাল মহলে ভাইরাল। সেই তালে সুর বেঁধেই বাৎসরিক প্রজেক্টের বিষয় রাখা হয়েছিল ‘প্রতিবাদ’। অনেকে ছাত্রছাত্রীই নগ্নতাকে প্রতিবাদের প্রধান অস্ত্র হিসেবে দেখাচ্ছে। কৃষ্ণেন্দুর ছবির ভিতরেও প্রতিবাদের ভাষায় নগ্নতা। কিন্তু সেই নগ্নতার পাশাপাশি সেখানে এক আবছা মায়ালু বাঙালিয়ানা লুকিয়ে রয়েছে। সেই বাঙালিয়ানার সঙ্গেই সেখানে রয়েছে খানিকটা আটপৌরে বাঙালী সঙ্কোচ ও লাজুকভাব, যা ছবিটিকে অন্য এক মাত্রা এনে দিয়েছে। কৃষ্ণেন্দু হলুদ টেম্পেরার ওপর সবে তিনটে লেয়ার ফেলেছে ছবিতে। তবু তাতেই ছবির খয়েরি ঘোড়ার মাংসপেশিতে যেন গতি ফুটে উঠছে। আর তার ওপর আসীন উন্মুক্ত নারী শরীর যেন এক ভাবালুতা মেশানো বৈপরীত্য তৈরি করেছে।
ছেলেটার কাজগুলো খুব চেনাচেনা মনে হয় বসন্তর। এমন নয় যে কাজগুলো কারও নকল। অথবা কারও প্রভাব রয়েছে তাদের ভিতর। কাজগুলো বসন্তকে তার নিজের যৌবন মনে করিয়ে দেয়। যে ‘নাগচম্পা’ ফুলের ছবিটা বাষট্টি জনের ভিতর থেকে ওরিয়েন্ট হোটেলের মালিক রূপেশ সিং কিনে নিয়ে গেল, সেই ছবির ভিতরেও ওই চেনাচেনা আগুনের আঁচটা ছিল। কোনও একসময় তুলি ধরলেই বসন্ত সে আঁচ নিজেই অনুভব করতে পারত। সে অনেকদিন হল। তখনও তার জীবনে তহমিনা ছিল।তহমিনা আর বসন্ত মির্জাপুরে পাশাপাশি স্কুলে পড়েছে। গ্রামে আঁকার প্রতিযোগিতা হলে একবার বসন্ত প্রথম হতো, একবার তহমিনা। আর্ট কলেজে এসে দুজনেই বুঝেছিল, তাদের ভিতর সম্পর্কটা আর নিছক ছেলেবেলার নেই। বাল্যকালের প্রতিবেশিনী কখন বসন্তর হৃদয়ের প্রতিবেশিনী হয়ে উঠল কে জানে। কিন্তু বিধাতার বিধান অন্যরকম সেকথাই বা কার জানা ছিল। হঠাৎ ইঞ্জিনভ্যানের সঙ্গে মুখোমুখি বাইক সংঘর্ষে বসন্তর বাবা মারা গেলেন। তার বাবা সঙ্গীতের যন্ত্র বানাতেন। হারমোনিয়ামের রিড টিপে বলে দিতে পারতেন সুর চড়বে না নামবে। কলকাতা থেকে কতো বড় বড় ওস্তাদ বিদুষী তাদের ঘরে এসে হারমোনিয়াম বেঁধে নিয়ে গেছেন। সংসার চলে যাচ্ছিল স্বচ্ছলভাবেই। বাবার মৃত্যুর পর সংসারের হাল ধরলেন বসন্তর জ্যাঠামশাই। তিনি এলআইসি করতেন। এনডাওমেন্ট রিটার্ন আর প্রিমিয়ামের বাইরে তার চিন্তাভাবনার তেমন চলাচল নেই। তহমিনার সঙ্গে তার সম্পর্কটা বাড়িতে জানাজানি হতেই সেই খবরের প্রতিক্রিয়া একধরনের অসুস্থতা পেল। মির্জাপুরে মুসলমান অধ্যুষিত পাড়ায় সংখ্যালঘু গোঁড়া বৈষ্ণব বসন্তদের পরিবার। ঘরে কূলদেবতা আছেন, রাধারাণী বিগ্রহ আছেন। বিগ্রহরা আপত্তি করতেন না হয়তো, কিন্তু জ্যাঠামশাই, মা ,জ্যাঠাইমা তাদের আপত্তি গোপন রাখলেন না। সব তখন কেমন যেন ছাড়াছাড়া হয়ে চলেছে দুজনের জীবনেই। বসন্তর ঘরে প্রতিক্রিয়ার কথা জানতে পেরে তহমিনা আর ভয়ে তার বাড়িতে কিছুই জানায়নি। কিন্তু এইসব খবর বাতাসে বাতাসে তেজস্ক্রিয় রশ্মির মতোই ঘোরাফেরা করে। কলেজ শেষ হতে না হতেই তহমিনার নিকে ঠিক করল ওদের পরিবার।শশুরবাড়ি কাতারে। বিয়ের ঠিক তিনদিন আগে বসন্তর সঙ্গে দেখা করেছিল সে। সেই গ্রীষ্মের ভরাদুপুরে নির্জন ডানকুনির কেবিনে শ্রাবণ নেমে এসেছিল। শিরশির করে কাঁপতে কাঁপতে বসন্তকে জরিয়ে সেদিন তহমিনা প্রতিজ্ঞা করেছিল, সে আর ছবি আঁকবে না। আর বসন্তকে দিয়ে প্রতিজ্ঞাও করিয়ে নিয়েছিল সে। বসন্ত আঁকা ছাড়তে পারবে না। তাকে আঁকতে হবে দুজনের হয়ে। প্রতিটি ছবির ভিতর প্রথম আঁচড় হবে তহমিনার, আর দ্বিতীয় স্পর্শ বসন্তর।
তহমিনাকে প্রতিমাসে একটি করে ফুল এঁকে দিত বসন্ত। বনজ গ্রামবাংলার ফুল। কখনও রক্তদ্রোণ, কখনও বা লালশিরিষ। কখনও ঝুমকো জবা, কখনও বা নার্গিস। তখন প্রতিটি ছোট ছোট ক্যানভাসে তুলি ছোঁয়ালেই ভিতরভিতর কেমন যেন একটা আগুনের আঁচ অনুভব করত বসন্ত। তহমিনা চলে যাবার পর বসন্ত প্রতিজ্ঞামতোই আঁকা ছাড়েনি। কিন্তু ফুলের ছবি আর সে আঁকেনি কখনও। কোথাও যেন সেই ভিতরভিতর গর্জে ওঠা দাবানল হারিয়ে গিয়েছে। বিদেশ থেকে দুদুটো স্কলারশিপ পাবার পর মাস্টার্স শেষ করে যেদিন এই কলেজে শিক্ষকতায় যোগ দিল, সেইদিনও বসন্ত জানত তার ভিতরের আগুনটা নিভে গেছে। কৃষ্ণেন্দুর নাগচম্পা তাকে বহুদিন বাদে সেই নিভে যাওয়া আগুনের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। তাই ছেলেটির সব কাজই সে বাড়তি মনোযোগ দিয়ে দেখে। বহুদিন পর এমন একটি ছেলে কলেজে এসেছে যার তুলির টানে জীবন লুকিয়ে আছে।
-তোমার এই ছবি আমাকে লেডি গডিভার উপকথার কথা মনে করিয়ে দিল কৃষ্ণেন্দু।
কৃষ্ণেন্দুর পাশেই সহেলী উদগ্রীব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার প্রোজেক্ট এখনও আঁকা হয়নি। দুজনেই প্রশ্ন করে বসল।
-লেডি গডিভা কে?
-বলছি।
সামান্য হেসে ট্যাব খুলে গ্যালারি থেকে ১৮৯৮ সালে শিল্পী জন কলিয়ারের আঁকা ‘প্রাকরাফায়েলিক’ তৈলচিত্রটি খুলে বসন্তস্যার কৃষ্ণেন্দুদের সামনে রাখল। কৃষ্ণেন্দু অবাক হয়ে দেখল, সেই ছবিতে নির্জন শহরের বুকে শান্ত ঘোড়ার উপর আলুলায়িত কেশ নিয়ে সামান্য বক্রগ্রীবায় এক অপরূপ সুন্দরী নারী। আশ্চর্যের বিষয়, ঘোরসওয়ার নারীটি সম্পূর্ণ নগ্ন। কিন্তু সেই নগ্নতা যেন এক স্নিগ্ধ আবেদন তৈরী করেছে ছবিতে। এই ছবি কৃষ্ণেন্দু বা সহেলী আগে কখনও দেখেনি। তাদের বিস্ময়চকিত চোখ দেখে কৌতূক করে বসন্ত বলল, “ছবির নারীটি যতোই রোম্যান্টিক লাগুক না কেন, এই ছবির পিছনের কাহিনীটি কিন্তু প্রতিবাদেরই।”

তেরশো শতাব্দীতে ইংল্যাণ্ডের ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবেতে মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত মার্সিয়ার এগারশো শতাব্দীর এক দম্পতি, লেডি গডিভা ও তার স্বামি লিওফরিকের কথা। লিওফরিক ছিলেন মারসিয়ার শাসক। তিনি খুব দয়াবান ছিলেন না। গরীব প্রজাদের উপর ছুতোয় নাতায় চাপিয়ে দিতেন কর। সেই কর অনাদায়ে জুটত শাস্তি। এমনকি মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত। লেডি গডিভা প্রজাদের প্রতি তার স্বামীর এই অত্যাচার মেনে নিতে পারেননি। তাই একদিন তিনি তার স্বামী কে বললেন প্রজাদের উপর থেকে বাড়তি কর আদায় বন্ধ করতে। তৎকালীন ইংল্যাণ্ডে নারীদের খুব যে সাঙঘাতিক বাক স্বাধীনতা ছিল, এমন ভাবলে ভুল হবে। লিওফ্রিক তার স্ত্রীর আবেদন তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে উড়িয়ে দিচ্ছিলেন। তারপর একদিন নাছোড় পত্নীর বায়নাবাজি বন্ধ করতে এক অদ্ভুত শর্ত রাখলেন। যদি ভরদুপুরে মার্সিয়ার জনবহুল রাস্তায় লেডি গডিভা সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে ঘুরে আসতে পারেন, তাহলে তাঁর সমস্ত কর তুলে নেবার শর্ত তিনি মেনে নেবেন।গরীব প্রজাদের কথা ভেবে লেডি রাজি হয়ে গেলেন। সেকথা ছড়িয়ে পড়ল মার্সিয়া জনপদে। মার্সিয়ার মানুষ ঠিক করলেন, যে নারী তাঁদের দুঃখকষ্টর কথা ভেবে নিজের আত্মমর্যাদা, সম্ভ্রম লজ্জাটুকুও ত্যাগ করতে রাজি হয়ে গেলেন, সেই নারী কোনও সামান্যা নারী নন। তিনি দেবী। তারা সকলে ঠিক করলেন ওই দিন মার্সিয়ার রাস্তায় কোনও মানুষজন থাকবে না। দরজা জানলা বন্ধ থাকবে যাতে লেডির সম্ভ্রমরক্ষা হয়। নির্দিষ্ট দিনে লেডি ঘোড়ায় চড়ে বের হলেন। তার উজ্জ্বল নগ্ন দেহ থেকে সূর্যের আলো ঠিকড়ে আসছিল যেন, তার ঘনকালো বাদামি চুলে ঢাকা পড়ে গেল তার দুটি সুডৌল স্তন। কিন্তু কেউ সে দৃশ্য দেখতে পেল না। মার্সিয়ার পথঘাট সেদিন জনশূন্য ছিল। শুধু একজন নিয়মভঙ্গ করেছিল। তার নাম ‘পিপিঙ টম’।
-লেডি গডিভার নগ্ন প্রতিবাদ ছিল তার অত্যাচারী স্বামী ও তার শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে। পরে ম্যাসাওনি ‘ইসাব্যিউ’ নামে এক অপেরা করেন লেডি গডিভাকে নিয়ে। আর্থা কিট, পিটার গ্যাব্রিয়েল, এরোস্মিথ, কে না গান গেয়েছে এই কিংবদন্তীকে নিয়ে।
বসন্তস্যারের পড়ানোর ভঙ্গিতে এক অদ্ভুত কোমনীয়তা আছে। কাহিনী সেরে বসন্ত ফিরে এল কৃষ্ণেন্দুর ছবিতে।
-তোমার এই ছবি অনেক বেশি বোল্ড। প্রেক্ষাপটের ঝলসানো ফসল, ঘোড়ার কালচে মাংসপেশি, সব জীবন্ত, কিন্তু…
-কিন্তু কী স্যার?
-তোমার ছবির মূল শক্তি এই নারীর নগ্নতা জীবন্ত নয়।
কৃষ্ণেন্দু হতাশ হয়ে চায় সহেলীর দিকে। বসন্তস্যার পরিবেশ সহজ করে বলে।
-আসলে কী জানো তো কৃষ্ণেন্দু? নগ্নতার ভার অনেক।সে একই সঙ্গে পবিত্র ও কলঙ্কিত।তুমি তাকে কীভাবে দেখাবে, তার উপর নির্ভর করবে তার গতিপথ ও পরিণতি।সেই বালককৃষ্ণ আর ঝড়রূপী তৃণাবর্তের কথা ভাবো। নগ্নতার ভার অনেক। সে ইচ্ছে করলে বালক কৃষ্ণর মতোই ভয়ানক অসুরকে টলিয়ে দিতে পারে। তোমার স্কেচে নারী শরীরের অবয়ব, এক্সপ্রেশন সুস্পষ্ট। কিন্তু কিছুর একটা অভাব আছে যা তুমি লাইভ স্কেচ না করলে পূরণ করতে পারবে না।
কৃষ্ণেন্দু ভাবতে থাকে। লাইভ ন্যুড মডেল রাখার তো অনেক খরচ। সে এতো পয়সা ঈওথা থেকে পাবে। বসন্ত স্যার ‘ভাবো’ বলে চলে গেল। কৃষ্ণেন্দু নূব্জ হয়ে আঁকাটা গোটাতে গোটাতে ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল। শূন্য লেকচার থিয়েটারে সে ধপ করে বসে পড়বার শব্দ বিকট অতিরঞ্জিত হয়ে ফিরে ফিরে এল যেন। পরিস্থিতি হাল্কা করতে সহেলী বলল।
-কৃষ্ণেন্দু। তোর কী মনে হয়। লেডি গডিভা সত্যিই ছিল?
-কে জানে!
কৃষ্ণেন্দুর শূন্য চোখের দিকে তাকিয়ে সহেলী বলল।
-আঁকবি?
-কী?
-লেডি গডিভাকে?
-কোথায়?
কৃষ্ণেন্দুর বোকা বোকা চাহনি দেখে সহেলী ফিক করে হেসে বলল।
-আমি যদি গডিভা হই?
-তুই?!!
-হ্যাঁ। তবে দুটো শর্ত আছে আমার।
-কী শর্ত?
-প্রথম। আমাকে ছুঁতে পারবি না। আই মিন ইট।
কৃষ্ণেন্দু মাথা চুলকায়। সহেলীকে মানসচক্ষে দেখা আর সশরীরে দেখার পার্থক্য অনেক। তবু সে নিজেকে সামলে নেয়।
-দুই?
-দ্বিতীয় শর্ত। তোকেও আমার প্রোজেক্টের জন্য ন্যুড পোজ দিতে হবে।
-তুইও আঁকবি একই বিষয়।
-না। আমারটা অন্য। আরেকটু ভেবে নিই। কিন্তু তোকে আমার মডেল হতে হবে। হবি?
হাসি হাসি মুখে কৃষ্ণেন্দু আবার ধড়মড় করে উঠে পড়ে। কিন্তু কবে কোথায়?
-হোটেলে রুম ভাড়া করব আমরা। একবেলার জন্য।
-কিন্তু কাগজপত্র?
-হয়ে যাবে। আমি ব্যবস্থা করব।
-আর লোকে তো খারাপ কথা বলবে?
-কে বলবে?কেউ না জানলেই তো হলো নাকি!তা ছাড়া আমরা নিজেরা খারাপ না হলেই হলো। কী। তাই তো?
সহেলী সামনে থাকলে সব কঠিন সমস্যা কতো সহজ সমাধান হয়ে যায়। কৃষ্ণেন্দুর মনে হলো সত্যিই তার সামনে মার্সিয়ার দেবী দাঁড়িয়ে আছেন।
(ক্রমশ)

লেখাটি যদি ভালো লাগে, আবহমানে নিজের ইচ্ছেমতো ফোন পের মাধ্যমে
অবদান রাখতে পারেন, এই কিউ আর কোড স্ক্যান করে। ফোন পে করুন 9051781537
অথবা স্ক্যান করুন পেমেন্টের লিংক

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes