দীপ শেখর চক্রবর্তীর গল্প   ‘খাদান’

দীপ শেখর চক্রবর্তীর গল্প ‘খাদান’

চটুল হিন্দি গানটা শুরু হতেই ঘুমটা ভেঙে গেল। তাকিয়ে দেখি, সিলিং ফ্যানটা বহুদিন ধুলো ঝাড়া হয়নি। ব্লেডের পাশে পুরু নোংরার আস্তরণ পড়েছে। বিছানার একদিকে ঢাই করা জামাকাপড়ের মধ্যে থেকে শ্যামলীর শাদা ব্রেসিয়ারটা এসে লাগছে আমার মুখের সামনে। জংলা চাদরটা আমার চিরকাল অপছন্দ। কতবার শ্যামলীকে বলেছি, আমি এলে এই চাদরটা পাতবে না। ওর কি মনে থাকে না নাকি ইচ্ছে করেই পাতে?
শ্যামলী আমার বান্ধবী নয়।
শ্যামলী আমার প্রেমিকা নয়।
আমার সঙ্গে শোওয়ার জন্য শ্যামলী টাকা নেয় আমার থেকে। এই কথাটা আমার বন্ধুরা কেউ জানে না। ওরা সকলে ভাবে শ্যামলী আমার প্রেমিকা। আমিও প্রতিবাদ করি না। আসলে এই বিষয়টা আমার ও আমার বন্ধুদের মধ্যে ততটাও গুরুত্বপূর্ণ নয়।
কিন্তু শ্যামলীকে আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না। উঠে রান্নাঘরে গেলাম, বাথরুমে, পাশের ঘরে, কোথাও শ্যামলী নেই। ওর বাবা মা পুরী গেছে। শ্যামলী ইচ্ছে করে যায়নি। গোটা বাড়ি ফাঁকা। আমিই ওকে পুরী দর্শন করিয়েছি কয়েকবার এ’কদিনে।
ঢেউ, ঢেউ, এক অনন্ত ঢেউয়ের ভেতর ডুবে থাকা। তাতে শ্যামলীর একুশ বছর বয়সের যৌবন ভেসে গেছে।
চটুল গানটা মাথার ভেতরে নিয়েই শ্যামলীর পাখির নীড়ের মতো বারান্দা দিয়ে বাইরে চলে এলাম। বড়বাজারের বর্ধিত অংশটা এসেছে স্টেশন অবধি। সন্ধের বাজারের ভিড়, দিকে দিকে রাস্তায় ছড়ানো তরকারি, বিক্রেতাদের চিৎকার আর হিন্দি চটুল গান সব মিলে যেন একটা জোর ধাক্কা দিল আমায়। আমিও শ্যামলীর বাড়ির মায়াময় সময়টুকু থেকে ছিটকে এসে পড়লাম বাস্তবে।

কাল রাতে অতিরিক্তই মদ খাওয়া হয়েছে। মাথাটা এখনও ঝিমঝিম করে দুলছে যেন। আগে শ্যামলী এতটা খেতে নিষেধ করত। এখন আর করে না।
তাহলে কি শ্যামলী আমাকে আর ভালবাসে না?
শ্যামলী কি কোনওদিনই আমাকে ভালবাসত?
স্টেশনের ঠিক সামনেই রাজনৈতিক মঞ্চ হয়েছে। সেখানে পরপর বসে আছে কয়েকটি সাদা পাঞ্জাবি, সাদা পাজামা। পরপর। মঞ্চের ওপর একজন দাঁড়িয়ে ঠিক করে নিচ্ছেন মাইকটি। তারপর শুরু করলেন – বন্ধুগণ…
চটুল হিন্দি গানটার একটা লাইন-
চোলি কে পিছে ক্যা হ্যায়, চোলি কে পিছে।
জায়গাটা আমার জন্য মোটেই নিরাপদ নয়। এখানে আগের বছর একটা গণ্ডগোল হয়েছিল বুবুদের গ্রুপটার সঙ্গে। বুবুকে সেদিন এমন মেরেছিলাম যে তিনটে স্টিচ পড়েছিল। তারপর আমাকে আর বাগে পায়নি। এদিকে ওদের নাকের ডগার ওপর শ্যামলীদের বাড়ি আমি আসি। তারপর প্রায় উবে যাই। বুবু জানে না, এখনও ধরতে পারেনি যে প্রত্যেক লেখকই আসলে একজন পলায়ন শিল্পী।
আসলে ওরা ওঁত পেতে থাকে আমার বাড়ি ফেরা পথের দিকে। এদিকে আমি ওদের এলাকার ভেতর দিয়েই পার হয়ে যাই। ওরা ধরতে পারে না। স্টেশনের ভেতর দিয়ে যে রাস্তাটা গেছে পাথর খাদানের পাশ দিয়ে সেদিক থেকে নিজের এলাকায় ঢুকে পড়ি। তারপর ওদের আর সুযোগ নেই। একবার ভুল করে চলে এলে কী হবে তা বুঝেছিল ওদের দলেই সোনাই।
বাবা বলেছে মারের বদলে মার দিয়েই এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হবে। নয় মুখ বুজে মার খেয়ে দাও। নয় পাল্টা দাও। কোনও ন্যায়ের প্রত্যাশা কোরো না। এইসব থানাপুলিশ, আইন, আদালতে যত ভরসা করবে তত নিজেকেই নিজে ঠকাবে। হতাশ হয়ে একদিন আত্মহত্যা করবে। আত্মহত্যার বদলে পাল্টা মারো। মারো, মেরে যাও। যুগ যুগ ধরে শুধু মারের বদলে মার।
আমি বলেছিলাম – যথা আজ্ঞা বাবা।
পাথর খাদানটা যে কীভাবে এখানে হঠাৎ গড়ে উঠল তা কেউ জানে না। এক শহরে আচমকা পাথর খাদান? পুরু ধুলোয় ঢাকা পড়েছে সবকিছু। এই কয়েক বছর আগেই তো ক্রাশার বন্ধের জন্য কত আন্দোলন হল এখানে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই যে সে তাই। আন্দোলনের প্রধান নেতা চলে গেছে ক্ষমতাধীন দলে।
তার মনে ইচ্ছে জাগে, আরও কঠোরভাবে এই আন্দোলন দমন করতে। ছেলেগুলোকে ধরে নিয়ে এসে পাথরে থেঁতলে ফেলতে ইচ্ছে করে। মেয়েগুলোকে তুলে এনে ইচ্ছে করে খাদানে নিয়ে গিয়ে রাতের পর রাত চুদি – একেকদিন তীব্র মদের নেশায় নাকি এমন কথা বলে ফেলেন নেতা তার শাগরেদ- দের কাছে। তারাও উত্তেজিত হয়, কেউ কেউ প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলে। বুবুরা এরই শেল্টারের লোক। এখনও তেমন হাত পাকেনি। পাকলেই আর আটকাবে কে? একটা ঘটনা ঘটবে। পুলিশের কাছে যাবে। ছাড়াতে যাবে স্বয়ং নেতা। ব্যাস, পুলিশের বাবার সাধ্য নেই আর আটকে রাখার। বুবুদের সঙ্গে ঝামেলাটা যদিও আমার এই নিয়ে নয়।
আসলে বুবু সেদিন ভাবতেই পারেনি এতটা মার খাবে। স্টেশন চত্তরে ওদের আড্ডার জায়গাটায় চা খাচ্ছিল আর মেয়ে দেখে ছুকছুক করছিল বুবু। লেডিস স্পেশাল আসার সময়টাই হল ওর চা খাওয়ার সময়। আমিও আর শ্যামলী ফিরছিলাম স্টেশনের রাস্তা ধরে। আমি একটা সিগারেট কিনতে গেছি আর এদিকে শ্যামলী গেছে চায়ের দোকানে।
সেখানেই কায়দা করে শ্যামলীর পেছনে হাত দেয় বুবু। সিগারেটের দোকান থেকে পরিষ্কার দেখি আমি। তারপর এক মুহূর্ত সময় না নিয়ে সোজা এসে ওর নাক বরাবর এমন ঘুষি চালিয়েছিলাম যে একেবারে রক্তারক্তি কাণ্ড।
সেই থেকে আমাকে ওরা খুঁজছে।
সেদিন কিছুক্ষণ পরেই বুবুদের দল চলে এসেছিল। কুকুরের মতো খুঁজেছিল আমাকে। তবে পায়নি। ওরা জানে না, আমি একজন অতি দক্ষ পলায়নশিল্পী। এই আমার কাজ এবং অনেক ছোট থেকেই এই কাজটি আমি দক্ষতার সঙ্গে পালন করে এসেছি। যেমন কোনও দলেই আমাকে দেখতে পাওয়া যায় না। সমস্ত দল থেকেই আমি কোনও না কোনও সময়ে পালিয়েছি। এই একই কথা যে কোনও মত, যে কোনও বিশ্বাস সম্পর্কেই প্রযোজ্য।
তবে এমন স্টেশনের অনতিদূরে পাথর খাদান গড়ে ওঠা নিয়ে কেউ কোনও সঠিক তথ্য দিতে পারে না। যারা করে খাচ্ছে তাদের মতে করে খাওয়ার জন্য একটা উপায় বার করে দেন ভগবান। এদিকে সমস্ত অঞ্চলটা ভরে থাকে পুরু ধুলোয়। গাছের পাতার ওপর পুরু হয়ে জমছে, জমছে পাখির ওপরে, এমনকী একেকদিন সূর্যটার ওপরেও একটা পুরু ধুলোর আস্তরণ পড়ে যায়। কেউই কাউকে দেখতে পায় না। এদিক ওদিক একে অপরকে খোঁজ করে বেড়ায় লোকেরা। এমনকী প্রবল ধোঁয়াশার কারণে ট্রেনের সময় বারবার বদলে যেতে থাকে। এই একটা কারণে বুবুর দল আমাকে সহজে খুঁজে পায় না। এমনও হয়েছে ওদের এলাকা দিয়ে আমি নিশ্চিন্তে চলে গেছি।
শ্যামলীর শরীরে বুবু হাত দিয়েছিল বলে যে তীব্র রাগ আমার হয়েছিল তা কতগুলো প্রশ্ন আমার মধ্যে জাগিয়ে তোলে। তাদের মধ্যে গাঢ়তম হলে এই, আমি কি তবে শ্যামলীকে ভালবেসে ফেলেছি? এমন হতেই পারে শ্যামলীর কাছে যেতে যেতে ওর শরীরের প্রতি এক আশ্চর্য অধিকারবোধ জন্মেছে। তবে শ্যামলী কেন প্রতিবার আমার সঙ্গে শোওয়ার জন্য টাকা নেয়? এই টাকা নেওয়ার মাধ্যমে ও কি শরীরের প্রতি অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে দেয় না আমাকে?
স্টেশনে এসে বসেছি বেশ কিছুক্ষণ হল। বুবুর দলটা ধারেকাছে নেই। থাকলেই বা কী। পালাতে পারার অলৌকিক ক্ষমতার কাছে ওদের সমস্ত নস্যি। বরং ওদের নাকের ডগায় বসে আছি, একথা ভাবলেই শরীরের মধ্যে উত্তেজনা হয়। বুবুর নাকটা আরেকবার মেরে ভেঙে দিতে ইচ্ছে করে, তবে তার জন্য ওকে একা পেতে হবে। আমি একা মানুষ, কোনও দল নেই। তাই একা হয়ে যাওয়ার কোনও ভয়ও নেই। বুবুর একা হয়ে যাওয়ার ভয় আছে।
একটি ত্রিশ বত্রিশ বছর বয়সী মেয়ে আচমকা এগিয়ে এল আমার কাছে। বাতাসে তখনও ধুলো, যা দেখা যাচ্ছে সবই আবছায়া, হিন্দি চটুল গান একের পর এক বেজে চলেছে এবং তার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে রাজনৈতিক বক্তৃতা। মেয়েটি এগিয়ে বলল-

আপনি কি স্থানীয় লোক?
হ্যাঁ
আপনি কি আমাকে কিছু তথ্য দিতে পারেন?
কী সম্পর্কে বলুন তো?
এই যে পাথরের খাদান। শুনলাম এখানে নাকি একটা মেয়ে মার্ডার হয়ে গেছে।
কথাটা শুনে আমার সমস্ত সত্তা যে কি নিদারুণ কেঁপে উঠল তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। শ্যামলী, তাহলে কি শ্যামলীকেই ওরা তুলে নিয়ে গেছে? শ্যামলী কি বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল? বুবুর ছেলেদের চোখ ফাঁকি দিতে পারেনি? শ্যামলী, শ্যামলী, আমি ওকে কী ভীষণ ভালবাসি।
আমার সমস্ত হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে। মেয়েটি এতটাই কাছে এসে কথা বলছে যে তার কণ্ঠস্বর যেন আমার আত্মা অবধি পৌঁছে যাচ্ছে। তাকে এখন দেখা যাচ্ছে খুবই স্পষ্টভাবে।
ওর গায়ে ছিল সবুজ সালোয়ার।
ঠিক।
ওর কপালে একটা কাটা দাগ ছিল?
ঠিক।
ওর উচ্চতা ছিল সেই সাড়ে পাঁচ ফুটের মতো?
ঠিক।
ওর নাম ছিল অরুণিমা।
অরুণিমা?
হ্যাঁ। অরুণিমা। মেয়েটির নাম অরুণিমা। ক্রাশার বন্ধ করা নিয়ে যে আন্দোলন চলছে সেই আন্দোলনের এক্টিভিস্ট। কাল রাত থেকে নিখোঁজ।
তবে তার নাম শ্যামলী নয়?
না। শ্যামলী বলে তো কারও নাম শুনলাম না। অরুণিমা। অরুণিমা দত্ত।
এতক্ষণে ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ল। একটু স্থির হয়ে বললাম- দেখুন, এই খুন সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।
জানেন না?
না?
আপনারা কিছুই কেউ জানেন না তাই তো?
আমি সত্যিই কিছু জানি না।
আপনাদের সত্যি আমার জানা আছে। এই বলে রেগে গটগট করে চলে গেল মেয়েটি। কোনও অপরাধ না করেও আমার ভেতরটা কেমন অপরাধী হয়ে উঠল। তাহলে কি আমি সত্যিই জানি না কিছু। নাকি নিজের সম্পর্কে আমার এই জানা সম্পূর্ণ ভুল।
তবে শ্যামলীর খোঁজ করা প্রয়োজন। ওর বাড়ি কি ফিরে যাব? তা ছাড়া কোনও উপায় নেই। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। আজ রাতেও শ্যামলীর বাড়িতে কাটিয়ে দেওয়াই ভাল। অন্তত শ্যামলীকে আজ রাতে আমার চাই। ওকে আজ বলতে হবে যে শোওয়ার জন্য ওকে আর একটিও টাকা দিতে আমি অপারগ। এতে করে ও যদি আমার সঙ্গে শুতে না চায় তাহলে শোবে না। কিন্তু আর এক টাকাও আমি শ্যামলীকে দিতে পারব না আমার সঙ্গে শোওয়ার জন্য।
স্টেশনের পথ থেকে নেমে এসে সিগারেটের দোকানে গেলাম। মঞ্চের ওপর রাজনৈতিক নেতার মুখ বদলে গেছে। তবে বক্তব্যের বিশেষ পরিবর্তন ঘটেনি। গোটাটাই খুব ঝাপসা। চারিদিকে একটা ধুলোর আস্তরণ। বাজার বসেছে, আরও জোরে বাজছে চটুল হিন্দি গান।
সিগারেট কিনতে যাব একটা ছয়-সাত বছরের বাচ্চা ছেলে প্যান্ট ধরে হ্যাঁচকা টান দিল। হাতে একটা ক্যাপ বন্দুক। একটা ক্যাপ কিনে দাও না, ফুরিয়ে গেছে। মহা জ্বালা হল। কোথায় ক্যাপ পাওয়া যায়? বাচ্চাটিই নিয়ে গেল পাশের দোকানে। এক রোল ক্যাপ, দশ টাকা।
অগত্যা কিনে দিলাম।
ক্যাপ বন্দুকের খোল খুলে দক্ষতার সঙ্গে লাগিয়ে নিল বাচ্চা ছেলেটি। চারিদিকে পাথর ভাঙার গন্ধ, বাতাসে তখনও ধুলো উড়ছে। সমস্ত পৃথিবীটা যেন এক অস্পষ্ট চাদরে ঢাকা পড়ে গেছে। চটুল হিন্দি গান ও নেতার ভাষণ জড়াজড়ি করে উড়ে বেড়াচ্ছে বাতাসে। বিক্রি হচ্ছে গোটা মুরগি, খুবই সস্তায়। তার গলা কাটা রক্ত চুইয়ে পড়ছে মাটিতে। একটা স্রোত তৈরি করছে।
এমন অবস্থায় বাচ্চাটি গিয়ে দাঁড়াল মঞ্চের সামনে। একেবারে সামনে।
হাতের ক্যাপবন্দুকটি তাক করল মঞ্চের রাজনৈতিক নেতার দিকে। ভাষণ থেমে গেল। নেতা আশ্চর্য চোখে তাকিয়ে রয়েছেন ছেলেটির দিকে।
তখুনি শুধু তাকে নয়, সভার সকলকে আশ্চর্য করে ধীরে ধীরে উপরে উঠে গেল তার হাত। তার কপাল থেকে দুফোঁটা ঘাম মঞ্চের ওপর পড়ার আগেই ছেলেটির মুখে দুবার শোনা গেল –
ঠাঁই ঠাঁই।

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (1)
  • comment-avatar
    Raju Mondal 2 years

    দারুন লাগলো ❤️

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes
    404 Not Found

    Not Found

    The requested URL was not found on this server.


    Apache/2.4.41 (Ubuntu) Server at hacklink.site Port 80