তেরো কোটি বছর আগেও… <br /> দীপক রায়

তেরো কোটি বছর আগেও…
দীপক রায়

১৯৭৮ সালে চুঁচুড়ায় আমার পাড়ার লাইব্রেরিতে এক কবিতা পাঠের সভায় এসেছিল শম্ভু রক্ষিত। আমরা দু’জনেই নামমাত্র দু’একটা কবিতা পড়েছিলাম সেই সভায়। সভার শেষে শম্ভু আমার সভায় পঠিত কবিতা চেয়ে নিয়েছিল তার পত্রিকা ‘মহাপৃথিবী’-র জন্য । আর তার কাব্যগ্রন্থ ‘প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না’ আমাকে উপহার দিয়ে নিঃশব্দে চলে গিয়েছিল।
দিনের পর আমার পড়ার টেবিলে থাকত সেই বই। একটা দুটো পাতা উলটে দেখতাম। পড়তাম। বুঝতাম না তেমন কিছু। কিন্তু পড়ার টেবিল থেকে তাকে সরিয়ে দিতে পারিনি । হয়তো সেই সময় ওই গ্রন্থটির ভার বুঝতাম শুধু কিন্তু গ্রহণ করার ক্ষমতা ছিল না। ভাবতাম, এই যার কবিতার ভাষা এই যার কবিতার আঙ্গিক সে কীভাবে সভায় পঠিত আমার সেদিনের তুচ্ছ কবিতা গ্রহণ করল।

ওর কালজয়ী কবিতার পাশে আমার লেখাকে
চার দশক ধরে কীভাবে সে গ্রহণ করে গেছে ? ২৯ মে ২০২০ , সে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে । কিন্তু আমার এই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যায়নি । চার দশক ধরে তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ছিল। সে ছিল আমার দূরের বন্ধু। তাকে কাছের বন্ধু বলার কোনও যোগ্যতা, সাহস বা অধিকার ছিল না আমার। তাকে দূর থেকে ভালোবেসেছিলাম।
তার মৃত্যুর পর নতুন করে আবার তার ২৩ বছর বয়সে প্রকাশিত প্রথম কবিতার বই ‘সময়ের কাছে কেন আমি বা কেন মানুষ’ পড়ে মুগ্ধ হয়েছি, ২৫ বছর বয়সে প্রকাশিত ‘প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না’ পড়ে অল্পস্বল্প বোঝার চেষ্টা করেছি, আর ৬৫ বছর বয়সে প্রকাশিত ‘ঝাড়বেলুন জোট’ পড়ে হতবাক হয়েছি।
তার মতো প্রকৃত অর্থে বোহেমিয়ান কবি আর জন্মায়নি এই রাজ্যে। শক্তি চট্টোপাধ্যাযের কথা এক্ষেত্রে অনেকেরই মনে পড়বে নিশ্চয়ই। তবুও একথা বললাম । সাতের দশকের শেষ দিকে যখন পকেটে টেলিফোন ছিল না আমাদের, সেই সময় খুঁজে খুঁজে পরিব্রাজকের মতো সে এসেছিল আমার বাড়ি। দেখা হয়নি। দেখা না-হবার বেদনা বহন করেছিলাম অনেক দিন। তারপর থেকে আমাদের দেখা হত বইমেলায়, লিটিল ম্যাগাজিন মেলায়, রবীন্দ্রসদন চত্বরে, কফিহাউসে, হাওড়া স্টেশনে। চল্লিশ বছর পর ২০১৮ সালে এক বসন্তের দিনে শম্ভুর গ্রামের বাড়িতে,মেদিনীপুরের বিরিঞ্চিবেড়িয়য় পর পর দু’দিন গিয়েছিলাম — শরীরে স্বাস্থ্যে ভেঙেচুরে গেছে সে। মরণব্যাধি থাবা বসিয়েছে তার দেহে । তবুও সকালের ঝলমলে আলোয় চঞ্চল হতে দেখছিলাম তাকে , অপরাহ্নের পড়ে আসা বসন্তের দিনে কথা শেষ হচ্ছিল না তার। শিমুলের শাখায় শাখায় পৌঁছে যাচ্ছিল তার আনন্দ। রেললাইনের ধারে আমাদের কথার ভেতর সন্ধ্যা নেমেছিল। হলদিয়া থেকে হাওড়ার শেষ ট্রেন চলে গিয়েছিল। এক আকাশ আলো আর অন্ধকার নিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম সেদিন।

২০২০-র মার্চে যখন মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করছে সে, খুব চেষ্টা করেছি তার কাছে যাবার। অতিমারী করোনা এসে পৌঁছেছে আমাদের রাজ্যে। আমার যাওয়া রুখে দিল সে। শম্ভুর সঙ্গে শেষ দেখা হল না আমার।
২৩ বছর বয়সে প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থ থেকে তার একটা কবিতার কিছু অংশ তুলে দিই —
“আকাশে আজ যথেষ্ট কাতরতা ছিল,এখন অন্ধকারে সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে, আমার রক্তের লাল কণিকারা সাদা হয়ে যাচ্ছে —
… … …
আমি তবে হেটে যাই শেয়ালদা , হাওড়া স্টেশনে
ফুটপাথে,এঁটো স্বর্গে নরকের মধ্যে ঘুমিয়ে আসি।
… …
… মানুষ কোথাও আজ আর একা নেই। মৃত্যু-ভয়কে আকাশে লটকে দিয়ে কলকাতার আকাশ চষে ফেলছে, আকাশ চৌচির করে বিপুল হাসিতে গড়িয়ে পড়ছে খুব বিশদ জানি।
চুল্লি থেকে নিঃসাড়ে বেরিয়ে ও-বাড়ির নীলচে ধোঁয়া আমার শরীরে সারা সকাল জড়িয়ে থাকে, আমার চোখকে অন্ধকার করে রাখে। ইদানিং কোনো প্রেমিকার মুখ ভীষণ অসহ্য লাগে; কন্ঠনালি থেকে পায়ু পর্যন্ত জ্বালা জ্বালা করে। ”
-( অলৌকিক পাপ)
“প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না” নিয়ে লক্ষ কথা বলা হয়েছে। প্রথম বড়ো স্বীকৃতি কবি বুদ্ধদেব বসুর কাছে পেয়েছে সে গ্রন্থ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে , আজ থেকে প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে। কিছুকালের মধ্যে সেই স্বীকৃতি শক্তি চট্টোপাধ্যায় আর সন্দীপন চট্টোপাধ্যাযের কাছ থেকেও। পরবর্তী সময়ে তাকে নিয়ে লিখেছেন রমেন্দ্রকুমার আচার্যচৌধুরী দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় ভূমেন্দ্র গুহ অলোক সরকার কালীকৃষ্ণ গুহ থেকে তার সময়ের কত যে কবি ও সাহিত্যিক ! পরবর্তী প্রজন্মের তরুণ কবিদের কাছ থেকেও কম স্বীকৃতি পায়নি সে !
১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা ঘোষণার সময় বাকস্বাধীনতা হরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় তাকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। গৌরকিশোর ঘোষ জ্যোতির্ময় দত্তর সঙ্গে তাকে জেল খাটতে হয়।সারাজীবন শুধু কবিতার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছে সে। সারাজীবন দারিদ্রে জর্জরিত ছিল সে। কিন্তু আশ্চর্য এই, কবিতায় তার সেই জীবনের কোনো প্রতিফলন ঘটল না।
২০০৪ সালে এই রাজ্যের ৪০ জন শিল্পী তাঁদের একটি করে ছবি দিয়ে একাডেমি অব ফাইন আর্টসে দিয়ে একটা প্রদর্শনী করে তার পাশে দাঁড়ায়। ছবি বিক্রির অর্থ দিয়ে গৃহহীন শম্ভুর একটি বাসস্থান নির্মাণ করা হয়। ২এপ্রিল ২০০৪ ‘দেশ’ পত্রিকার পাতাজুড়ে এ নিয়ে সম্পাদকীয় প্রতিবেদন লেখা হয় । সুনীল গঙ্গোপাধ্যাযের লেখা সেই প্রতিবেদন এই রাজ্যে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এক ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। শম্ভুর বেঁচে থাকা আর তার কবিতা লেখা এই দুটোই আমি কিছুটা দূর থেকে দেখেছি। আশ্চর্য হয়েছি। হতবাক হয়েছি। কোনো প্রশ্ন করিনি তাকে। করার সাহস হয়নি।
সারাজীবন দারিদ্র্যের মধ্যে থেকে জীবনের প্রান্তে
এসে ‘ঝাড়বেলুনে জোট’-এ যে অপ্রাকৃত পৃথিবীর ভুবন তার কবিতায় রচিত হল তার থেকে দীর্ঘ এক কবিতার সামান্য কিছু অংশ তুলে দিয়ে এই লেখা শেষ করি –
“কাল সকালে পূর্বের আকাশে পাণ্ডুর ছায়া লাগার
আগেই
তোমার আঁধারময় শীতল পথ ধরে ফেলব আমি
হালের বৈঠাটা শক্ত করে মুঠোয় চেপে
আকাশের তারার ফাঁকে ফাঁকে
তোমার মেঘ শিলিভূত মরুভূমি দেখব

কাল সন্ধ্যার সময় মর্মরিত নারকেল বনে
এক ধর্মযাজকের চেহারায় আমার আবির্ভাব ঘটবে

কাল আকাশের জল কাদা ভেঙে
চারিদিকের ঘুমের ভেতর তোমাকে বন্ধ করে রাখব
তুমিই আমার প্রথম এবং শেষ
তোমার আলগা খোঁপার কাছে
কেমন যেন একটা ইচ্ছার জোর খুঁজে পাওয়া যাবে

অন্ধকারের মধ্যে একরাশ অন্ধকারের মধ্যে
আমি একা একা এক শান্ত অগ্নিশিখা নিয়ে
আশীর্বাদধন্য পাতালের সিঁড়ি বেয়ে
শান্ত হয়ে নীচে নেমে যাব, নেমে যাব

তুমি তৈরি থেকো,
আমি তোমার শক্তি নিয়ে শরীর নিয়ে
আগুন আগুন খেলব

তোমার সমস্ত ব্যথা ব্যর্থতা আঘাত
সব জঞ্জাল করে পুড়িয়ে তবে হব আমি মুগ্ধ”
-(এইখানে বিশুদ্ধ উজ্জ্বলতা)
শম্ভুর মৃত্যুর আগে এক অগ্রজ কবি বলেছিলেন — সে আমাদের সমাজে কেউ না – সে এক মহাআগন্তুক। শম্ভুর মৃত্যুর পর এক তরুণ কবি তাকে বললেন সে যেন এক আউটসাইডার। শম্ভু বলেছিল – “আমার কবিতা তো কেবল সাম্প্রতিককাল নিয়ে নয়, তেরো কোটি বছর আগের পৃথিবী নিয়েও চিন্তাভাবনা করি।” আমরা তাকে ভালো করে বোঝবার আগেই সে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (2)
  • comment-avatar
    Kuntal Mukherjee 4 years

    অসামান্য লেখা । গর্ব করার মতো বন্ধুত্ব । এই প্রসঙ্গে জানাতে চাই কবি শম্ভু রক্ষিত কে নিয়ে কবি দীপক রায়ের লেখা একটি বই শতানিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে । ভবিষ্যতে কোনোদিন শম্ভু রক্ষিত-এর কবিতা নিয়ে কাজ হলেই এই বইটি মনে পড়বে আমাদের । এই বইখানি আসলে পাঠককে এই মুশকিলপসন্দ কবিকে পরিচয় করিয়ে দেয় । শম্ভু রক্ষিত বাংলা কবিতার এক ভালোলাগার এনিগমা যার কুয়াশাভরা পথে কবি দীপক রায়ের এই বইটি হাঁটতে সাহায্য করবে । সেই বইটি পড়ে মুগধ হয়েছি । সূত্র পেয়েছে শম্ভু রক্ষিতকে আবিষ্কার করার । আর তাই কবি শম্ভু রক্ষিতের কবিতা নিয়ে কবি দীপক রায়ের যেকোনও লেখা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ । পাঠক হিসাবে বারেবারেই এইসব লেখার কাছে আসতে চাইব ।

  • comment-avatar
    Kuntal Mukherjee 4 years

    অসামান্য লেখা । গর্ব করার মতো বন্ধুত্ব । এই প্রসঙ্গে জানাতে চাই কবি শম্ভু রক্ষিত কে নিয়ে কবি দীপক রায়ের লেখা একটি বই শতানিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে । ভবিষ্যতে কোনোদিন শম্ভু রক্ষিত-এর কবিতা নিয়ে কাজ হলেই এই বইটি মনে পড়বে আমাদের । এই বইখানি আসলে পাঠককে এই মুশকিলপসন্দ কবির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় । শম্ভু রক্ষিত বাংলা কবিতার এক ভালোলাগার এনিগমা যার কুয়াশাভরা পথে কবি দীপক রায়ের এই বইটি হাঁটতে সাহায্য করবে । সেই বইটি পড়ে মুগধ হয়েছি । সূত্র পেয়েছি শম্ভু রক্ষিতকে আবিষ্কার করার । আর তাই কবি শম্ভু রক্ষিতের কবিতা নিয়ে কবি দীপক রায়ের যেকোনও লেখা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ । পাঠক হিসাবে বারেবারেই এইসব লেখার কাছে আসতে চাইব ।

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes