জলের ভিতরে তবু অগ্নি
গৌতম চৌধুরী
কারারুদ্ধ কবি ওয়রওয়রা রাও-এর ৮০ বছরের জন্মদিনে, তাঁকে প্রণাম
১.
রাত্রির স্থাপত্য। প্রান্তিক আশ্রয়। অথবা আদ্যা। কে বলিতে পারে! শিশির-চিকচিকানো ঘাসও রাত্রি। সাক্ষী, নীরব ব্রোঞ্জের ঘোড়া। চিরসম্মোহিত সে। চোখে অশ্রু, স্তব্ধতার। বন্দরে থম-ধরিয়া-থাকা জাহাজটির চোখে ওই দৃশ্য। বহুদিন পরে আজ তাহার কল-কব্জায় ফুঁ। লোক-লস্কর পরখ করিয়া দেখিতেছে চাকা ও চুল্লি। বাঁশিতে ভোঁ পড়িল বলিয়া। আরও দেরি হইলে হাড়ে হাড়ে জং। সারেঙের দল পাচার করিয়া দিত জাহাজ-ভাঙার কলে। লঝঝরে লোহার স্তূপে মুখ থুবড়াইয়া পড়িয়া থাকিত, পরচা-হারানো অনাগরিক।
তবে কি সত্যই এই রাত্রি! এই ঢেউগুলি সত্য? দূরে জ্বলিয়া-উঠা দিগন্তরেখা সত্য? লোহার শৃঙ্খলগুলি বাতাসে মচকাইয়া উঠিতেছে। বাঁশিতে ভোঁ পড়িল বলিয়া। পুঞ্জ পুঞ্জ তারাদল এখানে ওখানে কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিতেছে। তাহারাও আজ উৎসুক। কী ঘটে, কী ঘটে! আটক-ছাউনির দড়িদড়া ঢেউটিন ওই বুঝি শূন্যে মিলায়।
২.
একটি সফেদ পালক নিমেষে কবুতর। জাদুকর পারে। নদীনালাও ফোটে মানচিত্রে। প্রচণ্ড গর্জনে বান আসিল। মহিষ ভাসিয়া যায় সেই তোড়ে। কোথাও পাড় ভাঙে হুড়মুড়। গাছ গাছালি, দালান কোঠা, ইস্কুল-মাদ্রাসা বেবাক গায়েব। এক মুহূর্তে ইতিহাস ভূগোল সকলই মুছিল। কী গভীর এই আত্মপরিচয়হীনতা! সাদা কাগজ বুকে ঝুলাইয়া দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা। এক মুষ্টি সরিষা মাত্র – কত অপ্রতুল!
হায় জাদুকর। কত কঠিন তাহার পরীক্ষা। সকল জাদুই অলীক যদিও। সকলেই জানে। তবু স্বপ্ন। তবু মায়া। ক্ষতি নাই। নহিলে তো এ-দুনিয়ার পুরাই বরবাদ। স্বপ্ন, ভ্রূণের মতো ভাসিতেছে গর্ভে। হাসিতেছে। হাত-পা ছুঁড়িতেছে। সমস্ত আগামী ভাসিয়া উঠিতেছে পর্দায়। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকের ভিতর রচিত হইতেছে এক ছিন্নতন্তু গাথা। কাহিনিহীন।
৩.
মুহূর্তের সত্য অবিরত মুহূর্তে মিলায়। তবু তাহাদের নিশানে ঝাপসা বাতাসের পতপত। ছড়াইয়া পড়ে ধ্বনি। ধ্বনি, ছড়াইয়া পড়ে পাখির ডানা হইতে। ছড়াইয়া পড়ে পাথরের ভাঁজে লুকানো জল হইতে। সকলেই সংকেত ছড়াইয়া দিতে চায়। রাত্রিব্যাপী নৌকা চলে, ছপছপ ছপছপ। আকাশের এই পারের তারা পৌঁছাইয়া যায় ওই পারে। ভোরের সেই তারাটি তবু গায়েব। তাহাতে কী? তীব্রকণ্ঠে দুই চারিটি পাখি ডাকিয়া উঠে। ধ্বনি মিলাইয়া যায় ক্ষীণ অন্ধকারে। আলোর ঘ্রাণ আসিয়া স্পর্শ করে তাহাদের।
এখন উচ্চারণ শব্দহীন। মন্ত্র ধ্বনিহীন। তবে কি তাহা এক প্রত্যাহার? তবে কি তাহা এক নিবর্তন? উত্তরের খোঁজে ব্যাঙ্গমা উড়াল দেয় দৃশ্যান্তরে।
৪.
নারী পুরুষ বা তৃতীয় কেহ নয়। প্রস্তরীভূত এক গান। কী দেখিয়াছে সে? মিথ্যার পর মিথ্যা, হত্যার পর হত্যা, ধ্বংসের পর ধ্বংস। কালো ঝলসানো এক আকাশে মাঝে মাঝে রক্তকুলিশ। বিশাল ডানামেলা পাখির দল তীব্রতম নখর ও চঞ্চু লইয়া একবার করিয়া ঝাঁপাইয়া পড়ে। হাড়গোড় পড়িয়া থাকে নগরের। ধোঁয়ার কুণ্ডলী ঢাকিয়া দেয় জনপদ। আকণ্ঠ তৃষ্ণায় সেই গান নদীতে নামিয়াছে। জল অপেয়। প্রান্তরে ছুটিয়াছে। বাতাস নাই। অতঃপর সে পাথর হইয়া পড়িয়া আছে। কে তাহাকে বাজাইবে? কে ভাঙাইবে ঘুম? সে কিন্তু ঘুমায় নাই। একটি গহন প্রকোষ্ঠের ভিতর দুইটি নিমীলিত চক্ষু, ওই পড়িয়া আছে তাহার প্রাণ। চারিদিকে রেশমগুটির মতো পাথরের সুতার পাক।
গান জাগো গান জাগো – পাথরখণ্ডের কাছে কাকুতি করিল একদল মেষপালক। পাথর জাগিল না। আহিরিণীরা নাচিল ঘুরিয়া ঘুরিয়া। পাথর ঘুরিল না। কিন্নরেরা আসিয়া গাহিল, গন্ধর্বেরা বাজাইল। সকলই মিলাইল পোড়া প্রান্তরে। বিতাড়িত একদল মানুষ মাথা নিচু করিয়া পরিখার উপরের সাঁকো পার হইতেছিল। তাদের নিচুকণ্ঠের বিলাপে পাথর নড়িয়া উঠিল। ভিতর হইতে কে গাহিয়া উঠিল – আমিও নির্বাসিত, আমাকেও সঙ্গে লও তবে।
৫.
কে নিবে কাহারে সঙ্গে! যাইতে হইলে যাও, একাকী। চলিতে হইলে চলো, বিনা রণধ্বনি। অর্গল খুলিয়া যায় রুদ্ধ প্রাচীরের। বাতাস তবু থমকাইয়া। সরলরেখার পথ কি তাহার? নৌকা ডুবে এবং ভাসে। বেলুন উড়ে এবং ফাঁসে। অপরে ভাবে, কী কুদরতি। সে ভাবে, কী এক বদ নসিব ঘাড়ে করিয়া জন্ম তাহার। অনেক চাওয়াই যে ভুয়া, জানা হইল। তাই এই বাগ্যতি। ভিক্ষার আকুতিতে করতল প্রসারিত। অমনই কুঁকড়াইয়া আসে আঙুল। সংবরণের প্রচণ্ড তাপে গলন্ত মোমের মতো ঝরিয়া ঝরিয়া পড়ে। অন্ধকার আরও স্তরকম্পিত সেই ছায়াময় দশ শিখধ্বজে।
এখনও প্রহর অনেক। ভিন তরঙ্গদৈর্ঘ্যে জানান দেয় পেঁচা ও শৃগাল। এই রাত্রি কাটিবে না – ইহা আস্থা। তর্কাতীত। জলের ভিতরে তবু অগ্নি। ভাষার ভিতরে তবু সন্ত্রাস। দেরি বলিয়া কিছু নাই। যেকোনও দিনই যথাযোগ্য। বাতাস পাক খাইতে থাকে। ঢেউ লাফাইয়া উঠে সমুদ্রে।