চিন্তার চিহ্নমালা ২
সন্মাত্রানন্দ
"নিয়মের প্রাসাদ অবিশ্বাস্যরকমভাবে হুমড়ি খেয়ে পড়ল একটি বিশ্বব্যাপী মহামারীতে। দিব্যি চলছিল তো জীবন দুলতে দুলতে, আমরাও মোটামুটিভাবে এই হয়েছে আর এই হবে ভেবে রোজ রাত্রে ঘুমোতে গেছিলাম। এবং আমাদের বিজ্ঞানের অহংকার ছিল, বিজ্ঞান আমাদের জীবনকে সুরক্ষিত করেছে, নিরাপত্তা দিয়েছে ভেবে আমরা দিব্য সুখে ছিলাম। সেই নিশ্চিন্ততার মধ্যে একবারও আমরা চিন্তা করিনি যে, আমাদের সুস্থিত সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্রযন্ত্রের পরিকাঠামোর ভিতর কোথাও ঘুন ধরছে, পৃথিবীর পথে পথে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতিদিন অনাহারে মরছে, পদে পদে অবমানিত হচ্ছে, রুগ্ন ব্যবস্থার মধ্যে শোষিত হতে হতে কার দুয়ারে তারা বিচারের জন্য আর্জি জানাবে খুঁজে পাচ্ছে না। সন্মাত্রানন্দ-র ধারাবাহিক গদ্য 'চিন্তার চিহ্নমালা'-র দ্বিতীয়্ পর্ব প্রকাশিত হল।
‘চিন্তার চিহ্নমালা’-র প্রথম পর্ব পড়ার জন্য ক্লিক করুন —-> প্রথম পর্ব
নৈরাজ্য
আমরা বেশিরভাগ মানুষ মনে করি, সব নিয়মে চলছে। মানে, চলা উচিত।
এবং সেই নিয়মটাকে আমরা অনেকটাই খুঁজে বের করে ফেলেছি। খুঁজে পেতে আর যা যতটুকু বাকি আছে, খুব শীঘ্রই আমাদের বিজ্ঞানীরা, আমাদের চিন্তকরা তা বের করে ফেলবেন। আমরা এরকম মনে করি। আমাদের বিজ্ঞানীরা ‘থিওরি অব এভরিথিং’, যা দিয়ে জগতের যাবতীয় ঘটনার ব্যাখ্যা করা যাবে, এমন কিছুর অনুসন্ধানে সম্প্রতি বিনিদ্র রজনী কাটাচ্ছেন। আমরা বেশিরভাগ মানুষ তাঁদের মুখের দিকে তাকিয়ে বসে আছি।
আবার আমাদের মধ্যেই একদল আছেন, যাঁরা মনে করেন, যদিও এমন কোনো চরম নিয়মের দ্বারাই জীবনের ও জগতের সমস্ত ঘটনা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, তবু সেই চরম নিয়মটা কখনই বুদ্ধিগম্য করা যাবে না। এরা ‘অজ্ঞেয়বাদী’ বা ‘অ্যাগনস্টিক’। লক্ষণীয়, এঁরাও কিন্তু চরম কোনো নিয়মেই আস্থাশীল। শুধু তার নিরূপণসামর্থ্যে আস্থাশীল নন, এই মাত্র।
আরেকদল মানুষ বলবেন—না, এমন কোনো নিয়ম আদৌ নেই। এঁদেরকে ‘এথিস্ট’ বা ‘নাস্তিক’ বলা যেতে পারে। মজার ব্যাপার, এঁরা নিয়মের অনস্তিত্বে আস্থাশীল। অর্থাৎ, আস্থা একটা আছেই। আর সেটা অনস্তিত্বে, এটুকুই।
আবার কেউ বলবেন, নিয়মটিয়ম কিছু নেই। জীবনের কোনো গন্তব্যই নেই। অতএব, এসো, জীবনটাকে লুটেপুটে ভোগ করি। এমন যাঁরা বলেন, তাঁরা ‘হেডনিস্ট’। জীবনের কোনো উদ্দেশ্যই যখন নেই, তখন ভোগ করাটাই বা কেমন করে উদ্দেশ্য হল, এ প্রশ্ন এঁদের করাই যায়। তবে সে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দায় তাঁদের নেই। বরং প্রশ্নটাকেই তাঁরা উপভোগ করবেন; যেহেতু উপভোগ করাই তাঁদের লক্ষ্য।
কথা এঁদের নিয়ে নয়। কথা আমাদের সেইসব বেশিরভাগ মানুষদের নিয়ে, যাঁরা বিশ্বাস করি, এই জগৎ ও জীবনের পশ্চাতে অলঙ্ঘ্য কোনো নিয়ম আছে, যার প্রশাসনে দুনিয়া ঘুরছে। শুধু তাই নয়, এর উপর আমরা আবার সেই অমোঘ নিয়মের নির্ণয়সামর্থ্যেও বিশ্বাস করি। সেই নির্ণয় কীভাবে হতে পারে? মোটামুটিভাবে এর একটা পদ্ধতিও আমরা স্মরণাতীত কাল থেকে ঠিক করে বসে আছি।
সেই নির্ণয়প্রণালী এবম্প্রকার। প্রথমে আমাদের মন এই প্রকৃতিকে পর্যবেক্ষণ করে। সেই পর্যবেক্ষণ থেকে নমুনা বা স্যাম্পল আহরণ করে। তারপর ওই সব নমুনাগুলোকে একটা কোনো সূত্রে বাঁধবার জন্য একটা তত্ত্ব খাড়া করে। ধরা যাক, সেই তত্ত্বের নাম ‘তত্ত্ব ১’। এবার এই তত্ত্ব-১-এর সাহায্যে আমরা পরবর্তী ঘটনাগুলি সম্ভাবিত হবে, আশা করি। অর্থাৎ, তত্ত্ব-১-এর সাহায্যে আমরা কিছু ঘটনা ‘প্রেডিক্ট’ করি। এর পর আমরা আবার পর্যবেক্ষণে যাই। পরে যা ঘটছে, সেগুলো ‘তত্ত্ব-১’ মেনে ঘটল কিনা, তা মিলিয়ে দেখি। যতক্ষণ তা মিলে যায়, আমরা উল্লসিত বোধ করি। এরপর যেই এমন কোনো ঘটনা ঘটে, যা ‘তত্ত্ব-১’ দিয়ে আর ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না, অমনি আমরা তাকে ‘ব্যতিক্রম’ বলে চিহ্নিত করি। কেউ কেউ আবার কাঁধের ওপর কলার উলটে ‘ব্যতিক্রম নিয়মেরই প্রমাণ’ ইত্যাদি বলে আত্মপ্রসাদ লাভ করি। কিন্তু সে চেষ্টা আসলে ‘বৃথা চেষ্টা ফুটা পাত্রে তৃষ্ণা মিটাবারে’। ফলত, যুক্তিশীল মানুষ ওইখানেই না থেমে গিয়ে এবার ‘তত্ত্ব-১’টিকে আরেকটু সম্প্রসারিত করার চেষ্টা করেন। অর্থাৎ ‘তত্ত্ব-১’-টারই একটু ফুটোফাটা সারিয়ে আরেকটা নতুন ‘তত্ত্ব-২’ দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয়, যাতে এই ‘তত্ত্ব-২’-এর সাহায্যে আগের ঘটনাগুলো তো ব্যাখ্যা করা যায়ই, তদুপরি সম্প্রতি যে বেয়াড়া অবজারভেশনগুলো দেখা গিয়েছিল, সেগুলোকেও এই নতুন ‘তত্ত্ব-২’ এর আলোকে ব্যাখ্যা করে দেওয়া যায়। কিন্তু এতেই যুক্তির ট্রেন থামে না। এর পর আবার ‘তত্ত্ব-২’-এর সাহায্যে নতুন করে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়। সেসব ভবিষ্যদ্বাণী খানিক মেলে, খানিক অবশ্যই মেলে না। অমিলগুলোকে নিয়মের পরিধির মধ্যে আনার জন্য আবার ‘তত্ত্ব-২’ কে ইম্প্রুভ করে ‘তত্ত্ব-৩’ বের করা হয়। এইভাবে তত্ত্ব-৩, তত্ত্ব-৪, তত্ত্ব-৫…… অন্তহীনভাবে চক্রাকারে ঘুরে চলেছে।
ব্যাপারটা বেশ সোজাই। তথাপি যাঁদের এই আলোচনা ভজকট লাগছে, তাঁদের জন্য নীচের রেখাচিত্র—
প্রকৃতি-পর্যবেক্ষণ ও নমুনা-আহরণ>>>>> তত্ত্ব-১ নির্মাণ>>>> ভবিষ্যদ্বাণী>>>>নতুন করে নমুনা আহরণ>>>> আহৃত তথ্যের সঙ্গে প্রস্তাবিত তত্ত্ব-১ এর তুলনা>>>>> ব্যতিক্রমী ঘটনা সার্থকভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য তত্ত্ব-১-এর উন্নতিসাধন>>>>> তত্ত্ব-২ নির্মাণ>>>>ভবিষ্যদ্বাণী>>>>নতুন করে নমুনা আহরণ>>>> আহৃত তথ্যের সঙ্গে প্রস্তাবিত তত্ত্ব-২ এর তুলনা>>>>> ব্যতিক্রমী ঘটনা সার্থকভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য তত্ত্ব-২-এর উন্নতিসাধন>>>>> তত্ত্ব-৩ নির্মাণ >>>> চলছে তো চলছেই, চলছে তো চলছেই, চলছে চলবে…
অর্থাৎ, কোনোদিন এমন কোনো চরম তত্ত্বে পৌঁছানো যাবে, যার আর উন্নতিবিধানের প্রয়োজন হবে না, যার প্রয়োগসীমার মধ্যে আর কোনো ব্যতিক্রম দেখা দেবে না—এমন একটা বিশ্বাস আমরা করে বসে থাকলেও, আমাদের সেই আশা ফলবতী হবে, এমন কথায় ভরসা রাখার মতো যুক্তি কিছুই নেই।
এই কথাটা বুঝতে পেরে জীবনানন্দ দাশ তাঁর ‘মানুষের মৃত্যু হলে’ কবিতায় প্রশ্ন তুলেছিলেন—
“সকল রৌদ্রের মতো ব্যাপ্ত আশা যদি
গোলকধাঁধায় ঘুরে আবার প্রথম স্থানে ফিরে আসে
শ্রীজ্ঞান কী তবে চেয়েছিলো?
সূর্য যদি কেবলি দিনের জন্ম দিয়ে যায়,
রাত্রি যদি শুধু নক্ষত্রের,
মানুষ কেবলি যদি সমাজের জন্ম দেয়,
সমাজ অস্পষ্ট বিপ্লবের,
বিপ্লব নির্মম আবেশের,
তাহলে শ্রীজ্ঞান কিছু চেয়েছিলো?” ( মানুষের মৃত্যু হলে / শ্রেষ্ঠ কবিতা)
নিয়মের অস্তিত্বে বিশ্বাসী যাঁরা, তার নির্ণয়সামর্থ্যে যাঁরা আস্থাশীল, তাঁদের এই আস্থার প্রাসাদ ধূলিস্যাৎ হয়ে যায় কখনো-বা হঠাৎ করেই। প্রতিটি জীবনের সঙ্গেই জড়িত হয়ে আছে একটি অনিবার্য অন্তিমতা, যাকে আমরা ‘মৃত্যু’ বলি। একদিন জীবনের এই কার্নিভাল হঠাৎ করে থেমে যায়। সামনের দিনগুলোর জন্য আমাদের পরিকল্পনা, আমাদের স্বপ্নের উপর হঠাৎ করে নির্মম যবনিকা-পতন। হঠাৎ যেন টের পেতে হয় আমাদের যে, এতক্ষণ ধরে একটা অর্থহীন নাটকই আমরা দেখে চলছিলাম। এই জীবন সত্যিই যেন একটা স্বপ্ন। আর স্বপ্ন কখনও লজিকালি ভাঙে না। একটি গল্প বা উপন্যাস যখন আমরা লিখি, তখন তার শেষটায় যেমন আমরা যথাসম্ভব গুছিয়ে কোনো একটা পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি, জীবন ওরকম গুছিয়ে শেষ হয় না। হুট করে ফুরিয়ে গিয়ে সব অন্ধকার হয়ে যায়। আমাদের পরিচিত প্রিয়জনদের দিকে তাকিয়েও মনে হয়, এ যেন একটা অবিশ্বাস্য ঘটনা। শ্মশানে শবদাহ করতে গিয়ে বহুবার সুপরিচিত ব্যক্তির মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে আমি মনে মনে এই প্রশ্নই করেছি:এই মৃতদেহটি কি তাঁরই, যাঁকে আমি দিনের পর দিন দেখেছি? যাঁর সঙ্গে আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভাববিনিময় করেছি? ইনিই কি তিনি? এত অসহায়, এত অর্থহীন, এত তুচ্ছ, এত অবাস্তব! অথচ অবাস্তব তো নয় মোটেই, কারণ সেই লোকই তো এই যে চোখের সামনে মরে পড়ে আছেন। তাহলে এই যে ‘অবাস্তব’ মনে হচ্ছে, তার আসল কারণ কী? আসল কারণ হল, জীবন সম্পর্কে যা আমরা স্বাভাবিক, সুষ্ঠু, নিয়মিত বলে ধরে নিয়েছিলাম, সেই নিয়মের প্রতিমা এখানে চুরমার হয়ে গেছে মৃত্যুর দন্তুর পরিহাসের ভিতর।
নিয়মের প্রাসাদ অবিশ্বাস্যরকমভাবে হুমড়ি খেয়ে পড়ল একটি বিশ্বব্যাপী মহামারীতে। দিব্যি চলছিল তো জীবন দুলতে দুলতে, আমরাও মোটামুটিভাবে এই হয়েছে আর এই হবে ভেবে রোজ রাত্রে ঘুমোতে গেছিলাম। এবং আমাদের বিজ্ঞানের অহংকার ছিল, বিজ্ঞান আমাদের জীবনকে সুরক্ষিত করেছে, নিরাপত্তা দিয়েছে ভেবে আমরা দিব্য সুখে ছিলাম। সেই নিশ্চিন্ততার মধ্যে একবারও আমরা চিন্তা করিনি যে, আমাদের সুস্থিত সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্রযন্ত্রের পরিকাঠামোর ভিতর কোথাও ঘুন ধরছে, পৃথিবীর পথে পথে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতিদিন অনাহারে মরছে, পদে পদে অবমানিত হচ্ছে, রুগ্ন ব্যবস্থার মধ্যে শোষিত হতে হতে কার দুয়ারে তারা বিচারের জন্য আর্জি জানাবে খুঁজে পাচ্ছে না। আমাদের এই আরামদায়ক ভুলে থাকার কারণ আমাদেরই ওই নিশ্চিন্ততার বোধ, যা প্রচলিত কোনো একপ্রকার নিয়ম—হোক তা রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর অচল বিশ্বাস কিংবা বিজ্ঞানের অমিতসম্ভব শক্তির উপর আস্থা অথবা আমাদের কল্পিত ধর্মধারণার ‘প্রশাসক নিয়ন্তা ঈশ্বর’-এর প্রতি আনুগত্য—কোনো না কোনোভাবে কোনো একপ্রকার স্থির নিয়মে মতিমান হওয়ার ফলেই। দেখা গেল, আমাদের সেই মতি ধাক্কা খেল, লুটিয়ে পড়ল, গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল সামান্য একটি আণুবীক্ষণিক জীবের দৌরাত্ম্যে। আমরা জীবনকে আবার নতুন কোনো নিয়মে বাঁধতে লেগেছি এর পরেও, ‘খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি’, কারণ আমরা যন্ত্রই হতে চাইছি, আমরা ভুলে যাচ্ছি নিয়ম যন্ত্রের ধর্ম, ভুলে যাচ্ছি প্রাণের অস্তিত্বই দাঁড়িয়ে আছে সকল প্রকার জড় নিয়মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণার মধ্যেই।
এরকম হাজারটা উদাহরণ দেওয়া যায়, যেখানে এই নিয়ম কার্যকর হচ্ছে না। নিয়ম ভেঙে পড়ছে। তাহলে, এমনটা মনে হওয়াই সঙ্গত যে, আসলে এই জগৎ বা জীবনে আদৌ কোনো চরম বা পরম নিয়ম নেই। যা আছে, তা হল, সীমাহীন নৈরাজ্য। এবং সেই নৈরাজ্য আমাদের কল্পিত বা স্থাপিত নিয়মগুলোকে একটা সীমা অবধি সহ্য করে চলে মাত্র। সময় আসে, যখন ওই নৈরাজ্য আত্মপ্রকাশ করে আমাদের নিয়ম-আসক্ত ব্যবস্থাকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে যায়। নিয়ম আদিতেও ছিল না, অন্তেও থাকবে না, মাঝখান থেকে আমরা একটা অর্থহীন নিয়ম-নিয়ম খেলা খেলে চললাম। সে খেলা আগেও বারবার ভেঙেছে, পরেও বারবার ভাঙবে এবং চিরকালই নৈরাজ্যই রাজ করে চলবে।
এই ভাবনায় একটা মারাত্মক ভুল হবে, যদি নৈরাজ্যকেই আমরা জগতের ‘পরম নিয়ম’ ভেবে বসি। যদি ভাবি, নিয়ম-না-থাকাটাই জগতের পরম নিয়ম, তাহলে আমরা আবার সেই আরেক ধরনের নিয়মের চক্করে গিয়ে পড়ব। মুশকিল হচ্ছে, আমাদের এই নিয়ম-আসক্তি নিয়ে। যেই বলা হল, ‘নিয়ম নেই’, তখন এই ‘না- নিয়ম’কেই আমরা একটা নতুন নিয়ম ধরে বসলাম। যেন একটা দোকানে সারাদিন ধরে হাজার হাজার মতবাদ বিক্রি হচ্ছে। সারাদিন ধরে বিক্রিবাটার পর দোকানদার দেখল, দোকান শূন্য, আর একটা জিনিসও দোকানে নেই, সব বিক্রি হয়ে গেছে। এই দেখে সে হৃষ্টমনে যখন দোকানের শাটার নামাতে যাচ্ছে, তখন উপস্থিত হল এক নির্বোধ ক্রেতা। সে দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করলঃ
“ভাই, এখানে অস্তিত্ববাদ আছে? কত দাম?”
দোকানদারঃ না, নেই। বিক্রি হয়ে গেছে।
ক্রেতাঃ নাস্তিত্ববাদ?
দোকানদারঃ নেই।
ক্রেতাঃ অজ্ঞেয়বাদ আছে নিশ্চয়ই?
দোকানদারঃ না, ফুরিয়ে গেছে।
ক্রেতাঃ সংশয়বাদ?
দোকানদারঃ না, দাদা, সেও শেষ।
ক্রেতাঃ আচ্ছা, একটু ঈশ্বরবাদ পাব?
দোকানদারঃ না, একটু আগেই ফুরিয়ে গেল।
ক্রেতাঃ রাষ্ট্রবাদ?
দোকানদারঃ নেই।
ক্রেতাঃ আন্তর্জাতিকতাবাদ? মার্কসবাদ?
দোকানদারঃ না, দাদা, নেই।
ক্রেতাঃ প্রেম? করুণা? মানবতা? বিজ্ঞান? কবিতা? কথা? ধর্ম? অর্থনীতি? চিকিৎসা? সংবাদমাধ্যম?
দোকানদারঃ বলছি তো, কিচ্ছু নেই, দাদা, এখন। আপনি আসুন।
ক্রেতাঃ ও। কিছুই নেই? তাহলে ওই ‘কিছু নেই’ জিনিসটাই দাও আমাকে।
এই ক্রেতার নির্বোধ আবদারের মতই হবে যদি আমরা এই নৈরাজ্যকে আরেকটি মতবাদ বলে দাঁড় করাই। কারণ, এই মতবাদ-দাঁড়-করানোর অপচেষ্টার বিরুদ্ধেই নৈরাজ্যের যাবতীয় বিদ্রোহ।
প্রতিটি মতবাদ বা নিয়মের আপেক্ষিক প্রয়োজনীয়তাকে আমি অস্বীকার করছি না। একটা নির্দিষ্ট পরিসরে তাদের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু যেকোনো মতবাদকেই, চিন্তার যেকোনো অবদানকেই পরম নিয়ম বলে মেনে নিলে মূর্খের স্বর্গে বাস করা হবে। নৈরাজ্যের ধারণাও একটি ধারণা, এবং সেই ধারণাকেও পরম বলে ভাবলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
তাই তথাগত বললেন, হে আনন্দ! আমি শাশ্বতবাদ বা নৈরাজ্যবাদ—এ দুয়ের কোনোটিকেই সত্য বলে মানি না। যা আমি অনুভব করেছি, সেই ‘বোধি’ কোনো তত্ত্ব নয়। কোনো মতবাদ নয়। মতবাদ-আসক্ত এই ধূলিধূসরিত ধরণীতে আমি আরেকটি নূতন মতবাদ প্রণয়ন করতে আসিনি। আমি শুধু বলেছি, সমস্ত মতবাদে আসক্তি পরিত্যাগ করে দ্যাখো। সত্য যা, তা স্বতঃই তোমার মনে ফুটে উঠবে। এসো, দ্যাখো। এহি, পশ্য।
কিন্তু মতবাদ সম্পর্কে বুদ্ধের এই নীরবতাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়েই বৌদ্ধরা তৈরি করে বসলেন বৌদ্ধ-দর্শনের প্রাসাদ, খিলান, অলিন্দ, ছাদ, চূড়া। শুধু বৌদ্ধরাই নন, পৃথিবীর যাবতীয় ধর্ম ও দর্শনের বেলাতেই এই হয়েছে। প্রফেটরা কখনও মতবাদ দেননি, তত্ত্ব কপচাননি। তাঁরা ছিলেন তাঁদের নীরব অনুভবের প্রতিমূর্তি। কিন্তু তাঁদের এই হিরণ্ময় নীরবতার ভাষ্য রচনা করতে গিয়েই মানুষ তত্ত্বের পর তত্ত্বের জাল বুনেছে নিজের চারিদিকে, শেষে সেই জালে আবদ্ধ হয়ে পোকার মতই শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরেছে।
সুতরাং, এই উপরে যা লিখলাম, নৈরাজ্য সম্পর্কে আমার এই যে লেখা, একে স্বীকার করে নিলেই একে সর্বাধিক অস্বীকার করা হবে।
(ক্রমশ)
চ ম ৎ কা র
ধন্যবাদ
সাম্প্রতিক সময়ে পড়া সব থেকে গভীর, দর্শনচর্চার রত্নদ্বীপ। এই লেখাটা পড়ে অনেক প্রশ্নের জন্ম নেবে, তরুণেরা পড়ুক এই লেখা। শ্রদ্ধা জানাই লেখককে।
প্রশ্নেরা জন্ম নিক। নির্বিচার নিষ্প্রশ্ন আনুগত্যের মৃত্যু হোক। নমস্কার।
দুর্দান্ত লাগছে
শুভেচ্ছা।
‘চিন্তার চিহ্নমালা’র দ্বিতীয় পর্ব পড়লাম। এই লেখা সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করার মতো মেধা আমার নেই। এমন একটি লেখা পড়ে আনন্দিত মুগ্ধ। লেখককে আমার পরম শ্রদ্ধা। লেখাটির মধ্যে মৃত্যু সম্পর্কে লেখকের যে গভীর উপলব্ধি তা এই পাঠককে যথেষ্টই আপ্লুত করেছে। নিকটজনের মৃত্যু এই পাঠককে এমনই হতাশা দুঃখে ভারাক্রান্ত করে যে মাঝে মাঝে মনের মধ্যে এক প্রশ্ন আগুনের জ্বালার মতো, এ নিয়ম কি সত্যিই কোনোভাবে লঙ্ঘন করে যাওয়ার উপায় নেই? হয়তো আছে, হয়তো নেই। লেখককে আমার প্রণাম।
ধন্যবাদ। আপনার প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতেই তো পৃথিবীর যাবতীয় ধর্মদর্শনের জন্ম। যতক্ষণ নিজেকে আমি শরীরমাত্র মনে করি, ততক্ষণা একে অতিক্রম করার উপায় নেই। কিন্তু যদি আমার চেতনাকে আমি চিনে নিতে পারি, তাহলে আশা আছে।
খুব ভালো লাগছে,শেষ করা না পর্যন্ত শান্তি নেই