চিত্রকলা ও যক্ষপুরীর রবীন্দ্রনাথ
গৌতম বসু
" বিশ্ব-সাহিত্যের ইতিহাসে আমাদের রবি ঠাকুর, শেক্সপীয়র, গ্যোয়েটে, উগো, টলস্টয় প্রমুখের সমগোত্রীয়। দান্তে বর্ণিত নরকাগ্নিতে তাঁকে যদি নিক্ষেপ করা হত, তাহলে, সন্দেহ নেই, তিনি মহাকবি হোমর, হরেস, ওভিড–এর সঙ্গে প্রথম বৃত্ত, লিম্বো-য় বিরাজ করতেন। কিন্তু, প্রশ্ন উঠছে, চিত্রকলার জগতে আমরা কি তাঁকে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, মিশেলঅ্যাঞ্জেলো, রাফায়েল, রেম্ব্রান্ট, ভ্যান গগের পাশে স্থান দিতে পারব? প্রশ্নটির উত্তর উহ্য রেখে, আমরা বরং বিশ্বের চিত্রকলার ইতিহাসে তাঁর অবস্থান নির্ণয়ে ফিরে যাই। আমরা দেখাবার চেষ্টা করেছি যে চিত্রকলায় রবীন্দ্রনাথ-এর কোনও পূর্বজ নেই, তিনিই ঐতিহ্যের উদ্ভাবক। একজন উদ্ভাবক, তিনি যতই অতিমানবিক শক্তিসম্পন্ন হোন, তাঁর কাজের পরিণতি তিনি দেখে যেতে পারেন না, রবীন্দ্রনাথও পারেন নি। মিকেলঅ্যাঞ্জেলো-র সঙ্গে তাঁর প্রভেদ এইখানেই, মিকেলঅ্যাঞ্জেলো এক সুদীর্ঘ পরম্পরা নিয়ে দাঁড়িয়ে, সেই পরম্পরাকে তিনি আরও এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এই অর্থে, চিত্রকলার ক্ষেত্রে, মিশেলঅ্যাঞ্জেলো এবং রবীন্দ্রনাথ, দু’জনে দু’টি ভিন্ন পাটাতনে অবস্থান করছেন, একজনকে অপরের সঙ্গে তুলনাই করা চলে না। চিত্রকলার জগতে রবীন্দ্রনাথের স্থান মিশেলঅ্যাঞ্জেলো-র নিচেই থাকবে, এটা যেমন রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে অগৌরবের বিষয় নয়, ঠিক তেমনই মিকেলঅ্যাঞ্জেলো-র পক্ষে শ্লাঘাবোধেরও প্রসঙ্গ নয়।" রবিপক্ষ। লিখলেন গৌতম বসু।
লিপির আশপাশ থেকে গজিয়ে ওঠা রেখা নিয়ে খেলতে-খেলতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অজানার উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছিলেন। ক্রমে, কবিতা লেখার জন্য খাতা নয়, ছবি আঁকার জন্য তাঁকে কাগজ কিনিয়ে আনাতে হল, সেই সব কাগজ এমন চিত্রে ভ’রে উঠতে লাগল যার সঙ্গে আপাতদৃষ্টিতে রবীন্দ্রলোকের কোনও সাদৃশ্য নেই। এরা কি পাখি, না তীক্ষ্ণ লোহার পাত জুড়ে-জুড়ে নির্মাণ করা বোমারু বিমান? পথের শেষে, গাছেদের ফাঁকে ও কি সূর্যালোক, না কি হলুদ যবনিকা? ওই সেই অরণ্য, যেখান থেকে নিষ্ক্রান্ত হওয়ার পথ মানুষের অজ্ঞাত। পশুগুলি বিরাট ও কদাকার, লেখনী থেকে বেরিয়ে এসে, মন্থরগতিতে তারা যেন ঘাড় ঘোরাতে-ঘোরাতে, পৃথুল লেজ নাড়াতে-নাড়াতে, কাগজেরই উপর থপ্ থপ্ ক’রে ঘুরে বেড়ায়। নারীমূর্তিগুলিই বা কোন্ জগৎ থেকে উঠে এল, মুখাবয়ব তাদের রুশ আইকনের মতো লম্বাটে কিন্তু পবিত্রতার লেশমাত্র নেই সেখানে, এক ফোঁটা হাসি নেই ঠোঁটের কোণে, তবু অসামান্য রূপবতী তারা প্রত্যেকে, সমুখপানে চেয়ে আছে, কিন্তু সে তাকিয়ে-থাকায় কোনও প্রত্যাশা নেই, শুভেচ্ছা বিনিময়ের কোনও অভিলাষ নেই, তারা জনমদুখিনী! পুরুষেরা কেউ-কেউ হাসছে, চোয়াল বেঁকিয়ে, করোটির প্রাকৃতিক আকার চূর্ণবিচূর্ণ ক’রে খ্যাঁক-খ্যাঁক ক’রে বিদ্রূপের হাসি হাসছে। আর রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং, ডান চোখটি বাঁ চোখের সামান্য উপরে অবস্থিত, সারামুখে কালিঝুলি মেখে কালো, বিষণ্ণ, প্রজ্ঞাবান!
ছবি,রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আমাদের সনাতন ধারণাগুলি বহুলাংশে বিপন্ন করেছে। বিপরীতে দিক থেকে দেখতে গেলে, এ-কথাও মান্য করতে হয় যে, বাঙালীর একাংশের কাছে বৃদ্ধি পেয়েছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা। তাঁর কবিতায় বারবার ফিরে-আসা পূজার থালা আর ফুলের মালার আধিক্যে যাঁরা ঈষৎ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন, তাঁরা যেন তাঁদের কাছের রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে পেলেন অবশেষে, পেলেন এক ‘তিমিরাচ্ছন্ন’, ‘আধুনিক’,‘আন্তর্জাতিক’ রবীন্দ্রনাথকে, যাঁর সঙ্গে এক অন্তরঙ্গ সম্পর্ক স্থাপন করা যায়। চিত্রী রবীন্দ্রনাথের উত্থানে যাঁরা বিপন্ন বোধ করেছিলেন, প্রথমে তাঁদের প্রসঙ্গ উত্থাপন করা যেতে পারে; দুই বিপরীতমুখী সম্প্রদায়ে তাঁরা বিভক্ত, প্রথম উপগোষ্ঠীর সদস্যরা সনাতনপন্থী রবীন্দ্রানুরাগী, তাঁদের দৃষ্টিকোণ থেকে চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথ, অচেনা ও তমসাচ্ছন্ন; ‘রাজা’ (১৯১১/১৯১৬/১৯২১) ও ‘রক্তকরবী’-র (১৯২৬) মঞ্চ ভেঙে অন্ধকারে অকস্মাৎ প’ড়ে যাওয়া নাট্যকার রবীন্দ্রনাথের কুশীলবদের হাড়গোড় বের-করা চেহারা। দ্বিতীয় উপগোষ্ঠীর সদস্যরা বিপরীত মেরুর অধিবাসী, তাঁরা চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথের সাহস ক’রে লক্ষ ক’রে স্তম্ভিত, কিন্তু যেহেতু তাঁরা নিজেরা প্রায় সকলেই ‘প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত’ চিত্রশিল্পী সেহেতু রবীন্দ্রনাথের ‘কারিগরি দুর্বলতা’ সম্পর্কে সচেতন ─ রঙের ব্যবহারে যিনি এমন দক্ষতার পরিচয় দিলেন, প্রতিকৃতির চোখ আঁকায় যার জুড়ি মেলা ভার, নাক আঁকার বেলায় কেন তিনিই পাশ নম্বর তুলতে পারলেন না, এটা তাঁদের বোধগম্য হয় না। এই দুই উপগোষ্ঠীর মানসিক প্রতিরোধ, আমরা দেখতে পাই, আনন্দ কুমারাস্বামী যাকে ‘zest’ রূপে চিহ্নিত করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের সেই অদম্য প্রাণশক্তির কাছে অবশেষে নতিস্বীকার করেছে। অধুনা আমরা এক বিচিত্র অবস্থার মধ্যে বসবাস করছি। রবীন্দ্রনাথের কবিতা এবং উপন্যাস সম্পর্কে যদি কেউ একগুচ্ছ বিরূপ মন্তব্য ব্যক্ত করেন তিনি লাভ করবেন মধ্যবয়স্ক ও নবীন পাঠকের নীরব, এমন কি, হয়তো, সরব সমর্থন। আবার, এর বিপরীতে, রবীন্দ্রচিত্রকলা সম্পর্কে উচ্ছ্বাসের বাতাবরণে সামান্য সংশয়প্রকাশও সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। উল্লিখিত অভিমতগুলি থেকে সর্বজনগ্রাহ্য ভাবনাসূত্র আহরণ করা, পৃথক অর্থে, একটি দুরূহ কাজ।
ǁ ২ ǁ
রবীন্দ্রনাথ যাকে ‘চিত্রবিদ্যা’ বলতেন, সেই বিদ্যা অনুশীলনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক দীর্ঘকালের হলেও নিজের চিত্রভাষার প্রকাশ দেখবার জন্য তাঁর জীবনের অন্তিম দেড় দশক পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। তার পিছনের সহজবোধ্য কারণগুলি পুনরাবৃত্তির কোনও প্রয়োজন এখানে নেই। আমরা কেবল একটি প্রস্থানবিন্দুর উল্লেখ এখানে করতে চাই। ‘ভারতশিল্প’-র ধারণা গ’ড়ে তোলার জন্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর(১৮৭১-১৯৫১), ভগিনী নিবেদিতা (১৮৬৭-১৯১১), আনন্দ কেন্টিশ কুমারাস্বামী(১৮৭৭-১৯৪৭) ও ‘Asia is one’ মহামন্ত্রদাতা কাকুজ়ো ওকাকুরা-র(১৮৬৩-১৯১৩) প্রমুখ কর্মী-চিন্তকদের মধ্যে যে তীব্র ভাবাবেগ আমরা দেখি, তা রবীন্দ্রনাথে দেখা যায় না; তিনি তাঁদের ধাঁচে পুনরুত্থানবাদী ছিলেনই না। রাজা রবি বর্মা-র (১৮৪৮-১৯০৬) দোআঁশলা শৈলী বর্জন ক’রে ভারতীয় চিত্রকলার মূলধারা তখন ওকাকুরা কর্তৃক প্রচারিত ‘নিরঙ্গা’ মতাদর্শের ভারতীয় সংস্করণের পথ ধ’রে এগিয়ে চলেছে। অবনীন্দ্রনাথ নিজের কাজের দ্বারা তরুণদের উদ্বুদ্ধ ক’রে চলেছেন, কুমারাস্বামী, বিস্মৃত গ্রন্থাদি ঘেঁটে অগণিত সন্দর্ভ রচনার দ্বারা, অক্লান্ত পরিশ্রমের দ্বারা ভারতশিল্পের অমূল্য তত্ত্বভাণ্ডার সমগ্র বিশ্বের সামনে উপস্থিত ক’রে চলেছেন, আর ভগিনী নিবেদিতা গ’ড়ে তুলছেন আত্মবিশ্বাসের ভিত্তিপ্রস্তর। এই বিপুল কর্মযজ্ঞে, রবীন্দ্রনাথ, এমন কি শান্তিনিকেতনের আশ্রমের স্বর্ণযুগেও, একজন পার্শ্বচরিত্র মাত্র। ভগিনী নিবেদিতা-র মাতৃ-আরাধনার নিম্নোদ্ধৃত আবাহনমন্ত্রের পাশে, রবীন্দ্রনাথকে, সঙ্গত কারণেই, কিঞ্চিৎ নিষ্প্রভ ব’লে মনে হয়।
‘Approach thou, O Mother, Deliverer !
Thy children, Thy nurslings are we !
On our hearts be the place for Thy stepping
Thine own, Bhumia Devi, are we!
Where lead they, O Mother !
Thy footfalls?
[ from: ‘The Footfalls of Indian History’ by The Sister Nivedita , 1915]
চিত্র : ১
চিত্র : ১ কার্টুন। শিল্পী গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
এই চালচিত্রে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬৭-১৯৩৮) অবস্থানেও কিছু বৈশিষ্ট্য আছে ; অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো তিনিও সাত নম্বর বাড়ির দক্ষিণের বারান্দার অন্যতম প্রধান মস্তিষ্ক, একজন দক্ষ সংগঠক, একজন জাতীয়তাবাদী, ভারতবর্ষের কার্টুনশিল্পের জনক, কিন্তু তিনি একা-একা কাজ করতে ভালবাসতেন, ছাত্র গ’ড়ে তোলার কাজে তাঁর বিশেষ আগ্রহ চোখে পড়ে না। মনের দিক থেকে গগনেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথ,তবুও পরস্পরের নিকটেই ছিলেন; এঁদের বিপরীতে, রবীন্দ্রনাথ, মতাদর্শের দিক থেকে, প্রশিক্ষণের দিক থেকে, এমন কি সাংগঠনিক শক্তির দিক থেকেও, সম্পূর্ণ একা। ফলত, আমরা লক্ষ করি, ভারতবর্ষের শিল্প আন্দোলনের খুব কাছে থেকেও রবীন্দ্রনাথ যেন সর্বত্র অনুপস্থিত। এই প্রাকৃতিক দূরত্বের নানা গৌণ কারণ খুঁজে পাওয়া গেলেও, মূল কারণ, আমাদের মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের স্বশিক্ষা ও তত্ত্ববিরোধিতা। ভারতশিল্প আন্দোলন সম্পূর্ণরূপে পরম্পরানির্ভর এক তাত্ত্বিক অবস্থান, স্বশিক্ষিত শিল্পীর জন্য সেখানে সম্মানের কোনও আসন সুরক্ষিত ছিল না।
রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর্ম ঘিরে যে বিপুল পরিমাণের আলোচনা-সাহিত্য জ’মে উঠেছে তার একটা সাধারণ (common) আকৃতি লক্ষ করা যায়।দিনকর কৌশিক (১৯১৮-২০১১)doodle-র জন্মবৃত্তান্ত খুঁজতে-খুঁজতে ‘মালতী-পুথি’ (১৮৭৮) পর্যন্ত পৌঁছে গেলেও, এ-কথা মেনে নিয়েছেন যে ছবির মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করবার তাড়না রবীন্দ্রনাথের চেতনায় তখনও ফুটে ওঠে নি। কৌশিক এতদূর প্রস্তাব রেখেছেন যে, রবীন্দ্রনাথের বাঙলা এবং ইংরেজি হস্তাক্ষরে Art Nouveu-র প্রভাব আছে[উৎস: ‘Rabindranath’s Paintings : A Study in Chronology/Drawings and Paintings of Rabindranath / Kala Bhavan, Santiniketan ,1988] । অধ্যাপক কৌশিক-এর প্রস্তাব সম্পর্কে আমাদের এইটুকুই বলবার রইল যে, রবীন্দ্রনাথের ‘য়ুরোপিয়ন কানেক্শন্’ প্রতিষ্ঠিত করবার সিধান্ত যখন আগে থেকে নেওয়াই হয়ে গেছে, তখন বিপরীত দিকের তথ্য ও যুক্তির বিশেষ ভূমিকা থাকে না।Doodle থেকে ছবিতে যাওয়ার সনাতনপন্থীর যাত্রাপথ সাধারণভাবে সরলরৈখিক; আলোচনার প্রথম ধাপ অবশ্যই পাণ্ডুলিপির সংশোধন, সেইখান থেকে নক্সা, লতাপাতা, রাক্ষস-খোক্ষসের সূত্র ধ’রে আলোচক পূর্ণ চিত্রের দিকে অগ্রসর হন, অবশেষে রবীন্দ্রনাথের চিত্রাবলী জার্মানির এক্সপ্রেশনিস্টদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়ে, তিনি তাঁর অভিযাত্রার সমাপ্তি ঘোষণা করেন, আমরাও এই ভেবে সন্তোষলাভ করি যে, বিদেশী চিত্রশিল্পীদের পাশে চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথের নাম উচ্চারিত হচ্ছে। হায়, ভৃত্যভাব আমাদের! আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি, কেন, মাত্র কয়েকটি লেখার কাটাকুটি থেকে লতাপাতা গজিয়ে উঠল, সব লেখা থেকে নয়? আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি, যে-সমস্ত লেখার আশপাশ দিয়ে লতাপাতা গজিয়ে উঠতে দেখা গেল, সেগুলি কোন্ সময়ের রচনা? আমরা কি গুনে দেখেছি রবীন্দ্রনাথ-এর ক’টি কালজয়ী কবিতায় কাটাকুটি থেকে doodle এবং doodle থেকে নক্সা ফুটে উঠেছে? আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি, একেবারে গোড়ার দিকে, কালোত্তীর্ণ রচনা ও দৃষ্টিনন্দন কাটাকুটির সহাবস্থানের একটিই দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে আছে, সেখানে ছবি নয়, লিরিক-ই প্রাধান্য বিস্তার করেছে, এবং, তদুপরি, সেটি কবিতা নয়, গান (‘বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান’ রচনা গিরিডি ২১এ আশ্বিন ১৩১২/১৯০৫)? আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি কেন এর ঠিক পূর্ববর্তী রচনা ‘বাঙলার মাটি বাংলার জল’-এ একটিও doodle নেই? না, এ-প্রশ্নগুলির একটিও আমরা বিচার করি নি। না, যে-লেখা থেকে ছবি গজিয়ে উঠেছে সে-লেখাগুলি আমরা লক্ষই করি নি। না, আমরা এই সহজ কথাটি ভেবে দেখি নি যে, লিখতে-লিখতে একজন লেখক যখন আঁকতে শুরু করেন তখন তাঁর লেখার স্রোত রুদ্ধ হয়ে গেছে কোথাও, লেখায় অমনোযোগ এবং আঁকায় মনোযোগ সমান্তরাল ধারায় দেখা দিয়েছে। লেখায় অমনোযোগের সূত্রটি অনুসরণ ক’রে আমরা রবীন্দ্রনাথের ছবির জগতে প্রবেশ করব।
রবীন্দ্রগ্রন্থের প্রকাশকদের বৃত্তান্ত অতীব করুণ ও চিত্তাকর্ষক। চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁর পরিবারের শুভানুধ্যায়ীরাই রবীন্দ্রনাথের বই প্রকাশের খরচ বহন করতেন। এরপর, দায়িত্বগ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথ-এরই বন্ধু, শ্রীশচন্দ্র মজুমদার-এর ছোট ভাই শৈলেশচন্দ্র মজুমদার। তাঁর প্রতিষ্ঠান ‘মজুমদার লাইব্রেরি’, মোহিতচন্দ্র সেন কর্তৃক নয় খণ্ডে সম্পাদিত ‘কাব্যগ্রন্থ’ (১৯০৩-০৮) প্রকাশ করেন। পনেরো খণ্ডের ‘গদ্যগ্রন্থাবলী’র (১৯০৭-১৯০৯) প্রকাশেও হয়তো শৈলেশচন্দ্রের সক্রিয় ভূমিকা ছিল (‘বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ পঞ্চাশৎবর্ষ-পরিক্রমা ১৯২৩-১৯৭৩’ দ্রষ্টব্য)। শৈলেশচন্দ্র অন্য আরও সমান্তরাল প্রকল্পে হাত দেন, যেমন ‘বঙ্গদর্শন’-এর পুনর্জন্ম, এবং স্বাভাবিক ভাবেই, ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েন। ‘বিশ্বভারতী’র আর্থিক পিপাসার কারণে রবীন্দ্রনাথের নিজের অর্থভাণ্ডার তখন তলানিতে এসে ঠেকেছে, ফলত শৈলেশচন্দ্রের জন্য উদ্বিগ্ন হওয়া ভিন্ন তাঁর আর-কোনও উপায় ছিল না। অবশেষে, ১৯০৮ সনে রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ স্থাপিত হয় এলাহাবাদনিবাসী চিন্তামণি ঘোষ-এর সঙ্গে এবং তাঁর প্রতিষ্ঠান ইণ্ডিয়ান প্রেস/ইণ্ডিয়ান পাবলিশিং হাউস, ১৯২৩ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের গ্রন্থপ্রকাশের দায়িত্ব বহন করেন। বলা বাহুল্য, দিব্যদৃষ্টিসম্পন্ন এই সকল পাগলদের আমরা মনে রাখি নি। ১৯২৫-এ বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়ের প্রথম বই ‘পূরবী’ প্রকাশের পর যখন অবশেষে অনিশ্চয়তা কাটে, তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স ৬৪ বছর! আজকের বেস্টসেলার লিস্টে ‘স্থায়ীরূপে’ উপবিষ্ট লেখকদের বিব্রত না ক’রেও বলা যায়, বাঙালীর গর্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম সংস্করণের কবিতার বইয়ের মুদ্রণ সংখ্যা, সাধারণত, মাত্র এক হাজার অথবা এগারশো কপি। তাঁর অন্তিমকাল পর্যন্ত এই অবস্থাই বহাল ছিল।নোবেল সম্মানও বই বিক্রির পালে হাওয়া যোগাতে পারে নি; এমন কি ‘শেষ লেখা’–র প্রথম সংস্করণের প্রিন্ট অর্ডারও মাত্র এগারশো!
১৯১৬–য় প্রথম প্রকাশিত ‘বলাকা’র ইণ্ডিয়ান প্রেস সংস্করণ থেকে শুরু ক’রে আমরা যদি কবিতার বইগুলি কালানুক্রমিক ভাবে সাজাই, একটি এলোমেলো চিত্র ফুটে উঠবে। ‘বলাকা’-পরবর্তী রবীন্দ্রনাথ, এক সময়োপযোগী কাব্যভাষা খুঁজে পাবার জন্য, তাঁর জীবনের অন্তিম পঁচিশ বছর জুড়ে কঠোর অনুশীলন করেছিলেন; ‘বলাকা’-পরবর্তী রবীন্দ্রনাথের কবিতার বইয়ের সংখ্যা ছাব্বিশ, কিন্তু তার প্রতিতুলনায় প্রধান বাঁকগুলি অসমান। ‘বলাকা’ (১৯১৬) ও ‘পূরবী’-র(১৯২৫)ব্যবধান ন’বছর, ‘পূরবী’ থেকে ‘পুনশ্চ’-র(১৯৩২)ব্যবধান আরও সাত বছর, অবশেষে আরও আট বছর বাদে ‘রোগশয্যায়’ (১৯৪০)প্রকাশিত হয়। এর কয়েক মাস বাদে, শেষবারের মতো রবীন্দ্রনাথের কবিজীবনে আবার একটা ঝড় ওঠে; ‘আরোগ্য’(মার্চ ১৯৪১), ‘জন্মদিনে’(মে ১৯৪১) এবং মরণোত্তর কাব্যগ্রন্থ ‘শেষ লেখা’ (অগাস্ট/ সেপ্টেম্বর ১৯৪১)।
‘জন্মদিনে’ কাব্যগ্রন্থে একটি পুরানো কবিতায় (সংখ্যা ১৮ / রচনাকাল: সেপ্টেম্বর ১৯৩৩) রবীন্দ্রনাথ নিজেকে একটি পরামর্শ দিয়েছিলেন, যা তাঁর সারা জীবনের সঞ্চয়:
‘ নানা দুঃখে চিত্তের বিক্ষেপে
যাহাদের জীবনের ভিত্তি যায় বারংবার কেঁপে,
যারা অন্যমনা, তারা শোনো
আপনারে ভুলো না কখনো।’
আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি, রবীন্দ্রনাথের ছবির গতিপ্রকৃতি বোঝবার প্রথাগত বিশ্লেষণ পদ্ধতির সঙ্গে কয়েকটি বিরোধের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে; এক, doodle-এর সঙ্গে কবিতালেখকের অমনোযোগের একটি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে যা যথাযোগ্য গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত হয় নি; দুই, তাঁর সৃজনশীলতার আভাস পেতে হলে নক্সা থেকে বিচার শুরু না ক’রে, এক ধাপ পিছিয়ে এসে, প্রথমে কবিতা থেকে শুরু ক’রে নক্সায়, এবং তারপর নক্সা থেকে রেখাচিত্রে ও জলরঙে যাওয়া সমীচীন; এবং তিন, উপযুক্ত গুরুত্ব সহকারে এটি বিচার করা যে, আনুমানিক ৫৫ বছর বয়স থেকে লেখক রবীন্দ্রনাথ আত্মপ্রকাশের একটা প্রবল সঙ্কটের সম্মুখীন হয়েছিলেন। তাঁর জীবনে, চিত্রকলা, বস্তুত এক সঙ্কটমোচন, শূন্যতা থেকে আত্মোন্মোচনের নতুন পথ টেনে এনে বার করবার এক অতিমানবিক মীমাংসা! এতদূরও অনুমান করতে স্পর্ধা হয় যে, ছবি, তাঁকে নতুন প্রাণশক্তি দিয়েছিল, এবং ছবির পর্বটি তাঁর জীবনে না এলে, অন্তিমপর্বের কবি রবীন্দ্রনাথকেও আমরা হয়তো পেতাম না। আমরা পঞ্চাশোর্ধ্ব রবীন্দ্রনাথ-এর জীবনে ফিরে যাই।
আমাদের অনুসন্ধান কর্ম আমরা শুরু করলাম কবির ৫৫ বছর বয়সের ‘বলাকা’ (প্রথম প্রকাশ : জ্যৈষ্ঠ ১৩২৩/ মে-জুন ১৯১৬) থেকে, কিন্তু যেহেতু এই বইয়ের কবিতাগুলি রচিত হয়েছিল ১৫ই বৈশাখ ১৩২১ থেকে ৯ই বৈশাখ ১৩২৩(এপ্রিল-মে ১৯১৪ থেকে এপ্রিল-মে ১৯১৬)-র মধ্যে, সেহেতু আমরা আরও দু’বছর (১৩২১-এ) পিছিয়ে যেতে চাই। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের বাইরে এই বইটি অধুনা অপঠিত, সেইজন্য, কেবল ‘তোমার শঙ্খ ধুলায় প’ড়ে’ নয়, এর ৪৫টি কবিতার প্রত্যকটিই যে অতি উচ্চমানের লেখা, তা অল্প কথায় প্রকাশ করা এক কঠিন কাজ। রবীন্দ্রনাথের আদি ও মধ্য পর্বের বহু বহু কবিতা সম্পর্কে এমন কঠোর বিরূপতা চোখে পড়ে নাতিতরুণ ও তরুণ কবিদের মধ্যে যে, নিজেদের প্রস্তাব পৌঁছে দেবার জন্য আমরা একটি বিকল্প পথ ভাবতে বাধ্য হই। সে-বছর রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিশীলতা যে কোথায় পৌঁছেছিল, তা সহজে অনুভব করবার জন্য একটি বিকল্প উপায় হল তাঁর গান। সে-বছর, ১৩২১, রবীন্দ্রনাথ ১১৭ টি গান বেঁধেছিলেন, যাদের মধ্য থেকে অতিবড় কৃপণের বিচারেও ৮০ টি গান, অমর।
এতগুলি অতিপরিচিত গান একসঙ্গে ফিরে পড়বার একটিই কারণ আমাদের সামনে আছে; স্বগৃহে অথবা ভ্রমণকালে, সুরুল থেকে শান্তিনিকেতনের পথে গরুর গাড়িতে, অথবা রেলস্টেশনের প্রতীক্ষালয়ে, পালকিতে, সুরুলে ভাদ্র মাসের দুপুরের ভ্যাপ্সা গরমে, অথবা শান্তিনিকেতনের দিব্য প্রভাতবেলায়, সন্ধ্যায় অথবা রাত্রে, একটা মানুষের জীবনে ভূতে-পাওয়া দশা নেমে না এলে, এই স্তরের সৃজনশীলতা, এতদিন ধ’রে রাখা অসম্ভব।
এতক্ষণ আমরা, ‘বলাকা’র কবিতা আর ‘গীতবিতান’-এ সঙ্কলিত গানে, ১৩২১ বঙ্গাব্দের (১৯১৪-১৫) প্রাচুর্যের কথাই তুলেছি, কিন্তু, খুঁটিয়ে লক্ষ করলে হয়তো এখানেই একটা সঙ্কটের সঙ্কেতও মিলবে। ডায়েলেকটিক্সের সঙ্গে পরিচিত হবার বহু পূর্বে বাঙালী ‘সরিষার মধ্যে ভূত’ প্রবচনটি উদ্ভাবন করেছিলেন, এবং সেই ভূত ‘বলাকা’র অন্তত তিনটি কবিতায় (কাব্যগ্রন্থের ১৩, ১৮ এবং ২৫ সংখ্যক কবিতায়) এবং ১৩২১-এ(১৯১৪-১৫) রচিত অন্তত বারোটি গানে(‘এরে ভিখারী সাজায়ে কী রঙ্গ তুমি করিলে’( ৫ জ্যৈষ্ঠ), ‘যখন তুমি বাঁধছিলে তার’ ( ১১ ভাদ্র), ‘যেতে যেতে একলা পথে নিবেছে মোর বাতি’ (২৬ ভাদ্র), ‘শেষ নাহি যে শেষ কথা কে বলবে’ ( ২৮ ভাদ্র), ‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু’ (১৬ আশ্বিন), ‘তোমার কাছে এ বর মাগি’(১৭ আশ্বিন),‘আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া’(১৭ আশ্বিন), ‘ এ আবরণ ক্ষয় হবে গো (১৮ আশ্বিন),‘পুষ্প দিয়ে মার যারে চিনল না সে মরণকে’ (১৯ আশ্বিন),‘আবার যদি ইচ্ছা কর আবার আসি ফিরে (২৩ আশ্বিন), ‘তোমায় নতুন করেই পাব ব’লে’ (২০ ফাল্গুন) এবং ‘চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে’ (২১ ফাল্গুন ১৩২১), এক অন্য কণ্ঠস্বর নিঃশব্দে উপস্থিত। রবীন্দ্রনাথ, সম্ভবত এই প্রথম, এত স্পষ্ট ভাবে, নিজের লেখায় ক্ষয়, বার্ধক্য ও পুনর্জীবনের প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন! এই ভাবনাই পরিশুদ্ধ হয়ে পরবর্তীকালে ‘বার্ধক্যরস’-এর রূপ ধ’রে ফিরে এসেছে তাঁর লেখনীতে, কিন্তু অন্তত ১৩২১-এ(১৯১৪-১৫) এটি ছিল নিজের কাছে কবুল করার উপযুক্ত অতিব্যক্তিগত আক্ষেপ। ‘বলাকা’-র ১৩ নম্বর লেখার (রচনাকাল ও স্থান : ২৩ পৌষ ১৩২১/ সুরুল) তৃতীয় ও অন্তিম স্তবকে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন :
‘ এসো এসো চ’লে এসো বয়সের জীর্ণ পথশেষে,
মরণের সিংহদ্বার
হয়ে এসো পার;
ফেলে এসো ক্লান্ত পুষ্পহার। ।
ঝ’রে পড়ে ফোটা ফুল, খ’সে পড়ে জীর্ণ পত্রভার,
স্বপ্ন যায় টুটে,
ছিন্ন আসা ধূলিতলে পড়ে লুটে।
শুধু আমি যৌবন তোমার,
চিরদিনকার,
ফিরে ফিরে মোর সাথে দেখা তব হবে বারংবার
জীবনের এপার ওপার ।’
‘ক্লান্ত পুষ্পহার’-এর উল্লেখের দ্বারা তিনি কোন প্রাপ্তিযোগের কথা নিজেকে মনে করাচ্ছেন তা বুঝতে আমাদের ক্লেশ হয় না। ১৮ নম্বর লেখাতেও (রচনাকাল ও স্থান : ২৯ পৌষ ১৩২১/ সুরুল) আমরা পাই ‘বার্ধক্যের স্তূপাকার আয়োজন’–এর উল্লেখ। অবশেষে ২৫ নম্বরে পৌঁছে, ভাবিকাল যার জন্য অপেক্ষা ক’রে থাকে, আমরা পাই সেই অনুপম কবিতা :
‘ যে বসন্ত একদিন করেছিল কত কোলাহল
লয়ে দলবল
আমার প্রাঙ্গণতলে কলহাস্য তুলে
দাড়িম্বে পলাশগুচ্ছে কাঞ্চনে পারুলে;
নবীন পল্লবে বনে বনে
বিহ্বল করিয়াছিল নীলাম্বর রক্তিম চুম্বনে;
সে আজ নিঃশব্দে আসে আমার নির্জনে ;
অনিমেষে
নিস্তব্ধ বসিয়া থাকে নিভৃত ঘরের প্রান্তদেশে
চাহি’ সেই দিগন্তের পানে
শ্যামশ্রী মূর্ছিত হয়ে নীলিমায় মরিছে যেখানে।’
[ পদ্মা,২০ মাঘ ১৩২১]
রবীন্দ্রনাথ, তাঁর বিরাট নির্লিপ্তির বোধ দিয়ে আপন জীর্ণদশার সেই সঙ্কেত গ্রহণ করলেন এবং ভাবলেন, ইতিপূর্বে যেমনভাবে হয়েছে, ঠিক সেইভাবেই কবিতা দিয়েই বুঝি অনুর্বরতার ওই বাধা তিনি পার হয়ে যাবেন। এবার আর তা হল না। দু’ বছর পর প্রকাশিত পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ ‘পলাতকা’ (১৯১৮) কোনওভাবেই ‘বলাকা’ ছুঁতে পারল না। আবার, উদ্বেগের সঙ্গে আমরা লক্ষ করলাম,‘পলাতকা’-র পর ব্যবধান দীর্ঘতর, চার বছর ; ১৯২২–এ দু’টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হল, ‘শিশু ভোলানাথ’ এবং ‘লিপিকা’। শিশুপাঠ্য কবিতা, বিবরণধর্মী কবিতা এবং লঘু কবিতা (light verse) ─ এই তিন ধরনের কবিতাতেই রবীন্দ্রনাথ-এর একশো গজের মতো কোনও লেখক সেদিন আসতে পারেন নি, আজও সে-অবস্থা অপরিবর্তিত আছে, ফলত ‘শিশু ভোলানাথ’–এর সার্থকতা প্রসঙ্গে নতুন স্তুতিবাক্য আমাদের ভাণ্ডারে নেই। ‘লিপিকা’ প্রসঙ্গে আমাদের আক্ষেপের অন্ত নেই, কারণ এই বইটি যে বাংলাভাষায় গদ্যকবিতা প্রবর্তনের প্রথম সচেতন ও সার্থক প্রয়াস, সে-বিষয়ে স্বয়ং লেখক নিঃসংশয় হয়েও, কেবল সংস্কারের বশবর্তী হয়ে তাঁর কাব্যগ্রন্থের তালিকায় ‘লিপিকা’-কে প্রবেশাধিকারই দিলেন না! গদ্যছন্দ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা সাময়িক ভাবে থামিয়ে দিয়ে তিনি সে-দায়িত্বভার, দুই বিশ্বাসভাজন, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত-কে(১৮৮২-১৯২২) অর্পণ করলেন। সত্যেন্দ্রনাথ মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে অকালপ্রয়াত হলেন এবং অবনীন্দ্রনাথ-এর কাজ রবীন্দ্রনাথ-এর মনঃপুত হল না, ফলত তিনিই এবার কাজটি হাতে তুলে নিলেন, কিন্তু ততদিনে দশটি অমূল্য বছর পেরিয়ে গেছে । পরিচিত ঘটনাপ্রবাহের পুনরাবৃত্তির পিছনে একটিই কারণ আছে; আমরা নতুন ক’রে অনুভব করি, ১৯১৬-পরবর্তী কবি রবীন্দ্রনাথ যেন কিঞ্চিৎ দিশাহারা, নিজেরই কৃতিত্বের কাছে তিনি যেন সাময়িক ভাবে পরাস্ত!
‘বলাকা’-য় (১৯১৬)যে সঙ্কটের প্রথম আভাস আমরা পেয়েছিলাম তার ঠিক ন’বছর পরে প্রকাশিত ‘পূরবী’(১৯২৫) কাব্যগ্রন্থে এক বিচিত্র আত্মসংঘাত ও তৎসঙ্ক্রান্ত মীমাংসা সূত্রের আভাস আমরা পাই। ‘পূরবী’ কাব্যগ্রান্থে অন্তর্গত ৮৮ টি কবিতা আসলে তিনটি অংশের সমাহার; প্রথম ও তৃতীয় অংশে যথাক্রমে ১৬ এবং ১১ টি লেখা ১৮৯৮ থেকে ১৯২৩, অর্থাৎ দীর্ঘ ২৫ বছর জুড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে রচিত হয়েছিল। ‘পথিক’ শিরোনামে পৃথক ভাবে চিহ্নিত দ্বিতীয় অংশে অন্তর্গত ৬৬ টি কবিতা লিখতে রবীন্দ্রনাথ নিয়েছিলেন মাত্র ৫ মাস (সেপ্টেম্বর ১৯২৪ থেকে জানুয়ারী ১৯২৫)। ১৯২৪-র শেষার্ধে রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখার গতি অবশেষে ফিরে পান, এটি ‘পূরবী’-র সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। বাইরে থেকে এর কারণ নির্ধারণ প্রায় অসম্ভব, তবু ভাবতে ভাল লাগে, পরিবেশ বদল হয়তো অন্তত একটি গৌণ উপাদান। যুক্তিবাদীদের বিরক্তি উৎপাদনের ঝুঁকি নিয়েও আরও একটি উপাদানের উল্লেখ করা যায়, নিয়তিলিখন। পেরু সরকারের তরফ থেকে তাঁদের স্বাধীনতা-অর্জনের শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবার জন্য রবীন্দ্রনাথ একটি আমন্ত্রণ পান। তাঁর বয়স তখন তেষট্টি বছর; তিনি কলকাতা থেকে মাদ্রাজ ছুঁয়ে কলম্বো বন্দরে পৌঁছে, য়ুরোপগামী ‘হারুনা-মারু’-তে ওঠেন। তাঁর শরীরে তখনই নানা রোগের উপসর্গ দেখা দিয়েছে।‘হারুনা-মারু’ মার্সাই বন্দরে পৌঁছতে, কয়েকদিনের জন্য তিনি পারী-তে কাটাবার পর শেরবুর্গ বন্দর থেকে দক্ষিণ আমেরিকাগামী ‘আন্ডেস’ জাহাজ ধরেন। কয়েকদিনের মধ্যেই তাঁর শরীর বিদ্রোহ ঘোষণা করে, জাহাজ বুয়েনস আইরেস বন্দরে নোঙর ফেলার পর স্পষ্ট হয় যে, আবার ট্রেনপথে পেরু-র লীমা-য় পৌঁছনোর শারীরিক অবস্থা তাঁর নেই [উৎসনির্দেশ:‘রবীন্দ্র-জীবনী’ তৃতীয় খণ্ড, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়]। এই সঙ্কটাবস্থায়, রবীন্দ্রনাথের আরোগ্যেলাভে সহায়তাদানের জন্য ভ়িক্টোরিয়ো ওকাম্পো (বিজয়া) এগিয়ে আসেন, তাঁর ভগ্নস্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের সমস্ত ব্যবস্থা তিনিই গ্রহণ করেন, তাঁকে নিয়ে যান সান ইসিডরো। রবীন্দ্রনাথের দক্ষিণ আমেরিকা ভ্রমণসূচী প্রসঙ্গে আমরা কিছুক্ষণ আগে ‘নিয়তিলিখন’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলাম। ভ়িক্টোরিয়ো ওকাম্পো অচিরে হয়ে ওঠেন রবীন্দ্রনাথের অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক। জুন ১৯৩০-এ পারী-র প্রখ্যাত ‘গ্যালেরি পিগাল’-এ যে ১২৫টি চিত্র প্রদর্শিত হয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, তার সমস্ত আর্থিক দায়ভার বহন করেছিলেন ভ়িক্টোরিয়ো ওকাম্পো।
শারীরিক প্রতিবন্ধকতা যে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিশীলতার অন্তরায় হতে পারে না, তা আমরা আবার দেখলাম। প্রথমে ‘হারুনা-মারু’ এবং পরে ‘আন্ডে্রে-এ ব’সে তিনি লিখে চলেছেন একের পর এক কবিতা — বাঙলা সন তারিখ ভুলে-যাওয়া এ এক যুগপৎ প্রবীণ ও নবীন রবীন্দ্রনাথ! আরও একটি কারণে ‘পূরবী’ বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য, এখান থেকে চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথের রেখাঙ্কন এক আশ্চর্য মাত্রান্তর লক্ষ করা যায়, যা সব দিক থেকেই এক বিস্ফোরণ। কোথাও-কোথাও রেখাচিত্রের ফাঁক দিয়ে কবিতার পঙক্তির অসহায় চাহনি আমাদের বিচলিত করে, কোথাও কবিতা শ্বাসরুদ্ধ। ‘পূরবী’-কে রবীন্দ্রনাথ-এর কবিতার কারাগার ব’লে মনে হয়। ছবি ও কবিতার যুদ্ধপ্রসঙ্গে প্রবেশ করার পূর্বে ‘পূরবী’-র বহু লেখা থেকে আমরা মাত্র একটি মহৎ কবিতার প্রথমাংশ বেছে নিলাম:
‘খুঁজতে যখন এলাম সেদিন কোথায় তোমার গোপন অশ্রুজল,
সে পথ আমায় দাও নি তুমি বলে।
বাহির-দ্বারে অধীর খেলা, ভিড়ের মাঝে হাসির কোলাহল,
দেখে এলেম চলে।
এই ছবি মোর ছিল মনে—
নির্জন মন্দিরের কোণে
দিনের অবসানে
সন্ধ্যাদীপ আছে চেয়ে ধ্যানের চোখে সন্ধ্যাতারার পানে।
নিভৃত ঘর কাহার লাগি
নিশীথ-রাতে রইল জাগি,
খুলল না তার দ্বার।
হে চঞ্চলা, তুমি বুঝি
আপ্নিও পথ পাও নি খুঁজি,
তোমার কাছে সে ঘর অন্ধকার।
[ ‘প্রকাশ’ (প্রথমাংশ) রচনা অ্যাণ্ডেস জাহাজ ২৬ অক্টোবর ১৯২৪ / ‘পূরবী’ (১৯২৫)]
আমাদের আলোচনার মূল প্রসঙ্গ, doodle থেকে নক্সার বিবর্তন; আমরা সেই ভাবনাসূত্রে ফিরে আসি। কাব্যভাষার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সহজ সম্পর্ক, যা বাঙলা কবিতাকে এতকিছু দিয়েছে, কবির মধ্যবয়সে পৌঁছে এক সঙ্কটের মুখে এসে পড়েছিল ব’লে মনে হয়। এই প্রথম তিনি এমন এক পরিস্থিতির সম্মুখীন হন যখন ভাবনার গতির সঙ্গে ভাষার গতির একটা অসঙ্গতি তৈরি হচ্ছে, ভাব যে দ্রুতিতে এগিয়ে চলেছে ভাষা তাকে সঙ্গ দিতে পারছে না; এই প্রথম, কবিতা রচনায় তিনি অমনোযোগী হয়ে পড়ছেন, ভুল শব্দ কাটছেন কিন্তু সঠিক শব্দটি তাঁর লেখনীর গোড়ায় আসছে না ─ সৃজনশীলতার মুখ তো আর রুমাল দিয়ে বেঁধে ফেলা যায় না ─ সেই অজাত শব্দটির পরিবর্তে কখনও ফুটে উঠছে অনিন্দ্যসুন্দর লতা, কখনও রাক্ষসের চোয়াল। একে doodle–শিল্পী রবীন্দ্রনাথ-এর অমনোযোগ না ব’লে চিত্রী রবীন্দ্রনাথ-এর নবার্জিত মনোযোগ, অর্থাৎ মনোযোগের স্থানান্তর বলাই বোধহয় যুক্তিসিদ্ধ। লিপি ও চিত্ররেখার এই বিপরীত সম্পর্ক (inverse relation), অথবা সহজ ভাষায় প্রকাশ করতে গেলে, শব্দ আসছে না ব’লে ছবি আসছে ─ আমাদের এই বিকল্প প্রস্তাব(hypothesis) যে বিদ্রূপের সম্মুখীন হবে তা আমরা জানি। রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞদের কাছে আত্মপক্ষ সমর্থনের একটি সুযোগ চেয়ে আমরা রবীন্দ্রকবিতার পাণ্ডুলিপির কয়েকটি নিদর্শন তুলে ধরতে চাই।
চিত্র : ২
চিত্র : ২
কবিতার নাম : ‘দুঃসময়’ / রচনাকাল : ১৫ বৈশাখ ১৩০৪ ( ১৮৯৭)
কবির বয়স : ৩৫ / কাব্যগ্রন্থ : ‘কল্পনা’ প্রথম প্রকাশ : ১৩০৭ (১৯০০)।
প্রথম স্তবক :
‘যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে,
সব সঙ্গীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া,
যদিও সঙ্গী নাহি অনন্ত অম্বরে,
যদিও ক্লান্তি আসিছে অঙ্গে নামিয়া,
মহা-আশঙ্কা জপিছে মৌন মন্তরে,
দিক্-দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা ─
তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা ৷৷ ’
তরুণ রবীন্দ্রনাথ বারো বছরের পুরনো একটা ডায়েরীর পৃষ্ঠা ছিঁড়ে, তারপর তাকে উল্টে নিয়ে প্রবল ভাবাবেগের বশবর্তী হয়ে খশ্খশ্ ক’রে লিখে চলেছেন এই অত্যাশ্চর্য কবিতা, ভাবলেই শিহরণ জাগে! শব্দ কাটছেন তিনি, শব্দ জুড়ছেন, পঙক্তি কাটছেন এবং জুড়ছেন, এমন কি স্তবকও জুড়ছেন, কিন্তু কোথাও কোনও doodle-এর দেখা নেই। তাঁর ভাব আর তাঁর ভাষা তখন সমান ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন, কাটাকুটির মধ্যেও কবির অধৈর্য ফুটে উঠছে যেন, এমনও মনে হচ্ছে লেখাটি লিখে ফেলতে না পারলে কবির প্রাণটাই বোধহয় বেরিয়ে যাবে।
চিত্র : ৩
চিত্র : ৩
কাব্যগ্রন্থ : ‘গীতাঞ্জলি’ প্রথম প্রকাশ : ১৩১৭ (১৯১০)। কবিতার ক্রমিক সংখ্যা : ১৪৮ / রচনাকাল: ২৩ শ্রাবণ ১৩১৭ ( ১৯১০)। কবির বয়স : ৪৯।
প্রথম স্তবক :
‘একটি নমস্কারে প্রভু, একটি নমস্কারে
সকল দেহ লুটিয়ে পড়ুক তোমার এ সংসারে ।
ঘন শ্রাবণ-মেঘের মতো
রসের ভারে নম্র নত
একটি নমস্কারে প্রভু, একটি নমস্কারে
সমস্ত মন পড়িয়া থাক্, তব ভবন দ্বারে ।’
মধ্য বয়সের রবীন্দ্রনাথ-এর এই পাণ্ডুলিপির নমুনা ও পূর্বের নিদর্শনের অন্যতম প্রধান সাদৃশ্য প্রথমেই চোখে পড়ে, এখানেও doodle-এর চিহ্নমাত্র নেই। বলা বাহুল্য doodle-এর অনুপস্থিতির কারণও অভিন্ন, এখানেও ভাব ও ভাষা পরস্পরের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা ক’রে চলেছে। লিপির সঙ্গে রেখাচিত্রের বিপরীত সম্পর্ক শনাক্ত করার জন্য ‘গীতাঞ্জলি’-র ১৪৮ সংখ্যক রচনাটি আমাদের দ্বিতীয় উদাহরণ। এইরকম আরও দৃষ্টান্ত রবীন্দ্রনাথের পাণ্ডুলিপি থেকে সহজেই তুলে আনা যায়।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় চিত্রের মধ্যেও প্রভেদ লক্ষণীয় ; এক, চিত্র ২-র কাটাকুটিতে যে অধৈর্যের আভাস পেয়েছিলাম তা এখানে নেই, পরিবর্তে, বর্জিত শব্দের প্রতি লেখকের নির্মমতাই যেন বেশি প্রকাশ পাচ্ছে, কোনও গোয়েন্দাপ্রবরও তৃতীয় ও চতুর্থ পঙক্তির আদিরূপ উদ্ধার করতে পারবেন না; দুই, কাটাকুটির পরিমাণও যেন কম, শব্দ গ্রহণ-বর্জনের প্রক্রিয়ার অনেকটাই লিপির ধাপে আসার আগেই সম্পন্ন হয়ে গেছে; এবং তিন, দ্বিতীয় চিত্রের সমস্ত চঞ্চলতা তৃতীয় চিত্রে ঝ’রে পড়েছে।
চিত্র : ৪
চিত্র : ৪
কাব্যগ্রন্থ : ‘পূরবী’ প্রথম প্রকাশ : ১৩৩২ (১৯২৫)। কবিতার নাম : ‘শেষ বসন্ত’ / রচনাকাল : ২১ নভেম্বর ১৯২৪ স্থান : বুয়েনস আইরেস। কবির বয়স : ৬৩।
শেষাংশ :
‘বেণুবনচ্ছায়াঘন সন্ধ্যায়
তোমার ছবি দূরে
মিলাইবে গোধূলির বাঁশরির
সর্বশেষ সুরে
রাত্রি যবে হবে অন্ধকার
বাতায়নে বসিয়ো তোমার
সব ছেড়ে যাব প্রিয়ে
সমুখের পথ দিয়ে
ফিরে দেখা হবে না তো আর।
ফেলে দিয়ো ভোরে-গাঁথা
ম্লান মল্লিকার মালাখানি
সেই হবে স্পর্শ তব, সেই হবে বিদায়ের বাণী’
‘শেষ বসন্ত’ একটি সুলিখিত কবিতা সন্দেহ নেই, কিন্তু অন্তর্যামী জানেন, যে রবীন্দ্রনাথকে আমরা প্রত্যহ স্মরণ করি, যে রবীন্দ্রনাথের লেখা প’ড়ে আর গান শুনে অন্তত চার প্রজন্মের বাঙালী সাবালক হল, যে রবীন্দ্রনাথের এই পঙক্তির কবিকৃত ইংরেজি অনুবাদ — ‘যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই / যা দেখেছি যা পেয়েছি তুলনা তার নাই’ — প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত সৈনিক-কবি উইলফ্রেড আওয়েন (১৮৯৩-১৯১৮) তাঁর নোটবইতে টুকে রেখেছিলেন, ইনি সেই রবীন্দ্রনাথ নন। লিখতে-লিখতে পৃষ্ঠার এক কোণে সামান্য নক্সা আঁকা অথবা বর্জিত শব্দে একটু আধটু গোঁফ–দাড়ি প্রদান করায় কোনও বিশেষত্ব নেই, অনেক লেখকের মধ্যেই এই প্রবণতা দেখা যায়। কেউ-কেঊ মনে করেন আঙুলের ওই সচলতা প্রকৃতপক্ষে মনের সচলতার বহিঃপ্রকাশ। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে এই লিখনভঙ্গিমা বিশেষ গুরুত্ব সহকারে বিচার করবার বিষয় কারণ, নক্সাগুলি আকারে ও জটিলতায় বাড়তে-বাড়তে ভীষণ মূর্তি ধারণ করেছে, এতটাই যে, তাঁর লেখনীর বিক্রম, কবিতাকে এগিয়ে যেতে না দিয়ে, তাকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে। বস্তুত, তাঁর লেখার খাতায় কবিতা ও রেখাচিত্রের মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ নিজেই এবং রেখাচিত্রের কাছে তাঁর তখনকার কবিতা যে পরাস্ত হয়েছিল, এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই। আমরা লক্ষ করি রেখাচিত্রগুলি কোথাও কোমল, কোথাও বলিষ্ঠ, কিন্তু যে-লেখা থেকে তারা উঠে এসেছে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক বন্ধুত্বের নয় শত্রুতার, বহু ক্ষেত্রে, উভয়ের মধ্যে কোনও সম্পর্কই গ’ড়ে উঠতে পারে নি। এই বৈরিতাকেই আমরা কবিতা ও রেখাচিত্রের বিপরীত সম্পর্ক রূপে চিহ্নিত করতে চাইছি; বলতে চাইছি, একই পৃষ্ঠায় কালোত্তীর্ণ কবিতা ও উত্তীর্ণ doodle-এর সহাবস্থান কমই দেখা যায়, কারণ, খুব স্বাভাবিক ভাবে রবীন্দ্রনাথের নজর সমানভাবে দু’টি দিকে এসে পড়ে নি, ভারসাম্য হারিয়েছে। কোনও-কোনও পাণ্ডুলিপিতে তাঁর কবিতার সঙ্কুচিত ও অসহায় রূপ এবং এর বিপরীতে নক্সার আক্রমণাত্মক চেহারা আমাদের প্রাণে ভীতি সঞ্চার করে।
আমরা এতক্ষণ কবিতা ও রেখাচিত্রের মধ্যে কেবল সংঘাতেরই উল্লেখ করলাম। প্রশ্ন উঠতে পারে, লেখা ও রেখার মধ্যে সহায়ক সম্পর্কের কোনও দৃষ্টান্ত কি খুঁজে পাওয়া যায় না? কবিতার সঙ্গে ছবির যে বৈরিতা আমরা লক্ষ করি, নাটকের সঙ্গে ছবির তেমন বৈরিতার সম্পর্ক ছিল না, ফলত সহায়ক সম্পর্কেরও একটি দৃষ্টান্ত আমরা পাই। পাণ্ডুলিপিচিত্রের এটিই আমাদের শেষ দৃষ্টান্ত। প্রসঙ্গত, রবীন্দ্রনাটক ও ছবির মধ্যে সুসম্পর্ক আমাদের বর্তমান আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ এক ভাবনাসূত্র, আমরা এখানে ফিরে আসব।
পাঠক লক্ষ করবেন পাণ্ডুলিপির সংলাপের সঙ্গে ‘বিশ্বভারতী’ কর্তৃক মুদ্রিত পাঠে বিস্তর প্রভেদ আছে । এর কারণ অনুসন্ধান করার জন্য আমাদের বেশি দূর অগ্রসর হতে হবে না, রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞরা আমাদের জানিয়েছেন ‘প্রবাসী’তে (১৩৩১) মুদ্রিত হবার আগে রবীন্দ্রনাথ বহুবার পাণ্ডুলিপি সংশোধন করেছেন, অন্তত দশটি পাণ্ডুলিপির সন্ধান পাওয়া গেছে। বস্তুত, নাটকটির নামও কয়েকবার পরিবর্তন করেছেন রবীন্দ্রনাথ, প্রথমে ‘যক্ষপুরী’ থেকে ‘নন্দিনী’,তারপর সেখান থেকে অবশেষে ‘রক্তকরবী’।
চিত্র : ৫
চিত্র : ৫
নাটক: ‘রক্তকরবী’, শেষ দৃশ্য / রচনাকাল : ১৩৩০(১৯২৩) থেকে ১৩৩১(১৯২৪)
স্থান : শিলং ও অন্যান্য স্থানে। কবির বয়স : ৬২-৬৩।
প্রথম প্রকাশ : ‘প্রবাসী’ ১৩৩১ (১৯২৪), গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশ ১৩৩৩(১৯২৬)।
পাণ্ডুলিপির পাঠ
ফাগুলাল :
সে সকলের আগে এগিয়ে গেছে ।
বিশু :
কোথায় গেছে ? নন্দিনী !
ফাগুলাল :
সে চলে গেছে মুক্তির পথে ।
বিশু :
তবে আর দেরি কেন ফাগুলাল !
ফাগুলাল :
বিশু ভাই, চল।
পাণ্ডুলিপিতে লাল কালিতে নিজের হস্তাক্ষরে রবীন্দ্রনাথ-এর সংযোজন
বিশু :
ঐ বুঝি ধুলোয় পড়ে ?
ফাগুলাল :
হ্যাঁ । ঐ ত রক্তকরবীর কঙ্কণ তার দান হাত থেকে খসে পড়েছে।
বিশু :
ঐ তার শেষের দান। তার রাখীবন্ধন। চল তবে।
আমার শেষ? প্রথম ধুয়ো
ধরলি রে কে তুই
আমার শেষ পেয়ালা চোখের
ভরলি রে কে তুই
দূর পশ্চিমে ঐ দিনের পারে
অস্ত রবির পথের ধারে
রক্ত রাগের ঘোমটা মাথায়
পরলি রে কে তুই?
অগণিত পাণ্ডুলিপিচিত্রের মধ্যে এটি এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম এই কারণে যে, লেখার ভয়ানকের সঙ্গে রেখার ভয়ানকের এক নিবিড় সম্পর্ক আমরা লক্ষ করছি। রবীন্দ্রনাথের এই রেখাচিত্রটি ‘রক্তকরবী’-র তমসার এক দক্ষ প্রতিফলন, এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই ।‘শেষ বসন্ত’ শীর্ষক কবিতায় (চিত্র : ৪ দ্রষ্টব্য) কবিতাকে ছবি দিয়ে ঢেকে দিয়েও যে ব্যঞ্জনা তিনি সৃষ্টি করতে পারলেন না, তা প্রায় একই সময়ে, কেবল রেখা ও লেখার সাযুজ্যের কারণে ‘রক্তকরবী’র ক্ষেত্রে সম্ভব হল।
ǁ ৩ ǁ
পূর্ণাঙ্গ রেখাচিত্র ও জলরঙের দুরূহ জগতে প্রবেশ করবার অব্যবহিত পরেও রবীন্দ্রনাথের পদক্ষেপে অনিশ্চয়তার লেশমাত্র চোখে পড়ে না; তাঁর আত্মবিশ্বাস আমাদের বিমূঢ় করে। বিশেষজ্ঞরা যাই বলুন, কবিতার গা বেয়ে বেড়ে-ওঠা অনুশীলনীতে এতটা স্বশিক্ষা কোথায় লুকিয়ে ছিল, তার কোনও ব্যাখ্যা নেই। চিত্রী রবীন্দ্রনাথের মধ্যে doodle-শিল্পী রবীন্দ্রনাথকে আমরা চিনে নিতে পারি, কথাটি যুগপৎ সত্য এবং অসত্য। সময় ব্যয় না ক’রে, কেবল নিজের ‘উষ্মা ও তাপ’ অনুসরণ ক’রে তিনি যে সামগ্রিক উচ্চতা অর্জন করেছিলেন তার কোনও স্পষ্ট ইঙ্গিত তাঁর doodle-শিল্পে অনুপস্থিত। বলা বাহুল্য ‘উষ্মা’ ও ‘তাপ’ শব্দ দু’টি ব্যবহার করার সাহস আমাদের হত না, যদি রবীন্দ্র-চিত্রকলা প্রসঙ্গে স্বয়ং অবনীন্দ্রনাথ এগুলি ব্যবহার না করতেন। রবীন্দ্রনাথের ‘ভল্কানিক্ ইরাপ্শন’-এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি লিখছেন:
‘ কেমন ক’রে এই মানুষের হাত দিয়ে এই বয়সে এই জিনিস বের হল। অতীতের কতখানি সঞ্চয় ছিল তার ভিতরে। অতি গভীর অন্তরের উষ্মা ও তাপে এই রঙ রূপ সমস্তই যেন প্রকৃতির খেলাঘরে লুকনো সামগ্রী হঠাৎ আবিষ্কারের আনন্দ দিয়ে নির্মিত; ফেটে বেরিয়েছে, রূপ পেয়েছে। এই যে volcanic ব্যাপার — এ থেকে শিখতে পারবে না, হবে না তা। ভল্কানিক্ ইরাপ্শনের মতো এই একটা জিনিস হয়ে গেছে।’
[উৎসনির্দেশ: পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে রবীন্দ্রনাথ-এর একশো পঁচিশতম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত চিত্রপ্রদর্শনীর (১–৯ মে ও ১২-২৫ মে, ১৯৮৬) ক্যাটালগ্।]
দক্ষিণের বারান্দা থেকে প্রচারিত ‘ভারতশিল্প’-এর তাত্ত্বিক ভিত্তিভূমিতে আত্মপরিচয়সন্ধানের যে উপাদান ছিল তার প্রতি রবীন্দ্রনাথের সমর্থন থাকলেও, জাতীয়তাবাদের তপ্ত বাষ্প থেকে তিনি নিজেকে কিছুটা দূরেই সরিয়ে রেখেছিলেন। ‘A Scene from Independent Movement ’, ( জলরঙ , ১৯৩৮) ছবিটির নাম রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং দিয়েছিলেন কি না, তা অস্পষ্ট রয়ে গেলেও , কাজটিকে একটি ব্যঙ্গচিত্র বললে বোধহয় অত্যুক্তি করা হবে না। অন্যান্য কাজে যেমন, চিত্রকলাতেও, উগ্র জাতীয়তাবাদ বিষয়ে তাঁর অবস্থান খুব স্পষ্ট। কেবল অতীতকালের গুণকীর্তন করলেই যে বর্তমানকালের মূল সঙ্কটের মীমাংসার পথ স্পষ্ট ফুটে উঠবে না, এ-নিয়ে তাঁর কোনও সংশয় ছিল না, কিন্তু প্রশ্নটি ঘিরে দক্ষিণের বারান্দার সঙ্গে কলহে জড়িয়ে পড়ার প্রবৃত্তিও তাঁর হয় নি। ফলত, এমনও ঘ’টে থাকা অসম্ভব নয় যে, রবীন্দ্রনাথের মনের গতিপ্রকৃতির কোনও আভাসই অবনীন্দ্রনাথ পান নি এবং সেহেতু, পূর্ণাঙ্গ চিত্রগুলি ‘ভল্কানিক্ ইরাপ্শন’-এর আকস্মিকতা নিয়ে তাঁর কাছে উপস্থিত হয়েছিল। প্রকৃত ঘটনাবলী ‘ভল্কানিক্ ইরাপ্শন’-এর তত্ত্বটি সমর্থন করে কি না, তা নিয়ে কিন্তু প্রশ্ন তোলার অবকাশ আছে। বস্তুত, চিত্রকলার লক্ষ্য বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের ধারণা আকস্মিক নয়, বরং দীর্ঘকালীন ভাবনার ফসল, এমন কি, চিত্রশিল্পীদের জগতে তাঁর প্রবেশেরেও বহু পূর্বে সুগঠিত। আমাদের এই প্রস্তাবের সমর্থনে আমরা রবীন্দ্রনাথের লেখা এমন একটি চিঠিতে ফিরে যাব যখন চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথের গর্ভাবস্থা চলছে। ইয়ুরোপের বিভিন্ন শহরে অনুষ্ঠিত ‘দি ইণ্ডিয়ান সোসায়টি অফ্ ওরিয়েন্টাল আর্ট’–এর সফল চিত্রপ্রদর্শনীর অংশগ্রহণকারী মুকুল দে-কে (১৮৯৫-১৯৮৯) ২৫এ এপ্রিল ১৯১৩ তারিখে রবীন্দ্রনাথ লন্ডন থেকে লিখছেন:
‘মুকুল, এবারকার exhibition এ তোর ছবিগুলি বিশেষ সমাদর লাভ করেছে। এ সংবাদ আমি পূর্ব্বেই পেয়েছি এবং মনের মধ্যে খুব আনন্দ বোধ করেছি। … অবনের কাছে শিক্ষালাভ করে তোর অন্তরের শক্তি পূর্ণভাবে উদ্বোধিত হয়ে উঠ্বে এই প্রত্যাশা আমি মনের মধ্যে দৃঢ় করে রাখলুম । … চিত্রশিল্প সম্বন্ধে আমি তোর গুরুর পদ গ্রহণ করতে পারি নে কিন্তু তবু বাইরে থেকে আমি একটু সমালোচনা করতে চাই। … আমার মনে হয় নিতান্ত মিষ্টিমধুর করে ছবি আঁকবার দিকে যদি তুই লক্ষ্য স্থির করিস্ তাহলে আপাতত তাতে অরসিক লোকের মন ভোলাতে পারবি কিন্তু তাতে সাধনার পথে তোর সদ্গতি হবে না। ইন্দ্রদেব যখন তপস্যা ভঙ্গ করতে চান তখন তিনি সাধকদের কাছে সুন্দরী অপ্সরী পাঠিয়ে সাধকের শক্তি পরীক্ষা করেন যারা ওতে ভোলে তাদের ঐখানেই সমাপ্তি। তোদের চিত্রবিদ্যার মধ্যে একটা কঠোরতা চাই। পৌরুষ চাই — যথার্থ সৌন্দর্য্য জিনিসটি মোহ নয় মায়া নয়, তা দশজনের চোখ ভোলাবার ফাঁদ নয় — সৌন্দর্য্য হচ্চে সত্য — যতক্ষণ সৌন্দর্য্যসৃষ্টির মধ্যে সত্যের সেই স্বাভাবিক দৃঢ়তা প্রশস্ততা কঠোরতা পাওয়া যাবে না ততক্ষণ তার উপরে সম্পূর্ণ নির্ভর স্থাপন করা যেতে পারবে না। বিশ্বসৃষ্টির দিকে চেয়ে দেখ্। এর সর্বত্রই খুব একটা জোর আছে, এ ভারি শক্ত — এর সৌন্দর্য্য বাবুয়ানার উপর প্রতিষ্ঠিত নয় — এ আমাদের বাঙলাদেশের কার্ত্তিকের মত গোঁফে তা দিয়ে ময়ূর চড়ে বেড়ায় না। বিশ্বের এই বিশাল সৌন্দর্য্য অসুন্দরকেও অনায়াসে আপনার অঙ্গীভূত করে নিতে পারে এবং তাতে তার কিছুমাত্র ক্ষতি হয় না। তোর তুলি মায়া-সরস্বতীর পায়ের তলার আল্তা দেবার তুলি হলে চল্বে না — তোর তুলিতে পৌরুষ দেখতে চাই — তার বাঁট বজ্রের মত শক্ত হবে, এবং সর্ব্বত্রই সে অকুণ্ঠিত প্রবেশাধিকার লাভ করবে। তোর চারদিকে যা তুচ্ছ জিনিস আছে, যা অসুন্দর, তার মধ্যেও সুন্দরকে তুই দেখ্বার সাধনা কর, তাহলেই বিশ্বসরস্বতী তোর সহায় হবেন। আমি যা বল্লুম তার সব কথা তার সব কথা হয়ত স্পষ্ট বুঝতে পারবি নে — এ চিঠি অবনের কাছে নিয়ে যাস্ তিনি তোকে সব কথা বুঝিয়ে দিতে পারবেন।’
[ উৎসনির্দেশ : ‘আমার কথা’ / মুকুল দে ]
এই অত্যাশ্চর্য চিঠিটি আমরা তিনবার, তিনভাবে পাঠ করতে পারি ; প্রথমবার,আঠারো বছরের বালকের কাছে পাঠানো রবীন্দ্রনাথ-এর এক সতর্কবার্তা, দ্বিতীয়বার, ‘ভারতশিল্প’-এর প্রবর্তক অবনীন্দ্রনাথ-এর কাছে পাঠানো রবীন্দ্রনাথ-এর মতভেদ-পত্র(Note of Dissent), এবং, তৃতীয়বার, নিজের কাছে গোপনে রেখে দেওয়া রবীন্দ্রনাথের কর্মজীবনের অন্তিমপর্বের কর্মসূচী।
আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি, রবীন্দ্রনাথের পূর্ণাঙ্গ চিত্র বিচারের বিশেষ একটি প্রথা সুপ্রতিষ্ঠিত, তাঁর ছবির বিশ্লেষকগণ তাঁকে জার্মান অভিব্যক্তিবাদের (German Expressionism) দোরগোড়ায় পৌছে দেন, সেইসঙ্গে তাঁর ছবির মধ্যে আদিম শিল্পকলার (Primitive Art / Primitivism) প্রকাশেরও একটি প্রস্তাব নিহিত থাকে। এই ভাবনাসূত্রের দু’টি উৎস আছে; এক, তথ্যের ভিত্তি এবং, দুই, প্রতীচ্যের সমকালীন শিল্পীদের কাজের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ-এর কালি-কলম ও জলরঙের কাজের ‘সাদৃশ্য’ ।
প্রথম প্রসঙ্গ: তথ্যের ভিত্তি। পরিতোষ সেন লিখছেন:
‘এসব কথা পাড়ছি এই কারণে যে কবির চিত্রকলায় একটা অভিব্যক্তিবাদের (Expressionism) আভাস আছে যা তাঁর ছবির বিষাদের মেজাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কোনও কোনও লেখক তাই জার্মান Expressionist শিল্পীদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠার কথা উল্লেখ করেছেন। এটা তো ঠিকই যে জার্মানিতে ভ্রমণকালে অনেক Expressionist শিল্পীদের কাজ শুধু দেখেননি যথাযথ ভাবে তা উপলব্ধি ও প্রশংসা করেছিলেন। তার একটি বড় প্রমাণ হল এই যে ১৯২৪ (?) সালে তিনি Paul Klee, Kandinsky, Nolde প্রমুখ বাঘা–বাঘা শিল্পীদের কাজের কলকাতায় এক প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিলেন । …’
[ উৎসনির্দেশ : ‘রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা’ / পরিতোষ সেন , ‘দেশ’ সাহিত্য সংখ্যা ১৩৯৮]
‘১৯২৪’-এর পাশে প্রশ্নবোধক চিহ্নটি স্থাপন করেছেন স্বয়ং পরিতোষ সেন, সেইজন্য অনুমান করা যেতে পারে যে, সাল সম্পর্কে তাঁর একটি সংশয় ছিল। বস্তুত, উল্লিখিত প্রদর্শনীটি Indian Society of Oriental Art-এর তত্ত্বাবধানে কলকাতায় আয়োজিত হয়েছিল ১৯২৪-এ নয়, ডিসেম্বর ১৯২২-এ (প্রদর্শনী শুরু হয় সম্ভবত ২৩এ ডিসেম্বর ১৯২২) এবং পার্থ মিটর্ তাঁর আকর গ্রন্থ ‘Indian Art’–এ সেই প্রদর্শনীর ক্যাটালগেরও উল্লেখ করছেন। এই প্রদর্শনীটি যে রবীন্দ্রনাথেরই উদ্যোগে আয়োজিত হয়েছিল তা নিয়ে পরিতোষ সেন-এর সঙ্গে তিনিও সহমত, বস্তুত, ওই প্রদর্শনীতে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকার উল্লেখ ক’রেই তিনি তাঁর বইয়ের দশম অধ্যায় ‘মডার্নিজ়ম ইন ইণ্ডিয়া’ আরম্ভ করেন। পরবর্তীকালে, আরও অনেক প্রখ্যাত রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ ও শিল্পসমালোচক এ-বিষয়ে তাঁদের সমর্থন জ্ঞাপন করেছেন। কিন্তু, রবীন্দ্রজীবনের প্রকৃত তথ্যের সন্ধানে যে দু’জনের কাছে আমাদের বারংবার ফিরে আসতে হয়, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় ও প্রশান্তকুমার পাল, তাঁরা এ-প্রসঙ্গে কী বলেন? রবীন্দ্রনাথ ও দীনবন্ধু অ্যানড্রুজ় ১১ই অক্টোবর ১৯২২ সিংহল যাত্রা করেন, ৯ই নভেম্বর ফিরে আসেন কেরল-এ, সেখান থেকে মাদ্রাজ যান, মাদ্রাজ ঘুরে ২৩এ নভেম্বর বম্বাই পৌঁছন। প্রভাতকুমার-এর ‘রবীন্দ্রবর্ষপঞ্জি’ গ্রন্থে, ১৯২২-এর ডিসেম্বরে রবীন্দ্রনাথ-এর কর্মসূচী বিষয়ে আমরা এই তথ্য পাচ্ছি :
‘ ডিসেম্বর ৪ : সাবরমতী আশ্রমে গমন ও ভাষণ । গান্ধীজি এখন কারাগারে । তিন মাস সফর অন্তে শান্তিনিকেতনে প্রত্যাবর্তন।
: পৌষ উৎসবে ও খ্রিস্টোৎসবে কবির ভাষণ দান । বিশ্বভারতীর প্রথম সাংবৎসরিক উৎসব।’
প্রভাতকুমার কর্তৃক প্রদত্ত তথ্যের সঙ্গে প্রশান্তকুমার–এর তথ্যসংগ্রহ মিলে যাচ্ছে, তিনি কেবল আরও একটিই তথ্য এই সঙ্গে যুক্ত করছেন — ‘আবার কলকাতায় আসেন 17 Dec [২ পৌষ] তারিখে, 21 Dec-র মধ্যেই তিনি শান্তিনিকেতন প্রত্যাবর্তন করেন … ’ । অর্থাৎ, ১৯২২-এর ডিসেম্বর মাসের মাত্র তিন দিন রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় কাটিয়েছিলেন। প্রসঙ্গত, প্রদর্শনীটি কলকাতার শিল্পরসিকদের মধ্যে কিছুটা বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল। বিশিষ্ট শিল্পতাত্ত্বিক অর্ধেন্দুকুমার গঙ্গোপাধ্যায় (O. C. Gangoli ) ইংরেজি ভাষায় রচিত একটি সন্দর্ভ (‘The New Art in Europe’ / Viswa-Bharati Quarterly April 1923) প্রকাশ ক’রে শিল্পরসিকদের বোঝাবার চেষ্টা করেন যে প্রদর্শিত ছবিগুলি আপাতদৃষ্টিতে যতটা উদ্ভট মনে হোক, ততটা উদ্ভট তারা নয়, তারা নবীন ভাবনার ফসল, তারাও সুন্দর। এই লেখাটিতে আয়োজক-সংস্থার উল্লেখ থাকলেও রবীন্দ্রনাথের কোনও উল্লেখ নেই। আমাদের মনে রাখতে হবে, তখনকার রসিক মহল টমাস ও উইলিয়ম ড্যানিয়েল, রাজা রবি বর্মা ও নব্যবেঙ্গল স্কুলের ছবি দেখতে অভ্যস্ত, এবং ও. সি. গাঙ্গুলী রুচিনির্মাতার ভূমিকা পালন করছেন। এই প্রদর্শনীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সংযোগের কোনও সংবাদ যদি তাঁর ঝুলিতে থাকত, তিনি তা সদ্ব্যবহারের কোনও সুযোগ নষ্ট করতেন না।
দ্বিতীয় প্রসঙ্গ: প্রতীচ্যের মডার্নিস্টদের কাজের সঙ্গে রবীন্দ্র-চিত্রকলার ‘সাদৃশ্য’। প্রদর্শনীর ভূত যদি-বা সহজে তাড়ানো যায়, পৃথক ধরনের ছবির মধ্যে মিল প্রমাণ অথবা অপ্রমাণ করা ততটা সহজ নয়। মডার্নিস্টদের ও রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি রেখে আমরা উভয়ের মধ্যে প্রভেদ ও সাদৃশ্য বিচার করব, কিন্তু তার পূর্বে, বিদেশে রবীন্দ্র-চিত্রকলার বিপুল জনপ্রিয়তা থেকে একটি-দু’টি ভাবনাসূত্রের সন্ধান করা যেতে পারে। অল্প সময়ের জন্য হলেও রবীন্দ্রনাথের ছবি যে বিদেশে আলোড়ন তুলেছিল, এ-বিষয়ে কোনও সংশয় নেই। ১৯৩০ সালের মে মাসে পারী-র ‘গ্যালেরি পিগাল’-এ ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো-র আর্থিক সহায়তায় আয়োজিত ও ১২৫টি কাজ সম্বলিত প্রথম প্রদর্শনীটি সব দিক থেকেই একটি বিস্ফোরণের চেহারা নেয়। তারপর, ওই বছরেই ইংল্যান্ডে দু’টি, জার্মানিতে তিনটি, ডেনমার্কে একটি, সুইটজ়ারল্যান্ডে একটি, সোভিয়েত রাশিয়ায় একটি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তিনটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। ৩১ জানুয়ারি ১৯৩১-এ রবীন্দ্রনাথ-এর স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পরেও, মে ১৯৩১-এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেল্ফিয়ায় আরও একটি প্রদর্শনী আয়োজিত হয়। ওই বছরের শেষেও উচ্ছ্বাসের অনুকম্পন থেমে যায় নি ব’লেই মনে হয়; রবীন্দ্রনাথ তখনও সম্পূর্ণ ঘোরমুক্ত নন, ২৪এ নভেম্বর ১৯৩১-এ বন্ধু রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়-কে লিখছেন:
‘ছবি সম্বন্ধে আমি কোমর বেঁধে আধুনিকতার চর্চা করি নি, করবার উপায়ও ছিল না,কারণ পরিচয়ের অভাব। বিদেশী আর্টিস্টরা কেউ কেউ বলচেন আমার চিত্রকলায় সাবেকী আধুনিকীর অদ্ভুত সম্মিলন ঘটেচে—এ কথাটা যদি সত্যি হয় এ ঘটকালি অজ্ঞানকৃত। যাই হোক ইণ্ডিয়ান আর্ট যাকে বলে সেটা আমার আনাড়ি কলমে প্রকাশ পায় নি—অতএব এ জাতকূল মিলিয়ে ভাল লাগবার আশা নেই। সম্পূর্ণ কুড়িয়ে পাওয়া জিনিস, ইংরেজি ভাষায় যাকে বলে ফাউণ্ডলিং। তাই এদেশের নিষ্ঠাবান মহলে ওকে দাঁড় করাতে ভয় করি। তবুও ছবিগুলোর মধ্যে এমন কিছু আছে যাকে দেখে আচারী লোকেরা হুঁকোর জল ফেলে দেবে না।
[ উৎসনির্দেশ: পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে রবীন্দ্রনাথ-এর একশো পঁচিশতম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত চিত্রপ্রদর্শনীর (১– ৯ মে ও ১২-২৫ মে, ১৯৮৬)ক্যাটালগ্।]
তাঁর ছবি, স্বদেশের সেই সময়ের শিল্পবস্তু সংগ্রাহকদের মধ্যে সাড়া জাগাতে পারে নি কারণ তাঁদের দেখার দৃষ্টি তখনও ফোটে নি; এটা তাঁদের সীমাবদ্ধতা হতে পারে, কিন্তু অক্ষমতা নয় ,অপরাধ তো নয়ই। এর বিপরীত অবস্থা আমরা লক্ষ করছি তখনকার প্রতীচ্যে, যেখানে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো-র তুল্য জহুরী ও আর্ট ডিলাররা, গ্যালারী পরিচালক ও কিউরেটররা রবীন্দ্রনাথকে সাদরে গ্রহণ করছেন, এবং আমরা আজ এ-প্রস্তাবও রাখছি যে জার্মান এক্সপ্রেশনিস্টদের অথবা অন্য কারুর-কারুর কাজের সাদৃশ্যই ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোদের রবীন্দ্রনাথ-এর শিল্পকর্মের প্রতি আকৃষ্ট করেছিল। অর্থাৎ, প্রস্তাবটি এইরকম: পশ্চিমের বিভিন্ন দেশের গ্যালারী পরিচালক ও কিউরেটররা এতটাই নির্বোধ যে তাঁরা আরও একজন Edvard Munch (১৮৬৩-১৯৪৪), আরও একজন Wassily Kandinsky(১৮৬৬-১৯৪৪),আরও একজন Emil Nolde (১৮৬৭-১৯৫৬), আরও একজন Paul Klee-র (১৮৭৯-১৯৪০) কাজ মাথায় বয়ে দৌড়ে বেড়িয়েছিলেন, এবং, এর বিপরীতে, রবীন্দ্রনাথ এতটাই বুদ্ধিমান, জহুরী সম্প্রদায়ের চোখে ধুলো দিতে এতটাই পারদর্শী যে, বিদেশে ভ্রমণকালে মডার্নিস্টদের ওই ছবিগুলি দেখে, দেশে ফিরে সেই অভিজ্ঞতার দ্বারা ‘অনুপ্রাণিত’ হয়ে সেগুলিকেই সামান্য এদিক-ওদিক ক’রে (যা, অধুনা এক স্বীকৃত ও প্রচলিত কর্মপদ্ধতি!) নতুন চিত্রকর্ম প্রস্তুত ক’রে, সেগুলিই আবার বিদেশে বয়ে নিয়ে গিয়ে, গ্যালারীতে প্রদর্শিত ক’রে, সিদ্ধিদাতা বিনায়কের কৃপায় হয়তো কিছু ছবি বেচেও, বিস্তর সুনাম কিনেছিলেন। না, রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আমরা এতটা ভেবে উঠতে পারছি না। হায়, এই সহজ কথাটি যদি আমরা অনুভব করতে পারতাম, মহৎ শিল্পীরা অন্য শিল্পীদের কাছে আসেন না, দূরে থাকেন! না, মডার্নিজ়মের পথিকৃতদের(যাঁদের মধ্যে মাত্র কয়েকজনই এক্সপ্রেশনিস্ট), পরস্পরের বহু দূরে অবস্থানরত এতগুলি ভিন্নমুখী, ভিন্নধর্মী প্রতিভাকে একটিই দলা পাকিয়ে গলাধঃকরণেও আমরা অসফল।
Walter Gropius(১৮৮৩-১৯৬৯)কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘Bauhaus’(‘বাউহাউস’)শিল্পীগোষ্ঠী, Ernst Kirchener (১৮৮০-১৯৩৮) ও অন্যান্যদের দ্বারা স্থাপিত ‘Die Brucke’ (‘সেতু’) শিল্পীগোষ্ঠী এবং Wassily Kandinsky–র ‘Der Blaue Reiter’ -র(‘নীল অশ্বারোহী’)সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নাম সংযুক্ত রেখেছেন শিল্প সমালোচকগণ, কিন্তু ভিন্ন ধারার ছবির মধ্যে কিছু অগভীর মিল খুঁজে নেওয়ার বাইরে, ভাবনার কোনও খোরাক তাঁরা পেশ করেন নি। কখনও–কখনও, এমনও মনে হয়, দুই পথচারীর রাস্তায় ধাক্কা লেগে-যাওয়ার মতো আকস্মিক ঘটনাকে তাদের আলিঙ্গনাবদ্ধ হবার বিবরণে রূপান্তরিত করা হয়েছে। বর্তমান আলোচনায় সব ক’টি বলপ্রয়োগের অলীক প্রয়াস ছুঁয়ে যাবার পরিসর নেই; আমরা কেবল পরিতোষ সেন-এর সন্দর্ভের সূত্র ধ’রে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ‘বাউহাউস’ শিল্পীগোষ্ঠী, বিশেষত কান্দিন্স্কি ও ক্লী-র সম্পর্কটি সেই স্তরে অনুসন্ধান করব, যে স্তরে শিল্প সমালোচকরা এত ‘মিল’ খুঁজে পেয়েছেন।
প্রথম কথাটি এই : ‘বাউহাউস’ প্রতিষ্ঠানের মূল অবদান, চিত্রকলায় নয়, নগর-স্থাপত্যে, বিশেষত ইমারত নির্মাণে, আসবাব পত্রে এবং ডিসাইন শিল্পে। স্থাপত্যকলা ও বিভিন্ন শৈলী ব্যবহার ক’রে বাড়ির নক্সা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ-এর আগ্রহের কোনও অন্ত ছিল না, এ আমরা বিলক্ষণ জানি। শান্তিনিকেতন-আশ্রমে কোথাও বাঙলার কুটির, কোথাও গুজরাটের কাঠের সদর দরজা, কোথাও জাভা, কোথাও মুঘল শৈলী, কোথাও গির্জা, কোথাও মসজিদ্, কোথাও অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরের রঙিন কাচের শার্সি ভেদ ক’রে সূর্যের আলো উপাসনালয়ের মেঝেতে শুয়ে রয়েছে — কত বৈচিত্র্যময় ভাবনা ভেবেছিলেন স্থপতি রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু কই, ‘বাউহাউস’-এর বাড়ির একটিও আদল তো নেই আশ্রমপ্রাঙ্গণে? কান্দিন্স্কি ও ক্লী, উভয়ই শিক্ষকতা করতেন ‘বাউহাউস’ প্রতিষ্ঠানে , এই জন্যই কি ‘বাউহাউস’-এর নাম উঠে আসছে বারবার? সাদৃশ্য কি তবে রবীন্দ্রনাথের ছবির সঙ্গে ‘বাউহাউস’ প্রতিষ্ঠানের নয়, সম্পর্ক কি তবে কান্দিন্স্কি ও ক্লী-র ছবির সঙ্গে? এবার, আমরা তর্কের জালে জড়িয়ে পড়ব আরও, কারণ কান্দিন্স্কি ও ক্লী, দু’জনে, দুই ভিন্ন জগতের অধিবাসী। রবীন্দ্রনাথ-কান্দিন্স্কি–ক্লী, এই ত্রিভুজ তৈরি ক’রে আমরা কোন মীমাংসাসূত্রে পৌঁছতে চাইছি?
ক্লী-র কাছে, তাঁর নিজের ভাষ্য অনুসারে, একটি রেখার হাত ধ’রে বেড়াতে বেরোনোর অপর নাম চিত্রকলা! এই নির্ভার অনুভূতি, সরলতার বোধ, এবং রঙে ও রেখায় সেই চেতনা ফুটিয়ে তোলার সঙ্কল্প, তাঁকে সর্বকালের মহৎ শিল্পীদের শোভাযাত্রাতেও এক স্বতন্ত্র স্থান ক’রে দিয়েছে। ভাবনায় ও প্রয়োগে যিনি আর-সকলের থেকে এতটাই পৃথক, নিজের কাজকে যিনি বিষণ্ণতা, বার্তা বিতরণ ও আগ্রাসন থেকে এতটা দূরে সরিয়ে রাখলেন, তিনি কোনও শিল্প- পরিবারের সদস্য হতে পারেন না, রবীন্দ্রনাথের নিকটবর্তী হবার প্রশ্নই ওঠে না। শাদা চোখের দেখার স্তরে তাঁদের ছবির মধ্যে যে মিল ধরা পড়ে, মনের দেখার স্তরে সে-মিল কতটা অক্ষত থাকে তা আরও একবার পরীক্ষা করবার জন্য আমরা দু’জনার দু’টি শ্রেষ্ঠচিত্রকর্ম(masterpiece) বেছে নিলাম, রবীন্দ্রনাথ-এর সুবিখ্যাত ‘আত্মপ্রতিকৃতি’(১লা আষাঢ় ১৩৪২/১৯৩৫) এবং ক্লী-র একটি স্বল্পপরিচিত প্রতিকৃতি ‘A Crusader’ (১৯২৯)। ছবি দু’টির মধ্যে একটি মিল আমরা লক্ষ করি। ‘আত্মপ্রতিকৃতি’ তে চোখ দু’টি কৃষ্ণবর্ণ ও বিষণ্ণ, দর্শকের দিকে সরাসরি তাকিয়ে রয়েছে, মধ্যে খাড়া নাক,ডান চোখটি রয়েছে বাঁ চোখের সামান্য উপরে। ‘A Crusader’–এ চোখ দু’টি বিষণ্ণ নয়, আতঙ্কিত ও নীলবর্ণ, এখানেও অপলক দৃষ্টি, এখানেও মধ্যে খাড়া নাকের সঙ্কেত, এবং, কি আশ্চর্য, চোখ এখানেও মুখাবয়বের সমানে-সমানে নেই, ডান চোখটি রয়েছে বাঁ চোখের সামান্য নিচে! এরপরেই, বলা বাহুল্য, মিলগুলি একে-একে ভেঙে পড়তে শুরু করে; অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞার ভারে ‘আত্মপ্রতিকৃতি’ দুঃখী ও মলিন, আর এর বিপরীতে Crusader দুর্ভাবনাহীন,উদ্দীপ্ত,তার মাথার একপাশ দিয়ে অগ্নিশিখা বেরিয়ে আসছে; সে এগিয়ে চলেছে! ক্লী-র ছবিটি বর্তমানে নিউ ইয়র্কে জনৈক শিল্পমোদীর ব্যক্তিগত সংগ্রহে আছে এবং তার হস্তান্তরের ইতিহাসও আমাদের অজানা, সেই কারণে ছবিটি রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন কি না তা আজ নির্ধারণ করা অসম্ভব। সমূহ তথ্য সামনে যদি থাকত, আমরা যদি নিঃসংশয়ও হতে পারতাম যে ছবিটি রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন এবং ১৯৩৫ সালের বর্ষাকালে চন্দননগর-এ ব’সে আত্মপ্রতিকৃতি আঁকার সময়ে, তর্কের খাতিরে যদি মেনেও নেওয়া যে, ক্লী-র ‘A Crusader’ তাঁর অবচেতনে ছিল, তা হলেও ‘আত্মপ্রতিকৃতি’-র মৌলিকতা কোনও ভাবেই খর্বিত হয় না: উপাদান ব্যবহারে অভিন্নতার দ্বারা লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার অভিন্নতা প্রমাণিত হয় না। ছবি দু’টিতে রূপের মিল আছে, ভাবের সাদৃশ্য নেই। আমরা এ-প্রসঙ্গে ফিরে আসব, রূপের মিল ও ভাবের সাদৃশ্যের মধ্যকারপ্রভেদ বোঝবার জন্য অবনীন্দ্রনাথের ভাষ্যের সহায়তা গ্রহণ করব।
অগভীর স্তরে কান্দিন্স্কি-র ছবির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ-এর কাজের যে একটি-দু’টি মিল খুঁজে পাওয়া যায়, যেমন স্বপ্নোত্থিত আকৃতি। এর প্রতিতুলনায় প্রভেদ অন্তত কয়েকগুণ, কিন্তু, দেখা যাচ্ছে, জনশ্রুতি সে-বিষয়ে অন্ধ ও বধির। কান্দিন্স্কি-র শৈশব কেটেছিল ইউক্রেন-এর বন্দরনগরী ওডেসা-য় এবং যেহেতু, সেই সময়ের অভিজাত বংশের শিশুদের পাঠক্রমে সঙ্গীত ও চিত্রকলার বিশিষ্ট স্থান ছিল, সেহেতু প্রাথমিক স্তরে তিনি ছিলেন চিত্রকলায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। কুড়ি বছর বয়সে কান্দিন্স্কি আইনশাস্ত্রের ছাত্র হয়ে মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন, কিন্তু, যখন অধ্যাপকের পদের জন্য তাঁকে মনোনয়ন করা হয়েছে, ঠিক তখন, ১৮৯৬ সালে, ত্রিশ বছর বয়সে, সেই ‘সফল’ জীবন বর্জন ক’রে তিনি বেছে নেন চিত্রশিল্পীর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, চ’লে যান জার্মানির মিউনিখে। মস্কোর সূর্যাস্ত, মস্কোর এবং ভলোগদা-র পেঁয়াজাকৃতির গম্বুজগুলি তাঁর স্মৃতির ভাণ্ডারে রয়ে যায়, ওই বহুবর্ণময় রাশিয়াই তাঁর ছবির ভিত্তিপ্রস্তর। বস্তুকে দর্শনপ্রার্থীর কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া যায়, কিন্তু ‘অবস্তু’ ? — এই ছোট্ট প্রশ্ন থেকে কান্দিন্স্কি তাঁর যাত্রা শুরু করেছিলেন। প্রথম দিকে দর্শকের জন্য চিত্রপটে বাস্তব জগতের কিছু চিহ্নের সঙ্কেত তিনি ছড়িয়ে রাখতেন, পরবর্তীকালে তা-ও তিনি প্রত্যাহার ক’রে নেন, ছবি প্রকৃত অর্থেই হয়ে ওঠে বিমূর্ততার অভিজ্ঞান। আমরা লক্ষ করি, রবীন্দ্রনাথ-এর নারীমূর্তি থেকে বিষণ্ণতার এমন এক আভা ছড়িয়ে পড়ে যে, অদীক্ষিত মানুষের কাছেও তা পৌঁছে যায়, কান্দিন্স্কি–র ক্ষেত্রে এই রকম সংযোগস্থাপন অসম্ভব, বিংশ শতাব্দীর চিত্রকলা বিষয়ে ওয়াকিবহাল অনেক মানুষের কাছেও তিনি সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য। চিত্রকলার মধ্যবর্তিতায় চেতনার যে স্তরে তিনি পৌঁছতে চেয়েছিলেন তা ব্যক্তিমানুষের উচ্চাভিলাষের পরাকাষ্ঠা। ১৯১১ সালে, মিউনিখ-এ প্রথম প্রকাশিত তাঁর শিল্পতত্ত্বের বই( ইংরেজি অনুবাদে যার নাম ‘The Art of Spiritual Harmony’ মতান্তরে,‘Concerning the Spiritual in Art ’) পাঠ না করলে তাঁকে স্পর্শ করা অসম্ভব। এর বিপরীতে, রবীন্দ্রনাথ বাস্তব জগত বর্জন করেন নি কখনও; রঙের ব্যবহারে বৈচিত্রের পরিচয় দিলেও কান্দিন্স্কি-র উজ্জ্বলতার সঙ্গে তাঁর কাজের তুলনা ক’রে চলে না। দু’জন প্রধান শিল্পীর মধ্যে এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রভেদ অন্যত্র আছে কি না, তা ভাবনার বিষয় হয়ে রইল।
এতক্ষণ আমরা যা বলছিলাম তা আমাদের শাদা চোখের বিচার, মনের বিচার অন্য। স্বয়ং অবনীন্দ্রনাথ ‘সাদৃশ্য’ প্রসঙ্গে আমাদের এই বিধান দিয়ে গেছেন:
‘ঘরের কোণে বসিয়া বুড়ি চরকা ঘুরাইতেছে আর ছড়া কাটিতেছে —
চরকা আমার পুত, চরকা আমার নাতি৷
চরকার দৌলতে আমার দুয়ারে বাঁধা হাতি৷৷
বুড়ির চরকাটি যে তাহার নাতি কিংবা হাতি অথবা পুতের অনুরূপ তাহা নয়; বুড়ির এইরূপ দেখিবার কারণ হইতেছে চরকাটির সঙ্গে বুড়ির সংসার ও বুড়ির নিজের মনোভাবের — হাতি কেনা ইত্যাদির—অচ্ছেদ্য সম্বন্ধটুকু। সুতরাং দেখিতেছি, রূপে রূপে মিল অপেক্ষা সাদৃশ্যের পক্ষে ভাবে ভাবে সম্বন্ধ অধিক প্রয়োজনীয়। সদৃশস্য ভাব ইতি সাদৃশ্য। একের ভাব যখন অন্যে উদ্রেক করিতেছে তখনই হইতেছে সাদৃশ্য’
[ উৎসনির্দেশ : ‘ভারতশিল্পের ষড়ঙ্গ’ – ‘সাদৃশ্য’ /অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর , ১৩৫৪/১৩৯৬ ]
অবনীন্দ্রনাথ এখানে প্রাঞ্জল ভাষায় আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, রূপের মিল নয়, প্রধান বিচার্য বিষয় ভাবের সাদৃশ্য, ‘একের ভাব যখন অন্যে উদ্রেক করিতেছে তখনই হইতেছে সাদৃশ্য’।
রবীন্দ্রনাথের ছবি-বিষয়ে যে বিপুল আগ্রহ পশ্চিমে দেখা গেছিল ১৯৩০-৩১এ, তার একটি বিশেষ কারণ আছে ব’লে আমাদের মনে হয় : অকস্মাৎ, কোনও পূর্বসূত্রের সহায়তা না নিয়েই, তিনি, সম্পূর্ণ নতুন একটি ভাব উপস্থাপিত করতে পেরেছিলেন। যাঁরা এক্সপ্রেশনিস্টদের অথবা অন্য কোনও শিল্পীগোষ্ঠীর কাজের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ছবির সাদৃশ্য চিহ্নিত করতে চাইছেন, তাঁরা মূলত রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক ব্যবহৃত অন্তত দু’টি শৈলীর ─ টর্সো-বিকৃতি ও বিমূর্তন (অ্যাব্স্ট্রাকশ্ন) ─ রূপের মিল দ্বারা চালিত হচ্ছেন, এক্সপ্রেশনিস্টদের সঙ্গে তাঁর ভাবের সাদৃশ্য দেখা গেছে কি না, তা বিচার করবার ক্ষেত্র গ’ড়ে ওঠে নি।
ভাবনার জগতে অসংখ্য বিন্যাস অন্তরীক্ষে ভেসে বেড়ায়, কিছু মানুষ তাঁদের চেতনার দ্বারা তা স্পর্শ করতে পারেন ; এর যোগসূত্র অতিসূক্ষ্ম, কোনও চিত্রশিল্পীর কোনও পর্বের সঙ্গে অন্য কারুর কাজে মিল খুঁজে পাওয়া, না-পাওয়াও আবশ্যক নয়। চিত্রশিল্পের জগতে রবীন্দ্রনাথ যে দরজা ভেঙে ঢুকে পড়েছেন, সেই দ্বিধা তিনি প্রসন্নচিত্তে বহন করেছেন, এবং, সেই কারণেই হয়তো, একটি-দু’টি ব্যতিক্রম (‘The Meaning of Art’ [১৯২১] এবং বার্মিংহ্যাম-এ অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় প্রদর্শনী [জুন,১৯৩০] উপলক্ষে রচিত গদ্যরচনা প্রভৃতি) সরিয়ে রাখলে, নিজের ছবির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে তিনি নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন নি, অনুভূতি প্রকাশের স্তরে এসে নিজেকে বিরত করেছেন। অথচ, কি আশ্চর্য, চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথ ভূমিষ্ঠ হবার বহু পূর্বে কান্দিন্স্কি-র রচনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর চিত্রকলার তত্ত্ব লিপিবদ্ধ হয়ে রয়েছে:
চিত্র : ৬
চিত্র : ৬
ওয়াসিলি কান্দিন্স্কি (১৮৬৬-১৯৪৪) প্রণীত ‘দি আর্ট অফ্ স্পিরিচুয়াল হারমনি’ ১৯১৪ সংস্করণ।
‘ There is, however, in art another kind of external similarity which is founded on a fundamental truth. When there is a similarity of internal tendency in the whole moral and spiritual atmosphere, a similarity of ideals, at first closely pursued but later lost to sight, a similarity in the inner feeling of anyone period to that of another, the logical result will be a revival of the external forms which served to express those inner feelings in an earlier age. An example of this to-day is our sympathy, our spiritual relationship with the Primitives. Like ourselves, these artists sought to express in their work only internal truths, renouncing in consequence all consideration of external form.
This all-important spark of inner life to-day is at present only a spark. Our minds, which are even now just awakening after years of materialism, are infected with the despair of unbelief, of lack of purpose and ideal. The nightmare of materialism which has turned the life of the universe , into an evil, useless game, is not yet past ; it holds the wakening soul still in its grip. Only a feeble light glimmers like a tiny star in a vast gulf of darkness. This feeble light is but a presentiment, and the soul, when it sees it, trembles in doubt whether this light is not a dream, and the gulf of darkness reality. This doubt and the still harsh tyranny of the materialist philosophy, divide our soul from that of the Primitives. Our soul rings cracked when we seek to play upon it, as does a costly vase, long buried in the earth, which is found to have a flaw, when it is dug up once more. For this reason, the Primitive phase, through which we are now passing, with its temporary similarity of form, can only be of short duration.’
[ উৎস : The Art of Spiritual Harmony by Wassily Kandinsky , 1914 edition ভূমিকার অংশ / অনুবাদ : Michael T. H. Sadler ]
ǁ ৪ ǁ
রবীন্দ্রনাথ নিজের ছবির বিষয়ে নিজে যা-যা বলেছিলেন সেগুলি আরও একবার ফিরে পাঠ করলে, আমরা কি নতুন কোনও ভাবনাসূত্র খুঁজে পেতে পারি? সাধারণত, আমরা ‘আলাপচারি রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থের নানা উক্তির সহায়তা গ্রহণ করি অথবা তাঁর অগণিত চিঠির, যেমন এক সময়ে উদয়শঙ্করের সংস্পর্শে-আসা ভাস্কর ও ভারতপ্রেমিক অ্যালিস বোনর-কে (১৮৮৯-১৯৮১) লেখা অধুনা দুষ্প্রাপ্য এই ছোট্ট পত্রটি :
January 20, 1940
Dear Miss Boner,
It has suddenly occurred to me to send you a piece of paper scratched over by my erratic pen with lines that grew into a vision of dumb efforts and desperate appeal to emptiness.
Yours sincerely,
Rabindranath Tagore
Miss Alice Boner,
Assi Ghat,
Benaras, U.P.
[ উৎসনির্দেশ: Alice Boner Diaries India 1934-1967, ed. by George Boner & two others ]
আমরা রবীন্দ্রনাথ-এর দু’টি ইংরেজি রচনা বিশেষ ভাবে স্মরণ করছি । প্রথমটি মে ১৯৩০-র রচনা, বিদেশে অনুষ্ঠিত চিত্রপ্রদর্শনী উপলক্ষে লিখিত তাঁর ছবির ‘আত্মপরিচয়’। লেখাটি দীর্ঘ না হলেও, কৈফিয়তক্লিষ্ট; আমরা কেবল তার একটি অংশ উদ্ধার করছি।
#
‘I had come to know that rhythm gives reality to that which is desolutory, which is insignificant in itself. And therefore, when he scratches in my manuscript cried, like sinners, for salvation, and assailed my eyes with the ugliness of their irrelevance , I often took more time in rescuing them into a merciful finality of rhythm than carrying on what was my obvious task. In the process of this salvage work I came to discover one fact , that in the universe of forms there is a perpetual activity of natural selection in lines, and only the fittest survive which has in itself the fitnss of cadence and I felt to solve the unemployment problem of the homeless hetrogeneous into inter-related balance of fulfilment is creation itself.’
[ উৎসনির্দেশ: Reprinted in ‘The English Writings of Rabindranath Tagore’ Vol III 1996]
প্রথমাংশে রবীন্দ্রনাথ যা জানান — শূন্যতা থেকে পরিত্রাণ লাভ করবার জন্য সৃষ্টিশীল মানুষের চিরকালীন আকাঙ্ক্ষা — সে-মনোভাব আমাদের পূর্বপরিচিত, বস্তুত, এই ভাবনাসূত্র তাঁর লেখায় সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে, এমন কি, মৃত্যুর দেড় বছর আগে অ্যালিস বোনর-কে লেখা চিঠিতেও ফুটে উঠেছে। উদ্ধৃতির দ্বিতীয় বাক্যটি আমাদের বর্তমান দীর্ঘ আলোচনার হৃৎপিণ্ড; এখানে রবীন্দ্রনাথ স্পষ্ট ভাবে, দ্ব্যর্থহীন ভাষায়, তাঁর মনঃসংযোগ স’রে আসার বাস্তব অবস্থা কবুল করছেন।
আমাদের দ্বিতীয় নির্বাচন, ১৯২১ সালের প্রাচীন একটি ইংরেজি রচনা; চিত্রশিল্পের জগতে রবীন্দ্রনাথ তখনও প্রবেশই করেন নি, অথচ, বিস্ময়ভরে আমরা লক্ষ করি, এর ভিতরেই তাঁর কর্মসূচী সম্পূর্ণ প্রস্তুত! রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি রচনাবলী, খুব সঙ্গত কারণে, কিঞ্চিৎ অবহেলিত; আমরা ধ’রেই নিয়ে থাকি এগুলি সবই বাঙলা রচনার পুনরাবৃত্তি। সাধারণভাবে মতটি অভ্রান্ত হলেও ‘The Meaning of Art’ এক ব্যতিক্রম। উদ্ধৃত অংশটির প্রথম বাক্য—Art is a solitary pedestrian, who walks alone in the multitude—গানের রূপ ধ’রে (‘প্রথম যুগের উদয়দিগঙ্গনে’ /রচনাকাল ২৫ বৈশাখ ১৩৪৫ [১৯৩৮]) চৌদ্দ বছর পর রবীন্দ্রনাথ-এর কাছে ফিরে এসেছিল:
‘ যে এসে দাঁড়ায় ব্যাকুলিত ধরণীতে
বননীলিমার পেলব সীমানাটিতে,
বহু জনতার মাঝে অপূর্ব একা ।’
আমাদের বর্তমান আলোচনার মূল বিষয়, রবীন্দ্রনাথ-এর চিত্রকলা নতুন ক’রে বোঝবার জন্য ‘The Meaning of Art’-র একটি নির্বাচিত অংশ আমরা এখানে তুলে ধরা হল:
‘Art is a solitary pedestrian, who walks alone in the multitude, continually assimilating various experiences, unclassifiable and uncatalogued. There was a time when human races lived in comparative segregation and therefore the art adventurers had their experience within a narow range of limits , deeply-cut grooves of certain common characteristics. But today that range has vastly widened , claiming from us a much greater power of receptivity than what we were compelled to cultivate in former ages. If today we have a living soul that is sensitive to ideas and to beauty of form, let it prove its capacity by accepting all that is worthy of acceptance, and not to some blind injunction of custom or fashion, but in following one’s instinct for eternal value, the instinct which is a God given gift to all real artists. Even then our art is sure to have a quality which is Indian , but it must an inner quality and not an and not an artificiually fostered formalism,and therefore not be too obtrusively obvious and abnormally self-conscious.
When in the name of India art we cultivate with deliberate aggresiveness a certain bigotry born of the habit of a past generation , we smother our souls under the idiosyncracies unearthed from buried centuries.
Art is not a gorgeous sculpture immovably brooding over a lonely eternity of vanished years. It belongs to the procession of life, making constant adjustment with surprises, exploring unknown shrines of reality along its path of pilgrimage to a future which is as different from the past as the tree from the seed. Art represents the inexhaustible maginficence of creative spirit. It is generous in its acceptance and generous in its bestowal ; it is unique in its manner and universal in its appeal; it is hospitable to the all because it has the wealth of its own; its vision is new though its view may be old. It carries its special criterion of excellence within itself and therefore contemptuously refuses to be browbeaten into conformity with a rhetoric manufactured by those who are not in the secret of the subtle mysteries of creation, who want to simplify through their academic code of law that which is absolutely simple through its spontaneity.’
[উৎসনির্দেশ: ‘The Meaning of Art’ / Rabindranath Tagore (1921) Reprinted by Lalit Kala Akademi 1969 and 1983] ।
এই গদ্যরচনাটির সুতীব্র শব্দক্ষেপণ লক্ষ করতে-করতে এমনও সন্দেহও জন্মায়, আমাদের সামনে এ-বুঝি রবীন্দ্ররচনা নয়, কোনও শিল্প-আন্দোলনের ম্যানিফেস্টো! দক্ষিণের বারান্দা থেকে সম্প্রচারিত নব্য বেঙ্গল স্কুলের নির্দেশাবলীর প্রতি তাঁর আপত্তি যে কতটা গভীর ছিল, তা এই গদ্যাংশ থেকে অনুমান করা যায়। আমরা আরও বুঝতে পারি, সমসময়ের ভারতবর্ষ অথবা সমসময়ের পশ্চিম, কারুর উপদেশ নয়, সেই ১৯২১ থেকেই রবীন্দ্রনাথ কেবল অন্তরের নির্দেশ মেনে চলেছেন। বস্তুত,বর্তমান আলোচনায় উদ্ধৃত ২৫এ এপ্রিল ১৯১৩-এ মুকুল দে-কে তাঁর লেখা চিঠিটি যদি স্মরণ করি, তা হলে প্রস্থানবিন্দু ১৯২১-ও নয়, আরও পিছিয়ে যায়। ১৯২৩-২৪ এ, The Meaning of Art–র বঙ্গানুবাদ প্রকাশ করেন প্রতিমা ঠাকুর( তথ্যসূত্র নির্দেশ : রবিজীবনী/প্রশান্ত কুমার পাল, অষ্টম খণ্ড) কিন্তু, আমাদের দুর্ভাগ্য, অমূল্য এই রচনাটি লোকচক্ষুর অন্তরালেই রয়ে যায়। মুল্ক্ রাজ আনন্দ্ আমাদের জানাচ্ছেন, রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষের সময়ে রবীন্দ্রনাথের অগ্রন্থিত রচনা সংরক্ষণের কর্মযজ্ঞ যখন চলছে, তখনও ‘The Meaning of Art’ সব দিক থেকেই একটা হারিয়ে যাওয়া লেখা। W.G.Archer (১৯০৭-৭৯)-এর প্রখ্যাত কিন্তু বিতর্কিত, ও বিষ্ণু দে-র মতানুসারে ভ্রান্তিপূর্ণ, আলোচনা গ্রন্থ India and Modern Art (১৯৫৯)–এ দু’টি উদ্ধৃতির সূত্র ধ’রে লেখাটি ১৯৬৯ সালে পুনরাবিষ্কৃত হয়।
ǁ ৫ ǁ
পরিশেষে, আমরা কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী ও বিশেষজ্ঞের লেখা থেকে রবীন্দ্রনাথের কারিগরি উদ্ভাবনী শক্তির একটা আভাস পাবার চেষ্টা করব। স্টেলা ক্রাম্রীশ(১৮৯৮(?)- ১৯৯৩) রবীন্দ্রনাথের রেখাঙ্কন পদ্ধতির মধ্যে দু’টি মূল ধর্ম শনাক্ত করেছেন, যথাক্রমে,
১। drop and loop পদ্ধতি : ফুলের,সরীসৃপের, মানুষের মুখাবয়বের এবং টর্সো-র গঠন
রবীন্দ্রনাথের পেন্সিলে অথবা কলমে এই বঙ্কিম, বলিষ্ঠ রেখায় সহজেই ধরা পড়ত; এবং
২। angles terminating in sharp points : উড়ন্ত মানব-পক্ষী, পাখির চঞ্চু, বিমানরূপী পাখির
ডানাযুগল, রাক্ষসের দাঁতের পাটি প্রভৃতি আঁকার সময়ে রবীন্দ্রনাথ , এক ধরনের খোঁচায়
সমাপ্ত হওয়া দীর্ঘ, ঋজু সরল রেখা ব্যবহার করতেন।
স্টেলা ক্রাম্রীশ আমাদের আরও জানান, এই দু’টি অঙ্কন পদ্ধতির উপর রবীন্দ্রনাথ জলরঙ প্রয়োগ ক’রে তাঁর বিস্ময়কর পট তৈরি করেছেন, যা কখনও-কখনও ভৌতিক মাত্রা পেয়ে গেছে। যেখানে কেবল কালি ব্যবহার করা হয়েছে সেখানেও গাঢ় এবং হালকা দাগের সমন্বয়ে একই আবহ গ’ড়ে তোলা হয়েছে। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তিনি আরও জানান, কিউবিজ়মের সঙ্গে অথবা গগনেন্দ্রনাথের শৈলীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পদ্ধতির কোনও মিল নেই। আপাতবিরোধী দু’টি পদ্ধতির, অর্থাৎ ‘drop and loop’ এবং ‘angles terminating in sharp points’ সমন্বয়ে উপর সমগ্র রবীন্দ্রচিত্রকলা সগৌরবে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
[ উৎসনির্দেশ: ‘Form Elements in the visual work of Rabindranath Tagore’ by Stella Kramrisch / Lalit Kala Contemporary Issue No 2 , December, 1964]
স্টেলা ক্রাম্রীশ তাঁর প্রশিক্ষিত দৃষ্টি দিয়ে রবীন্দ্রনাথের ছবি যেভাবে দেখছেন তা আমাদের সাধারণ ভাষায় অনুবাদ ক’রে নিলে এইরকম দাঁড়ায়: রবীন্দ্রনাথ-এর সব কাজে দু’টি জ্যামিতিক আকার, ত্রিভুজ এবং উপবৃত্ত(ellipse) , লুকিয়ে রয়েছে, যা কখনও একা, আবার কখনও একই সঙ্গে ব্যবহার ক’রে, এবং এর উপরে রঙের বৈচিত্র্য এনে তিনি অসাধ্য সাধন করেছেন।
রবীন্দ্রনাথের পূর্ণাঙ্গ চিত্রের এমন নিখুঁত বিশ্লেষণ আমরা অন্যত্র পাই নি। এ-প্রসঙ্গে কলা সমালোচক অশোক মিত্র-র (১৯১৭-৯৯) বিশ্লেষণও প্রণিধানযোগ্য; তিনি বিবর্তন ও চিত্রণের জটিলতা বৃদ্ধির দিক থেকে রবীন্দ্রনাথ–কে অনুসরণ করেছেন। Doodle থেকে পূর্ণাঙ্গ চিত্রে পৌঁছনোর অভিযাত্রা তিনি পাঁচটি পর্বে ভাগ ক’রে নিয়েছেন:
১। ‘প্রথমে কাটাকুটিগুলি হয় আকারহীন, ধ্যাবড়া ধ্যাবড়া দাগে, প্রান্তগুলি কলম দিয়ে ভাল
ক’রে সীমা ক’রে দেয়’। অর্থাৎ, প্রাথমিক পর্যায়ে doodle–এর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব সীমারেখার
দ্বারা চিহ্নিত কিন্তু তার গঠন বিশেষত্বহীন;
২। ‘দ্বিতীয় পর্যায়ে এল জন্তু, লতা, পাতার ইঙ্গিত, তার পরেই এল চোখ, মুখের রেখা কিংবা
অদ্ভুত কাল্পনিক জন্তুর শরীর, বা ফুল; পা, শরীর, মাথা, পাপড়ি।’
৩। ‘পূরবী’র পাণ্ডুলিপির কাটাকুটি এল তৃতীয় পর্যায়, শেষ কয়েকটি পাতায় এল সারা
পাতাময় কাটাকুটি, কালিকলমে আঁকলেন যত রকমের অদ্ভুত আকৃতি, প্রাণীজগতের
কাল্পনিক জীব, এক প্রাণীর শরীরে আরেক প্রাণীর মাথা, যেন সুকুমার রায়ের বকচ্ছপ
মূর্তি। প্রাকৃতিক প্রাণী নকল করছেন না ব’লে আরও সুবিধা হল, তার সব প্রাণী হল
দ্বিমাত্রিক, ঘনত্ব বা ভল্যুমবর্জিত, যদিও কাটাকুটির আলোছায়ায় বা কিয়ারসকুরোতে
ভল্যুমের আমেজ এল।’
৪। ‘চতুর্থ পর্যায়ে তিনি সোজা বড় বড় সাদা কাগজের উপর ছবি আঁকব বলেই ছবি আঁকতে
লাগলেন। দাবার চাল পড়ে গেছে, ফেরার পথ রইল না। আঁকার বিষয়বস্তু সব সময়েই
কল্পনা এবং আজগুবির জগতে রইল, প্রায় সর্বদাই অপ্রাকৃতিক এমন কি অনৈসর্গিক।
রীতি হল স্পষ্টই দ্বিমাত্রিক, মডলিং বা পারস্পেকটিভের বালাই নেই । …’
৫। ‘তাঁর পঞ্চম পর্যায়ের চিত্রগুলি এল সব একসঙ্গে, বিরাট স্রোতের আকারে যেন সম্মুখে যা
পেল তা-ই ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। এল প্রাকৃতিক বস্তু, প্রাকৃতিক দৃশ্য, প্রতিকৃতি, বৈঠকী
গ্রুপ, বাড়ি, স্থাপত্য; এক কথায় সারা বিশ্বজগৎ। তার সঙ্গে তাল রেখে চলল তাঁর রেখা,
আলো, ভল্যুম, মাস, পারস্পেকটিভ, গভীরত্ব, ভাস্বর, দ্যুতি, তুলি, কলম, রঙের উপর
দখল। তাঁর রঙ এমন এক আলো বিচ্ছুরিত করল যা ভারতীয় ছবিতে আগে কখনও দেখা
যায় নি। তাঁর ছবিতে কোনও সময়ে ঠিক ইওরোপীয় রচনা বা কম্পোজিশনের আদর্শ
ফুটে ওঠে না। তার পরিবর্তে বরং আমরা পাই এক ধরনের আকারের পাশে আকার দিয়ে
সজ্জারূপ,যে-আকারগুলি পরস্পরের পারম্পর্যে আনে স্থাপত্যের আকৃতিগত সারল্য ও ঋজুতা।
এই ধরনের স্থাপত্যগত সারল্য ও ঋজুতা আমরা বিশেষ করে পাই তাঁর নরনারীর পূর্ণ
আকারের মুখগুলিতে যাদের প্রায় সূত্র বলা যায়[য], যাদের কঠিন হাড়ালো প্রতিচ্ছবিতে
প্রায় এসিরিয়ান ভাস্কর্যের এবং পরবর্তী কালের মোজেইকের কাঠিন্য পাই।’
[ উৎসনির্দেশ : ‘বিশ শতকের ভারতীয় চিত্রকলা ও রবীন্দ্রনাথ’/ অশোক মিত্র /‘দেশ’ সাপ্তাহিক পত্রিকা]
স্টেলা ক্রাম্রীশ ও অশোক মিত্র-র লেখা দু’টি একে অপরের পরিপূরক। একজন চিত্রকরকে নানাবিধ কারিগরি বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়, সেইসঙ্গে জড়িয়ে থাকে তাঁর নিজের সীমাবদ্ধতার দিক; এরই মধ্য দিয়ে তাঁর নিজের পথ, ভাবতে-ভাবতে এবং কাজ করতে-করতে, আপনিই বেরিয়ে আসে। শিল্পসৃষ্টির অন্যান্য প্রশাখায় যেমন, ঠিক তেমনই চিত্রকলাতে, রবীন্দ্রনাথ নিজেই ছিলেন নিজের ইস্কুলকলেজ।
ছবি আঁকার সময়ে, সাদা কাগজকে চিত্রপটে রূপান্তরিত করার সময়ে নিজের কাজের সঙ্গে তিনি কিভাবে সম্পর্ক স্থাপন করতেন তার কিছু দৃষ্টান্ত প্রত্যক্ষদর্শী রানী চন্দ-র ‘আলাপচারি রবীন্দ্রনাথ’-এ আমরা পাই, সেগুলির সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠ পরিচয় আছে। অন্য একজন প্রত্যক্ষদর্শী, বিষ্ণু দে-র ধারাবিবরণী আমরা এখানে তুলে ধরলাম:
‘ এ এক আশ্চর্য নির্ভীক বিশ্ব, এক প্রবল ব্যক্তিস্বরূপের নিবিড় ঐশ্বর্যে বিস্ময়কর ও বিস্মিত জগৎ। এ জগতে বস্তুর প্রকাশ বহুরূপে অন্তহীন, কখনো-বা বস্তুর সুকুমার পেলব প্রায় মেয়েলি লালিত্য, কখনো-বা সরল বস্তু, সন্ত্রাসের বা দুঃস্বপ্নের বিশ্বের বস্তু বা সূক্ষ্ম কল্পলীন বস্তু। মনের এ-চিত্রলোকে নানা মেজাজ, গতির ও স্তব্ধতার আনন্দের ভাব, তীব্র অভীপ্সা, কঠিন উপহাস, তীক্ষ্ণ ঠাট্টা, স্নিগ্ধ মমতা। এবং হাত প্রায় সর্বদা হাত অভ্রান্ত টানে নিশ্চিত। বেগবান রেখার সৌন্দর্য যেমন দুঃসাহসিক তেমনই অনিবার্য, যদিচ প্রেরণা অনেক সময়ে পরীক্ষামূলক, এমন কি স্থির পাহাড়ের বা শান্ত মুনি মূর্তির ছবিতেও মনে হয় প্রচণ্ড বেগ যেন তলে তলে প্রচ্ছন্ন রয়েছে ।এবং অধিকাংশ ছবিতে রঙের ব্যবহার যেমন ব্যঞ্জনাময় তেমনই নব নব উন্মেষশালী। রবীন্দ্রনাথের অস্থির কলম, তুলি বা আঙুল প্রয়োগ করতেন সমান ও পূর্ণ স্বাধীনতায়, নানা কালিতে ও নানা জাতের রঙে। মনে আছে একদিন তিনি গল্প করতে-করতে ছবি আঁকছিলেন, চেয়ারটিতে তিনি এবং বাইরের লোকটি সিল্ক-ঢাকা বিছানায় সঙ্কুচিতভাবে বসে। রঙ ফুরিয়ে গেল, কিন্তু ছবির তাগিদ নয়; চামড়ার কাজের এক শিশি রঙ এনে ছবির কাজ শেষ করলেন । দরকার হলে ফুল চটকে তিনি ছবির রঙে ব্যবহার করেছেন।’
[উৎসনির্দেশ:‘চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথ’ বিষ্ণুদে/‘কৌরব’ আশ্বিন ১৩৮৬(সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ১৯৭৯)]
ǁ ৬ ǁ
ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে অগণিত অমীমাংসিত প্রশ্ন রয়ে গেছে, যেগুলির অন্তত কয়েকটি ঘিরে পণ্ডিতেরা বিস্তর কলহ ক’রেও কোনও সমাধানসূত্রে উপনীত হতে পারলেন না। ঘোষিত প্রশ্নের পিছনে আরও কিছু প্রশ্ন আছে, যেগুলি স্পষ্টভাষায় উচ্চারিতই হয় নি। একটি প্রশ্ন এইরকম : ভারতীয় ভাস্কর্য ও স্থাপত্যের প্রতিতুলনায় ভারতীয় চিত্রকলার নিম্নমানের কোনও সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। এক যুগ থেকে অন্য যুগে, যুগ যুগ ধ’রে, প্রায় অবিচ্ছন্নভাবে, যে উপমহাদেশের নাম-হারা ভাস্কর ও স্থপতিগণ সারা উপমহাদেশের ভূখণ্ড জুড়ে তাঁদের মহত্ত্বের পরিচয় রেখে গেলেন সেই উপমহাদেশেরই চিত্রকরগণ কার্যত হাত গুটিয়ে ব’সে রইলেন, এমনটি ঘটল কেন? Jan Vermeer-এর (১৬৩২-৭৫) ‘Maidservant pouring milk’ ছবিটি যখন দেখি, তখন কেবল হলুদ জামা-পরা মেয়েটিকেই দেখি না, দেখি সে এক মনে একটি জগ থেকে আরেক পাত্রে দুধ ঢালছে, তার পিছনে দেওয়ালে গাঁথা ছোট ছোট পেরেকগুলিও দেখি। ভাবি, শ্রীরাধার দর্শনলাভ করলাম।ভর্মীয়র-এর আঁকা পরিচারিকার ছবি পাশে এক গা গয়না-পরা কিষেণগড়ের রাধাকে স্থাপন করতে আমরা অক্ষম।
চিত্র : ৭
চিত্র : ৭
ইয়ং ভ়রমীর(১৬৩২-১৬৭৫) ‘পরিচারিকা’, তৈলচিত্র, ১৬৫৮(?)
চিত্র : ৮
চিত্র : ৮
‘রাধা’ কিষণগড় শৈলী, ১৭৬০(?) কাগজের উপর অস্বচ্ছ জলরঙ(গুয়াশ্)। চিত্রশিল্পী নিহলচন্দ্(?)
সারা ভারতের দেবস্থান, সংগ্রহশালা, ধনবানদের গৃহ ঘুরে-ঘুরে মাথা খুঁড়লেও Francesco Guardi–র(১৭১২-৯৩) ‘Capriccio with arch in decay and villa in the background’, Joseph Turner-এর(১৭৭৫-১৮৫১)‘The Slave Ship’ অথবা Theodore Gericault-এর (১৭৯১-১৮২৪) ‘The Raft of “The Medusa” ’-র তুল্য কোনও চিত্র খুঁজে পাওয়া যাবে না। অথচ, আশ্চর্য হই এই ভেবে যে, আমরাই আবার যখন লাহোর-এর কেন্দ্রীয় সংগ্রহালয়ে রক্ষিত ‘অনশনরত বুদ্ধ’-র আলোকচিত্র দেখি, অথবা দিল্লীতে হুমায়ুনের সমাধিস্থল, পাটনা সংগ্রহশালার ‘দিদারগঞ্জ–এর যক্ষীমূর্তি, তাঞ্জাভুর-এর রাজরাজেশ্বর মন্দির অথবা যখন মহারাষ্ট্র-র খুল্দাবাদ-এ ঔরঙ্গজেব-এর নিরাভরণ গোরস্থানের সামনে এসে দাঁড়াই, তখন বুঝি যে, পবিত্রভূমিতে আমরা দণ্ডায়মান; রোদে পুড়ে জলে ভিজে যাঁরা জড়পদার্থে এমন প্রাণসঞ্চার করেছিলেন, তাঁরা যে আমাদেরই পূর্বজ, এই কথা ভেবে এক অবর্ণনীয় গৌরববোধে আমাদের শরীর নিথর হয়ে আসে। অপ্রিয় সত্য বাক্যটি এই; অজন্তার চৈত্যগৃহ ও বিহার মিলে ২৯ টি (মতান্তরে ৩০টি) গুহার মিউরালচিত্রগুলি এক পাশে সরিয়ে রাখলে, চিত্রকলার আন্তর্জাতিক পরম্পরায় আমরা একটি দরিদ্র জাতি।
অজন্তা গুহামালার ৩০ টি গুহার মধ্যে মাত্র দু’টি(২৯ ও ৩০ নং)অন্যদের থেকে সামান্য বিচ্ছিন্ন, বাকি ২৮ টি গুহা পর পর এক সুবিশাল অর্ধচন্দ্রের আকারে বিন্যস্ত। বলা বাহুল্য, এ-বিন্যাস কৃত্রিম নয়, ওয়াগোরা নদীর বঙ্কিম গতিপথ ও তার কোল ঘেঁষে উঠে-যাওয়া পাথুরে টিলার প্রাকৃতিক বিন্যাসে মিশে রয়েছে। প্রতিটি গুহাকে পৃথক নম্বর দেওয়ার প্রথাটি অর্বাচীন, এবং তা মিউরালচিত্রের বয়স নয়, গুহার অবস্থানের উপর নির্ভরশীল। আমরা অনুমান করি, অন্তত দু’টি পৃথক কালপর্বে প্রকল্পটি রূপায়িত হয়েছিল; প্রাচীনতম (১০ নং, অনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতক) এবং নবীনতম (১ নং, অনুমানিক ৫ম খ্রিস্টীয় শতকের শেষভাগ) গুহার মধ্যকার ব্যবধান সাত শতাব্দী। বস্তুত,অজন্তা গুহামালাতেই ভারতীয় চিত্রকলার বিবর্তনের পরিচয় পাওয়া যায়। কেবল সময়সীমা ও কাজের বিস্তৃতির (scale of operations) দিক থেকে অজন্তা গুহামালাকে এক মাইলফলক-প্রকল্প মনে হলেও, অজন্তা-পূর্ববর্তী ধর্মস্থানগুলির প্রতিতুলনায় তার ব্যবধান আরও বিস্ময়কর। আমাদের মনে রেখেছি যে, জৈনধর্মের আদি যুগে যেমন, অনেকটা তেমনই, বৌদ্ধধর্মের আদিযুগে, বিশেষত হীনযান বৌদ্ধধর্মে, শাক্যমুনি বুদ্ধের মূর্তি সর্বত্র অনুপস্থিত। প্রতীকের দ্বারা বুদ্ধদেবের প্রকাশ বোঝানোর প্রয়াস নিজেই উচ্চমানের শৈল্পিক সঙ্কেত, যেমন সিদ্ধার্থের মহানিষ্ক্রমণের প্রতীক আরোহীহীন অশ্ব এবং পরিনির্বাণের প্রতীক চিরকালীন ‘দেহ’ অর্থাৎ স্তূপ। কিন্তু না-বলা বাণীরও কিছু নিজস্ব সীমাবদ্ধতা আছে। এদিক থেকেও অজন্তা প্রধান এক প্রস্থানবিন্দু। শৈলীকে শিল্পকর্মের ভিতরে লুকিয়ে রাখার শৈলী আয়ত্ত করার ক্ষেত্রেও অজন্তা–র ভূমিকা বৈপ্লবিক। সরলতম স্তরে, ছবিগুলি শিক্ষামূলক গল্পের চিত্ররূপ এবং ঠিক সেই কারণেই, শিল্পীর দৃষ্টিকোণ থেকে মরণফাঁদ। সন্ন্যাসী-শিল্পী ও তাঁদের সহযোগীরা কীভাবে সমাধান খুঁজে বার করলেন তা বিস্ময়কর। ছবির জমি এমনভাবে ভাগ ক’রে নেওয়া হল যে, দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে যাওয়ার বিরতিগুলি সুকৌশলে গোপন হল, বিভাজনরেখাগুলি যেন থেকেও নেই। গল্প ভুলে যিনি অবাক চোখে দাঁড়িয়ে রইলেন, অজন্তা তাঁর কাছে নিশ্চল, রাজার শোভাযাত্রায় যিনি যোগদান করতে আগ্রহী, তিনি হেঁটে চললেন, অজন্তা তাঁর কাছে চলমান। শিল্পভাবনার যে উৎকর্ষের উল্লেখ আমরা করলাম তা রূপায়ণের জন্য শৈলী ও কারিগরি দক্ষতার যে স্তরে পৌঁছনো আবশ্যিক, তা গ’ড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন হয় সময়ের, পরম্পরার; অজন্তায় পৌঁছতে ভারতবর্ষ সুদীর্ঘ সময় নিয়েছে। সময় উপযুক্ত না হলে — রূপভেদ, সাদৃশ্য, প্রমাণ, ভাবযোজনা, লাবণ্যযোজনা, বর্ণিকাভঙ্গ — কে ধারণ করবে এই দুরূহ সূত্রাবলী? ১০ নং গুহার ‘অবলোকিতেশ্বর পদ্মপাণি’ অথবা ১৬ নং গুহার ‘রোগজীর্ণ রাজকুমারী’-র সামনে এসে দাঁড়ালে আমরা অনুভব করি, ওই স্তরের নীরব বাঙময়তা ভারতীয় উপমহাদেশের চিত্রকলায় আর ফিরে আসে নি কোনওদিন।
এরপর, ভারতীয় চিত্রকলার আকাশে, শতাব্দীর পর শতাব্দী, ঘন তমসা নেমে আসে। কেবল লিপিশিল্পীরা কোনওরকমে বেঁচে রইলেন, তালপাতার পুথির নকলগুলি কোনও রকমে নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেল। এত উন্নতমানের, দীর্ঘজীবী পরম্পরা কীভাবে এক-দেড় শতাব্দীর মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল তার বহুবিধ কারণ থাকা সঙ্গত, কিন্তু মূল কারণ, হয়তো, ভারতবর্ষ থেকে বৌদ্ধধর্মের উচ্ছেদ। অনেকে মনে করেন চিত্রপটগুলির অবলুপ্তির মূল কারণ, এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশে ও আবহাওয়া; এ-দেশে চিত্রপট টেকে না, কেবল পাথরে রিলিফের কাজই স্থায়ী। অনেক দূর পর্যন্ত মেনে নিয়েও প্রস্তাবটি শেষাবধি স্বীকার ক’রে নিতে আমরা পারি নি কারণ, চিত্রপটের নাশ আর পরম্পরার নাশ, দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী প্রক্রিয়া। পরম্পরা গ’ড়ে উঠতে প্রয়োজন হতে পারে এক সহস্রাব্দ, তাকে হারাবার জন্য এক শতাব্দীই যথেষ্ট। ছবি আঁকতে শুরু করার পূর্বে শিল্পী ও কারিগররা কীভাবে কাদামাটি, গোবর চুনের প্লাস্টার প্রভৃতি দিয়ে ছবির জমি তৈরি ক’রে নিতেন, ভিজে জমির উপরেই রেখাচিত্রের কাজ শুরু করা হত কি না, রঙ প্রস্তুত করা হত কীভাবে, কীভাবে তা প্রয়োগ করা হত, তুলি তৈরি করা হত কীভাবে, কোন্ পিগমেন্ট প্রাকৃতিক আলো শুষে নেয়, কোন্ পিগমেন্ট আলো প্রতিফলিত করে — এই সমস্ত আপাততুচ্ছ খুঁটিনাটির উপর চিত্রবিদ্যার সুবিশাল ইমারত দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেখান থেকে নিয়মিত ভাবে একটি দু’টি ক’রে ইট সরিয়ে নিলে ইমারতের ভেঙে পড়া এক অনিবার্য ঘটনা। ছবি আঁকার নিজস্ব সঙ্কট পেরিয়ে যাবার জন্য নতুন-নতুন পথ উদ্ভাবন করতে হয়, পরম্পরার এটিই মূল চালিকাশক্তি। অজন্তা-পরবর্তী চিত্রশিল্পীরা সেই পরম্পরা ধ’রে রাখতে পারেন নি।
অজন্তার বৌদ্ধবিহার তখনও তার পূর্ণরূপ পায় নি, ঠিক সেই সময়ে, আনুমানিক দ্বিতীয় শতকের শেষার্ধ থেকে, পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে, আদিযুগের খ্রিস্টানরা রোম-এর কলোসিয়ম-এ শহীদের মৃত্যুবরণ করছেন। ভূগর্ভস্থ গোরস্থানে তাঁদের সমাধিস্থ করা হচ্ছে এবং সেখানকার ফাঁকা দেওয়াল ক্রমে ভ’রে উঠছে মিউরালচিত্রে; catacomb–এর দীপশিখার আলোয়, এমনই এক গভীর, অটল প্রত্যয়ের পরিবেশে খ্রিস্টান চিত্রকলার জন্ম। অজন্তার ১০ নং গুহার ‘অবলোকিতেশ্বর পদ্মপাণি’-তে যেমন ভারতীয় চিত্রকলার পতনের পূর্বাভাষ নেই, ঠিক তেমনই The Catacomb of San Giordani-এ ‘Christ as The Good Shepherd’ দেখে অনুমান করা অসম্ভব যে, সেই ধারা এক হাজার সাতশো বছর ধ’রে বহু পথ ঘুরে অবশেষে বিংশ শতাব্দীতে এসে Georges Rouault-এর (১৮৭১-১৯৫৮) ‘Ecco Homo’-তে পৌঁছে সমাপ্ত হবে। ভারতীর এবং প্রতীচ্যের চিত্রকলা আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে, উত্থান নিয়ে বেঁচে থাকতে আমাদের ভাল লাগলেও, পতনের মাঝে বেঁচে থাকার শিক্ষাও আয়ত্ত করা প্রয়োজন।
আমরা জানি, প্রায় এক হাজার বছর শূন্যতার পর, পুনরুত্থানের দু’টি ধারার কল্যাণে ভারতবর্ষে শিল্পচর্চার নিম্নগতি অবশেষে রুদ্ধ হয়েছিল। এক, আজকের রাজস্থান, মালবা, মধ্য ভারত, উত্তরাঞ্চল, অন্ধ্রপ্রদেশ, জম্মু-কাশ্মীর-এর বিভিন্ন ছোট-ছোট রাজ্যে চিত্রকলার পুনরুত্থান এবং, দুই, সম্রাট হুমায়ুন (১৫০৮-১৫৫৬) ও সম্রাট আকবর(১৫৪২-১৬০৫)-এর হস্তক্ষেপে পারস্য থেকে অনুচিত্রীদের প্রশিক্ষকরূপে আগমন। চিত্রবিদ্যার পুনরুদ্ধারের সুচিহ্ন ভারতবর্ষে আবার দেখা গেলেও আমাদের মনে রাখতে হবে যে, একটি জাতির কৃষ্টির ইতিহাস থেকে এক হাজার বছর মুছে গেলে, সেই ফাঁক কোনওদিন পূরণ হবার নয়। প্রতীচ্যের চিত্রকলার ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য। ইংল্যান্ড, য়ুরোপ, এবং পরবর্তীকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোর চিত্র ও মিউরালশিল্পীরা, সেই দ্বিতীয় শতক থেকে, অক্লান্ত পরিশ্রম ক’রে যে সুবিশাল পরম্পরা গ’ড়ে তুলেছেন, তা যদি একবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছে আজকের চিত্রীদের ফ্যাশনপ্রীতি ও ইন্সটলেশন আর্ট প্রভৃতি বুদ্ধির ব্যায়ামের কাছে পরাস্ত হয়, তবে তাঁদের জন্যও আমাদের তুল্য দশা অপেক্ষা করছে। ভারতীয় উপমহাদেশ ও য়ুরোপ-এর চিত্রকলার তুলনামূলক বিচার বর্তমান আলোচনার বিষয় নয়, আমরা কেবল প্রতীচ্যের এক স্বল্পায়ু প্রবর্তক Massaccio(১৪০১-১৪২৮) কাজ থেকে পরম্পরা গঠনে নতুন ভাবনা ও নতুন কর্মকুশলতার ভূমিকাটি বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করব।
ছবির ভাষার ক্রমোন্নতির নতুন-নতুন পদ্ধতি পরীক্ষা করার পদ্ধতিটি পশ্চিমেও সুপ্রাচীন, যেমন linear perspective এবং continuous representation-র (একই পটে বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনার চিত্ররূপ) প্রয়োগ ষষ্ঠ শতাব্দীতেও দেখা যায়, কিন্তু মাসাক্চ্চো-ই প্রথম ব্যক্তি যিনি দ্বিমাত্রিক চিত্রপটে ত্রিমাত্রিক মায়া(illusion)সৃষ্টি করার জন্য বিজ্ঞানের নিয়মগুলি সচেতন ভাবে ব্যবহার করেছিলেন। তিনি কেবল কিয়ারস্কুরো-র (chiaroscuro) প্রবর্তকই নন, foreshortening-র ( সামনের বস্তুকে পিছনের বস্তুর তুলনায় বড় ক’রে আঁকা) সচেতন প্রয়োগও তাঁর কাজেই প্রথম দেখা যায়। পরবর্তীকালে, Michelangelo Buonarotti (১৪৭৫-১৮৪৩) ও Rembrandt van Rijn-এর (১৬০৬-১৬৬৯) কাজে যথাক্রমে ফর্শর্টেনিং ও কিয়ারস্কুরো-র অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন গুলি আমরা দেখি। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি (১৪৫২-১৫১৯), মিশেলঅ্যাঞ্জেলো বুয়োনারত্তি (১৪৭৫-১৮৪৩), রাফায়েল (১৪৮৩-১৫২০) প্রভৃতি সকলেই মাসাক্চ্চো-কে গুরু মানতেন, চ’লে আসতেন ফ্লরেন্স-এর Santa Maria del Carmine-এর গির্জায়, যেখানে তাঁর ফ্রেস্কো আজও আছে, এবং সেগুলি দেখে-দেখে তাঁরা চিত্রাঙ্কন অভ্যাস করতেন।
গুরুশিষ্য পরম্পরার এই দেশেও, চিত্রশিল্পীদের মধ্যে ধারাবাহিক ভাবে শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণের সেই বিনি সুতোর মালা দেখার সৌভাগ্য আমাদের হল না; অকালে ম’রে-যাওয়া কোনও মাসাক্চ্চো আমাদের দেশে জন্মগ্রহণ করলেন না! আমরা এই সহজ কথাটি বুঝতে পারলাম না যে, একজন Caravaggio-র (১৫৭৩-১৬১০) ‘ The Entombment of Christ’ –এর পিছনে একটি সমগ্র জাতির অধ্যবসায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। শিল্প–ঐতিহ্য অতিসূক্ষ্ম এক সম্পদ, যে ভাবনার গভীরতার উপর সে সদানির্ভরশীল, যে অনুবর্তন ও বিদ্রোহের সংমিশ্রণে সে নিজেকে সজীব রাখে, তা ছেদজীর্ণ হলে, শিল্পীরা পরাধীন হয়ে পড়লে, পৃষ্ঠপোষকরা খামখেয়ালী ও দায়িত্বজ্ঞানহীন হলে, পরম্পরার বিনাশ অনিবার্য। আমাদের দেশে সমস্ত সুচিহ্নগুলি, এই কারণেই, শেষ পর্যন্ত, সুচিহ্নই রয়ে গেল। অবক্ষয় রোধের প্রসঙ্গে কিছুক্ষণ পূর্বে আমরা হুমায়ুন ও আকবর-এর সশ্রদ্ধ উল্লেখ করেছিলাম; হুমায়ুন পারস্য থেকে প্রশিক্ষক আনিয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে দু’জন, খয়াজা অবদ্ উস্-সামাদ এবং মীর সৈয়দ আলি-র অবদান অনস্বীকার্য। আকবর-এর দৃষ্টান্ত আরও বিস্ময়কর, তিনি লক্ষ করলেন, তাঁর অগণিত পালকিবেহারার মধ্যে একজনের বালকপুত্র যেখানেই যায়, খশ্ খশ্ ক’রে ছবি আঁকে; এই বালকটিই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে পরবর্তীকালে তাঁর সভার অন্যতম প্রধান চিত্রকর দস্বন্ত হয়ে ওঠেন। বিভিন্ন ‘কারখানা’য় কর্মরত অসংখ্য দক্ষ শিল্পী ও কারিগরদের নাম ভেসে ওঠে — বসাবন, আবুল হাসান, উস্তাদ মনসুর, মনোহর, গোবর্ধন, দৌলত এবং একমাত্র নারী-শিল্পী সহিফা বানু ; অগণিত অনুচিত্র আমাদের নিদ্রাহরণ করে, ‘Akbar brings the elephant Hawai under control’ (১৫৯২?), ‘The Devotee offering his daughter to the clouds in marriage’ (১৫৭৫?) ‘The Dying Enayat Khan’(১৬১৮?), ‘ Abuben Adam attended by the Angels’(১৭৮৭?), ‘Yoginis’(?) প্রভৃতি কিন্তু, হায়, Caravaggio-র ‘The Entombment of Christ’ অথবা Rembrandt –এর ‘Jeremiah Lamenting The Destruction of Jerusalem’–এর স্তর আমরা ছুঁতে পারলাম না! মহতের দ্বারপ্রান্তে এসেও আমাদের দেশের চিত্রশিল্পীরা খালি হাতে ফিরে গেলেন।
বহুবর্ণ ছবির, তৈলচিত্র অথবা জলরঙ ভিতরে যে রেখাচিত্র (ড্রয়িং) লীন হয়ে রয়েছে তার সবলতার উপরেই চিত্রশিল্পীর কাজের মান নির্ভর করছে; তাঁর দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাসের একটি পরিচয় আমরা এখান থেকে পেয়ে যাই। এইদিক থেকে বিচার করলে মসৃণ বয়ন (fine texture) এবং অমসৃণ বয়ন (rough texture), উভয় ক্ষেত্রেই ভারতীয় ও পাশ্চাত্যের চিত্রশিল্পীদের মধ্যে দক্ষতার কোনও তারতম্য নেই। আমাদের প্রস্তাবের সমর্থনে পাঠকদের বিচারের জন্য আমরা চারটি নমুনা প্রস্তুত করেছি, দু’টি পাশ্চাত্যের এবং দু’টি ভারতবর্ষের।
চিত্র : ৯
চিত্র : ৯
অমসৃণ বয়নের দৃষ্টান্ত(ভারত)
আনন্দ কুমারাস্বামী-র প্রতিকৃতি, রেখাচিত্র । শিল্পী গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
চিত্র : ১০
চিত্র : ১০
অমসৃণ বয়নের দৃষ্টান্ত(বিদেশ)
‘মড়া ও ডাক্তার’, রেখাচিত্র। শিল্পী অনোরে ডমিয়ে
চিত্র : ১১
চিত্র : ১১
মসৃণ বয়নের দৃষ্টান্ত(ভারত)
স্টাডি (অসম্পূর্ণ), রেখাচিত্র। শিল্পী অজ্ঞাত , নাথওয়াড়া শৈলী ।
চিত্র : ১২
চিত্র : ১২
মসৃণ বয়নের দৃষ্টান্ত(বিদেশ)
‘সাবস্টন্স অ্যান্ড শ্যাডো’, রেখাচিত্র। শিল্পী জন লীচ।
গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর আঁকা প্রতিকৃতি ও নাথওয়াড়া শৈলীর শিল্পীর আঁকা স্টাডিতে রেখাঙ্কনের যে দক্ষতার পরিচয় আমরা পাই তা অন্য দু’টি নমুনার চেয়ে কোনও অংশে ন্যূন নয়, এবং এইরকম আরও বহু দৃষ্টান্ত অনায়াসে তুলে ধরা যায়। দমিয়ে-র ড্রয়িংটি একটি দক্ষ কাজের চেয়ে কিছু বেশি; আমাদের দেশের প্রাচীনকালের রসবেত্তাদের দ্বারা নির্মিত অভিধা ব্যবহার ক’রে বলা যেতে পারে দমিয়ে ‘অলৌকিক’, ‘লোকোত্তর’। জন লীচ একজন স্বল্পখ্যাত চিত্রকর হলেও, আজ, তিনি কার্টুনশিল্পের পথিকৃৎরূপে নন্দিত। এক অর্থে তাঁর কাজটি দমিয়ে-র কাজের মতোই বিস্ময়কর কারণ, কেবল সমান্তরাল রেখার ভিন্ন-ভিন্ন, কখনও-কখনও পরস্পরবিরোধী বিন্যাসের দ্বারা তিনি সামাজিক অসাম্যের বাস্তব তুলে ধরতে পেরেছেন, যা বস্তুত, দমিয়ে-র সমগ্র শিল্পকর্মের মূল বার্তা।
ǁ ৭ ǁ
পাশ্চাত্য চিত্রকলা বিষয়ে আমাদের যুগপৎ দীর্ঘ ও অসম্পূর্ণ আলোচনায় জড়িয়ে পড়ার মূল কারণ আমরা ইতিপূর্বে ব্যক্ত করেছি। আমরা তিনটি ঘটনা মনোযোগ সহকারে বোঝার চেষ্টা করেছি; এক,অজন্তা-পরবর্তী ভারতবর্ষে চিত্রকলা চর্চা শূন্যে এসে ঠেকেছিল; দুই, তার কয়েক শতাব্দী পূর্বে পাশ্চাত্য চিত্রকলার উত্থান শুরু, এবং তিন, ভারতের ও পশ্চিমের চিত্রকলার মধ্যকার ফাঁক আর কোনওদিন ভ’রে উঠতে পারে নি। প্রশ্ন উঠতে পারে, এই আলোচনার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ-এর আঁকা ছবির য়ুরোপ-এ প্রতিষ্ঠালাভের প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ সম্পর্ক আছে কী?
এই সম্পর্কটি অনুভব করবার জন্য আমাদের ১৯৩০-এর য়ুরোপ-এর শিল্পমোদীদের মন বোঝার চেষ্টা করতে হবে। প্রথম কথা হচ্ছে, জেম্স ফর্গুসন্ প্রমুখের গবেষণাগ্রন্থের কল্যাণে প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশর ভাস্কর্য, স্থাপত্য ও চিত্রকলা বিষয়ে পশ্চিমের শিল্পমোদীদের সম্যক ধারণা তৈরি হয়েছিল। মুঘলযুগের অনুচিত্রের বহু নিদর্শন ছাড়াও কাঙ্গড়া, বাশোলী, বুঁদি, জয়পুর, মেওয়াড় প্রভৃতি বিভিন্ন ঘরানার নিদর্শন ছড়িয়ে ছিল ব্রিটেন, য়ুরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-র বিভিন্ন জাদুঘরে এবং ব্যক্তিগত সংগ্রহে , ফলত, সঙ্গত কারণেই রবীন্দ্রচিত্রকলা প্রথম দেখে তাঁরা আশ্চর্য হয়ে লাফিয়ে উঠলেন, এক লহমায় বুঝে ফেললেন, এই ছবি পুবে অথবা পশ্চিমে এর আগে কোথাও দেখা যায় নি, এখান থেকেই ভারতীয় চিত্রকলার নতুন পথ খোঁজা শুরু হল, রবীন্দ্রনাথ-ই প্রথম, অকৃত্রিম ‘প্রিমিটিভ্’! ভারতীয় শিল্প-বিষয়ে তাঁরা যদি অজ্ঞ হতেন তা হলে রবীন্দ্রনাথ যে স্থান অধিকার ক’রে নিয়েছিলেন তা অনায়াসে রাজা রবি বর্মা অথবা বেঙ্গল স্কুলেরও অধিকারে আসতে পারত। দ্বিতীয় প্রসঙ্গ, রবীন্দ্রনাথ-এর ‘প্রিমিটিভিজ়ম’-এর অকৃত্রিমতা । ছবির জগতে রবীন্দ্রনাথ-এর প্রবেশের অনেক আগেই য়ুরোপ-এ আভাঁ-গার্ড শিল্পীরা ‘প্রিমিটিভ্ আর্ট’-কে নিজেদের নতুন পথ খোঁজার কাজে ব্যবহার করছিলেন, এঁদের মধ্যে অন্যতম প্রধান শিল্পী পাবলো পিকাসো (১৮৮১-১৯৭৩)। তাঁর প্রখ্যাত কাজ ‘লে ড্যামোসেল দ’ভিগ্নঁ’-এ(১৯০৭) পাঁচটি কিউবিস্ট-প্রতিম টর্সো এঁকে তাদের মধ্য থেকে তিনটি বেছে নিয়ে তাদের উপর ঠকাস্-ঠকাস্ শব্দে আদিম আফ্রিকা-র তিনখানা মুখোস বসিয়ে বুদ্ধির খেলায় সকলের মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। এর প্রতিতুলনায় রবীন্দ্রনাথ-এর ‘প্রিমিটিভিজ়ম’ (এই অভিধা তাঁকে খুশি করত না ব’লেই আশঙ্কা হয়!) এক প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, ককেশিয়ান দেহে নিগ্রয়ড্ মুখোশ বসিয়ে দেবার অভিনব প্রকল্পে তিনি জড়িয়ে পড়েন নি। তাঁর চিত্রকলার সঙ্গে যদি কোনও মিল কোথাও থাকে তা হলে তা এক অন্য প্রকৃত ‘প্রিমিটিভ্’ শিল্পী Henri Rousseau-র (১৮৪৪-১৯১০) কাজে আমাদের খুঁজতে নিতে হবে। আপাতদৃষ্টিতে তাঁর ও অঁরি রুসো-র কাজে কোনও মিল নেই; রবীন্দ্রনাথ-এর ছবিতে তাড়নার বেগ যে অধৈর্যের আবহ সৃষ্টি করেছে তা রুসো-তে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত, রুসো এক নিখুঁত কারিগর। বাস্তব জগতের আনন্দবিষাদের সঙ্গে রুসো-র কোনও সংস্রব নেই, তিনি জেগে-জেগে স্বপ্ন দেখেন চন্দ্রালোকে ভাসমান এক গভীর অরণ্যের, যেখানে দীর্ঘ কেশবতী, কৃষ্ণাঙ্গ এক নগ্নিকা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে বাঁশি বাজিয়ে অরণ্যের সাপেদের মোহিত করছেন। অবনীন্দ্রনাথ যেভাবে ভাবতে শিখিয়েছেন আমরা সেভাবেই ভাবি, সাদৃশ্য সেখানে, যেখানে একজনের ভাবনা অপরে ভাবছে। সারা বিশ্ব ঘুরে আমরা এই একজনই সঙ্গী খুঁজে পেলাম চিত্রকর রবীন্দ্রনাথের, শুল্ক বিভাগের জনৈক প্রাক্তন কর্মচারী, অঁরি রুসো!
চিত্র : ১৩
চিত্র : ১৩
অঁরি রুসো (১৮৪৪-১৯১০)। ‘দ্য স্নেক চার্মর’ (১৯০৭)।
রবীন্দ্রনাথের পছন্দ হোক আর না-ই হোক, তাঁর নামের সামনে ‘আদিম’ বিশেষণটি, সেই ১৯৩০ সালেই, প্রথম জুড়ে দিয়েছিলেন স্বয়ং আনন্দ কুমারাস্বামী। আমেরিকার বস্টন–এ মিউজ়িয়ম অফ্ ফাইন আর্টস-এর কর্তাব্যক্তি থাকাকালীন তিনিই রবীন্দ্রনাথের ছবির প্রদর্শনীর বন্দোবস্ত করেছিলেন। সেই প্রদর্শনী উপলক্ষে একটি ক্যাটালগ প্রকাশিত হয়েছিল যেখানে কুমারাস্বামী এই প্রস্তাবটি রাখেন, এবং আমাদের মনে হয়, এত বছর পরে, আজও, রবীন্দ্রচিত্রকলার ভাবের বিশ্লেষণে অন্য কেউ-ই এতটা অন্তর্দৃষ্টি ও গভীরতার পরিচয় রেখে যেতে পারেন নি। রচনাটির শেষে তিনিও এক জায়গায় হোঁচট খেয়েছেন, বলেছেন যে, অন্য কোনও মাধ্যম নয় রবীন্দ্রচিত্রকলা ও রবীন্দ্রগানের মধ্যে একটি সম্পর্ক আছে। আমরা বুঝতে পারি বাঙলাভাষার উপর তাঁর সীমিত অধিকার এই বিভ্রান্তির জন্য দায়ী, ভাষার উপর পূর্ণ অধিকার থাকলে তিনি অতিসহজেই ধ’রে ফেলতেন যে,‘রক্তকরবী’র অন্ধকার জগতের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ছবির সম্পর্কটি অনেক বেশি গাঢ় :
‘An exhibition of drawings by Rabindranath Tagore is of particular interest because it puts before us , almost for the first time , genuine examples of modern primitive art. One may well wonder how those artists and critics who have so long striven for and praised the more calculated primitivism, archaism and pseudo-barbarisms of European origin will respond ; will they admire the real thing?…
… It would be a great mistake to search in them for hidden spiritual symbolism ; they are not meant to be deciphered like puzzles or code messages. Nor do they bear any definite relation to the contemporary Bengali school of painting led by his nephews Abanindranath and Gogonendranath Tagore, or to the contemporary movement elsewhere. It is obvious that the poet must have looked at many pictures in the course of his long life; but there is nothing in his own work to show that he has seen them. This is a genuinely original , genuinely naive expression ; extraordinary evidence of eternal youth persistent in a hoary and venerable personage .
Childlike,but not childish. It is perfectly legitimate to be amused by, to laugh at, or with some of these creations, as one is amused by a child’s visions of the world; it is not legitimate to ridicule them. From a few examples, one might gather that the artist “knows how to draw”; but this is not a consistent quality, and it would be as much beside the mark to praise this apparent knowledge when it appears, as to criticise the work as a whole as that of a man who does not know how to draw. In these days we have become familiar with the cult of incompetence, and have professed to admire the work of countless artists who do not know how to draw, and in addition have voiced sufficiently loudly their contempt of training. Rabindranath, on the other hand, has no contempt for training or virtuosity, he simply does not possess it, and knowing this he puts before us in all simplicity, certainly not cynically, the creation of his playful vision, for us to use as we will. There is, indeed, one quality in respect of which these pictures may be called at once typically Indian, and adult, in spite of their naiveté; this quality finds expression in satisfying composition, clear cut rhythms, and definition of forms. …
…They are not pictures about things, but pictures about himself. In this sense they are probably much nearer to his music than to his poetry .In the poetry, so far at least as the content is concerned, he is not primarily an inventor, but rather the sensitive exponent of a racial or national tradition, and therefore his words are more profoundly sanctioned and more significant than those of any private genius could be, all India speaks and understands the same language. The poetry reveals nothing of the poet’s personality, though it establishes his status. But the painting is an intimacy comparable to the publication of private correspondence. What a varied and colourful person is revealed! … The manner is as varied as the theme , and this despite the fact that all the pictures are done with a pen, usually the back of a fountain pen, and coloured inks or tints ; any method is employed that may be available or that may suggest itself at the moment. The artist, like a child, invents his own technique as he goes along, nothing has been allowed to interfere with zest. The means are always adequate to the end in view ; this end is not “Art” with a capital A, on the one hand ─ nor, on the other a merely pathological expression ; not art intentioned to improve our minds, nor to provide for the artist himself an “escape”; but without ulterior motives , truly innocent ,like the creation of a universe.’
[উৎসনির্দেশ:‘Ananda K. Coomaraswamy /October 20,1930 ; From the catalogue published on the occasion of the exhibition of the drawings and paintings of Rabindranath Tagore held at the Museum of Fine Arts, Boston, USA in October, 1930]
এতক্ষণে আমরা আমাদের দীর্ঘ আলোচনার অন্তিম অংশে এসে পৌঁছেছি। আর একটিই প্রশ্ন এখনও বিবেচনার জন্য প’ড়ে রইল : কে বড়, রঙতুলির রবীন্দ্রনাথ, না কবিতার রবীন্দ্রনাথ? বিংশ শতাব্দীর বিশ্বসাহিত্য গুলে-খাওয়া নবীন কবি আমাদের জানান, লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহৎ, কিন্তু, ওফ্, এতই অতিকথনপ্রেমী তিনি যে তাঁকে প’ড়ে-ওঠা যায় না, তবে হ্যাঁ, অবগাহন করা যায় তাঁর গানের বেদনাবোধে! এ-প্রতিক্রিয়ার ভিন্ন দিকও আছে। ১৯৭৯ সালে বিষ্ণু দে লিখছেন, ‘বহুকাল আগে এক আর্টস্কুল-অধ্যক্ষ বলেন যে রবীন্দ্রনাথ তো একটা দেশলাই বাক্স আঁকতে পারেন না, তাঁকে কী ক’রে চিত্রকর বলা যায়?’ আর্টস্কুল-অধ্যক্ষ এবং নবীন কবি, দুই প্রান্তের দুই বিশেষজ্ঞ এড়িয়ে আমরা যদি সাধারণ বাঙালীর মন নিয়ে প্রশ্নটি বিবেচনা করি তা হলে নিশ্চিত রূপে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, তিনি একাধারে একজন মহৎ লেখক, মহৎ সঙ্গীতজ্ঞ এবং মহৎ চিত্রশিল্পী।
বিশ্ব-সাহিত্যের ইতিহাসে আমাদের রবি ঠাকুর, শেক্সপীয়র, গ্যোয়েটে, উগো, টলস্টয় প্রমুখের সমগোত্রীয়। দান্তে বর্ণিত নরকাগ্নিতে তাঁকে যদি নিক্ষেপ করা হত, তাহলে, সন্দেহ নেই, তিনি মহাকবি হোমর, হরেস, ওভিড–এর সঙ্গে প্রথম বৃত্ত, লিম্বো-য় বিরাজ করতেন। কিন্তু, প্রশ্ন উঠছে, চিত্রকলার জগতে আমরা কি তাঁকে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, মিকেলঅ্যাঞ্জেলো, রাফায়েল, রেম্ব্রান্ট, ভ্যান গগের পাশে স্থান দিতে পারব? প্রশ্নটির উত্তর উহ্য রেখে, আমরা বরং বিশ্বের চিত্রকলার ইতিহাসে তাঁর অবস্থান নির্ণয়ে ফিরে যাই। আমরা দেখাবার চেষ্টা করেছি যে চিত্রকলায় রবীন্দ্রনাথ-এর কোনও পূর্বজ নেই, তিনিই ঐতিহ্যের উদ্ভাবক। একজন উদ্ভাবক, তিনি যতই অতিমানবিক শক্তিসম্পন্ন হোন, তাঁর কাজের পরিণতি তিনি দেখে যেতে পারেন না, রবীন্দ্রনাথও পারেন নি। মিকেলঅ্যাঞ্জেলো-র সঙ্গে তাঁর প্রভেদ এইখানেই, মিকেলঅ্যাঞ্জেলো এক সুদীর্ঘ পরম্পরা নিয়ে দাঁড়িয়ে, সেই পরম্পরাকে তিনি আরও এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এই অর্থে, চিত্রকলার ক্ষেত্রে, মিকেলঅ্যাঞ্জেলো এবং রবীন্দ্রনাথ, দু’জনে দু’টি ভিন্ন পাটাতনে অবস্থান করছেন, একজনকে অপরের সঙ্গে তুলনাই করা চলে না। চিত্রকলার জগতে রবীন্দ্রনাথের স্থান মিকেলঅ্যাঞ্জেলো-র নিচেই থাকবে, এটা যেমন রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে অগৌরবের বিষয় নয়, ঠিক তেমনই মিকেলঅ্যাঞ্জেলো-র পক্ষে শ্লাঘাবোধেরও প্রসঙ্গ নয়।
চিত্রকলার ক্ষেত্রে মিশেলঅ্যাঞ্জেলো প্রসঙ্গে আমরা যা-যা বললাম, সাহিত্যের ক্ষেত্রে ঠিক সেই একই কথাগুলি রবীন্দ্রনাথের পক্ষে প্রযোজ্য। চিত্রকলায় যিনি উদ্ভাবক, কবিতায়, বৈদিক ভাষা থেকে গণনা শুরু করলে, তিনিই কয়েক হাজার বছরব্যাপী ঐতিহ্য মাথায় বয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, নবীন কবি যতই অসহিষ্ণু হয়ে উঠুন, রবীন্দ্রনাথকে তাঁর আসন থেকে টলানো যাবে না। এমন একটা দিন হয়তো আসবে যেদিন তাঁর আঁকা আত্মপ্রতিকৃতিগুলি, এমন কি তাঁর আঁকা নিসর্গচিত্রগুলিও, অনাগত দিনের কোনও ভারতীয় চিত্রশিল্পী পেরিয়ে যাবেন, কিন্তু এমন দিন কখনই আসবে না, যেদিন ‘শিশু’, ‘গীতাঞ্জলি’,‘গীতিমাল্য’, ‘আরোগ্য’, ‘শেষ লেখা’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ কোনও বাঙালী কবি পিছনে ফেলে আসতে পারবেন। তিনের দশকের প্রধান কবিরা তাঁকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন ক’রে অন্য পথে হেঁটেছেন ব’লেই মহাকাল তাঁদের মুণ্ডচ্ছেদ করেন নি। শেষ বয়সে পৌঁছে রবীন্দ্রনাথ রানী চন্দ–র কাছে নিজের ছবির বিষয়ে যতই সন্তোষ প্রকাশ ক’রে থাকুন, নিজের কাব্যভাষার আয়ুষ্কাল সম্পর্কে যতই ঘনীভূত হয়ে উঠুক তাঁর সংশয়, চিত্রকলাবিদ্যায় তিনি সম্ভাবনাময়, কাব্যে — দ্বার হতে দ্বারে ফিরিল শ্রীমতী লইয়া অর্ঘ্যথালি — তিনি অনতিক্রম্য, তিনিই যবনিকা।
Excellent! The essay is both enriching and enjoyable. It captures the readers’ attention from the very beginning.
The essay is both enriching and enjoyable. It captures the reader’s attention from the very beginning.
গৌতম বসু লিখিত ‘চিত্রকলা ও যক্ষপুরীর রবীন্দ্রনাথ ‘
প্রবন্ধটি পাঠ করে মুগ্ধ গোলাম,,,, এধরণের প্রবন্ধের জন্য মুখিয়ে আছি,,,,