গৌতম বসুর অপ্রকাশিত নিবন্ধ – এডওয়ার্ড জেন্নর

আজ থেকে ২৭০ বছর আগে, আমাদের এই পৃথিবী ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম। ভারতবর্ষের অনেকটাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অধীনে চ’লে এসেছে, দাক্ষিণাত্যে ও অন্যান্য কিছু-কিছু এলাকায় স্বাধীন রাজারা কোম্পানির সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ ক’রে চলেছেন বটে, কিন্তু ক্রমে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে ভারতবর্ষের সর্বত্র ইংরেজ শাসন কায়েম হতে চলেছে। ইংল্যান্ড তখন পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী রাষ্ট্র, সেখানে শিল্পবিপ্লবের সূচনা হয়েছে। কেবল শিল্পসামগ্রী উৎপাদনে নয়, জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে – পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও জীববিদ্যা – ইংল্যান্ড ও য়ুরোপের মূল ভূখণ্ডের নানা দেশের বৈজ্ঞানিকরা প্রভূত উন্নতি ক’রে চলেছেন, বিজ্ঞানের প্রয়োগে সাধারণ মানুষের জীবন সহজ ও বাধামুক্ত হয়ে আসছে।
১৭৪৯ সালে, ইংল্যান্ডের দক্ষিণ–পশ্চিমে, গ্লস্টরশায়ার কাউন্টির অন্তর্গত বার্ক্লে-তে এক শিশুর জন্ম হল, নাম এডওয়ার্ড। তার বাবা, রেভেরন্ড স্টিফন জেন্নর একজন ধর্মযাজক, তার মা-ও আর-এক ধর্মযাজক পরিবারের কন্যা। এডওয়ার্ড আর তার ভাইবোনেরা, গ্রামের মনোরম পরিবেশে বড় হয়ে উঠছিল, অকস্মাৎ ঘটল ছন্দপতন, এডওয়ার্ডের বয়স যখন মাত্র পাঁচ বছর, তাদের বাবার জীবনাবসান হল, পরিবারের দায়িত্ব নিলেন তাদের জ্যাঠামশায়। তখনকার দিনে বাচ্চাদের ওপর লেখাপড়ার চাপ ছিল না বললেই চলে, আট বছর বয়সে এডওয়ার্ডকে ইস্কুলে ভর্তি হল। বালক বয়স থেকেই এডওয়ার্ডের মধ্য প্রকৃতিবিজ্ঞান বিষয়ে এক প্রবল আগ্রহ লক্ষ করলেন তার অভিভাবকরা, এডওয়ার্ড গ্রামের মাঠে-ঘাটে ঘুরে-ঘুরে নানা আকারের কীট পতঙ্গ ও ফসিল জোগাড় ক’রে, দেখবার মতো একটা সংগ্রহশালা বানিয়ে ফেলল। ইস্কুলপড়ুয়া থাকাকালীনই এডওয়ার্ড ঔষধবিজ্ঞানে (ফারমাকোলজি) প্রাথমিক পাঠ নিয়ে ছিল, তার বাড়ির বড়রা কিশোর এডওয়ার্ডকে চিকিৎসক করবার জন্য ডাক্তারের শিক্ষানবিশ ক’রে তাকে ব্রিস্টল পাঠিয়ে দিল। সেই সময়ে ইংল্যান্ডের মতো উন্নত দেশেও চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়নের জন্য কোনও মেডিকাল কলেজের অস্তিত্ব ছিল না, মেধাবী ছাত্ররা কোনও–না-কোনও খ্যাতনামা ও অভিজ্ঞ ডাক্তারের শিক্ষানবিশ(অ্যাপ্রেনটিস)হয়ে কাজ শিখে নিতেন। কিছুদিন ব্রিস্টলে কাটাবার পর এডওয়ার্ডকে গ্লস্টরশায়ার থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে লন্ডনের এক হাসপাতালে ডঃ জন হান্টারের অ্যাপ্রেনটিস ক’রে পাঠানো হল।
এডওয়ার্ড জেন্নর তখন ২০ বছর বয়স্ক এক উজ্জ্বল এবং পরিশ্রমী তরুণ, তাঁর প্রশিক্ষককেও তরুণই বলা চলে, কারণ তাঁর বয়স তখন মাত্র একচল্লিশ বছর। তাঁরা একযোগে কাজ করতে শুরু ক’রে দিলেন। ঠিক এই সময়ে আর-একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। বিশ্বখ্যাত নৌ-অভিযাত্রী ও মানচিত্র বিশেষজ্ঞ ক্যাপ্টেন জেমস কুক্‌-এর(১৭২৮-১৭৭৯) প্রশান্ত মহাসাগরের বহু অচেনা অঞ্চল ঘুরে, বিপুল পরিমাণে তথ্য সংগ্রহ ক’রে তাঁর প্রথম নৌ-অভিযান (১৭৬৮-১৭৭১)শেষ ক’রে ইংল্যান্ড ফিরে আসেন। প্রধানত দুরকমের তথ্য আনেন ক্যাপ্টেন কুক্‌, এক, শুক্রগ্রহের কক্ষপথ সঙ্ক্রান্ত তথ্য, এবং দুই, প্রাণী ও উদ্ভিদজগতের অগণিত নমুনা। দ্বিতীয় বিষয়ের সংগ্রহের তালিকাটি জেন্নর এমন দক্ষতার সঙ্গে প্রস্তুত করেন যে, ক্যাপ্টেন কুক্‌-এর দ্বিতীয় অভিযানের সদস্য হিসেবে তাঁকে তখনই মনোনীত করা হয়। এদিকে, ডঃ হান্টা্‌র, তাঁর প্রিয় ছাত্রের সঙ্গে একযোগে কাজ করবার জন্য বেশ কয়েকটি প্রকল্প সাজিয়ে ফেলেছেন। তিনি তাঁর ছাত্রকে ভাল চিনতেন, জানতেন যে লন্ডনের সদাব্যস্ত পরিবেশে সে কোনওদিন সুখী হতে পারবে না, তার পক্ষে গ্লস্টরশায়ারের গ্রামীণ বাতাবরণই ভাল। ক্যাপ্টেন কুক্‌-এর দ্বিতীয় অভিযানে অংশগ্রহণ না-ক’রে, এমন কি লন্ডন মহানগরীতেও ডাক্তারি না ক’রে নিজের গ্রামে ফিরে যাওয়া যে কত সুদূরপ্রসারী এক সিদ্ধান্ত তা আজ ভাবলে অবাক হতে হয়।

ǁ ২ ǁ

ডঃ এডওয়ার্ড জেন্নর ১৭৭৩ সালে নিজের গ্রামে ফিরে এসে ডাক্তারি শুরু করেন; ১৭৮৮ সালে বিয়ে করেন এবং ১৭৮৯ সালে তাঁদের কোলে এক পুত্রসন্তান আসে। ডঃ এডওয়ার্ড জেন্নরের সময়ে দু’টি সংক্রামক ব্যাধি, কাউপক্স আর স্মলপক্স, পশ্চিমি দুনিয়াকে প্রবল সঙ্কটে ফেলে, একটা হিসেব অনুসারে, ১৭০০-১৮০০র মধ্যে ৬ কোটি মানুষ প্রাণ হারান। আমরা যদি মনে রাখি, পৃথিবীর তখনকার জনসংখ্যা ছিল আজকের জনসংখ্যার এক ভগ্নাংশ মাত্র, তাহলে স্মলপক্সে মৃতের ন্যূনতম সংখ্যা ৬০ কোটিতে দাঁড়াতে পারে। কাউপক্সের মারণক্ষমতা স্মলপক্সের প্রতিতুলনায় অনেক কম, গ্রামাঞ্চলের অগণিত গোয়ালঘর থেকে সেটা ছড়াত।
হাতুড়ে গ্রাম্য চিকিৎসকরা বহুকাল ধ’রে রোগ নিরাময়ের জন্য টিকার ব্যবস্থা দ্বারা সংক্রমণ কমিয়ে আনার চেষ্টা ক’রে এসেছেন, কিন্তু তাঁদের প্রচেষ্টা বিজ্ঞানসম্মত না হওয়ার কারণে বিশেষ সাফল্য লাভ করতে পারে নি। পশ্চিমের মানুষ জানতেন যে প্রাচ্যবিশ্বে, বিষে বিষক্ষয়ের এই চিকিৎসা পদ্ধতি কয়েক শতাব্দী ধ’রে চ’লে আসছিল, যদিও এই পদ্ধতির বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান কখনও যাচাই ক’রে দেখে নি। বস্তুত, কেবল প্রাচ্যবিশ্ব নয় তখনকার দিনের ইংল্যান্ডের কয়েকটি প্রান্তিক অঞ্চলেও এই চিকিৎসা পদ্ধতির প্রয়োগ দেখা যায়।
ডঃ জেন্নর যখন তরুণ শিক্ষানবিশ, সেই সময়ে, গ্রামের এক গোয়ালিনী তাঁকে একবার বলেছিলেন ‘আমার স্মলপক্স হবে না, কারণ আমি কাউপক্স থেকে সেরে উঠেছি।’ কথাটির তাৎপর্য তখনই পরিষ্কার না হলেও ডঃ জেন্নরের মনে সেটি গেঁথে যায় এবং মেয়েটির কথা তিনি ডঃ হান্টারকেও জানান। তাঁদের মধ্যে এ-প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনাও হয়। দুটো রোগের মধ্যে যদি মিল থেকে ( যেমন কাউপক্স ও স্মলপক্সের মধ্যে আছে), তাহলে একটা রোগ থেকে সেরে উঠলে মানুষের শরীর এমন কিছু আত্মরক্ষার ব্যবস্থা (অ্যান্টিবডি) নিজেই ক’রে নেয়, যা দ্বিতীয় রোগ থেকেও তাকে সুরক্ষিত রাখে। ‘ভারিওলা’ নামের এক মারাত্মক শক্তিধর ভাইরাস স্মলপক্স রোগের উৎস। ডঃ জেন্নর তাঁর গ্রামের রোগীদের ওপর নানা রকম পরীক্ষা করেন; যেমন, কাউপক্সে আক্রান্ত এক গোয়ালিনীর হাতের ঘা থেকে মরা জীবাণু নিয়ে এক নীরোগ বালকের শরীরে কৃত্রিম উপায়ে চালনা করা হয়। এর কয়েক সপ্তাহ পর, দেখা যায়, সেই বালকটির শরীরে ‘ভারিওলা’ ভাইরাস কৃত্রিম উপায়ে প্রবেশ করিয়ে দিলেও সে সম্পূর্ণ সুস্থ থাকছে; মরা জীবাণুর সহায়তা নিয়ে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হল বালকটির শরীরে, সেটাই তাকে রক্ষা করছে। ডঃ জেন্নর তেইশটি এইরকম পরীক্ষা, প্রত্যেকটির ফলাফলসহ ১৭৯৮ সালে তাঁর চাঞ্চল্যকর গবেষণাপত্র ‘অ্যান এন্‌কোয়রি ইন্‌টু দ্য কসেস অ্যান্ড এফে্টস অফ ভারিওল ভ্যাক্সিন’ প্রকাশ করেন। পথিকৃৎদের কপালে প্রথমেই জোটে পরিমিত পরিমাণে উচ্চপ্রশংসা এবং অপরিমিত ঠাট্টা ও কৌতুক, ডঃ জেন্নরও তাঁর ব্যতিক্রম নন। কিন্তু বিভিন্ন দেশে তাঁর প্রদর্শিত পথে যখন টিকার প্রয়োগ করা হয় এবং তার রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা সম্পর্কে মানুষের দ্বিধা যখন দূর হয়, তখন তিনি বিপুল জনস্বীকৃতি লাভ করেন। ১৮২৩ সালে, পরিণত বয়সে ডঃ জেন্নরের জীবনাবসান হয়।
আমাদের পৃথিবী এখন সম্পূর্ণভাবে স্মলপক্সের কবলমুক্ত, কিন্তু নতুন-নতুন ভাইরাস আমাদের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। ডঃ জেন্নরের সময় থেকে বিজ্ঞান এখন অনেক উন্নত। আমরা আজ জানি, রোগীর দেহে যে অ্যান্টিবডি ছড়িয়ে পড়ে তাদের একটা ‘স্মৃতিশক্তি’ আছে, রক্তপ্রবাহে ভেসে বেড়ানো অজস্র কণিকা থেকে তারা তাদের শত্রুকে চিনে নিয়ে তখনই তাকে আক্রমণ ক’রে অকেজো ক’রে দেয়। সাম্প্রতিককালের গবেষণার ফল ডঃ জেন্নরের সামনে ছিল না, তবু রোগনিরাময়ের সমাধানসূত্রের ক্ষেত্রে তিনি যে এতটুকু ভুল করেন নি, তার একমাত্র কারণ তাঁর বিরল বৈজ্ঞানিক প্রতিভা।

গৌতম বসু

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes