গোমুখ হয়ে কালিন্দী খাল পেরিয়ে বদ্রীনাথ – ফিরে দেখা
পর্ব-তিন
অরুণ ভট্টাচার্য
গঙ্গোত্রী থেকে গোমুখ
উত্তরকাশী থেকে ইনারলাইন পারমিট পেতে দেরি দেখে দলের দুজন বাদে বাকি চারজন গঙ্গোত্রী চলে যায়। সেসময় এই অভিযানের জন্য ইন্ডিয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ফাউন্ডেশনের অনুমতি পত্র নিয়ে উত্তরকাশী জেলাশাসকের এবং ইন্ডো-টিবেটিয়ান বর্ডার পুলিশের (আই টি বি পি)অনুমতি পত্রের দরকার। কালিন্দী খাল পর্যন্ত অনুমতি দেবার কথা উত্তরকাশী জেলাশাসকের আর কালিন্দী খালের পর থেকে বদ্রীনাথের আগে মানাগ্রাম পর্যন্ত আই টি বি পি-র। এগুলি যোগাড় করাটা বেশ সময়সাপেক্ষ।
তৃতীয় সমস্যা হল, এই অভিযানের পোর্টার-বন্ধু জোগাড় করা। হিমালয়ে সাধারণ ট্রেকিং-এর জন্যে যেসকল পোর্টার-বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয়, তাঁরা কখনই গঙ্গোত্রী হিমবাহ অঞ্চলে নন্দনবনের ওপরে যাবেন না অর্থাৎ ষোল হাজার ফুটের ওপরে গেলে হ্যাপের কাজ শুরু হয়। উত্তরকাশীতে দুই শ্রেণীর পোর্টার-বন্ধু মেলে, হাই অল্টিট্যুড পোর্টার ও লো অল্টিট্যুড পোর্টার, সংক্ষেপে হ্যাপ ও ল্যাপ (HAP & LAP)। গঙ্গোত্রী হিমবাহ অঞ্চলের যে কোন অভিযানে তা ট্রেকিং বা মাউন্টেনিয়ারিং যাই-হোক-না-কেন, এই দুই শ্রেণীর পোর্টার-বন্ধুকে সঙ্গে নিতে হবে। হ্যাপ-বন্ধুদের নন্দনবন পর্যন্ত কোন কাজে পাওয়া যাবে না। যেমন, রান্না করা, জল আনা, ফাইফরমাস খাটা ইত্যাদি। তাদের কাজ শুরু হবে নন্দনবনের পর।
অনুমতি-পত্র পাবার পর গঙ্গোত্রী থেকে পোর্টার-বন্ধুদের নিয়ে গোমুখের দিকে যাবার কথা। গঙ্গোত্রী (10,319 ফুট) পৌছে দেখা গেল দলের প্রথম চারজন যাঁরা আগেই গঙ্গোত্রী চলে এসেছিলেন, ওখানে অপেক্ষা একদিন করে গোমুখের দিকে চলে গেছেন। তার ওপর পোর্টার-বন্ধুদেরও দেখা নেই। আসলে ঐ একই সময় এক বিদেশী পর্বতাভিযাত্রী দল উত্তরকাশী থেকে গঙ্গোত্রী পর্যন্ত যত পোর্টার-বন্ধু ছিলেন, সবাইকে তাঁদের অভিযানের কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। ফলশ্রুতি, অমিল পোর্টার-বন্ধু।
দুইদিন গঙ্গোত্রীতে অপেক্ষা করার পর তৃতীয় দিনের পড়ন্ত বেলায় সেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকা পোর্টার-বন্ধুরা উপস্থিত হয়। আর বিলম্ব না করে গোমুখের পথে সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়া। গঙ্গোত্রী থেকে গোমুখের পথে যাওয়ার শুরুতেই সেখানকার পুলিশে সব কাগজপত্র দেখে দলের পিছিয়ে-থাকা শেষ দুজনকে গোমুখের পথে যেতে দেয়। এদিকে চীরবাস-এ জিরিয়ে নেবার সময়, তাঁদের সঙ্গে থাকা এক পোর্টার-বন্ধুর সঙ্গে কাকতালীয়ভাবে চীরবাস-এ দেখা। তার কাছে জানা গেল, আগুয়ান সদস্যরা অধৈর্য্য হয়ে ফিরতে শুরু করেছেন। ধরেই নিয়েছেন, পোর্টার-বন্ধু না পাওয়াতে অভিযান বাতিল হয়ে গেছে। সেই পোর্টার-বন্ধুকে সঙ্গে সঙ্গে আবার গোমুখের দিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, যাতে তারা আবার ফিরে যায়। সন্ধ্যা নামে. বৃষ্টিও নামে। ঐ বৃষ্টির মাঝেই ভুজবাস আসে। জানা গেল, সেখানে দলের সদস্যরা নেই, গোমুখের দিকে এগিয়ে গেছে। ভাগিরথীর দুপাশের গিরিশিরাদুটি অন্ধকারে পাঁচিলের মতো দাঁড়িয়ে। ইতিমধ্যে বৃষ্টির মেঘ দূরে চলে গেছে, অদূরের তুষার শৃঙ্গগুলিতে প্রতিফলিত তারাভরা আকাশের আভায় পথরেখা খুঁজে পেতে কোন অসুবিধা হয় না। এই সময় বেশ দূরে বেশ কয়েকটি আলো এগিয়ে আসতে থাকে। কালো কালো ছায়াগুলি এসে ঐ শেষ দুই সদস্যের রূকস্যাকগুলি নিয়ে নেয়। সামনে দেখা যায় তিনটি তাঁবু। প্রথম দিনের হাঁটা শেষ। গোমুখের বেশ কাছে। ভাগিরথী নদীর প্রকৃত ডান দিকে। নদীর স্রোতের গর্জন আর গঙ্গোত্রী হিমবাহের হিমেল হাওয়ায় প্রভাব দলের সকল সদস্যদের মিলিত হবার আনন্দে দূরে সরে যায়।