ক্রোড়পত্র: নিশীথ ভড়
‘ মর্মরের সঙ্গে একটা কাঁটাগাছের সন্ধি ; নিশীথ ভড়ের কবিতা ‘
শুভম চক্রবর্তী
নিশীথ ভড়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ নিজের পায়ের শব্দ ‘ প্রকাশিত হয় ১৯৮৪ সালে। প্রকাশের ৩৬ বছর পর সেই কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতা নিয়ে আমি পাঠপ্রতিক্রিয়া লিখতে বসেছি। নিশীথ ভড়ের জীবন খুব সুখপ্রদ ছিল না। বিস্তর ঝড়ঝাপটার মধ্যে উৎকর্ণ হয়ে তাঁকে শুনে নিতে হয়েছিল ‘ নিজের পায়ের শব্দ ‘। হয়তো সেই পদশব্দই তাঁর ‘ অপর ‘ অস্তিত্বের একমাত্র স্মারক। এখন যখন আমরা সবাই একইরকম। লাইনেই ছিলাম বাবা বলে দাঁড়িয়ে আছি আর ভাগ ক’রে ওল্ড মঙ্ক খাচ্ছি তখন অস্তিত্বের এই অভিজ্ঞান দিয়ে কী করে চেনা যাবে একাকী , সন্তাপিত কবি নিশীথ ভড়ের মুখ। এই হালকা দুলুনির তন্দ্রা এনে দেওয়া সুখপ্রদ জীবনে কেউ আমায় তার গতজীবনের ধর্ষিত হওয়ার কথা বলেনি, কেউ বলতে এলেও আমি শুনিনি, ব্যস্ততার ভান করে জোরে জোরে হেঁটে ঢুকে গেছি আলোঝলমল জীবনে, সেই আমার পক্ষে কীভাবে সম্ভব তাঁর কবিতাকে স্পর্শ করা।
‘Image-music-text’ গ্রন্থের author-এর মৃত্যু প্রবন্ধে রলাঁ বার্ত যে প্রতর্কটিকে সুচিহ্নিত করেছেন তা সাহিত্য সমালোচনার ইতিহাসে একটি বৈপ্লবিক প্রস্থান। অথবা রবীন্দ্রনাথের ‘ একাকী গায়কের নহে তো গান ‘। অথবা solipsism -এর একটা ধারণা যেখানে আমিহীন কোনো কিছুই নেই, ফলত নেই নিশীথ ভড়ও। হিউম্যান জিওগ্রাফার yi fu tuan ‘ টোপোফিলিয়া ‘ এবং ‘ টোপোফোবিয়া ‘ সংক্রান্ত আলোচনায় মানুষের মনে তার ভৌগোলিক প্রেক্ষিতের প্রভাবটিকে অ্যাড্রেস করেছেন। নিশীথের আলো এবং অন্ধকার বুঝতে এই ভাবনা কাজে লাগবে। পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল এবং রণজিৎ দাশ-এর গদ্য থেকে জানি নিশীথের জীবনের অনেকটাই কেটেছে রেড লাইট এরিয়ার কাছাকাছি। নিশীথ পড়ছেন বঙ্কিমচন্দ্র, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথের আদর্শায়িত আখর আর দেখছেন, সট বা হোল নাইট ডিউটি দিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়া রংমাখা বেশ্যাদের। জীবনঅভিজ্ঞতা এবং পাঠঅভিজ্ঞতা নিশীথের কাছে দ্বন্দ্বাতীত কোনো রূপ নিয়ে আসেনি, এই দ্বন্দ্ব(হিপোক্রেসি!)-ই নিশীথের অনেক কবিতাকেই তীর্যক ও শ্লেষাত্মক একটি বাকভঙ্গি দিয়েছে। নিশীথ ভড়ের প্রসঙ্গে আমার ফালগুনী রায়ের কথা মনে পড়ে। ফালগুনীর জীবন যদিও আগাগোড়াই তছনছপ্রবণ, তুলনায় নিশীথের জীবনের শেষ দিকটা আপাতসুখী, পারিবারিক। কিন্তু এই দু’জনই প্রায় একইসময়ের একাকী, বন্ধুহীন এবং ‘আউটসাইডার’৷ তলপেটে রেড লাইট এরিয়া নিয়ে জেগে থাকা কলকাতা শহরের দুই সিসিফাস, নিশীথ ও ফালগুনী।
অমিতাভ গুপ্ত নিশীথের কবিতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে নিশীথকে ‘ সন্তাপের কবি’ অভিধায় ভূষিত করেছেন। এবার তাঁর ‘ নিজের পায়ের শব্দ ‘ কাব্যগ্রন্থের ‘ তোমাকে ‘ কবিতাটি পড়া যাক। নিতান্ত ডায়েরির মতো ক’রে সূচনা হয়েছে কবিতাটির, এলোমেলো লোকের সঙ্গে এলোমেলো কথা বলার অনুসঙ্গ দিয়ে। তারপর কিছু দৃশ্যের আয়োজন করেছেন নিশীথ যাতে আপাত না-বলায় বেশ্যাপাড়ার আবহ দ্যোতিত হয়ে ওঠে৷ তারপরে হঠাৎ-ই কবিতাটির শেষ হয়েছে বিদ্যুৎচমকের মতো একটি পঙক্তি দিয়ে ‘ শান্তভাবে, তোমার গতজীবনের ধর্ষণের কথা বলো আমাকে। ‘ এই একটি মাত্র পঙক্তিই কবিতাটিকে অপার বিস্তার দেয়, কথক এখানে হয়ে ওঠেন সমস্ত ধর্ষিত, অপমানিত মানুষের প্রতিনিধি আর কবি অপমানিতের বেদনা ভাগ ক’রে তাঁকে আশ্রয় দেওয়ার লোক, শান্ত স্বরে স্বীকার করার লোক। পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল নিশীথের তীর্থসংহারের কবিতাগুলিকে অতিমাত্রায় শান্তায়নবাদী বলেছেন, এই শান্তির বীজ আগেই উপ্ত হয়েছিল রাতে, একাকী ধর্ষণের কথা শুনতে চাওয়ার সহানুভূতিশীলতার মধ্যে।