
ক্রোড়পত্র: নিশীথ ভড়
ফেরা :
অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়
সমস্ত বিপথ ছেড়ে খুব রাতে এসে আমি নিজের দরজায় কড়া নাড়ি
কে রয়েছ এখানে আজ? সাড়া দাও, ভিতরে খিল এঁটে
কে ঘুমোচ্ছ? খুলে দাও, খোলো-খোলো, দরজা খোলে না
কেউ মজা করছে তবে এত রাতে? নাকি আমি আকাট মাতাল
নিজের দরজাই চিনতে ভুল করছি? দু পায়ের নীচে
মাটি কেঁপে ওঠে ঠিক, টের পাই, কী করব কোথায় যাব আমি?
সমস্ত বন্ধুর বাড়ি ভুলে গেছি, আহাম্মক রসিকতা রাখো
বাইরে ভীষণ শীত, পুলিশ টানবে শেষে, দয়া হয় না, দরজা খোলে না—
আমাকে মাতাল ভেবে যে বন্ধ করেছে দরজা সেও কি কাঁপছে আরো ভয়ে
নিজের দরজার সামনে কাঠ হয়ে এই প্রশ্ন কাঠকে করেছি।
(নিজের দরজার সামনে : নিশীথ ভড়)
প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত একবার ‘প্রকৃত’ কবি-সম্পর্কে বলেছিলেন—একজন কবি যখন জুতোর ফিতে বাঁধছেন, তখনও তিনি কবি। এই সংজ্ঞা-কে মান্যতা দিয়ে ‘কবি’ হয়ে উঠতে পারেন না সবাই। একজন কবিকে সমাজ-সংসারে অনেক অকাব্যিক ব্যস্ততার ভিতর জারিত হতে হয়। ‘অকবিজীবন’ যাপন করে যেতে হয় না-চাইতেও! এক্ষেত্রে সিস্টেমের সহজ ভিকটিম কিন্তু ‘কবি’ই। সিস্টেম কবির বোধিজগতে শিকল পরিয়ে দেয় নিজের ধর্ম মেনে।
সেই কবে লিখেছেন শঙ্খ ঘোষ—‘একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি / তোমার জন্য গলির কোণে / ভাবি আমার মুখ দেখাব / মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’।… নিজের সঙ্গে লীন হতে-না-পারা মানুষটির, প্রেমিকার কাছে সৎ হয়ে পৌঁছতে না-পারা যুবাটির অন্তর্মনন ঢেকে দিয়েছে বিজ্ঞাপনের রঙচঙে আলোকমালা…। সে নয়, তার ‘মুখোশ’ ঝুলতে থাকে বিজ্ঞাপনে।
একজন অনুভূতিপ্রবণ মানুষের ভেতর ও বাইরের মধ্যবর্তী জায়গায় অবস্থানের ‘ক্রাইসিস’ও আদ্যন্ত সঙ্গত এবং প্রাসঙ্গিক। সেই দ্বন্দ্বাদীর্ণ সংকটই আরেক রূপে ধরা দিয়েছে সত্তরের অন্যধারার কবি নিশীথ ভড়ের এই কবিতায়।
বহিরঙ্গের হট্টগোল, আকাব্যিক জীবন আর বহির্মুখী বিক্ষেপ আস্তে আস্তে আপন হতে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে কবিকে। নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিক করে দেয় তাকে; অজ্ঞাতসারেই। অনুভবের তলদেশে আঁট হয়ে-থাকে দরজার পাল্লাদুটো…।
ছিন্নমূল, উদ্বাস্তু মানুষের মতন সেই মানুষ, যিনি কবি, খুব রাতে নিজের একান্ত সেই কপাটের সামনে অসহায় শরণার্থী যেন। সমূহ কবিতার ভিতজুড়ে আত্মস্থ-হওয়ার সেই সমস্যা; কবিতাটি পাক খেয়ে চলে সেই জটিলতার চারপাশেই…। সারাটি দিনের চাহিদা, বৈশিষ্ট বা প্রয়োজনীয়তা অমোঘ পাশে বেঁধে রাখে কবির অন্তর্সত্তা। তাঁকে কেন্দ্রীভূত হতে দেয় না। গভীর ও সংহত মনন ক্রমাগত ঘেঁটে দেয়; এলোমেলো করে দেয় প্রকৃতি-অনুসারেই। কবির মগ্ন-ধ্যানবিন্দু উপড়ে ফেলে বাহির-জগতের ঠুলি পরিয়ে দেয়। তার বারংবারের চেষ্টার মায়াকৌশলে নির্জনতার আগল ভেঙে পড়ে। ভেতরের প্রজাপতিগুলি উড়ে যায় চোখধাঁধানো অন্ধ আকাশপানে। কবি প্রকৃতঅর্থে এখানে সহায়হীন, হয়তবা কিছুটা অসচেতনও এবং অবশ্যই উৎসর্গীকৃত।
মধ্যরাত্রির নিরালায় চারপাশ শান্ত হয়ে এলে তড়িৎস্পর্শে যেভাবে চেতনা ফিরে আসে; আচমকা ছ্যাঁকাখাওয়া মানুষ সম্বিৎ ফিরে পায় যেভাবে—সেভাবেই নিজের ছোঁয়ায় এসে উপনীত হতে চান তিনি। নিজস্ব অন্তর্লোকে মিশে যেতে চান। আপনদুয়ারে অবিশ্রান্ত করাঘাত এবং কড়া নাড়া চলে তাই।
কিন্তু সে দরোজা শক্ত করে আঁটা খুব। অবিরল ঘুরতে ঘুরতে, উড়ে বেড়াতে বেড়াতে অন্তর তার ঝাঁপ টেনে দিয়েছে কবেই। এ এক অসম্ভব বিচলন। অনলস যন্ত্রণার প্রকাশলগ্ন। আক্ষরিক অর্থেই ‘শিকড়চ্যুতি’র ছটফটানি।
সৃজনশীল সত্তা তো সততই অন্তরপিয়াসী। বাইরের মোহাবিষ্ট আগ্রাসনে সত্যসত্যই রুচি নেই তার। নিজেকে অনুভব করাই অপার শান্তি তার কাছে।… নিজের অন্দরে প্রবেশের সেই সহজদ্বার বন্ধ হয়ে গেলে কী করবে তবে? বারবার ধাক্কাও তাকে। পাগলের মতো চেঁচিয়ে প্রলাপ বকো। মাথা কোটো।… দরজা খুলছে না তবু। আকস্মিক বিভ্রান্তি পেঁচিয়ে ধরেছে ঠিক। সাপের মতো। শীতল ও বিষাক্ত।… কেউ মজা করে খুলছে না? ‘নাকি আমি আকাট মাতাল নিজের দরজাই চিনতে ভুল করেছি’?… লক্ষনীয় বিষয়, এই অমোঘ ইলিউশনে, এই বিভ্রান্তি ও সন্দেহে ‘মাটি কেঁপে’ উঠছে। দুলে যাচ্ছে তাবৎ অস্তিত্ব।… এক ভয়ার্ত প্রশ্নের সমীপে দাঁড়িয়ে জড় হয়ে যায় বোধটুকুও…। ‘কী করব কোথায় যাব আমি’ চেতনাসম্পন্ন সত্তার সেই আদি ও অন্তিম জিজ্ঞাসা। হ্যাঁ, এই আর্তি যেকোনো বোধদীপ্ত প্রাণীরই। বোধিবৃক্ষ থেকে চ্যুত-হয়ে-পড়া ‘জ্ঞান’ কোথায় বা ঠাঁই পাবে তবে।… অন্তর্গৃহের উৎখাত হওয়া মানুষ কোনখানে আসনপিঁড়ি পায়!…
এক ভয়ংকর সংশয়ের অন্ধকারে অস্থির ডানায় ঝটপট করে চলেছে এই কবিতা। এমনকি কান পাতলে শোনা যায় তার পালকে-পালকে সংঘর্ষের ব্যাকুল শব্দটিও। লক্ষ্য করুন, মাঝরাত, বাড়ি ফেরা, মাতাল—এইসব টুকরো টুকরো শব্দসম্ভারে যে আবহের নির্মিতি—সেখানে সচেতনভাবে ছায়া ফেলেছে ‘সে বড়ো সুখের সময় নয়’ প্রবাদ-হয়ে-যাওয়া সেই কবিতা। তবে ওই ছায়াটুকুই। তার বেশি নয়। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় অস্থির, লক্ষ্যহীন আত্মার দিশাহারানো আকুতি। যন্ত্রণাদগ্ধ বেলাগাম নিশিযাপন এবং অন্বেষণে অন্বেষণে ব্যর্থ, পরিত্রাণশূন্যতার ফলস্বরূপ উন্মার্গগামী চলনেই আশ্রয় নেওয়া শেষমেশ। সময়ের সেই অসুখ এই লেখায় আরও গভীর, আরও মর্মন্তুদ। আরও নির্দিষ্ট-ঘনিষ্ঠ হয়ে বেঁধে ফেলেছে কবিকে। আত্মঅসুখের চেহারা নিয়ে টালমাটাল পায়ে ঘরসন্ধান করে ফিরছে নিশীথ ভড়ের এই কবিতা। এখানে বিশৃঙ্খলা সমবেতভাবে, সব সৃজনকামী আত্মার।
নিষ্ঠুর সত্য বা আত্মদর্পণের ভাঙাচোরা ছবির স্মনে দাঁড়িয়ে বিবশ কবির মনে পড়ছে ‘সমস্ত বন্ধুর বাড়ি ভুলে গেছি’… ‘বাইরে ভীষণ শীত’… ‘পুলিশ টানবে শেষে’… অকপট অন্তর্-বয়ান।… আপনার চেয়ে বড়ো বন্ধু কেউ আছে! বাকি সব বন্ধুই তো দূরের, বাইরের।… নিজ-সান্নিধ্যে ফিরে আসার সেই বন্ধ অর্গলের সম্মুখে অধীর-থেকে ভয়াবহ সম্ভাবনার শীতে কেঁপে ওঠে সমস্ত শরীর…। না, দরজা তবু খোলে না!
এই কবিতার দেহে বিছিয়ে-থাকা কয়েকটি শব্দকে খুঁটে আনি এইবার। খেয়াল রাখুন, ‘আকাট মাতাল’… ‘আহাম্মক রসিকতা রাখো’… এই দুটি উদ্ধৃতি। ‘আকাট’ ‘আহাম্মক’ এই বিশেষণ ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে কত সহজেই কবি চিহ্নিত করে দিচ্ছেন, বোধের নিরেট, স্তব্ধ পিণ্ডকে। ইশারার আড়ালে-আবডালে দিনের আলোর মতো জ্বলজ্বল করছে কবির নিহিত কনফেশন। তিনি ক্রম-রূপান্তরে বোধশূন্য হয়ে যাচ্ছেন যে!… কবিতাটি শেষ হয়েছে গহীন উপলব্ধির গহীনতর অভিঘাতপ্রাপ্তির বিস্ময় নিয়ে। ‘আমাকে মাতাল ভেবে যে বন্ধ করেছে দরজা সেও কি কাঁপছে আরো ভয়ে / নিজের দরজার সামনে কাঠ হয়ে এই প্রশ্ন কাঠকে করেছি’।
অন্তরচারী সেই নিভৃতের নিকট এখন ‘তিনি’ও অচেনা, বেভুলো, মাতাল…। নিজের সঙ্গে দীর্ঘকালীন অদর্শনে কখন আপন ভুলেছে তাকে। আবছা, উলোঝুলো মনে হয়। ভেতরে আলো জ্বলে ওঠে না। হাট হয়না দরজা। বিস্মৃতির ছায়ামাখা অস্তিত্বের নিজেকেই ‘কাঠ’ মনে হয় তখন।… দরজা যে কাঠেরই রূপভেদ। যাবতীয় একান্ত অনুভূতি নির্জীব পড়ে-আছে কাঠের ওপারের দুর্জ্ঞেয় দেশে…। অনুভব কাষ্ঠবৎ। রূদ্ধ-কঠিন এই সত্যের অকস্মাৎ উদ্ভাসে চেতনারহিত এই মন। যে মন ছুঁয়ে হাঁটা শুরু হয়েছিল একদিন। বাহির চষে ফিরে-আসা পা-দুটি ঘর পায় না আজ…। মন পায় না মন…।
‘দরজা’ তো রূপকমাত্র। দরজা বলে কিছু নেই। নিজ-নিকেতনে ফিরতে পারবে তুমি, কোনোদিন! কোনও একদিন!