কাকে বলে কৃত্রিম বুদ্ধি – পর্ব ১ <br /> সমীরণ চট্টোপাধ্যায়

কাকে বলে কৃত্রিম বুদ্ধি – পর্ব ১
সমীরণ চট্টোপাধ্যায়

গোড়ার কথা

মানুষ কিভাবে মনে রাখে, কিভাবে শেখে, কিভাবে তার বুদ্ধির বিকাশ হয় – এ সমস্তই বড়ো রহস্যময়। মানুষের মস্তিষ্কের আনাচে কানাচে খুঁজেও পাওয়া যায় না কোন স্মৃতি প্রকোষ্ঠ। কম্পিউটারের যেমন মেমরি আছে, যা নাকি দরকারে আর একটু কিনে বাড়িয়ে নেওয়া যায়, তেমন ভাণ্ডার মানুষের মাথায় তো নেই। সেখানে তো শুধু কোটি কোটি স্নায়ু কোষ (যার ইংরাজি নাম নিউরোন) আর তাদের মধ্যে অগণিত জৈব তারের সংযোগ। এই অন্তর্জাল ঘেঁটে বিজ্ঞানীরা খুঁজে চলেছেন ঠিক কিভাবে আমরা দেখি, শুনি, ভাবি। কিন্তু এ তো আগামীর কথা। এই মুহূর্তে তো তোলপাড় করা খবর হল, যন্ত্রের মেধা নাকি ছাড়িয়ে যাচ্ছ এমনকি মানুষের সৃষ্টিশীলতাকেও। এই লেখায় আমরা টাইম মেশিনে সেই পথ ধরে হাঁটব, যে পথ দিয়ে যন্ত্রের এমন ক্ষমতার বিকাশ ঘটে গেল।

এ আই এর আশির দশক

শুরুর থেকেই শুরু করি। গঙ্গা যেমন মহাদেবের জটা থেকে শুরু হয়, তেমনি কম্পিউটার বিজ্ঞানের সব তত্ত্বরই আদি পুরুষ যেন এলান টিউরিং। জন্মের শতবর্ষ পার করেও তাঁর মেশিনের চেয়ে শক্তিশালী মেশিন আজও অধরা। আবার তাঁর সৃষ্ট বি-টাইপ নেটওয়ার্ক যা প্রবন্ধ আকারে ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তাকে আধুনিক নিউরাল নেটওয়ার্কের আদিমতম রূপ বললে অতিকথন হয়না। তবে সত্তর থেকে আশির দশকে (যার শেষ অর্ধে) আমি যখন কম্পিউটার সায়েন্স পড়ছি, তখন কম্পিউটারকে বুদ্ধিমান করে তোলার খেলায় অন্য নেশা ছিল। তখন একদিকে ছিল ধাঁধা বা জটিল খেলায় (যেমন দাবা) কম্পিউটারকে আরও পারদর্শী করে তোলার চেষ্টা যা পোশাকি ভাষায় ‘হিউরিস্টিক সার্চ’ নামে খ্যাত। অন্য দিকে তথ্য ভাণ্ডারকে অঙ্কের ভাষায় প্রকাশ করে নানাবিধ উপপাদ্য (চলতি ভাষায় থিওরেম) প্রমাণ করার চেষ্টা। যেমন ধরুন আমি যদি ‘মানুষ নশ্বর’ এবং ‘রাম একজন মানুষ’ – এই দুটি বাক্য ঠিক মতো অঙ্কের ভাষায় প্রকাশ করে কম্পিউটার কে গিলিয়ে দিই (রবি ঠাকুরের তোতা কাহিনি স্মরণীয়), এবং জিজ্ঞেস করি ‘রাম নশ্বর’ কি না, তবে কম্পিউটার আমাকে জানাবে যে আমার অনুমান সঠিক।

এতক্ষণ শুনতে শুনতে কেউ তো বলে উঠবেই যে তাহলে আমি যদি পুরো মেটিরিয়া মেডিকার কাব্যটিকে অঙ্কের ভাষায় গুঁজে দিই কম্পিউটারের মোটা মাথায় এবং রোগীর উপসর্গ জানিয়ে জিজ্ঞেস করি কী রোগ হয়েছে, তাহলে কম্পিউটার আমাকে ওষুধ পর্যন্ত দিয়ে দিতে পারে। ব্যস, আর কী! কম্পিউটার হয়ে গেল ডাক্তার। অর্থাৎ জন্ম নিল এক্সপার্ট সিস্টেমের। এই পর্যন্ত সবই ঠিক চলছিল। গোল বাধাল নান রকমের গণিতবিদরা। এমনিতেই তো জানেন, গণিতবিদরা কেমন খুঁতখুঁতে হয়, পান থেকে চূণ খসলেই মনে করে পৃথিবী রসাতলে যাবে। অতএব তারা এক গুচ্ছ তাত্ত্বিক প্রশ্ন তুলল। সব সময় কম্পিউটার এমন উত্তর ঠিক দিতে পারবে কি? যদি দিতে পারে, সেই উত্তরের জন্য কতদিন হা পিত্যেশ করে বসে থাকতে হবে? সব উত্তর যে কম্পিউটার ঠিক বলবে তার নিশ্চয়তা কোথায়? আর এত বুদ্ধি এই বিজ্ঞানীদের, যে এই সব প্রশ্নের সদর্থক উত্তর তো দিলেনই না বরং নানা মহা পণ্ডিত (যেমন গোডেল) জানিয়ে দিলেন এই সব প্রশ্নেরই উত্তর নঞর্থক। অতএব, সাধের এক্সপার্ট সিস্টেমের দফা রফা। এবং যন্ত্রের মধ্যে বুদ্ধি দেওয়ার গবেষণা একেবারে হিমঘরে। তবে একটাই ভাল ব্যাপার হল যে এই গবেষণাকে কবরও দেওয়া হয়নি, চিতাতেও তোলা হয়নি। একটি সুপ্ত বীজের মতো সে রয়ে গেল উপযুক্ত পরিবেশের অপেক্ষায়।

বলা উচিত যে এই এক্সপার্ট সিস্টেমের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হল আইবিএমের সুপার কম্পিউটার ডিপ ব্লু। ইনি দাবা খেলার এক্সপার্ট। আর দাবা খেলা বুদ্ধির চরম পরাকাষ্ঠা বলেই মনে করা হয়। এনার আবির্ভাব ১৯৮৫ সালে চিপ টেস্ট নামে। পরে যেমন যেমন ক্ষমতা বেড়েছে তেমন তেমন নাম পাল্টে প্রথমে ডিপ থট এবং তার পরে ডিপ ব্লু। একথা মানতে হবে যে প্রথমে ১৯৯৬ সালে ডিপ ব্লু হার মেনেছিল দাবার তদানীন্তন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন কাস্পারভের কাছে। কিন্তু পরের বছর ডার্বিতে আরও উন্নত ডিপ ব্লু কাস্পারভকে হারিয়ে দেয় ছয় গেমের সিরিজে। তবে, এই জয় পরাজয়, বুদ্ধি কাকে বলে সেই প্রশ্ন তুলে দিয়ে গেল। ডিপ ব্লু প্রতি সেকেন্ডে ২০০০ চাল এবং প্রতিচাল এগিয়ে হিসেব করে যে খনি খনন করে তার থেকে খুঁজে আনে তার পরের দানটি যেটি তার মতে সর্বশ্রেষ্ঠ। কিন্তু এমনকি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নও কী এত চাল আগাম দেখে খেলে? না এত চাল আগাম হিসেব করা মানুষের মস্তিষ্কের ক্ষমতায় সম্ভব? কে না জানে মানুষের পাটিগণিতের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ এবং ভুলের প্রবণতায় ভরা। বোঝা গেল বুদ্ধি যাকেই বলা হোক, যন্ত্র গণকের গণনা শক্তির অননুকরণীয় ক্ষিপ্রতা বুদ্ধির প্রকাশের এক বিচিত্র সংজ্ঞা তৈরি করেছে। আর যাই হোক, এ বুদ্ধি সে বুদ্ধি নয়।

মেশিন লার্নিং

এইবার আপনারা অস্থির হয়ে উঠেছেন। “এতো সব অতীত, পতিত”, মেশিন লার্নিং কই? এইটাই মোদ্দা কথা। আমরা যেভাবে শিখি, যন্ত্র কে সেই ভাবে শেখাব কিভাবে? এই খানে একটা দার্শনিকের সমস্যা তৈরি হয়। আগে না আমি চিন্তা করে বার করব আমি কিকরে চিন্তা করি। তবে না! এইখানে কেমন গুলিয়ে গেল। ‘চিন্তা করব কেমন করে চিন্তা করি’ – কেমন একটা নিজের মধ্যেই পাক খেয়ে যাচ্ছে না! অতএব যতক্ষণ না নিউরো সায়েন্স আমাকে উদ্ধার করতে আসছে, একটু বাঁকা পথে হাঁটি। আমদের মস্তিষ্কে কী আছে? অসংখ্য নিউরোন আর তাদের জড়িয়ে একটা অতি জটিল নেটওয়ার্ক। তাই তো? একটু সহজ করে ভাবলে, নিউরোনে বিদ্যুৎ তরঙ্গ যায়, তাকে উত্তেজিত করে। একটা নিউরোনে অনেক অনেক নিউরোন একই সাথে খবর পাঠায়। সেই সব খবর নিয়ে গ্রহীতা নিউরোন বিচার করে যে সেও তার সাথে লাগানো নিউরোনগুলোকে বিদ্যুত তরঙ্গ দিয়ে কোন খবর দেবে কিনা। দিলে এমন চলতে থাকবে যতক্ষণ না একটা শেষ পর্যায় আসে যেখানে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কেমন সিদ্ধান্ত? ধরুন, একাবারে গোড়ায় নিউরোনগুলিকে একটা বেড়ালের ছবি দেখান হল। শেষ পর্যায়ে আমায় সে বলবে যে যেটা দেখান হয়েছিল সেটা বেড়াল, কুকুর নয়। এটাই সিদ্ধান্ত।

এখানে অনেক কিন্তু আছে। বেড়ালের কেন কোন ছবিই তো কম্পিউটার বুঝবেনা। সে তো চেনে শুধু সংখ্যা। তাহলে ছবি থেকে পেতে হবে সংখ্যার সারি। সে কিন্তু অন্য গল্প, অন্য বিষয় যার নাম ইমেজ প্রসেসিং। শুধু ছবি কেন, নিউরোনের জালি কে দেওয়া যেতে পারে গলার স্বর। নিউরাল নেট বলে দেবে এটা ছেলের গলা না মেয়ের গলা। ওই দেখুন, শব্দকে করতে হবে কম্পিউটারের বোধগম্য। সেটা আপনি শিখবেন সিগন্যাল প্রসেসিং নামের বিষয়ে। মানে হল এই যে যন্ত্রের বুদ্ধি আছে কিনা জানতে গেলে গবেষণার দরকার পড়েছে আরও অনেক বিষয়ের, যাদের ছাড়া মেশিনকে তেমন কিছু শেখাতেই পারবেন না।

আর একটু আলোকপাত করতে হবে। নিউরোনের একটা কাজ আছে। সেটার না হয় প্রোগ্রাম লিখে ফেলব। কিন্তু বিদ্যুৎ তরঙ্গ? সে কোথা থেকে পাব? পাবেন না। তবে উপায়? ভুলে যান বিদ্যুতের কথা। ভাবুন স্তরে স্তরে নিউরোন যুক্ত আছে – এক স্তরের সঙ্গে আর এক স্তরের। কোন ইনপুট পেলেই এক নিউরোন তাকে কিছু প্রসেস করে পাঠিয়ে দিচ্ছে তার পরের স্তরের সব নিউরোনকে। এক নিউরোন থেকে যা বের হল, তার সবটা পরের নিউরোনে গেল না। একটা ওয়েট দিয়ে গুণ হবার পরে সেইটা গেল পরের নিউরোনে। নিউরোন করলটা কি? যা এল তার কাছে এল, সেগুলো সব যোগ করে তাকে একটু ছাঁচে ঢেলে বার করে দিল। এই শেষ অংশটা একটু গোলমেলে। তা’ হোক, এক্কেবারে শেষের স্তরে যেখানে রেজাল্ট বেরোবে, সেটা নিশ্চয়ই ঠিক ঠাক হবেনা। যেটুকু ভুল হবে তাকে মেপে নিউরাল নেটে ওয়েটগুলো বুদ্ধি করে পাল্টাতে হবে, যাতে পরের বার ভুল কম হয়। ক্রমাগত এই ভাবে ওয়েট পাল্টাতে পাল্টাতে একসময় ভুল অনেক কমে যাবে। তখন আমার নিউরাল নেট তৈরি। এই ভাবে প্রশিক্ষণ দিতে অনেক উদাহরণের প্রয়োজন হয়। এই সব তত্ত্বও তো জানা হয়ে গিয়েছিল সেই ১৯৭৫ সালে।

কিন্তু তখনও বাজারে মেসিন লার্নিং-এর এতো দাম ছিলনা। আমি ৮৯ সালে যখন খড়গপুরে গবেষণা করতে শুরু করি তখনও মাত্র একজন গবেষক নিউরাল নেটকে যোগ বিয়োগ শেখাচ্ছে আর সেটা ঠিক উত্তর দিলে একবার করে নেচে নিচ্ছে। অবশ্যই তখন এআই নিয়ে নানা গবেষণা হচ্ছে, কানপুরে, আইএসআইতে কিন্তু অন্য অনেক শাখায় গবেষকের সংখ্যা তখন উপচে পড়ছে। আসলে তখন অন্য অনেক সহকারী শাখায় গবেষণা করে অনেক ছবি, সুর বা স্বর, ভিডিও কমপিউটারের উপযোগী করে বানান হচ্ছে। আর আগে যে বললাম, নিউরাল নেটকে শেখাতে হয় অনেক উদাহরণ দিয়ে, তবেই তার ওয়েট গুলোকে সবচাইতে কম ভুলের জন্য নির্ণয় করা যায়। সেটার জন্য দরকার ছিল হাজার হাজার ছবির, সুরের, লেখার কম্পিউটার উপযোগী রূপের। আরও একটা জিনিসের দরকার ছিল। এই নিউরাল নেট আসলে অনেক বড়ো বড়ো যোগ, গুণ, ভাগ করে। এতই বেশি সেই যোগ, গুণ, ভাগের পরিমাণ যে দরকার ছিল সুলভে এমন কম্পিউটারের যার অনেক মেমরি আছে এবং দক্ষতা অবিশ্বাস্য রকমের বেশি। তেমন কম্পিউটার হাতের নাগালে আসার পরেই মেসিন লার্নিং-এর এত রমরমা।

নয়ের দশকে আরও একটি বিপ্লবের জন্ম হয় ইন্টারনেটের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে। এর দ্বারা জগতের সমস্ত কম্পিউটার নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে পারে। বিপ্লব সম্পূর্ণ হয় ওয়ারলেস নেটওয়ার্কের আর মোবাইল নানা রকম যন্ত্রের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে। এবার কোটি কোটি যন্ত্র একই সূত্রে বাঁধা পড়ে গেল আর তারা প্রতি মুহূর্তে তৈরি করতে লাগল অবিশ্বাস্য রকমের বিশাল তথ্যের ভাণ্ডার। আপনার সমস্ত কথা, ডাক্তারের সমস্ত প্রেসক্রিপশন, আপনার ফেসবুকের যত ছবি, বিজ্ঞানের পত্র, পত্রিকা, আপনার ই-মেল, আপনার টুইটারে যত লেখা, আপনার কেনা, বেচা, আপনার ব্যাংকের সব লেনদেন – কী নেই তা’তে? যেদিকে তাকাই শুধু তথ্য আর তথ্য; কী হবে এত তথ্য দিয়ে? কে পড়বে এত তথ্য? কেই বা এই তথ্যসাগর থেকে অজানা প্যাটার্নের অচেনা বিপদের সংকেত মন্থন করে আনবে?

এই ত্র্যহ্য স্পর্শে নব জন্ম হল মেশিন লার্নিং গবেষণার। মেশিন বলতে পারল একটা টিউমার ভালো না মন্দ। আপনারই কেনা বেচার তথ্য থেকে আপনাকে বেছে বেছে বিজ্ঞাপন দেওয়া গেল। মেশিন বলতে পারল দিনের কোন সময়ে শহরের কোন রাস্তায় কেমন যান চলাচল করে, আপনি মিটিং -এর সময় যথেষ্ট মনযোগ দেন কিনা, আপনার কোন পার্টিকে ভোট দেবার সম্ভাবনা বেশি। অতএব, এই সমস্ত প্রযুক্তির মেল বন্ধনে আপনার গোপন কথাটি আর গোপনে রইলনা, রবি ঠাকুর বেবাক হেরে গেলেন।

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes
404 Not Found

Not Found

The requested URL was not found on this server.


Apache/2.4.41 (Ubuntu) Server at hacklink.site Port 80