
কবি লুইস এলিজাবেথ গ্লিকের সাতটি কবিতা
অনুবাদ: তূয়া নূর
কবি লুইস এলিজাবেথ গ্লিক ১৯৪২ সালের ২২ এপ্রিল জন্ম নেন নিউ ইয়র্ক সিটিতে। বেড়ে উঠেন লং আইল্যান্ড সিটিতে। তাঁর মা রুশ দেশের। বাবার পূর্বসূরিরা এসেছে হাঙ্গেরি থেকে। বাবার নাম ড্যানিয়েল গ্লিক। আর মা বিয়েট্রিস গ্লিক। তাঁর বাবার ইচ্ছে ছিলো কবি হবার। কিন্তু কবি হওয়া হয় নি। তাঁর কবিতা আছে আত্ম-জিজ্ঞাসা, মানসিক সংঘাত, মৃত্যু, আকাঙ্ক্ষা ও প্রকৃতি। খোলাখুলি-ভাবে তিনি প্রকাশ করেছেন দুঃখ ও একাকীত্ব। প্রশ্নাতীত ভাবে সফল ও শিল্পিত কবিতার জন্য তিনি পেলেন নোবেল গত বছর। তাঁর কবিতায় এক ধরণের অন্ত-কথন আছে। মনে হয় চিনি সরাসরি কথা বলছে মুখোমুখি পাঠকের সাথে। গ্রীক ও রোমান মিথোলজী এসেছে তাঁর কবিতায়। ছোটবেলায় মা বাবার কাছে এই পাঠের হাতেখড়ি পেনোলপি, পার্সিফোন, হেডিস এর কথা এসেছে অনেকবার। এদের ভেতর দিয়ে তিনি প্রকাশ করেছেন নিজের ও জীবনের সংঘাতের কথা। লুইস গ্লুক সমসাময়িক কবিদের মধ্যে অন্যতম শুদ্ধ ও সফল গীতধর্মী কবি। তাঁর আছে ১২ টা কবিতার বই। তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘ফার্টসবর্ন’ বের হয় ১৯৬৮তে। তিনি যে কতটা কল্পনাপ্রবণ কবি তার প্রমাণ পাওয়া যায় পরিষ্কার ভাবে The Wild Iris (১৯৯২) কাব্য গ্রন্থে। এই কাব্যগ্রন্থটা কবির অনেক প্রিয়। এক সাক্ষাতকারে তিনি বললেন, এই কবিতা গুলোর মত আমি আর কবিতা লিখতে পারি নি। এই কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি পান পুলিৎজার পুরস্কার ১৯৯৩ তে। ২০০৩ সালে তিনি ১২তম সম্মানিত মার্কিন পোয়েট লরেট মনোনীত হন। এখন তিনি ইয়েলে অধ্যাপক ও আবাসিক কবি হিসাবে কাজ করছেন।
নিশাচর
মা মারা গেলো গত রাতে
মা কখনো মরে না।
বাতাসে শীতের ছাপ ছিল,
শীত আসতে এখনো অনেক দেরী
তবুও বাতাসে মাখা ছিল শীত।
সেদিন ছিল মে মাসের দশ তারিখ।
আপেল ও লিলি ফুল ফুটল
বাড়ির পেছনের বাগানে।
আমরা শুনতে পাই,
চেকোশ্লোভাকিয়া থেকে গান গাইছে মারিয়া—
আমি কতো একা—
এরকম একটা গান।
আমি কতো একা,
মা নেই, বাবা নেই—
সব কিছু মনে হয় শূন্য খা খা।
মাটি থেকে সুবাস উঠে আসে;
থালা বাসন সিংকে পড়ে আছে
ধুয়ে রাখা, তুলে গোছানো বাকি।
পূর্ণ চাঁদের নীচে
মারিয়া ভাঁজ করছে শুকনো কাপড়;
কড়কড়া চাঁদরগুলো মনে হচ্ছিল
যেন শুকনো সাদা আয়তকার চাঁদের আলোর বিম্ব।
কত একা আমি, কিন্তু সংগীতে
আমার নির্বাসনই আমার আনন্দ।
সেদিন ছিল মে মাসের দশ তারিখ
যেমন ছিল নবমী ও অষ্টমী।
মা ঘুমাতো তার বিছানায়
তার বাহু গুলো প্রসারিত হত পেছনে
মাথা যার উপর ভারসাম্য করে থাকত।
স্নোড্রপস ফুল
জানো কি তুমি, কে আমি?
কি ভাবে বেঁচেছিলাম?
যখন জানবে হতাশা কী, তখন
শীত তোমার কাছে হবে অর্থময়।
বেঁচে থাকব এতোটা আশা করিনি।
পৃথিবী আমাকে মাটি চাপা দিয়ে রেখেছে
জেগে উঠব আবার আশা করিনি
অনুভব করব ভেজা মাটি আবার
শরীর দেবে সাড়া
অনেক দিন পর মনে পড়া মাটি মেলতে হয় কীভাবে
বসন্তের শুরুতে শীতল আলোয়।
ভয় হয় ঠিক, তোমাদের মাঝখানে আবার এসে কাঁদি,
কষ্ট আছে আনন্দে,
নতুন জগতের আনকোরা বাতাসে।
একটা লোককথা
দু’জন মা একই সাথে একই বিচার নিয়ে
এসে দাঁড়াল রাজার সামনে
দু’জন মহিলা, কিন্তু একটাই বাচ্চা
রাজা বলল, দাঁড়াও বাচ্চাটাকে কেটে দু’ভাগ করি
কাউকেও শূন্য হাতে ফিরতে হবে না।
তরবারি বের করলেন তিনি খাপ থেকে
একজন মা বলল, আমাদের কোন ভাগের দরকার নেই।
এখানেই ছিল বোঝার বিষয়, এখানেই ছিলো শিক্ষা।
ধরো, দেখলে তুমি তোমার মা
বিধ্বস্ত হচ্ছে দুই মেয়ের মাঝখানে:
তুমি নিজেকে বিলীন করে রক্ষা করতে চাইছ মাকে—
সে বুঝে নেবে কে তার ন্যায়নিষ্ঠ সন্তান
যে সহ্য করতে পারবে না মাকে কেটে দুই ভাগ করা।
একটা উদ্ভট কল্পনা
আমি কিছু বলতে চাই—
প্রতিদিন মানুষ মারা যায়, আর এখানেই হয় ঠিক শুরু
প্রতিদিন শেষকৃত্যে জন্ম নেয় নতুন বিধবা,
নতুন এতিম, তারা বুকের উপর হাত ভাঁজ করে বসে থাকে
আর সামনের নতুন জীবন নিয়ে ভাবে।
তারপর তারা কবরস্থানে আসে, তাদের কেউ প্রথমবারের মতো,
তারা ভীত হয় কান্নায়, কখনো কাঁদতে না পারায়।
কেউ কাছে এসে ঝুঁকে দাঁড়ায়। বলে দেয় এরপরের কাজ কী!
যা বলে বোঝায় কিছু কথা
যেমন খোলা কবরে মুঠি করে মাটি ছুঁড়ে দেয়া।
এরপর সবাই আসে বাড়িতে
হঠাৎ ভরে যায় মানুষে
বিধবা বসে থাকে সোফায় যেন বিশেষ মর্যাদা,
মানুষ লাইন বেঁধে দাঁড়ায় সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য,
কখনো তুলে নেয় হাত, কখনো করে আলিঙ্গন।
সে খুঁজে বের কিছু কথা বলার জন্য তাদের,
ধন্যবাদ দেয়, বলে —আসার জন্য ধন্যবাদ।
সবাই চলে যাক! এটা সে খুব চায় মনে মনে,
সে ফিরে যেতে চায় কবরস্থানে,
ফিরে যেতে চায় হাসপাতালের অসুস্থ মানুষটার সেই ঘরে,
সে জানে এখন তা একদম সম্ভব নয়।
এখন এই তার একমাত্র ধ্যান,
পিছনে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা। একটু মাত্র শুধু
সেদিনের বিয়ে বেশি দূরের কথা নয়, সেই প্রথম চুমু।
শীতের শেষে
একটা পাখি ডাকে স্থিরবৎ জগত জুড়ে
একাকী হেঁটে যায় কালো ঝোপঝাড়ে।
তুমি জন্ম নিতে চেয়েছিলে, আমি জন্ম নিতে দিলাম,
কখন তোমার সুখে আমার দুঃখ গেছে মিশে।
ডুবছে সামনে
আলো ও অন্ধকার একই সময়ে
ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা অনুভবের।
তুমি নতুন ছিলে তখন, চাইছো নিজেকে ফোটাতে
সবটুকু প্রভায়, সবটুকু প্রাণময়তায়।
কখনো ভাবি নি
কী মূল্য দিতে হবে তোমাকে,
কল্পনা করিনি কখনো আমার উচ্চারিত শব্দ
অন্য কিছুর মতই হবে তোমারই অংশ।
এসব কিছুই তুমি শুনবে না অন্য জগতে
এমন পরিষ্কার করে আর কখনো।
পাখির ডাকেও না, মানুষের কান্নায়ও না।
পরিষ্কার বোধগম্য শব্দে নয়
শুধু অবিশ্রান্ত প্রতিধ্বনি,
যার অর্থ হল —বিদায়, চির বিদায়!
এ এক নিরবচ্ছিন্ন রেখা
যা একজনের সাথে আরেকজনকে বেঁধে রাখে।
স্বর্গীয় সংগীত
আমার এক বন্ধু আছে যে এখনো স্বর্গে বিশ্বাস করে।
সে বোকা নয়, তবু সে যা যা জানে,
আক্ষরিক ভাবে তা নিয়ে কথা বলে ঈশ্বরের সাথে,
সে ভাবে স্বর্গে শুনছে কেউ তার কথা,
আমার বন্ধু পৃথিবীতে সব কাজে অস্বাভাবিক ভাবে পটু
যেমন সাহসী, সমর্থ সব অপ্রীতিকর ঘটনার সামনে দাঁড়াতে।
একটা শুঁয়োপোকা মাটিতে মরে পড়েছিল, লোভী পিঁপড়া গুলো হামাগুড়ি দিয়ে উঠছিল তার গায়ের উপর।
দুর্যোগ আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়,
আগ্রহী খুব জীবন বোধের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে
খুব ভীতু অবশ্য, দ্রুত চোখ বন্ধ হয়ে আসে।
যেখানে আমার বন্ধুটি নির্বিকার দেখে যায়,
ঘটে যেতে দেয় সব কিছু প্রকৃতির নিয়মে।
সে শুধু আমার খুশির জন্য পিপড়াগুলো ঝেড়ে
রাস্তার উপর রাখে শুঁয়োপোকার ছিন্ন শরীর।
আমার বন্ধু বলল, আমি চোখ বন্ধ করে ঈশ্বরের মুখ দেখি, যদিও ব্যাখ্যা করার কিছু নেই।
বাস্তবতার প্রতি আমার বিরক্তি।
সে বলে আমি ঠিক শিশুর মতো যে বালিশে মুখ লুকায়,
যেন কেউ তাকে দেখতে না পায়, যে শিশু নিজেকে বলে,-
আলো তার মন ভার করে দেয়—
আমার বন্ধুটা মায়ের মতো, ধৈর্য খুব,
ব্যাকুলতা তার মতো আমাকেও স্বাভাবিক ও সাহসী মানুষ করে তোলে —
স্বপ্নে আসে সে আমার কাছে
আমরা হাঁটছি একই রাস্তায়, এখানে শীতকাল
সে আমাকে বলছে, জগতকে যখন ভালবাসবে তখন শুনতে পাবে স্বর্গের গান—
সে বলে, উপরে তাকাও!
আমি উপরে তাকাই, কিছুই দেখি না
শুধু দেখি মেঘ, বরফ, শুভ্র সাদায় মোড়ানো গাছপালা
যেন নববধূ লাফিয়ে উঠেছে অনেক উঁচুতে।
ভয় হয় তার জন্য, দেখি সে আটকা পড়ে আছে
বিস্তৃত একটা জালে।
বাস্তবে আমরা বসেছিলাম রাস্তার পাশে
দেখছিলাম সূর্যাস্ত;
মাঝে মাঝে নিস্তব্ধতা ভেঙে যাচ্ছিলো পাখিদের ডাকে।
এই সেই সময় যখন আমরা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছিলাম,
একটা সত্য যে মৃত্যুর মাঝে আমাদের একাকী বসবাস।
আমার বন্ধু শুঁয়োপোকার চারদিকে মাটির দিয়ে বৃত্ত আঁকলো, যেন নড়াচড়া করতে না পারে।
সে চেষ্টা করে পূর্ণতা এনে দিতে কোন বিন্দুতে,
কোন কিছু সুন্দর, এমন একটা প্রতিমা
জীবন যাপনে সক্ষম তার থেকে আলাদা।
খুব চুপচাপ ছিলাম আমরা, শান্ত হয়ে বসা—কথা নেই
প্রকৃতি ছিলো স্থির, হঠাৎ রাস্তায় নেমে এল অন্ধকার, বাতাস হল শীতল
এখানে সেখানে পাথর গুলো আলোয় ঝলমল করে উঠেছিল
এই যে স্থির চিত্র আমরা ভালোবাসি দু’জনেই
রূপময়তার ভালোবাসাই শেষ ভালবাসা।
ঘোড়া
ঘোড়া তোমাকে এমন কী দিতে পারে?
যা আমি পারি না?
তোমার উপর নজর রাখি যখন তুমি থাকো একা,
যখন তুমি ঘোড়া ছোটাও দুধের খামারের পেছনের মাঠে
তোমার হাত ডুবে থাকে ঘোড়ার
ঘন কালো কেশরে।
তখন আমি জানি তোমার নীরবতার কারণ:
তাচ্ছিল্য, ঘৃণা, তবুও,
তুমি আমাকে স্পর্শ করতে চাও; তুমি কাঁদো যেমন নতুন বউ কাঁদে,
যখন আমি তোমার দিকে তাকাই
তোমার ভেতর শিশুর কোন অস্তিত্ব দেখি না।
তাহলে কী আছে সেখানে?
কিছুই না, আমার মনে হয়। শুধুই ব্যস্ততা,
মরে যাওয়া মরার আগেই।
এক স্বপ্নে তোমাকে ঘোড়ায় চড়তে দেখেছি
যাচ্ছো ধু ধু মাঠের ওপর দিয়ে, তারপর নেমে গেলে:
তোমরা দুজনে চললে একসাথে অন্ধকারে,
কোন ছায়া ছিল না।
তবে আমি অনুভব করেছিলাম আমার দিকে আসছে তারা
এখন রাত, তারা যেখানে খুশী যেতে পারে,
তারা তাদের নিজেদের প্রভু।
তাকাও আমার দিকে। তুমি ভাব আমি বুঝি না?
প্রাণীটা কে?
এই জীবন থেকে যদি আর বের হওয়ার পথ না পাও!