এতগার কেরেট-এর গল্প
অনুবাদ ও ভূমিকা- সুদীপ বসু
এতগার কেরেট-এর জন্ম ২০ অগাস্ট, ১৯৬৭, ইজরায়েলের তেল আভিভে। পোলিশ মা-বাবার তৃতীয় সন্তান কেরেটের পোল্যান্ড ও ইসরায়েল দুটি দেশেরই নাগরিকত্ব আছে। প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘পাইপলাইন্স’ বেরোয় ১৯৯২-এ। দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘মিসিং কিসিংগার’ (১৯৯৪) পাঠকমহলে রীতিমতো তোলপাড় ফেলে দেয়। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গল্পের সংকলনের ভেতর রয়েছে ‘দা বাস ড্রাইভার হু ওয়ান্টেড টু বি গড এ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ ‘দা গার্ল অন দা ফ্রিজ’ প্রভৃতি। টেলিভিশনের জন্য অসংখ্য চিত্রনাট্য লিখেছেন কেরেট। পুরস্কৃত হয়েছেন ‘জেলিফিশ’ ছবিটি পরিচালনার জন্য। সাহিত্য ও সিনেমা দুটো ক্ষেত্রেই পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় পুরস্কার। কেরেটের ভাষা ছাপোষা, আপাতভাবে প্যাঁচপয়জারহীন। ঘটনার গতি সরলরৈখিক। জটিলতা যা কিছু, তির্যক চোরাপ্যাঁচ যা কিছু সব ভাবনার জগতে, দেখার দুনিয়ায়। চরিত্রগুলিও সাদামাটা। রোজকার জীবন থেকে উঠে আসা। অনেক সময় মনে হয় অস্তিত্বের বেদনা যেন তাঁর ঠাট্টার বিষয়। বাস্তবপরাবাস্তবের রূপকার কেরেট মনে করেন ছোটোগল্পের সম্ভাবনা অসীম। ‘অনেক রাতে’ গল্পটি ‘ফ্লাই অলরেডি’ বইটি থেকে নেওয়া। বাকি দুটি গল্প ‘দা গার্ল অন দা ফ্রিজ’ বইটিতে পাওয়া যাবে। এতগার কেরেটের গল্প। অনুবাদ ও ভূমিকা- সুদীপ বসু
অনেক রাতে
অনেক রাতে, যখন সারা পৃথিবী ঘুমিয়ে কাদা, মা চোখ বন্ধ করে জেগে থাকে। অনেকবছর আগে, তখন কিশোরী, মা মনেপ্রাণে বিজ্ঞানী হতে চাইত। মা স্বপ্ন দেখত তিনটে অসুখের ওষুধ আবিষ্কার করবে – নিউমোনিয়া, ক্যানসার আর মনখারাপ। ছোটবেলা মা’র পরীক্ষার খাতাপত্র ছিল পরিচ্ছন্ন, ঝকঝকে আর রেজাল্ট ছিল তুখোড়। ওষুধ আবিষ্কারের পাশাপাশি মা চাইত মহাশূণ্যে পাড়ি দিতে অথবা একটা ফুটন্ত আগ্নেয়গিরির দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকতে। কিন্তু মা’র জীবনে কোথাও একটা কোনো বড়সড় গোলমাল হয়ে যায়। ভালোবেসেই বিয়ে করেছে মা, নিজের পছন্দের বিষয় নিয়েই কাজ করে, ঘরে একটা ছোট্ট মিষ্টি ছেলেও আছে। তবু মা সারারাত ঘুমোতে পারে না। অবশ্য এর একটা কারণ হতে পারে এই যে, বাবা যে সেই ঘন্টাখানেক আগে বাথরুমে গেছে এখনও পর্যন্ত বিছানায় ফিরে আসেনি।
অনেক রাতে, যখন সারা পৃথিবী ঘুমিয়ে কাদা, বাবা খালি পায়ে বারান্দায় পায়চারি করে। অস্থিরভাবে। আর ঘন ঘন সিগারেট ধরায়। আর ধারদেনার চিন্তায় ডুবে থাকে। ঘোড়ার মতো পরিশ্রম করে বাবা। কত কষ্ট করে টাকা বাঁচায়। তবু সবকিছুই আজ বাবার হাতের বাইরে চলে গেছে। সেদিন ক্যাফেতে ওই গয়নার দোকানের লোকটা বাবাকে টাকা ধার দিয়েছিল। খুব শিগগিরি তা শোধ দিতে শুরু করতে হবে। বাবা আকাশ পাতাল হাতড়েও ঠাহর করতে পারে না কীভাবে তা শুরু করা যাবে। সিগারেটটা শেষ হয়ে গেলে, জ্বলন্ত টুকরোটা বাবা রকেটের গতিতে বারান্দা থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। নিজের ছেলে যখন লজেন্সের মোড়কটা রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে, বাবা সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে ওঠে ‘রাস্তা নোংরা কোরো না’। কিন্তু এখন তো অনেক রাত। তাছাড়া বাবা খুব ক্লান্ত। তাছাড়া মাথায় এখন একটাই চিন্তা পাগলের মতো ঘুরপাক খাচ্ছে – টাকা টাকা আর টাকা।
অনেক রাতে, যখন সারা পৃথিবী ঘুমিয়ে কাদা, ছেলেটা লম্বা আর ক্লান্তিকর সব স্বপ্নের ভেতর ডুবে যায়। একটা কাগজের টুকরো জুতোয় আটকে গেছে। কিছুতেই তোলা যাচ্ছে না। তাকে নিয়ে স্বপ্ন। উফ্। মা একবার বলেছিল, স্বপ্ন আসলে আমাদের মস্তিষ্ককে তার নিজেরই বলা গল্প। যদিও ওই একই স্বপ্ন, সিগারেটের গন্ধ আর জমাজলে ভরা, প্রতিরাতেই ফিরে ফিরে আসে। ছেলেটা ধরতেই পারে না স্বপ্নটা আসলে কী বলতে চাইছে। ছেলেটা ঠান্ডা বিছানায় ছটফট ছটফট করে। আর ভাবে কখন বাবা বা মা এসে গায়ে শীতের চাদর ঢাকা দিয়ে যাবে। ভাবে জুতোর থেকে কাগজের টুকরোটাকে যেদিন একেবারে তুলে ফেলা যাবে, যদি আদৌ যায়, একটা নতুন স্বপ্ন হয়তো এলেও আসতে পারে।
অনেক রাতে, যখন সারা পৃথিবী ঘুমিয়ে কাদা, অ্যাকোরিয়াম থেকে সোনালী গোল্ডফিশটা বেরিয়ে আসে। বাবার ছেড়ে যাওয়া চেককাটা হাওয়াই চটিটা পায়ে গলিয়ে নেয়। তারপর বসার ঘরে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বসে টি.ভি-টা চালিয়ে দেয়। ওর প্রিয় শোগুলো হল কার্টুন, নেচার চ্যানেল অথবা সি.এন.এন. –– বিশেষ করে যখন কোনো জঙ্গী হানা বা বিপর্যয়ের ছবি সরাসরি টেলিকাস্ট করা হয়। গোল্ডফিশ টিভিটা মিউট করে দেয়, যাতে কেউ টের না পায়। ভোর ৪-টে নাগাদ ও ফিরে যায় অ্যাকোরিয়ামে। বাবার স্যাঁতস্যাঁতে হাওয়াইচটি ছেড়ে যায় ঘরের মাঝখানে। মা যে সকালে বাবাকে এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারে, তোয়াক্কাই করে না।
অ্যাজমার আক্রমণ
যখন তোমার হাঁপানি শুরু হয়, তোমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। যখন শ্বাস বন্ধ হ’য়ে আসে, কথা বলা প্রায় অসম্ভব হ’য়ে পড়ে। একটা গোটা বাক্য উচ্চারণ করতে গেলে যা দরকার তা হলো ফুসফুসে যথেষ্ট হাওয়ার সঞ্চার, যা তখন কমে আসে। তিনটে থেকে ছটা শব্দ, ব্যাস ওই-ই অনেক। আর ঠিক তখনই তুমি শব্দের সত্যিকারের ওজন টের পাও। মাথার ভেতর শব্দরা জট পাকিয়ে যায়, ঘূর্ণির মতো ঘুরতে থাকে। শুধুমাত্র একান্ত দরকারী শব্দটার জন্য অন্ধকার হাতড়ে মরো তুমি, দরকারী আর দামী। সুস্থ লোকেরা শব্দ নিয়ে যাচ্ছেতাইভাবে খরচ করে করুক, যেভাবে ডাস্টবিন লক্ষ্য করে তুমি জঞ্জাল ছুঁড়ে দাও। কিন্তু তোমার ব্যাপারটা আলাদা। ধরো একজন অ্যাজমারোগী কাউকে বলল ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’। আবার ধরো সে বলল ‘আমি তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসি’। এ দুটোর মধ্যে কিন্তু বিরাট ফারাক। দুটো শব্দের ফারাক – ‘পাগলের’ আর ‘মতো’। কম নয়! দু-দুটো শব্দ বেশি উচ্চারণ করা। ক্যাপসুলের প্রয়োজন পড়তে পারে। অথবা ইনহেলারের! এমনকি …. তেমন হলে অ্যাম্বুলেন্সেরও!
মজাদার রঙ
ড্যানি তখন মাত্র ছ’বছরের যখন সে প্রথম ওই ‘সাপ্তাহিক রঙ-করো’ প্রতিযোগিতায় নাম লেখায়। বাচ্চাদের কাজ ছিল ইজ্যাককাকার হারানো পাইপটা খুঁজে বার করে সেটাকে মজার রঙে রঙিন করে দেওয়া। ড্যানি পাইপটা খুঁজে পায় এবং মজাদার সব রঙ দিয়ে সেটাকে ভরিয়ে দেয়। পুরস্কার হিসেবে জিতে নেয় ‘ন্যাশনাল ল্যান্ডস্কেপ এনসাইক্লোপেডিয়ার’ গোটা সেট।
সেই শুরু। এরপর সে ইউয়্যাভকে তার হারানো কুকুরছানা ‘হিরো’কে খুঁজে পেতে সাহায্য করে। ইয়ায়েল ও বিলহাকে খুঁজে দেয় তাদের হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট বোন আর ড্যানিরই সাহায্যে পুলিশকর্মী অ্যাভনার খুঁজে পায় তার হারানো পিস্তল। শুধু তাই নয় অ্যামি ও অ্যামির নামক দুই সেনানীর হারিয়ে যাওয়া প্যাট্রল জিপটির হদিশ তো সে-ই প্রথম দিয়েছিল। তবে কেবল খুঁজে দেওয়াই নয়, উজ্জ্বল উচ্ছল রঙে এদের রাঙিয়ে দেওয়াতেও তার ছিল সমান উৎসাহ।
শিকারি জায়ির ড্যানিরই অদম্য চেষ্টায় খুঁজে পায় ঘাপটি-মেরে-থাকা খরগোশটিকে, রোমান সৈন্যরা যীশুকে, চার্লস ম্যানসন শোবার-ঘরে-লুকিয়ে-থাকা শ্যারন টেটকে, আর সার্জেন্ট জোন্স ফেরার-হয়ে-যাওয়া সাদ্দাম হুসেনকে। প্রত্যেকবারই ফিরে আসা জন্তু বা মানুষকে মজাদার রঙে রঙ করে দেয় ড্যানি।
সে জানে তার এই গোয়েন্দাগিরির জন্যে লোকে তাকে আড়ালে ‘টিকটিকি’ বলে আওয়াজ দেয়। কিন্তু তাতে তার কিছু যায় আসে না। তারই জন্যে জর্জ খুঁজে পায় নোরিয়েগাকে, নাৎসিরা আনা ফ্রাঙ্ককে আর রোমানিয়ার জনগণ চশেস্কুকে। আর এই তিন পলাতককেই ড্যানি উজ্জ্বল রঙ ভরিয়ে দেয়।
এর ফলে দুনিয়ার তামাম জঙ্গীরা আর স্বাধীনতাযোদ্ধারা টের পায় যে লুকিয়ে থেকে আর কোনো ফায়দা হবে না। অনেকটা মরিয়া হয়েই তারা নিজেরাই নিজেদের গায়ে রঙ মাখতে শুরু করে। তারা আশা হারিয়ে ফেলে। ধীরে ধীরে মানুষ নিয়তির বিরুদ্ধে লড়বার শক্তি হারিয়ে ফেলতে থাকে। গোটা পৃথিবী অবসাদে ডুবে যায়। ড্যানিরও মন ভেঙে যায়। এই যে তার একঘেয়ে কাজ – খুঁজে বার করা আর রঙ করে দেওয়া – এ কাজে সে ক্রমশ উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। তার মনেও আর কোনো উদ্যম থাকে না। শুধুমাত্র নিয়ম আর তাড়নার বশে সে একাজ করে যেতে থাকে।
এছাড়াও পুরস্কারে পাওয়া সেই ‘ন্যাশনাল ল্যান্ডস্কেপ এনসাইক্লোপেডিয়ার’ সেটের সাতশো আঠাশটি বই রাখবার মতো জায়গার সংকুলানও সে কোথাও করে উঠতে পারে না।
দুনিয়াতে আর কিছুই মজাদার থাকে না কেবলমাত্র ওই বাহারি রঙগুলো ছাড়া।
পড়ে ভালো লাগল