ঋজুরেখ চক্রবর্তীর কবিতা
শীতের কবিতা
সহস্র রজনী পার করা কোনও নাটকের শেষবারের মতো যবনিকাপতনের পর সেই অন্তিম কার্টেইন কলে মঞ্চের মাঝখানে হাতজোড় করে গিয়ে দাঁড়াতে ঠিক কেমন লাগে তা তোমার অভিজ্ঞতার পরপারে। কিন্তু তোমার শোবার ঘরের উত্তরের খোলা জানলাটা দিয়ে অদূরেই ঝাঁক ধরা একরাশ বোগেনভিলিয়ার পাপড়ি ছুঁয়ে হিম ঠান্ডা হাওয়া যখন তোমার শেষ চুম্বনের স্বাদ ভুলে যাওয়া ওষ্ঠাধরে এসে কামড় বসাতে চায়, তুমি জান সেই তূর্য বিপন্নতার কোনও নাম নেই, অভিধা নেই, বংশপরিচয় নেই, কোনও স্বপ্ন কিংবা পিছুটান ─ কোনওটাই নেই, কোনও মালিন্যও নেই।
অথচ কোনও মালিন্য যে নেই, কী আশ্চর্য, সেটাই শুধু মাঝেমাঝে গোপন ব্যথার মতো পীড়া দেয় তোমাকে, যা মুখ ফুটে স্বীকার করবে না তুমি কোনওদিন! এই যে তুষের চাদরে মুড়ে রাখা হারানো সাম্রাজ্যের ঈষৎ হলদে হয়ে যাওয়া মানচিত্র, যার নদীপথগুলি সরু থেকে আরও সরু হতে থাকা শিরা-উপশিরার মতো একদিন নিরবধি বেদনা বহন করে নিয়ে যেত, তুমি একে সযত্নে বুকের কাছে ধরে রেখে হাওয়ার কম্পনে একা কম্পাসের কাঁটার মতো স্থির দাঁড়িয়ে আছ, তোমাকে যে মালিন্য আর মানায় না তা তুমি জান।
জানলার বাইরে হিম ঠান্ডা হাওয়ার মধ্যে মুখ বাড়িয়ে ঝুঁকে নীচে তাকালে তুমি দেখতে পাবে ধরিত্রীর আর্দ্র করতলে রাশি রাশি বোগেনভিলিয়ার পাপড়ি বিছিয়ে রাখা আছে ─ কে যেন তার সহস্র আবিলতার শেষে অন্তিম উপাসনায় বসবে।
বসন্তের কবিতা
এই যে শীত চলে গেলে নির্লিপ্তির চেয়েও বড় হয়ে ওঠে আকাশ আর তোমার বাড়ির সামনের নাম-না-জানা গাছটায় সৌজন্যবশত একটা-দুটো করে নতুন পাতা গজাতে থাকে অতিথিবৎসল, বিগত জন্মে তুমি জেনেছিলে অবুঝ মানুষ তাদের অপচয়িত ঔদার্যের স্মারক হিসেবে এই সময়টার নাম রেখেছে বসন্ত। কী অপূর্ব ধ্বনিমাধুর্য এই নামের! যেন তুলনামূলক ব্যর্থতা ও সাফল্যের মাঝখানে তিরতির করে কাঁপতে থাকা সমূহ জীবনযৌবনধনমান তার অনন্ত নাশকতার সম্ভাবনা নিয়ে এই মাধুর্যের চোরাবালিতে ডুবে মরবে বলে ব্যাকুল হয়ে আছে। তুমি এর মধ্যে অস্বাভাবিকতা কিছু দেখনি। জগতে যা-কিছু করুণ তারই যে একধরনের মাধুর্য থাকে, এ তো আর নতুন কথা কিছু নয়! নতুন কথা যেটা─তোমার পক্ষে নতুন কথা যেটা─তুমি এই মাধুর্যের ভেতর গীতিকবিতার তারল্য খোঁজনি কোনওদিন, খুঁজেছ এক মরমিয়া নিষ্ঠুরতার প্রশ্রয়, যার রঙ পলাশ।
তুমি জান বিদায়ী বসন্তে ঝড় ওঠে উথালপাথাল, আর ঝড় থেমে গেলে বৃষ্টি নামে মুষলধারায়, সবই হয়, তবে তা ক্ষণিকের জন্য, তারপর সারা চরাচর দাউ দাউ পুড়ে যেতে থাকে।