আড়ালে আড়ালে ঘনিয়ে ওঠা দু-এক কথা
সরোজ দরবার
আবরণের আড়ালটুকু যদি সরিয়ে দেওয়া যায়, আবরণ বাঁচিয়ে রাখার এই প্রয়াসের যদি মরণ ঘটে পরমপ্রকাশ সম্ভব হয়, তবে তো আর পরাজয়ের কিছু থাকল না। যে সত্য, তাকেই চিনে, তার গলাতেই মালাটি গিয়ে পড়বে। কিন্তু সেইটে যদি না-হয়ে ওঠে! একদিনে তো এ লয় সম্ভব নয়, একজীবনের অনুশীলন প্রয়োজন। সেই সময়টুকুতে তাহলে কি আমাদের আড়ালটুকুকেও আঁকড়ে ধরা জরুরি! ধরা যাক, তখনও এই পর্বেও ছায়া ঘনিয়েছে বনে বনে। নবঘনবরিষণে গোপনে গোপনে এসেছে কেয়া। এলই যখন সে অভিসারে তখন দেখা হল মনে মনে। এই মনে মনে দেখা-হওয়া কি সেই মানসপ্রতিমার সঙ্গে? সম্ভবত তাই-ই। আমরা ভাবতে পারি, এখানে দুজনের মনই জড়িত। অর্থাৎ, যে এসেছে তার মনে আমার যে রূপ, আর আমার মনে তার যে রূপ, সেই দুই ভিতরঘরের সত্যি মানুষের সঙ্গে এখানে দেখা হচ্ছে। তাই বুঝি সে গোপনে এসেছে। নইলে আর কেন অভিসার! কীসের গোপনে আসা! সরোজ দরবারের লেখায়।
আড়ালের খোঁজ আমাদের পড়ে কখন? এই পৃথিবীর প্রায় সবকিছুই প্রকাশ্য। এই স্বয়ংপ্রকাশের ভিতর আড়াল খুঁজিই-বা কেন আমরা! অথচ খুঁজি যখন, তখন নিশ্চয়ই, এই সমূহ প্রকাশের ভিতর আর-একটা পৃথিবীর অস্তিত্ব কল্পনা করি নিশ্চয়ই। আর-এক নিজস্ব পৃথিবী তৈরি করে নেওয়া যায়, যদি থাকে এই প্রার্থিত গোপনীয়তা। কিন্তু তা কি প্রকাশের থেকে একেবারে ভিন্নতর কিছু? সম্ভবত, নয়। গোপন বলতে তাকে তো একেবারে অপ্রকাশ বলা যায় না। বরং সে-ও একরকমের প্রকাশ, কিন্তু সে-প্রকাশে হাটের ধর্ম নেই। পাপড়ির সঙ্গে বৃন্তের যোগাযোগ যেমন। চোখে পড়ে না তেমন। গভীর তবু গোপন এই যোগাযোগই ফুলের প্রকাশ সম্ভব করে তুলেছে। সম্ভব করে তুলেছে প্রাণের বহুবর্ণিল উদ্ভাস। যে কোনও সৃষ্টির আগে স্রষ্টা যেমন তার ভিতরের কোনও এক সত্তার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। কামনা করেন আড়ালটুকু। যে-আড়ালে দেওয়া-নেওয়া সম্ভব।
আড়ালের খোঁজ তাই অস্বাভাবিক কিছু নয়। খোঁজ পড়েই। মানুষ তার ভিতরঘরটাকে আড়াল করে, করে রাখতে চায়। বাইরের ঘর সকলের জন্য, কিন্তু ভিতরের ঘরের সদস্য নির্দিষ্ট। এ দুইয়ের মধ্যে একটা পর্দার ব্যবধান থাকে। আবার একেবারে সদরের সঙ্গে রাস্তার বা পইঠার মাঝে আড়াল হয়ে থাকে দরজা। ঘর আর বাইরের ভিতর সে দাঁড়িয়ে থেকে এক পৃথিবীর দুটো স্বতন্ত্র পৃথিবীর নির্মাণ সম্ভব করে তোলে। এইখানে এসে আমরা বলতে পারি, আড়াল আমরা তখনই খুঁজি যখন আমরা একই সমতলে বাস্তবতার কয়েকটি স্তরবিন্যাস নিজেদের মনের মতো করে সাজিয়ে নিতে চাই। দুই স্তরের মধ্যে মধ্যে পর্দা হয়ে একরকমের আড়াল থাকে।
এখন, যদিও পর্দার আড়াল রইল, তবু ওই ভিতরঘরটুকুকে কি সত্যিই গোপন বলা যায়? বোধহয়, তেমন করে নয়। বিশেষত আজকের এই তথ্যের প্রাচুর্যের যুগে; মানুষ যেখানেই থাকুক-না-কেন, সে তো নজরদাররি আওতায়। গোপন বলে তেমন কিছু আর নেই। বড়ো চোখ মানুষের সবটাই দেখছে, সর্বক্ষণ। নিয়ন আলোয় যা কিছু ব্যক্তিগত পণ্য যখন সব হয়েইছে এতদিনে, তখন কীসের আর আড়াল সম্ভব হবে? এই বাস্তব মেনে নিয়েও বলা যায়, তবু দরজা হাট করে তো কেউ ঘুমোতে যায় না। কিছু আড়াল আবশ্যিক হয়ে ওঠে। যা কিছু ভিতর ঘরে স্বাভাবিক, তাকে কেউ বসার ঘরে টেনে আনে না। আর যদি কেউ আনে, তখন সমালোচনার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। আমাদের ভুরু বেঁকে যায়। এখানে, সঙ্গত-অসঙ্গত, শ্লীল-অশ্লীলের তুলনামূলক ক্ষেত্রটি এসে যায় এবং সেই নিয়ে তর্কবিতর্ক এসে জুটলেও, আমরা তাদের এখনই ধরব না, শুধু এটুকু অনুভব করব, সমবেতমানসে গাঁথা আছে এই বাইরের আর ভিতরের প্রভেদ। কোনটি বাইরে সুন্দর, কোনটি ভিতরে- তার একটা পূর্বনির্দিষ্ট ধারণা আমরা বহন করেই চলেছি। বাইরের ঘরে কিছু নিয়ম মেনে চলতেই হয়। সেই নিয়ম থেকে বেরোনো অনেকটাই সম্ভব ভিতরের ঘরে, সেখানে নিজের মতো করে থাকার স্বাধীনতা খানিক বেশি। যেমন আর-একটু বাইরে থেকে দেখলে, রাস্তা-আপিসে আমাদের চলাচল, কাজ করার যে একটা নিয়মবাঁধা অভ্যেস আছে, ঘরের ভিতর তার ফাঁস আলগা হয়ে আসে। ঘর, বাইরের এই ধারণাগুলি বদলে বদলে যায় ওই আড়ালটুকুর নিরিখেই। নইলে সমস্তটাই এক, একই হত। সে কি একঘেয়ে হত? আমরা জানি না, কেন-না সেরকম বাস্তবতার ভিতর বেঁচে থাকা আমাদের অভিজ্ঞতায় নেই।
কাজেই, যদি এই বাইরের ঘর আর ভিতরের ঘরের ভিন্নতাটুকু ঘুলিয়ে দেওয়া যায়, তাতে এসে লাগে ওই হাটের ধর্ম। কোলাহল, গুঞ্জন। বেচাকেনা, লাভের হিসেব। তার ভিতর একটা অস্থিরতা আছে। সে প্রতি মুহূর্তেই বিবর্তিত। চঞ্চল। কিছু-না-কিছু হচ্ছে। এই যে অনন্ত অস্থিরতা এ তো গোটা জীবনে কাম্য হতে পারে না। তাহলে প্রশান্তির সমস্তটুকু মুছে গিয়ে এক দীর্ঘ দাপাদাপি, দৌড় এসে আমাদের ঘিরে ধরে। এই দুটো ঘর ঘুলিয়ে যাতে না যায়, তা আমাদের খেয়াল রাখতে হয় বইকি। বাস্তবতার আলাদা আলাদা স্তরগুলোকে আলাদা করে রাখাই শ্রেয়।
আবার এমনও সময় আসে, যখন পর্দাখানা আমরা সরিয়ে রাখি স্বেচ্ছায়। বাইরের আর ভিতরের ঘরে তখন আড়ালটুকু নেই। সমগ্রতা পায় ঘর। এখানে ঘর বলতে, খণ্ডিত পরিসর পেরিয়ে একরকমের পূর্ণতার ধারণার আভাস মেলে। যখন, বাইরের ভিতরের জলবিভাজিকা আমরা মুছে ফেলতে পারি স্বেচ্ছায়।
মুখে যদি-বা এই কথাটা সহজে বলা যায়, এমনকি লিখেও ফেলা গেল, কিন্তু তা কি কাজে সম্ভব হয় সর্বদা? যে-মানুষটিকে বাইরের জন্য আমাদের সাজিয়ে রাখতে হয়, তার সঙ্গে তো ভিতরের মানুষটার অনেকটাই মিল নেই। সমগ্রতায় পৌঁছনোর এই তো এক মস্ত বাধা। অথচ দুজনের রোজই দেখা হয়। কথাবার্তা হয়। কে কাকে বেশি শাসিয়ে রেখেছে, তা নিয়ে নিশ্চয়ই চাপানউতোরও চলে। মনে হয়, এইসব দ্বন্দ্বমুখর কুরুক্ষেত্রে জয় হাসিলের সম্ভবনা বাইরের মানুষটিরই বেশি। কেন-না, মানুষকে অধিকাংশ সময় বাইরের মানুষ হয়েই থাকতে হয়। যদিও ভিতরের মানুষটির কাছাকাছি থাকাই তার কাম্য। সে জন্য তার আকুতিও কম নয়।
বাইরের মানুষটিকে তবু ফেলে তো দেওয়া যায় না। আপাতভাবে তাকে বয়ে নিয়েই চলতে হয়। অথবা, বাইরের মানুষটিই বয়ে নিয়ে চলে আমাকে। প্রকাশ্যে একটা পরিচয়ের নির্মিতি চলতে থাকে। এখন যে পরিচয় প্রকাশ্যে, সেটুকুই তো পরিচয়ের সবটা নয়। অতএব বলা যেতে পারে,
তুমি মোর পাও নাই পরিচয়।
তুমি যারে জান সে যে কেহ নয়, কিছু নয় ।।
মালা দাও তারই গলে, শুকায় তা পলে পলে
আলো তার ভয়ে ভয়ে রয়-
বায়ু-পরশন নাহি সয়।।
এ তো একরকমের পরাজয়। আবু সয়ীদ আইয়ুব বলেন, এ ঠিক অবমানিত হওয়ার দুঃখ নয়। আক্ষেপ এই যে, যার গলায় মালা দেওয়া হল, তার সত্য রূপ জানতে পারলে হয়তো মালাই লজ্জা পেত। তাহলে এখানে পরাজয় আসলে বাইরের মানুষটার কাছে, ভিতরের মানুষটার। যে বাইরের মানুষ অন্য অনেকের পরিচয় দিয়ে গড়া, যে ‘মানসীপ্রতিমামাত্র’, সে এসে হারিয়ে দিয়েছে সত্যিকার আমিকে। আলো যার ভয়ে ভয়ে আছে, বাতাসের সামান্য স্পর্শ তার সহ্য হয় না। এই বুঝি নিবে গেল!।
এই পরাজয় ঘুচিয়ে দেওয়াও সম্ভব, যদি এই কাজটুকু ঘটে ওঠে জীবনে-
মরণ আসুক চুপে পরমপ্রকাশরূপে
সব আবরণ হোক লয়।
ঘুচুক সকল পরাজয়।।
আবরণের আড়ালটুকু যদি সরিয়ে দেওয়া যায়, আবরণ বাঁচিয়ে রাখার এই প্রয়াসের যদি মরণ ঘটে পরমপ্রকাশ সম্ভব হয়, তবে তো আর পরাজয়ের কিছু থাকল না। যে সত্য, তাকেই চিনে, তার গলাতেই মালাটি গিয়ে পড়বে। কিন্তু সেইটে যদি না-হয়ে ওঠে! একদিনে তো এ লয় সম্ভব নয়, একজীবনের অনুশীলন প্রয়োজন। সেই সময়টুকুতে তাহলে কি আমাদের আড়ালটুকুকেও আঁকড়ে ধরা জরুরি! ধরা যাক, তখনও এই পর্বেও ছায়া ঘনিয়েছে বনে বনে। নবঘনবরিষণে গোপনে গোপনে এসেছে কেয়া। এলই যখন সে অভিসারে তখন দেখা হল মনে মনে। এই মনে মনে দেখা-হওয়া কি সেই মানসপ্রতিমার সঙ্গে? সম্ভবত তাই-ই। আমরা ভাবতে পারি, এখানে দুজনের মনই জড়িত। অর্থাৎ, যে এসেছে তার মনে আমার যে রূপ, আর আমার মনে তার যে রূপ, সেই দুই ভিতরঘরের সত্যি মানুষের সঙ্গে এখানে দেখা হচ্ছে। তাই বুঝি সে গোপনে এসেছে। নইলে আর কেন অভিসার! কীসের গোপনে আসা!
এইবার দেখা যখন হয়ছে, তখন কুশল মঙ্গল হবে। কিছু দেওয়া-নেওয়াও হবে। কেমন করে হবে সে আদান-প্রদান? না, আপনারে লুকায়ে। যাকে লুকিয়ে এই সত্যিকার দুই মানুষে দেওয়া-নেওয়া হল, সে তবে সেই বাইরের মানুষটি? তাকে আড়াল করে ফেললেই তবে কি আড়ালে যে থাকে সত্যরূপ প্রকাশ্য হয়ে ওঠে! আবরণ ঘুচে গেলে যেমন মরণে পরমপ্রকাশ সম্ভব হয়। হয়তো তা-ই।
কিন্তু আপনাকে লুকাতে হবে কেন? নিজেকে লুকিয়ে না ফেললে এই দেওয়া-নেওয়া কি সম্ভব হবে না? না-ও তো হতে পারে। অন্তত আমরা যদি কিশোরের দিক থেকে দেখি আর খানিকটা আমাদের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা দুই মানুষের সঙ্গে মিলিয়ে মিল্যে দেখে নিই তবে হয়তো সুড়ঙ্গের ভিতর আলোরই দেখা মিলবে। রক্তকরবী-র এই ছেলেটিই কিন্তু প্রথম রক্তকরবী ফুলের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। যক্ষপুরীর ভিতর যে রক্তকরবী হয়, সে খবর একমাত্র সেই-ই জোগাড় করেছে। ফুল তুলে এনে দিয়েছে নন্দিনীকে। নন্দিনী সেই রক্তকরবীই তো তুলে রাখবে রঞ্জনের জন্য, পরে গিয়ে যা কুড়িয়ে পাবে বিশু। কিন্তু সে তো অনেক পরের কথা। এই যে রক্তকরবী নন্দিনীর হাতে তুলে দেওয়া, এও যেন কিশোর করছে আপনাকে লুকায়ে। কেন? এক তো বাইরের একটা দিক আছে, যে, তাকে মারের মুখের উপর দিয়ে ফুল আনতে যেতে হয়। নন্দিনী তাই তাকে যত বোঝায় যে, নিয়মে বাঁধা কাজের রাজ্যে ফাঁকি দিলে তাকে প্রহৃত হতে হবে, কিন্তু সে তো তা শোনে না। নন্দিনীর জন্য সে ফুল আনবেই। কাতর আর্তিতে সে বলে, ‘নিষ্ঠুর হয়ো না।’
এই নিষ্ঠুরতা তার স্বাভাবিক প্রকাশের পথে নন্দিনীর দেওয়া বাইরের বাধা কেবল নয়; বরং এ-হেন কাজের ভিতর দিয়েই সে যে নিজেকে আবিষ্কার করে, যক্ষপুরীর এক কর্মী- এই নির্মিত পরিচিতির বাইরে বেরিয়ে সে যখন নিজের এক অসামান্য পরিচয় খুঁজে পায়, এই যে আবরণ ঘুচে গিয়ে সত্যির প্রকাশ, তা যদি বাধাপ্রাপ্ত হয়, তবে সে-ও তো নিষ্ঠুরতা। আড়াল মুছে ফেলার পথে বাধা হয়ে থাকা নিষ্ঠুরতা। ফুল আনার মতো উপলক্ষ ক-টা আর মেলে! যেখানে নিজেরই কালিঝুলি মাখা নিয়মের চাকর বাইরের লোকটার মরণ ঘটিয়ে পরমপ্রকাশ সম্ভব করে তোলা যায়! খেয়াল রাখতে হবে, এই ফুল কিন্তু সহজে পাওয়া যায় না যক্ষপুরীতে। আর পাওয়া যে যায়, সে-খবর কেউ জানেই না প্রায়। অর্থাৎ, ফুল জোগাড়ের ভিতর কষ্ট আছে। তার উপর আছে মারের ভয়। এই সমস্ত দুঃখটা যখন স্বীকার করে নেওয়া গেল, তখন একটা স্বাভাবিকতায় পৌঁছানো গেল, যেখানে আড়ালের আর দরকার নেই। তাই বুঝি বলা ছিল-
এসো এসো দুঃখ, জ্বালো শিখা,
দাও ভালে অগ্নিময়ী টিকা।
এখন এই যে ফুল আনল কিশোর, শম্ভু মিত্র খেয়াল করে ভেবেছিলেন দৃশ্যটা, যে, কীভাবে আনবে সে সেই ফুল? মঞ্চের একই সমতলে দাঁড়িয়ে নন্দিনী আর কিশোর। এমতবস্থায় প্রার্থিত রক্তকরবী হাতে দেখে নন্দিনীর তো সর্বাগ্রে উল্লাস করার কথা ছিল। কিন্তু তা সে করেনি। রবি ঠাকুরের রেখে যাওয়া এই আভাস থেকেই শম্ভুবাবুর প্রস্তাবনা এই যে, কিশোর রক্তকরবী এনেছিল, তবে লুকিয়ে। অনেকের চোখ থেকে লুকিয়ে, আর নন্দিনীর সামনে তা হাজিরও করেছিল লুকিয়ে। অর্থাৎ, যে হাতে তার ফুল ছিল, সেই হাতখানা সে পিছনের দিকে করে রেখেছিল।
আমরা তাহলে কী বুঝব? আড়াল মোচনের জন্য আড়ালের প্রয়োজনও আছে। যে-রক্তকরবী দেওয়া কিশোরকে বাইরে থেকে বের করে এনে ভিতরের সত্যি কিশোরের কাছে পৌঁছে দেবে, তা আনার জন্য আড়াল আবশ্যক। সেই আড়াল তাকে নিয়মের শাসন থেকে মুক্তি দিচ্ছে। আর নন্দিনীর সামনে সেই রক্তকরবী তুলে দেওয়ার সময়ও একটু আড়াল প্রয়োজন। নইলে নন্দিনীর ফুল পাওয়ার পরবর্তী যে আনন্দ, সেই প্রার্থিত মুহূর্তটি সেভাবে ঘনিয়ে ওঠে না। অপেক্ষা থেকে অতৃপ্তি হয়ে তৃপ্তির তুঙ্গ মুহূর্ত ছোঁয় না। আবার, কিশোর তো এখানে নিজেকে খানিক লুকিয়েই রাখে। নন্দিনীকে সে নিজের মনের সব কথা যেন বলেও বলে না। নন্দিনী তা বোঝে যে না, তা তো নয়। তবু এই একটু আড়াল করে রাখা নিজেকে। আড়ালের এই বহু পরত – থাকা বা না-থাকার ভিতরই একটা আনন্দমুহূর্ত প্রকাশিত হয়ে উঠেছে। যা চাওয়া হয়েছে, তা পাওয়া যাচ্ছে।
এবার যদি কিশোরের জায়গায় বসিয়ে ফেলা যায় নিজেদের, তাহলে হয়তো বলা সম্ভব,
যখন যা চাই তখুনি তা চাই।
তা যদি না হবে তাহলে বাঁচাই
মিথ্যে, আমার সকল আশায়
নিয়মেরা যদি নিয়ম শাসায়
দগ্ধ হওয়ার কৃপণ আঙুলে-
তাহলে শুকনো জীবনের মূলে
বিশ্বাস নেই, সে জীবন ছাই!
এ তো তাহলে সার্বিক সেই ভিতরের মানুষটার কথা। সে নিয়ম থেকে মুক্তি চায়। নইলে প্রাণ কাঁদে। অথচ বাইরের মানুষটাকে নিয়ম মানতেই হয়। যেখানে নিয়মের রাজত্বই সমস্তটা, সেখানে প্রাণের সন্ধান নেই। দুপুরে রুক্ষ গাছের পাতার কোমলতাগুলি সেখানে কেবল হারিয়ে যেতে থাকে। এই রুক্ষতা যদি ক্রমাগত বাড়তে থাকে, তখন বাইরের মানুষটাই সমস্তটা জুড়ে বৃহৎ হয়ে ওঠে। তাকে যদি একটু নিয়ন্ত্রণে না আনা যায়, তবে ভিতরের মানুষের কাছে যাতায়াত একেবারে রুদ্ধ হয়ে পড়ে। কথোকথন তো দূরের কথা। তখন একটু শাসন প্রয়োজন। নিজেকেই এখন শাসন করতে হয় নিজেকে। আর তার জন্যও দরকারি হয়ে ওঠে আড়াল।
মেঘের কোমল করুণ দুপুর
সূর্যে আঙুল বাড়ালে-
তোমাকে বকব, ভীষণ বকব
আড়ালে।।
এই আড়ালটুকু তাহলে জরুরিই। কেন-না এই আড়ালের শাসন সম্ভব হলেই নিয়মের বাঁধন কাটা যাবে। যা পৌঁছে দেবে প্রাণের মুহূর্তে, রক্তকরবীর খোঁজ পাওয়ার মুহূর্ত, এবং তার উদ্ভাসিত প্রকাশে। সফল হবে দেওয়া-নেওয়া। নির্মিত পরিচয় পেরিয়ে সেখানে জেগে থাকবে এক সত্যরূপ, যে সত্যরূপ এখন আড়ালে থাকে বাধ্যতায়।
তাহলে আড়ালের উভমুখী এক পথের দেখা মিলল এতক্ষণে। কখনও আমাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে আড়ালের প্রয়োজন পড়ে। কখনও আবার আড়ালকে ঢাল করেই আড়াল কেটে বেরোনো যায়। আড়ালে সেই বকা হয়ে ওঠে আত্মশাসন। এইখানটায় আমাদের আরও কিছুক্ষণ থিতু হওয়া আবশ্যক। এই কারণে যে, আত্মশাসনের কিছু ভ্রান্ত ব্যাখ্যাও কখনও আমাদের পথভ্রষ্ট করতে পারে।
যখন চারিদিকে মৃত্যুর উৎসব, বিচ্ছিন্নতার ব্যাধি এমনকি মানুষের গভীরতর ও পবিত্রতম যে অনুভূতি সেই শোকের প্রকাশও যখন নির্জনের অভিজ্ঞান ফেলে রেখে উদযাপনে অঙ্গীকারবদ্ধ প্রায়, তখন আমরা সম্ভবত ভুলে থাকছি আড়ালের ধারণা এবং তার প্রয়োগ। আমরা মাঝে মাঝে ভাবছি রবি ঠাকুরের কথা। কীভাবে হাজার কোলাহলের ভিতর তিনি নিজেকে তাঁর কাজে ডুবিয়ে রাখতে পারতেন। এরকম তো বহু উদাহরণ মেলে। তার যে-কোনো একটিকে তুলে ধরে বলা যায়, দেখো, এই আত্মশাসন শিক্ষণীয়। কোনও একটা উপলক্ষে যখন এই এই হট্টগোল চলছিল, তখন রবি ঠাকুর নামে মানুষটার কেমন নিমজ্জন। চারিদিকে এত এত কিছু বিচলিত হয়ে পড়ার মতো ঘটনা, তবু তিনি তো তাঁর কলম থামাননি। এ-কথা অনস্বীকার্য যে আত্মশাসনে রবীন্দ্রনাথের সমকক্ষ মানুষ দুটি খুঁজে পাওয়া ভার। একটি আড়ালের পর্দা তিনি বহু অনুশীলনে তৈরি করেন নিজের জন্য। যে-ঘর তিনি বহু যতন করে ধুয়ে মুছে রেখেছেন, যিনি আসবেন বলে তাঁর নিয়ত জেগে থাকা, জ্যোৎস্নারাতে বনের উৎসব থেকে তিনি নিজেকে সরিয়ে রেখেছেন, সেই ঘরে বাইরের হাটের কোলাহল এসে সমস্ত নিভৃতি আর প্রশান্তিটুকু কাচের গুড়ো করে দিক, এ তিনি কিছুতেই চাইতেন না। হতেও দেননি। তীব্র নিয়ন্ত্রণ না-থাকলে, নিজেকেই নিজের থেকে আড়াল করতে না-জানলে এই কাজ করা সম্ভব নয়।
আড়ালের এই প্রয়োগটুকু আমরা যদি মাথায় রাখি, তবে বলতেই পারি, বাইরের এই সকল ব্যথায় আমরা যেন কাতর না হয়ে পড়ি। এই মৃত্যু, এই অবহেলা, রাষ্ট্রীয় এই নির্লজ্জপনার ভিতর বসেও আমরা যেন আমাদের কাজটি করে যেতে পারি। কাজ তো প্রয়োজনীয়, তা না-করেও উপায় নেই। কিন্তু আড়ালের এই ব্যাখ্যায় কিছু ভ্রান্তি-শ্যাওলা এসে জোটে। কেননা, ছোটো ছোটো ঢেউ এসে তখন বলতে থাকে, তাহলে কি সামাজিক প্রয়োজনে, মানবতার প্রয়োজনে নিজেকে মেলে ধরার দরকার নেই? বিস্ময়ের এই যে, ঠিক সেইরকম উদাহরণও পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথেই। রাজনৈতিক, সামাজিক প্রতিবাদ, ঠিক যেখানে যখন দরকার কবি তার আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন। বদলে গিয়েছে তাঁর কাজের সংজ্ঞা ও ধরন। তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে প্রতিকার দরবার করেছেন। কিছু তার সফল হয়েছে। যেখানে দেখেছেন, কিছুই করার নেই, সেখানে নিজের যা করার তাই-ই করে প্রমাণ করেছেন, একলা চলতে হয়; কখনও একলা চলাই সবথেকে বড়ো বিবৃতি হয়ে ওঠে। হয়তো বলাই যায় যে, আত্মশক্তি পর্বের লেখা প্রায় সমস্তই কবির আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা। এবং সেই আড়াল কেটে বেরনোই সূত্র ধরিয়ে দিচ্ছে আত্মশক্তির জাগরণের।
এই যে নিজেরই রচিত আড়ালকে নিজেই তছনছ করে বেরিয়ে আসা, এইখানেই আমাদের স্মরণ করা প্রয়োজন আমাদেরজীবনের ভিতর আড়ালেই ওই দ্বিমুখী গতায়াতকে। আত্মশাসনে নিজেকে আড়াল করা জরুরি যখন তা ব্যক্তিআনন্দের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু যখন বৃহত্তর প্রয়োজন দরজায় কড়া নাড়ে তখন আড়ালকেই তুচ্ছ করার মতো আত্মশাসনের ক্ষমতাটুকুও নিজেকে করায়ত্ত করতে হয়। কেবল নিজেকে আড়াল করার উদাহরণটুকুকে জাপটে ধরলে কেমন যেন স্বার্থগন্ধ এসে তাকে আবিল করে। আবার, কেবল বাইরের ভূমিকাটাকে ধরলে, ভিতরের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের যে আড়াল জরুরি, সেটিকে অস্বীকার করা হয়। এই দুটো ভূমিকেই তাই একযোগে ছুঁতে পারলে, আড়ালের একটা সত্যিকার ভূমিকা হয়তো আমরা দেখতে পাব। তখনই সম্ভবত বোঝা যায়, আড়ালের জোর তখনই যখন তাকে নিয়ন্ত্রণের চাবিটুকুও হাতে থাকে।
এটুকুই আড়াল নিয়ে কয়েকটা ঘনিয়ে ওঠা কথা। খুব কি এর মানে আছে! নাই-ই থাকতে পারে! মানে খোঁজাই নিরর্থক। প্রতি পলে যে সমস্ত ভাবনা ঘনিয়ে ওঠে আর চলে যায় তার কতটুকু ধরা থাকে, আর কতটুকুরই বা অর্থিবিচার সম্ভব! সে সম্ভাবনা তাই গোড়াতেই বাতিল করা উচিত। তবু শব্দের নিজস্ব সম্মোহন থাকে। যেমন পথের। এমন কিছু পথ থাকে, যা বলে আর-একটু এগিয়ে এসো। সেইসব পথের শেষ হয় না। তেমন অনেক শব্দেরও। সে কেবল হাতছানি দেয় পথ থেকে পথান্তরে। আড়াল থেকে আড়াল পেরনোর ভিতর এই যে দু-একটা কথা, তার মধ্যেও ছিল ওই সম্মোহনী। সেই টানেই এতটা হেঁটে আসা। হয়তো আড়ালের থাকা, না-থাকা কিংবা আড়াল রাখা না-রাখার দ্বন্দ্বের ভিতর দিয়ে একটা রক্তকরবী-মুহূর্তের অর্জনের আমরা পৌঁছে যেতে পারি; আমাদের দৈনন্দিন হতাশায়, যক্ষপুরীতে- আমাদের এই বেঁচে থাকার ভিতরও তা সম্ভব হয়ে উঠতে পারে।
সরোজের এই বাহির-আড়ালের তদন্ত-সন্দর্ভ মনে রাখার মতো। গভীর অনুভবের স্পর্শ লেগে আছে এই লেখায়।