আমাদের স্ক্র্যাপবুক
রাজেশ্বরী বসু
"ঘূর্ণিঝড় থামার পর সাত দিন টিট্টিভ পাখির কোন দেখা নেই। খুব চিন্তা। বাবার মন খুব খারাপ। তারপর অষ্টম দিনে আবার টিট্টিভ পাখি ফিরে এলো। আমরা নিশ্চিন্ত হলাম। বাবা বলল, “আজকের দিনের সব থেকে ভালো খবর টিট্টিভ পাখি আবার ডাকছে, এই আনন্দেই বাকি সপ্তাহ কেটে যাবে।” জীবনের এরকম ছোটখাটো অনুভূতি যে এত সুন্দর হতে পারে এটা কাউকে আজকাল বোঝাতে অসুবিধে হয়, বোঝানো যায় না। বাবা চলে যাওয়ার পর আমি টিট্টিভ পাখির ডাক শুনেছি, কিন্তু মৌচাক দেখতে পাইনি, শুনলাম ওরা অন্য বাসা বেঁধেছে।"
“At the end of the drive, the old white house rose up, surrounded by shivering trees. A few close friends stayed on after the burial. So many people in the big room. And yet, it was so empty. All that was left of Leo Tolstoy was a name on the cover of a long row of books.”
“On Count Leo Tolstoy”,
জীবনী – Henri Troyat, ফরাসি থেকে অনুবাদ- Nancy Amphoux
ধুপ ধাপ, একটা শব্দ হলো। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে দেখলাম দেড়তলার তাকের বইগুলো মাটিতে পড়ে আছে। চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম, হঠাৎ পুরোনো বই-এর গন্ধের সঙ্গে বাবার গন্ধ ভেসে এলো। মনে হলো বই পড়তে এসে ঠিক আগের মতো দু-হাত ভর্তি বই সামলাতে না পেরে মাটিতে ফেলে দিয়েছে। ঔরঙ্গজেবের লেখা পত্র, প্লেটো, গিলগামেশ কাব্য-এর বিভিন্ন এডিশন এক এক করে গুছিয়ে রাখলাম। এখানে মূলত দর্শন ও ধর্মের বই থাকে। সুসংহত হওয়ার ফলে বিষয় অনুযায়ী বই বিভক্ত করে রাখাটা বাবার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ এক কাজ ছিল। এদিক ওদিক হলেই বিরক্ত হতো। দুর্গাপুজোর আগে এক দিন বা দু’ দিন বরাদ্দ থাকত বই গোছানোর জন্য। সকাল থেকে সেই এক অদ্ভুত কর্মযজ্ঞ। শিশুসুলভ উত্তেজনা বাবার মুখে চোখে ফুটে উঠতো। আমি তার অ্যাপ্রেন্টিস। প্রত্যেকটা বই পাড়া হতো, তার সঙ্গে দু-এক পাতা পড়াও হতো। তারপর সেগুলো গোছানো হতো। ফলত বই গোছানোর কাজটা সময়সীমার মধ্যে কোনোদিন শেষ হয়েছে বলে আমার মনে পড়ছে না । বাবা বলতো – “ এই যে বইয়ের ধুলো ঘাঁটছি এটার মধ্যে কী রোমাঞ্চ।” এই অভ্যেস আজও রয়ে গেছে তাই বই কিনতে ভালো লাগে। সেদিন নিউ ইয়র্ক-এর থার্টিএইট্থ্ স্ট্রিট-এ একটা পুরনো বইএর দোকানে গেলাম, দেখলাম একটা illustrated “ Old English Fairy Tales” , ভাবলাম বাবার জন্য কিনে নিই, সোনালি border দেওয়া চিত্রণ, কী খুশিই না হবে। পাশের এক ক্রেতা কী একটা কারণে চেঁচামেচি করে উঠতে মনে পড়ল , রূপকথার সোনালি চিত্রণ আঁকা বই দেওয়ার মানুষ তো আর নেই, খুব সহজে আর পাওয়াও যাবে না বোধহয়।
আমার আর বাবার এক অভিনব শখ ছিল। স্ক্র্যাপবুক তৈরি করা, অর্থাৎ খবরের কাগজ বা ম্যাগাজিন থেকে ছবি কেটে বই তৈরি করা। যেখানে যখন কাগজে কোনো বিষয় বা ছবি দেখতে পেতাম, সেটা কেটে রাখা হতো, এবং সেগুলো সাদা পাতায় সেঁটে একটা ফাইল তৈরি করা হতো। বিভিন্ন ছবি স্থান পেতো। যুদ্ধের, শান্তির ― মানুষের বেঁচে থাকার গল্প বলার একটা চেষ্টা হত। এখানেও বিষয় হিসেবে সাজানো হত খাতা ও ফাইল। এটা আমাদের খুব প্রিয় একটা কাজ ছিল। একটা ছবি ছিল – নিকারাগুয়ায় স্কুলে পড়তে যাবে বলে এক দল বাচ্চা তাদের নিজেদের চেয়ার নিজেরা মাথায় করে নিয়ে যাচ্ছে। এটা বাবার খুব প্রিয় ছিল। আমায় দেখিয়ে বলতো, “ আমাদের যতটুকুই সম্পদ থাকুক, তা দিয়েই অনেক কিছু সম্ভব। যাদের নেই তাদের কিছু করার ইচ্ছেটা বোধহয় আরও প্রবল হয়।” সংগৃহীত ছবিগুলো থেকে দুটি এখানে দিলাম। নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি, দুঃখ, পরাজয়ের পরেও মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর যে আশ্চর্য ক্ষমতা, অর্থাৎ ‘Human Spirit’, তাকে বাবা শ্রদ্ধা করত। শ্রদ্ধা করত সাহসকে। Captain Robert Falcon Scott এর অসামান্য সাহসের গল্প কতবার শোনাত। আমারও একই গল্প অনেক বার শুনতে বেশ লাগত।
সংগৃহীত:গৌতম বসু
আমাদের বারান্দায় বগেনভিলিয়া গাছের ফাঁকে ধীরে ধীরে তৈরি হল এক মৌচাক। তখন আমি কর্মসূত্রে কলকাতার বাইরে। প্রতিদিন আমাদের আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছিল মৌচাক ও তার বাসিন্দারা। প্রতিদিন সকালে বাবার কাজ ছিল ওই মৌচাকটা ঠিকঠাক আছে কিনা দেখা। একদিন আমাদের মালী প্রস্তাব দিল আগুন জ্বালিয়ে মৌচাক সরিয়ে ফেলবে। বাবা ও আমি হাউমাউ করে উঠলাম। বাবা বলল “ওরা আমাদের পরিবারের অংশ এখন। ওদের সরানো যাবে না।” যে বার আম্ফান এলো, ঝড় থামার পর বাবার খুব চিন্তা হল মৌচাক ও মৌমাছিদের নিয়ে। মৌচাক অক্ষত আছে দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে আমায় ফোনে বলল “মৌমাছিগুলো ভালো আছে, কিন্তু টিট্টিভ পাখিটা ডাকছে না।“ এখানে টিট্টিভ পাখির সংক্ষেপে একটা পরিচয় দেওয়া দরকার। আমাদের বাগানে এক ছট পাখি দেখা যেত, একটু গাঢ় নীল রঙ, ঠোঁটটা লম্বা গোছের। অবিশ্রান্ত “টিট্টিভ টিট্টিভ” ডাকে চারিদিক মাতিয়ে রাখতো। স্বভাবতই নামটা বাবার দেওয়া। এই পাখিটিকে নিয়ে আমাদের দীর্ঘ আলোচনা হত। পাখিটার দম সম্বন্ধে বাবার মনে গভীর ভক্তি ছিল। সকাল ৮ টা থেকে দুপুর অব্দি ‘টিট্টিভ’ ভাষায় অনেক বক্তব্য রাখত, এক মুহূর্তও থামত না। ঘূর্ণিঝড় থামার পর সাত দিন টিট্টিভ পাখির কোন দেখা নেই। খুব চিন্তা। বাবার মন খুব খারাপ। তারপর অষ্টম দিনে আবার টিট্টিভ পাখি ফিরে এলো। আমরা নিশ্চিন্ত হলাম। বাবা বলল, “আজকের দিনের সব থেকে ভালো খবর টিট্টিভ পাখি আবার ডাকছে, এই আনন্দেই বাকি সপ্তাহ কেটে যাবে।” জীবনের এরকম ছোটখাটো অনুভূতি যে এত সুন্দর হতে পারে এটা কাউকে আজকাল বোঝাতে অসুবিধে হয়, বোঝানো যায় না। বাবা চলে যাওয়ার পর আমি টিট্টিভ পাখির ডাক শুনেছি, কিন্তু মৌচাক দেখতে পাইনি, শুনলাম ওরা অন্য বাসা বেঁধেছে।
প্রকৃতি যে ক্রমাগত ধংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, সেটা নিয়ে আমাদের লজ্জিত ও বিব্রত হওয়া উচিত, এটা খুব দৃঢ়ভাবে বাবা বিশ্বাস করতো। প্লাস্টিক ব্যবহার বর্জন করতে হবে, এরকম প্রতিজ্ঞা করল। দোকানে বাজারে যেখানেই যেত, প্লাস্টিক দিলে ফিরিয়ে দিত। তাই খুব ব্যবহৃত হতো ঝোলা, বিভিন্ন ধরনের — বাজারে একরকম, কলেজ স্ট্রিট-এ আরেক রকম। ভুল করে একদিন প্লাস্টিক-এ করে বাজার থেকে কিছু নিয়ে এসেছিল (অন্য কোন উপায় ছিল না নিশ্চয়), ফিরে বলল, “হিসেব রাখা দরকার, আজ একটা প্লাস্টিক ব্যবহার করলাম!”
কেদার-বদ্রিতে ২০১৩ সালে যে বার প্রকৃতির রোষে চারিদিকে প্রচুর ক্ষয় ক্ষতি হল, বাবা প্রকাশ করল “ধ্বংসের ছেলেমেয়েরা”, উৎসর্গ করা উত্তরাখণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তরবঙ্গকে। সেখান থেকেই একটা অনুবাদ তুলে দিলাম ―
অবশিষ্ট রইল না কিছু, অস্থি ছাড়া
দড়ি দিয়ে শক্ত ক’রে বাঁধা, ক্রুশচিহ্নর আকারে,
ভগবানের অপার মহিমা কীর্তনের জন্য
এবং মানুষেরও জন্য
পাবলো নেরুদা
১৯০৪- ১৯৭৩
“ধ্বংসের ছেলেমেয়েরা”
অনুবাদঃ গৌতম বসু, ২০১৩
এরকম আরও ফোল্ডার তৈরি হত, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। ভরভরা রাও-এর প্রতি অবিচার, কৃষকদের আন্দোলন ইত্যাদি ঘটনায় দেশ যখন উত্তাল, বাবা বলল, “কিছুই তো করতে পারব না, একটা লেখালিখি করে অন্তত নিজের অবস্থানটা জানানো দরকার। অন্যায় দেখে চুপচাপ বসে থাকা যায় না।” তৈরি হল “আমাদের ইস্তেহার”। কবিতা জগৎ থেকে আমাকে দূরে রাখবে বলে, কবিতার বই কখনই দেখাত না, কিন্তু ফোল্ডার হলে প্রথম কপি আমি পেতাম, আমার বেশ আনন্দ হত। ফোল্ডার বেরনোর পর একদিন বাবা তার সেই খুব পরিচিত চোখ বুঝে কথা বলার ভঙ্গিমায় বলল, “ জানিস, ভ়িভ়িআর-কে পুনের যে ইয়েরাওয়াদা ( Yerawada) কারাগারে বন্দী রাখা হয়েছে সেখানে মহাত্মাও এক সময়ে বন্দী ছিলেন এবং রবীন্দ্রনাথ বহু কষ্ট স্বীকার করে সেখানে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেছিলেন। ভাবা যায়?” এর সঙ্গে পাঠাল, Vietnamese বৌদ্ধ ভিক্ষু থিছ কাং দুচ (Thich Quang Duc)-এর সেই অমর দৃশ্যর ছবি।
সংগৃহীত ঃ গৌতম বসু, ঋণস্বীকার ঃ ATI, google
এরকম তথ্য যা শুনে কিছুটা সময় বাকরুদ্ধ হয়ে যেতে হয়, আর কেউ দেয় না। এরকম ছবি মাঝে মাঝেই আমাকে ইমেইল-এ পাঠাত, যেগুলো দেখে নতুন করে ভাবতে ইচ্ছে করে । বিগত দেড় মাস সেরকম কোন ইমেইল আমার কাছে আসেনি, আসবেও না। পুরনোগুলো তাই রোজ দেখি।
সর্বশেষে আসা যাক গান বাজনার কথায়। এর কোন শেষ নেই। সেদিন শুনছিলাম পঃ নিখিল ব্যানার্জির জয়জয়ন্তী । সুরের ওঠা নামা যখন চলছিল, দেখতে পেলাম, বাবা ওই চেয়ারে বসে মাথা নিচু করে বুকের সঙ্গে লাগিয়ে, চোখ বুজে শুনছে আর হঠাৎ বলে উঠছে, “ বুঝে বাজাচ্ছে রে! আহা!”
জ্যাজ (Jazz) শুনতে খুব পছন্দ করতো, মন ভালো করতে হলে জ্যাজ শুনতে হয়, এরকমটাই ছোটবেলায় আমি শিখেছিলাম। তাই মন খারাপ হলেই লুইস আর্মস্ট্রং। New Orleans জ্যাজ-এর পীঠস্থান। সেখানে নাকি কেউ পরলোক গমন করলে, জ্যাজ সংগীতের দলবল গান বাজনা করতে করতে কবরস্থান যায়। ওটাই ওদের শোক দেখানোর পদ্ধতি কারণ ওদের বিশ্বাস জীবন এক উৎসব, তার শেষও উৎসব। এটা আমাকে বাবাই বলেছিল, সঙ্গে অসংখ্য ভিডিও পাঠিয়েছিলো। অনেক বার এই কথা বলতো এবং ভুলে যাওয়ার ফলে অনেক বার একই ভিডিও পাঠাত। আমি অবশ্য কোনদিন বলতাম না যে এটা আমি আগেও দেখেছি, আবার দেখতাম, ভালো লাগতো। বাবা যখন শায়িত ছিল, আমার ওই গল্প এবং ওই ভিডিওগুলোর কথা খুব মনে পড়ছিল, মনে হল, আচ্ছা, এখন একটা Satchmo শুনলে কি বাবা মনে মনে বলবে, “এটা কী দিলি রে! এটা কিন্তু খুব unique। এরকমই আসলে হওয়া উচিত।”
আমরা যাকে খুব ভালোবাসি তার চলে যাওয়া মেনে নেওয়া কঠিন। হারিয়ে যাওয়ার পর যে শূন্যস্থান তৈরি হয় তার অনুভূতি আমার পক্ষে ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। শূন্যস্থানের এপারে রয়ে যায় কাজ এবং অসংখ্য টুকরো স্মৃতি। সেই টুকরো স্মৃতি কিছু সাজিয়ে দেওয়ার একটা চেষ্টা করলাম।
এই পড়ে থাকা স্মৃতি কোনদিনই শেষ হওয়ার নয়। বাবা নিজের মা-এর শ্রাদ্ধের জন্য যে কার্ড তৈরি করেছিল, সেটা ফোল্ডার-এর ধাঁচে। সেখানে অনেকগুলো সাহিত্যের অংশের মধ্যে একটি ছিল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “শান্তিনিকেতন”/ মাতৃশ্রাদ্ধ” থেকে শ্রাদ্ধমন্ত্রের অংশ। সেই একই লেখার অন্য এক অংশ দিয়ে শেষ করলাম।
“আমাদের মধ্যে একটি মূঢ়তা আছে; আমরা চোখে-দেখা কানে-শোনাকেই সব চেয়ে বেশী বিশ্বাস করি। যা আমাদের ইন্দ্রিয়বোধের আড়ালে পড়ে যায়, মনে করি, সে বুঝি একেবারেই গেল। ইন্দ্রিয়ের বাইরে শ্রদ্ধাকে আমরা জাগিয়ে রাখতে পারি নে।
আমার চোখে-দেখা কানে-শোনা দিয়েই তো আমি জগৎকে সৃষ্টি করি নি যে, আমার দেখাশোনার বাইরে যা পড়বে তাই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। যাকে চোখে দেখছি, যাকে সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে জানছি, যে যাঁর মধ্যে আছে, যখন তাকে চোখে দেখি নে, ইন্দ্রিয় দিয়ে জানি নে, তখনও তাঁরি মধ্যে আছে। আমার জানা আর তাঁর জানা তো ঠিক এক সীমায় সীমাবদ্ধ নয়। আমার যেখানে জানার শেষ সেখানে তিনি ফুরিয়ে যান নি। আমি যাকে দেখছি নে, তিনি তাকে দেখছেন– আর তাঁর সেই দেখায় নিমেষ পড়ছে না।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শান্তিনিকেতন/মাতৃশ্রাদ্ধ
লেখাটি বড় ভালো। কবির মৃত্যু হয় না।
এমন স্মৃতিচারণ পড়ে কিছুই বলার থাকে না। মুগ্ধতা ও বিষাদ একই সঙ্গে ঘিরে ধরে। এমন লেখা পড়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকাই শ্রেয়
টুকরো টুকরো স্মৃতি গুলো সেই টিট্টিভ পাখির মত একটানা বেজে চলেছে মনে.. মনের আশে পাশে।
হৃদয়স্পর্শী লেখা। খুব ভালো লাগল।
অপূর্ব! আহা!