আবহমান বাংলা কবিতার অলোকরঞ্জন দিগন্তঃ একটি অক্ষম আলোচনা
: শ্যামশ্রী রায় কর্মকার
আবহমান বাংলা কবিতায় অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত এক অপার দিগন্ত। তিনি ‘পরঠিকানিয়া’ হয়েও একটি গহনতম বাঁকের মতো বাংলা কবিতার সঙ্গে স্রোতোবন্ধনে জুড়ে রেখেছেন ফরাসী ও জার্মান কবিতাকে। উচ্চকিত কবিতার থেকে দূরে তিনি এক শুদ্ধশুচি স্বর।
“সাঁওতাল পরগনার গ্রাম মন্ত্রমুগ্ধ, রাত্রির সংকেতে
ভয় নেই, ঠাকুমার হাত কাঁপে হাতে কাঁপে কুপী,
বাড়ির বারান্দা কাঁপে সে আলোয়, বাঁশবনের গায়ে
জড়োসড়ো পাতা কাঁপে, কাঁপে বনভূমি, তাকে ফেলে
কুপীর করুণ আলো অগ্রসর, হয়তো বা ভূমা
যে এখনো দূরগম্য তাকে খুঁজে নেবে। নিরুপায়
প্রান্তরে দাঁড়িয়ে যেন বড়ো একা আমার ঠাকুমা”
তাঁর কৈশোর কেটেছিল সাঁওতাল পরগনার রিখিয়ায়, তাঁর ঠাকুর্দা ঠাকুমার কাছে। তারই ছায়া পড়েছে এই কবিতায়। “যে এখনো দূরগম্য, তাকে খুঁজে নেবে” কুপীর করুণ আলো। আলোর সঙ্গে করুণের এই সহাবস্থান যেমন একটি মূর্চ্ছনার সৃষ্টি করে, তাকে ছাপিয়ে যায় দূরগম্যকে খুঁজে নেবার আকুলতা। কবিতাটি পড়া শেষ হলে আমাদের ভেতরেও একটি করুণ আলো কাঁপতে থাকে। তার খোঁজা শেষ হয় না।
কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের ‘যৌবন বাউল’, ‘নিষিদ্ধ কোজাগরী’, ‘রক্তাক্ত ঝরোখা’র মতো আবিষ্ট করে রাখা কাব্যগ্রন্থের আশ্চর্য পঙক্তি আমাদের অনুভূতির রাজ্যে আলোড়ন তুলেছিল । তাঁর কবিতার বিস্তার আমাদের বারবার চমৎকৃত করেছে। মনে হয়েছে, যেন এক বিপন্ন দার্শনিক বসে আছেন নির্জনে, নগর সভ্যতার ক্ষতচিহ্নগুলি মেলে রাখছেন মাঠের রিক্ততায়। তাঁর সঙ্গে সরাসরি কথা হয়ে ওঠেনি কখনো, সে আমারই জড়তা। অথচ তাঁর কবিতার উদাসীন বাউলের সঙ্গে আমার নিবিড় সম্পর্ক। ভিড়ের মধ্যে তাঁর নির্জন শব্দগুলি সন্ধ্যাপ্রদীপের মতো উদ্ভাসে ভরে রাখে আমাদের।
তাঁর কবিতা আমাদের এক মহাজাগতিক উপলব্ধির দিক নিয়ে যায়। যে উপলব্ধি জাগ্রত চেতনার স্তর অতিক্রম করে অভিসন্ধিহীন এক অন্তরালকে উন্মোচিত করে।
“সমাধি এবং বাড়ি একাকার হয়ে গেল যেই
বাড়িতে অনবরত মোম জ্বালি আর সমাধিতে
খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ি, কিন্তু কবরের প্রহরীরা
বলল এ পান্থসদনে যুগ্মশয়নের
কোনো অনুমতি নেই”
[ ওষ্ঠে ভাসে প্রহৃত চুম্বন]
এখানে ‘পান্থসদন’ শব্দটির ব্যবহার আমাদের চমকিত করে। বলে, মৃত্যুই শেষ কথা নয়। এই কারণেই হয়তো কবির যন্ত্রণা আরও তীব্র সুরে বাজে, নির্জন অরণ্যে কোনো করুণ কনসার্টের মতো। কবির প্রবল আকুতি সত্ত্বেও তাঁর সহমর্মিনীর সঙ্গে নিভৃত শয়নের এই অবকাশটুকু কবরের প্রহরীরা তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নিতে চায়। এই কবিতায় জন ডানের মোহময়তাকে ছাপিয়ে কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত এক চিরন্তন বেদনার শিখরে আরোহন করেন । তখন আর কবিতাটি একটি আঙ্গিকে সীমাবদ্ধ থাকে না। অসীম হয়ে ওঠে।
জীবনানন্দ প্রসঙ্গে একটি আলোচনায় কবি নিজেই একবার বলেছিলেন, “কোনো কবিকেই সামগ্রিক ভাবে কেউ ছুঁতে পারে না”। তাঁর নিজের কবিতার ক্ষেত্রেই কথাটি সিনাই পাহাড়ের গায়ে দৈব নির্দেশের মতো প্রোজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তাঁর কবিতায় নিমগ্ন রূপকের ব্যবহার, চিত্রকল্পের প্রয়োগ , অনুপ্রাস ও বিরোধালঙ্কারের অনায়াস অথচ প্রচ্ছন্ন ব্যবহার পাঠককে ঋষ্যমূক করে রাখে। মিথ, দর্শন, আধ্যাত্মিকতার বিভূতিবৈভব, দৃশ্য- অদৃশ্যবোধের দ্যোতনা অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কবিতাকে এমন সমৃদ্ধ করে রেখেছে, সেই অলোকমাধুরী আমাদের পরমার্থ হয়ে থাকবে বহুকাল। কবির চিরহরিৎ স্বভাব তাঁকে দিয়ে যে বিপুল সম্ভার নির্মাণ করিয়ে নিয়েছিল, সেইসব রত্নাবলির অমূল্য সঙ্কেতরশ্মি উদ্ধার করার দায়িত্ব পরবর্তী প্রজন্মের। কেমন তাঁর সঙ্কেত? সে কথা বলতে গিয়ে বরং তাঁরই একটি কবিতা তুলে ধরি-
“একদল জীবন যাপন করবে
অন্যেরা গড়বে শিল্পঃ
আমি ও দুয়ের মধ্যে যাতায়াত করছি এখন
ফলত কী ঘটে যাচ্ছে বুঝতেই পারছি বিলক্ষণ
বাঁচার ভিতরে আজ লেগেছে শিল্পের কারুকাজ
শিল্পের স্নায়ুতে গিয়ে আদিখ্যেতা করছে জীবন
ততখানি শুদ্ধ নই এ দুয়ের কারুর কাছেই
সেটাও দারুণ মজা, সন্দিহান সমস্ত ঘরানা
ধরতে পারছে না আমি কি বোল বাজাব পাখোয়াজে! ”
শিল্পের স্নায়ুতে গিয়ে আদিখ্যেতা করছে জীবন- এমন মৌলিক প্রয়োগ অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কবিতাকে অনন্য চিহ্নিত করেছে বারবার। শেষ স্তবকটিতে একটি নির্দোষ কৌতুক তো আছেই , সেইসঙ্গে আছে তাঁর কবিতাজীবন সম্পর্কীয় একটি সূক্ষ্ম সংকেতও ।
কবি বিভাস রায়চৌধুরীর একটি পঙক্তি উদ্ধৃত করে বলি, “মৃত্যু একধরণের অনুপস্থিতি ছাড়া কিছু নয়”। কিন্তু কবি কি অনুপস্থিত আদৌ? তাঁর উপস্থিতি তাঁর প্রতিটি কবিতায়, আমাদের মতো ভিড়ে নির্জনতার রসদ খোঁজা তরুণ প্রজন্মের প্রতিটি কবি ও পাঠকের অভ্যন্তরে। আমরাও তাঁর কবিতার বুধুয়ার মতো তাঁরই কবিতার দিকে পাহাড়ের মতো মুখ তুলে ভাবব ,
“… ওটা কার বাড়ি, কার অত নীল,
আমার ঘরের চেয়ে আরো ভালো, আরো
নিকোনো উঠোন তার, পাখিবসা বিরাট পাঁচিল
ওখানে আমিও যাব, কে আমায় নিয়ে যেতে পারো?”