আত্মসংলাপ এবং একটি কবিতার বই
হিন্দোল ভট্টাচার্য
অমিতাভ মুখোপাধ্যায়/ শূন্যস্থানে তাকাও/ পার্চমেন্ট/৬৫টাকা
আত্মসংলাপ বা আত্মসন্দর্ভকে অনেক সময়ই সূত্রহীন বলে মনে হলেও, তা কবির যে অন্বেষণের যাত্রাপথ, তাকেই চিহ্নিত করে। বাংলা কবিতার দীর্ঘকালের ঐতিহ্য অনুসরণ করলে, আমরা এই দার্শনিক তথা পর্যটককেই খুঁজে পাব, যিনি হাজার বছর ধরে পথ হেঁটে চলেছেন। তাঁর রূপের পরিবর্তন হচ্ছে, ভাষার পরিবর্তন হচ্ছে, কিন্তু যাওয়া শেষ হচ্ছে না। ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয়, সঙ্গীত, চিত্রকলার মতো কবিতা এক দীর্ঘ ও আবহমান নদীর মতো। কোনও কোনও কবি পৌঁছতে পারেন সেই নদীর কাছে। অল্প অল্প করে চেতনার অংশটুকু নিয়ে নেন। আমরা ভাবি, এ হলো তাঁরই রচনা। কিন্তু আসলে তা এক দীর্ঘ আবহমানের থেকে নিয়ে আসা খণ্ড খণ্ড রূপ মাত্র।
এ প্রসঙ্গে একটি কবিতার বইয়ের প্রসঙ্গ উঠে আসে। নয়ের দশকের কবি অমিতাভ মুখোপাধ্যায়ের ‘ শূন্যস্থানে তাকাও’। পার্চমেন্ট প্রকাশনী থেকে বেরোনো এই কাব্যপুস্তিকাটিতে অমিতাভর কাব্যব্যক্তিত্ব এত স্পষ্ট, যে আশ্চর্য হতে হয়। মানুষের দোতলা থেকে (২০০১), গোয়েন্দার আকাশ (২০১৪, এর পরিবর্ধিত সংস্করণ বেরিয়েছে সাম্প্রতিক কালে) কাব্যগ্রন্থের পরে এই গ্রন্থ। “এই নিশ্চুপে আধখোলা জানলার কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই” (কথা), “এই যাপন মিথ্যে হয়ে গেলে কিছুই তো করার থাকে না/ শিল্পসুষমার কাছে কুকুরের মতো বসে থাকা ছাড়া ( বিশ্বাস অমনিবাস) – এই কবিতাগুলিতেই অমিতাভর কাব্যব্যক্তিত্ব স্পষ্ট। অমিতাভর কবিতাগুলির মধ্যে একপ্রকার আত্মসন্দর্ভ রয়েছে। তিনি নিজের মনেই কথা বলে চলেছেন। এবং এই কথা বলে চলার জগৎটি পরিব্যাপ্ত। কিছু কিছু কবিতা অন্তর্গত সঙ্কটকে চিহ্নিত করে। মনের ভিতর এমন এক অ্যাভিনিউ তৈরি করে, যার ভিতর নিজেরও নিশ্চুপ হয়ে যাওয়া ছাড়া আর করার কিছু থাকে না। হয়তো এই নিজস্ব সলিলকির জন্যই তঁর হ্যামলেট শীর্ষক কবিতার কাছে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। “ শুধু তুমি আর আমি হোরেশিও/ আর কেউ টের পাচ্ছে না মনোবিজ্ঞানের এই দ্গদগে ভূমিকার প্রথম পাতা/শুধু ছাই উড়িয়ে উড়িয়ে দেখছি, আর মিশে যাচ্ছি ছাইয়ের ধূসরে” (হ্যামলেট)। কবিতাটি যেন সেই ‘বিয়ন্ড আওয়ার ফিলোজফি’-কে ধারণ করে রেখেছে সমকালীন বিপন্নতায়। সমকালীনতাকে অমিতাভ আশ্চর্য নিপুণভাবে চিরকালীনতার মধ্যে দিয়ে দেখছেন। ‘অনুশীলন’ শীর্ষক কবিতায় যেমন তিনি বলছেন, “ তুমি যাকে বহন করছ, সমস্তই তোমার পরিশীলিত যাপনের ফল”। অদ্ভুত কিছু সত্য উচ্চারিত হয় অমিতাভর কবিতায়। “হাততালি থেকে দূরে” শীর্ষক কবিতায় যেমন তিনি লিখেছেন, “ আমাদের সব বিধিনিষেধের শেষে তারপর একদিন ছায়া নেমে আসে/ তুমি-আমি যার নীচে এখনো বসব বলে পণ করি, দাঁড়াতে পারি না…”।
অমিতাভ মুখোপাধ্যায়ের ‘ শূন্যস্থানে তাকাও’ একটি কাব্যপুস্তিকা হলেও, প্রকৃত প্রস্তাবে, একটি অখণ্ড কবিতার অংশ। যার কোনও শুরু, শেষ নেই।