অয়ন চৌধুরীর কবিতা
জ্যোৎস্না ও মরা মানুষ
কমলালেবুর ভিতরের বিপরীতার্থক সমাবেশের মতো
রসালো হয়ে আছে আজকের রজঃস্বলা চাঁদ
তুমি তার দিকে কয়েক মিনিট অথবা কয়েকশো বছর
তাকিয়ে আছ। কোনও টুপ শব্দ হয়নি রাত্রির জলে
এমনকি প্রথম সঙ্গমে চিৎকার করেনি কোনও নারী
যে পোকা পাতার গায়ে রেখে দিল অসম্ভব ক্লান্তি,
ডানা ঝেড়ে উড়ে গেল গর্ভ সমীপে, তারও কিছু ভয় ছিল শূন্যতার—
তবু এই বেহায়া চাঁদ আজ গতর খুলেছে
মরা মানুষের খুলির ভিতর প্রতিস্পর্ধী আগুন,
চামড়া খসে যাবে, ছাই হয়ে যাবে হাড় তবু এই
বিভৎস ঘূর্ণির মতো বাতাসের ভিতর ঢলানি জ্যোৎস্না নেমেছে!
সাপ ও পিতৃপুরুষ
এই রাত্রিখানি দেবতার পায়ের কাছে গাঢ় হয়ে আছে।
তার নখ ও স্নায়ু জুড়ে লেগে গেল অস্থিপোড়া ঘ্রাণ,
পিতৃপুরুষের ঋণটুকু মুছে গেল স্থির গঙ্গার জলে
সমূহ আয়োজনে ফাঁকা পড়ে আছে ঘর,
পায়ের ছাপ বসা চটি আর গলার মাফলার
বহু পুরনো গাছের গায়ে যেভাবে হিম হয়ে থাকে শূন্যতার শব্দ
সেভাবে তার ফাঁকা খাট ও আলনায় নিঝুম কুয়াশা নেমেছে।
সন্ধ্যাআরতি হয়নি বলে আজ এ বাড়িতে উঠে এসেছে সাপ
অভিশাপ লাগে না কখনো বাস্তুভিটার গায়
সে আগলে রাখে এ মাটির অনুতাপটুকু রক্তাভ ফণায় ফণায়…
মৃত মানুষের মন ও সাদা ফুল
এ অন্ধকারটুকুও কেটে যাবে একদিন
লেবুপাতায় উড়ে এসে বসবে জোনাকি আলো
পিণ্ড তার নামিয়ে এসেছি ঘাটে, মৃত মানুষের
মন শান্ত করতে মন্ত্রোচ্চারণের মিথ্যে খেলায় মেতেছি।
সামান্য অস্থিভষ্ম ছাড়া আর কিছু বাকি নেই,
আর কোনও মন, দেহ বা সমন এ বিশ্বচরাচরের কোথাও লেগে নেই— এই সত্যটুকু জেনে গেছি বলে
আজ এতখানি শূন্যগর্ভ মেঘ ভেঙে পড়ল বাড়ির উঠোনে—
শ্বেতচন্দন, তুলসীপাতার নরম স্পর্শ সে ছুঁতে পারেনি। প্লাস্টিকে মুড়ে দেহ চলে গেছে দূরে।
এই মাটি তার শেষ ঘ্রাণটুকু পেল না বলে এখনও চোখেমুখে শোক আগলে রেখেছে
রাত্রি নিবিড় হল, নিভৃতবাসে দু’একটি সাদা ফুল অশ্রুর মতো ফুটে আছে!
ভাবুক মেহমান ও মহাকাল
এই যে একটি মুখ হারিয়ে গেল,
তার পরিচিত অভিব্যক্তিগুলি ধু ধু স্মৃতির মতো চিকন,
তার বৃহৎ উদরের কাছে যে শোকটুকু ঘুমিয়ে আছে
তাকে সন্তানসম স্নেহে আমাদের নিজের করে ভাবতে ভাবতেই বেলা পড়ে এল
ঘাটের জলে কেঁপে ওঠে হাওয়া
শেষ ডুব দেওয়ার পর হাঁসগুলি ফিরে গেল,
তাদের পায়ে লেগে আছে আমাদের অশ্রু
ভূ-কম্পনের মতো কেঁপে ওঠা অপেক্ষার বলিরেখা।
দু’মুঠো আতপ, সামান্য তিল ও গঙ্গাজলে পূর্বপুরুষের প্রেত ও আত্মারা হাঁ-মুখ নিভিয়ে ফেলল
শান্ত হয়ে এল তাদের চোখ, দলে এসেছে নতুন মানুষ—
কোশাকুশি, ফুল-দুব্বো, দান ও ধ্যান দিয়ে সাজিয়ে রাখা আয়োজনে উচ্চারিত হচ্ছে তাদের নাম ও গোত্র। তারা কি আকাশপথে নেমে এসেছে আজ? এ বাড়িতে দাপিয়ে বেড়াল সারা দুপুর! পরিচিত ঘরে বসে কয়েকশো বছরের স্মৃতি ঘেঁটে ঘেঁটে উলটোপালটা করে গেল সব!
এভাবে প্রতিটি আয়োজনের শেষে সাজানো আছে আর একটি নৈবেদ্যর থালা, পাথরের পরাত, কমণ্ডলু, ঘৃত-চন্দন।
অথচ সমস্ত মায়া কাটিয়ে বৈতরণি পারের কাছে বসে কোনো এক ভাবুক মেহমান তাকিয়ে আছে তার ঘরের দিকে।
প্রতিদিনের জমে ওঠা ধুলোয় একটি পায়ের ছাপ কখনো পড়বে না জেনেও
শুধু এই মহাকাল চঞ্চুর আঘাতে পালকে পালকে দাহঘ্রাণটুকু খুঁজে নেবে বলে
এই ঘোর সন্ধ্যায় প্রদীপের সলতে পাকাতে বসেছে মা!
অয়ন চৌধুরী
জন্ম ১৯৯৩। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। প্রথম কবিতা প্রকাশ ২০১০ সালে। এরপর ভারত, বাংলাদেশের বিভিন্ন কাগজে অসংখ্য কবিতা প্রকাশ। পাশাপাশি ছোটগল্প ও প্রবন্ধ লিখেছেন। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ তিনটি। গল্পগ্রন্থও রয়েছে একটি। ২০১১ সাল থেকে সম্পাদনা করছেন ‘স্রোত’ নামে বাংলা সাহিত্য সাময়িকী ও প্রকাশনা। কবিতা ও সম্পাদনার জন্য বিভিন্ন সময়ে পুরস্কৃত ও সংবর্ধিত হয়েছেন৷ সম্প্রতি তাঁর যদি দু’টুকরো জেরুজালেম ছুড়ে দাও ঝুলবারান্দা থেকেই কাব্যগ্রন্থের জন্য পেয়েছেন ‘অন্যমুখ সাহিত্য সম্মান’ এবং সাহিত্য-সংস্কৃতিতে বিশেষ অবদানের জন্য লালগোলা উৎসবে বিশেষ সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন। লেখালেখির পাশাপাশি অয়ন একজন চিত্রশিল্পী। প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবেও তিনি সুপরিচিত। সম্প্রতি অনেক অনেক বাংলা বই সেজে উঠছে তাঁর প্রচ্ছদে। সে ভালবাসে ছবি তুলতে এবং বই-এর ইতিহাস ও বাংলা রক সংগীত নিয়ে গবেষণা করতে।
গহন থেকে উঠে আসা কবিতা। এমন কবিতার সামনে নিস্তব্ধ হয়ে যেতে হয়।
অসাধারণ।আমি অয়নের কবিতার ভীষণ ভক্ত।অনেক কবিতা না পড়লেও প্রকাশিত সব কবিতা পড়ি।ভালোলাগে।আগামীদিনে আরো চাই।
Ak ononto chinta te vese jabar moto bhabdhara khuje pai Ayan Da r lekha kobita gulite. I wish to see more Literary writings of yours in the coming days. Its always a pleasure to read your poetic expressions.