অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তকে লেখা খোলা চিঠি
শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
" আপনি লিখেছেন, ব্রদস্কির কথা। সর্বোপরি দিয়েছেন ওসিপ মান্দেলশ্তামের খবর। নাদিয়েজদা মান্দেলশ্তামের লেখা হোপ এগেইন্সট হোপের কথা। দিয়ে গেছেন নিরন্তর বার্লিন প্রাচীর ভাঙার পরের ধারাভাস্য। উপসাগরীয় যুদ্ধ হয়ে বলকানের যুদ্ধ। যুদ্ধ ঢুকে গেছে আপনার জিভে ভাঙা কাচের টুকরো। কিন্তু আপনি তো কবি, লিরিকাত্মাই আপনার ভারতাত্মা। আপনার পক্ষে শুধু গদ্য লিখে চুপ থাকা সম্ভব ছিল না। আপনি কি জানতেন না কবিতায় রাজনীতি চলে না বিশশতকের বিভীষিকার পরে। প্রতিবাদের কবিতা আসলে কিছু করতে পারে না। তাই আপনি সেই পথে হাঁটেননি। আপনি কী জানতেন না সাহিত্যের অমর হবার ফরমুলা! সারাজীবন পড়িয়ে এটুকু তো শিখতে পারতেন! কিন্তু না। আপনার জিভে যুদ্ধের ভাঙা কাচ। আপনি ২০০৩ এর ম্যাক্সমুলার সন্ধ্যায় বলেছিলেন আপনার কবিতার গায়ে গালফ যুদ্ধের অনপনেয় দাগ। বুঝিনি। শান্ত কলকাতায় কোনও যুদ্ধ আঁচ ফেলে না। শুধু স্তালিনমাদুলি দল বলে দিলে মার্কিন হানাদারদের বিরুদ্ধে মিছিল হয়। কিন্তু ফিদেল কাস্ত্রোর সমকামী মানুষের কন্সেন্ট্রেশান ক্যাম্পের বিরুদ্ধে হয় না। কারণ সে খবর আসে না, বা আমরা চাই না আসুক। আপনি চেয়েছিলেন। আসুক। আপনি দেখতে পেয়েছিলেন আমাদের একুশ শতকে কবিতার কোনও সামাজিকতা নেই। তার নেই অমরত্বের সুযোগ। অতএব আপনি নিজের আয়ুধ লিরিকেই গুঁজে দিয়েছেন খবরের কাগজের অক্ষর। "
অলোকদা,
আপনি প্রণামে বিশ্বাস করতেন না, তবুও প্রণামেই শুরু করি, আমাদের আজন্ম শিক্ষকহীন প্রজন্মের পাশে হাভাতে বিশ্বের অক্ষরগুলোকে বিশ একুশের সন্ধি শতকের উপযোগী করে ছেড়ে রাখার জন্য। আগে হলে হয়ত এক দুর্মর ফ্যাক্স করে দিতাম আচমকা আপনার ঘুম ভাঙিয়ে। আপনিও হয়ত চকিত জবাবে আমার দিন টানটান করে দিতেন। কিন্তু আজ থাক সেসব কথা। আজ আপনাকে যা জানাতে চাই তা এক স্পষ্টতা। আমি আপনাকে বুঝতে পারছি। আপনার কবিতার মধ্যে ঢুকতে পারছি নিজের অভিজ্ঞতায়। হয়ত আপনার জানা ছিল আপনার বিশ্ব-পর্যায়ের কবিতা, অর্থাৎ আপনার কবিতার সবচেয়ে বড় অংশকে বাংলা কবিতার কেষ্ট বিষ্টুরা নাকচ করেছিল। আমিও। মনে হত কী দরকার ছিল কবিতায়, তা আবার ঝুঁকিহীন লিরিক ফর্মে ওইসব বাহ্যিক বিষয় টেনে আনা। আপনার সঙ্গে কথা বলতে ভয় পেয়েছি। একটা সময় প্রবল অবসাদে আপনার কবিতায় আলো দেখতে পেলেও পরে মনে হয়েছে, কেন! দূরে গেছি। ফিরে পড়তে গিয়ে দাগ লেগেছে সমসময়ের নাকচের। কিন্তু আজ প্রিয় প্রাক্তন ছাত্রী, ইউক্রেনের তরুণ কূটনীতিবিদ আনা মারচেংকোর ইমেইল আমাকে আপনারই মত ছন্ন করে দিল। আমি গত সপ্তাহে এই চলমান যুদ্ধমালার এক প্রধান অধ্যায়ের সূচনা পর্বে তাঁকে চিঠি লিখেছিলাম। তার উত্তরে ছিল আত্মবিশ্বাস। সারা ইউরোপ সঙ্গে আছে ইউক্রেনের, রাশিয়া কী এমন করতে পারে! আমারও মনে হয়েছিল বিবেকী ইউরোপ একবার সাড়া দেবে। যেমনটাবা আগেও দিয়েছে, আপনারই লেখার যার সঙ্গে পরিচিতি, সেই ভ্রমণে নয় ভূবনে থেকে সমবায়ী শিল্পের গরজে অব্দি। কিন্তু আজ আনার এই চিঠি আমাকে প্রথমেই যে কবিতা মনে করালো তা আপনার, এবং যে মনে হওয়া আমাকে আরও একবার স্পষ্ট করে দিলো আমার মাতৃভাষা যে কবিতা ছাড়া আর কিছু নয়, আমার এই প্রাতিস্বিক ছেনালির মাঝেও আসলে কবিতাই প্রকৃত ভাবনার জগত, এবং সে অসহায়ভাবে কবিতা দিয়েই দুনিয়াকে ছুঁয়ে ছেনে দেখতে চায়। “সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের শান্তিবাহিনী/ বেয়নেট হাতে রক্ত মাখিয়ে/ খিন্ন আফ্রিকার দিকে রুটি ছুঁড়ে দিলে/ ধ্রুপদী কবিতার কানাগলিতে আর কি ফেরা যায়?” না যায় না। যদিও জেনেছি কবিতা আসলে আমাদের অন্তঃকরণের সাজ ও রক্ষণ সেখানে এই বহিঃদুনিয়ার কী কাজ? ভেবেছি আর সজাগ হয়ে উঠেছি স্পষ্টতায়। কবিতা কিছু পারে না। এমনকি কবিকেও বদলাতে পারে না। তাহলে কবিতা কী দেয়। দেয় আমার মত কিছু নাছোড় মানুষের সংবেদনের ভাষা। মনে পড়ছে ২০০৩ সালে পুরনো ম্যাক্সমুলার ভবনের সেই সন্ধ্যা, আপনি পশ্চিমী ধ্রুপদী সঙ্গীতের অনুষঙ্গে আমাদের সামনে এনেছিলেন যুদ্ধের ছায়ায় নামক এক গদ্যের বই, হ্যাঁ, এতদিন এত বিস্মৃতিপ্রিয় মাথায় এই বই ও সেই সন্ধ্যা, বস্তুত অদ্রীশ বিশ্বাসের সৌজন্যে, আজও স্মৃত। আমরা চুপ করে যাই। বাংলা কবিতার জগত ডুবে থাকে তার গহিন আন্ডার ওয়ার্ল্ড ও শীতকালীন আমোদে। আপনিও আসতেন এই শীতকালে। অংশগ্রহণ বা বর্জন করতেন। হয়তবা বাংলার আবহমানে কোনও ছায়া পড়েনা যুদ্ধ বা গার্হস্থ্য হিংসার, দেখে আপনি নিশ্চিত হতেন হয়ত বা। আমিও হতাম। কিন্তু অই! বুঝি একবার যুদ্ধস্পৃষ্ট হলে আর ফেরা যায় না। আমাদের প্রতিনিয়ত চলা হিংসার সুনির্বাচিত ঝলক আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়। স্পষ্ট বুঝে যাই আরেকবার কবিতা কিছুই করে না এক দীর্ঘ অসাড় ছড়িয়ে রাখা ছাড়া। আর যেখানে “কবিতা জগত” নিজেদের মধ্যেই চুপ সেখানে বাহ্যিক দুনিয়ায় তার অনুপস্থিতি স্বাভাবিক। কবি আমাদের সময়ে এসে আর জনগণের মুখ হতে পারেন না। কারণ জনতার সঙ্গে তার কোনও যোগ নেই। আর এখানেই কি মনে হয় কবিদের ব্যক্তিগত পাওয়ার অংক ছাড়া সবকিছুতে নিঃস্পৃহ থাকা স্বাভাবিক। আর অস্বীকার করা যায় না অতিরিক্ত সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মিছিল আমাদের যাবতীয় সংবেদনশীলতাকে ভোঁতা করে দিয়েছে। আমরা বুঝেছি রাজনীতি একটি পেশা, সেখানে অ্যামেচার লোকের স্থান নেই। বুঝে গেছি আসলে দুনিয়া চালায় কারা। আপনিই খোলসা করে দিয়েছেন যুদ্ধের ছায়ায় যুদ্ধজীবি যুদ্ধচর যুদ্ধপ্রাণ যুদ্ধোৎসাহী সরকারদের কথা। পরে আরও খোলসা হয়েছে বিদেশনীতি ও স্বদেশনীতি আলাদা। কূটনৈতিকতা। স্পষ্ট হয়েছে ঔদাসীন্য ও অসহায়তা। কিন্তু আজ যখন যুদ্ধ ঢুকে পড়লো আমার সকালের কফিতে, এসে পড়েছিলো আগেও এই একই যুদ্ধবাজ রাশিয়ার জর্জিয়া আক্রমণ, কিন্তু তখন আমি ইউরোপে, শান্ত উদার গণতন্ত্রের আবরণে দেখছি মিউজিয়াম। কলকাতায় চলে যেতে চলেছে সিপিএম যাদের মারণ ক্ষমতা আমাকে কোনও দিন আশ্চর্য করেনি! আগেই দেখেছি কলকাতার বুদ্ধিজীবিদের সিপিএম প্রেম। তর্ক করে বোকা বনেছি গ্রামে সে দলের অত্যাচারের কথা বলে। মিছিল বেরিয়েছিলো গোধরা নিয়ে। শুধুই গোধরা নিয়ে, কেশপুর গড়বেতা নিয়ে নয়। আজ এত বছর পর আমি পশ্চিমবাংলায় নেই। একটা সাধারণ পেটের ভাত জোটাতে পারিনি। উদ্বাস্তু হয়েছি। আপনি বইতে লিখে দিয়েছিলেন আজকের উদ্বাস্তু কালকের বিশ্বনাগরিক। সে কি সহজে হওয়া যায়? হয়ত ভাল হত আপনার হির্শবার্গের মত আমার সোরিয়া বেছে নিলে। আরেকটু কেন্দ্রে থাকা যেত। কিন্তু আমি পেয়েছি দিল্লি। এই করোনা-বন্দিদশা আসার আগে অব্দি আমার কাজের জায়গা, সেরবান্তেস ইন্সটিটিউটের খাবার ঘরে ছটা দেশের রান্নার গন্ধ ভাসত দুপুরে। যুদ্ধ এসেছিল, গুয়াতেমালার মেহিকোর হিংসা, গোটা লাতিন আমেরিকার মানুষের গ্লানি ও স্তালিনবাদী দলেদের অত্যাচার, মার্কিন অত্যাচার, ইতিহাসের জোরালো মুগুর। এসেছে, আমার খাবার দুপুরে, কফিতে, জড়িয়ে গেছে অপহৃত মানুষের খবর। আমিও তো দেখেছি, সিপিএম কীভাবে জয়নগরে এস ইউ সি আই বা সাগরে আর এস পি র লোকেদের মেরেছে। আমারও তো “রাজনৈতিক হিংসা” -র শিকার পিতৃহীন বন্ধু ছিল। অপহরণ কাকে বলে তা আমি নিজের কৈশোর প্রতিবেশেই দেখেছি। এখন সিপিএম চলে গেছে। হয়ত চিরতরেই। স্বাধীন বাংলায় সরকার পুনরাবৃত্ত হয়নি কখনও। কিন্তু হিংসা থামেনি। শ্রুত সত্তরের দশকের হিংসা হয়ে নতুন সহস্রাব্দে স্তালিনের ছবিতে মালা লাগানো দলের হিংসা। আপনিও দেখেছেন। পূর্ব জার্মানি, পূর্ব ইউরোপ। জানতেন বাংলায় স্তালিন ভগবান। সে যে হিটলারের চেয়েও বেশি লোক মেরেছে সে কথা বলা যাবে না। আপনি লিখেছেন, ব্রদস্কির কথা। সর্বোপরি দিয়েছেন ওসিপ মান্দেলশ্তামের খবর। নাদিয়েজদা মান্দেলশ্তামের লেখা হোপ এগেইন্সট হোপের কথা। দিয়ে গেছেন নিরন্তর বার্লিন প্রাচীর ভাঙার পরের ধারাভাস্য। উপসাগরীয় যুদ্ধ হয়ে বলকানের যুদ্ধ। যুদ্ধ ঢুকে গেছে আপনার জিভে ভাঙা কাচের টুকরো। কিন্তু আপনি তো কবি, লিরিকাত্মাই আপনার ভারতাত্মা। আপনার পক্ষে শুধু গদ্য লিখে চুপ থাকা সম্ভব ছিল না। আপনি কি জানতেন না কবিতায় রাজনীতি চলে না বিশশতকের বিভীষিকার পরে। প্রতিবাদের কবিতা আসলে কিছু করতে পারে না। তাই আপনি সেই পথে হাঁটেননি। আপনি কী জানতেন না সাহিত্যের অমর হবার ফরমুলা! সারাজীবন পড়িয়ে এটুকু তো শিখতে পারতেন! কিন্তু না। আপনার জিভে যুদ্ধের ভাঙা কাচ। আপনি ২০০৩ এর ম্যাক্সমুলার সন্ধ্যায় বলেছিলেন আপনার কবিতার গায়ে গালফ যুদ্ধের অনপনেয় দাগ। বুঝিনি। শান্ত কলকাতায় কোনও যুদ্ধ আঁচ ফেলে না। শুধু স্তালিনমাদুলি দল বলে দিলে মার্কিন হানাদারদের বিরুদ্ধে মিছিল হয়। কিন্তু ফিদেল কাস্ত্রোর সমকামী মানুষের কন্সেন্ট্রেশান ক্যাম্পের বিরুদ্ধে হয় না। কারণ সে খবর আসে না, বা আমরা চাই না আসুক। আপনি চেয়েছিলেন। আসুক। আপনি দেখতে পেয়েছিলেন আমাদের একুশ শতকে কবিতার কোনও সামাজিকতা নেই। তার নেই অমরত্বের সুযোগ। অতএব আপনি নিজের আয়ুধ লিরিকেই গুঁজে দিয়েছেন খবরের কাগজের অক্ষর। আপনার কবিতা থেকেই বুঝেছি আমার শহর দিল্লির রিং রোডের সূর্যাস্ত কেন খড়িবলি বলে! আপনি বাঙালির চিরন্তন কবিতা পাঠের অভ্যাসে বাহ্যত নাড়া দেননি। দিয়েছেন তার বিষয়ে। জানি না ঠিক বলছি কিনা, তবে এটুকু বুঝি, কবির মন, কবিতা পাঠকের মন তার সমস্ত কিছুর উত্তর কবিতায় চায়। বা চাওয়া উচিত। আপনি নিজেকে সেই কৈফেয়ত দিয়েছেন। অমরত্ব তাচ্ছিল্য করে, লিরিকপ্রাণ ছিঁড়ে ফেলে নির্মাণ করেছেন পিচ্ছিল খবর দেওয়া কবিতা। যুগান্তর হয় না। আমাদের সময়ে এক যুগ অনায়াসে সেঁধিয়ে যায় অন্য যুগে। কিছুই বদলায় না। শুধু প্রিয় ছাত্রীর যুদ্ধাকুতি চিঠিতে পেয়ে আর কোনও কবিতা নয়, মনে পড়ে আপনারই কবিতা। আজ বিকেলে আবার শরণার্থীর ঋতু খুলে বসব। সঙ্গে রাখবো যুদ্ধের ছায়ায়। কেননা আমাদের সময়ে যুদ্ধ থামে না। থামবেও না। শুধু অন্ধকারের সঙ্গে আরেক অন্ধকারকে মিলিয়ে দেখে নেবো আমাদের সময়টা একা নয়। কবির দায় হয়তো সেটাই। শুধু বুঝি আপনি নিজের কবিতার কাছে সৎ ছিলেন।
শ্রদ্ধা জানবেন। ভালো থাকবেন।
শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
নয়ডা
২৭/০২/২০২২
অসম্ভব সংবেদনশীল লেখা কিন্তু সত্যি সত্যি আমরা তাকে হারিয়ে ফেলেছি। যে জাতি যুদ্ধের ভয়ংকরতার মধ্যে দিয়ে যায় নি তার কাছে যুদ্ধের নামে কবিতা না লেখা হয়ত কিছুটা মেনেও নেওয়া যায় কিন্তু হিপোক্রেসিটা মেনে নিতে পারা যায় না যখন এরাই যুদ্ধ বিরোধী মিছিল করে। ‘তোমার নাম আমার নাম আমার নাম ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম’ করে। শাসকের প্রতি লেখার পর সেই শাসকের চাটুকার হয়ে যায়। খুব আত্মবিশ্লষণ দরকার আমাদের। এরপর কবিতা লিখতে বসে হয়ত থ হয়ে থাকবো । যদি ছেড়ে দিতে পারতাম সবচেয়ে ভালো হত! কিন্তু এত জোর দিয়ে বলতে পারবো না। রক্তের ভিতরে নিস্তেজতা হিম হয়ে আছে শুভ্রদা।