অলোকরঞ্জনের কবিতা–ভুবন: ‘ভারতবর্ষের চেয়ে দুঃখী দেশ আমার হৃদয়’
: রাহুল দাশগুপ্ত
বিশ শতকের সত্তর দশকে, ইমার্জেন্সির সময়, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কবিতায় একটি নতুন বাঁক আসে। এ প্রসঙ্গে তিনি নিজেই লিখেছেন, ‘কবিতাকে শাশ্বতে ন্যস্ত রেখেও যুগাবর্তের শামিল হতে হবে। এরপর থেকে আমার লিখতে–চাওয়ার ইতিহাস হয়তো চিরায়তের সঙ্গে সমকালীনের অন্তর্বয়নের সমাচার, কখনো সরাসরি কখনও বা একান্তর আড়বুনুনিতে।’ অতএব অলোকরঞ্জনের কবিতায় মিলেমিশে যেতে থাকে দুটি স্বর, শাশ্বত এবং যুগাবর্তের। তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে, আক্ষরিক অর্থেই চিরায়তের সঙ্গে সমকালীনের অন্তর্বয়নের সমাচার। আগে যা ভাবাই যেত না, অলোকরঞ্জনের কবিতায় উঠে আসতে থাকে সেইসব উচ্চারণ। একদিকে তিনি লেখেন, ‘সংকলিত সত্তা আমার একাগ্র পবিত্র করে রাখি।’ অন্যদিকে তিনি ঈশ্বরের অন্তর্বাস খুলে দেখতে চান।
অলোকরঞ্জনের কবিতায় একজন সাধককে অনায়াসেই চেনা যায়। তাই তিনি লেখেন, ‘গোপন কান্নার মতো ঘুণাক্ষরে আমার ভিতরে বুদ্ধ বাড়ে।’ এই সাধক পুবের বারান্দায় হোমানল জ্বেলে বসে থাকেন। তিনি চান নিঃসঙ্গতা। সাধকের এই নিঃসঙ্গতার ছবি চমৎকার ফুটে ওঠে একটি কবিতায়, ‘একটা কাক প্রজ্ঞাপরিমিত/ বসে আছে সেগুন ডালের একটিমাত্র চুড়োয়/ একটি শান্ত অপ্রতিবাদ।’ তিনি শিশুদের দেখতে থাকেন, যারা বারান্দা থেকে দিগন্ত ছিঁড়ে অনন্ত মহাকাশের দিকে যেতে চায়। শিশুরা স্বাধীন এবং নিষ্পাপ। সাধক মানুষটি যেন পুজো করেন এই নিঃসঙ্গতা, নিষ্পাপতা এবং স্বাধীনতাকে। তিনি পুজো করেন হোমানলের শুদ্ধতা এবং পবিত্রতাকে। ‘পুবের বারান্দা’য় দিনের প্রথম আলো এসে পড়ে। তিনি পুজো করেন সেই আলোকে, যা জ্ঞান এবং প্রজ্ঞার প্রতীক। এই সাধক চান বিপন্ন মানবতার স্বর হয়ে উঠতে। তার আশ্রয় হয়ে উঠতে। অলোকরঞ্জন তাই লেখেন, ‘আমার হাত এক বিঘৎ ঈষৎ মেঘ, ছায়া দিচ্ছে/ হাত সরালে রৌদ্র হবে খুব।’
কিন্তু অলোকরঞ্জন কখনও ভুলতে পারেন না তিনি একজন শিল্পীও বটে। তাই লেখেন, ‘হাত থেকে ঝরে যায় ঝরে ঝরে যায়/ অবিরল চিত্রকল্প।’ কিন্তু বর্তমান পৃথিবীতে একজন শিল্পীও কী বিপন্ন নন? একটি কবিতায় তাই তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘সুন্দর আর কতো নিরুপায়?’ তিনি জানেন, শিল্পীকে নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে মানুষজনের প্রবৃত্তি ও প্রবণতা। কেউ তাঁর দিকে এগিয়ে দেবে না দরদীর হাত, এমন–কী আবিষ্কারের চূড়ান্ত মুহূর্তেও। এই শিল্পী শাশ্বতের খোঁজে আর্ত। তাই তিনি লেখেন, ‘তবু খুঁজেছিলাম সত্তার শাশ্বত আলম্বন বিভাব, নিছক হৃদয় এবং ইন্দ্রিয় পার হয়ে।’ এই কী একজন প্রকৃত শিল্পীর কাজ নয়? সত্তার শাশ্বত আলম্বন বিভাবকে খোঁজা? এই শাশ্বতের বর্ণনা তিনি এইভাবে দেন, ‘আমিও আপন বাল্যকালে বালক ছিলাম/ আমিও অনন্ত ও মৃত্যুর কপালে/ তিলক পরাব বলে তখন ভেবেছিলাম।’ শিল্পের অসুখে ভুগেও তিনি বেঁচে থাকতে চান শ্রীমন্ত কৌতুকে। এই কবি জানেন, একজন কবির যাত্রা সবসময়ই ভোরের দিকে।
তাঁর কবিতায় অনায়াসে আসেন, ‘রাজা ওইদিপৌস’ নাটকের তাইরেসিয়াস, ভার্জিল, হাফিজ, সুফীরা, মঙ্গলকাব্যের কবিরা, নোভালিস, রেমব্রান্ট, সুরদাস, পাউল ক্লের ছবি, আদ্রেঁ জিদের জার্নাল, কাফকা, কাম্যু, গটফ্রিড বেন, আন্তোনিও মাচাদো, টয়েনবি, ভিত্তোরিয়া দে–সিকা, শরৎচন্দ্র, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অতসীমামী’, নন্দলাল বসু, রাধিকামোহন মৈত্র, তরু দত্ত, বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য, অমিয়ভূষণ মজুমদার, বিজন ভট্টাচার্য, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, দাউদ হায়দার। তিনি এক বিশ্ব–নাগরিক। তাই নিগ্রো নাকাড়া আর ষড় গোস্বামীর মৃদঙ্গ মিলেমিশে যায় তাঁর কবিতায়। কিন্তু তারপরও তিনি ফিরে ফিরে আসেন মাটি ও শেকড়ের কাছে। নিজের ভাষা ও সংস্কৃতির রূপক ও প্রতীকগুলির কাছে। তাঁর কবিতায় দেখা যায় এমন লাইন, ‘উপেন্দ্রকিশোর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়েছে এই রূপক যেখানে বাঘ এবং গোরুতে একঘাটে জল খায়।’
একটি কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘ভারতবর্ষের চেয়ে দুঃখী দেশ আমার হৃদয়।’ বিশ্ব–পর্যটক এই শিল্পীর চোখে উত্তর–ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষ যে কতটা দুঃখী দেশ, তা নিশ্চয়ই চোখে পড়েছিল। তাই নিজের ব্যথাতুর হৃদয়ের বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি এরকম তুলনা টেনেছেন। অলোকরঞ্জন ঘোষণা করেছেন, ‘ভয়ানক ঘৃণা করি ঔপনিবেশিকতা!’ কিন্তু উত্তর–ঔপনিবেশিকতার চেহারা যেন তার চেয়েও ভয়ানক। হিংসা ও সন্ত্রাসের আগ্রাসনে মানুষ সেখানে বিপন্ন। তীব্র শ্লেষে অলোকরঞ্জন লিখেছেন, ‘প্রেম যেরকম মুগ্ধ প্রেমের কবিতা নয়/ দেশটা যেমন কখনো নয় মন্ত্রণালয়।’ এ এমন এক দেশ, যেখানে বন্ধু প্রকাশকের কাছে গিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে, তার বন্ধুর নতুন পান্ডুলিপি নিছক আবর্জনা ছাড়া কিছুই নয়! কিন্তু মানবিক কবি শত্রুদেরও দেখেন একজন শিল্পীর চোখ দিয়েই, তাদের বাকরীতিকে দেখে তাঁর মনে হয় নিসর্গ, তাদের উত্থাপিত হাত দেখে স্থাপত্যের কথা মনে পড়ে তাঁর। বারান্দার পাশে জড়ো হওয়া নখদন্তহীন, রাতের নিন্দুকদের জড়ো হতে দেখেও তিনি আলো জ্বালানোর কথা ভাবেন।
অলোকরঞ্জন যেন দেখতে পান, এক প্রকান্ড ক্ষয়ের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে মানব–সভ্যতা। মোমের দুদিকই পুড়ছে। রাত্রিকে তাঁর মনে হয়, গণিকার মতো। এ এমন এক সময়, যখন, ‘কাপুরুষ দেখে সংগ্রামীরাও লুকিয়ে পড়ে।’ এরকম সময় সাধারণ মানুষের মধ্যেই অলোকরঞ্জন খুঁজে নিয়েছেন নিজের নিসর্গকে। লিখেছেন, ‘দুদিকে খাটিয়া পেতে ঘুমিয়ে থাকে কাতারে কাতারে নরনারী/ তাদের মাঝখান দিয়ে হেঁটে যাবার পথটাই আজ আমার নিসর্গ।’ তখন আপাতমৃত লোকালয়ের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে, রাত্রির নাগরিকতাকে প্রত্যক্ষ করতে করতে, তিনি অনুভব করেন অনন্ত নিসর্গের আস্বাদ। তিনি খোঁজেন বন্ধুত্ব, কারণ, ‘বন্ধুত্বের ইতিহাস সংস্কৃতির ইতিহাস।’ তাঁর মনে পড়ে, ভগৎ সিং–এর মতো নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিকদের কথা, যাদের ফাঁসির কাঠে শিশির লেগে তাকে যেন নতুন মাতৃভূমির মতোই মনে হয়। ত্যাগের ছোঁয়ায় ফাঁসিকাঠ যেন বদলে যায়, হয়ে ওঠে নতুন মাতৃভূমি। মজুরদের তিনি সহতীর্থ ভাবেন, দেখতে পান, বিজন ভট্টাচার্যের নাটক থেকে উঠে এসে তারা তুলে আনছে তাল–তাল রোদ্দুর।
অলোকরঞ্জন তাঁর কবিতাকে চারপাশের সমস্যাদীর্ণ বাস্তব–পৃথিবীর সঙ্গে যুক্ত করতে চেয়েছেন। তিনি মানবহৃদয়ের সার্বজনীন বেদনাকে স্পর্শ করতে চেয়েছেন। আবার তিনি সেই বাস্তব–পৃথিবী এবং বেদনার ক্ষণস্থায়িত্বকে অতিক্রমও করতে চেয়েছেন। শাশ্বতের প্রতি আর্তি সারাজীবন তাঁকে তাড়িত করেছে। তিনি নিশ্চিতভাবেই বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রনাথের এক যথার্থ উত্তরাধিকার। তাই একইসঙ্গে নেমে আসতে চেয়েছেন সাধারণ মানুষের মধ্যে, হতে চেয়েদের তাদের দুঃখ–যন্ত্রণার অংশীদার। অন্যদিকে তিনি উঠতে চেয়েছেন এমন এক উচ্চতায়, যেখানে সমস্ত তুচ্ছতা, সাময়িকতা, সংকীর্ণতা ও সীমাবদ্ধতা তুচ্ছ হয়ে যায়। রোজকার জীবনের অভিজ্ঞতা ও সংলাপ থেকেই তিনি তাঁর কবিতার বিষয় খুঁজে নেন। তারপর তা তোলপাড় তোলে তাঁর অন্তর্জগতে। তিনি প্রতিক্রিয়া জানান কবিতার সাবলীল ভাষায়। আর তাঁর অস্তিত্বের বোধ যেন ছড়িয়ে যেতে থাকে, সত্ত্বা যেন ডালপালা আর শেকড়বাকড় ছড়িয়ে দিতে চায়, কখনও তা নামতে থাকে পার্থিব পৃথিবীর দিকে, মজুরদের বন্ধু হয়ে উঠতে চায়, কখনও তা উচ্চতা পেয়ে উঠতে থাকে, আর ঈশ্বরের দিকে আর্ত হাত বাড়িয়ে খুঁজে নিতে চায় তাঁরও বন্ধুত্ব।
তাঁর কবিতায় ভাষা ও ছন্দ নিয়ে সারাজীবন নানা পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে গিয়েছেন অলোকরঞ্জন। ভাষা ও ছন্দের খেলায় তিনি যেন বুঁদ হয়ে থাকতেন। তাই প্রচুর শব্দের সমারোহে অনেক সময় তিনি কী বলতে চান, তা যেন ঠিক স্পষ্ট হয়ে ওঠে না। কোনও দৃশ্য বা স্মৃতি, টুকরো টুকরো অভিজ্ঞতা, রোমান্টিক কিছু অনুভূতি বা উপলব্ধি নিয়ে তিনি লিখে যান একের পর এক কবিতা। আর কখনও কখনও তাঁর আত্মাকে মথিত করে উৎসারিত হয়ে ওঠে এমন কোনও বিশ্বাস, যার মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে তাঁর সত্ত্বার নির্যাস বা অনুসন্ধান। নিজের মতো করে তিনি ভাবেন এবং ভাষা ও ছন্দের নানা বৈচিত্র্যের মধ্য দিয়ে তাকে প্রকাশ করেন। তাঁর দেখার চোখ মৌলিক ও নিজস্ব। তাঁর কবিতায় আবেগ কম, যুক্তি ও প্রজ্ঞা বেশি। পাঠকের সঙ্গে তাঁর কবিতা সবসময় সংযোগ তৈরি করতে পারে না। বাংলা কবিতায় অলোকরঞ্জন যেন এক শ্রমণ, যিনি সারা জীবন কারো পরোয়া না করে নিজের মতো করে হেঁটে গিয়েছেন, তাঁর সেই চলার পথের একদিকে রয়েছে মানুষ, অন্যদিকে রয়েছেন ঈশ্বর। কখনও তাঁকে বোঝা যায়, কখনো যায় না। কখনো তাঁকে স্পর্শ করা যায়, কখনও যায় না। তিনি একইসঙ্গে একজন শিল্পী, সাধক, প্রাবন্ধিক, দর্শক এবং অনুবাদক। তাঁর কবিতাকে ঠিক যেন কোনও চেনা ছকে তাই ফেলা যায় না…
কবিতা সংগ্রহ। দ্বিতীয় খন্ড। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত