অভিজিৎ ঘোষ- এর কবিতাগুচ্ছ
হারানো সুর
যেদিন আকাশ মেঘে ঢাকে না
ফুটে ওঠে সব তারা
আমি ছাদে উঠে যাই
হাত নাড়ি তারাদের…
ওই তো হাত নাড়ছে শ্যামল
ওই তো ওই তো কাকু, ওই যে
দূর্গা, আঁচল পেতে কুড়িয়ে নিচ্ছে সব আম, আর
ওই বাঁ’দিকে ঘেঁষে সাদা শাড়িতে ঠাকুমা-
বসে বসে নারকোলের নাড়ু বানাচ্ছে…
রাতের আকাশ আসলে আর কিছুই না
হাফ শ্যুটিং হওয়া বায়োস্কোপ…
উপসংহার
আমিই সেই সেনাপতি-
নিজের হাতে সাজিয়েছি পরাজয়ের চক্রব্যূহ
তারপর আমার বিশ্বস্ত বাহিনিকে
ঠেলে দিয়েছি মৃত্যুর দরজায়
নিজের হাতে লন্ডভন্ড করেছি সাজানো বাগান
উপড়ে ফেলেছি শিকড়সহ শাল, সেগুন, মেহগনি
এবার আমি নিজেই সেজেছি যোদ্ধার বেশে
এই তুলে নিলাম তরবারি, তীর-ধনুক
কেউ নেই যে বর্ম পরিয়ে দেবে…
তবুও লুকাবো না দ্বৈপায়ন হ্রদে…
একদিন ঠিক রচিত হবে নির্ভুল চক্রব্যূহ…
২০২১
এক
এই দুপুর বারোটায়
মাঝরাতের চেয়েও গভীর অন্ধকার
যে ন্যাংটো ছেলেটা মরামের রাস্তায়
ধুলো মেখে ঘুরছিল- এইমাত্র
সে ঘরে ঢুকে গেল খেলার সঙ্গী না পেয়ে…
ও এখন কী করবে?
দুই
একদিন বাসে যেতে যেতে
পতপত ওড়া পতাকা
তোমাকে সামান্য শান্তি দিয়েছিল…
এখনো স্বপ্নে আসে সেই পতাকা?
তুমি কি তার রং চিনতে পারো?
তিন
একদিন শিমুল পলাশে মত্ত হয়ে ভেবেছিলে
ওই রঙে পৃথিবী ছেয়ে যাবে…
এবারো ফুটেছে, প্রাকৃতিক নিয়মে, পলাশ শিমুল
এখনো কি তোমার চোখে স্বপ্ন জেগে আছে?
পিকচার আভি বাকি হ্যায়
মাঝে মাঝে মনকে ধাক্কা দিই,
মনে করায়- সেই দিন,
গোধূলিবেলা আর হাঁসেদের ঘরে ফেরা-
ঠিক যেন কমল হাসান ধাওয়া করেছে শ্রীদেবীকে…
মন কানে কানে বলে যাই-
এত তাড়া কীসের,
পিকচার আভি বাকি হ্যায়…
শৈশব
রাতে খাবার শেষে
মা একবাটি দুধ দেয়
আমি একচুমুকে শেষ করি
মা খালি বাটির দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে
ফেলে আসা দিনের কথা—
মায়ের আঙুল ধরে আমার হেঁটে যাওয়া…
মোজা, আমি আর রোমান্টিক কবিতা
ব্যস্ততা বলতে মোজা না খুলেই
খাটে উঠে পড়েছি- ব্যস এটুকই
সামনে সাদা কাগজ কলম
জানলা দিয়ে সেই পুরানো চাঁদ আর তার
আলো, সঙ্গে কিছু তারা আর জোনাকি
ঘামের গন্ধে সারা ঘর ভরপুর
একটা টিকটিকি ওঁত পেতে আছে…
ময়নার মা রুটি-তরকারি ঢাকা দিয়ে চলে গেছে
মনে আছে- বসাকদা ভাড়ার তাগাদা দিয়েছে তিনবার
আবার সিগারেটের গন্ধে ভরে যাচ্ছে ঘর
সাদা কাগজে আঁচড় পড়ছে
এবার লেখা হবে একটি রোমান্টিক কবিতা…
অন্তর্ঘাত
জ্বলন্ত উনুনের কাছে গিয়ে বসি
মুঠো-মুঠো উষ্ণতা কুড়িয়ে
বেরিয়ে পড়ি রাতের রাস্তায়
বাতাসার মতন উষ্ণতা ছড়ায়
কিছদূর গিয়ে দেখি-
বাঘের মতো ঘাপটি মেরে বসে আছে শীতের কূয়াশা
আমাকে গিলবে বলে…
লড়াই
ছিলায় টান পড়ল আর
কেঁপে উঠল বন, গুহা, পাহাড়
এই বুঝি শুরু হল আক্রমণ
গুহামানব আঁকড়ে ধর দেওয়াল
বাঁচাতেই হবে
গুহার দেওয়ালে আঁকা চিত্র
হাজার বছর পরে মানুষ দেখবে
কীভাবে বাঁচাতে হয় সভ্যতা
কশেরুকা বন্ধক না রেখে…
একটি যৌনতার কবিতা
ভোরবেলা। শিউলি ছড়ানো উঠোনে
ঝাঁট দেওয়ার আগেই
কুড়িয়ে নিলে শিউলি
যত্ন করে রাখলে ঘরের টেবিলে
আমার চোখে তখন ভোরের স্বপ্ন
ঠেলা দিয়ে তুললে…
সূঁচ-সুতো নিলে
গাঁথা হবে একটি মালা…
আমার চোখ তখন তোমার আঙ্গুলে,
আর এলানো বিছানা
আমার কাঁধে হাতে রেখে
ক্যামেরার শাটার টিপছে…
ইতিহাসবিদ
ইচ্ছে হয়, সিগমা (Σ) হয়ে উঠি
তারপর সাজানো বাগান, ঘিঞ্জি বস্তি
লাল-নীল ছেলে-মেয়ে, উড়ালের নীচে ছেলে-মেয়ে
ব্যর্থ প্রেমিক, সংসারী মানুষ
সবাইকে একসাথে জুড়ে দিই- যেভাবে
ওয়াশিং মেশিনে অভিমানী ব্লাউজ
ঘেমো গেঞ্জি, আহ্লাদী বালিশের ওয়ার
একসাথে ঢুকে যায় আর টিপ-টপ হয়ে বেরিয়ে আসে…
শুধু কবি থাকবে সিগমার বাইরে
যোগ চিহ্নের সাথে ধ্রুবক হয়ে
আর মহাকালকে চিনিয়ে দেবে
পূতিগন্ধ-ল্যাভেন্ডারের ফারাক আর
চাদরের শরীরে ব্যর্থ প্রেমের উষ্ণতা…
জাদুবাস্তব
শেষ চেঞ্জ করার সময়
অনেকের সাথেই নম্বর শেয়ার করা হয়নি
হয়তো অনেকেই
পুরানো নম্বরেই চেষ্টা করছে
এই সন্ধ্যায় নির্জনে এই শহরে
মনে পড়ছে সেই দশ ডিজিটের
বহুদিনের সঙ্গীটিকে
এখন কার দখলে সেই নম্বর?
ডায়াল করলাম-
ট্রু-কলারে ভেসে উঠলো সেই নাম-
যে নামে শুধু তোমরাই ডাকতে আমাকে…
সঞ্চয়
সব কিছুই কি হারিয়ে যায়?
যা ভেবেছ হারিয়ে গ্যাছে
ভালো করে খুঁজে দ্যাখো
কেমন শিকড় আঁকড়ে পড়ে আছে
আর চুঁইয়ে পড়া রস
চেটেপুটে নিচ্ছে নিজের শরীরে
কিছুই হারায় না
আমরাই চিনতে পারি না
বন্ধু’র নরম হাতের তালু…
একা একা ঢেউয়ের সাথে
কীভাবে একা থাকতে হয়, জেনে গেছি
এখন নিস্তরঙ্গ পুকুরের সামনে বসে ঢেউ গুনি
ছোট, বড়, পুকুরের পাকস্থলী থেকে উঠে আসা ঢেউ।
এখন আর তোমার কাছে ফিরব না
তোমার চারপাশে পারিষদের দল ঘিরে থাকে
আমার চোখ ধাঁধিয়ে যায়
এভাবে কি আলো দেখা যায়?
তবে একদিন, একদিন ঠিক
তোমাকে শিখিয়ে দেব
কেমন করে ঢেউ গুনতে হয়
নিস্তরঙ্গ পুকুরের সামনে বসে…
জানলা
বহুদিন পর ফেবারিট জানলার পাশে বসেছি। গোধূলির রঙ মিশে যাচ্ছে সবুজ ঘাসের সাথে। গরুরা ফিরছে ঘরে। কোথাও বোধহয় কালবৈশাখী হয়ে গেল, সঙ্গে দু-এক পশলা বৃষ্টি। এখন তুমি কী করছ? তোমার শহরে নেমেছে আজ এমন গোধূলি? তুমি আজ কি পরবে তোমার প্রিয় হলুদ সালোয়ার, সঙ্গে ম্যাচিং ওড়না? এই ফাঁকে বলে রাখি, আমার হয়তো তোমার শহরে ফেরা হবে না। এখন ও-সব কথা থাক। একটু পরেই আঁধার নেমে আসবে। তার আগে কুড়িয়ে রাখি এই গোধূলি। তোমার জটিল শহরকে পাঠিয়ে দেব একমুঠো সরল গোধুলি…
সমর্পণ
সেই নির্জন তপ্ত দুপুরে
যেদিন আমার হাতের তালু ছুঁয়েছিল
তোমার শান্ত লাজুক গাল
আমার সকল অহঙ্কার আকাশে উড়েছিল…
নো ম্যান্স ল্যান্ড
নো ম্যান্স ল্যন্ড-
পৃথিবীর সব থেকে শান্তির জায়গা
এখানে ঘাসেরা আপন খেয়ালে বেড়ে ওঠে
সূচ্যাগ্র মেদিনীর জন্য গোলাগুলি নেই
আকাশের কোন সীমা নেই
প্যালেস্তাইনের পথিক ইজরাইলের পথিককে জল দেয়
কোনটা ভারতের আকাশ কোনটা পাকিস্তানের—
কেউ জানে না…
সব ব্যরিকেড ভেঙে আরো আরো বেড়ে ওঠো
নো ম্যান্স ল্যান্ড…
অভিজিৎ, তোমার সমস্ত কবিতা বেশ ভালো লাগলো আমার। অনেক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা রইল।
-রুচিরা দি
অভিজিৎ খুব ভালো লাগলো তোমার কবিতাগুলো।
অনেক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। আরো পড়ার অপেক্ষায় থাকলাম। ভালো থেকো।
রুচিরা দি
ধন্যবাদ দিদি
খুব সুন্দর লেখা। অসম্ভব ভালো। পড়ে তৃপ্তি পেলাম। হৃদয় ছুঁয়ে গেল।
ধন্যবাদ
প্রতিটি কবিতা ভীষণ সুন্দর
ধন্যবাদ দাদা
কবিতাগুলিতে সময়-সচেতন ও মানবতাবাদী এক কবির মুখ। বেশ কয়েকটি লেখাই উচ্চ মানের। অভিজিৎকে অভিবাদন।
ধন্যবাদ স্যার
কয়েকটি লেখা তো খুব ভাল লাগল। তোমার নিজের স্বর। সাবলীল লেখা।
ধন্যবাদ পার্থদা
আজ সকালে একসঙ্গে এতগুলি কবিতা পড়লাম! মন ভালো হয়ে গেল।বেশ ভালো লাগলো।বিষয়বস্তু এবং গল্প-ভাবনার কারণে। কিছু কবিতা নিয়ে সাক্ষাতে আলোচনার ইচ্ছে রইলো।
ধন্যবাদ। সুযোগে কথা হবে।
একসঙ্গে এতগুলি ভালো কবিতা অনেকদিন পড়া হয়নি। কবি কে হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে অনেক ভালোবাসা ও শুভকামনা জানাই।