অপুর মৃত্যু ও বাঙালি মধ্যবিত্ত মননের চলাচল <br />  দেবব্রত শ্যামরায়

অপুর মৃত্যু ও বাঙালি মধ্যবিত্ত মননের চলাচল
দেবব্রত শ্যামরায়

আটের দশকের শেষ দিকে আমরা যারা অনাড়ম্বর ছেলেবেলা কাটিয়েছি, হয়তো মনে করতে পারব প্রতি শনিবার সন্ধেবেলা দূরদর্শনে বাংলা ছবি দেখানো হত। পরের দিকে সেই স্লটটা রবিবারে সরে যায়। সেরকমই কোনও এক সন্ধেয় খেলাধুলোর পাট সেরে বাড়ি ফিরে দেখি টিভিতে ‘অপুর সংসার’ দেখানো হচ্ছে। আমাদের সব ছবি দেখার অনুমতি ছিল না, তাছাড়া ওই কাঁচা বয়সে ও ছবি দেখতে বসার কথা ছিল না, তবু সত্যজিৎ রায়-সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ইত্যাদি চেনাজানা অনুষঙ্গগুলি গোটা ছবিটা দেখিয়ে নিল। মনে আছে, দেখেছিলাম বিয়ে করতে আসা এক পাগল পাত্রের অঙ্গভঙ্গি। অবাক হয়েছিলাম কীভাবে সিনেমার স্ক্রিন ডিসলভ হয়ে বদলে যাচ্ছে ফিরতি পথের ঘোড়ার গাড়ির পর্দায়। তখন বুঝিনি, অনেকদিন পরে আবার ছবিটা দেখতে গিয়ে দেখেছি শুধু ভয়ঙ্কর সেই মজা বা বিস্ময়টুকু নয়, ছবিটির আরও অনেক উপাদান চেতনে- অবচেতনে রয়ে গেছিল। যেমন অপুর স্বপ্নতাড়িত মনোলগ। অথবা অপু-অপর্ণার স্বল্পায়ু দাম্পত্যদিনের দৃশ্যগুলো। চালচুলোহীন অপুর শ্রীহীন ঘরে অপর্ণার অপ্রস্তুত সংসার (এখানে আলাদা করে বংশীচন্দ্র গুপ্তের কথা বলতেই হয়, বিশ্বাস হয় না ওটা একটা বানানো সেট), সকালের খোলা ছাদে উনোনের আঁচ ও ধোঁয়া, অপুর প্রেম ও বালিকা অপর্ণার সিগারেট-শাসন; সৌমিত্র-শর্মিলার দাম্পত্য দৃশ্য, এবং যুবক অপুর জীবনদর্শন উনিশ শতকের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালির সেন্সিবিলিটি, তার শ্রেণিগত গুণ ও দোষসহ, নির্মাণ করে দিয়েছিল। যে বাঙালি তার পার্থিব সম্পদের চেয়ে সম্পর্ক ও মননশীলতাকে অধিক মর্যাদা দিত, যে বাঙালি অতি অল্পে খুশি, অথচ সারা বিশ্বের জ্ঞানবিজ্ঞান-সংস্কৃতি-প্রগতিশীল চেতনার সমাহার সে চেটেপুটে খেতে চাইত- বিভূতিভূষণে ভর করে নিজের সেই রেনেঁসা মূল্যবোধ ছবির শরীরে বুনে দিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়।

আমরা কেউ তো সময়-বিচ্ছিন্ন নই। ব্যক্তি সৌমিত্রও নন। তাই আজ অর্ধশতাব্দী দূরে দাঁড়িয়ে একটু আলগাভাবে দেখলে দেখতে পাব, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নিজের জীবনের চলাচলই যেন মধ্যবিত্ত বাঙালির অবনমনের লেখচিত্র। Simple living, high thinking – এর আদর্শ আঁকড়ে থাকা মধ্যবিত্ত বাঙালি যুবসমাজ কখন যে ফসিলপ্রায়, পিছিয়ে পড়া, এবং বিশ্বায়নের প্রথম ধাক্কাতেই দিশেহারা, পণ্যায়িত ভারতে বাজার চাহিদার সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে দলে দলে ব্যঙ্গালোরমুখী হতে হয়েছিল। শিল্পে মন্দা, একটির পর একটি রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে পেছনে ফেলে এগিয়েছে, সংস্কৃতি জগতে জরা, নিজের সেরা সময় পেরিয়ে আসা সৌমিত্র নিজেও বিস্মরণযোগ্য সিনেমায় বহুপ্রজ। দূষিত হয়ে পড়া বাম সরকারকে একসময় সরে যেতে হচ্ছে। জার্সি বদলাচ্ছেন, শাসকের চেয়ার মুছছেন সংস্কৃতি জগতের তথাকথিত রথী-মহারথীরা। সঙ্কট৷ আরও গভীর যখন কিছুদিন পর বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও প্রগতিশীলতার বড়াই ক্রমে খানখান হয়ে যাবে ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতিতে। উত্তরভারতের ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতি ক্রমশ শিকড় ছড়াবে শাক্ত লোকায়ত বাংলায়। সৌমিত্র অবশ্য আজীবন নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাসে স্থিত ছিলেন, এমনকি সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ঝোড়ো সময়েও, দল বদলে রাজনৈতিক সুবিধে নেওয়ার জন্য হাত পাতেননি কোনওদিন। তবে এহেন সৌমিত্রকেও অবশ্য সেই বাজারেই নামতে হল, ‘সংসার চালাতে’ নানা পাবলিক অ্যাপিয়ারেন্স, এমনকি গ্রহরত্নের বিজ্ঞাপন, পঁচাশি বছর বয়সে কোভিড উপেক্ষা করে ফের শুটিং শুরু করার ভুল অথবা নিরুপায় সিদ্ধান্ত নিতে হল। সত্যজিৎ-এর ‘দেবী’-র নায়ক হনুমানযন্ত্র বেচছেন, এই দৃশ্যে বাঙালি, যে এখনও ব্যক্তিসত্তা আর শিল্পীসত্তার বিযুক্তি হজম করতে পারেনি, তার প্রগতিশীলতার গুমোর ধাক্কা খেল। অথচ যে বাংলায় রক্তদান শিবির কমে গিয়ে দিন দিন রামনবমী ও গণপতি বাপ্পার রমরমা, সেখানে অন্য কিছু আশা করাই বা কেন? বাঙালির দীর্ঘ বস্তুবাদচর্চার ইতিহাসের মধ্যে কতখানি বেনোজল ছিল তা নতুন সহস্রাব্দে এসে ক্রমশ স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। তাই গ্রাম-পাড়াগাঁ-মফস্বল থেকে শহরে এসে মননে বিশ্বনাগরিক হওয়ার স্বপ্ন দেখা অপুর (ঠিক যেভাবে কৃষ্ণনগর থেকে কলকাতায় এসেছিলেন সদ্যতরুণ সৌমিত্র) এই আকস্মিক সংক্রমণজনিত-মৃত্যু বাঙালির রেনেসাঁ প্রজন্মের অবশিষ্ট মূল্যবোধের প্রতীকী প্রস্থানবিন্দু হয়ে থেকে যাবে।

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes