অধিকাংশ ধর্মান্ধতা তৈরি হয় ক্লাসরুম থেকে
সায়ন ভট্টাচার্য
বিষ্ণুর অবতার হলো রাম। পুরাণে কথিত এই ধারণা, ব্যাপকভাবে সমাদৃত হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে। প্রাচীন ভারতীয় মহাকাব্য রামায়ণ অনুযায়ী রাম অযোধ্যায় জন্মগ্রহণ করেন। ঔপনিবেশিক কুখ্যাত ঐতিহাসিকরা বিভেদনীতি তৈরি করে প্রমাণ করার চেষ্টা করে মুঘলরা বাবরি মসজিদ নামক একটি মসজিদ নির্মাণ করে যা রাম জন্মভূমির স্থান তথা রামের জন্মস্থান এ বলে মনে করা হয়। ১৮৫০-এর দশকে এই রাম মন্দির নিয়ে একটি সহিংস বিরোধ দেখা দেয়। দেখতে পাচ্ছি – একটি টেমপ্লেট ঘুরছে মূলত তরুণদের ফেসবুক প্রোফাইলে – একটা বিরাট পা, পিছন থেকে সামনের দিকে এগোচ্ছে, সামনে দেখা যাচ্ছে রাম মন্দির। পায়ে আঁকা ১৮৫০ থেকে ২০২৪ এর একটা যাত্রাপথ। তার হাতে ধনুক, ফিরে আসার মধ্যে যেন এক উগ্র প্রতিহিংসা।
তরুণদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার বার্তা তার মানে রাম মন্দির!
শিক্ষকরা নিশ্চুপ। অধিকাংশেরই কিছু যায় আসে না, ছাত্র ছাত্রীরা কী ভাবলো তাই নিয়ে। আসলে এই যে গৈরিকীকরণ, হিন্দুত্ব অহংকার এসব চোরাস্রোতে ক্লাসরুমে চলতে থাকে শিক্ষকদের (অ)শিক্ষা দানের প্রভাবে।
১৯৮০-এর দশকে হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংঘ পরিবারের অন্তর্গত বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) হিন্দুদের জন্য জায়গাটি পুনরুদ্ধার করার জন্য ও এই স্থানে শিশু রাম (রাম লালা) নিবেদিত একটি মন্দির নির্মাণের জন্য সবাই একত্রিত হয়ে নতুন করে আন্দোলন শুরু করে। ১৯৮৯ সালের নভেম্বরে ভিএইচপি বিতর্কিত মসজিদ সংলগ্ন জমিতে একটি মন্দিরের ভিত্তি স্থাপন করা হয় । ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২-এ, ভিএইচপি ও ভারতীয় জনতা পার্টি ১,৫০,০০০ স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে ওই স্থানে একটি সমাবেশের আয়োজন করে, যারা কর সেবক নামে পরিচিত। সমাবেশটি হিংসাত্মক হয়ে ওঠে এবং বিক্ষুব্ধ জনতা মসজিদটি ভেঙে ফেলে। ইতিহাসের একটি নথি বিলুপ্ত হয়ে যায় পৃথিবীর বুক থেকে। এই ঘটনা নিয়ে ছাত্রী ও ছাত্রদের একটা সঙ্গে কথা বললেই দেখেছি – স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমন একটা রাখঢাক গুরগুর চলতে থাকে। আমার প্রশ্ন কেন? আমি দশ বছরে আমার শিক্ষকতার জীবনে যত ছাত্রী ও ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়েছি, আমি শুনেছি প্রতিটা ইতিহাসের ক্লাসে শেখানো হয়েছে – মুঘল যুগ হলো ‘অন্ধকারময় যুগ’ – কেন অন্ধকারময়, কারণ ওরা নাকি প্রতিহিংসাপরায়ণ, ‘বেইমান’, ‘গদ্দার’। ওই সময় নাকি কোনও শিক্ষাদিক্ষা ছিল না, মোগল বাদশারা শুধু খুনখারাপি নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। এতে করে একটা নির্দিষ্ট ধর্মগোষ্ঠীকে প্রান্তিক করে দেওয়া হয় ক্লাসরুমে সেই শিক্ষাটা আসলে শিক্ষকদের আছে কিনা সন্দেহ আছে। এই শিক্ষার চলনটা বিগত তিরিশ চল্লিশ বছর ধরে হয়ে এসেছে। আমরা এগুলো থেকে চোখ ফিরিয়ে রেখেছি। আজ যদি আমরা সবার থেকে সেকুলার মনোভাব আশা করি তাহলে তো হবে না।
সমস্যাটা রাম মন্দির হচ্ছে এটা নয়, সমস্যাটা অনেকে গভীরে। সমস্যা হলো সাধারণ শিক্ষায়। এই শিক্ষা ব্যবস্থায় (ব্যবসাও বলতে পারেন) সবচেয়ে খারাপ মরা পচা একটা ঔপনিবেশিক ঘুণধরা কাঠামোতে শিক্ষাদান হয়েই আসছে। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য নিয়ে পাঠ নেই কোনও। সবাই একটা আমরা তোমরা, ভালো ছেলে – খারাপ ছেলে, ফার্স্ট বয় লাস্ট বয়, হিন্দু মুসলমান, মন্দির মসজিদ করে চলেছি বছরের পর বছর ধরে। আমরা শুধু মধ্যবিত্তের ভন্ডামি করি – যে শিক্ষক, অধ্যাপক মঞ্চে উঠে খুব বড় বড় জ্ঞানের বাণী দান করেন, তিনি নিজের জীবনে কিন্তু সেটা প্র্যাকটিস করেন না।
অধিকাংশের মনে শ্রেণি চেতনা বলতে ধর্মীয় চেতনাই কাজ করে। সেখানে প্রগতি বলতে যে অর্থনৈতিক প্রগতি বোঝায় সে সবের কোনও ধারনাই নেই। সেদিন ক্লাস টুযেলভ-এর এক কমার্সের ছাত্রর কথা শুনছিলাম, সে বলছে – ” রাম মন্দির হলে দেশের অনেক উপকার হবে, কত মানুষ ফুল বিক্রি করবে, হোটেল হবে, মিষ্টির দোকান হবে, জিনিসপত্রের দোকান হবে আরও কত কত জিনিস হবে…এর আমি কেন বিরোধীতা করবো!” আসলে এই অন্ধত্বটা আমাদের দায়। সিলেবাসে ছোটদের জন্য রামায়ণ বা মহাভারত যেভাবে (ভুল ভাবেই যদিও) পাঠ করানো হয়, বৈচিত্র্যময় বৌদ্ধ কাহিনী, আরব্য রজনী, কিংবা খ্রিস্ট কাহিনী-র মানবিক দিকগুলো শেখানো হয়! হয় না। এইভাবেই তৈরি করা হয়েছে একটি গোষ্ঠীর প্রধান প্রভাব।
মোদী সরকার, স্বাধীনতার পরবর্তীকালে আসা সবচেয়ে হিংস্র শাসনকাল চালাচ্ছে। দেশে সবচেয়ে বেশি কৃষক মারা এই শাসনকালে। মানুষের চাকরি গেছে সবচেয়ে বেশি এই আমলে, রাজ্যে কাজ না করে চোর খুঁজে লোকের মনোরঞ্জন করছে এই দলের বিরোধীরা। আর স্কুলে, কলেজে, শিক্ষকরা শেখান – “শোনো, রাজনীতির কথা লিখবে না কেমন পরীক্ষায়, নম্বর কমে যেতে পারে।” কিংবা ” শোনো, বিতর্কিত কোনও লাইন লিখবে না কেমন!” – এখানে ‘বিতর্কিত’ মানে রাজনীতির কুখ্যাত দিক। সবাই শিখলো – রাজনীতি খুব খারাপ জিনিস। শূন্য হয়ে রইলো সচেতনতা। পরে এই সরল মাথাগুলোই রাজনৈতিক দলের শিকার হয়ে যায় না বুঝে – সেই হিংসার আগুন ছড়িয়ে যায় সমাজের দিকে। এর দায় শিক্ষক ছাড়া আবার কার!
এই যে এত বড় একটা সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটছে দেশজুড়ে, কোনও শিক্ষকদের মুখে টু শব্দটা আছে – হয়তো আছে কিন্তু সেটা এতটাই কম তাকে নগন্য বলা যায়! মৌন হয়ে থাকা মানে অন্যায়কে মেনে নেওয়া – এটা মানতে হবে।
তরুণ প্রজন্মের সামনে কোনও সঠিক শিক্ষক নেই যে বলবে – ধর্মের চেয়ে মানুষ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, মন্দিরের চেয়ে একটা উন্নত শিল্প সহস্রগুণ প্রয়োজনীয়।