অজিত সিং বনাম সিং
ঊনত্রিংশতি পর্ব
তৃষ্ণা বসাক
অজিত সিং বনাম অজিত সিং দ্বাবিংশতি পর্ব তৃষ্ণা বসাক অজিত সিং প্রথমে ছিল বঙ্গলক্ষ্মী চানাচুর, তারপর এল আজাদ হিন্দ চানাচুর, তারপর একের পর এক বিপ্লব চানাচুর, সর্বহারা চানাচুর, উন্নততর সর্বহারা চানাচুর, এখন চলছে বিশ্ববাংলা। এখানেই কি ভাবছেন গল্প ফুরিয়ে গেল? এবার আসছে একে ফিফটি সিক্স চানাচুর। নাম যাই হোক, সোল এজেন্ট আমি।’ ‘বেওয়ারিশ’ গল্পের চানাচুরওলা এবার ঢুকে পড়েছে বাংলার শিল্পক্ষেত্র থেকে শিক্ষাজগতের ক্ষমতার অলিন্দে।খুন, যৌনতা, প্রতিশোধ, নিয়তিবাদের রুদ্ধশ্বাস সুড়ঙ্গে সে টের পাচ্ছে- -বহুদিন লাশের ওপর বসে বারবার হিক্কা তুলেছি আমরা -বহুদিন মর্গের ভেতরে শুয়ে চাঁদের মুখাগ্নি করেছি আমরা -অন্ধ মেয়ের মউচাক থেকে স্বপ্নগুলো উড়ে চলে গেছে (জহর সেনমজুমদার) এই সবের মধ্যে বাংলার কি কোন মুখ আছে আদৌ? থাকলে কি একটাই মুখ? না অনেক মুখ, সময়ের বিচিত্র রঙে চোবানো? বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দী জুড়ে বাংলার অজস্র মুখের ভাঙ্গাচোরা টুকরো খুঁজে চললেন তৃষ্ণা বসাক, তাঁর নতুন উপন্যাস ‘অজিত সিং বনাম অজিত সিং’-এ । সব কথনই রাজনৈতিক, সেই আপ্তবাক্য মেনে একে কি বলা যাবে রাজনৈতিক থ্রিলার? সিটবেল্ট বাঁধুন হে পাঠক, ঝাঁকুনি লাগতে পারে। প্রকাশিত হল উপন্যাসের ২৯ তম পর্ব। এই উপন্যাসের সব চরিত্র কাল্পনিক।
২৯
অজিত জানলায় দাঁড়িয়ে দেখছিল। নির্দিষ্ট কিছু না, রাস্তার লোকজন, গাড়িঘোড়া। বেসিক ট্রাফিক সেন্স নেই লোকগুলোর, কীভাবে রাস্তা পার হচ্ছে! গাড়িগুলো কেবল একে অন্যকে ওভারটেক করতে ব্যস্ত। যেখানে পারছে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। দেখে তার হেবি মাথা গরম হয়ে গেল। শালা সব শুয়োরের বাচ্চা, তার হাতে ক্ষমতা থাকলে এই দেশটা সে একদিনে ঠিক করে দিত।সবক শিখিয়ে ছাড়ত।
তার খুব অস্থির লাগছে, মনে হচ্ছে যথেষ্ট ক্ষমতা তার হাতে নেই। সে যেখান থেকে উঠে এসেছে, তাতে তার মনে হয়েছিল সে বুঝি অনেক উঁচুতে উঠে গেছে। আগে সেই হালতুর কাছে একটা এলেবেলে পাড়ায় একতলার ফ্ল্যাট, যেখানে কামিনী ফুলের গন্ধ আসত। আর এখন তো কত উঁচুতে থাকে সে। এই একটা নাকি, নামে বেনামে কত ফ্ল্যাট। সব কি সে চেয়েছে নাকি, এসব হয়েই যায় আপনে আপ। তার ক্যারিশ্মা এসব, কিন্তু সরকার যেমন ইচ্ছে করলে পাবলিকের জিনিস জাতীয় সম্পত্তি করে নিতে পারে, এও তেমনই। করেছে অজিত সিং, দই খাচ্ছে নেপোয়। মানে কচি নেতা, বুড়ো নেতা, মন্ত্রী সান্ত্রী, তাঁদের যত গোপন কাজকর্মের ঠেক তার এই ফ্ল্যাটগুলো। হোটেলে গেলে আজকাল আধার কার্ড লাগে।সেসব ডকুমেন্টস থেকে যায়, সিসিটিভি ক্যামেরা ছবি তুলে রাখে। সে তুলনায় অজিত সিং-র ফ্ল্যাট অনেক নিরাপদ।প্রথম প্রথম হেব্বি ভাল লাগত তার। নিজেকে একজন কেউকেটা মনে হত, যখন নেতা, মন্ত্রী ফোন করে বলত ‘ভাই সিংজী, একজন লোক পাঠাচ্ছি, তোমার কামালগাজীর ফ্ল্যাটের চাবিটা দিও তো ভাই। আসলে একজন পাবলিশার অনেকদিন ধরে পেছনে পড়ে আছে, বলছে স্যার আপনার এমন বর্ণময় জীবন, কত বড় বড় দেশনেতা দেখেছেন, কত নেতা তো আপনার হাতেই তৈরি, তারপর সেই সত্তরের দিনগুলো। ঠিক কী হয়েছিল, কেউ জানে না। কে ওদের মেরেছিল। পুলিশ,কংগ্রেস না কি লাল পার্টিই। আপনি তো সেইসময় বরানগরে… বুঝলে না সিংজী, সারাদিন দলের কাজ, বিধানসভা সামলে বাড়ি ফিরে এসব লেখা হয় না, ভাবছি এই উইকেন্ডটা নির্জন কোথাও গিয়ে লেখাটা নিয়ে ভাবব। হোটেলে উঠলে কী হবে বল তো, ব্যাটা চ্যানেলওলারা ঠিক গন্ধ পায়। ডান্ডা নিয়ে তাড়া করবে, বলবে স্যার বাইট দিন বাইট। তাই তোমার ওই কামালগাজীর ফ্ল্যাটটাই ভালো। দুদিন একটু শান্তিতে লিখতে পারব। আগে খুব লিখতাম বুঝলে। তোমাদের বউদি তো সেসব লেখা পড়েই ফ্ল্যাট। তাহলে ওই কথাই রইল গনু যাবে চাবি আনতে, তোমার কোন অসবিধে নেই তো?’
এত বড় লোক চাইছেন তার বাড়ির চাবি, এ সৌভাগ্য কজনের হয়? কান এঁটো করা হাসি হেসে তার তো বলাই উচিত ‘ছি ছি এসব কি বলছেন স্যার! আপনি আমার বাড়িতে পায়ের ধুলো দেবেন, সে তো আমার সৌভাগ্য। আমি আজই পরিষ্কার করিয়ে রাখব। থাকা হয় না তো’
না, সেসব কিছু বলতে পারবে না অজিত। মনে মনে খুশি হলেও সে অত কথা অত মধু ঢেলে বলতে পারে না। সে কাঠ কাঠ গলায় বড়জোর বলবে ‘জরুর স্যার। আপনি চলে আসবেন। কোন প্রবলেম হবে না’
কিন্তু তার কান একটা কথা ধরে নেবে। ওদের কারা মেরেছিল? সত্যিটা কে জানে? কে পুলিশ? কে পার্টির লোক? আর কোন পার্টির লোক? এসব কীভাবে জানা যাবে? কোনদিন জানা যায় নাকি?
আজকাল তো এক একজনকে দেখে চমকে চমকে যায় সে। এই লোকটা তাদের পার্টির হয়ে লেজ নাড়ছে, দুদিন আগে তো লাল ছিল, আবার দুদিন পরে গেরুয়া হয়ে যাবে! যা শালা। ইতনি আসান সব। খেয়ে পাতা ছিঁড়ে মুখ মুছে ফেলা। কে যেন একবার পুরাণের গল্প বলেছিল। কোন একটা মেয়েকে বর দিয়েছিল এক সাধু। শালি তুই যতবার খুশি, যতজনের সঙ্গে ইচ্ছে শুতে পারিস, প্রত্যেকবার শোবার পর তুই ফির কুঁওয়ারি হয়ে যাবি। এরাও মনে হয় সেই বর নিয়ে এসেছে। যত ইচ্ছে এ দল ও দল করুক, থাকবে কুঁওয়ার কুঁওয়ারি, যেন শিশির লাগা পদ্মফুল।
অজিতের আজকাল মনে হয়, এই দেশে আসলে কোন আলাদা রঙ নেই, আলাদা পার্টি নেই। শুধু আছে হেরো পার্টি আর জেতা পার্টি। অজিত গুনগুন করল ‘মিলে সুর মেরা তুমহারা সুর বনে হামারা’
ওর আবছা ভাবে কার যেন কথা মনে পড়ল। টিভিতে এই গানটা হলেই মটর ছিলতে ছিলতে কি রোটি পাকাতে পাকাতে ছুটে আসত সে। সারাদিন সে গুনগুন করত ‘মিলে সুর মেরা তুমহারা সুর বনে হামারা’
আর ওই যে, ওই গানটা ‘বুলন্দ ভারত কি বুলন্দ তসবির/ হামারা বাজাজ’ এটা দেখে বলেছিল ‘আমাদের একটা বাইক কিনবে তো? কত সুবিধে হবে তাহলে। কালীঘাট মন্দির দর্শন করনা, ইধার উধার ঘুমনা’
আজ অজিতের তিন তিনটে গাড়ি , এছাড়া তাকে নিজেদের গাড়ি চড়াবে বলে কত লোক হত্যে দ্যায়। বলে ‘প্রথম চড়বেন আপনি সিংজী’। এসব সে কিছুই দেখে যেতে পারল না। বুদ্ধু কাঁহিকা!
তবে এত গাড়ি চড়লেও অজিত নিজে চালাতে পারে না গাড়ি।একটা কার রেন্টালে তার বলাও আছে দরকার পড়লে যাতে চট করে পায় গাড়ি। সে নিজের গাড়ি বের করে না বেশি। ফ্ল্যাটের মতো তার গাড়িও অন্যের ভোগেই বেশি লাগে। তবে আজকাল একটু দিতে দ্বিধা করে তার। খালি মনে হয় নিজে পাপ করে ফাঁসা একরকম, কিন্তু অন্যের পাপ ঘাড়ে নিতে তার আপত্তি আছে।
শালা নেতা বই লিখবে না কী করবে সে কি জানে না? নতুন একটা মাগিকে তুলেছে, তাকে নিয়ে উঠবে অজিতের ফ্ল্যাটে। শালা কিতাব লিখবে ওর শরীরে মোহব্বতের সিয়াহী দিয়ে!
এ তবু ভাল, দুজন অ্যাডাল্ট লোক নিজের ইচ্ছেয় যা ইচ্ছে করুক, তাতে তার চাপ নেই। কিন্তু গাড়ি নিয়ে অন্যে অ্যাকশন করে এল, কি ড্রাগ বেচল তবে অজিত তার দুশমন। তার দল চলে একদম অলগ নিয়মে। অ্যাকশন করতে হবে যতটা সম্ভব পাবলিক ট্রান্সপোর্টে বা হেঁটে। গাড়ি থাকলেই সেটা একটা এক্সট্রা রিস্ক। শুধু গাড়ি কেন কোন পার্সনাল বিলংগিং মানেই রিস্ক। আগেকার দিনে লোকে লেঙট পরে তেল মেখে চুরি করতে যেত, তা হাজার গুণ ভালো। নাহ সেকালের লোকের বিচার উঁচা ছিল। প্রফেশনাল এথিক্স বলে একটা চিজ ছিল। এখন দেখো গাছে না উঠতেই এক কাঁদি। একটা খাল্লাস করতে না করতেই, দামি ফোন চাই, চুলে লাল নীল রঙ করা চাই বিদেশি মোরগের মতো, মলে গিয়ে ব্র্যান্ডেড ড্রেস কেনা চাই, দামি ছোকরিকে নিয়ে রিসর্টে যাওয়া চাই , ছোকরি চাই বলে দামি গাড়িও চাই- আর এই সব ছবি ফেসবুক না কি বুক বলে সেখানে লটকানো চাই। মানে ধরা পড়ার জন্যে যা যা করা দরকার সব করা চাই। এই যে তার দলের অমন চোখা ছেলেটা জগা, তার এসব বাই নেই, না ছোকরি, না গাড়ি, না ড্রেসের বাহার, কিন্তু বলে না, ভগবান সবাইকে মারার কোয়ি না কোয়ি রাস্তা করে রেখেছে। যাতে তারা নিজেরাই নিজেদের হাতে খুন হয়। শালা খুন করে সেখানে বই ফেলে এল। ইংলিশ বই। এখন সে ম্যাও সামলাতে গিয়ে অজিতের পেছন ফেটে যাচ্ছে। দাদাজী বলত ‘দেখ পাপ্পু, অমন যে বড়া জানবর হাতথি, তাকে ভগবান আঁখ দিয়েছে ছোটা ছোটা । যদি ওর আঁখ বড়া দিত, তো ও তো নিজেকে দেওতা ভাবত। বহোত ঘামন্ড হয়ে যেত ওর। সবাইকে পিষে মেরে দিত। সেই জন্যেই ভগবান ওকে আঁখ দিয়েছে ছোটা ছোটা। তুই জানবি পাপ্পু, সবাইকেই ভগবান কোথাও না কোথাও একটু কমি দিয়েছেন। কাউকেই পুরোটা দেননি। নইলে তুই শোচ একবার, সবাই তো ভগবান বনে যেত।’
‘সবাইকে কুছ না কুছ কমি দিয়েছেন? আমাকে কী কমি দিয়েছেন দাদাজী?’
পাপ্পুর এ প্রশ্নের সোজা উত্তর দেননি দাদাজী। হেসে বলেছিলেন ‘আপনে আপ সমঝে যাবি। বঙ্গালে এসে পড়েছিস, বঙ্গালের মুখ এই কলকাত্তা। আর তার মুখ এই ইউনিভার্সিটি। সব পড়ালিখা আদমি একসঙ্গে এখানে। তোর বাবার কাছে ফেলে রাখতে ভরসা করিনি, নিজের কাছে এনেছি এই উম্মীদ নিয়ে যে তুই কুছ বনকর দেখাবি। এক বাত ইয়াদ রাখনা। যত উঁচুতেই উঠিস না কেন, মাটিকে ভুলিস না।‘
মাটি, মানুষ –এদের ভুলে গেছে কি অজিত? ভোলেনি তো, কিন্তু দাদাজী যে বলেছিল কলকাতার মুখ এই ইউনিভার্সিটি, সেখানকার পড়ালিখা লোকদের শোচ বিচার দেখলে আজকাল এত রাগ হয়ে জাত কেন কে জানে!
কতদিন কোন শরীরের কাছে যায়নি মনে হচ্ছে, শালা। অথচ পরশুই তো শনিবার গেল। মোহরমালা আর সে।ঘরের সুখ। সে ফোন করে চন্দনকে। চন্দন ফোন ধরে না। সে নাকি পাড়ায় কেবল ত্রাণ বিলি করে বেড়াচ্ছে।
সারা বছর ত্রাণ লাগে এই দেশটার। এটা একটা সুবিধে বটে। এই নিম্নচাপ, এই খরা, যত ত্রাণ তত পোয়া বারো চন্দনের, চন্দনদের। অজিতের আজকাল টাকায় আসক্তি নেই আর।টাকা যা যা দিতে পারে, তা সব সব পাওয়া হয়ে গেছে অজিতের। টাকার শক্তি দেখে যে খুশি হত, মলে গিয়ে ঘুরে ঘুরে জিনিস কিনতে যার খুব আনন্দ হত, সে তো আর নেই। এতগুলো বছর চলে গেল, তেমন করে মনে পড়েনি পিংকিকে। মাঝে মাঝে মনে হত পিংকি বলে কেউ ছিলই না। একজন মানুষ যেভাবে বিশিষ্ট হয়ে উঠতে পারে তার কিছুই পিংকির মধ্যে ছিল না। না রূপ, না পড়ালিখা, না কোন দাপট। রান্নাবান্না করত, পাড়ার মেয়েদের সঙ্গে মিলে পুজো দিতে যাওয়া, কলকাতায় অভ্যস্ত হয়ে উঠে শপিং মলে কেনাকাটি একটু, তাও এস্কেলেটরে চড়তে ভয় পেত বরাবর। রান্না করত ভালই, মাছ রাঁধতে চাইত না, ডিম ভুজ্জি আর চিকেন ভালো রাঁধত, বাজার করে নিত নিজেই, সে যেন বুঝেই গিয়েছিল তার স্বামী খুব বড় বড় কাজকারবারে ব্যস্ত থাকে, তাকে এইসব তুচ্ছ ঘরেলু কাজে বিরক্ত করা ঠিক না। মাছ বেশিই বাইরে থেকে খেয়ে আসত অজিত, বাড়ি এনে লাভ কী? পিংকি মাছ ছোঁয় না, ডিম খায়, চিকেন নামমাত্র। ও তার ছোটবেলার খাবারগুলোই ভালবেসে খায়। সে ভালবাসত কলকাতার মিঠাই খেতে, সেটা মাঝে মাঝে নিয়ে আসত অজিত। পিংকি অবশ্য মুখ ফুটে কিছু বলেনি কোনদিন, চায়নি কিছুই, শুধু একবার বলেছিল ‘একটা তলাব নেই কেন এ পাড়ায়? ছট পুজো করতে কতদূর যেতে হয়।’ বোধহয় গংগায় গেছিল সবাই দল বেঁধে, ম্যাটাডোর ভাড়া করে। খুব কষ্ট হয়েছিল পিংকির। ফিরে এসে মৃদু অভিযোগের সুরে বলেছিল ‘একটাও তলাব নেই এই পাড়ায়? তলাব আছে এমন কোথাও ফ্ল্যাট নাও না কেন?’
অজিতের মেজাজ চড়ে গেল। ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দিয়েছিল ওকে। পিংকি অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল ওর দিকে। এমন নয় যে এই প্রথম মার খেল। সে ভাবছিল, রান্নায় নুন বেশি হয়নি, বিছানাও টান করে পাতা, তবে চড় খেল কেন? সে কী করে জানবে, আঙ্গুরবালা সরদারের লাশটা পড়ে ছিল তলাবের ধারে। অতখানি জমি আর পুকুর, একটা বুড়ি আটকে রেখেছিল। ফ্ল্যাট উঠলে কত মানুষের থাকার জায়গা হয়। এ তো সমাজসেবাই।
কোনটা বেশি দরকার, একটা তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকা বুড়ি দশ কাঠা জমি পুকুর দখল করে বসে থাকবে না কি সেখানে কয়েকশো লোকের মাথা গোঁজার ঠাঁই হবে? খুব খেলিয়েছিল বুড়ি তাদের। শেষ যেদিন গেছিল, নাড়ু আর জল খেতে দিয়ে বলেছিল, ‘না বাবা, ভেবে দেখলাম আমার সোয়ামি শ্বশুরের ভিটে, তুলসীমঞ্চে প্রদীপ দেখাই রোজ সন্ধেবেলা, ওই আলোটুকু ওরা ওপর থেকে দেখে শান্তি পায়, ভাবে তাদের ভিটেয় আছে তবু একটা মানুষ। এ জমি আমি প্রাণ থাকতে ছাড়তে পারব না’
ছাড়েও নি, গলা টিপে মারতে হল, বুড়ি তবু হাঁকুপাঁকু করে দম নিতে চাইছিল, মরতেই চায়নি মালটা। এঁটো বাসনপত্র ঘাটে ছড়িয়ে দেওয়া হল, যাতে মনে হয় বাসন ধুতে এসে পা পিছলে মরেছে বুড়ি। চলে আসার পরও সেই ঝপ শব্দটা কানে লেগে ছিল। এত অ্যাকশন করেছে জীবনে, তবু এটা যেন তাড়া করছিল তাকে। তার মায়ের চোখদুটো এইরকম ছিল না? বাবার কাছে মার খেয়ে পালিয়ে বেড়ানো মা, যাকে হয়তো করুণাই করেছে সে বরাবর। তবু কেন কানে বাজে মার সেই ডাক ‘পাপ্পু, আ খা লে বেটা’
সেদিন বাড়ি ফিরেও পুকুরটা কিছুতেই মন থেকে মুছতে পারছিল না। কালো জল পুকুরের, চারদিকে গাছ গাছালির ছায়ায় তেমন আলো পায় না তো। দিনের বেলায় একরকম, কিন্তু রাতের পুকুর কেমন গা ছমছমে। মনে হয় একটা ভয়ঙ্কর প্রাণি উঠে আসতে পারে যেকোন সময়। তাড়া করে বেড়াচ্ছিল পুকুরটা ওকে। সেই সময়ে কেন পিংকি বলল ‘এ কেমন পাড়া, একটা তলাব নেই। বঙ্গালে তলাব নেই ভাবা যায় না। ছট পুজোয় আবার গংগায় যেতে হবে’
ঠাস করে একটা চড় জাস্ট। তার জন্যে কি কেউ…
সেই রাতের বৃষ্টি আর কামিনী ফুলের গন্ধ।
এখন অবশ্য সে গন্ধ নেই আর। সেই বাড়ি, সেই পাড়া ছেড়ে ও এখন পনেরো তলার ফ্ল্যাটে বাইপাসে। আঙ্গুরবালা সর্দারের জমিতেও বহুতল উঠেছে। কত ফেমিলি। চোখ ধাঁধানো আলো সারারাত। শীতকালে লনে টেনিস খেলা হয়। কত আলো পাচ্ছে ওর স্বামী শ্বশুর। আঙ্গুরবালাও দেখছে নির্ঘাত সে আলো, ভাবছে কেউ আছে ওর ভিটেতে। এই তো চেয়েছিল সে। তাহলে কী পাপ করল অজিত? কেন এত জ্বালা হয় বুকে?
অবশ্য আগে কোনদিন হয়নি এমন। সময় ছিল কই। সকাল থেকে রাত অব্দি দৌড়চ্ছে। ইদানীং লেকচারার, ডেপুটি রেজিস্ট্রার সব পোস্টের রিক্রুটমেন্ট তার হাতে। প্রমোশনও। অ্যাসিস্টেন্ট থেকে অ্যাসোসিয়েট তারপর প্রফেসর, এসব ধাপে কে উঠবে, সে-ই ঠিক করে। আগে এসব ঠিক করত লাল পার্টির বড় বড় পড়ালিখা জানা লোকেরা। আলিমুদ্দিন ইস্ট্রিটে পার্টি অফিসে বসে। সেখানে পাপ্পু, আনপড় পাপ্পু, ক্লাসে যার নামই ডাকত না! পড়ালিখার নামে জ্বর আসত যার, দাদাজী প্রফেসরদের দেখিয়ে বলত ‘বাঙ্গালী লোগ সব বড়া আদমী। ডক্টর, ইঞ্জিনিয়ার, প্রফেসর। তোকে পড়ালিখা শিখে এইরকম বড় হতে হবে। এইরকম বড় নোকরি করতে হবে।’
বাঙ্গালি নোকরি করে আর কত কামাবে? অজিত এইরকম অনেক নোকর চাকর রাখতে পারে। শালা কত ডক্টরেট, অক্সফোর্ড, কেম্ব্রিজ তার পায়ে পথে হাঁটে, কাউন্সিল মিটিং -র মিনিটে মিনিটে খবর চলে আসে তার কাছে। সেদিন একজন ঢুকল আট লাখে। কমই আছে এখনো অবদি। প্রাইমারি স্কুলের মাস্টারির রেট অনেক বেশি। সেখানে অবিশ্যি মেয়ের বাপ টাকা দ্যায়।
মুকুন্দপুরের ফ্ল্যাটে বসে রাস্তা দেখছিল অজিত। একটা ড্রিংক বানাল। কাজু, চানাচুর ছাড়াও রেডি টু ইট চিকেন ফিংগার স্ন্যাক্স ছিল। সেসব না খেয়ে তার এখন মাখনা খেতে ইচ্ছে করল। ঘিয়ে ভাজা মাখানা, যার ওপর পিংকি গোলমরিচের গুঁড়ো ছড়িয়ে দিত।পিংকির হাতের অড়হর ডাল, কড়ি, ভিন্ডির ভুজ্জি, আলু মটর, আলুর পরাটা, লিট্টি, ক্ষীর।মাথা ধরলে দু আঙ্গুলে একটু ঝান্ডু বাম ছাড়াও কী যেন একটা মিশিয়ে মাথা টিপে দেওয়া, কোমরে পায়ে মাসাজ। ইচ্ছে হলেই হাতের কাছে পাওয়া তার শরীর। ভারিভুরি, নয়ছল্লা না জানা শরীরের মাটি মাটি স্বাদ মনে পড়ছিল অজিতের। সে ড্রিংকটা বানিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল। সূর্য এখন মাথার ওপরে। টবগুলো এখানে থাকলে শুকিয়ে যাবে, ভেতরে নিয়ে যেতে হবে, ঝুঁকে পড়ে দেখল একটা টবে তুলসীগাছটা কেমন শুকিয়ে গেছে। এটা পিংকির হাতে পোঁতা গাছ। অজিত হাতের ড্রিংকটা টবে ঢেলে দিল।