
অজিত সিং বনাম অজিত সিং
উনবিংশ পর্ব
তৃষ্ণা বসাক
অজিত সিং প্রথমে ছিল বঙ্গলক্ষ্মী চানাচুর, তারপর এল আজাদ হিন্দ চানাচুর, তারপর একের পর এক বিপ্লব চানাচুর, সর্বহারা চানাচুর, উন্নততর সর্বহারা চানাচুর, এখন চলছে বিশ্ববাংলা। এখানেই কি ভাবছেন গল্প ফুরিয়ে গেল? এবার আসছে একে ফিফটি সিক্স চানাচুর। নাম যাই হোক, সোল এজেন্ট আমি।’ ‘বেওয়ারিশ’ গল্পের চানাচুরওলা এবার ঢুকে পড়েছে বাংলার শিল্পক্ষেত্র থেকে শিক্ষাজগতের ক্ষমতার অলিন্দে।খুন, যৌনতা, প্রতিশোধ, নিয়তিবাদের রুদ্ধশ্বাস সুড়ঙ্গে সে টের পাচ্ছে- -বহুদিন লাশের ওপর বসে বারবার হিক্কা তুলেছি আমরা -বহুদিন মর্গের ভেতরে শুয়ে চাঁদের মুখাগ্নি করেছি আমরা -অন্ধ মেয়ের মউচাক থেকে স্বপ্নগুলো উড়ে চলে গেছে (জহর সেনমজুমদার) এই সবের মধ্যে বাংলার কি কোন মুখ আছে আদৌ? থাকলে কি একটাই মুখ? না অনেক মুখ, সময়ের বিচিত্র রঙে চোবানো? বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দী জুড়ে বাংলার অজস্র মুখের ভাঙ্গাচোরা টুকরো খুঁজে চললেন তৃষ্ণা বসাক, তাঁর নতুন উপন্যাস ‘অজিত সিং বনাম অজিত সিং’-এ । সব কথনই রাজনৈতিক, সেই আপ্তবাক্য মেনে একে কি বলা যাবে রাজনৈতিক থ্রিলার? সিটবেল্ট বাঁধুন হে পাঠক, ঝাঁকুনি লাগতে পারে। প্রকাশিত হল উপন্যাসের উনবিংশ পর্ব। এই উপন্যাসের সব চরিত্র কাল্পনিক।
১৯
কিঞ্জল চশমা খুঁজছিল। কটা বাজে দেখবে। ওর বেশ খেয়াল আছে কাল বিঘ্নেশের সঙ্গে ফিরছিল পার্টি থেকে। ফিরতে ফিরতে মনে পড়ল আজ শনিবার, মা থাকবে না আজ, মার নাইট আউট। মা নেই, আর ও থাকবে বাড়িতে, ভাবতেই কালো কালো ঝুলের মতো মন খারাপ আর ভয় জড়ো হয় মনের মধ্যে। দূর, মা না থাকলে সেই বা ফিরবে কেন? ওই লোকটার সঙ্গে থাকতে অস্বস্তি হয় তার। যেন ওর সবটা পড়ে নিচ্ছে মালটা।যেন ওকে একদম সুতো খুলে দেখছে সেই দুপুরের…। বাড়ি ফিরবেই না আজ ঠিক করে ফেলল কিঞ্জল। গাড়িতে উঠে বিঘ্নেশকে বলল ‘ব্রো, তোর ফ্ল্যাটে কে আছে আজ? আমি আজ থেকে যাই?’
বিঘ্নেশের আসল বাড়ি দুর্গাপুর, বাবা মা থাকে ওখানে। এখানে সে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট পড়তে এসেছে। মাল্লুদার পার্টি। বাবা একটা ফ্ল্যাট কিনে রেখেছে ছেলের পড়ার জন্যে বহু আগে থেকে। ছেলে একসময় কলকাতায় পড়তে আসবেই এই ভাবনা থেকে। কারো সঙ্গে শেয়ার করত হয় না, পেয়িং গেস্ট থাকতে হয় না, অনেক সুবিধে। ইচ্ছে মতো বন্ধু, বান্ধবীরা নাইট স্টে করে, গাঁজা টাজা খাওয়া হয়।কিন্তু সমস্যা হচ্ছে থেকে থেকে ওর মা উদবিগ্ন হয়ে ওঠেন ছেলের জন্যে। ছেলে কী খাচ্ছে, ফ্ল্যাট ঠিক মতো পরিষ্কার করা হচ্ছে কিনা, তার চেয়েও বড় কথা কাদের সঙ্গে মিশছে, বান্ধবী জুটেছে কিনা- এইসব সরেজমিনে তদারকি করতে উনি প্রায়ই এসে হাজির হন। বলেই আসেন অবশ্য। গিয়ে কী দেখতে হবে, না জানিয়ে গেলে কতটা শক লাগবে, তার একটা আন্দাজ আছে তো ভদ্রমহিলার। তবে দুয়েকবার না বলেও এসেছেন। একটা ডুপ্লিকেট চাবি থাকে ওঁর কাছে।সেটাই চাপের ব্যাপার। ভাবছিল কিঞ্জল। মহিলা না এসে হাজির হন আচমকা। ছেলের বেডরুমে একটা অচেনা মেয়ে শুয়ে আছে দেখলে কতটা ধাক্কা খাবেন, দিল কি দৌরা পৌঁছবে কিনা, সেটা ও আন্দাজ করার চেষ্টা করছিল। কুলকুল করে হাসিও পাচ্ছিল বেজায়।
বিঘ্নেশ কি শুনতে পেল না ওর কথা? কোন উত্তরই তো দিল না। ওকে অন্যমনস্ক লাগছিল। কিঞ্জল আবার বলল ‘আজ থেকে যাই? আন্টি এসে পড়বেন না তো?’
বিঘ্নেশ কেমন একটা কাঠ কাঠ গলায় উত্তর দিল ‘মা সবে কাল চলে গেছে।’
‘ওহ গ্রেট’
‘কিন্তু…’
‘কিন্তু কী?’
‘আজ দু চারজন ফ্রেন্ডস এসেছে, তোর অসুবিধে হবে থাকার। একদম অচেনা গ্রুপ।তুই চিনিস না। পাতাখোর টাইপ।অকওয়ার্ড লাগবে তোর’
‘কীসের অসুবিধে? আমি গিয়ে জাস্ট শুয়ে পড়ব। কে আছে তাতে আমার ছেঁড়া যায়। বালের অকঅয়ার্ড’
বিঘ্নেশ একটু রাগ রাগ চোখে তাকায় কি কিঞ্জলের দিকে? কিঞ্জল অনেক, অনেক দিনই তার ফ্ল্যাটে থেকে গেছে, বলেছে ‘শালা রোজ বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না, কোন আর্বান লোক রোজ বাড়ি ফেরে না দেখবি’। এসে রান্নাঘরে ঢুকে খুটখাট করে মিনিট পনেরোর মধ্যে একটা পাস্তার দুরন্ত ডিশ, এমনকি ডিমের ঝোল ভাত অব্দি করে ফেলেছে, নিজের ফ্ল্যাটটাকে বেশ বাড়ি বাড়ি মনে হয়েছে বিঘ্নেশের, তারপর খাওয়ার পর বিয়ারের গ্লাস আর কফির মাগ(যেহেতু কিঞ্জল মদ্যপান করে না, সে চূড়ান্ত কফি অ্যাডিক্ট) হাতে তুমুল আড্ডার পর শোবার ঘরটিতে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে, বিঘ্নেশকে শুতে হয়েছে সোফায়। কিঞ্জলকে সহজলভ্য ভেবেছিল সে, যে মেয়ে নিজের বাড়ি ছেড়ে অন্যের ফ্ল্যাটে রাত কাটায়, তাকে বিছানায় আনা কঠিন নয় সে ভেবেছিল। কিঞ্জল সে আশায় জল ঢেলে বলেছে ‘তুই আমার ব্রো, নেভার ফরগেট দ্যাট’
আরো বলেছে ‘ডোন্ট থিংক আই অ্যাম আ লুজ উম্যান। আর আমার ওপর ফোর্স করতে আসিস না। আমার মা কে জানিস তো? মায়ের হাতে এই শহরের তাবড় তাবড় লোকের টিকি বাঁধা আছে। ইন ফ্যাক্ট বাবার হাতেও’
কিঞ্জলের মা, দ্যাট সুইট বিচ, কী করে সবার টিকি বেঁধে রেখেছে সে তো কলকাতার অলি গলি দেওয়ালও জানে। কিন্তু সে কথা কিঞ্জলকে বলা যাবে না। একবার বলতে গিয়ে যা অবস্থা করে ছেড়েছিল। নি কিট চালিয়ে দিয়েছিল। কাঁধের নিচে এসে লেগেছিল সজোরে, বহুদিন ব্যথা ছিল তার। অত মোটাসোটা হলে কী হয়, দারুণ ফিট যে মেয়েটা, সেইদিন টের পেয়েছিল বিঘ্নেশ। এটাও টের পেয়েছিল কিঞ্জল অন্যকে ব্যবহার করলেও ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে ওকে ব্যবহার করা যাবে না।
সেই থেকে কিঞ্জল কখনো ওর ফ্ল্যাটে আসার কথা বললে ওর কোন উৎসাহ থাকে না। সোফায় শুতে হবে সারারাত। তার ওপর মেখলা, ওর স্টেডি জি এফ এখন, যদি একবার শোনে কিঞ্জল নাইট স্টে করেছে, ওকে জাস্ট ডাম্প করে দেবে। কিছু শুনবেই না, কিছু বোঝার চেষ্টাই করবে না। মেয়েরা এইরকমই। ওরা ওদের মরজিতে চলবে। ওরা ইচ্ছে মতো আসবে, চলে যাবে, ভালো বাসবে আবার ঠেলে দেবে। কিঞ্জল কি বোঝে না নিজের বাড়িতে বন্ধ দরজার ওপারে অমন আগুনের গোলাকে রেখে সোফায় সারারাত ছটফট করতে কেমন লাগে?তাছাড়া বিঘ্নেশকে এইরকম হ্যান্ডু দেখতে, ওকে দেখে কিঞ্জলের কি কোন ফিলিং হয় না? মালটা ফ্রিজিড নিশ্চয়। কলকাতায় এসে থেকেই দেখছে মেয়েরা তার জন্যে পাগল, সুযোগ পেলেই বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। আর এটা কী একটা, যাতা।
নিজের বাড়ি ছেড়ে একটা মেয়ে একটা বাইরের ছেলের ফ্ল্যাটে নাইট স্টে করবে কোন ফূর্তি ছাড়া, এটা ভাবতেও তার অদ্ভুত লাগে। কেন আসে তবু কিঞ্জল? এ প্রশ্ন তো সরাসরি করা যায় না, ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করার অবশ্য দরকার হয়নি। কিঞ্জল ভেতরচাপা মেয়ে নয় একেবারে। ও নিজেই বলেছিল, কলকাতায় ওর কোন আত্মীয় নেই যে যার বাড়ি গিয়ে মাঝে মাঝে থাকতে পারে সে। কিন্তু মা যেদিন যেদিন বাড়ি ফেরে না, বাইপাসের ফ্ল্যাটে থেকে যায়, সেদিন ওর একদম বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না।
‘মা ফেরে না কেন?’
‘বাহ, মাঝে মাঝে না গেলে, না থাকলে ফ্ল্যাটটা নষ্ট হয়ে যাবে না?’
ওর সরল উত্তর শুনে হাড় জ্বলে গেছিল বিঘ্নেশের। ‘মোহরমালা ওখানে ঘর ঝাড় পোঁছ করতে যায় নাকি রে? ফ্ল্যাট নষ্ট হয়ে যাবে, না বাল! তোর মা তো অজিত সিং -র রাখেল রে। অজিত সিং, শালা বিহারীর বাচ্চা, ক্লাস থ্রি স্টাফ, এখন ভিসিকেও তার সামনে গদগদ হেসে কথা বলতে হয়, শালা নাকি ফাইভ স্টার ইউনিভার্সিটি। সেই অজিত সিং কে বেঁধে রেখেছে তোর মা, তাতেই তো তোর এত গুমোর!’ হিসহিস করে বলতে চায় এসব বিঘ্নেশ, বলতে পারে না। কী যেন একটা আছে কিঞ্জলের মধ্যে। ওর সামনে এলে সবার মতো ও-ও মিইয়ে যায়। নেতানো মুড়ি যেন।
ফ্ল্যাটে ঢুকতেই হইহই করে উঠল পিউস, ভিকি আর রত্নদীপা।
‘এসো বাবা এসো, একেবারে জোড়ে এলে । দুধে আলতায় পা দিয়ে চৌকাঠ ডিঙ্গোতে হয় যে। আগে থেকে বলে রাখলে সব গুছিয়ে রাখতে পারতাম।’
ভিকি বলল ‘তাতে কি হয়েছে, দুধ না থাক, মদ তো আছে।’ এই বলে সে রান্নাঘর থেকে একটা ছোট থালা এনে তাতে বোতল থেকে ভদকা ঢালে। আর কিঞ্জল হাসতে হাসতে সেই থালার ওপর দাঁড়ায়। ওরা হাঁ হয়ে যায় দেখে।
কিঞ্জল বলে ‘ এরপর নিয়ম হচ্ছে যারা এটা ঢেলেছে তাদের এটা খেতে হয়, এক চুমুকে, ডান?’
পিউস আমতা আমতা করে বলে ‘নট ডান। বাপরে কাকে জোটালি। এ মাল তো তোর জিনা হারাম করে দেবে।’
কিঞ্জল হাসি মুখেই বলে ‘ ফর ইয়োর ইনফো, আমাকে কেউ জোটায়নি, আমি নিজেই জুটেছি, আমার ইচ্ছে হলে এরকম চলে আসি, এখানে রাত কাটাতে। আর বিঘ্নেশ বুঝে গেছে রাত কাটানো মানে কিন্তু ওর সঙ্গে শোয়া নয়। তোরাও বুঝে নে সেটা। আর শোবার ঘরে যদি কারো ব্যাগ বা কোন জিনিস রেখে থাকিস, বার করে নে, কারণ এখুনি আমি দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ব। সকালে আটটায় কফি করে আমায় ডাকবি। তারপর মুড ঠিক থাকলে আমি সবাইকে ব্রেকফাস্ট বানিয়ে খাওয়াব, আই প্রমিস!অ্যাই বিঘ্নেশ, তোর ভাঁড়ারে সুজি, টক দই, পেঁয়াজ, লঙ্কা আছে তো?’
অন্য কেউ হলে এসব শুনলে ক্ষেপে যেত, কিন্তু বিঘ্নেশ খুব কুল গলায় বলল ‘তুই একবার বলেই দেখ না কী চাই’
কিঞ্জলও যেন বুঝতে পারল এই ব্যাপারে বিঘ্নেশকে কোন চ্যালেঞ্জ দেওয়া যাবে না, ওর কিচেন আর পাঁচটা একা থাকা ছেলেদের মতো নয়, ওয়েল স্টকড অ্যান্ড ওয়েল মেন্টেন্ড। এর কারণ হল ওর মা প্রায়ই ছেলের দেখভালের নাম করে কলকাতার ডেরায় হানা দেন, তাই কিচেনে এইসব গেরস্তপোশাকি জিনিসপত্র মজুত থাকে। মা তো বাইরে থেকে খাবার আনানো পছন্দ করেন না, ব্রেকফাস্ট থেকে ডিনার সবই বাড়িতে বানানো হয়, হয় রান্নার মাসীকে দিয়ে, নয়তো নিজেই বানান। আগেও দু একবার নাইট স্টে করে ব্রেকফাস্ট বানিয়ে দেখেছে কিঞ্জল। খুব আরাম পাওয়া যায় এমন রান্নাঘরে কাজ করে। আটা, ময়দা, চিঁড়ে, সুজি, যাবতীয় মশলাপাতি ঝকঝকে কন্টেনারে লেবেলিং করা, যে কেউ ওই রান্নাঘরে প্রথম পা দিয়েও অসুবিধেয় পড়বে না। এর তুলনায় তাদের রান্নাঘর বরং খানিক অগোছালো। ফ্ল্যাটটা বহু পুরনো, এখান থেকে কিঞ্জলের ইস্কুল খুব কাছে, পায়ে হেঁটেই যাওয়া যায়। এই স্কুলেই নার্সারি থেকে পনেরো বছর কেটে গেছে তার। না পুরো পনেরো বছর নয়, ক্লাস ফাইভে তো সে এক বছরের জন্যে মার সঙ্গে মালদায় ছিল, ওখানকার স্কুলে পড়ত। সিক্সে এসে আবার পুরনো স্কুলে অ্যাডমিশন নেয়। এসবই সম্ভব হয়েছে, কারণ ভাইস প্রিন্সিপাল ছিলেন ভবানী শাস্ত্রীর মস্ত বড় ভক্ত। ওই এক বছর কলকাতাতেই থাকতে পারত কিঞ্জল, কিন্তু মাকে ছেড়ে থাকার কথা ভাবতেই পারেনি সে। আজও পারে না। মা ফ্ল্যাটে নেই বলে সে আজ ফিরবেই না।
তার স্কুলের থেকেও আরও বড় কারণ বাবা, শ্রীযুক্ত ভবানী শাস্ত্রী মনে করেন এই বাড়িটা তাঁর জ্যোতিষ ব্যবসার পক্ষে খুব শুভ। তাঁর পসার, পরিচিতি সবই এখান থেকে। মন্দিরের কাজটার যোগাযোগও তো এখান থেকে। শুধু তাই নয়, বাবা মনে করেন মার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিটাও এখানে থাকার জন্যেই হয়েছে। কিঞ্জলও যে এত কম বয়সে পি এইচ ডি জমা দিয়ে ফেলল, সামনের বছরের সমাবর্তনে ও ডিগ্রি পাবে, সেটা এই বাড়ির পয়েই।
মা এগুলো সবই মেনে নিয়েছে। কিঞ্জল আজ অব্দি দেখেনি মা বাবার কোন কথার অবাধ্য হয়েছে, আর এটাও ঠিক, এই বাড়িতে থাকা বা দু একটা পাথর ধারণ করতে বলা ছাড়া বাবা মার কোন ব্যাপারেই নাক গলায় না। স্নেহময় পিতা যেমন সন্তানের উত্থান সস্নেহে এবং পরিতৃপ্তির সঙ্গে দেখতে থাকেন, মার ব্যাপারেও বাবার মনোভাবটা ঠিক সেইরকমই। মনে হয় যেন মার পুরো কেরিয়ারটাই বাবা ছকে দিয়েছে, মা জাস্ট বাধ্য ছাত্রীর মতো শুধু সেই রুটম্যাপ ফলো করে গেছে। অবভিয়াসলি, কেউ যদি দেখে কারো কথা শুনে তার কেবল উন্নতিই হচ্ছে, সে সেখানে নারীবাদ ফলাতে যাবে কেন? মা আউট অ্যান্ড আউট বাস্তববাদী মানুষ, সেটাই করেছে, যেটা করলে তার আখেরে লাভ হয়।একদম ঠিক। যুক্তির দিক থেকে দেখলে মা একদম সঠিক কাজই করেছে।তার বেলাতেও মা পুরোপুরি স্নেহময়ী মা। এমন কোন সংকটের কথা মনে পড়ে না, মা যেখানে তার পাশে থাকেনি। শুধু একবার মা মালদায় পোস্টেড ছিল, ও ওখানের স্কুলে পড়ত, মার কাছে থাকত। সেই সময় ওখানে টানা কয়েকদিন পাওয়ার ছিল না, সাইক্লোনে ইলেক্ট্রিকের খুঁটি উপড়ে গেছিল, কবে সারবে ঠিক নেই, কিঞ্জলের খুব কষ্ট হচ্ছিল, তাই মা কয়েকদিনের জন্যে রেখে গেছিল কলকাতায়, সারাদিনের এক বুড়ি দিদা থাকত, খুব ভালবাসত কিঞ্জলকে, দেখে রাখত, তাও তো কিঞ্জল ছিল মাত্র পনেরো দিন। ওদিকে সব ঠিক হতেই মা নিয়ে গেছিল তাকে। তারপর অনেক চেষ্টা চরিত্র করে কলকাতার কাছাকাছি কলেজে ট্রানফার নিয়ে ফিরে এসেছিল। আর সেই ট্রান্সফারের পেছনেও ছিল ভবানী শাস্ত্রীর তৎপর হাত।
কোথাও তো কোন অসুবিধে হয়নি তাদের, তবু কেন যেন কিঞ্জলের মনে হয় মা কি একটু অন্য রকম হতে পারত না? সত্যিকারের নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারত না কি? প্রথম কলেজের চাকরিটা তো নিজের যোগ্যতাতেই পেয়েছিল, তার পরের উত্থান কেন কেবলই ভবানী আর তার পোষা গ্রহ নক্ষত্রের হাত ধরে? তা না করে মা এরকম একটা লোকের সঙ্গে আদ্যন্ত সহযোগিতা করে এখানেই থেকে গেল, হ্যাঁ এটা ঠিক, বাড়ির বাইরে মার একটা নিজস্ব বৃত্ত আছে, এখন তো একটা মস্ত ফ্ল্যাটই আছে মার, প্রায় প্রতি শনিবার মা যায় সেখানে, বসবাস না করলে যে ঘরবাড়ি নষ্ট হয়ে যায় তা কে না জানে। মা শনিবার কেন যায়, কী করে সেসব নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই কিঞ্জলের। বরং সে ভাবে আজকাল, মা বহু আগেই তো নিজের একটা আলাদা আস্তানা করতে পারত, চলে যেত সেখানে কিঞ্জলকে নিয়ে, তাহলে এতদিনে তার একটা অন্যরকম জীবন হতে পারত। অনিল মৈত্র রোডের ছায়া ছায়া ঘরে, চারদিকে অদৃশ্য গ্রহ নক্ষত্রের নজরদারির মধ্যে তার জীবন কাটত না, তাকে এভাবে অন্য লোকের ফ্ল্যাটে রাত কাটাতেও হত না।
এইসব ভাবতে ভাবতে বোধহয় একটু অন্যমমস্কই হয়ে গেছিল কিঞ্জল, সে খেয়াল করেনি রত্নদীপা তাকে কী একটা যেন বলেছে।
‘সরি কী বলছিলি রে?’
‘বলছিলাম সুজি আর টক দই, তার সঙ্গে পেঁয়াজ লঙ্কা, এরকম ডেডলি কমবো দিয়ে কী পাকাবি রে তুই?’
‘বাপের জন্মে খাসনি, গ্যারান্টি। চিল্লা’
‘চিল্লা! হোয়াট ইস ইট?’
‘আ ইন্ডিয়ান প্যান কেক’
‘ওহ দ্যাট গ্রেট ইন্ডিয়ান কিচেন!’
ব্যস অমনি আলোচনা ঘুরে গেল নেটফ্লিক্সের দিকে। কে কী দেখেছে লেটেস্ট। এর মধ্যে কিঞ্জল লক্ষ্য করল ভিকি ওর দিকে হাঁ করে চেয়ে আছে।মুখের দিকে নয়, বুকের দিকে। মাথা গরম হয়ে গেল ওর। ছোট ছোট গাঁজার কলকে রাখা আছে ওদের পাশে। একবার ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে তার এক ক্লায়েন্টের বাড়ির পুজোয় গিয়ে এগুলো দেখেছিল সে। পুজোয় গাঁজা! কে যেন বলেছিল অবাক হয়ে। যাঁর বাড়ির পুজো তিনি বলেছিলেন ‘এ হচ্ছে ত্রিনাথের মেলা। আমাদের সাত পুরুষের পুজো। ত্রিনাথের পুজো গাঁজা ছাড়া হয় না’
কিঞ্জল বলল ‘নে তোদের ত্রিনাথের মেলা শুরু কর, চতুর্নাথকে এনে দিলাম। গুড নাইট ফোকস। এঞ্জয়’
এই বলে সে ঘরে ঢুকেছিল, দরজাও লাগিয়ে দিয়েছিল নিশ্চয়, না, আরেকবার বেরিয়েছিল জল খেতে, দেখেছিল ড্রয়িং রুমে ওরা সবাই জড়ামড়ি করে পড়ে আছে। ডাইনিং টেবিলে রাখা জলের বোতল টা তুলে খেয়েছিল কি ও? কিচ্ছু মনে পড়ছে না কেন?
কটা বাজে এখন? চশমাটা কোথায়, মোবাইলটাই বা কোথায় গেল? চশমার জন্যে হাঁতড়াতে হাঁতড়াতে নিজেকেই ছুঁয়ে ফেলল কিঞ্জল আর ছুঁয়েই চিৎকার করে উঠল সে। ও মাই গড! তার শরীরে একটা সুতো পর্যন্ত নেই!
(ক্রমশ)