অজিত সিং বনাম অজিত সিং
পঞ্চম পর্ব
তৃষ্ণা বসাক
প্রথমে ছিল বঙ্গলক্ষ্মী চানাচুর, তারপর এল আজাদ হিন্দ চানাচুর, তারপর একের পর এক বিপ্লব চানাচুর, সর্বহারা চানাচুর, উন্নততর সর্বহারা চানাচুর, এখন চলছে বিশ্ববাংলা। এখানেই কি ভাবছেন গল্প ফুরিয়ে গেল? এবার আসছে একে ফিফটি সিক্স চানাচুর। নাম যাই হোক, সোল এজেন্ট আমি।’ ‘বেওয়ারিশ’ গল্পের চানাচুরওলা এবার ঢুকে পড়েছে বাংলার শিল্পক্ষেত্র থেকে শিক্ষাজগতের ক্ষমতার অলিন্দে।খুন, যৌনতা, প্রতিশোধ, নিয়তিবাদের রুদ্ধশ্বাস সুড়ঙ্গে সে টের পাচ্ছে- -বহুদিন লাশের ওপর বসে বারবার হিক্কা তুলেছি আমরা -বহুদিন মর্গের ভেতরে শুয়ে চাঁদের মুখাগ্নি করেছি আমরা -অন্ধ মেয়ের মউচাক থেকে স্বপ্নগুলো উড়ে চলে গেছে (জহর সেনমজুমদার) এই সবের মধ্যে বাংলার কি কোন মুখ আছে আদৌ? থাকলে কি একটাই মুখ? না অনেক মুখ, সময়ের বিচিত্র রঙে চোবানো? বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দী জুড়ে বাংলার অজস্র মুখের ভাঙ্গাচোরা টুকরো খুঁজে চললেন তৃষ্ণা বসাক, তাঁর নতুন উপন্যাস ‘অজিত সিং বনাম অজিত সিং’-এ । সব কথনই রাজনৈতিক, সেই আপ্তবাক্য মেনে একে কি বলা যাবে রাজনৈতিক থ্রিলার? সিটবেল্ট বাঁধুন হে পাঠক, ঝাঁকুনি লাগতে পারে। প্রকাশিত হল উপন্যাসের পঞ্চম পর্ব।
আগের পর্বগুলি পড়তে ক্লিক করুন — (১), (২), (৩), (৪)
৫
আজ সকালটি বেশ মনোরম। এই অনিল মৈত্র রোডের অন্ধকার একতলায় দিনেও আলো জ্বালিয়ে না রাখলে লেখাপড়ার কাজ করা যায় না। কিন্তু জানলা দিয়ে বেশ হাওয়া আসছে আজ। বাঁকিয়ে চুরিয়ে তাকালে এক ফালি যে আকাশটা চোখে পড়ছে সেটা ঝকঝকে নীল, তাতে খাঁটি গাওয়া ঘিয়ের রঙের রোদ ভেসে ভেসে যাচ্ছে।
ভবানী ছক নিয়ে বসেছেন। বারবার তাঁর ভুরু কুঁচকে যাচ্ছে। বাহান্নতে একটা অপঘাত মৃত্যুর ফাঁড়া। সেটা কাটিয়ে উঠতে পারলে জাতক আশি অবদি টেনে দেবে। কিন্তু কাটানো শক্ত, খুবই শক্ত।কারণ জাতকের জীবনের প্রতিটি বাঁকেই ওত পেতে রয়েছে মৃত্যু। মৃত্যুর সঙ্গে এমন লুকোচুরি খেলা জন্মছক অনেকদিন দেখেননি তিনি। শেষ বার সেই ডি সি কুন্দ্রা, খিদিরপুরের গলিতে যাঁর গুলিতে ঝাঁঝরা শরীরটা পাওয়া গিয়েছিল। ওঁর স্ত্রী নিজে আসেননি, কাউকে দিয়ে পাঠিয়েছিলেন জন্ম তারিখ আর সময়, দেখে চমকে উঠেছিলেন ভবানী। এ তো আলোকভুক পতঙ্গের মতো মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
এখন যে ছক নিয়ে বসে আছেন, সেই জাতকের রক্তে অপঘাত মৃত্যুর যোগ আছে। ঠিক বুঝতে পারছেন না, বাবা না মা, না দুজনেই… হাতের সিগারেট জ্বলে যাচ্ছে। ছাই ফেলার জন্য অ্যাশট্রেটা খুঁজলেন। নেই। কোথায় যে যায়? বাড়িতে তাঁর কাছে কেউ আসে না।কালীমন্দিরেই তাঁর সাজানো চেম্বার। মোহরেরও অফিসিয়াল কাজকর্ম কখনোই এই বাড়িতে থেকে করে না সে। এ একটা অলিখিত চুক্তি তাঁদের মধ্যে একদম প্রথম থেকেই।ছোট ফ্ল্যাট, মেয়ে পড়াশোনা করে। এর মধ্যে আর বাইরেটাকে টেনে আনতে চান নি তাঁরা। তাই অ্যাশট্রেটা একান্ত তাঁরই হয়ে আছে। আত্মীয় স্বজন প্রায় কেউ নেই, দু চারজন যা আছে বৃদ্ধা মহিলা। একজন ফুলিয়া আর একজন হিন্দ মোটরে থাকে। এক পিসিমা আর এক দিদি। ভবানীর। অনেক বছর তারা আসতে পারে না আর। ভবানী যান মাঝে মাঝে। কারণ তাঁর যা কিছু জ্যোতিষ শিক্ষা, সবই পিসেমশাইয়ের কাছ থেকে। আর দিদি না থাকলে পিতৃমাতৃহীন তিনি কোথায় ভেসে যেতেন। দিদি, বিশেষ করে জামাইবাবু তাঁর জন্যে যা করেছেন, তুলনা হয় না।
মোহর কি বেরিয়ে গেছে? না বলে যায় না অবশ্য। যতই ওপরে উঠুক, জানে তার জীবনের সব চাবিকাঠি এই ভবানী চক্রবর্তীর হাতের জন্মছকেই আছে। মোহরের মেয়েও তাই জানে। কলকাতা শহরের সব ক্ষমতাই এই ছকে বেঁধে রেখেছেন ভবানী। কিন্ত এই ছকটা বড় অদ্ভুত। এত বছর ধরে এত কুষ্ঠী ঘাঁটছেন ভবানী, কিন্ত সেই তিনিই বুঝতে পারছেন না এটা খুনীর জীবন না সন্তের? ধর্ষকের না প্রেমিকের? তার ওপর বাহান্নতে অপঘাত মৃত্যুর যোগ…
অনেকে বলে- এই যে জ্যোতিষীরা মানুষের ভাগ্য বলে দ্যায়, এটা বিরাট বুজরুকি, কেউ কেউ বলে, না না বুজরুকি নয়, এ খানিকটা অনুমান আর খানিকটা মানুষের মনের হদিশ জানার ক্ষমতা। অনেক মানুষ দেখতে দেখতে এই ক্ষমতাটা জন্মায়। ঢিল আন্দাজেই ছোঁড়া, কিন্তু সেই আন্দাজটা যে কতদিন কত মানুষ ঘেঁটে করা তা তো কেউ দেখতে পাচ্ছে না।
অপঘাত মৃত্যুর যোগ এখন সবারই হতে পারে, কিন্তু তাঁর মতো কেউ কি অভ্রান্ত সময়টা বলে দিতে পারে ? মোহর যখন মফস্বলের কলেজে ঘষছিল, বাড়ি থেকে পাক্কা তিন ঘণ্টা লাগত যেতে, তখন তিনি পুরো অংক কষে ওকে বলেছিলেন পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসবে, আসবেই। প্রশাসনিক পদে। অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে। মোহরমালা ধর এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার।
ছাই উড়ে যাচ্ছে। উড়ে উড়ে বসার ঘরটা কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া। অনিল মৈত্র রোডের নিচতলার ভাড়া ঘরে এমনিতেই তেমন আলো ঢোকে না। পাশের বাড়িতে স্কুলবাচ্চার মায়েদের কলরবলর। তবু এ বাড়ি পাল্টাননি ভবানী। মোহরও জোর করেনি তেমন। তার বাইপাসের আঠেরশো স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট যদিও সে সাজিয়েছে মনের মত করে। মাঝে মাঝে গিয়ে থেকেও আসে। বিশেষ করে শনিবার, মঙ্গলবার। যে দুটো দিন মাঝরাতের আগে ভবানী বাড়ি ফিরতেই পারেন না। কালীবাড়িতে তাঁর থাকার ব্যবস্থা করাই থাকে। খুব ক্লান্ত থাকলে ওখানেই রাতটা কাটিয়ে আসেন। যদি কোনদিন ফিরেও আসেন, মোহর থাকে না। একটা ফ্ল্যাট কিনে ফেলে রাখা ঠিক না। মানুষ বসবাস না করলে তা নষ্ট হয়ে যায়। ইঁদুর আরশোলা উইয়ের বাসা হয়। কিন্তু মোহরহীন বাড়িতে ফিরে ভবানী মাথার মধ্যে অন্য শব্দ পান। ইঁদুরের চিকচিক বা আরশোলার ফড়ফড় নয়, লক্ষ লক্ষ উই যেন তাঁর মাথা কুরে কুরে খাচ্ছে আর তার নিচ থেকে শোনা যাচ্ছে মোহরের শীৎকার। শুধু শোনা নয়, তিনি দেখতে পান, সেই আঠারশো স্কোয়ার ফিটের ঝকঝকে অ্যাপার্টমেন্টে মনের মত করে সাজানো বিছানায় দুটো শরীর কত যে কসরত দেখাচ্ছে। সেই শব্দ-দৃশ্যগুলো মাথায় ঘোরে, ঘুম আসে না। কিন্তু ভবানী চক্রবর্তীর এমন তো হবার কথা নয়। মোহরের ছক তো তাঁরই করা। জাতিকা একাধারে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও পরপোকারী, দানশীলা ও বহুগামিনী- এ তো তাঁর থেকে ভাল কেউ জানে না। বারো বছরের বড় তিনি। কী-ই বা দিতে পারবেন ওকে? শরীর? যদিও যথেষ্ট সক্ষম তিনি এই ৬৫ তে। কিন্তু ইচ্ছেটা যেন মরে গেছে। হয়তো মা কালীই সেই ইচ্ছেটা বন্ধক রেখেছেন। কামিনীতে মন গেলে কাঞ্চন থাকে না। জীবনে কাঞ্চন সবচেয়ে দামী – এ তিনি সার বুঝেছেন। কাঞ্চন থাকলে কত কামিনী আসবে। আসেও। সমাজের দুধের সর যাদের বলা হয়, সেই সব কামিনীরা পায়ে এসে পড়ে। চারদিকে ডেঙ্গুর মশার মত থিকথিক করছে সমস্যা। কারো ছেলে ড্রাগ অ্যাডিক্ট, কারও স্বামী পরকীয়া করছে, কেউ আবার স্বামীকে সরাতে চায় ডবকা প্রেমিকের জন্যে, কারো দাদা কিংবা ভাই সম্পত্তি মেরে দিয়েছে, কাউকে আবার সবাইকে ডিঙ্গিয়ে ওপরে উঠতে হবে। তারা ঘন ঘন চোখ মোছে আর কথায় কথায় বুকের আঁচল খসায়। ভবানী সস্নেহে তাদের পিঠে পাছায় হাত বুলোন, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা পরানোর সময় বুকের খাঁজ, স্তনবৃন্ত ছুঁয়ে নেন ধীরেসুস্থে। এতেই তাঁর সুখ। দেখে সুখ, একটু ছুঁয়ে ছেনে সুখ। আর সুখ মায়ের পায়ের তলায় বসে জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ-কাম-ধর্ম-মোক্ষের এই যে জটিল মানব জীবন –তাকে তন্ন তন্ন করে দেখতে। সেরকম করে তো মোহরের জীবন দেখা হয়ে গেছে তাঁর। ও কী করতে পারে, আর কী পারে না- সব হাড়ে হদ্দে জানা। তবু মোহর বাইপাসের ফ্ল্যাটে থাকলে তাঁর ঘুম আসতে এত দেরি হয় কেন কে জানে!
অ্যাশট্রেটা কোথায় গেল আবার? তাঁর হঠাৎ মনে হল, মোহর কি এ বাড়িতে কাউকে ডাকছে? অ্যাশট্রেটা কি সে বেডরুমে নিয়ে গেছে? ভবানী ডাকলেন ‘মোহর?’ কোন সাড়া নেই। হলুদ তুলোট কাগজের জন্মপত্রগুলো একটা কাচের কাগজচাপা দিয়ে চাপা দিয়ে বেড রুমের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালেন ভবানী। আর দাঁড়িয়েই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলেন তিনি। স্নান সেরে আয়নার সামনে এসে প্যান্টি পরছে মোহর। পায়ের কাছে নীল তোয়ালে পড়ে আছে। তার সোনালি নিতম্ব, ভবানীর ফেলে আসা উজ্জ্বল দিনের মত তাঁকে হাতছানি দিল। বহুবছর পর তাঁর শরীর জেগে উঠল। তিনি সম্মোহিতের মত গিয়ে মোহরের জলকণাসিক্ত নিতম্বে ডান হাত রাখলেন, আর বাঁহাতে তার উন্মুক্ত বাম স্তনটি ধরলেন। আর মোহর? বাইরে যাই করুক, ঘরে বহুকাল উপবাসী, তাঁকে বাধা দিল না। বুজে আসা খসখসে গলায় বলল ‘দরজাটা বন্ধ করে এলে না?’
(ক্রমশ)