অজিত সিং বনাম অজিত সিং
দ্বাদশ পর্ব
তৃষ্ণা বসাক
প্রথমে ছিল বঙ্গলক্ষ্মী চানাচুর, তারপর এল আজাদ হিন্দ চানাচুর, তারপর একের পর এক বিপ্লব চানাচুর, সর্বহারা চানাচুর, উন্নততর সর্বহারা চানাচুর, এখন চলছে বিশ্ববাংলা। এখানেই কি ভাবছেন গল্প ফুরিয়ে গেল? এবার আসছে একে ফিফটি সিক্স চানাচুর। নাম যাই হোক, সোল এজেন্ট আমি।’ ‘বেওয়ারিশ’ গল্পের চানাচুরওলা এবার ঢুকে পড়েছে বাংলার শিল্পক্ষেত্র থেকে শিক্ষাজগতের ক্ষমতার অলিন্দে।খুন, যৌনতা, প্রতিশোধ, নিয়তিবাদের রুদ্ধশ্বাস সুড়ঙ্গে সে টের পাচ্ছে- -বহুদিন লাশের ওপর বসে বারবার হিক্কা তুলেছি আমরা -বহুদিন মর্গের ভেতরে শুয়ে চাঁদের মুখাগ্নি করেছি আমরা -অন্ধ মেয়ের মউচাক থেকে স্বপ্নগুলো উড়ে চলে গেছে (জহর সেনমজুমদার) এই সবের মধ্যে বাংলার কি কোন মুখ আছে আদৌ? থাকলে কি একটাই মুখ? না অনেক মুখ, সময়ের বিচিত্র রঙে চোবানো? বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দী জুড়ে বাংলার অজস্র মুখের ভাঙ্গাচোরা টুকরো খুঁজে চললেন তৃষ্ণা বসাক, তাঁর নতুন উপন্যাস ‘অজিত সিং বনাম অজিত সিং’-এ । সব কথনই রাজনৈতিক, সেই আপ্তবাক্য মেনে একে কি বলা যাবে রাজনৈতিক থ্রিলার? সিটবেল্ট বাঁধুন হে পাঠক, ঝাঁকুনি লাগতে পারে। প্রকাশিত হল উপন্যাসের দ্বাদশ পর্ব।
১২
‘তুমি খেয়াল করেছ সব পটাপট মারা যাচ্ছে এই সময়ে? কিন্তু তোমাকে আমি মারা যেতে দেব না। এই ঝান্ডুবাম লাগালে কেউ মরে না।’
তিনি, পদ্মনাভ ঘুমোচ্ছিলেন।ঘুমোনো ছাড়া এই মুহূর্তে আর কাজ নেই তাঁর। তাঁদের পার্টি সাইনবোর্ড হয়ে গেছে সবাই বলে। তাঁরা নাকি রিপ ভ্যান উইঙ্কলের মতো ঘুমোচ্ছিলেন এত বছর। পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেছে, বুঝতেই পারেননি।ঘুম থেকে উঠে তাঁরা দেখলেন পৃথিবীটা পালটে গেছে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তিনি একটা স্বপ্ন দেখছিলেন। পায়ে হাওয়াই চটি পরা, মুখে গামছা বাঁধা কয়েকটা লোক একটা সাঁকো পেরিয়ে যাচ্ছে। খুব সরু একটা জলের ধারা সাঁকোর নিচে বয়ে যাচ্ছে, যাকে কোনভাবেই খালও বলা যাবে না, বড়জোর একটা নালা। তবে সরু হলেও খুব স্বচ্ছ জল, এত স্বচ্ছ যে নিচের লতাগুল্ম তো বটেই, পরীর এক পায়ের নূপুর পড়ে থাকলেও দেখা যাবে মনে হয়। তবে সত্যি সত্যি কারো পায়ের নূপুর পড়ে নেই, পরীর তো নয়ই। এইসব গ্রামে পরীরা নামে না, হয়তো আগে নামত।যখন ধানের শিষে দুধ জমত মিহি জ্যোস্নায় আর লক্ষ্মী ধানক্ষেত ধরে হেঁটে চলে যেতে যেতে টের পেতেন সাঁকোর ওপর গ্রামের উচক্কা যুবকের বুকে ঘন হয়ে লেপ্টে আছে পরী। লক্ষ্মীকে দেখে পরী লজ্জা পেয়ে ছুটে পালাতে যেত আর অমনি তার এক পাটি নূপুর পড়ে যেত জলে। সে ছিল অন্য পৃথিবী। তবে এই নালার জলে পরীর পায়ের নূপুর না থাক, কিশোরীর নাকফুল থাকতেই পারে, সেই যে কিশোরী মাঝরাতে মাঠ সারতে গেছিল, আর ফেরেনি, তার, তাদের ছিঁড়ে নেওয়া নাকফুল, রক্ত মাখা নাকফুল পড়ে আছে জলের তলায়। জলের ওপর নড়বড়ে একটা সাঁকো। সাঁকোটা প্রবল দুলছে। সাঁকোটা দুলছে কেন? পদ্মনাভ দেখতে পেলেন একটা জলরাক্ষস মাথা তুলছে নালা থেকে, তার মাথায় লেগে সাঁকোটা দুলছে। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন রাক্ষসটাকে তাঁর খুব পরিচিত একজনের মতো দেখতে। তিনি সবে বলতে যাবেন ‘আরে তুমি সাঁকোটা নাড়াচ্ছ কেন? ওরা তো আমাদের লোক।’ সেই শুনে রাক্ষসটা খিকখিক করে হেসে আরও জোরে সাঁকোয় চাপ দিতে লাগল। আর অমনি সাঁকো থেকে সবকটা লোক নিচে নোংরা নালায় পড়ে গেল। আর তখনি পদ্মনাভ বুঝতে পারলেন, তিনিও এতক্ষণ ওই নালাতেই ছিলেন, লোকগুলো তাঁর গায়ের ওপর পড়েছে, তাঁর খুব জোরে আঘাত লাগা উচিত ছিল, কিন্তু অদ্ভুতভাবে তাঁর ভীষণ সুড়সুড়ি লাগছে। কেউ যেন তাঁকে কাতুকুতু দিচ্ছে।
পদ্মনাভ খুব কষ্ট করে চোখ খুললেন, আবছা আলোয় দেখতে পেলেন যাকে, তাকে তিনি প্রতিবার ঘুম ভাঙ্গার পর চিনতে পারেন না। এবারও ঘুম ভেঙে তিনি নতুন করে চিনলেন শতরূপাকে, যে তাকে কতমাস বন্দি করে রেখেছে এই কোটি যোগিনীর গলিতে। সে সত্যি সত্যি তাঁর গলায় সুড়সুড়ি দিচ্ছে।
পদ্মনাভর এখন মনে হচ্ছে শতরূপার এই ঘরটা, যাকে ও অমোঘ জানবাড়ি বলছে, কেন বলছে, কী এর মানে পদ্মনাভ জানেন না, এই বাড়িটা আসলে একটা কৃষ্ণগহ্বর ছাড়া কিছু নয়। সব আলো শুষে নেয়। ব্ল্যাক হোল। এমন এক ব্ল্যাক হোল, যেখানে একবার ঢুকে পড়লে সময় স্থির হয়ে যায়। তাই বাইরের কোন পরিবর্তনের আঁচ গায়ে লাগে না।এখানে এসে তাঁর ভাবতে ইচ্ছে করছে পরিবর্তন, বদলা, বদল কিছুই হয়নি আসলে। সেই যে, কোন আক্কেলে শু শু করতে এখানে ঢুকে ছিলেন, কোটি যোগিনীর গলিতে সুলভ, দুর্লভ কোন শৌচালয়ই দেখতে পাননি। দোতলায় দাঁড়ানো বুক আধেক খোলা এক রমণীর ডাক তিনি উপেক্ষা করতে পারেননি, সেটাও তো সত্যি। স্পষ্ট মনে আছে, সেই মহিলার পাশে একটি খাঁচা ছিল, খাঁচায় টিয়াপাখি, সেই যে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে এলেন, আর শতরূপা কোথা থেকে বেরিয়ে তাঁকে এই ঘরে টেনে নিল, তারপর থেকে তিনি আর এখান থেকে বেরোতে পারেন নি, এই ঘরটা যেন তাঁকে শুষে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, ওই যে গলির দিকের খোলা বারান্দা, যেখানে ওই রমণী ও টিয়াপাখি সুদ্ধু খাঁচা ছিল, সেখানেও কখনো যেতে পারেননি।ওখানে দাঁড়িয়ে অবলোকন করতে পারেননি নিচের তুচ্ছ অকিঞ্চিৎকর জীবন।ফলে গলির জ্যান্ত জীবন, লোক চলাচল, মিছিল, ডাঙ্গুলি, খেলা হবে –কিছুই তাঁর দেখা হয়নি। কিন্তু তা বলে যে তিনি এই ঘরের বাইরে কিছুই দেখেননি তা নয়।
সেটা বলার আগে ঘরটির একটু বিবরণ দেওয়া যাক। পাঁচ তারা হোটেলের সুটের মতো ব্যবস্থা এখানে। হয়তো তার চেয়েও বেশি। যে ঘরটিতে তিনি এসে ঢুকেছিলেন, সেটি শোবার ঘর। এছাড়া আরও দুটো ঘর আছে, একটায় সোফা, টিভি ইত্যাদি, একপাশে একটা টেবিল চেয়ার আছে, এই ঘরে বাইরের লোক আসে, মাঝে মাঝে টেবিল ঘিরে বসে মিটিং হয়, কারা আসে, কেন আসে, কীসের মিটিং তা জানেন না পদ্মনাভ, জানার ইচ্ছেও হয় না। কারণ আরও একটা ঘর, অর্থাৎ তিন নম্বর ঘরটা সম্পূর্ণ তাঁর, একেবারে তাঁর মনের মতো করে সাজানো। দেওয়াল জোড়া তাকে তাঁর পছন্দের বই, একটা প্লেস্টেশন অব্দি আছে, তাতে পছন্দের সিনেমা বা গান শুনতে পারেন।সংস্কৃতি কেন্দ্রে যেমন ছিল, একটা প্রজেক্টর, ইচ্ছেমত ওয়ার্ল্ড সিনেমা দেখার সুযোগ, সেখানে বসে থাকতে থাকতে তিনি বুঝতেই পারেননি দুনিয়াটা কত বদলে গেছে।তিনি যখন বিশ্ব সিনেমার স্বাদ নিতে মগ্ন ছিলেন, তখন সত্যিকারের বিশ্ব তাঁর পায়ের তলা থেকে সরে যাচ্ছিল। কেন এমন হয়? তাঁর পার্টি মাসের কথা বলে, অথচ সেই মাস যা দেখে, তা তিনি কখনো দেখতে পারেননি। মাটি মানুষের মন কি পড়তে পারেননি তাঁরা? তাই এখন টুম্পা সোনার সুরে সুরে শ্লোগান শোনাতে হচ্ছে লোককে? একেই কি বলবেন শুদ্ধিকরণ?
শতরূপা একদিন ওর ফোনে গানটা চালিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল ‘দেখো দেখো, পাবলিক কী চায়? কী খায়?’
টুম্পা সোনা, দুটো হাম্পি দে না, আমি রকের ছেলে’
নিজে গুনগুন করে গেয়ে ঝকাস করে হাম্পি দিয়েছিল পদ্মনাভের দুই গালে। শতরূপার গায়ে ভীষণ মাংস মাংস গন্ধ, যখনি ও কাছে আসে, গা বমি বমি করে তাঁর।
অথচ শতরূপা তো পুরুষের মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া সুন্দরী। ধবধবে ফর্সা রঙ, সাড়ে পাঁচ ফুট হাইট। এখন বাড়িতে সে সবসময় কাফতান পরে থাকে, কিংবা টপ আর শর্টস। কিন্তু আগে যখন অ্যাসিস্টেন্ট কন্ট্রোলার অব একজামিনেশন ছিল, শাড়িই ছিল ওর সিগনেচার পোশাক। শাড়ি আর কপালে বড় টিপ। শাড়ির সঙ্গে স্লিভলেস ব্লাউজ, পিঠ প্রায় পুরোটাই খোলা, ব্রার স্ট্র্যাপটুকু বাদ দিয়ে। পদ্মনাভকে কে একজন বলেছিল শতরূপা যখন লিফটে উঠত, কর্মীদের মধ্যে ঠেলাঠেলি পড়ে যেত কে লিফটে ওর পেছনে দাঁড়াবে।ওর উন্মুক্ত পিঠ কাছ থেকে দেখার জন্যে। প্রায়ই কর্মীদের নিয়ে মিছিল করত শতরূপা, ঠেলে বার করত সবাইকে বিভাগ থেকে, কেউ না যেতে চাইলে ভুবনমোহিনী হাসি হেসে বলত ‘আমি ডাকছি, তাও আপনি যাবেন না?’
এসব কথা শুনতে না চাইলেও কানে আসত পদ্মনাভর। মহাকরণে কাজটুকু ছাড়া বাকি সময় তো তিনি সংস্কৃতি কেন্দ্রেই কাটাতেন, এসব মুখরোচক খবরে তাঁর কোন উৎসাহ ছিল না। জান্তব। শতরূপা সম্পর্কে এই ছিল তাঁর কনক্লুশন। সামনাসামনি দেখা হয়েছে দু চারবার। শতরূপা অন্যদের যে অস্ত্রে ঘায়েল করত, তাঁর ওপর সেসব প্রয়োগ করতে গিয়ে বিফল হয়ে ফিরেছে। তখন সে প্রায়ই উইক এন্ড শান্তিনিকেতনে কাটাত। ইতিহাসের ওপর পি এইচ ডি করছিল, বলত সেই কাজে যেতে হয়। আসলে থাকত তাঁদের পার্টির এক নেতার সঙ্গে, তাঁর ফার্ম হাউসে। আর সেই নিয়ে বাড়িতে স্বামীর সঙ্গে যেমন সমস্যা শুরু হল, তেমনি পার্টির আরও বড় দুই নেতা, যারা অল্প বিস্তর শতরূপার দাক্ষিণ্য পেয়েছিলেন, তাঁরাও বিরূপ হয়ে গেলেন। আর তাই ইতিহাসের উপাদান খুঁজতে গিয়ে নিজেই ইতিহাস হয়ে গেল শতরূপা।ইতিহাস বিভাগে লেকচারার হয়ে জয়েন করার পরদিন থেকেই ওকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। সবাই বলেছিল কিউরিসিটি কিলড দা ক্যাট। অনেক বেশি কৌতূহল দেখিয়েছিল মেয়েটা, পার্টির অনেক গোপন খবর জেনে ফেলেছিল, তাই নিজেই খবর হয়ে গেল। গোপন করে ফেলা হল ওকে। জমিদারি প্রথায় যাকে বলা হত গুমখুন।পদ্মনাভর আশ্চর্য লাগে, শতরূপাকে সরিয়ে দেওয়া হবে আর তাঁর কাছে কোন খবর থাকবে না! তার মানে তখন থেকেই, নাকি তারও আগে থেকেই রাশ আলগা হতে শুরু করেছে, কেন্দ্রীয় কমিটি নেহাতই কথার কথা। দল নয়, ব্যক্তিই বড়। এইসব ব্যক্তিরাই চালক, তারাই সব ঠিক করছে, পদ্মনাভ কি তাহলে শুধু পুতুল? আর এটাও কি আশ্চর্য নয়, সেই হারানো শতরূপাকে তিনিই আবিষ্কার করলেন, তাও আবার কোথায়? কোটি যোগিনীর গলিতে। কি আশ্চর্য সমাপতন। শতরূপাকে খুন করা হয়েছে, এরকম খবরের পাশাপাশি আরও একটি কথাও তো উড়ছিল হাওয়ায়। শতরূপা যোগিনী হয়ে গেছে। পুরুলিয়ার এক আশ্রমে মুণ্ডিত মস্তকে তার ছবি এসেছে পুলিশের হাতে। আর তার পাশে? নামটা জেনে চমকে গেছিলেন পদ্মনাভ। এও কি সম্ভব?
সেই চমকটা আবার ফিরে এল তাঁর শরীরে। শতরূপার থেকে ছিটকে সরে গেলেন তিনি।
শতরূপা খিলখিল হেসে বলল ‘কম্যুনিস্ট হয়েও বামনাই গেল না তোমার দেখছি। তা অবশ্য পুরুতের বংশ তোমাদের’
বলে একটু সরে গিয়েছিল শতরূপা। একটা সিগারেট ধরিয়েছিল আনমনে, বলেছিল, ‘জানো তো, আমি তোমাদের পার্টির খুব ভেতরে ঢুকেছিলাম, কী দেখেছিলাম জানো? আঁশ লেগে আছে, রক্তমাখা আঁশ’
রক্তমাখা শব্দটা শুনলে এখনো বুকের মধ্যে খুব কষ্ট হয়, সেই পোস্টারগুলো মনে ভেসে ওঠে। অনেক বছর আগে দেশের প্রধানমন্ত্রীকে শকুন আঁকত তাঁর পার্টির ছেলেরা, শকুন কিনা নিশ্চিত বলা যায় না, খড়্গনাসাটি চিহ্নিত করাতেই ছিল শিল্পীর মুন্সিয়ানা। সেই অদ্ভুতদর্শন মানুষ পাখিটির ঠোঁট থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরতে দেখা যেত। আর তাঁর ছবিওলা পোস্টারে তো রক্ত ঢালা হয়েছিল বালতি বালতি। তবু আঁশ শব্দটা তাঁকে কৌতূহলী করল।
‘কীসের আঁশ?’
‘জাতপাতের আঁশ, পিতৃতন্ত্রের আঁশ, সংস্কারের আঁশ। আমি খুব কম নেতা দেখেছি যারা এসবের ধার ধারেন না। পলিটব্যুরোকে কী বলত জানো সবাই? পলিত বুড়ো! স্ট্রাকচারটা ভাবো একবার।কজন দলিত ছিল মাথার ওপর? কজন মেয়ে? কজন বাম নেতা নিজের বাড়ির বাল্বের ফিউজ পাল্টাতে পারেন? গাড়ির স্টেপনি বদলাতে পারেন? কজন বাড়িতে এক কাপ চা বানিয়ে দেন বউকে? নিজের জামা কাপড় কাচেন? আসলে বাঙালি বাবুতন্ত্রটি এক থাকল, ওপরে সর্বহারার প্রলেপ পড়ল।পুজোর আগে কুৎসিত শহর যেমন আলোয় সেজে ওঠে। কৌটো বাজিয়ে পয়সা তোলা হল, কিন্তু সেই পয়সা অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে পারল না। যে লোকগুলো কাজ করত, শুধু তাদের ঝান্ডা ধরিয়ে কাজের অভ্যেস নষ্ট করে দেওয়া হল’
পদ্মনাভ উষ্মার সঙ্গে বলেন ‘এখন যে লুম্পেনাইজেশন হয়েছে এটাই কি তাহলে পরিবর্তন?’
‘পরিবর্তন আসতে গেলে চেতনার পরিবর্তন চাই। তোমরা কেউ তা পারোনি।’
‘তাহলে আপনি কী করছেন?’
‘ঝান্ডু বাম লাগাচ্ছি’ হেসে গড়িয়ে পড়ে শতরূপা।
এই ঘরে থাকলে অন্য ঘরে শতরূপা কার সঙ্গে দেখা করছে, কেন দেখা করছে-এসব জানার ইচ্ছে হয় না তাঁর। এত নির্ভার আনন্দে জীবনে কখনো থাকেন নি, এত কোয়ালিটি টাইম কখনো কাটাননি নিজের সঙ্গে।
তবে মাঝে মাঝেই শতরূপা তাঁকে নিয়ে একটা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। প্রথম দিন গিয়ে চমকে গিয়েছিলেন। চোখ জুড়ানো সবুজ মাঠ, তার মধ্যে একটা ভাঙ্গা স্কুলবাড়ি, আর একপাশে একটা টিউব কল। একটা ছোট মেয়ে জল পাম্প করছে, তার জামার পিঠের বোতাম নেই একটাও। যখনি সে পাম্প করছে, তখনি তার জামা নেমে আসছে কাঁধ থেকে আর সে টেনে তুলছে। এইভাবে চলতে থাকে। জল পাম্প করা, জামা নেমে যাওয়া, জামা টেনে তোলা। জামা নামারও কোন শেষ নেই, জামা তোলারও। দেখতে দেখতে কেমন ঘোর লেগে যায় পদ্মনাভর। এই তাহলে জীবন? একটু জলের জন্যে এত সংগ্রাম শুরু হয়ে যায় শৈশব থেকে? শতরূপা কি মনের কথা পড়তে পারে? সে বলে ওঠে ‘এ আর কী এমন কষ্ট। এখনই বৃষ্টি নামবে।’
বলতে বলতে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। মেয়েটা জামাটা খুলে কলসির মুখে বাঁধল। হায়, জামা দিয়ে কি বৃষ্টির জল ভেতরে যাবে না? ওর পরনে একটা নীল ইজের এখন, টগরফুলের কুঁড়ির মতো দুটো বুক ভিজছে। দেখতে দেখতে কেঁদে ফেললেন পদ্মনাভ ‘আমি কিচ্ছু করতে পারিনি এদের জন্যে, কিচ্ছু না!’
শতরূপা ওঁকে বুকে টেনে বাচ্চাদের মতো ভুলোতে লাগল। তারপর বলল ‘এবার দেখো’
পদ্মনাভ দেখলেন শহিদ কলোনির ঘর। মিলি তাঁকে জড়িয়ে বলছে ‘অ পদাদা, আমাকে ববি দেখতে নিয়ে যাবা?’
পদ্মনাভর আরও কান্না পেল। মিলি নিশ্চয় তাঁকে ভালবাসত। নন- ইন্টেলেকচুয়াল ভেবে ওকে কোনদিন পাত্তা দেননি।শরীরিণী মিলি, স্থূল মিলি ভেবে ঘেন্নাই করেছেন।যদি আরেকবার সুযোগ দিত জীবন, নতুন করে শুরু করার! শহিদ কলোনির ছোট ঘরে ছোট ছোট স্বপ্ন দিয়ে শুরু করার। তেলহলুদ, কাঁথা, পাটি, কেরোসিনের লাইন, ছেলেমেয়েকে নিয়ে রোজ বিকেলে পার্কে যাওয়া। এইসব ছোট ছোট সুখ ছোট ছোট মানুষের। এইভাবেই বাঁচা যেত যদি অতি সাধারণের একজন হয়ে। এইসব মানুষরাই তো আসল, বানিয়ে তোলা, ফাঁপিয়ে তোলা নয়, যন্ত্র নয়, এদের কথা নিয়েই গল্প উপন্যাস লেখেন লেখকেরা, এদের পাশে পাবার জন্যেই রাজনীতিকরা চেষ্টা করে চলেছে, মিলিকে বিয়ে করলে মনে হয় এইসব মানুষের পাশে থাকতে পারতেন, এদের কাছ থেকে এত সরে যেতেন না তিনি।
(ক্রমশ)