অজিত সিং বনাম অজিত সিং
চতুর্দশ পর্ব
তৃষ্ণা বসাক
অজিত সিং প্রথমে ছিল বঙ্গলক্ষ্মী চানাচুর, তারপর এল আজাদ হিন্দ চানাচুর, তারপর একের পর এক বিপ্লব চানাচুর, সর্বহারা চানাচুর, উন্নততর সর্বহারা চানাচুর, এখন চলছে বিশ্ববাংলা। এখানেই কি ভাবছেন গল্প ফুরিয়ে গেল? এবার আসছে একে ফিফটি সিক্স চানাচুর। নাম যাই হোক, সোল এজেন্ট আমি।’ ‘বেওয়ারিশ’ গল্পের চানাচুরওলা এবার ঢুকে পড়েছে বাংলার শিল্পক্ষেত্র থেকে শিক্ষাজগতের ক্ষমতার অলিন্দে।খুন, যৌনতা, প্রতিশোধ, নিয়তিবাদের রুদ্ধশ্বাস সুড়ঙ্গে সে টের পাচ্ছে- -বহুদিন লাশের ওপর বসে বারবার হিক্কা তুলেছি আমরা -বহুদিন মর্গের ভেতরে শুয়ে চাঁদের মুখাগ্নি করেছি আমরা -অন্ধ মেয়ের মউচাক থেকে স্বপ্নগুলো উড়ে চলে গেছে (জহর সেনমজুমদার) এই সবের মধ্যে বাংলার কি কোন মুখ আছে আদৌ? থাকলে কি একটাই মুখ? না অনেক মুখ, সময়ের বিচিত্র রঙে চোবানো? বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দী জুড়ে বাংলার অজস্র মুখের ভাঙ্গাচোরা টুকরো খুঁজে চললেন তৃষ্ণা বসাক, তাঁর নতুন উপন্যাস ‘অজিত সিং বনাম অজিত সিং’-এ । সব কথনই রাজনৈতিক, সেই আপ্তবাক্য মেনে একে কি বলা যাবে রাজনৈতিক থ্রিলার? সিটবেল্ট বাঁধুন হে পাঠক, ঝাঁকুনি লাগতে পারে। প্রকাশিত হল উপন্যাসের চতুর্দশ পর্ব।
পূর্বপ্রকাশিত-র পর
১৪
মোহরমালা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে চমকে গেলেন। দেওয়ালে পোস্টার সাঁটা। এর মধ্যে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। অনেক বলা সত্ত্বেও পোস্টার লাগানো হতেই থাকে।কয়েক দশক ধরেই বাঙ্গালির প্রতিবাদের এটাই ধরন। বাস ট্রাম পোড়ানো, ভাঙচুর করা, ট্রেন অবরোধ করে একটা কাজের দিন নষ্ট করা আর দেওয়ালগুলোকে কুৎসিত করা। এছাড়াও আছে ভোটের সময় পাড়ায় পাড়ায় দড়িতে লাগানো কাগজ আর কাপড়ের ছোট ছোট দলীয় পতাকা, ইস্তাহার, ফেস্টুন। দেওয়াল যদি বা মুছেও দ্যায় রাজনৈতিক দলগুলো, কিন্তু এইসব ফেস্টুন বা পতাকা সরিয়ে নেবার কথা কারো মাথায় থাকে না, এগুলো পাড়ার মাথায় ঝুলতে থাকে দলতন্ত্রের অভিশাপ হয়ে। বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে তারপর একসময় মাটিতে লুটোয়, কাদা মাখামাখি হয়, গরুরা ঘাস খেতে খেতে একবার উদাস চোখ তুলে দেখে চেয়ে, তারপর তাচ্ছিল্যের ভাব করে আবার ঘাস খাওয়ায় মন দ্যায়। কী বিশ্রী জিনিস এসব, খাওয়াও যায় না।
তিনি এসে প্রস্তাব দিয়েছিলেন একটা বোর্ড থাক ছাত্রদের জন্যে। কেন্দ্রীয় কোন জায়গায়। যাতে সবার নজরে পড়ে। বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকে যেমন। সেখানে যত ইচ্ছে ক্ষোভ, বিক্ষোভ, প্রতিবাদ লেখা যাবে।পাঁচতারা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁদের, এখানে দেশ বিদেশ থেকে কত গণ্যমান্য মানুষ আসেন, দেওয়ালগুলো কুৎসিত না করাই ভালো। কিন্তু তাতে কোন ফল হয়নি। ট্রাম বাস না পোড়ালে, নিজেদের শহর নোংরা না করলে, সাধারণ মানুষকে দুর্ভোগে না ফেললে এদেশে কোন আন্দোলন হয় না। তাই যত্রতত্র পোস্টার সাঁটানো অব্যহত আছে।
কিন্তু, কিন্তু এই পোস্টারগুলো সেরকম নয়। এরকম অদ্ভুত পোস্টার বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে কোনদিন দেখেননি মোহরমালা। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের বাইরে থাকে হয়তো এরকম, গুপ্ত রোগ, যৌন রোগের পাশাপাশি অদ্ভুত পোস্টার দু একটা তাঁর মাঝে মাঝে চোখে পড়েছে। যেমন সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে- ইহাই এক এবং একমাত্র সত্য। কিংবা শৌলমারীর সাধুই কি নেতাজী? যত পাগলের কাণ্ড ভেবেছেন সেসব দেখে। কিন্তু এটাকে তিনি কী বলবেন? এরকম যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে, বিল্ডিঙের দেওয়ালে সাঁটা হতে পারে, তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি।
এখানে লেখা আছে
‘সাবধান
বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসের দিন আসন্ন।
এর জন্য প্রয়োজন অরিষ্টনেমি যজ্ঞ।
যোগাযোগ করুন ভবানী শাস্ত্রীর সঙ্গে।’
এর নিচে অদ্ভুত কিছু চিহ্ন আঁকা। স্বস্তিক তিনি চেনেন, কিন্তু না, স্বস্তিক না, অন্য কিছু, একটা অস্বস্তি শুরু হয় শরীরে এগুলো দেখলে।
মোহরমালা উঠতে উঠতে সিঁড়ির রেলিং আঁকড়ে ধরলেন। এই পুরোনো বিল্ডিংর উঁচু উঁচু সিঁড়ি, কোন লিফট নেই, উঠতে হাঁফ ধরে যায়। এখানে আসার তাঁর দরকার পড়ে না। লাইব্রেরি সায়েন্স, ফোটোগ্রাফি ক্লাব আর একদম নিচে কন্সট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং ছিল একসময়। এখন সেটা অন্য ক্যাম্পাসে চলে গেছে। আরও কিছু হাবিজাবি কর্মকাণ্ড থাকতে পারে, সেসব তিনি জানেন না।কোনটার সঙ্গেই তাঁর দরকার নেই কিছু।যদি কোন মেন্টেনেন্সের সমস্যা হয়, তাঁকে দেখতে হবে, এইটুকু তাঁর এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে। তবে এখান থেকে কোন সমস্যা নিয়ে কেউ যায়নি এতদিনের মধ্যে।গেলেও মনে করতে পারলেন না এই মুহূর্তে। গানের স্কুল গীতিনন্দন এই বাড়ির তিন তলায়। এরা তাঁর পেছনে পড়ে আছে শুধু তাই না, তিনিও এদের একটু প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন।গানে তাঁর একটা খাঁটি অনুরাগ আছে। রবীন্দ্র সঙ্গীতে ফিফথ ইয়ার আর ক্লাসিকালে থার্ড ইয়ার অব্দি করা ছিল। তারপর কেরিয়ারের চক্করে আর এগোয়নি। কিন্তু গানের টানটা ভেতরে রয়ে গেছে। তাঁর মাও ভাল গান গাইতেন। আশার গান বেশি গাইতেন, তবে আশাকণ্ঠী নয়। তাঁর একটা স্বকীয় গায়কী ছিল। তাঁদের ছোট মফস্বল শহরে অনেক অনুষ্ঠানে ডাক পড়ত তাঁর। মা খুব জনপ্রিয় ছিলেন, দেখতেও অপূর্ব সুন্দরী। নীল শিফন পরে মা যখন গান ধরতেন ‘ মহুয়ায় জমেছে আজ মৌ গো’ কিংবা ‘ময়না বলো তুমি কৃষ্ণ রাধে/ তাকে মন দিতে যে হায় কেমন বাধে’ তখন ওই বয়সেই অনেকের চোখে আগুন জ্বলে উঠতে দেখেছেন তিনি। প্রতিটি অনুষ্ঠানেই মা একটা কাজ করতেন।। নিজের গান শুরুর আগে মোহরকে ডেকে নিতেন স্টেজে। একটি ভজন ‘গুরু বিনা ক্যায়সে গুণ গায়ে’ আর একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘সারাজীবন দিল আলো সূর্য গ্রহ চাঁদ’ কিংবা ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে’ বাঁধা ছিল ছোট্ট মোহরের। এখন তিনি বুঝতে পারেন, তিনি ছিলেন মায়ের সুরক্ষাকবচ। ছোট মেয়ের কচি গলার ভজন শোনার পর মার দিকে হাত বাড়াতে দুবার ভাবত লোকে। এইভাবে মা পুরুষের আগ্রাসী হাতকে ঠেকিয়ে রাখতেন, দুটো পয়সা বেশি রোজগার করার জন্যে কোনদিন তিনি সরস্বতীকে রাস্তায় নাচান নি। মা অত আগেও কেমন নিজেকে বাঁচাতে জানতেন। নিজেকে, নিজের ছোট্ট সংসারটাকে। তাঁর মেয়ে হয়ে তাহলে তিনি কেন কিছু পেলেন না? তবে মার আর কিছু না পান, গানের প্রতি ভালবাসাটা পেয়েছিলেন। গান যে কতখানি রক্তে ঢুকে আছে তাঁর, তা টের পাননি এতদিন। টের পেলেন যখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করার পর তাঁর কাছে এল গীতিনন্দনের ছেলেমেয়েরা। আর রক্তে ঘুমিয়ে থাকা সুর আবার জেগে উঠল। যা হারিয়ে গেছে ভেবেছিলেন, তা আসলে হারায়নি। ভেতরে রয়ে গেছে। মায়ের গর্ভজলে শুধু না, জন্মের আগে থেকে মায়ের সুরসাগরে ভেসে ছিলেন তিনি। তাঁকে মা ধরে রেখেছেন আজো, জড়িয়ে আছেন সুরের জালে। অথচ যখন এখানে পড়তে এসেছিলেন, তখন কখনো গীতিনন্দনের সদস্য হবার কথা ভাবেননি। তখন মফস্বল থেকে আসা মেয়ের সংকোচ ঘিরে থাকত তাঁকে।এই বিল্ডিং -এ তো এসেইছেন, দূর থেকে দেখেছেন ঝাঁ চকচকে সাজ পোশাকের দারুণ স্মার্ট মেয়েগুলোকে।সেসময় সত্যিই শহর আর মফস্বলের মেয়েদের বিস্তর ফারাক সাজ পোশাকে। এখন তো ছোট ছোট শহরেও শপিং মল। সারা পৃথিবী সেখানে ঢুকে পড়েছে।খাবারেও। মফস্বলের বাচ্চারাও টিফিনে পাস্তা পিৎজা খায়, ব্র্যান্ডেড পোশাক পরে। দামী বিউটি পার্লার আর সাঁলো এখন অলিতে গলিতে। তাঁদের তো সেরকম ছিল না। তেল দেওয়া দীর্ঘ চুল মোটা বিনুনি করা। দুটো বিনুনি করার অভ্যেস ছেড়েছিলেন বন্ধুদের টিটকিরিতে। কিন্তু চুলে তেল দেওয়ায় অভ্যেস আরও অনেক বছর ছিল। মা নারকেল তেলে মেথি আর কীসব মিশিয়ে দিয়েছিলেন, সেটাই মাখতেন। আর ডুরে তাঁতের শাড়ি, খুব বড়জোর মায়ের মুর্শিদাবাদী সিল্ক। কানে সোনার রিং, হাতে গলায় কিচ্ছু না।কপালে টিপও নয়। শুধু চোখে কাজল লাগাতেন। তাতেই কেউ চোখ ফেরাতে পারত না। কিন্তু সেটা স্বীকার করত না মুখে। কলকাতা আর মফস্বলের একটা অলিখিত বিভাজন ছিল। মফস্বল থেকে আসা ছেলেমেয়েরা প্রথম প্রথম জল থেকে তোলা মাছের মতো খাবি খেত এখানে এসে। তারা মাত্রাতিরিক্ত গম্ভীর হয়ে থাকত, নিজেদের চারদিকে একটা ঘেরাটোপ টেনে রাখত আর কলকাতার ওপর প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করত পড়াশোনা দিয়ে। কলকাতার ছেলেমেয়েরা এদের নামই দিয়ে দিত বই মুখস্থ পাবলিক, গাঁতানো ক্লাস।সেইসময় মোহরও পড়ার বাইরে অন্যকিছু করার কথা ভেবে উঠতে পারেননি।
এখন সেই গীতিনন্দনেই তাঁকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে সাধাসাধি। তাঁরও সারাদিন বুড়ো চতুর আর ধান্দাবাজদের সঙ্গে মিশতে মিশতে দিনের শেষে তরুণদের সংগ খুব পছন্দ। তিনি দেখেছেন সবচেয়ে সুন্দর যুবাদের এখানেই দেখতে পাওয়া যায়। তাই সপ্তায় অন্তত একদিন এখানে চলে আসেন।
কিন্তু একি! ভবানী শাস্ত্রী! ভবানী কি তাহলে এরকম পোস্টার বানিয়ে কাউকে দিয়ে সাঁটিয়েছে! ও জানে তিনি এই পথে যাবেন তাই? কিন্তু কেন? সব জেনেও মোহরের কোন কাজে বাধা দেননি ভবানী। কারণ তিনি ভবিতব্যে বিশ্বাস করেন। না, এটা ভবানীর কাজ হতে পারে না। কেউ তাঁর নামটা ব্যবহার করছে। কিন্তু কে হতে পারে? এমন কেউ যে চায় মোহর আর ভবানীর মধ্যে একটা দূরত্ব আসুক। পোস্টারটা তারা জেনেই লাগিয়েছে যে এখান দিয়ে মোহর সপ্তায় অন্তত একদিন যান। আগের সপ্তায় আসতে পারেননি মোহর, একটা মিটিং-এ আটকে গিয়েছিলেন। সুতরাং এটা গত পনেরো দিনের মধ্যেই লাগানো হয়েছে। মোহরের খুব সন্দেহ হল এই পোস্টার একমাত্র এখানেই লাগানো হয়েছে। কারণ মেন বিল্ডিং-এ গাড়ি করে নামা আর ওঠা ছাড়া আর কোথাও সেভাবে যাওয়া হয় না। এই গীতিনন্দন যে বাড়িতে সেই ইন্টিগ্রেটেড বিল্ডিং মেন বিল্ডিং থেকে সামান্যই দূরে। তবু এই পথটা গাড়িতেই আসেন মোহর। কয়েক দশক আগে ভিসিরাও রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতেন, ছাত্রদের থেকে ঝালমুড়ি খেতেন –এমন গল্প ভাসে ক্যাম্পাসে। সেসব জমানা কি আর আছে? ছাত্ররা কত উদ্ধত, অসভ্য, তেড়িয়া হয়ে গিয়েছে, হেঁটে গেলে কেমন যেন নিরাপত্তার অভাব বোধ করেন। যারা পোস্টার মেরেছে, তারা তাঁর রুটটা শুধু ভালোভাবে চেনে তাই নয়, তাঁর স্বভাবের সঙ্গেও পরিচিত। এই ইন্টিগ্রেটেড বিল্ডিং-এ যে লিফট নেই তা তারা জানে। এবং এও জানে তিনি খুব ধীরেসুস্থেই সিঁড়ি ভেঙে ওঠেন। সিঁড়ির ধাপে ধাপে দম নিতে নিতে ঠিক নয়, শারীরিকভাবে তিনি এখনও যথেষ্ট ফিট, প্রতিদিন ফ্রিহ্যান্ড করেন, সময় করতে পারলে জিমে যান, মেয়েই বরং বেশ গোলুমোলু, কিন্তু সে নিয়ে সে লিস্ট বদারড, আগে মোটা মেয়েরা কী পরবে তা সত্যিই চিন্তার বিষয় ছিল, এখন শপিং মলে ওভারসাইজ পোশাকও পাওয়া যায়, মেয়ে তো ওয়েস্টার্ন পোশাক দিব্যি ক্যারি করে।তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে শাড়ি পরেন ঠিকই, কিন্তু অন্যত্র সব ধরনের পোশাকেই সাবলীল।সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব বেশি অ্যাক্টিভ নন যদিও মেয়ের মতো, কিন্তু ইচ্ছে হলে এক আধটা ছবি পোস্ট করেন ফেসবুকে বা ইন্সটাগ্রামে, আর নিমেষে তাতে লাইক, কমেন্টের বন্যা বয়ে যায়।তাঁর ছিপছিপে শরীর অন্তত বছর দশেক বয়স লুকোতে জানে। সিঁড়ি দিয়ে ধীরে ওঠার কারণ এই সিঁড়ি অনেক কথা জানে, অনেক কিছু মনে পড়িয়ে দ্যায়। এর ধাপে ধাপে তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়।
তিনি তো এই বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্র্যাজুয়েশন করেছেন। সেই সংস্কৃতির দিনগুলো। অনীকের সঙ্গে আলাপ। সে তো মেকানিকাল। ইঞ্জিনিয়ারিং-র ছেলে আর আর্টসের মেয়ে যেন অবধারিত সমাপতন। এখানে ফোটোগ্রাফি ক্লাবে অনীক আসত। একদিন ওঁকে ছাদে নিয়ে গেছিল।বিরাট ছাদ, সিঁড়ি দিয়ে উঠেই একটু শেড, সেখানে একটা দুটো বাতিল বেঞ্চ রাখা থাকত। সন্ধানী ছেলেমেয়েরা খোঁজ রাখত এই জনহীন ছাদের, শুধু একটু খেয়াল রাখতে হত সন্ধে না হয়ে যায়, সন্ধে হয়ে গেলেই নিচের কোলাপসিবলে তালা পড়ে যাবে, তখন এত বড় বিল্ডিঙ্গে আটকা থাকতে হবে সারা রাত, পরের দিন দারোয়ান আসার অপেক্ষা করতে হবে।তখন তো মোবাইল ছিল না, যে মেন বিল্ডিং এ সিকিউরিটিতে ফোন করে বলা যাবে যে আটকে পড়েছি। খুব দুঃসাহসী এক প্রেমিক যুগল একবার আটকে পড়েছিল এমন নজির আছে। সেই ছাদের নির্জনতায় অনীক চুমু খেয়েছিল মোহরমালাকে। সেই চুমুর স্বাদ এখনও লেগে আছে ঠোঁটে। নামবার সময় সিঁড়িতে আলো জ্বলেনি। অনীক হাত ধরে ধরে নামিয়েছিল। মোহর দাঁড়িয়ে পড়েন সেখানে। এই ধূলোপড়া সিঁড়ির ধাপে, ধূলোপড়া রেলিঙে সেদিনের সেই স্পর্শ যেন লেগে আছে। ছুঁলেন মোহর আর ছুঁয়েই কেঁপে উঠলেন। ক্ষতি ছিল কিছু অনীকের হয়ে থাকলে? ছোট সংসারে ছোট সুখ নিয়ে?
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাপ, ওপর থেকে পার্টির চাপ, অজিত, অফ অল পার্সনস অজিতের সঙ্গে সম্পর্ক। কিছু দিলে তবে কিছু পাওয়া যায়, এই অংক কবে থেকে রক্তে ঢুকে গেল? এক ছোট শহরের মেয়ে মোহর, এম ফিল করার সময় থেকেই জেনে গেলেন এই অংক, পি এইচ ডি, চাকরি, একের পর এক সিঁড়ি ভাঙ্গা- সব এই অংক মেনে। এই অংক একটু উল্টোপাল্টা হয়ে গেলেই মুখ থুবড়ে পড়তে হবে। খাওয়া পরার হয়তো অভাব থাকবে না। কিন্তু এই যে এত বড় জায়গায় সবার নজরে বসে থাকা, অজিতকে হাতের মুঠোয় রেখে যত গোপন ব্যাপারের স্বাদ নেওয়া, রাজ্য রাজনীতি থেকে সিনেমা জগতের অন্দরমহল- এর যে থ্রিল, তা কি দিতে পারত অধ্যাপনা? সে তো করেছেন অনেক বছর। কিন্তু ভবানীই তাঁর ছক দেখে বলেছেন জাতিকা অনেক ওপরে উঠবে, কিন্তু ভবানী তো এটাও বলেছিলেন , ‘জানো তো মোহর ওপরে উঠলে নিচের মানুষগুলো যেমন ছোট ছোট দেখা যায়, তেমনি ওপরের মানুষগুলোও নিচের মানুষদের চোখে হারিয়ে যায়। তাই এত উঁচুতে উঠো না যাতে তোমাকে দেখাই যায় না। আর একটা কথা মনে রেখো যত উঁচুতে উঠবে তত আঘাত বেশি লাগবে যখন আছড়ে পড়বে’ ।
ভবানী এত কথা কখনো বলেন না তাঁর সঙ্গে। এখন দুজনের দেখাই বা কোথায় হয়? মেয়ে যখন ছোট ছিল, তখন মেয়ের জন্যেই কথা হত তাঁদের। এখন মেয়ে বড় হয়ে একেবারেই নিজের জগতে ঢুকে গেছে। মার সঙ্গে কথা হলেও, বাবার কাছেই ঘেঁষে না। বাবার কাজকর্ম ওর কাছে নাকি ‘ইরি’ মনে হয়।‘হি ক্যান প্লে ইভিল’ ফিসফিস করে বলেছিল একবার। মোহর বিশ্বাস করেননি ওর কথা ‘তুই বাবার সম্পর্কে এসব কী বলছিস উল্টোপাল্টা? আফটার অল তোর বাবা। জানিস তো লোকটার কত ইনফ্লুয়েন্স ওপর মহলে।’
তখন একটা অদ্ভুত কথা বলেছিল কিঞ্জল। বলেছিল ‘লোকটা এমন কিছু জিনিস নিয়ে খেলে, যার ওপর কারো কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। এই গ্রহ নক্ষত্র, অল বোগাস। সবাই জানে। তবু মানুষ নিজের ভবিষ্যতকে জানতে চায়, আর সেই দুর্বলতাকে মূলধন করে লোকটা। মানুষের ওপর অসম্ভব প্রভাব খাটাতে পারে। তাই আমি একদম কমফোর্ট ফিল করি না। আমি আমার ভবিষ্যতকে জানতে চাই না। আমার যা কিছু সব এই বর্তমান। এর প্রতিটি মুহুর্ত আমি চেটে পুটে নেব। এর নিয়ন্তা আমিই। কোন অজানা গ্রহের ভরসায় আমি জীবন কাটাতে পারব না।’
ভবানী কি কালা জাদু জানে?কীসের জন্য নয়তো ওকে ফেলে যেতে পারলেন না? সেই কি তাঁর জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করছে?
মোহরমালা সিঁড়ির রেলিং আঁকড়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। তাঁর কি হাঁফ ধরে গেল এইটুকুতেই? যেই মনে হল ভবানী নিজেই এই পোস্টার লাগিয়েছে, অমনি তাঁর শরীর কেঁপে উঠল। তাহলে কি ভবানী তাঁকে ভয় দেখাতে চাইছে? ভয় দেখিয়ে তাঁকে হাতের মুঠোয় রেখে দিতে চাইছে?
সেই মুহূর্তেই ফোন বাজল, তূণীর।
‘ম্যাম আপনি কি আসছেন?’
তিনি ফিসফিস করে বললেন ‘তূণীর, একবার সিঁড়ির ল্যান্ডিং- এ এসো, আমার শরীরটা খারাপ করছে।
বলার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দেখতে পান তূণীরকে। সে তার মানে এখানেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোন করছিল, ওপর থেকে দেখছিল মোহর আসছেন কিনা। তূণীর এসেই বলে ‘কী হল ম্যাম, শরীর খারাপ লাগছে? উঠতে পারবেন তো? নাকি নিচে যাবেন? ডক্টর ডাকব?’
এতগুলো কথা এক নিঃশ্বাসে বলে সে, ওর মুখে খাঁটি উদবেগ। মোহর হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলেন ‘আমার হাত ধরো তূণীর, ধরে থাকো, ছেড়ে দিও না’।
(ক্রমশ)