অজিত সিং বনাম অজিত সিং
চতুর্থ পর্ব
তৃষ্ণা বসাক
‘প্রথমে ছিল বঙ্গলক্ষ্মী চানাচুর, তারপর এল আজাদ হিন্দ চানাচুর, তারপর একের পর এক বিপ্লব চানাচুর, সর্বহারা চানাচুর, উন্নততর সর্বহারা চানাচুর, এখন চলছে বিশ্ববাংলা। এখানেই কি ভাবছেন গল্প ফুরিয়ে গেল? এবার আসছে একে ফিফটি সিক্স চানাচুর। নাম যাই হোক, সোল এজেন্ট আমি।’ ‘বেওয়ারিশ’ গল্পের চানাচুরওলা এবার ঢুকে পড়েছে বাংলার শিল্পক্ষেত্র থেকে শিক্ষাজগতের ক্ষমতার অলিন্দে।খুন, যৌনতা, প্রতিশোধ, নিয়তিবাদের রুদ্ধশ্বাস সুড়ঙ্গে সে টের পাচ্ছে- -বহুদিন লাশের ওপর বসে বারবার হিক্কা তুলেছি আমরা -বহুদিন মর্গের ভেতরে শুয়ে চাঁদের মুখাগ্নি করেছি আমরা -অন্ধ মেয়ের মউচাক থেকে স্বপ্নগুলো উড়ে চলে গেছে (জহর সেনমজুমদার) এই সবের মধ্যে বাংলার কি কোন মুখ আছে আদৌ? থাকলে কি একটাই মুখ? না অনেক মুখ, সময়ের বিচিত্র রঙে চোবানো? বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দী জুড়ে বাংলার অজস্র মুখের ভাঙ্গাচোরা টুকরো খুঁজে চললেন তৃষ্ণা বসাক, তাঁর নতুন উপন্যাস ‘অজিত সিং বনাম অজিত সিং’-এ । সব কথনই রাজনৈতিক, সেই আপ্তবাক্য মেনে একে কি বলা যাবে রাজনৈতিক থ্রিলার? সিটবেল্ট বাঁধুন হে পাঠক, ঝাঁকুনি লাগতে পারে। প্রকাশিত হল উপন্যাসের চতুর্থ পর্ব।
প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন —> প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন –> দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন —> তৃতীয় পর্ব
দোলন আবার সেই স্বপ্নটা দেখছিল। একটা খুব বড় টেবিল, এত বড় যে সমুদ্রের কথা মনে হল তার। এপার ওপার দেখা যায় না। কিন্তু সমুদ্র কী করে হবে? এটা তো কমিটি রুম নাম্বার টু। দেওয়ালে পর পর মণিষীদের অয়েল পোর্ট্রেট, দেখে দেখে মুখস্থ হয়ে গেছে ওর। এই, এই ঘরেই তো এর আগে সে ছবার এসেছে। কী ঠান্ডা ভেতরটা। দোলনচাঁপা বলে উঠল ‘একটু এসিটা কমানো যাবে? আমিই কমিয়ে দিয়ে আসছি’ এই কথা শুনে তার ডাইনে বাঁয়ে বসে থাকা চারজন চারজন আটজন লোক গলা ফাটিয়ে হাসতে শুরু করল। মাঝরাতে ঢেউয়ের কানফাটানো আওয়াজ যেমন হয়, তেমনি হাসি। ওর যে মনে হচ্ছিল সমুদ্র, সেটা তাহলে বাজে কথা নয়। শুধু ওভাল টেবিলের একেবারে ওপ্রান্তে, ওর ঠিক উল্টোদিকে যে লোকটা বসে আছে, সে ওর দিকে ঠাণ্ডা চোখে চেয়ে বলল ‘পুট অফফ ইয়োর ক্লোথস প্লিজ। কুইক’ দোলন বলতে পারত, ‘আমি তো ইন্টারভিউ দিতে এসেছি, জামা খুলব কেন?’ তার বদলে সে বলল ‘আমার বড্ড শীত করছে জানেন’ অমনি সবাই আবার সেইরকম কানে তালা লেগে যাওয়ার মতো হেসে ওঠে। দোলন দু কানে হাত চাপা দিয়ে চিৎকার করে বলে ‘প্লিজ স্টপ! ফর গডস সেক’ অমনি তার ঘুম ভেঙে যায়। এক্ষুনি তার শীত করছিল না? এখন তো দরদর করে ঘাম হচ্ছে। তাহলে কি ওটা স্বপ্ন ছিল? নাকি এটা স্বপ্ন? এটাই দোলনের একমাত্র সমস্যা। সে বুঝতে পারে না, তার জীবনে সত্যি সত্যি কোনটা ঘটেছে? ডঃ নিয়োগী ওকে বলেছেন , আপনি বিশ্বাস করতে পারেন আপনার জীবনে এসব কিছুই ঘটেনি। আপনি কোন ইন্টারভিউই দেননি, তো কীভাবে ভাবছেন আপনি একজন লুজার? চাকরি করার ইচ্ছে থাকলে, এটা কি একটাই জায়গা? এই ইউনিভার্সিটি ছাড়া কত পড়ানোর স্কোপ আছে। এত ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট আপনার’ যতক্ষণ ডঃ নিয়োগীর চেম্বারে থাকে, এসব কথা বিশ্বাস করে সে। বাড়ি এসে দু-একদিন ফুরফুরে লাগে নিজেকে। কন্ট্রোলের বইগুলো খুলে বসে। তারপর আবার যে কে সেই। স্বপ্নটা ফিরে ফিরে আসে। নজন লোক মিলে তাকে গ্যাং রেপ করছে। আর সে চিৎকার করে উঠছে। বিছানায় নিজের হাঁটুর ওপর মুখ গুঁজে গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে চমকে ওঠে দোলন। চিৎকারটাও কি সত্যি নয়? সত্যি সে চিৎকার করলে কি তার পাশে শুয়ে প্রদীপ্ত এমন অঘোরে ঘুমোতে পারত? নাকি তার চিৎকার কেউ মিউট করে দিয়েছে?
পাশে শুয়ে প্রদীপ্ত নির্বিকারে ঘুমোচ্ছে। ওর মতো ঘুমোচ্ছে এই শহর, এই সময়।কতদিন, কতদিন স্বাভাবিক একটা ঘুম আসেনি তার। ঘুমোয় যে সে তো ওষুধের জন্যে। নার্ভগুলো শান্ত করে রাখার ওষুধ। এই ওষুধ গুলো কি এই শহরটাকেও কেউ দিয়েছে? রাস্তায় লোক মরে পড়ে থাকলে পাশ কাটিয়ে যায় কী করে নাহলে? হসপিটাল ভর্তি নেয় না, দশ মাসের শিশুকন্যার… একটা অস্ফুট আর্তনাদ ফোটে দোলনের গলায়। ভালো হয়েছে সে আসেনি। কী করে বাঁচাত তাকে দোলন? সংসারটাই তো সে ঠিক ভাবে করতে পারছে না।
কোথায় যেন পড়েছিল ব্যাচেলর থেকে মাস্টার্স, মাস্টার্স থেকে পি এইচ ডি, তারপর পোস্ট ডক, তারপর চাকরির উঁচু পদ- আস্তে আস্তে মেয়েদের সংখ্যা কমে যায়। পিরামিডের মতো। একে বলে সিজার্স ডায়াগ্রাম। যখন বি ই করেছে, এত সব জানত না দোলন। একটা কথা চালু ছিল ক্যাম্পাসে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকা যতটা কঠিন, বেরনো ততটাই সহজ। হোম ইউনিভার্সিটি। যারা পড়াচ্ছে, তারাই প্রশ্ন করছে, তারাই খাতা দেখছে। ফলে চার বছর পড়ার কোন দরকার নেই। পড়ে শুধু বোকারা। না পড়ে কত কী করার আছে। গীতি সংসদ, ফোটোগ্রাফি ক্লাব, মাউন্টেয়ারিং। এইচ এস আর জয়েন্ট দিতে গিয়ে নিজেদের সব ভালবাসার জিনিস শিকেয় তুলে রেখে দিন রাত এক করে প্রচুর খাটতে হয়েছে, সেই শোধ সুদে আসলে তুলে স্রেফ আরাম এই চার বছর। ফুল মস্তি। গান করো, কবিতা লেখো, রাজনীতি করো। আর প্রেম তো আছেই। লাভ ইজ ইন দা এয়ার। কথাই আছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সবাই একা একা ঢোকে আর যুগলে বেরোয়।
গান অল্পস্বল্প শিখেছিল দোলন, বাঙালি মেয়েরা যেমন শেখে, নাইনে ওঠার পর পড়ার চাপে আর হয়নি। নিজের তেমন টান ছিল না যে ধরে রাখবে।ছবি তোলা, মাউন্টেয়ারিং কোনটাই তার আগ্রহের জায়গা নয়। বরাবর সে পড়ুয়া টাইপ মেয়ে। পড়ার বইয়ের বাইরে ইংরেজি থ্রিলার পড়ে, বাংলায় ফেলুদা। ব্যোমকেশ পড়তে গিয়ে বেশ শক্ত লেগেছে। রাজনীতি তাকে আদৌ টানে না, তবে কাঁধে ঝোলা, এক গাল দাড়ি, তারা-তারা চোখের ছেলেগুলোকে তার বেশ লাগত। বিশেষ করে এস এফ আই র দেবল সেনগুপ্ত যখন ক্লাসে এসে তাদের পাকড়াও করে বোঝাত, ওর বুকে একটা তিরতির কাঁপন হত। দেবল ব্যাপারটা বুঝত বলেই কি মাঝে মাঝে তার দিকে গাঢ় চোখে তাকিয়ে অল্প হেসে বলত ‘কী রে দোলনচাঁপা, ভোটটা আমাদের দিচ্ছিস তো এবার?’ কীসের ভোট, কেন ভোট –কিছুই বুঝত না দোলনচাঁপা। ও যখন পড়ত, তখন তো ইউনিভার্সিটিতে দুটো ছাত্র সংগঠন শুধু- বাম আর অতি বাম। সিপি বা ছাত্র পরিষদ, যাকে সবাই ছিপি বলত, তারাই ঢুকতে পায়নি কোনদিন। ছেলেমেয়েরা খুব গর্বিত ছিল এই নিয়ে। তাদের এই মেধাবী ইমেজের সঙ্গে বাম বিশেষ করে অতি-বাম রাজনীতিটা যেত ভাল। যেমন তাঁতের শাড়ির সঙ্গে পোড়ামাটির গয়না যায় কিংবা শিফনের সঙ্গে মুক্তো। এই তুলনা অবশ্য দোলনচাঁপার মাথায় আসেনি। ওর সঙ্গে আর যে একটিমাত্র মেয়ে পড়ত, বিদিশা, সে-ই বলেছিল।সেসময় ইঞ্জিনিয়ারিং-এ অনেক বিভাগেই মেয়েদের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা।মেকানিকালে, এখনো মনে আছে, নব্বইটা ছেলের সঙ্গে পড়ত একটা মেয়ে। তার নাম ছিল অনন্যপূর্বা। সবাই বলত এপি। আর্কিটেকচার, কেমিকাল এসবে কিছু মেয়ে দেখা যেত। ইলেক্ট্রনিক্স, কম্পিউটার, পরে আই টি এসব হয়ে মেয়েরা প্রচুর ভর্তি হল। তো, ওদের বিভাগে ওর ইয়ারে সেসময় দুজন মেয়ে। ও আর বিদিশা। বিদিশা আসত কালিকাপুর থেকে, ক্যানিং লাইনের কালিকাপুর। মফস্বলের মেধাবী মেয়ে। ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট ছিল। ক্লাসে ওর রেজাল্টই সবচেয়ে ভালো ছিল। সেটা নিয়ে বাকিরা ওকে হিংসে করত। ও ছাড়া বাকি সবাই কলকাতার। শুধু হিংসে নয়, ওকে তাচ্ছিল্য করত, বাঁকা বাঁকা কথা বলত, এখনকার পরিভাষায় যাকে ট্রোল বলা যায়। ওর সাদামাটা সালোয়ার, বাংলা-বাংলা ইংরেজি উচ্চারণ, বিনুনি করা চুল সব মিলিয়ে ও একটা খোরাক। দোলনচাঁপাও তাই ভাবত প্রথম প্রথম। কিন্তু সেই মেয়েই যখন সবাইকে পেছনে ফেলে সব সাবজেক্টে ফার্স্ট হতে শুরু করল, তখন সবাই ওকে গিলতে বাধ্য হল। সেই বিদিশা একটা অদ্ভুত কথা বলেছিল ওকে। ও সারা ছোটবেলা ওদের শহরে পিসিমাদের সভা সমিতিতে নাকি একটা গান শুনতে শুনতে বড় হয়েছে। পিসিমা? সিপিএম কে পিসিমা বলত ওরা। গানটা ছিল-
‘সাথীদের খুনে রাঙা পথে পথে হায়নার আনাগোনা।’
এই গান গাইত রোগা, কালো, দাঁত উঁচু, বিয়ে না হওয়া মেয়েরা। এই গান শুনলেই বিদিশার একটা অন্ধকার জীবনের কথা মনে হত। এই মেয়েগুলো কোনদিন একটা সুন্দর জীবন পাবে না, মনে হত ওর। কষ্ট হত ওদের জন্যে। বমি পেত গানটা শুনে। ও বলেছিল স্রেফ এই গানটা আর ওই মেয়েগুলোর জন্যেই ও কোনদিন সিপিএমকে ভোট দেবে না।
খুব অদ্ভুত লেগেছিল দোলনচাঁপার, কিন্তু সে বুঝতে পেরেছিল এই মেয়েটার একটা নিজস্ব চিন্তা আছে। দোলনচাঁপার অবশ্য এমন কোন গানের স্মৃতি ছিল না। কোন রাজনৈতিক দল নিয়েই তার কোন মাথাব্যথা ছিল না। ছাত্র রাজনীতি তার খুব সময় নষ্ট মনে হত। বিদিশা বলেছিল, মোটেই সময় নষ্ট নয়, এগুলো হচ্ছে ইনভেস্টমেন্ট। যারাই ছাত্র রাজনীতি করে, তাদের থেকেই লেকচারার হয়। আমার কথা মিলিয়ে নিস।
তখন বিশ্বাস হয়নি , কিন্তু পরে তো দেখল তাই। সেই যে তারা-তারা চোখের দেবল, সবাইকে সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখাত, তিনটে পেপারে সাপ্লি ছিল।সবাই মজা করে বলত সাপ্লি, রি-সাপ্লি, রিরি-সাপ্লি! কিছু ছেলে অনেক বছর ধরে সাপ্লি ক্লিয়ার করতেই থাকত। সেই দেবল আজ লেকচারার। এরকম আরও কত কে।
সেসব তখন তো জানা ছিল না। মিছিলে হাঁটা, হাত মুঠো করে ওপরে তোলা এসব ওকে টানত না, বলা ভালো রিপেল করত।
আর প্রেম? তারও তো দুটো বড় বাধা ছিল। বাবা এখানকার অধ্যাপক, তাঁর উপস্থিতি তো বটেই। তাছাড়া এটা স্বতঃসিদ্ধ ছিল যে ইঞ্জিনিয়ারিংর ছেলেরা আর্টসের মেয়েদের সঙ্গে প্রেম করবে। ফ্যাশনে ইঞ্জিনিয়ারিংর মেয়েরা তো পিছিয়ে।তারা শুধুই পড়াশোনা করে, আর কিছুই জানে না। অন্তত তখন তাই ছিল।
তাই ইউনিভার্সিটি ফেস্টে ক্ষণে ক্ষণে যে প্রেমের মুকুল ফুটত, তার নব্বই ভাগই আর্টসের মেয়ে আর ইঞ্জিনিয়ারিংর ছেলেদের মধ্যে। আর্টসের ছেলে আর ইঞ্জিনিয়ারিং-র মেয়েরা ছিল ব্রাত্য। এইরকম এক মাতাল বসন্ত সন্ধেয় ওপেন এয়ার থিয়েটারে সুমনের (তখন চট্টো) গান শুনতে শুনতে দোলন দেখেছিল তাদের ডিপের দু বছরের সিনিয়র প্রদীপ্ত তার দিকে গাঢ় চোখে তাকিয়ে। শেষ পর্যন্ত আমি তোমাকে চাই। সেরকম যদি না হত, তাহলে, তাহলে হয়তো আজ তাকে রোজ এত নার্ভ ঠান্ডা করার ওষুধ খেতে হত না।তবুও, এমনি ছোটখাটো কারণেও যদি কখনো দুজনে আলাদা হয়ে যাবার কথা ভেবেছে মাঝে মাঝে, তখন অবধারিতভাবেই তাদের মাঝে এসে দাঁড়াতেন সুমন।
এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই
ডাইনে ও বাঁয়ে আমি তোমাকে চাই
সুমন তো ডাইনেই চলে গেলেন।তাঁর ‘তোমাকে’ও তো একজন নয়, তবু দোলন আর প্রদীপ্তর ভেতর সেই গানের আকুতিটা, খুব চাপা পড়া হলেও, আছে । টের পায় দোলন। যদিও কতদিন ওদের শরীর পাশাপাশি শুলেও স্পর্শ করে না পরস্পরকে।পোশাক খুলতে গেলেই দোলনের মনে পড়ে সেই কমিটি রুম নম্বর টু, ধাতব কণ্ঠস্বর ‘পুট অফফ ইউয়োর ক্লোথস’ ওর সব ইচ্ছে যেন ওই ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে বাঁধা পড়ে গেছে।
(ক্রমশ)