সমীর দে রায়-এর কবিতা

সোজা পথের ধাঁধা
আলোর দিকে তাকাই, চোখ ধাঁধিয়ে যায়
সেই আলো যখন ঠিকরে পড়ে ঘাস-হিমে
হেমন্ত-সকালের ধানভরা হরিৎ প্রান্তরে
তখন অবাক হয়ে দেখি।
যে রাস্তা সোজা গেছে নদীর দিকে
তার থেকে বেড়িয়ে আসা ছোট ছোট আলপথ
ছড়িয়ে ছিটিয়ে চলে গেছে এপাশ-ওপাশ
এগারো বিঘের মাঠে, বাঁশঝাড়ের ছায়ায়, হরি বিলের পাশে
তারপর আবার ফিরে আসা—মিশছে নদীতে।
সেখানে সূর্যোদয়ের ঝলকানি চলকে উঠছে ঢেউয়ে
নদীর জলে ঝলসে উঠছে চোখ,
কোথায় রাস্তা—হন্যে হয়ে খুঁজি।
ভিটেমাটি
কঞ্চি দড়, শুধু খসে পড়ে মাটি—
ছিটেবেড়া দিয়ে ফেরে
ফালাফালা সূর্যালোক,ছেঁড়া হাওয়া, গাজনের গান
কে ছিলে কোথায় ছিলে কেন ছিলে তুমি
কোন হিমঘর থেকে আজ
ছাইভস্ম মেখে উঠে এলে অরণ্য-হাওয়ায়—
দাওয়ার উনুনে পোড়ে ঝরাপাতা,আধ-সেদ্ধ ভাত
ঘাটের কেত্তন ফুঁড়ে তিনসন্ধে—বেজে ওঠে শাঁখ
নিয়তিনিয়ন্ত্রিত সুখ ক্ষণিকের
চোখদুটি সচকিতে চকচক করে—
ফেলে-আসা নিভৃত তুলসীতলা
উঠোনে অক্ষয় মঞ্চ আজ বুঝি নিষ্প্রদীপ একা
এইভাবে দিনরাত্রি—
মাঝরাতে বাঁখারির চালে
চাঁদ ও নক্ষত্ররাজি করাতচিহ্ন এঁকে যায়
সান্ধ্যস্নান
কোথাও় যাবো না আর
ফুল ফুটবে, বসে দেখব একা
চাঁদ উঠবে বারান্দায়
প্রাণখোলা হাসির মতন
ঘরের স্তব্ধতা আজ
ঝনঝন শব্দ করে বেজে উঠবে
পাকদণ্ডী বেয়ে উঠবে অন্ধকার
গন্ধ তার–কৃষ্ণচাঁপা ফুল।
কুবোপক্ষী ডেকে উঠবে কুবকুব
নিশ্চুপ হাওয়ায় তার তান ভাসবে
চাঁদনৌকো ভেসে যাবে দরিয়ায়
খই ফুটবে তারাদের, বসে দেখব একা
সার ও সারাৎসার
কাল রাতে সার ও সারাৎসার নিয়ে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সেই ভাবনায় আজ আবার দিন শুরু করলাম।
সকালটা বেশ, একটা ভালোলাগা ভর করে আছে নেশার মতন। রাস্তা থেকে মাঠে নেমে আলপথ ধরে হাঁটছি ঘন কুয়াশার মধ্যে। আলুবাড়িতে জল ছিঁচ হয়েছে সদ্য, প্যান্টে কাদা লাগছে, কোথায় যে যেতে চাই কে জানে। ওই দূরেই কি সারাৎসারের হদিশ? কুয়াশা ছিঁড়ে ছিঁড়ে দূরে সরছে, প্রভাতী আলোর আভায় দূরে তালগাছের সারি, সর্ষেক্ষেত, দিগন্তের চলচ্চিত্র কাছে সরে সরে আসছে ক্রমশ।
হঠাৎ চমকে দেখি একটা নিস্তেজ শাঁখামুটি কুণ্ডলী পাকিয়ে আলপথে শুয়ে রোদ পোয়ানোর অপেক্ষায়। পদশব্দে নড়েচড়ে মাথা তুলছে। আঁত্কে পিছন ফিরে ছুট, হাঁফাতে হাঁফাতে রাস্তার কাছে আসি, দোকানের হরিপদ হাত ধরে তোলে, বেঞ্চিতে বসায়।
রোদ উঠছে। আবার ওদিক পানেই তাকালাম, সার ও সারাৎসার আরও দূরে, নিঃশব্দে মিলিয়ে যাচ্ছে দিগন্তে।