
আলোক ধনওয়ার কবিতা
ভূমিকা ও অনুবাদ — বেবী সাউ
আলোক ধনওয়া ২ জুলাই, ১৯৪৮ সালে বিহারের মুঙ্গের, বেলবিহমায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রথম কবিতা 'জনতা কা আদমি' ১৯৭২ সালে 'বাম' ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। একই বছর 'ফিলহাল' পত্রিকায় 'গলি দাগো পোস্টার' কবিতাটি প্রকাশিত হয়। এই দুটি কবিতাই দেশের বামপন্থী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রধান কবিতা হয়ে ওঠে এবং আলোক ধনওয়া বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং পাঞ্জাবের লেখক সংগঠনগুলির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত হন। ১৯৭৩ সালে শহীদ পাঞ্জাবি কবি অবতার সিং -এর জন্য 'পাশ'-এর গ্রাম তালওয়ান্দি সালেমের কাছে একটি সাংস্কৃতিক অভিযান শুরু করেন। আলোক ধনওয়া গ্রেপ্তার হন। অবশ্য তাড়াতাড়ি মুক্তিও পেয়ে যান। গত চার-পাঁচ দশক ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে সক্রিয় রয়েছেন তিনি। তিনি ছোটনাগপুর এবং শিল্প শহর জামশেদপুরে স্টাডি সার্কেল পরিচালনা করেন এবং থিয়েটার ও সাহিত্যের উপর বিভিন্ন জাতীয় প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি বক্তা হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি প্রগতিশীল লেখক সমিতি, জনবাদী লেখক সমিতি এবং জন সংস্কৃতি মঞ্চের অনুষ্ঠানেও সক্রিয় ছিলেন। মহাত্মা গান্ধী ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ওয়ার্ধা, রাইটার-ইন-রেজিডেন্স হিসেবে থাকেন । তিনি ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তিনি 'বিহার সঙ্গীত নাটক একাডেমি'-এর সভাপতি হিসেবে যোগদান করেন। তাঁর প্রথম কাব্য সংকলন 'দুনিয়া রোজ বনতি হ্যায়' ১৯৯৮ সালে রাজকমল প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়। 'কপড়ে কে জুতে', 'পতঙ্গ', 'ভাগি হুই লড়কিয়াঁ', 'ব্রুনো কি বেটিয়াঁ' এবং 'সফেদ রাত'-এর মতো বেশ কয়েকটি কবিতা হিন্দি ও অন্যান্য ভাষায় ব্যাপক সাড়া ফেলে এবং আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। 'মুলাকাতে' তার দ্বিতীয় কাব্য সংকলন। তাঁর কবিতা ইংরেজি এবং প্রায় সমস্ত ভারতীয় ভাষায় অনুদিত হয়েছে। তিনি পহল সম্মান, নাগার্জুন সম্মান, ফিরাক গোরখপুরী সম্মান, গিরিজা কুমার মাথুর সম্মান, ভবানীপ্রসাদ মিশ্র স্মৃতি সম্মান, প্রকাশ জৈন স্মৃতি সম্মান, বেনারসি প্রসাদ ভোজপুরী সম্মান, রাহুল সম্মান এবং বিহার জাতীয় ভাষা পরিষদের বিশেষ সাহিত্য পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছেন। পাটনা নিবাসী কবি আলোক ধনওয়ার কবিতায় আমরা পাই সমাজ, ব্যক্তি, প্রকৃতি এক আশ্চর্য মেলবন্ধন। তিনি তাঁর অপার কাব্যিক কুশলতা, ভাষা নির্বাচন, সময়চেতনা, সামাজিক ও রাজনৈতিক মনোভাবের সঙ্গে তা সম্ভব করে তুলেছেন। নির্বাসিত ও নষ্ট সময়ের এক আশ্চর্য দলিল হয়ে ওঠে তাঁর কবিতাগুলো। একেকবার মনে হয় তাঁর জন্য কবিতা যেন সব জায়গায় অপেক্ষা করছে; যেমন- জলের ভেতর, অশ্রুকণায়, শিশুদের মধ্যে, গায়কের গানে, যুদ্ধক্ষেত্রে, নারী কিংবা বৃক্ষরাজির মধ্যেও। অনূদিত নিম্নোক্ত কবিতাগুলো তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'মুলাকাতে' থেকে নেওয়া হয়েছে। এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোতে আমরা পাই প্রকৃতি, জীবন, জনজাতি, উত্তাল প্রেম, বিরহ, সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া এবং বিরাট এক সময়ের চালচিত্র। এই সংকলনে অন্তর্ভুক্ত কবিতাগুলি আরও স্বচ্ছভাবে প্রকৃতি, মানুষ, রাষ্ট্র এবং বিশ্বের প্রতি তাঁর আবেগপ্রবণ ভালবাসা এবং সময়ের প্রতি তার মতবিরোধ ও সমালোচনাকে ফুটিয়ে তোলে। তাঁর কবিতা ছিল অনেকাংশে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও আত্মঘাতী। সমাজে নির্বাসিত বৈজ্ঞানিক আদর্শের পুনর্গঠন রয়েছে। তার কাছে দেশ ও সমাজ শুধু ধারণা নয়, এগুলি কংক্রিট এবং জীবন্ত সত্তা যা স্পর্শ করে অনুভব করা যায়, তবেই তিনি ফাঁসির মঞ্চের দিকে অগ্রসর হয়ে বিভিন্ন ভাষায় কথা বলতে গিয়ে শহীদদের উদ্বেগ অনুভব করতে সক্ষম হন, নিষ্ঠুরতার সামন্তের দুর্গ ভাঙেন। আজকের ক্রমবর্ধমান যুবশক্তিতে আমরা 'কিছুটা বেশি ভারত'কে চিনতে পারি। দেশভাগ আজও তাদের পীড়া দেয়। তিনি বলেছেন- "ভারত ভাগ না হলে আমরা আরও ভালো কবি হতাম, বারবার বারুদ দিয়ে পুড়তাম, হত্যার মাঠ পেরিয়ে, আমরা বিড়ম্বনার কবি হতাম।" নীচে অনূদিত কবিতাগুলো সরাসরি হিন্দি ভাষা থেকে অনুবাদ করা হয়েছে।
আলোক ধনওয়ার কবিতা
*নিজের কথা
কতদিন হল রাত আসছে
যাচ্ছে পৃথিবীতে
তাও তাকে দেখা
তার সঙ্গে থাকা মনে হয় কত অদ্ভুত!
মানে এই যে আমি
নিজের কথা বলছি।
*নদী
ইছামতী এবং মেঘনা
মহানন্দা
ইরাবতী এবং ঝিলম
গঙ্গা গোদাবরী
নর্মদা এবং ঘাঘরা
নাম নেওয়াও যায় না এত
এদের সঙ্গে কতবার দেখা হয়
যত বার তারা আসে রাস্তায়
এবং ওই সময়ও কত কম
কাছাকাছি যেতে পারে মন
মাথা তো ভরে থাকে
লুটেরা বাজারের চিৎকারে।
*ঘুম
রাতের পাগল পথিক
আমার আত্মার পাশেও খানিক থেকো
আমাকে দাও এমন ঘুম
যেখানে একটা তৃণও চাপে না থাকে
এমন ঘুম
যেন চাঁদের পিঠে জলের ঘাস
*রেল
সব ভালো মানুষের একটি রেলগাড়ি আছে
যেটা মায়ের ঘরের দিকে যায়
হর্ন বাজিয়ে
ধুঁয়ো উড়িয়ে।
*শরীর
যুগ যুগ ধরে নারী রচনা করেছেন যাকে
যুগের অন্ধকারে নিজের সেই একান্ত শরীর
আজ আমি চলেছি
খুঁজতে
নিজের শরীরে।