Novel- সুবর্ণরেখার তীরে / অষ্টম ও নবম পর্ব
ছন্দা বিশ্বাস

অষ্টম পর্ব

এই জায়গায় এসে সোম খুবই আশ্চর্য হল। প্রায় তিন ক্রোশ পথ সে অতিক্রম করে এসেছে। আরো বেশ কিছু পথ চলার পরে সে এই স্থানে এল। বেলা শেষ হয়ে আঁধার নেমেছে বেশ কিছুটা আগেই। অচেনা জনপদ, অজানা পথে না জানি কত বিপদ ওৎ পেতে থাকে। তাই আর বেশি দূর এগোনো ঠিক হবে না মনস্থির করল সে। রাতট আএক জায়গায় কাটাতে হবে। কিন্তু উপযুক্ত জায়গা সে দেখতে পেল না। তাই সে আবার পথ চলতে শুরু করল।

পথ চলতে চলতে এক সময় অন্ধকারের ভিতরে দূরে আলো দেখতে পেল। উজ্জ্বল না হলেও স্পষ্ট নজরে পড়ছে। বেশ কিছু বাতি জ্বলছে দেখে মনে আশার সঞ্চার হল।

সেই আলোর দিকে এগিয়ে যেতেই পথের পাশে একটা সরাই খানা নজরে পড়ল। রাত্রি দ্বিতীয় প্রহরের দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে। অপরিচিত জায়গায় পথ চলা ঠিক হবে না মনে করে আজ রাতটা সে এই সরাইখানাতে কাটাবে মনস্থির করল।

সরাইখানাতে এসে বেশ কিছু মানুষের দেখা পেল। সকলেই পথিক নয়, কিছু সরাইখানার কর্মচারী আর কিছু তার মতো আগন্তুক। কয়েকজন যে এর আগে এ স্থানে এসেছে সেট আতাদের আচার আচরণ এবং কথার ভিতরে প্রকাশ পেল। সোম অদূরে একট আতেপাই এর উপরে বসে এই সমস্ত কিছু নিরীক্ষণ করছিল। এদের কাছ থেকে সে অনেক কথা জানতে পারল। এর আগে সে লোক মারফত এই সিংভুম অঞ্চলের নানা কাহিনি শুনেছে।

এবারে সরাইখানার কর্মচারীদের সঙ্গে গল্প করতে করতে একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর সঙ্গে সোমের পরিচয় হল।

সোমদেব সেই সন্ন্যাসীর মুখে শুনলেন এক রোমহর্ষক কাহিনি।

পনের

মানভূম -ধলভূম

জায়গাটি ভারী অদ্ভুত। দূর থেকে চোখে পড়ল সোমদেবের। ঢেউ খেলানো এক মালভূমি। ভূমি থেকে বেশ কিছুটা উপরে দিকে উঠে গিয়ে গিয়েছে। কিছুটা ঢেউ খেলানো এবং তারপরে আবার সমতল। ভূমিরূপ মালভূমি আকৃতির। ধাপে ধাপে উপরের দিকে উঠে গেছে শাল- শিরিষ- মহুয়া- পলাশ ইত্যাদি বৃক্ষসকল।নীচেয় লতাগুল্মাদি জড়াজড়ি করে অবস্থান করছে। দিনের বেলাতেও সেই পাতার অর্গল ভেদ করে সূর্যরশ্মি প্রবেশ করতে বাধা পায়। এমনি গভীর আর নিরেট সেই বনভূমি। জঙ্গলে কিছু নবীন বৃক্ষ, বাকীগুলো বহু প্রাচীন। জঙ্গলে পরিকীর্ণ অধিকাংশ অঞ্চল।

স্থানীয় মানুষের মুখে মুখে জায়গাটির নাম হয়ে যায় জঙ্গল মহল বা ঝাড় খন্ড। ‘ঝাড়’ শব্দের অর্থ জঙ্গল এবং ‘ খন্ড’ অর্থাৎ প্রদেশ বা মহল। সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে এই অঞ্চল নানা খনিজে সমৃদ্ধ ছিল। বিভিন্ন ধরণের পাথরের জিনিস আবিষ্কৃত হয়েছে মধ্য প্রস্তর যুগ এমনকি পুরাতন প্রস্তর যুগের। ছোট নাগপুর মালভুমি দ্বারা বেষ্টিত এই অঞ্চল। চালকোলিথিক যুগের বহু নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছিল এক সময়ে। বহুকাল আগে হাজারিবাগ, পালামৌ জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে এইসব মনোলিথ মেগালিথিক জিনিসপত্র দেখা যেত। শোন এবং কোয়েল নদীর আশেপাশে ছিল বিভিন্ন পুরাকীর্তি সমূহ। তারপরে এল লৌহ যুগ। ইতিহাস বলে খৃস্টপূর্ব ১২০০ সাল থেলে ১০০০ সালের ভিতরে আর্যরা গাঙ্গেয় সমভূমিতে ছড়িয়ে পড়েছিল। তারা সেই সময়ে লোহার জিনিস্পত্র ব্যবহার করতেন। সেই লোহার তৈরি জিনিস দিয়ে তারা এই ঘন জঙ্গল সাফ করে বসবাস করতে শুরু করে দিল। আস্তে আস্তে ইন্দো- আর্য সংস্কৃতির আধিপত্য দেখা গেল এই কেন্দ্রীয় গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে।

সোমদেব আরো কয়েক ক্রোশ পথ অতিক্রম করে এক জায়গায় উপস্থিত হল। একদিন রাতে এসে সেই স্থানে পৌঁছাল। দুইদিকে ঘন জঙ্গলে পূর্ণ। অচেনা অজানা জায়গা কেমন হবে, এই বনের চরিত্র কীরূপ, হিংস্র জন্তু জানয়ারের বাসভুমি বলেই মনে হচ্ছে। সুতরাং আর বেশী দূর এগোন সম্ভব নয় মনে করল। সেদিন পথ পার্শ্বে একটা সরাইখানা দেখতে পেয়ে সেদিকে এগিয়ে গেল।

পাথুরে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা সেই সরাইইখানায় দ্বাররক্ষী ছিল। তার সঙ্গে কতাহ বলে সে রাতটা সেখানেই আশ্রয় নিয়েছিল। সরাইখানাতে আরো অনেক মানুষ ছিল। সেটা বুঝতে পারল আস্তাবলে ঘোড়াগুলোকে দেখে। ঘোড়াগুলোকে সরাইখানাতেই এক দিকে একটা বেশ উঁচু ছাউনি মতো করে দেওয়া আছে। সেখানে গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখেছে। দানা পানি দেওয়া হয়েছে। সেগুলো তারা খাচ্ছে।

সোম লক্ষ্য করল সরাইখানাতে ঘোড়াদের খাবার দাবার দেখাশুনা করার জন্যে আলাদা লোক রাখা ছিল।

সে পথ চলতে চলতে খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। কত শত মাইল অতিক্রম করে অবশেষে এসে পৌঁছাল।

পথশ্রমে এমন ক্লান্ত সে ইতিপূর্বে কখনো হয়নি।

সরাইখানাটি সমতল থেকে কিছুটা উঁচুতে অবস্থিত। উপর থেকে বহুদূর অবধি দেখা যায়। রাতে নগরীতে দীপ জ্বালা দেখে অনুমান করল এটাই বোধ হয় মল্ল রাজাদের রাজধানী। ঘন অন্ধকারের ভিতরে প্রজ্জ্বলিত দীপশিখা দেখে সোমদেবের যাত্রা পথের কষ্ট ভয় দ্বিধা দ্বন্দ দূর হয়ে গেল।

সে রাতে সোমদেবের মন এক অজানা কারণে পুলকিত রইল। কখনো কখনো আনন্দের কিছু কিছু কারণ অজ্ঞাত থেকে যায়। মন নিজেই জানে না সত্যিটা কী। অথচ হৃদয় কীভাবে যেন হর্ষোৎফুল্ল হয়ে পড়ে।

এই সরাইখানাটা নগরের বাইরে অবস্থিত। আগামীকাল সোমদেব নগরীতে প্রবেশ করবে। বিকেলে সূর্যাস্তের পর পরেই নগরীর মূল প্রবেশদ্বার বন্ধ হয়ে যায়। সে কারণে প্রধান ফটক থেকে সামান্য কিছু দূরে সরাইখানাতে আশ্রয় নিতে হল। পথে কিছু বিলম্ব হয়েছিল। একটা সমস্যায় জড়িয়ে পড়েছিল যার জন্যে সোমদেব বিন্দুমাত্র প্রস্তুত ছিল না। হরেক দেশের হরেক রীতিনীতি। মানুষের আচার বিচার এক একে রকমের। এতো বড়ো একটা দেশ সেখানে কত ধরণের মানুষের বাস। ভিন্ন তাদের লোকাচার। সোমদেব পথে বের হওয়ায় কত না অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে। এবারের ঘটনাটা বেশ চমকপ্রদ। সে কাহিনি পরে কখনো শোনানো যাবে।

সোমদেব লোক মুখে নানা গল্প কাহিনি শুনেছে এই সিংভূম সম্মন্ধে। শুনেছে এখানে বহু মঠ চৈত্য বিহার বর্তমান। এখানকার মানুষগুলো বেশীর ভাগই ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মালম্বী। পরে হিন্দু ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের সঙ্গে বৌদ্ধদের গোলমাল বেঁধে যায়। হিন্দুরা ব্রাহ্মণেরা রাজ অনুগ্রহ লাভ করায় ক্রমে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারতা কমে যেতে থাকে। পাল রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মালম্বী। সেই সময়ে বৌদ্ধরা রাজ অনুগ্রহ লাভ করেছিলেন। তৎকালিন সময়ে এই সকল বৈদ্ধ মঠ চৈত্য নির্মান করা হয়েছিল। পরবর্তী কালে এলেন সেন রাজারা। সেন রাজারা ছিলেন শৈব মতাবলম্বী। তাদের সময়ে হিন্দু ধর্ম ক্রমে প্রাধান্য লাভ লাভ করে। বৌদ্ধধর্ম আস্তে আস্তে গুটিয়ে আসে।

এরপরেই এলো তুর্কিরা। ধ্বংস যজ্ঞে মেতে উঠল বখতিয়ার। প্রথমে বিহার তারপরে বাংলা জয় করল। সোমদেব লোক মুখে জেনেছে এই মানভূম- ধলভূম অঞ্চল যেমন প্রাকৃতিক সম্পদে পূর্ণ তেমনি আছে নানা স্থাপত্য সমূহ। বৌদ্ধ স্থাপত্য অধিকাংশই। বর্তমানে এই অঞ্চলের শাসক হলেন হিন্দু রাজা। তিনি পরধর্ম সহিষ্ণু। নচেৎ তার রাজ্যে এতো মঠ চৈত্য বিহার গড়ে উঠত না।

আর বৌদ্ধ শ্রমণেরা নির্ভয়ে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াতে পারতেন না।

সোমদেব সরাইখানাতে আহার করার সময়ে এখানকার কর্মচারীদের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে ফেলল। সোমদেবের মানুষের সঙ্গে মেশার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। তার চেহারার ভিতরে এমন আকর্ষণ ক্ষমতা আছে যার জন্যে অচেনা ভাষা অচিন দেশের মানুষ হয়েও সে সকলের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠতে পারে। রাতে খাবার পরে দুইজন কর্মচারী তার কাছে এলো। সামনের প্রশস্ত চাতালে দাঁড়িয়ে তারা কথা বার্তা বলতে লাগল। তবে তাদের দুই পক্ষের বুঝতে অসুবিধা হল না। কারণ এই সরাইখানাতে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গার মানুষের যাতায়াত আছে। সিংভূমের উপর দিয়ে যে সড়ক চলে গেছে সেই সড়ক পথে আসা যাওয়া করেন ভিন রাজ্যের ব্যবসায়ীরা। তারা প্রায় সকলেই রাত্রে এখানেই কাটায়। সরাই খানাটি দ্বিতল বিশিষ্ট। উপরের তলে বিত্তশালী ব্যক্তিদের জন্যে বিশেষ ব্যবস্থা আছে। সুরা নারী গীত বাদ্য কোনো কিছুরই অভাব নেই।

যুবক দুইজনের মুখ থেকে সোমদেব জানতে পারল বহু পন্ডিত ব্যক্তির আশ্রয়স্থল এই রাজ্য। যুগ যুগ ধরে কত পন্ডিত প্রবর এই সমস্ত রাজ রাজাদের আশ্রয়ে থেকেছেন। এই দেশ এই সব জায়গায় ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন তথ্য আহরণ করে সেগুলি আবার লিখে রেখেছেন। যুগে যুগে এই মহান দেশের কত না গৌরব গাঁথা লেখা হয়েছে। সোমদেবের মনে হল যুবক দুইজন সরাইখানাতে কাজ করলেও তাদের অভিজ্ঞতা প্রচুর। বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে মিশে কথাবার্তা বলে তাদের জ্ঞানের ভান্ডার ঋদ্ধ করেছে। সে আরো জানতে পারল এই নগরীর রাজার অতীব সুন্দরী এক রাজকন্যা আছে। পরীর মতো সুন্দরী সেই রাজকন্যা। প্রতিবছর রাজকন্যার জন্মদিন মহা ধূমধামে পালিত হয়। তখন নগরীর যত অনাথ আতুরজন আছে সকলের খাবারে ব্যবস্থা করেন রাজা মশায়। সেইদিন নগরীর কোনো একজন মানুষ যেন অনাহারে না থাকেন এমনই তাঁর নির্দেশ।

কবে সেই দিনটা?

সোমদেবের কৌতুহল হল জানার জন্যে। মনে মনে ভাবল, এই একটা দিন সে হয়ত চেষ্টা করলে সেই অসামান্য রূপবতী রাজকন্যার দেখা পেলেও পেতে পারে। সোমদেব সদ্য যুবা। তার পক্ষে এমন কৌতুহল স্বাভাবিক। যুবক দুজনেই এ অঞ্চলের আদি বাসিন্দা। এই ধলভূম মানভূম অঞ্চল গোন্দ, সাঁওতাল, ভিল ইত্যাদি আদিবাসীদের প্রাচীন বাসভূমি। দলমা পাহাড় পূর্ব- পশ্চিম দিক বেষ্টন করে আছে। আর উত্তর দিক গভীর জঙ্গলে পূর্ণ। তাই এই অঞ্চল বহুকাল লোকচক্ষুর আড়ালে ছিল। বাইরের শত্রুরা বহুকাল অবধি জানতেও পারে নি এই অঞ্চলের কথা। সুবর্ণরেখা নদী এই অঞ্চলের মানুষের জীবন রেখা। সোমদেব এদের সঙ্গে কথা বলে অনেক তথ্য পেল। এই সুবর্ণরেখা নদীর বালিতে মিশে থাকে সোনা। এই অঞ্চলের আদিবাসীরা সে সোনা আহরণ করে।

কথা বলতে বলতে অনেক রাত হয়ে গেল।

সোমদেব শুনতে পাচ্ছে দোতলার কোনো এক গৃহ থেকে সুন্দর এক সুর ভেসে আসছে। অনেক রাত পর্যন্ত সে শুয়ে শুয়ে সেই গীতধ্বনি শ্রবণ করতে করতে এক সময়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

ষোলো

উত্তরের বৌদ্ধ গুম্ফা থেকে আগত সন্ন্যাসী

সোমদেবের সে রাতে কিছুতেই ঘুম আসছিল না। এক অজানা শংকা ঠিক নয় তবু এক মানসিক অস্থিরতা তাকে কিছুতেই স্বস্তি দিচ্ছিল না। যে ঘরটাতে সেয়া শ্রয় নিয়েছে সেটিও বৃহৎ কোনো কক্ষ নয় যে তার ভিতরে হেঁটেচলে মনের অস্থিরতা দূর করতে পারবে। স্বল্প পরিসরে তার মানসিক উদবেগ আরো বাড়তে লাগল।

সামনের দিঙ্গুলো কেমন হতে চলেছে সে ব্যাপারে যেন সে এই মুহূর্তে ব্যাকুল হয়ে পড়েছে।

কিন্তু সে তো কখনো এমন উদবেল চিত্তের ছিল না। অল্প বয়েস থেকেই সে জিবিকার সন্ধানে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াত বলে ছোট থেকেই বহু মানুষের সান্নিধ্যে যেমন আসতে পেরেছে তেমনি বিভিন্ন জায়গা সম্মন্ধে নানা অভিজ্ঞতায় পূর্ণ হয়েছে তার ঝুলি। তাই হঠাৎ কোনো কিছুইতে সে ব্যতিব্যস্ত বা ব্যাকুল হয় নি।

সে চিন্তামুক্ত হয়ে নিশ্চিন্তে শুয়ে থাকতে না পেরে শয্যাত্যাগ করে বাইরে এসে দাঁড়াল।

সরাইখানার বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই সে মুগ্ধ হয়ে গেল। আকাশ চোয়ান ধবল জ্যোৎস্না। এমন জ্যোৎস্নায় প্লাবিত চরাচর বহুদিন সে দেখেনি। দূরে ঢেউ খেলানো অনুচ্চ পাহাড় শ্রেণী। চারিদিক অপূর্ব শান্ত মহিমা বিরাজ করছে। এই নিস্তব্ধতার নিজস্ব এক ছন্দ নিজস্ব এক ভাষা আছে। নিরুচ্চারিত অথচ হৃদয়গ্রাহী সেই ভাষার এমনি আকর্ষণীয় ক্ষমতা আছে যে তাকে কিছুতেই অস্বীকার করতে পারছে না। আর পারছে না বলেই এই রাতে তাকে গাহড় ধরে শয্যা থেকে টেনে বাইরে নিয়ে এসেছে। মনে হচ্ছে আকাশটা বুঝি তার মাথার উপরে অনেকটা নেমে এসেছে। পূর্ণ চন্দ্র থেকে গলানো রুপোর ঝরোখা ঝুলে আছে। নৈশ প্রকৃতি যেন কিছু বলতে চায়।

প্রশস্ত চাতালের দিকে নজর পড়তেই সে দেখল একজন সন্ন্যাসী হেঁটে বেড়াচ্ছেন চাতালের উপরে।

শান্ত অথচ দৃঢ়তা তাঁর চলার ছন্দে ধরা পড়ছে। প্রতিটা পদক্ষেপ যেন তিনি সুচিন্তিতভাবে ফেলছেন। দীর্ঘদেহী সুপুরুষ সন্ন্যাসীর হাত দুটো পিছনের দিকে ধরা আছে। সামান্য সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন।

দেখে মনে হল তিনি খুবই চিন্তিত।

মধ্য রাত্রি পেরিয়ে চতুর্থ যাম উপস্থিত। চন্দ্রদেব এখন কিছুটা পশ্চিমে হেলে পড়েছে। সন্ন্যাসীর অস্থির পদচারণা দেখে সোমদেব বুঝতে পারল সন্ন্যাসী আসন্ন কোনো বিপদের আগাম আঁচ পেয়েছেন। তাতেই তিনি বিভ্রান্ত। চিন্তিত, কিছুটা হলেও শঙ্কিত। চাঁদের স্তিমিত আলোয় তার মুখমন্ডল স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। বড়ো মায়াময়। কাষায় বস্ত্র পরিধানে। মুন্ডিত মস্তক। তাকে দেখে সে নিশ্চিত হল ইনি কোনো বৌদ্ধ সন্ন্যাসী।

এ যাবৎ সোমদেবের সঙ্গে বহু সাধু পুরুষের আলাপ পরিচয় হয়েছে।

সোমদেব ধীর পায়ে নেমে এসে দাঁড়াল সন্ন্যাসীর পিছনে। সন্ন্যাসী ঘাড় ঘুরিয়ে মৃদু কন্ঠে বল্লেন,”বৎস!”

সোমদেব এর ভিতরে সংস্কৃত ভাষাটা সামান্য কিছুটা রপ্ত করতে পেরেছে। সে ভাঙ্গা ভাঙ্গা সংস্কৃতে বলল, আপনি মনে হচ্ছে খুবই চিন্তিত?

তুমি অতিশয় বুদ্ধিমান। ঠিকই ধরেছ।

জানতে পারি কী তার হেতু?

সন্ন্যাসী সোমদেবকে বল্লেন বখতিয়ার বিহার জয় করতে এসে মগধের উপরে কী পরিমাণ ধ্বংস লীলা চালিয়েছে। লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুদেরকে নির্বিচারে হত্যা করেছে। রাজপথের ধুলো রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। গঙ্গায় ভাসছে অগণিত মৃতদেহ। এক সময়ে এতদ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে ছিলেন স্বয়ং দেব তথাগত। কাশী- কোশল- মগধ পাঞ্চাল ছাড়াও বাংলা, বিহার, উৎকলে বৌদ্ধদের বিহার-সংঘারাম চৈত্য ছিল হাজার হাজার। মুসলিম শাসকেরা সে সব ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছে। বল পূর্বক মানুষদেরকে ধর্মান্তরিত করছে। ভয়ে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা পালিয়ে চলে গেছে নেপাল,চীন নয়তো তিব্বতে।

সোমদেব শিহরিত হল সন্ন্যাসীর কথা শুনে।

সন্ন্যাসী বল্লেন, তিনি আসছেন নেপাল থেকে। উত্তর প্রদেশ পার হয়েই তিনি শুনতে পেয়েছিন এই ধ্বংস লীলার কথা। জেনেছিলেন বখতিয়ারের চরেরা সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাই তিনি প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে লুকান পথ ধরে এখানে এসে পোঁছান। সেনারা সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে জানতে পেরে তিনি দিনের বেলায় লুকিয়ে থাকতেন এবং রাতের অন্ধকারে পথ চলতেন।

বিপদের কথা শুনে সেই রাতেই তিনি তার শিষ্যদেরকে নিয়ে অগ্রসর হলেন।

সোমদেব উপস্থিত হল এক জায়গায়। সে স্থানের নাম অন্তিচক। শান্তি পা, বাগেশ্বর কীর্তি, প্রজ্ঞাকরমতী ছিলেন দ্বার রক্ষকের দায়িত্বে। অভয় কর গুপ্ত, শ্রীভদ্র এরা ছিলেন আচার্য। বিশাল প্রাকার বিশিষ্ট এক বিহার।

সোমদেব লক্ষ্য করল প্রায় তিন মিটার প্রশস্ত প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত এই বিহার। ছয়খানা প্রবেশ দ্বারে দ্বার পাল দন্ডায়মান আছেন। ভিতরে অসংখ্য প্রকোষ্ঠ। প্রকোষ্ঠের ভিতরে উঁচু বেদিকা। সন্ন্যাসীদের বিশ্রাম কক্ষ এগুলো। সোমদেব জানতে পারল এখানে কয়েক শত সন্ন্যাসী সম্মিলিতভাবে জীবন যাপন করেন। পাল রাজ ধর্মপাল নির্মাণ করেছিলেন এই বিহার। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের আবাসস্থল ছিল এটি। সে আজ থেকে প্রায় চার শত বৎসরের বেশী। পাথরের গায়ে উৎকীর্ণ আছে তাঁর নাম। তাঁকে বলা হত, “বিক্রম শীলাদেব।” এই উপাধি রাজা গ্রহণ করেছিলেন।

সেই সময়ে তিনি অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞানের সংগে আলোচনা করে এই বিহার প্রতিষ্ঠা করেন।

সোম দেখল উত্তর দিকে লম্বা একটি কক্ষ। সেই কক্ষের দেওয়াল ছিল বেশ মোটা পুরু। কয়েক মিটার পুরু, পোড়া ইট দিয়ে বানানো। সেই দক্ষিণ দিকের দেওয়ালে কয়েক ফুট অন্তর চ্যানেলের মতো ঢালু সরু সরু ছিদ্র বিশেষ। বাতাস চলাচলের জন্যে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে বানানো। খুবই সংরক্ষিত এই অঞ্চল। তখনকার দিনে পন্ডিতেরা তালপাতার পুঁথির উপরে লিখে রাখতেন। যুগ যুগ ধরে সেই সমস্ত পান্ডুলিপি সযত্নে রাখার জন্যে এই প্রয়াস। যাতে তাল পাতার পুঁথিগুলি সযত্নে রক্ষিত থাকে। বায়ু চলাচলের পথ এটি। আর বাইরের লোক চক্ষুর আড়ালে রাখার জন্যে গোপন কক্ষ এটি। একটি সরু পথ ছিল ভিতরের কক্ষে প্রবেশ করার।

মূলতঃ দক্ষিণমুখী ছিল এই কক্ষটি। যাতে দখিনা বাতাস ভিতরের দিকেও বইতে পারে।

উত্তর দিকের বারান্দা প্রায় তিরিশ মিটার লম্বা।

চারটি বড়ো বড়ো কক্ষে ১০৮ জন সন্ন্যাসী লোকচক্ষুর অন্তরালে এই সকল পুঁথি লেখার কাজ করতেন। এখানে বিভিন্ন পুস্তকের অনুবাদকর্ম করা হতো। মহা বজ্রাসন এবং কমল কুলিশ ছিলেন তাদের ভিতরে অন্যতম। ধর্মীয় শিক্ষা এবং বুদ্ধি বৃত্তি চর্চার কেন্দ্র এটি।

এসব কাজ করা হতো খুবই সতর্কতার সঙ্গে এবং গোপনীয় ভাবে।

সেদিন সোমকে রাত্রিবাসের জন্যে গুম্ফার ভিতরে অথচ মূল প্রাঙ্গণের বাইরে একটি অতিথি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হল। সাধারণতঃ বাইরের কেউ এসে তাদের থাকার জন্যে এইসকল গৃহ নির্মান করা হয়েছিল। মূল বিহারে উপসম্পদা গ্রহণের আগে কেউই সেখানে বাস করতে পারে না।

রাতে আহারের পরে সন্ন্যাসী নিজেই এলেন সোমদেবের সঙ্গে কথা বলতে। উৎসাহী সোম সন্ন্যাসীর মুখে এই অঞ্চলের আরো বহু গল্প শুনলেন। সন্ন্যাসী বললেন, এইবার তোমাকে একটা রোমহর্ষক কাহিনি শোনাব।

সোমদেব গভীর মনযোগ সহকারে শুনতে লাগল সেই কাহিনি।

নবম পর্ব

সতের

ধ্বংস লীলা

পাহাড়ের নীচেয় এসে ঘোড়া থামালেন বখতিয়ার খলজী। পিছনে পাঁচশত সৈন্যের হাতের লাগামে টান পড়ল। অশ্বের গতি রোধ হল।

ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে এলেন বখতিয়ার। ঘাড় উঁচু করে তাকালেন। সামনেই অনুচ্চ পাহাড়। পাহাড়ের উপরে সর্পিলাকার প্রাকার দ্বারা পরিবেষ্টিত। দুর্গের ন্যায় প্রাকারের ভিতরে অট্টালিকা সমূহের কিঞ্চিৎমাত্র দৃশ্যমান। সুউচ্চ অট্টালিকার মাথার উপরে পত পত করে উড়ছিল একটি পতাকা। বখতিয়ার প্রধান সেনাপতির দিকে তাকিয়ে বল্লেন, এটাই কি সেই দুর্গ?

সেনাপতি মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ, জাহাঁপণা।

বখতিয়ারের দুই পাশে তখন দুইজন সেনাপতি এসে দাঁড়িয়েছেন। তার ডান হাত এবং বাম হাত হলেন এই দুইজন। যা কিছু সিদ্ধান্ত এবং পরিকল্পনা নেন তিনি এই দুইজন সেনাধ্যক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেন।

তার প্রধান সেনাপতি হলেন সুবাহদার আউলিয়া খান। এই স্থান আক্রমণের মূল ষড়যন্ত্রী। মগধে আসার পরে একজন অনুচরের মুখে শুনেছিলেন পাহাড় চূড়োতে এই দুর্গের কথা। এখানে নাকি শত শত বৎসর ধরে প্রচুর রত্নরাজী ধন দৌলত গচ্ছিত আছে। শোনামাত্র বখিতিয়ারের লোভাতুর চোখ দুটো সহস্র আলোক শিখার মতো দীপ্যমান হয়ে উঠল। মুহূর্ত্যের ভিতরে লুন্ঠনের স্বপ্নের বীজ রোপিত হল মনে। এটি লুন্ঠন না করা পর্যন্ত তার স্বস্তি নেই। আগেই তিনি মগধের বিশাল ধন সম্পদের কথা শুনেছেন। সেই সময়ে মগধ ছিল সমৃদ্ধশালী নগরী। বিভিন্ন লোক মারফৎ কানে আসতো মগধের নানা গল্প কাহিনি। তখন থেকেই বখতিয়ার পরিকল্পনা করেন বিহার জয়ের।

বখতিয়ার খবরটা শোনা মাত্র ছক কষতে শুরু করে দিলেন। সেনাপতি বল্লেন, একেবারে আঁটঘাট বেঁধে তবে নামতে হবে। যুদ্ধ তো একটা কৌশল মাত্র। সব কিছু জেনে বুঝে গুছিয়ে না নামলে অনেক সময় পরাজয়ের সম্ভাবনা থেকে যায়। তাছাড়া বিশাল আকারের এই হিন্দুস্থান দেশটা সম্মন্ধে ভাবতে গেলে বখতিয়ারের কেমন যেন ঘোর লেগে যায়। আলাদা ভূপ্রকৃতি, আলাদা জলবায়ু, অসংখ্য রাজা, রাজ্য । ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের বাসভূমি। সেই সব রাজ রাজাদের কার কত শক্তি তার পক্ষে আদৌ জানা সম্ভব নয়। তিনি বহিরাগত তাই এদেশের মানুষই ভরসা।

বহুদিন হল বখতিয়ার স্বদেশভূমি ত্যাগ করে এদেশে চলে এসেছেন। বখতিয়ার অবসরে তার ফেলে আসা জীবনের কথা ভাবেন। তিনি ছিলেন তুর্কি বংশোদ্ভূত একজন হত দরিদ্র পরিবারের সন্তান। দারিদ্র্যের যন্ত্রণা সইতে না পেরে একদিন বেরিয়ে পড়লেন। কাজের সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে একদিন এসে উপস্থিত হলেন মহম্মদ ঘুরির রাজধানীতে। যোগ দিলেন সেনা বাহিনীতে। কিন্তু সকলেই তাকে কু নজরে দেখতে লাগল। অনেকেই নানা উপহাস এবং বিদ্রুপ করতে লাগল। তার অতিশয় কুৎসিত চেহারা, বেঁটে -কালো, হাত দুটো ছিল বেজায় লম্বা। কান দুটো কুকুরের কানের মতো, চোখ কুত কুতে, বর্তুলাকার। এই কারণে তিনি উপহাসের পাত্র হয়ে উঠলেন। বুঝতে পারলেন এখানে তার উন্নতি সম্ভব নয়। এরপরে তিনি দারুণ যন্ত্রণা নিয়ে চলে আসেন কুতুবুদ্দিন আইবকের দরবারে। এখানেও তাকে কেউ বিশেষ সমাদর তো দূরে থাকুক পাত্তা পর্যন্ত দিলে না। মনক্ষুণ্ণ হয়ে তিনি এবারে বদাউনে গেলেন। সেখানকার শাসন কর্তা ছিলেন হিজবর উদ্দিন। তিনি বখতিয়ারকে নগদ বেতনে তাঁর সেনা বাহিনীতে নিযুক্ত করলেন। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন না থাকায় কিছুদিন বাদে এ স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। এরপরে অযোধ্যায় এলে তৎকালীন শাসনকর্তা হুমাস উদ্দিন বখতিয়ারকে মির্জাপুর জেলার ভগবৎ আর ভিউলি জায়গীর প্রদান করলেন। বখতিয়ারের জীবনের নতুন অধ্যায় সূচিত হল। এটাই তার শক্তির মূল উৎস হলে তিনি আস্তে আস্তে তাঁর শক্তি বৃদ্ধিতে মন দিলেন। প্রায় দুই হাজার সেনা নিয়ে একদিন বেরিয়ে পড়লেন বিহার জয়ের উদ্দেশ্যে।

বখতিয়ার যাকে পাঠিয়েছিলেন সে ইতিমধ্যে অনেক খবরাখবর সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছে। আম গাছে ঘেরা সেই অঞ্চল। দুর্গের সামনে একটা বড়ো সড়ো পুষ্করিণী রয়েছে। একটা উঁচু আম গাছে উঠে দেখেও এসেছি, ভিতরে প্রাঙ্গণে বিশাল বড়ো দিঘি আছে। আর আছে মন্দির। ঠিক উল্টানো বাটির মতো।

আটটি বিভিন্ন মাপের অট্টালিকা রয়েছে। প্রত্যেক দ্বারে রয়েছে দ্বার রক্ষী। প্রচুর মানুষ কিল বিল করছে। সবই নেড়া ব্রাহ্মণ।

নেড়া ব্রাহ্মণ?

হ্যাঁ, মুন্ডিত মস্তক প্রত্যেকের।

অনুচরের কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলেন বখতিয়ার। মাথা নেড়ে বল্লেন, এই নেড়ি মুন্ডি ব্রাহ্মণেরা আমার গতি রোধ করবে কী করে বলো? কী শক্তি আছে এদের?

তা বলতে পারবো না। দেখে তো মনে হল সকলেই খুবই নিরীহ প্রকৃতির।

এই অঞ্চলের নামটা কী শুনি?

নালন্দা, জাহাপণা ।

নালন্দা!

হ্যাঁ, প্রকৃত নাম ছিল ‘ন আলম দা’।

বখতিয়ার শ্লেষ ভরা কন্ঠে নামটা উচ্চারণ করলেন।

অনুচর বল্লে, এক সময়ে এই গ্রামে শাক্যমুনি বুদ্ধ বাস করতেন। তিনি মানুষের ভিতরে ধন রত্ন সব কিছু অকাতরে বিলিয়ে দিতেন। এই ‘ন আলম দা’ এর অর্থ হল অকাতরে সব কিছু বিলিয়ে দেওয়া। অনেক আগে এই গ্রামের নাম ছিল নালক। এই নালক গ্রামে তাঁর মৃত্যু হয়। বুদ্ধের দান ধ্যান থেকে লোকমুখে এই জায়গার নাম হয়ে গেছে নালন্দা।

বখিতিয়ায় জেনেছেন এই জায়াগটি খুবই বর্ধিষ্ণু। নানা অভিজাত মানুষের বাস। মগধের রাজধানী রাজগৃহ বা রাজগীর থেকে মাত্র কয়েক ক্রোশ দূরে। একটা বাণিজ্য পথ চলে গেছে পাহাড়ের পাশ দিয়ে। পথের অবস্থা ভালোই।

বখিতয়ার দেখলেন পাহাড়ের উপরে আম গাছের সারি।

অনুচর জানাল, সে লুকিয়ে দেখেছে বড়ো মনোরম সেই স্থান।

আম্র কাননের ভিতরে ছায়া শীতল সেই স্থান সারাটা দিন পাখির কূজনে মুখর থাকে।

বিশাল সব অট্টালিকা। সাত তলা আটতলা, কোনটা বা নয় তলা। দ্বাররক্ষী ছাড়া আর তেমন কোনো রক্ষী নজরে পড়েনি তার।

সেদিন আচার্য ঘোড়ায় চড়ে ফিরছেন। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত্রি আসন্ন। ওদন্তপুরী থেকে তিনি নালন্দার পথে। আগামী মাসে নালন্দায় বিশাল এক ধর্ম সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। সে ব্যাপারে ওদন্তপুরীর আচার্যের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। কিছুদিন আগে পর্যন্ত তিনি ওদন্তপুরীর অধ্যক্ষ ছিলেন। বর্তমানে নালন্দার দায়িত্বে আছেন।

এই নালন্দা মহাবিহারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রাজা প্রথম কুমার গুপ্ত। চতুর্থ শতাব্দীর শেষের দিকে নির্মিত হয়েছিল এটি। এটি হল প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। দূর দূরান্ত থেকে ছাত্রেরা আসেন অধ্যয়ন করতে।

আচার্য ভাবছিলেন এই মগধে একের পর এক কত মহান রাজারা রাজত্ব করে গেলেন। সকলেই নালন্দার উন্নতির জন্যে বিপুল অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছেন। তাঁদের আনুকূল্যে এবং বিখ্যাত বৌদ্ধ পন্ডিতদের নিষ্ঠা ও প্রচেষ্টায় নালন্দা আজ এই উচ্চতায় পৌঁছেছে।

বুদ্ধ গুপ্ত, তথাগত গুপ্ত, বালাদিত্য, বজ্রদেব নামের রাজারা একে একে এই মহাবিহারের উন্নতি সাধন করলেন। সেই সময়ে নালন্দার পাশাপাশি আরও তিনটি বৌদ্ধ বিহার প্রসিদ্ধ লাভ করেছিল। সেগুলো হল ওদন্তপুরী, বিক্রম শীলা এবং তক্ষশীলা। পরবর্তী কালে পাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এর শ্রীবৃদ্ধি ঘটানো হয়েছিল।

যতজন আচার্য এর দায়িত্বে ছিলেন সকলেই এই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতির জন্যে অনেক কাজ করে গেছেন। পুরো ক্যাম্পাসটি পনেরো বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে। নালন্দা এখন সারা পৃথিবীর গর্ব।

আচার্য ভাবছিলেন নালন্দা বিশ্ব বিদ্যালয়ের পাঠাগারটি সত্যি গর্বের বিষয়। নয়তলা বিশিষ্ট এই অট্টালিকায় বেদ ,উপনিষদ, দর্শন, বিতর্ক, ন্যায় শাস্ত্র, যুক্তি বিদ্যা, ব্যকরণ,সাহিত্য, গণিত, শিল্প কলা, চিকিৎসা শাস্ত্র ইত্যাদি নানা বিষয়ের উপরে হাজার হাজার বই আছে। সুদূর কোরিয়া, চীন, জাপান, তিব্বত, পারস্য, তুরস্ক থেকে ছাত্ররা এখানে আসে অধ্যয়ন করতে।

পাঠাগারের মূল ভবন তিনটি। ভবনগুলি বিভিন্ন নামে পরিচিত,- রত্ন সাগর, রত্ন দধি এবং রত্ন রঞ্জক।

দশ হাজার শিক্ষার্ত্রী বর্তমানে অধ্যয়ন করছে এখানে। দুই হাজার শিক্ষক শিক্ষাদানে ব্যস্ত। সকলেই পন্ডিত প্রবর। সারা পৃথিবীতে এর তুল্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর একটিও নেই। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ছাত্ররা এখানে অধ্যয়ন করছেন। পড়াশোনা বেশীরভাগ শ্রুতি নির্ভর। নানা বিষয়ে আলোচনা এবং বিতর্কে অংশ নিচ্ছে ছাত্রেরা। আচার্য জানেন, বিখ্যাত পন্ডিত শীলভদ্র ছিলের এক সময়ে এই বৌদ্ধ বিহারের মহাচার্য। তিনি ছিলেন হিউয়েন সাং এর গুরু। বহু শাস্ত্রে সুপন্ডিত। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এইখানে অধ্যাপনা করেছিলেন। এখানকার অধ্যাপকেরা ছিলেন এক একজন সাধক। তারা ছাত্রেদের ভিতরে জ্ঞানের প্রদীপ জ্বেলে রাখতেন। মহাবিজ্ঞানী আর্যভট্ট এই নালন্দাতে শিক্ষালাভ করেছিলেন। সেটি ছিল ৪৭৬ খৃস্টাব্দ। তিনি এক সময়ে নালন্দার প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন। তার ‘শূন্য’ আবিষ্কার গণিতের এক যুগান্তকারী ঘটনা। অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান এখানে স্নাতক হন। মাত্র বারো বছর বয়েসে তিনি এখানে আসেন পাঠ নিতে। আচার্য বোধিভদ্র তাকে শ্রমণ রূপে দীক্ষা দেন। দীক্ষা নেবার পরে তার নাম হল অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান। ১৮ বছর বয়েসেই তিনি সর্ব বিদ্যায় পারদর্শী হন। এতোকাল শিক্ষালাভের অধিকার ছিল কেবলমাত্র ব্রাহ্মণ সন্তানদের। এই বৌদ্ধ বিহার নির্মিত হওয়ার পরে এই সব বাধা কেটে যায়। সর্বজনীন বিশ্ববিদ্যালয় রূপে গণ্য হল এটি। এই চারটি বিহার পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলত। এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা যান অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান করতে। কীভাবে এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো উন্নত করা যায় সেই বিষয়ে নানা আলাপ আলোচনা করতেন।

আচার্যের ফিরতে ফিরতে সেদিন রাত হয়ে গেল। আবহাওয়াও হঠাৎ বেশ খারাপ হয়ে গেল। ঝোড়ো হাওয়া বইছে। ঘোড়াটি হঠাৎ বিশ্রী সুরে ডেকে উঠল। সারমেয়দের সমবেত ক্রন্দনধ্বনি এক ভয়াবহ সংকেতের বার্তা বহন করছে। নালন্দার থেকে মাইল খানেক দূর থেকে আচার্যের নজরে পড়ল এক ভয়ংকর দৃশ্য। দেখলেন রাতের অন্ধকার মুছে গিয়ে আকাশ রক্তে রাঙ্গা হয়ে উঠেছে। বাতাসে উৎকট পোড়া গন্ধ। জঙ্গলের ভিতর থেকে জন্তু জানোয়ারের দল ছুটে পালিয়ে যাচ্ছে অজানা দিকে। রাত পাখিরা ভয়ার্ত স্বরে ডাকতে ডাকতে উড়ে যাচ্ছে দূরে।

এক অজানা আশংকায় আচার্য ভীত এবং শংকিত হলেন। তাঁর বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল।

রাতের অন্ধকারে বখতিয়ারের সেনারা অতর্কিতে ঢুকে পড়ল। দুর্গ ভেবেছিল যাকে সেটি আদতে নালন্দা বিশ্ব বিদ্যালয়। প্রত্যেক দ্বারে ছিল দ্বাররক্ষী। বখতিয়ারের উন্মত্ত সেনারা অতর্কিতে তাদের ধারাল তরবারির আঘাতে নালন্দার দ্বার রক্ষীদের এক এক কোপে মাথা কেটে ভিতরে প্রবেশ করল।

তখন ছাত্রাবাসের বিভিন্ন কক্ষে ছাত্রেরা গভীর মনোনিবেশ সহকারে পাঠাভ্যাসে ব্যস্ত ছিলেন। মঠের অন্যান্য সন্ন্যাসীরা ব্যস্ত ছিলেন নিজের কাজে। হঠাৎ তাদের কানে এলো আর্তনাদ! মারণ চীৎকারে বাতাস কেঁপে উঠল। চীৎকার ক্রন্দন আর ছোটাছুটি করতে দেখলেন তারা কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে। ছাত্রদের ভিতরে অনেকেই বয়েসে নিতান্তই কিশোর। তারা ক্রন্দন করে উঠল ভয়ে। শত শত অস্ত্রধারী লোক বিহারের ভিতরে ঢুকে সমস্ত কিছু লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে। সামান্য সময়ে ভিতরে বখতিয়ারের সেনারা কক্ষে ঢুকে নিরীহ ছাত্রদের কারো হাত- পা, কারো মাথা কেটে ফেলল তরবারির এক একে আঘাতে। রক্তের বন্যা বয়ে গেল। কর্তিত দেহাংশ, ছিন্ন মুন্ডু পড়ে রইল যত্র যত্র। হুংকার দিয়ে উঠল সেনারা। কিছু শ্রমণ ভয়ে আত্মগোপন করে ছিল। তারাও রেহাই পেল না। নালন্দার বাইরে যে বড়ো দিঘি ছিল সেই দিঘির জল লাল হয়ে গেল শ্রমণদের রক্তে। কয়েক ঘন্টা ধরে পাঁচশত সেনা বাহিনী জঘন্য হত্যা লীলা চালিয়ে গেল।

বখতিয়ারের ধারালো তরবারির আঘাতে সেদিন রক্তের বন্যা বয়ে গিয়েছিল।

এরপরে বখতিয়ারের নির্দেশে মঠে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হল।

দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগল প্রার্থনা গৃহ, পাঠ কক্ষ, সন্ন্যাসীদের বাস ভবন, ছাত্রদের শয়ন কক্ষ।

জ্বলে উঠল পাঠাগার। হাজার হাজার দুষ্প্রাপ্য বইএর ভান্ডার পুড়তে লাগল। আকাশ রক্তবর্ণ ধারণ করল সেই লেলিহান অগ্নি শিখায়। জীবন্ত দগ্ধ হলেন হাজার হাজার শ্রমণেরা। জমে উঠল লাশের পাহাড়। ঝোড়ো বাতাসে মিশে যাচ্ছে পোড়া মাং স আর রক্তের গন্ধ।

কয়েক ঘন্টা ধরে পাশবিক হত্যা লীলা চালিয়ে গেল উন্মত্ত বখতিয়ার। তার দুই চোখে ফেটে পড়ছে ক্রোধ। এতো বড়ো ধ্বংস যজ্ঞ চালিয়েও সে কিছুই পেল না।

আচার্য বুঝতে পারলেন। তার সর্বাংগ শিহরিত এবং কম্পিত হল। বুক ফেটে যাচ্ছে, অথচ তিনি অসহায়! সেনাদের পৈশাচিক উল্লাশে ঢেকে যাচ্ছে শ্রমণদের আর্তনাদ! কালো রাত্রি শুষে নিচ্ছে সব যন্ত্রণা, সব হাহাকার। বখতিয়ারের ক্রোধ, লালসা আর পৈশাচিক উন্মত্ততায় পৃথিবীর গর্ব নালন্দার শেষ অধ্যায় রচিত হল।

আজও নালন্দার ইট কাঠ পাথরের তলায় কেঁদে মরে সেই দুঃসহ যন্ত্রণার ইতিহাস।

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes