সুধা তোমায় ভোলেনি

সুধা তোমায় ভোলেনি

স্মরণ-- শাঁওলী মিত্র (১৯৪৮-২০২২)

একটি জানলা। আর সেই জানলার সামনে একটি মুখ। অসুস্থ এক বালকের কণ্ঠস্বর। সে অজানাকে জানতে চায়। দূরের নীল পাহাড়টাকে দেখে তার মন খুশি হয়ে ওঠে। আমরা কেউ সেই বালকটাকে দেখিনি। কিন্তু আমাদের প্রত্যেকের মনের ভিতর সেই বালকটি রয়েছে। আমরা দইওয়ালার ডাক শুনে ঠিক অমন ভাবেই তাকে ডেকে উঠি। আমাদের উপায় নেই এই ঘর থেকে বেরিয়ে ওই নীল পাহাড় পেরিয়ে নদীটার কাছে যেতে। পাথুরে রাস্তা পেরিয়ে ঝরনার ধার দিয়ে সেই গ্রামে পৌঁছতে আমরা পারি না, যে গ্রাম থেকে সেই দইওয়ালা আসেন। কিন্তু আমাদের প্রত্যেকের কণ্ঠ কী আশ্চর্য ভাবে মিশে যায় বালকের কণ্ঠের ভিতর। বালকের সেই বাঁচার আকাঙ্খা, ভালোবাসা ভরা গলার স্বর, স্বপ্নের ভিতর হারিয়ে যাওয়া দৃষ্টি যেন তার কণ্ঠের ভিতরেই প্রতিধ্বনিত হয়। সেই ডাক শোনা যায়, যা আমাদের হৃদয়ের ভিতর অনুরণিত হয়। ডাক, যা খুব সহজে আসে না। সে জানে রাজার চিঠি আসবে তার কাছে। সে অপেক্ষা করে থাকে রাজার চিঠির জন্য। সে জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকে দূরের মেঘের দিকে। আর ভাবে রাজার চিঠি তো এল না এখনও।

‘প্রদীপের আলোটা নিভিয়ে দাও, আকাশের তারা থেকে আলো আসুক’। এ কথা তার ঘরের মধ্যে যখন গুনগুন করে ওঠে, তখন সে ইতিমধ্যে পেয়ে গেছে রাজার চিঠি। তার কণ্ঠ তখন স্তব্ধ। সেই স্তব্ধ কণ্ঠের নীরবতাও যেন শুনতে পাওয়া যায়। টের পাওয়া যায় তার উপস্থিতি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ডাকঘর’ নাটকটি আমার ছোটবেলায় পড়ার আগেই মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল। সৌজন্যে- অমলের ভূমিকায় যাঁর কণ্ঠ শুনেছিলাম, সেই শাঁওলী মিত্র। এর পর যতবার সেই নাটকটি পড়েছি, আমার মাথার ভিতরে, মনের ভিতরে সেই কণ্ঠটিই বেজে উঠেছে। অমল হিসেবে আমি কার কারও কণ্ঠ সারাজীবনে কখনও শুনিনি। অমল আমার বন্ধু। এমন একজন বন্ধু, যার সঙ্গে আমার জীবনে কখনও দেখা হবে না। কিন্তু মন যখন খুব অবসন্ন, তখন আমি ডাকঘর নাটকটির কাছে যাই। আর, সেই নাটকটির কাছে গেলেই যে অমলের কাছে যেতেই হয়। আর অমল মানেই তো তিনি। শাঁওলী মিত্র।

অমলকে তো বেঁধে রাখা যায়নি কিছুতেই। মৃত্যু তাকে বেঁধে রেখেছিল বলে ভেবেছিল হয়তো। কিন্তু তার স্বপ্ন, তার সৌন্দর্যবোধ, তার ভাবনা মৃত্যুকে ছাপিয়ে চলে গিয়েছিল বহুদূর। এক ভালোবাসাময় বিষাদের স্পর্শের কাছে আমাদের নিয়ে এসেছিল অমল। আর এই আশ্চর্য ঘটনাটি সম্ভবই হতো না, যদি না অমলের গলায় নানা ভঙ্গিতে কবিতার সূক্ষ্মতায় অভিনয় করতেন শাঁওলী মিত্র। যেমন অমলকে বেঁধে রাখা যায়নি, তেমনই শাঁওলী মিত্রকেও বেঁধে রাখা যায়নি। মৃত্যুর এক নিজস্ব নীরবতা আছে। সেই নীরবতাকে সম্মান করতে জানতেন ডাকঘরের ঠাকুরদা। সেই নীরবতাকে সম্মান করতে আমরা শিখিনি। মৃত্যুকেও আমরা পণ্য করেছি। মৃত্যুকেও আমরা করে তুলেছি ইভেন্ট।

শাঁওলী মিত্র নীরবেই চলে গেলেন ডাকঘরের অমলের মতো রাজার চিঠি পেয়ে। পড়ে রইল স্মৃতি। বিতত বিতংস, নাথবতী অনাথবৎ। পড়ে রইল তাঁর অসংখ্য লেখা। অভিনয়, নাটক। তার সঙ্গেই পড়ে রইল তাঁর ব্যক্তিত্বের এক স্বতন্ত্র নির্জনতা। এই নির্জনতাকে সম্মান জানাই।

‘সুধা’ তোমায় ভোলেনি অমল। এমন অসংখ্য নীরবে থাকা, নির্জনতায় থাকা ‘সুধা’-রা আপনাকে ভুলবে না শাঁওলীদি। অমল আবার কথা বলে উঠবে আমাদের ঘরে ঘরে। তার ক্ষণস্থায়ী জীবন নিয়েই আমাদের সে দিয়ে যাবে এক চিরকালীন দুঃখবোধ। যা সত্য এবং সুন্দর।

হিন্দোল ভট্টাচার্য

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (3)
  • comment-avatar
    মন্দিরা গাঙ্গুলী 3 years

    মন ছুঁয়ে যাওয়া লেখা।

  • comment-avatar
    Jaya kundu 3 years

    Khub valo laglo pore. Amal ke kokhono bhuli ni.

  • comment-avatar
    স্বপন নাথ 3 years

    ব্যক্তিগত পরিচয়ে জানি শাঁওলীদি আজীবন লালন করে গেছেন অমলকে ।তোমার শ্রদ্ধাঞ্জলি সেই অমলকে অমরতা দিল ।

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes