‘চিন্তামণি, রেখে যাও ধ্বনি’ – সৌম্য দাশগুপ্তের কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে একটি গদ্য <br /> হিন্দোল ভট্টাচার্য

‘চিন্তামণি, রেখে যাও ধ্বনি’ – সৌম্য দাশগুপ্তের কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে একটি গদ্য
হিন্দোল ভট্টাচার্য

সমুদ্রতটে, মৃত গালিভার সৌম্য দাশগুপ্ত ভাষালিপি প্রচ্ছদ - সঞ্জীব চৌধুরী মূল্য-৪০ টাকা

‘রাজার জামা পরা মায়াবী সাতদিন’ নামক কৃশকায় কাব্যগ্রন্থ দিয়ে যাঁর শুরু, সেই সৌম্য দাশগুপ্ত মূলত আট-এর দশকের কবি। ধ্রুপদী এবং স্বতন্ত্র কাব্যভাষার এই কবির
কবিতাজীবনের মূল ডিএনএ হলো সংযম। আর ঠিক এই কারণেই সৌম্য দাশগুপ্তের প্রবাসজীবন, ব্যস্ত পরিসংখ্যানবিদের পেশা এবং কর্পোরেট জীবন পেরিয়েও মন থাকে বাংলা কবিতার দুরূহ এক প্রদেশে। জনপ্রিয়তার রাস্তাকে পরিহার করে তিনি প্রকৃত কবিতার অন্দরমহলে প্রবেশ করেছিলেন বহুদিন আগেই। যদিও এ প্রশ্ন চলে আসতেই পারে, কোনটা প্রকৃত
কবিতার রাস্তা, তা কেই বা জানে। ঠিক যেমন সত্যকে কোনও একদেশদর্শী ভাবনার মধ্যে বেঁধে ফেলা যায় না, তেমনই কবিতাকেও নির্দিষ্ট কোনওকিছুর মধ্যে বেঁধে ফেলা যায় না।
কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে মূল জায়গা হলো এক ব্যক্তিত্ব। আর সেই ব্যক্তিত্ব তৈরি হয় ভাবনার জায়গা থেকে। ভাবনার পরিসরই একজন ব্যক্তি কবিকে অন্যের থেকে পৃথক করে রাখে।
এই ব্যক্তিত্বই তাঁকে ধারণ করে রাখে যতদিন তিনি কবিতার সাধনায় মগ্ন থাকবেন, ততদিন। এমনকী কবির মৃত্যুর পরে তাঁকে পাঠ করার সময়ও বিভিন্ন যুগে তাঁর এই ব্যক্তিত্বের সঙ্গেই
কথোপকথন হবে পাঠকের, যে পাঠকের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং কথোপকথনের আর কোনও উপায় থাকবে না। সৌম্য দাশগুপ্ত ধারাবাহিক ভাবে নিজের ভাবনার প্রতিফলনগুলি লিখে
চলেছেন তাঁর কবিতায়। আরও একটি অভিনবত্ব রয়েছে তাঁর কবিতাশৈলীতে। যেমন তিনি সাত পাঁচ মাত্রা বা মাত্রাবৃত্ত- স্বরবৃত্তকেও ব্যবহার করেছেন আগে তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থে, তেমন তিনি চেনা শব্দের অন্তর্গত অর্থের কোডকে ভেঙে সেই অর্থকে সম্প্রসারিতও করে ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ভাবে। অর্থাৎ, যাতে শব্দকে তার চেনা অর্থের থেকে মুক্তি দেওয়া যায়। তখন শব্দের সঙ্গে
অন্য কোনও শব্দের মিথষ্ক্রিয়ায় তৈরি হয়েছে সম্পূর্ণ অন্য এক অর্থ। আলোচ্য কাব্যগ্রন্থেও এই কাজ আমরা দেখতে পাই। তার সঙ্গে দেখতে পাই অক্ষরবৃত্ত ছন্দকে ভাবনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে
ব্যবহার। আলোচ্য কাব্যগ্রন্থের নাম ‘সমুদ্রতটে, মৃত গালিভার’। নামকরণেই, রয়েছে শব্দের মধ্যে রূপকের ব্যঞ্জনা। কিন্তু এই রূপক কীসের? কেন? তা জানতে আমাদের যেতে হবে
কবিতার গভীরে।
একটি ২০ পাতার কাব্যগ্রন্থের কিছু কবিতা পুরো তুলে দেওয়া সেই কাব্যগ্রন্থের প্রকাশকের পক্ষে এবং সেই বইটির পক্ষেও ভালো নয়। কিন্তু কিছু কবিতার কিছু পংক্তি নিয়ে আলোচনা করাই যায়। বিশেষ করে, যখন বিষয়টি, আলোচনার জন্য নয়, ভাবনার সঙ্গে ভাবনার একপ্রকার সংলাপের জন্য। এই গ্রন্থের বিভাব কবিতাতেই আমরা মুখোমুখি হই ৩৪ মাত্রার দু লাইনের। তার পর আমাদের সামনে আসে ‘দেয়াল প্রস্তুত’ শীর্ষক কবিতা। অনেকটা মন্ত্রের মতো বা সংস্কৃত কাব্যের মতো ধ্বনিমাধুর্য সহ কবিতাটি অত্যন্ত আধুনিক এক চিন্তার বীজ নিয়ে আসে আমাদের কাছে।
“প্রভূত পছন্দ পড়বে, পছন্দ, পছন্দ, খুশি, ঘোলাজলে এসে ঘরে বিছানায় জমাবে প্লাবন” বা ” জয়ধ্বজা হয়ে এসো, কলম ও তিলক, ছৌ, বেইজ, লালন, আজ তোয়াতে গুরুর সম্ভাবনা”। খেয়াল করে দেখলেই বোঝা যাবে, আধুনিক জীবনের প্রতিচ্ছবি লেখা হচ্ছে এক অদ্ভুত ইনভোকেশন জাতীয় কবিতার মধ্য দিয়ে। ফলত, ধ্বনি ও ছন্দের ব্যবহার এবং শব্দের ব্যবহারে, আঙ্গিকের ব্যবহারে কবিতাটিতে একপ্রকার এপিক কোয়ালিটি এসে পড়ছে। কিন্তু সম্পূর্ণ কবিতাটিই সমকালের এক অলংকার হয়ে উঠছে। এই কবিতাটিকে যদি সেই মহকাব্যিক প্রেক্ষাপটের ( এ প্রসঙ্গে মাইকেল বা মিল্টন মনে পড়তে পারে) জায়গায় ভাবি, তবে এর পরে আমরা দেখব’গালিভার’ শীর্ষক কবিতায় তিনি লিখছেন, ” স্থিতিই কামনা করি। বারবার তবু এক অস্থিতি এসে/ ছিন্নভিন্ন করে দেয় ধ্যানের নির্বেদ”। কিন্তু এই যে অস্থিতি এসে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে ধ্যানের নির্বেদ তার কারণ কি কাফকাস্ক? কিন্তু না। তার চেয়েও অনেক জটিল। কারণ তিনি ভুবনায়ন পরবর্তী সময়ের অস্থিতির কথা বলছেন। তাই বলছেন, ” আশৈশব সামাজিক শিক্ষাসত্রে, পরিবারে, মধ্যবিত্ত বোধে/ অর্জন করার মতো স্থিতি আমাদের, আজ আশ্চর্য হবার,/ আবিষ্কারের কোনো উত্তেজনা নেই, এই লিলিপুটে ভরা/ বিষণ্ণ সমুদ্রতটে শায়িত শবের মতো, মৃত গালিভার।”
দাশগুপ্ত-র মনের মধ্যে যে দার্শনিক সত্ত্বা, তা প্রতিমুহূর্তে নিজেরই সঙ্গে সংলাপে রত। তাই ‘জন্মের সাধনা হবে বলে এই জন্ম’ শীর্ষক কবিতায় তিনি যেন বা বৌদ্ধ ট্রান্সমাইগ্রেশন দর্শনের এক রূপভেদ ( অ্যালোট্রপ বলতেও পারি হয়তো) দেখতে পাচ্ছেন এই নিরন্তর সৃষ্টি এবং ধ্বংসের মধ্যে। বেদান্তসুলভ একপ্রকার বীক্ষা কাজ করছে এই কাব্য-অভিপ্রায়ে। জন্মের সাধনা হবে বলে এই জন্ম, এই ভাবনাটিই আমাদের বিস্ময়ের মধ্যে ঠেলে দেয়। আমাদের স্তম্ভিত করে। বিষণ্ণ করে। এরই মধ্যে তাঁর আশ্চর্য লেখনী থেকে বেরিয়ে আসে ‘ যে চোখ কামনাভরা শারীরবৃত্তীয়’, ‘অশ্রুতীর্থতীর’, ‘ এই গোপনীয় মেঘে মেঘে আলাপচারিতা’-র মতো এক একটি খণ্ড মুহূর্ত। যা এক অখণ্ড প্রবাহের মধ্যে মিশে যাচ্ছে।
এই কবিতাগুলি পড়তে পড়তে চুপ করে যায় মন। ভাবি, প্রবাহের এই কি ধর্ম? কোটি কোটি বছর ধরে প্রবহমান যে জীবনকে নিয়ে প্রত্যেকে চলেছি, চলেছে এই মহাবিশ্ব, তাকে তো বাক্যে কথায় মনে ভাবনায় কোনোভাবেই প্রকাশ করা যায় না। আবহমান অবচেতনার মধ্যে সেই স্মৃতি লুকিয়ে আছে, যাকে কবি বলছেন, ” স্মৃতি এক ঐশ্বর্য”। আবহমান ইতিহাসচেতনাই লিখেছেন কবি তাঁর ঐশ্বর্য এবং ভূগর্ভে পাথরবুকে জমে থাকা আণবিক স্নেহ’ নামক কবিতায়। হয়তো এই আবহমান অবচেতনা এবং আবহমান ইতিহাসচেতনার কথা লিখতে লিখতেই তিনি উপনীত হচ্ছেন ‘ আমাদের জন্ম থেকে রঙ এক অপরূপ গোষ্ঠীচেতনা’- এই কাব্যিক অভিপ্রায়ে। ‘ কেমন আত্মিয়প্রেমে গোষ্ঠীর কেন্দ্রাতিগ অভিকর্ষে যাওয়া’ এই চেতনাই তো আমাদের নিজস্ব। বন্ধু, তোমার নামে মন্ত্রের প্রতিভা– এই প্রকাশভঙ্গির মধ্যে এই ইয়ুং কথিত অবচেতনার কথাই প্রতিভাত হচ্ছে বারবার। এই কবিতাটির কাছে এসে, কোনও প্রত্যক্ষ সংযোগ না থাকলেও মনে পড়ে গেল অনন্য রায়ের কবিতা। নিভৃত চিন্তার বিভিন্ন তল আমরা দেখতে পাই সৌম্যর এই গ্রন্থের বিভিন্ন কবিতায়। যেমন- রেওয়াজ, দেশ, তুমি বলো আজ কোন দেশে, ফেরা, এবং দৃশ্যের অগোচর। শেষোক্ত কবিতার শেষ লাইন চিরকালীন এক চৈতন্য-র অংশ হিসেবেও পড়া যায়- ” মানুষ মানুষকে দেখে? কী দেখে সে মানুষে মানুষে?” ‘শ্রমণ’ কবিতাটি পড়ে আমাদের মন খারাপ হয়ে যায় স্বাভাবিক ভাবেই। ‘চলো সময়ের ডানা’ কবিতাটি আমাদের ‘মিডনাইট ইন প্যারিস’ ছবির মতোই নিয়ে যায় প্রিয় সময়ের কাছে। যেখানে কবি লিখছেন, ” বিকিরণ, বিকিরণ, এসো দোস্ত উনিশ শতকে/ চলো সময়ের ডানা ইচ্ছামতো দৃশ্যমান দেশে।”
এই গ্রন্থের শেষ পাতায় একটি ছোট্ট বাক্য লেখা আছে- আত্ম যদি না থাকিত, অভিমানে না যদি অহং… এ প্রসঙ্গে মনে হয়, এই যে কাব্যগ্রন্থটি এতক্ষণ ধরে পড়ে শেষ করলাম ( প্রথমত কোনও গ্রন্থই শেষ হয় না। তার লেখা শুরুর আগে একটা দীর্ঘ অংশ অপ্রকাশিত থাকে এবং সেই গ্রন্থ শেষ হয়ে গেলেও একটি দীর্ঘ অংশ অপ্রকাশিত থাকে) সেটি একটি কবিতার গ্রন্থ হলেও, একটি দর্শনের গ্রন্থও নয় কেন? অথবা এই গ্রন্থটি একটি মহাকাব্যই বা নয় কেন? এ এক অন্য তর্ক যে এই সময়ে কোনও মহাকাব্য লেখা আদৌ সম্ভব কিনা। যদি বা মহাকাব্য নাই বলি, তবু মহাকাব্যিক পটভূমি, প্রেক্ষাপট এই ক্ষুদ্র কাব্যপুস্তিকার প্রতিটি শব্দের ভিতরে। মহাকাব্যিক মহাচেতনাই এই গ্রন্থে আমাদের বাংলা কবিতার মধ্যে মিশে গেল সৌম্য দাশগুপ্তের হাত ধরে। এখন প্রশ্ন অন্য। যে কাব্যগ্রন্থের অমন মহাকাব্যিক ইনভোকেশন থাকে, সেই কাব্যগ্রন্থের শেষ এখানে আদৌ হতে পারে কিনা। কারণ, মনে হল, কাব্যগ্রন্থটি অনেক অনেক ইশারা দিচ্ছে আমাদের এক দীর্ঘ যাপন এবং পথের।
হয়তো, কবির কাছে লিখিত কবিতার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ না লেখা কবিতাগুলি।

সৌম্য দাশগুপ্তর এই আশ্চর্য কবিতাগ্রন্থটি কেউ যদি পড়তে চান, তাহলে ভাষালিপি থেকে সংগ্রহ করতে পারেন। এর প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী শ্রী সঞ্জীব চৌধুরী। এই গ্রন্থের প্রতিটি কবিতার অন্তরের দর্শনকে ফুটিয়ে তুলেছেন প্রচ্ছদে।

লেখাটি যদি ভালো লাগে, আবহমানে নিজের ইচ্ছেমতো ফোন পের মাধ্যমে
অবদান রাখতে পারেন, এই কিউ আর কোড স্ক্যান করে। ফোন পে করুন 9051781537
অথবা স্ক্যান করুন পেমেন্টের লিংক

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes