একটি প্রক্রিয়ার নাম
রুমা তপাদার
সমস্ত রাত্রি শেষ হলে একটি কন্যাশিশুর জন্ম হয়। সেই শিশুটি প্রথম যখন চোখ খুলে সাদা রক্ত পান করে, লৌকিক-অলৌকিক সমস্ত রহস্যের অবসান ঘটে, তখন সেই মুহূর্তের নাম ‘সুন্দরী’। অনেক শব্দ আমাদের কাছে সামান্য সচ্ছলতা দাবি করে। কিন্তু কৌশলে শোষণের পাশে আটকে থেকে সেই শব্দ বন্দি হয়ে যায়, একা এক কারাগারে।
আমার মনে হয় কোনও মেয়ের নামের আগে অথবা নামের পরিবর্তে যদি ‘সুন্দরী’ সম্বোধন যুক্ত হয় তখনই তার আগে অদৃশ্যে জুড়ে যায় একজোড়া পুরুষ-চোখ। যার ভয়ে সে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে একা ফাঁকা রাস্তায় পা ফেলতে ভয় পায়। ভয় পায় ভিড়ভাট্টায় এগিয়ে যেতে। যার জন্য তার ‘মাথার ভিতর স্বপ্ন নয়, প্রেম নয়, কোনো এক বোধ কাজ করে’। শুধুমাত্র যার শরীরেই সর্বনামের আগে তুমি ওই অক্ষরটি লেপে দিয়েছো। সেই তুমি কেউ একা নও, যে শুধুমাত্র সে-ই প্রথম। আগে এবং প্রতিবার—বারবার—আবার… আবারও। সেই তুমি বন্ধু হতে পার, স্বামী হতে পার, পাড়ার কাকিমাও হতে পার। আবার মৃত্যুশয্যাশায়ী কোনও ব্যক্তি-সেবিকার স্পর্শবিনিময়। হতে পারে সেই চোখ অচেনা, অথচ হুবহু চেনা চোখের মতোই। সে যারই হোক না কেন, সেটি সবসময় পুরুষের চঞ্চল চোখ অথবা পৌরুষের দৃষ্টি। পুরুষ বলতে পুরুষকার কেউ যে— তাও ঠিক নয়। একরকম ছন্নছাড়া মানসিক স্বভাব, একরকম শব্দ একরকমভাবে দেখার মানসিকতা, এক রকমের আস্তরণে মুড়ে সেই মেয়েটিকে তখনই কামনার দৃষ্টিতে দেখা। নিজের সত্ত্বগুণ বাদ দিয়ে তমো গুণে দেখা। আবার এমনটাও হয় যে, সেই মুহূর্তেই তাকে পাওয়ার বাসনা বা আকাঙ্ক্ষা কিছুই থাকে না। শুধু ভাল লাগাতেই কিন্তু এই সর্বনাম, বিপরীতে সীমাবদ্ধ কোনওদিন থাকে না। শিরা-উপশিরা ধমনী সমস্ত কিছু পার করে পায়ের আঙুলে গিয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত নামটি না পৌঁছে যায়, ততক্ষণ শুধুমাত্র দৃষ্টি অথবা কণ্ঠের মধ্যে এই শব্দটি সীমাবদ্ধ থাকে না। তার তীব্রতা মাটি ভেদ করে পৃথিবীর উত্তপ্ত কেন্দ্রে পৌঁছে গলে যায় না। এক্ষেত্রে আরও কঠিন হয়ে ওঠে। বস্তুত একটি প্রক্রিয়ার নাম হল ‘সুন্দরী’। এই শব্দটি ‘নিজের মুদ্রা দোষে একা হতেছি আলাদা’ এই দাবি রাখে। একটি জেগে থাকার নাম ‘সুন্দরী’। একবার মাত্র নিশ্চিন্তে অঘোর ঘুমে চোখ বন্ধ করার নাম ‘সুন্দরী’। প্রথম আলো দেখার নাম ‘সুন্দরী’। প্রথম স্রোতের নাম ‘সুন্দরী’। প্রথম কান্নার নাম ‘সুন্দরী’। একটি গাছকে তার পাতা-কাণ্ড-শিকড় সমস্ত কিছুকে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র ফুলের নাম ধরে ডাকার নাম ‘সুন্দরী’। বৃষ্টির জলে সবুজ পাতার আরও সবুজ হয়ে ওঠার নামও…। অনেকেই বক্রদৃষ্টিতে ‘সুন্দরী’ শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন, —সেইসমস্ত চোখের জলের নাম সুন্দরী। চোখের তলার কালি লুকিয়ে কাজল পরার নাম ‘সুন্দরী’। খুব গভীরভাবে দেখলে বোঝা যায় অনেক মহিলার কাছেই এই ‘সুন্দরী’ শব্দটি কীভাবে বেঁচে থাকে, তাদের দিন থেকে রাত হয় এই শব্দটির ওপর নির্ভর করেই। নতুন বৌটি সলজ্জিত মুখ নিচু করে শুধু এই শব্দটি শোনার প্রত্যাশায়। অন্যত্র পতিতাপল্লীর যে মেয়েটির জন্ম হয়েছে এই পতিতাপল্লীতেই, তার দেবী-মা তাকে ‘সুন্দরী’ বলে ডাকে অথবা যে-মেয়েটি আজ আর শারীরিক বিনিময়ে সামান্য খাদ্যের যোগানটুকুও পায় না, সেও ‘সুন্দরী’। কারণ বহু আগে পরমমুহূর্তে তাকে ‘সুন্দরী’ বলে অভিহিত করেছিল তাঁর পরমপুরুষ— সে একমাত্র তাঁর অন্তরাত্মা। যার চামড়া ঝুলে গেছে। বুকের মাংস পেটে এসে ঠেকেছে। সন্তানের কাছে সেই মা-দেবী অকল্পনীয় ‘সুন্দরী’। কারণ আমাদের দেশে ছিন্নমস্তা দেবীরূপে পূজিত হন। জীবনের সমস্ত সংকটের কথা হাসিমুখে সহ্য করেছে যে নারী, সে ‘সুন্দরী’। সমস্ত রাত্রি শেষ হলে একটি কন্যাশিশুর জন্ম হয়। সেই শিশুটি প্রথম যখন চোখ খুলে সাদা রক্ত পান করে, লৌকিক-অলৌকিক সমস্ত রহস্যের অবসান ঘটে, তখন সেই মুহূর্তের নাম ‘সুন্দরী’। অনেক শব্দ আমাদের কাছে সামান্য সচ্ছলতা দাবি করে। কিন্তু কৌশলে শোষণের পাশে আটকে থেকে সেই শব্দ বন্দি হয়ে যায়, একা এক কারাগারে। তাকে সেখান থেকে বার করে আনতে একটি কোলের ওপর দুটি হাত যথেষ্ট। সেই যোগমায়া-হাত সমস্ত লিঙ্গের শেরার শিরোপা নেওয়া থেকে বিরত রাখতে উন্নত দৃষ্টির ঘোর বর্ষণ ঘটায়। গর্ভ পূর্ণ হয় প্রথম থেকে অষ্টম বারের জন্য। আমাদের মাতৃভাষা সেই কোল দাবি করে। আপামর মাতৃভাষী বাঙালির কাছে মাতৃভাষার কোলের উপর স্তব্ধ দুটি শিশুহাত এবং সদ্য পাওয়া চোখে নতুন জগৎ দেখার মতো করে যে স্তব্ধতায় ঘিরে বসে থাকে সেখান থেকে সুন্দরী শব্দকে বার করে এনে স্বরগ্রামে ফেলে দিতে পারলেই শতনাম তাকে ঘিরে বসে থাকবে। নিছকতার গণ্ডি পেরিয়ে নতুন অঙ্গীকারে আবিষ্কৃত হবে একই শব্দের পুনোরুদ্ধারে। উথাল-পাথাল করে আছড়ে পড়বে অন্য বর্ণে, ভিন্ন সাজে, উন্নততর মানসিকতায়। অতি প্রাচীন কাল থেকে নিয়ে সটান এসে পড়বে র্যাপের যুগে। সেই ব্রাহ্মমুহূর্তটির নাম প্রকৃতই ‘সুন্দরী’।