অজিত সিং বনাম অজিত সিং
পর্ব-৫১
তৃষ্ণা বসাক
৫১
অনেক অনেক বছর পর খুব ভালো লাগছে
শতরূপার।মনে হচ্ছে সেই ছোটবেলার মতো আবার
কমিউনে থাকছেন। যেন তিনি কোন মরণ পণ মিশনে
নামেন নি, যেন স্রেফ সবার সঙ্গে বসে হেসে খেলে আড্ডা
দিয়ে জীবন কাটিয়ে দেওয়াই জীবনের উদ্দেশ্য- এরকম
মনে হচ্ছে। কমিউনে যখন থাকতেন, বড়রা নিশ্চয়
অনেক ভারি ভারি কাজ করতেন, কিন্তু ছোটরা তো
সেসব বুঝত না, বোঝার দরকার হত না। তাঁদের
দিনরাত্তির খেলা আর খেলা। মা পড়িয়ে দিতেন এমন
ভাবে যে সেটা খেলাই মনে হত। আর বাড়ির মত একা
একা পড়া তো নয়, সবাই মিলে পড়া, তার কোন
বাঁধাধরা সিলেবাসও নেই। আর পড়ানোর বিষয়ও বিচিত্র।
কবিতার ছন্দ থেকে আইনস্টাইনের থিওরি অব
রিলেটিভিটি, মোচা কাটার কৌশল থেকে নারকেল পাতা
থেকে ঝাঁটা তৈরির পদ্ধতি- সে ভাবা যাবে না। একেকটা
বিষয় মাথার ওপর দিয়ে যেত, তবু আকর্ষণ করত তীব্র।
তবে হাজার খেলার ফাঁকে ফাঁকে শতরূপা এক একবার
এসে মাকে দেখে যেতেন। মা আছে তো? কোথাও চলে
যায়নি তো? এখানেও এই মস্ত বাড়িটায় বিবিধ কর্মকাণ্ড
চলছে, সব দিকেই মাথা দিতে হচ্ছে তাঁকে, তবু তার
ফাঁকে ফাঁকে তিনি সুমনকে দেখে যাচ্ছেন।মনে হচ্ছে ওই
তাঁর জীবনের একমাত্র ধ্রুবক।
এখানে অনেকে এসেছে, আরও আসছে, ভবিষ্যতেও
আসবে। হারানো মানুষের এক অনন্ত কার্নিভাল। কিন্তু
এত মানুষের থাকা খাওয়ার খরচ কোথা থেকে আসবে?
কেন, যেখান থেকে এতদিন শতরূপার খরচ এসেছে। তাঁর
বাবা মা কমিউনিস্ট ছিলেন, স্পিরিচুয়াল কোন প্রসঙ্গ
তাঁদের কথায় কখনো আসেনি, তেমন কোন বই তাঁদের
বাড়িতে ছিল না। কিন্তু দিদার কাছে গেলেই দিদা তাঁকে
রামকৃষ্ণ কথামৃত পড়ে শোনাতেন। বলতেন, জীবনে বেঁচে
থাকতে হলে এত ভাল পরামর্শ আর পাবি না। আধ্যাত্মিক
গুরু নয়, একজন প্র্যাক্টিকাল মানুষ হিসেবে নিতে পারিস,
ঠকবি না। শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে গেছিল শতরূপার।
এত আশ্চর্য উপমা, এত প্রতিদিনের জীবনযাত্রা থেকে
উদাহরণ, পরে তাঁর বহুবার মনে হয়েছে, কমিউনিস্টরা
যদি এই ভাষা রপ্ত করতে পারত, তাহলে এদেশে তাদের
শেকড় অনেক দূর ছড়াতে পারত। সেই কথামৃতে আছে,
বাড়ির গিন্নির কাছে একটা হাঁড়ি থাকে, তাতে সমুদ্রের
ফেনা, আপাত অদরকারি অনেক জিনিস তোলা থাকে,
ওইরকম ঈশ্বর সৃষ্টির বীজ তুলে রাখেন, যাতে পৃথিবী
ধ্বংস হয়ে গেলে আবার নতুন করে শুরু করা যায়।
শতরূপাকে যখন বইপাড়ার এক ছোট সংকীর্ণ গলি থেকে
তুলে নেওয়া হল, তখন কেউ বা কারা বুঝে গিয়েছিলেন
ধংসের দিন আসন্ন। পৃথিবী এখন প্রাচীনা হয়েছেন। আর
কিছুই আগের মতো থাকবে না। এখন ক্রমশ শেষের দিন
সে ভয়ংকরের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। না, ভুল হল।
সেদিন না, তার অনেক আগে থেকেই সেই কতিপয়
মানুষ, যারা বারবার কৌরব সভায় বিকর্ণের মতো
প্রতিবাদ জানিয়ে একা হয়ে পড়ছিলেন, তাঁরা জেনে
গেছিলেন শতরূপাকে উধাও করে দেওয়া হবে। তবে তাঁরা
আগেই কিছু করেননি কেন? করেছিলেন। একটা ফোন
এসেছিল নিখোজ হবার আগের দিন, সাবধান করেছিল
তাঁকে। তিনি দেওয়াল লিখন পড়তে পারেননি। কিন্তু
যারা জানত তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে, তারা ওইসময়
বাধা দিল না কেন? দিল না, কেন তারা মনে করেছিল,
তাতে কোন লাভ নেই। যেকোন বিপ্লবের একটা বলি
লাগে। শতরূপা তাই। কিন্তু তারা কাজ শুরু করে
দিয়েছিল। সৃষ্টির বীজ সঞ্চয় করে রাখার কাজ।
শতরূপাকে যখন প্রায় পাগল বানিয়ে এক অজানা জায়গায়
অন্ধকার রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে আসা হল, তারাই তাঁকে তুলে
আনল পরম যত্নে। খুঁজে বার করল কলকাতার বুকেই
এমন এক কলকাতা, বাইরে থেকে কেউ যার সন্ধান
পাবে না। কোটি যোগিনীর গলিতে কমরেড নন্দ স্মৃতি
ভবনের উল্টোদিকে বিহারী অধ্যুষিত একটি এলাকা,
যেখানে বাঙালি ইন্টেলিজেনশিয়া ঢুকতে গেলেও নাক
সেঁটকাবে, সেইখানে শতরূপার পুনর্বাসন হল। সেখানেই
পদ্মনাভ ঢুকে পড়লেন একদিন। না, এটা একেবারেই
স্ক্রিপ্টেড ছিল না। জীবনের কিছু কিছু ব্যাপার যেমন
স্বচ্ছন্দে নিয়তির ওপর চাপিয়ে দেওয়া যায়, এও তেমনই।
নিয়তি, পদ্মনাভর আসাটা তেমনই নিয়তি।তবে এ এমন
এক নিয়তি, যার জন্য অপেক্ষা করে কেউ কেউ
আজীবন। পার্টিতে যে অংশটা তাঁকে চিরকাল উপেক্ষা
করেছে, স্থূল শারীরিক একটা নরকের কীটের বেশি কিছু
ভাবেনি, তার প্রধান আর বিখ্যাততম মুখ এই পদ্মনাভ।
সেই পদ্মনাভ নিজের থেকে এসে যখন ধরা দিল, তখন
মনে হল তিনি জিতে গেছেন। যদিও সেই মনে হওয়ার
সব অর্থই তাঁর কাছে, পদ্মনাভর মতো অনুভূতিহীন
স্বার্থপর লোকের কাছে এর কোন অর্থ হয় না। এক
একটা লোক আজন্ম রুথলেস হয়, তাদের কোথাও শেকড়
থাকে না, তারা সবজায়গার সুবিধে ভোগ করে, কিন্তু
কেউ আপনার হয় না তাদের, তারা শুধু নিতে জানে,
পদ্মনাভ তেমন একজন।তবে শতরূপার মনে হয় পদ্মনাভ
এসব জেনে বুঝে করেন না। কোনটা শোভন, কোনটা
অশোভন, সমাজের বেসিক নর্মসগুলো তিনি গুরুত্বই দেন
না, আসলে বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকা একটি শিশু ছাড়া
কিছু নন তিনি। ভাবামাত্রই বড় মায়া হল তাঁর। কোথায়
যে গেলেন লোকটা? যেমন হঠাৎ করে এসেছিলেন, তেমন
হঠাৎ করেই চলে গেলেন।এমন লোক, যিনি কারো মনেই
কোন ছায়া ফেলে গেলেন না, নইলে যারা দেখাশোনা
করত, খাবার দিত, চা দিত, স্নানের তাগাদা দিত,
খবরের কাগজ এনে দিত টাইমে টাইমে, সেই
সাহায্যকারিণীর দল, তারা একবারও জিজ্ঞেস করে না
কেন ওঁর কথা? বেশ কয়েক মাস টানা ছিলেন যে
লোকটা, তিনি হঠাৎ কোথায় গেলেন, এমন একটা গোদা
কৌতূহল হল না কেন কারো? নাকি কৌতূহল মানা
হ্যাঁয়। ভাবতেই শিরদাঁড়া দিয়ে হিমস্রোত বয়ে যায়।
তাহলে কি পদ্মনাভর আসা আর চলে যাওয়া কোনটাই
এমনি এমনি নয়? যারা তাঁকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে
আবার জীবনে ফিরিয়েছে, নিয়োজিত করেছে নানান কর্ম
কাণ্ডে, তারাই কি তবে পদ্মনাভকে পাঠিয়েছে, আবার তুলে
নিয়েছে, তাদের কোন কাজ হয়ে যেতেই? তাহলে, তাহলে
শতরূপাও একটা কাঠপুতলি ছাড়া কিছু নয়? না তা হতেই
পারে না। তিনি কিছুতেই মানবেন না পদ্মনাভর এন্ট্রি আর
এক্সিট স্ক্রিপ্টে ছিল। ওর সেই লস্ট লুক, সেই মেয়েটিকে
কল পাম্প করতে দেখে সেই আকুল কান্না, এগুলো কি
অভিনয় হতে পারে? তাছাড়া পদ্মনাভকে কন্ট্রোল করা
সম্ভব হলে তো অনেক কিছুই দেখতে হত না। তবে শতরূপার
ভাবতে ভালো লাগে কোনারকের সূর্যমন্দিরের চুম্বক
যেমন বড় বড় জাহাজকে টেনে আনত, তেমনি করে তিনি
একাই পদ্মনাভকে টেনে এনেছেন। এর মধ্যে অন্য কেউ
নেই।
তবে পদ্মনাভ আসার পর থেকে শতরূপার মিশনে দ্রুতি
এল। বিরাট একটা যুদ্ধ জয় হয়ে গেছে, এমন তৃপ্তিতে
শতরূপা সত্যি সত্যি শত রূপে, সহস্র ধারায় কত কত
কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন আরও। তাঁর এতদিনের মূল
ফোকাস ছিল গ্রামের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা।কিন্তু ধীরে ধীরে
তাঁরা রিয়েলাইজ করলেন, যারা পড়াশোনা শিখতে আসবে,
তাদের পেটে খাবার যেমন দরকার, তেমনই দরকার মনে
আনন্দ। এই সব দরিদ্র পরিবারে, ছেলেমেয়েরা বাড়িতে কী
পরিবেশ পায়? অশান্তি, মায়ের ওপর অত্যাচার,
শৌচাগারের অভাব, মেয়েদের পিরিয়ড হলে নোংরা কাপড়
ব্যবহার- এর একটি থাকলেও তাঁদের মতো সম্পন্ন ঘরের
শিশুরা কি পড়ায় মন বসাতে পারবে? শিশুশিক্ষা একটা
বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়, সামগ্রিক ব্যাপার। পরিবার ভালো না
থাকলে, পরিবেশ সুস্থ না হলে শিশুটি কিছুতেই পড়াশোনা
করতে পারবে না।তাই তিনি শিশুশিক্ষার ব্যাপারটি
একেবারে নতুন করে ডিজাইন করলেন। তাঁর নতুন
শ্লোগান হল- রিচ আ চাইল্ড, টিচ আ চাইল্ড। একটা
শিশুকে স্কুলে আনার আগে তার কাছে পৌঁছতে হবে, তার
বাড়ি পরিবেশের উন্নতি না করলে সব চেষ্টাই জলে যাবে।
সেই যে মেয়েটি, জল তুলতে তুলতে বারবার যার ফ্রক
নেমে যাচ্ছিল আর সে টেনে তুলছিল, ফ্রকটি যদি ছেঁড়া
না হত, তার জল ভরা অনেক সহজ হত।সেইরকম,
একটা বাচ্চা যদি খালি পেটে স্কুলে আসে, তবে মিড ডে
মিল দিলে তার পেট হয়তো ভরে, কিন্তু বাড়িতে যারা
অভুক্ত, তাদের কথা তো তার মাথায় থেকে যায়,
সেগুলো তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। সে তাহলে পড়ায় মন
দেবে কী করে? বিশেষ করে যদি সে মেয়ে হয়, তাহলে
তার ওপর একটা অলিখিত শর্ত থাকে, যা খাবার পাবে,
তা বাড়িতে নিয়ে আসতে হবে। এরকম তো চোখের
সামনে দেখেছেন শতরূপা। বাড়ি থেকে থালা বা গামলা
এনে তাতে মিড ডে মিলের খিচুড়ি নিয়ে সেটা বাড়ি
রেখে আসতে যাচ্ছে ছোট্ট মেয়ে, কারণ তার ভাই খাবে,
বাবা খাবে, সেখান থেকে হয়তো এক গাল তার পেটে
যাবে, তাও হয়তো যাবে না। এরকম অবস্থায়, সে ক্লাসের
পড়া পড়বে কী করে?
আসলে অনেক ভালো ভালো প্রকল্প থাকে, তাদের উদ্দেশ্য
নিশ্চয় ভালো, কিন্তু অনেক ডট থাকে যাদের জোড়া হয়
না, সেই বিন্দুগুলোকে জুড়তে হবে। জয়েন দা ডটস।
অনেক ফাঁকফোকর থাকে যেগুলো ভরাট করতে হবে। এই
কাজগুলোর জন্যে একটা গ্রামকে ধরে এগোতে চেয়েছেন
শতরূপা। পরে সেটাই মডেল হয়ে যাবে, আর বাকিরা যা
অনুসরণ করবে। সেই গ্রামটাই হল আনুড়িয়া। ওখানে
একবার, দুবার গিয়েছেন। তিনি সামনে থেকে কাজ করেন
না, এখনো একটা ভয় কাজ করে। যদি কেউ চিনে ফেলে
তাঁকে। কিন্তু এত বছর পরে কে আর চিনবে? আর
আনুড়িয়া এমন এক আশ্চর্য গ্রাম, বাইরের সঙ্গে তার
কোন যোগাযোগ নেই বললেই হয়, তবু সেখানে পড়ে
থেকে কাজ করেন না শতরূপা। চলে আসেন, আর প্ল্যান
দেন। এটাই।
এখন সেই গ্রামটাকে কেন্দ্র করেই তাঁদের যাবতীয় কাজ
কর্ম ঠিক হচ্ছে। শুধু যে মডেল গ্রাম তাই না, এতগুলো
লোকের থাকার জন্যেও সেখানে একটা বাড়ি ঠিক
হয়েছে।বাড়িটার সুবিধে হচ্ছে সামনের অংশটা পোড়ো,
পেছনের দিকটা যথেষ্ট ভালো। সেখানটায় যতটা সম্ভব
ভালো ব্যবস্থা করে নিয়েছেন তাঁরা। বিচিত্র পেশার লোক
এসে জুটেছে, তাই বাড়িঘর সারাই, কলের কাজ,
ইলেক্ট্রিকের কাজ –এইসবে বাইরে থেকে লোক আনতে হয়
না। তবে এখানে যতজন আছে, তার বেশি অনেক বেশি
লোক আছে বাইরে। তারা ভিড়ের সঙ্গে মিশে আছে,
মিছিলে গলা ফাটাচ্ছে, ক্লাবে বসে গুলতানি করছে,
অ্যাকশন, হ্যাঁ অ্যাকশন করছে, মারাও যাচ্ছে, আবার
জন্মাচ্ছে। তারাই একদিন সব বদলে দেবে।
একতলা, দোতলায় সব কাজ একনজরে দেখে শতরূপা
ওপরে চলে এলেন। তিনতলার ছাদ। এত বড় ছাদ হতে
পারে, না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। শতরূপা সেই
ছোটবেলায় মেদিনীপুর শহরে কমিউনে থাকার সময়
এরকম ছাদ পেয়েছিলেন, যদিও তার রেলিং খুব উঁচু ছিল
না আর তাঁরা খুব ডানপিটেও ছিলেন, তাই মা কাকিমারা
সবসময় ছাদের দরজায় তালা দিয়ে রাখতেন। শীতের
দুপুর আর গরমের সন্ধে, মায়েরা ছাদে সময় কাটাতেন,
অনেকখানি সময়, একমাত্র তখনই ছাদে আসার অনুমতি
পাওয়া যেত।সেই দিনগুলো যেন সোনার জলে লেখা খুব
দামি লেদার বাউন্ড বইয়ের মতো। খুব যত্ন করে তাকে
রাখা আছে। শীতের দুপুরে মায়েরা বড়ি দিতে দিতে গল্প
করতেন, আমলকী কেটে নুন মাখিয়ে শুখোনো হত।
মাদুর পেতে লেপ বালিশ রোদে দেওয়া হত। আর সেই
লেপ বালিশ দিয়ে তাঁবু বানিয়ে ওঁরা খেলতেন। মাঝে
মাঝেই বকুনি দিতেন মায়েরা লেপ নোংরা করার জন্যে।
কিন্তু তাঁরা বুঝতেন, সে বকুনি ধর্তব্যের মধ্যে না।
মায়েরাও এই মুহূর্তগুলো এত উপভোগ করতেন, যে
এইসব ছোটখাট অপরাধ রোদে ভেসে ভেসে, হাওয়ায়
ভেসে ভেসে কোন অনির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে চলে যেত।
মনে আছে রোদের দিকে বেশিক্ষণ চাইলে মনে হত লাল
গোলাপী সবুজ রঙের বুদ্বুদ হাওয়ায় ভেসে চলেছে।
শতরূপার মনে হত তিনি নিশ্চয় বিশেষ প্রতিভাবান শিশু,
স্পেশাল। বড় হয়ে বিরাট কেউ হবেন।
এই ব্যাপারটা তাঁকে এত উত্তেজিত করেছিল যে কোন
বন্ধুকে জিগ্যেস করতে সাহস পাননি, তারাও এরকম দেখে
কিনা। যদি জানেন তারাও এরকম দেখে, তবে তো তাঁর
এক্সক্লুসিভনেস কিছু থাকবে না, স্বপ্নটা ভেঙে খানখান হয়ে
যাবে।
আজ ছাদে এসে সেই বুদ্বুদগুলো ফিরে পেতে চাইলেন,
স্বাভাবিকভাবেই পেলেন না। কারণ রোদ্দুরের দিকে
তাকিয়ে থাকার মতো সময় তাঁর নেই, মাথায় সবসময়
নানা কাজ থই থই করছে।
ছাদে এসে তিনি দেখলেন, বাড়ির সবাই প্রায় এখানেই
আছে। ছাদের একপাশে কিছু নারকেলপাতার কাঠি জড়ো
করা ছিল, সেগুলো ভেঙে ভেঙ্গে ছাদের মেঝেতে একটা
কীসের যেন নকশা তৈরি করছেন অমরনাথ। তাঁকে কি
এই কাজটাও দেওয়া হয়েছিল? মনে পড়ছে না শতরূপার।
অমরনাথ হঠাৎ দেখলেন তাঁর নকশার ওপর কার যেন
ছায়া। তিনি চোখ তুলে প্রথমে বুঝতে পারলেন না এ
কে। রোদে তাঁর চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছিল।ক্রমে এক
অতিকায় মূর্তি তাঁর নজরে এল। বহুদিন আগে টিভিতে
এক ঝলক একটা হিন্দি ব্লক বাস্টার দেখেছিলেন। বাবা
মায়ের হত্যার প্রতিশোধ নিচ্ছে রাস্তা থেকে উঠে আসা
এক দীর্ঘদেহী যুবা। অমিতাভ বচ্চন ছিলেন সে চরিত্রে।
আততায়ীর মুখের ওপর এইভাবেই ঝুঁকে এসেছিল তার
ছায়া।এই দীর্ঘ ছায়া যখন কোন মানুষের মুখে পড়ে, তার
বাঁচার আশা থাকে না। ভয়ে কেঁপে উঠলেন অমরনাথ।
তাজমুল আর ঝুঁকে পড়ল তাঁর নকশার ওপর।
কুন্তল এগিয়ে এসে শতরূপাকে বলল ‘ভালো লাগছে না
বুঝলেন, আপনার কাজ আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
একটা ন্যাশনাল চ্যানেল ডাকছে বারবার । ভাবছি জয়েন
করব।’
শতরূপা কোন উত্তর দিলেন না। কুন্তল তো যাবেই, ওকে
আটকে রাখা যাবে না। কিন্তু ওকে ফিরে আসতেই হবে
তিনি নিশ্চিত।
ছাদের একদম অন্য প্রান্তে একটি মেয়ে একা একা অংক
করে যাচ্ছে। ওকে বাচ্চাদের পড়ানোর কাজে লাগাতে হবে।
আর তার খুব কাছে বসে বিস্ময়ে মুগ্ধতায় ওর অংক
কষা দেখছে যে লোকটা, তাকে কি চেনেন উনি? একি!
এ যে পদ্মনাভ! পদ্মনাভ ফিরে এসেছে শুধু নয়, ওর
মুখে কেমন একটা জীবন্ত অভিব্যক্তি।এই প্রথম এমন হাসি
ওর মুখে ফুটতে দেখলেন শতরূপা। তাঁর হিংসে হচ্ছিল।
তিনি পদ্মনাভকে বিদ্রূপ করে কিছু বলতে যাবার আগেই,
হঠাৎ একটা নতুন মানুষ সেখানে হাজির হল। তার হাতে,
কি আশ্চর্য একটা টেস্টটিউব।
মেয়েটা তার দেবী প্রতিমার মতো মুখটি তুলে বলল ‘এটা
কী?’
‘তুমি যে চারজনের কথা বলেছিলে, দেখো এর মধ্যে।
ওরা আস্তে আস্তে ছোট হয়ে গেছে। আর দেখো ওরা যে
এত ছোট, ওরা বুঝতেও পারছে না। দেখো দেখো, এর
মধ্যেও ওরা আটভাট বকে যাচ্ছে। কাকে লেকচারার
পোস্টে নেবে, কাকে হুড়ো দেবে, কার প্রোমোশন
আটকাতে হবে, কাকে নিয়ে জোকার রিসর্টে যেতে হবে,
সব, সব ঠিক করে যাচ্ছে’
মেয়েটা অস্ফুটে বলল ‘কেয়ার অব বকুলতলা। এতদিন
সেখানেই সব ঠিক হয়ে এসেছে’
লোকটা টেস্টটিউবটা নাচাতে নাচাতে বলল ‘আর হবে
না’
‘না। ওটা রেখে দাও। জিন নিয়ে কাজ করা মানুষটাও
হারিয়ে গিয়ে এখানে চলে আসবে। সে এদের নিয়ে
গবেষণা করবে। জিনের কোন প্রবণতা মানুষকে এত
দলদাস করে তোলে, সেটা দেখতে হবে।’
পদ্মনাভ হাত বাড়িয়ে বললেন ‘আমি কি দেখতে পারি
ওর মধ্যে কারা আছে?’
শতরূপা আশ্চর্য হয়ে দেখলেন পদ্মনাভর কথা ওরা কেউ
শুনতে পেল না। সম্পূর্ণ উপেক্ষা করল। খুব রাগ হল
তাঁর, পদ্মনাভ যতই খারাপ কাজ করে থাকুক, একজন
সম্মানীয় ব্যক্তি তো বটে, এরা কোথাকার হরিদাস তাঁকে
এমন ইগনোর করছে? তিনি রেগে বললেন ‘উনি কে
জানো? আর যাই হোক, কোন করাপশনের দাগ ওঁর
গায়ে নেই। সেইটুকুকে অন্তত শ্রদ্ধা করো’
কি অদ্ভুত, ওর দিকে তাকাল না কেউ, শুনতেই পেল
না, যেন মাঝখানে একটা পর্দা দেওয়া, তিনি ওদের
দেখতে শুনতে পাচ্ছেন, কিন্তু ওরা তাঁকে পাচ্ছে না, যেমন
ওরা পাচ্ছে না পদ্মনাভকে।
রাগে দুঃখে তাঁর কান্না পেল। তিনি, শতরূপা ব্যানার্জি,
তিলতিল করে এই জায়গাটা গড়ে তুলেছেন, বছরের পর
বছর আন্ডার গ্রাউন্ডে লুকিয়ে থেকে প্রতীক্ষা করেছেন,
আজকের দিনটার, তাঁর জন্যে এই সমাজের ব্রাত্য
মানুষগুলো এখানে আশ্রয় পেয়েছে, আর তাঁর কথা কেউ
শুনতেই পাচ্ছে না?
তিনি ছাদের রেলিং এ থুতনি ঠেকিয়ে অঝোরে কাঁদতে
থাকেন।এই যে চমৎকার এই গ্রাম, তার ধানক্ষেত,
আলপথ, পুকুরঘাট- এইসব তাহলে কোন সময়ের? এই
ছাদ কি তাঁর ছেলেবেলার কমিউনের ছাদ থেকে আলাদা?
এই রোদ, হাওয়া কি তাঁর স্বর শুনতে পাচ্ছে? তিনি
কোন সময়ে আছেন? নাকি হারিয়েই গেছেন সময়ের
মানচিত্র থেকে?
হঠাৎ কে যেন পাশে এসে দাঁড়াল। খুব সংকোচের সঙ্গে
বলল ‘ম্যাডাম, দুঃখ করবেন না। আমি এসে থেকেই
দেখছি আপনার এই জায়গাটায় না, সময়ের খোপ খোপ
করা’
-মানে?
-মানে একটা খোপ থেকে ডাকলে অন্য খোপে পৌঁছয়
না।বাইরেও অবশ্য এরকম ছিল। অনেকসময় আমার কথা
বাপিদা কি কেতো শুনতেই পেত না। মার কথা আমি।
আমার কথা ওই লোকটা, যে আমার বাড়ির ছবি
আঁকছে। এরকম হয় ম্যাডাম। জীবনটা এইরকম। সবাই
আলাদা আলাদা খোপে থাকে। কিন্তু দেখবেন, এগুলো
একদম পারমেন না। কখন যে কে কার খোপে ঢুকে
পড়বে আপনি বুঝতেও পারবেন না’
ঠিক সেইসময় কুন্তল ছুটতে ছুটতে এসে বলল ‘আমাকে
বেরোতে হবে এক্ষুনি, ন্যাশনাল হাইওয়েতে একটা
অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। হেভিওয়েট একজন, গাড়ি নয়ানজুলিতে
পড়ে গেছে, সেটা কভার করতে হবে’