
সৃজিতা সান্যাল-এর কবিতাগুচ্ছ
নিসর্গ
১.
আমাকে অনন্ত করে
চলে গেল আশ্বিনের চাঁদ।
কোলে তার লগ্নভাঙা একান্ত আঁধার।
দীঘি শান্ত হয় যত ধীরে সেই অগম্য চূড়ায় পৌঁছে যাই
অবারিত
বুকে হাঁটে কালসর্পযোগ
এখানে মন্দির কই?
মেঘ লাগে রুপোলি জরিতে।
২.
এসো এ দিনের শেষে।
ঢেউতোলা সমস্ত নিকষ গুছিয়ে রেখেছি।
(এমত আঁধারে রাত্রিজাগা চোখের তারকা নিষ্প্রভ হয়।
দেহ ভাঙে রক্তমুখী নীলা…)
পা ডুবিয়ে বসি, আয়!
জল বাড়ে যমজ নদীতে।
৩.
ঈশ্বর একদিন এ পৃথিবী, নদী ও পাহাড়
বিনাশর্তে লিখে দিল
তবু
সেই দ্রুমমূলে মাটির প্রদীপখানি
কোন সোমত্ত বিভায় জ্বলে!
দেখতে রোজ ফিরে আসি
যেন অন্ধ, আলোর কাঙাল!
উপসম্পদা
সংশোধনপর্ব শেষে এ কবিতা নিজস্ব ক্লান্তির
জরা-ব্যাধি-মৃত্যু ছুঁয়ে যেইভাবে কুমারের রথ
ভুলের ওপারে ভুল। শাস্তা এই জেতবনে নেই।
পায়েসের ভাণ্ড ফেলে চলে গেছে একাকী সুজাতা…
করুণাসন্ধানে তবু দীপ্ৰ বুঝি হয়েছে কাজল?
শূন্যমার্গে এইটুকু। এতাদৃশ অঞ্জলি। অহং।
পাথর বিষয়ক, আগুন বিষয়ক
ত্বরান্বিত করো দোর, মেঘকিশোরীর চেনা ফুল
আমি তো দুর্গের কাছে কোনও ভ্রম কখনও রাখিনি।
প্রথম শ্রাবণদিনে প্লুতপ্লাবনের ধার ঘেঁষে
সমবেত মুখচ্ছবি, অনিকেত। সুধাভাজনের।
ভেবেছিলে ছুঁড়ে দেবে দশ লক্ষ নারায়ণী সেনা
নিজে না এসেই দেবে বরাভয়! কবচকুণ্ডল!
অতএব নষ্ট হোক লিপিমালা, অনাহত স্বর
তোমার প্রাচীরমূলে রেখে আসি স্বর্ণাঞ্জলি।
কোনও শোক তোমাকে দুর্বার করেনি
কদাপি তাই তুচ্ছতায় ভাসাও সন্তাপ?
ত্বরান্বিত করো সাজ টোকা পড়ে প্রধানদুয়ারে
হস্তপুট রেখাহীন। পাহারায় পাথরপ্রতিমা
তাদের হৃদয়কুচি রেখেছিলে মুঠিবদ্ধ করে
তবে কোন প্রার্থনায়, অর্গ্যানমাফিক কোন সুরে
দুর্গদ্বারদুটি স্পষ্ট বাজুবন্ধে নামাবে মৃদুতা!
নিমীলিত করে নিই রাত্রিজাগা চোখের পলক
পাথর ও আগুনের উচ্চতর গলনাঙ্ক ছুঁয়ে।
বীজপত্র সিরিজ
১.
ঘৃণার যদি কোনও চেহারা থাকত তাকে দেখতে হতো এক অন্ধ রমণীর মতো।
কালো জোব্বার আড়ালে লুকোনো তার ধারালো ছুরির ফলায় হাতের তেলো ছিন্নভিন্ন হয়।
সে কাঁদে না। চিৎকারও করে না।
কেবল গুহার আঁধারে বুকে হেঁটে বেড়ায় তার অট্টহাসির শব্দ, হিংসার অশরীরী প্রতিধ্বনি। তার সর্পিল নিশ্বাসে সহস্র বছরের বিবমিষা জট পাকানো।
আর
দুই ভুরুর মাঝখানে
তীব্রতম বিশ্বাসঘাতকতার চেয়েও তীব্র
তার জন্মদাগ
২.
বেশিদিন বদ্ধ জলার মধ্যে থাকতে থাকতে মানুষ বোবা ও অন্ধ হয়ে যায়। তার ঘর দিয়ে অকারণে বয়ে যায় বসন্তের বাতাস। সে টের পায় না। আরামকেদারায় বসে নিশ্চিন্তে ঝিমুতে থাকে খবরের কাগজ হাতে। পলাশ ফোটে। এবং তার ঘাড় বেয়ে গড়াতে থাকে কষাটে রক্তের গন্ধ। নিশ্চিন্তে। সে টের পায় না।
কাচের বয়ামে বেশিদিন থাকতে থাকতে মানুষ বধির ও খঞ্জ হয়ে যায়। সে দেখে তার সামনে প্রদীপ ফুঁড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে আলাদিনের আশ্চর্য জিন। তাকে জিজ্ঞেস করছে কী চাই। প্রথমে মোলায়েম। পরে দবদবে গলায়। আর কী চাই কিছুতেই মনে পড়ছে না বলে সে ধীরে ধীরে সেঁটে যাচ্ছে দেয়ালের গায়ে। যেন অদৃশ্য থাকাই তার এক ও একমাত্র লক্ষ্য।
নির্বাচিত অসুখগুচ্ছ
ডিসট্যান্সিং
কতদূরে গেলে ঠিক গ্রহগুলি তারা হয়ে যায়?
এইখানে পড়ে থাকি তারকাঘাতের ক্ষত নিয়ে।
হাইপক্সিয়া
ডাক্তার যে বলে গেল, রক্তে এত প্রাণবায়ু কম
দৃশ্যতই বেঁচে আছি অথচ কী অনাবিল সুখে!
ডেথবেড
এই তো ও পাড়া থেকে ঘুরে এলে কত অনায়াসে
তুমি, তুমি, এবং তুমিও।
প্রশ্ন করি তবে?…
ইমিউনিটি
শিরা ও ব্লেডের মাঝে যতটুকু ব্যবধান ছিল
সেখানেই পাখি ডাকে। ঘাসে দোলে সকালশিশির।
নগরপত্তন হয় ওই জমিজিরেতের কোলে।
ভ্যাকসিনেশন
ক্ষত নেই, ব্যাধি নেই কোনও
কিন্তু ব্যূহ বেঁধে চলে শ্বেতবর্ণ শোণিতকণিকা।
খুব ভাল লাগল।
সৃজিতার কবিতায় ভাবপ্রবাহের চকিত বাঁক, ইমেজ শিফ্টিং বেশ ভালো। ভবিষ্যতে এই কবির আরও কবিতা পড়ার অপেক্ষা থাকল।
ভীষণ ভালো লাগল। প্রতিটি কবিতাই।