‘শীত ও সহোদরা’- মরমিয়া এবং আধুনিক, স্বতন্ত্র অথচ আন্তরিক
দিব্যেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
শীত ও সহোদরা/ হাওয়াকল পাবলিশার্স/ প্রচ্ছদ- বিতান চক্রবর্তী / মূল্য-- ২০০ টাকা প্রাপ্তিস্থান- www.hawakal.com
এমিলি ডিকিনসন তাঁর কবিতায় লিখেছিলেন, “ওয়ান সিস্টার হ্যাভ আই ইন আওয়ার হাউস”। এছাড়াও লিন্ডা রডরিগেজ লিখেছিলেন, ‘ডার্ক সিস্টার, পোয়েমস’। কিন্তু বাংলায় শুধু বোনকে নিয়ে লেখা একটি সম্পূর্ণ কাব্যগ্রন্থ এক অভিনব সংযোজন সন্দেহ নেই। বিশেষ করে, কবিতা যখন মনস্তত্ত্ব এবং অবচেতনের নানা রাজ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে, আর তার সেই অভিযাত্রার মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসে মানব সম্পর্কের সম্পূর্ণ নতুন এক অধ্যায়, তখন কবিতার খণ্ড ইতিহাসেও তা নতুন এবং সামগ্রিক ইতিহাসে তা অভিনব বলা যেতেই পারে।
বেবী সাউয়ের কাব্যভাষা ক্রমপরিবর্তনশীল। যদিও শুধু কাব্যভাষার পরিবর্তনশীলতাই কবির কবিতাকে উন্নীত করে না। তার সঙ্গে প্রয়োজন হয় কবির ব্যক্তিত্ব এবং ভাবনাজগতেরও পরিবর্তনের। কাব্যভাষার যে সাবলীল বয়ানে তিনি ‘গান লেখে লালনদুহিতা’ থেকে শুরু করেছিলেন, তা সামান্য হলেও দুরূহ হয়ে যায় ‘ছয় মহলা বাড়ি’-তে। কিন্তু সেই কাব্যভাষা থেকে তিনি বেরিয়ে আসেন ‘একান্ন শরীরে ভাঙো’-কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলির মধ্যে। যে বিষয়টি এখানে গুরুত্ব দেওয়ার, তা হলো, এক কাব্য-পরিব্রাজকের মতোই তিনি এক একটি কাব্যগ্রন্থে এক একটি অঞ্চলে বিচরণ করেছেন। ফলে ‘হেমন্তের অন্নপূর্ণা’ বা ‘ ছায়াপথের পরিযায়ী’ কাব্যগ্রন্থে তিনি সম্পূর্ণ অন্যরকমের এক ভাষা, ছন্দ এবং কাব্যভাবনায় বিচরণ করেন। কিন্তু তার পর থেকে তাঁর কবিতা ক্রমশই বদলে যাচ্ছে এবং কবিতাগুলি হয়ে পড়েছে আরও সহজ, অথচ তরল নয়। কবিতার ঘনত্ব কাজ করেছে কবিতার অভ্যন্তরস্থ ভাবনার ভিতর। ফলে, কবিতার মধ্যে আসছে এক স্বতন্ত্র স্বর। এই স্বর, কবিতাকে পৌঁছে দিচ্ছে অনন্য কাব্যিক নির্মাণে। এখানে অন্তঃ-সন্দর্ভের মধ্যে থেকে কবি সাবলীল ভাবেই তুলে এনেছেন একধরনের সংলাপের সংযোজনা।
‘শীত ও সহোদরা’ এক নতুন অনন্য পথে পড়ে থাকা গন্ধচাঁপার কলি। কেয়া বনের ঝোপ পেরিয়ে কুড়িয়ে পাওয়া শামুক। হ্যারিকেনের আলোয় খুঁজে আনা অনন্ত অনুভূতিমালা। যে অনুভূতি শব্দ দিয়ে সাজিয়েছে দৃশ্যের পর দৃশ্য, আলোর পর জোছনা। যে জোছনায় বোনকে খুঁজে পাই নতুন চেতনায়।নতুন আলোয়। কবি লিখেছেন- ‘বরাবর আমিই বোনের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হয়ে উঠতে চেয়েছি’-এই শ্রেষ্ঠ হতে চাওয়ার মধ্যেও একটা প্রশ্ন রয়েছে। যে প্রশ্ন কবির চতুর্থ কবিতায় পরোক্ষভাবে পাই,- ‘প্রতিটি পরিচয় তুলে নিচ্ছে একা, বোন’। এর পরের কবিতায় আরও স্পষ্ট হচ্ছে ভাবনা- ‘বোনের দিকে মুগ্ধ তাকিয়ে থাকতে থাকতে/ অনুভব করেছি আড়ালে বসে আছে বাঘ’। গভীর অন্ধকারের ভিতরেই যেন আমাদের অনুসন্ধান এই বোন আসলে কে? তখনই সেই অমোঘ লাইনের সামনে এসে দাঁড়াই- ‘বোবা,মূক, অসহায় আমি/ তবুও দাঁড়াই এসে শান্ত আত্মজার কাছে’। যে রাগ,অভিমান, ঈর্ষা জমেছিল এতদিন, বোনের উপর তা আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে যায়। দেশের বাড়িতে তারা মুখোমুখি শুয়ে থাকে আর অনুভব করে- ‘সামান্য দ্বেষের রাজ্য ছাড়া আমাদের হারানোর মতো কিছু নেই’। এই বোধের কাছে কবি আমাদের পৌঁছে দেন অনুভবের তানপুরায়। আর বলেন- ‘ তারপরেও আমরা দু-জন বন্ধু…’। এই বন্ধুত্বকে আবার শীত এলে নিঃসঙ্গ করে দেয়। যেভাবে শীতে সমস্ত গাছেরা নিঃসঙ্গ। কাব্যগ্রন্থের আবার শেষদিকে এসে কবি বলেছেন- ‘ বোন আর আমি একে অপরের সমকক্ষ হতে চেয়ে…/ নিজেকেই নিজে হারিয়ে ফেলেছি’। যে শ্রেষ্ঠ হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন, তিনিই নিজেকে হারিয়ে ফেলেছেন,শান্ত,সমাহিত হতে হয়েছেন, বুঝতে পেরেছেন তার ভিতরে থাকা শত্রুতা কমে আসছে। এবং কবি শেষে বলেছেন- ‘একমাত্র আমার নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বোনকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে’। আর এই বোন আর কবি যেন সবশেষে একাকার হয়ে গিয়েছেন। এখানেই কবি বেবী সাউ এক অভিনব পথে হাঁটতে চেয়েছেন। বেঁধে রেখেছেন ‘শীত ও সহোদরা’ কাব্যগ্রন্থের মরমিয়া সুর।
যদিও, এই মরমিয়া সুর অভিনব। এই মরমিয়া সুরের ভিতর আধুনিকতার স্পর্শ অনেকটাই বেশি। তিনি নাগরিকতার প্রচ্ছন্ন বিষাদের অন্ধকারকে লালন করেছেন ভিতরে, তবু, সেখানে রয়েছে মাটির গন্ধ। এই বেবী সাউই গবেষণা করেছিলেন ‘কাঁদনাগীত’ নিয়ে। কঁদনাগীতের সহজ সরল কবিতার মধ্যে যে রূপক প্রতীক এবং অলঙ্কারের জগত, তা তাঁকে সাহায্য করেছে বাইরে এক সহজ ভাষার আস্তরণ রেখে ভিতরে অপেক্ষাকৃত জটিল ভাবনার প্রকাশে। ‘শীত ও সহোদরা’ কাব্যগ্রন্থের পরতে পরতে কবি বাইরের ন্যারেটিভকে যত সহজ করেছেন, ভিতরের কথাগুলিকে ততই করে তুলেছেন দ্বিস্তর বা ত্রিস্তর-সম্পন্ন।
কাব্যভাষার এই ব্যবহার অভিনব না হলেও, বিষয়ের সঙ্গে আঙ্গিকের এই দ্বৈত-সম্পর্কের বয়ান বেবী সাউয়ের এই কাব্যগ্রন্থটিকে করেছে স্বতন্ত্র। হয়তো আগামীদিনে কখনো এই কাব্যগ্রন্থ নিয়ে নানা রকমের অর্থ আবিষ্কার সম্ভব। কবিতায় যদিও নারী-পুরুষের ভেদাভেদ নেই, তবু, এই কাব্যগ্রন্থের অনেক জায়গাতেই, নারীর বিশেষ বিশেষ মনোজগতের উন্মোচন হয়েছে। যা মানবমনের বিচিত্র জগতের দিকেই ইশারা করছে। ইশারা করেছে মরমিয়া মনের একাকী পড়ে থাকা গন্ধচাঁপার কলির কাছে।