শঙ্খ ঘোষের ‘মানে’
স্বপন চক্রবর্তী
" সহজযান বললে আবার অষ্টম শতকের তান্ত্রিক বৌদ্ধমার্গের কথা মনে আসে, মনে আসে চর্যার সন্ধাভাষার কথা। মহাযান বৌদ্ধপন্থার এই গুরুবাদী মার্গে তপশ্চর্যা নয়, সিদ্ধাচার্যদের শরণ নেওয়াই মুখ্য। অনুত্তর যোগে আস্থা থাকলেও এই মত অনুসারে ভোগে অনাসক্তি অহেতুক, কারণ জগৎ শূন্য, ফলে পাপ-পুণ্যেরও কোনও তাৎপর্য নেই। এটি যে বৌদ্ধ ভাবুক নাগার্জুনের (দ্বিতীয়-তৃতীয় সাধারণাব্দ) শূন্যবাদের ঈষৎ তরলীকৃত বিকল্প এমনও ঠিক নয়। নাগার্জুনের দর্শনে সত্যের দ্বিত্ব সুবিদিত। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুজগতে সংবৃতিসত্য আছে, তা নির্বাণের একরকম পথ, কিন্তু তাতে পরমার্থসত্য নেই। বস্তু ও ঘটনা মূলত নিঃস্বভাব, এবং স্বভাব ব্যতিরেকে তারা তাৎপর্যহীন, শূন্য। এহেন পরমার্থের অনুপস্থিতিই শেষ বিচারে অস্তিত্ব তথা অনস্তিত্বের ‘মানে’। এই মানে না থাকাই কি তবে ‘মানে’?" স্বপন চক্রবর্তীর কলমে।
মূর্খ বড়ো, সামাজিক নয় (রচনাকাল ১৯৭২-৩; প্রকাশকাল ১৯৭৪) গ্রন্থে শেষ কবিতাটি শঙ্খ ঘোষের পাঠকের মনে থাকবে। শঙ্খ ঘোষের বহুশ্রুত আর দশটি রচনার মতো নয় সেটি। কবিতার নাম ‘মানে’। খানিকটা ভিলানেলের ঢঙে লেখা পাঁচটি ত্রিপদীর পরে দুটি আলাদা স্তবকে ভাগ করা পঙ্ক্তি, সেটি আবার মন্ত্রের মতো একই শব্দমালার পুনরুক্তি। সম্পূর্ণ কবিতাটিতে রয়েছে একই অন্ত্যমিলের দম বন্ধ করা প্রয়োগ, এমনকী শেষের দুটি পুনরাবৃত্ত চরণেও তা-ই। রীতিটি খানিক অচেনা, আরবি পদ্যে বরং এর চল বেশি। পুরো কবিতাটি উদ্ধৃত করছি আলোচনার সুবিধের জন্যে।
মানে
কোনো-যে মানে নেই, এটাই মানে।
বন্য শূকরী কি নিজেকে জানে?
বাঁচার চেয়ে বেশি বাঁচে না প্রাণে।
শকুন, এসেছিস কী-সন্ধানে?
এই নে বুক মুখ হাত নে, পা নে—
ভাবিস পাবি তবু আমার মানে?
অন্ধ চোখ থেকে বধির কানে
ছোটে যে বিদ্যুৎ, সেটাই মানে।
থাকার চেয়ে বেশি থাকে না প্রাণে।
ছুটেছে উন্মাদ, এখনো ত্রাণে
রেখেছে নির্ভর, সহজযানে
ভাবে সে পেয়ে যাবে জীবনে মানে!
বিভোর মাথা কেউ খুঁড়েছে শানে
কিছু-বা ভীরু হাত আফিম আনে—
জানে না বাঁচে কোন্ বীজাণুপানে:
কোনো-যে মানে নেই সেটাই মানে।
কোনো-যে মানে নেই সেটাই মানে।
কবিতাটিতে প্রশ্ন বেশি, উত্তর কম। যে বাক্যগুলিতে সরাসরি প্রশ্ন করা হয়নি, যেমন তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম স্তবকে, সেখানেও রয়েছে অমীমাংসিত সমস্যা অথবা অনির্দিষ্ট উত্তরের ইঙ্গিত—‘থাকার চেয়ে বেশি থাকে না প্রাণে’, ‘ভাবে সে পেয়ে যাবে জীবনে মানে’, ‘জানে না বাঁচে কোন্ বীজাণুপানে’। উত্তর আসছে আগে, প্রশ্ন পরে। প্রথম পঙ্ক্তিটিই একরকমের উত্তর। কবিতার শেষে গোড়াকার পঙ্ক্তিটি ফিরে আসে প্রায় উত্তর হিসেবেই—একবার নয়, দু-বার, দুটি স্তবকে ভাগ করে। বাক্যটিতে কেবল একটিই বদল ঘটানো হয়েছে। ‘এটাই’ শব্দটির জায়গায় বসেছে আরও নিশ্চিত পদ ‘সেটাই’, যেন নির্দেশক সর্বনামটি থেকে পাঠক ধরে ফেলতে পারবেন উত্তরটি, যেন ‘সেটা’ বলা হয়ে গেছে পূর্ববর্তী পঙ্ক্তি কটিতেই। তা ছাড়া বাদ গেছে ‘নেই’ শব্দটির পর যতিচিহ্নটি, যেন নিশ্চয়তার কারণে সেটির প্রয়োজন ফুরিয়েছে।
দ্বিতীয় পঙ্ক্তিতে আসছে ‘নিজেকে জানার’ কথা, অর্থাৎ আত্ম-চেতনার প্রসঙ্গ। জ্ঞানের বিষয়ী কে? তার আধারই বা কী? পঙ্ক্তিটিতে অন্তত বিষয়ী বন্য শূকরী; আধার, প্রাণ। বন্য শূকরী কেবল বাঁচে, তার বেশি তার প্রাণে আর আঁটে না, তার জীবধর্মের আর কোনও বিস্তার নেই। এটাই যদি হয় পঙ্ক্তি দুটির বলার কথা, তবে ধরে নেওয়া স্বাভাবিক যে আমরা, যারা ‘বন্য’ নই, আমাদের রয়েছে জৈব প্রাণের অতিরিক্ত কিছু। জীব হিসেবে আমরা যে খানিক মার্জিত, আমাদের অস্তিত্ব যে কেবলমাত্র বন্য প্রাণধারণে সীমাবদ্ধ নয়, আমাদের যে রয়েছে ন্যূনতম আত্মসচেতনতা, অথবা ধূসরতম অর্থে হলেও আত্মজ্ঞান—এমনটা ভাবতেই প্ররোচিত হ’ন পাঠক প্রথম তিন পঙ্ক্তির স্তবকের শেষে। সচেতনতার বিচারে মানুষ কি প্রকৃতিতে এক অদ্বিতীয় ব্যতিক্রম, যেমনটা এককালে ভেবেছিলেন প্রাণীবিদ্ রবার্ট ওয়েন (১৮০৪-৯২)? তাঁর মনে হয়েছিল যে, মানবমস্তিষ্কে ‘হিপোকাম্পুস মাইনর’ নামের একটি অংশ আছে যার ফলে মানুষ অন্য সকল ‘এপ’ অর্থাৎ উচ্চতর বানর-জাতীয় পশুর থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। এই মত গোঁড়া সৃষ্টিবাদী আস্তিক ছাড়া আজকাল কেউই মানেন না, যদিও উচ্চতর ‘এপ’ থেকে মানুষে উত্তরণ যে এক পর্বান্তর বা ‘ফেজ ট্রান্জিশন’ সে কথা প্রায় সকল জীববিজ্ঞানী মেনে নেন।
কিন্তু বিবর্তনের পর্যায়ক্রমে গুণসূচক এক ভেদরেখা লঙ্ঘন করে বিশেষ কোনও মুহূর্তে—সে মুহূর্ত সহস্রাধিক বৎসর জুড়ে ব্যাপ্ত হলেও—এক মৌলিক পর্বান্তর দেখা দেওয়া এক জিনিস, আর আত্মসচেতনতা, অন্তত নিজের সংহত প্রাণীরূপের ঐক্য সম্পর্কে প্রবৃত্তিজাত উপজ্ঞা তথা অভিজ্ঞান, আর এক স্বতন্ত্র প্রসঙ্গ। এ যুগের অনেক বিজ্ঞানী ও দার্শনিক এমনটাই মনে করেন। অনেকের বিচারেই মানুষ ছাড়াও অন্যান্য কিছু প্রাণীর একরকমের বিষয়ীসত্তার বোধ আছে, আছে ন্যূনতম আত্মতার অভিজ্ঞতা, আছে আবেগ ও স্মৃতির সংহতি, নির্মাণ ও অনুকৃতির দক্ষতা, দর্পণে নিজের চেহারা শনাক্ত করার বুদ্ধি, এমনকী আছে বোধগম্য একরকমের ভাষা। এই মতের সমর্থনে ২০১২ সালে বিলেতের কেম্ব্রিজে ফ্রান্সিস ক্রিক স্মারক সম্মেলনে এক ঘোষণাপত্রও জারি হয়। তাতে স্বাক্ষরকারী বিজ্ঞানী ও দার্শনিকরা রায় দেন যে, মস্তিষ্কের গঠন ও ক্রিয়ার সাদৃশ্যের ভিত্তিতে বলা যেতেই পারে যে, মানুষের মতো অন্যান্য প্রাণীরও চেতনা আছে। অনুমান করি, আছে বন্য শূকরীরও। স্থূল বিচারে, পশ্চিমের বিজ্ঞানীরা এখন স্পষ্টত দু-দলে বিভক্ত। একদল (যেমন মার্কিন ভাবুক ড্যানিয়েল ডেনেট) বিশ্বাস করেন যে, চেতনা হচ্ছে মস্তিষ্কের বিবর্তনের সূক্ষ্মতম পরিণাম। ইংরেজ দার্শনিক এবং ডেনেটের এককালের শিক্ষক গিলবার্ট রাইল পরিহাসছলে যাকে বলেছিলেন ‘গোস্ট ইন দ্য মেশিন’, চেতনা আদৌ তা নয়। অর্থাৎ তা নয় শরীরে অন্তরীন কোনও প্রচ্ছন্ন, অশরীরী অথচ সক্রিয় এবং অখণ্ড উপস্থিতি। আবার অন্য একদল (যেমন সার্বিয়ার ইহুদি বংশজাত মার্কিন দার্শনিক টমাস নাগেল) মনে করেন বিজ্ঞান ও জড়বাদে বিশ্বাস রাখা শ্রেয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও চেতনার বা বিষয়ীসত্তার ‘ইনটিরিয়রিটি’র, তার অন্তর্গত ঐক্যের সম্যক্ হদিশ পাওয়া যেতে পারে জীববিদ্যা বা স্নায়ুবিজ্ঞানে—এমন মনে করার কোনও কারণ এখনও ঘটেনি।
চেতনার জন্ম জড় শরীরে—তা না হয় মানা গেল। চেতনার ‘মানে’ও কি পাওয়া যাবে বিভাজ্য এক শরীরে, যা কিনা বিবর্তিত হয়েছে জীবধর্মের নিয়ম মেনে, যার প্রতিটি কোষ কিনা সংরচিত হয়েছে বিশেষ দৈহিক ও মানসিক প্রয়োজনে? জিনের অন্তর্গত ডিএনএ থেকে সংকেত উদ্ধার করে সংবাহক আরএনএ অণু সংকেতকে তরজমা করে নেয় নানা প্রোটিনের অনুক্রমে, সেই অনুক্রম এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী নির্ধারিত হয় জেনোটাইপ থেকে সৃষ্ট বিশেষ বিশেষ ফেনোটাইপ, তার প্রতিলিপি ফের পাই সংশ্লিষ্ট জীবের বংশধারায়। এভাবে সংগঠিত বিশেষ বিশেষ দেহকোষ নির্ণয় করে দেয় শরীরের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কাজ—বুক, মুখ, হাত, পা। খুবই মোটা দাগের হলেও এই বর্ণনায় আপাতত কাজ চলে যাবে।
দ্বিতীয় স্তবকে এই সংহিত শরীরের লোভে ঘিরে আসে শকুন, যার জীর্ণনে মানবদেহ পায় অন্য কোনও নৈসর্গিক ভূমিকা। কথক নিজে শব, জৈবিক অর্থে গতপ্রাণ এক মানবিক চ্যালেঞ্জার। তার বেঁচে থাকার মানে আপাতবিচারে তার অবসিত শরীরের মতোই নিঃশেষিত। শকুনের মুখে তুলে দেওয়া হচ্ছে একদা সজীব দেহকোষের বিচিত্র নির্মাণকাণ্ড ভাগ ভাগ করে—বুক, মুখ, হাত, পা—যে বুকে নেই হৃদয়, যে মুখে নেই ভাষা, যে হাতে নেই সৃষ্টির প্রতিভা, যে পায়ে নেই স্বাভীষ্ট গতির শক্তি। ধরে নিলাম শকুনের আছে চেতনা। যার সন্ধানে সে এসেছে—লাশের বুক, মুখ, হাত পা—তা সে পেয়ে যাবে খাদক যেমন খাদ্যের মানে খুঁজে পায়, খুঁটে নেয় অশরীরী স্বরের অধিকারীর ছিন্ন ছিন্ন দেহখণ্ড থেকে। কিন্তু সেই অর্থ উদ্দেশ্য ও ক্রিয়াতেই ফুরিয়ে যাওয়ার কথা। ‘মিনিং অফ লাইফ’ ও ‘মিনিং ইন লাইফ’, নিসর্গে প্রাণের অস্তিত্বের সামূহিক মানে (‘জীবনে মানে’) অথবা ব্যক্তির বেঁচে থাকার নিহিত মানে (‘আমার মানে’), দার্শনিকের দৃষ্টিতে যতই ভিন্ন হোক, এর কোনওটারই হদিশ সেই অর্থতে ধরা পড়ার কথা নয়। নিসর্গের গাঢ় সুপরামর্শ বা তুমুল সমাচারের মধ্যে ঠাঁই নেই এই উভয়েরই। অথচ শবের এখনও ভাষা আছে, প্রশ্ন আছে, মাত্রাবৃত্তে মাপা আমন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে আলগা বিদ্রুপ।
তৃতীয় স্তবকে উত্তর একটা আছে বটে। শবের চোখ অন্ধ, কান বধির। কিন্তু তার মাঝখানে ‘ছোটে যে বিদ্যুৎ, সেটাই মানে।’ এর পর রয়েছে এক সিদ্ধান্ত: ‘থাকার চেয়ে বেশি থাকে না প্রাণে’। এবারে আর বন্য শূকরীর প্রাণের কথা বলা হচ্ছে না, বলা হচ্ছে মানুষের কথা—দ্বিতীয় স্তবকের লাশটিকে ডিঙিয়ে। স্নায়ুকোষ থেকে স্নায়ুকোষে যে তড়িৎতরঙ্গ ছোটে তার দৌলতে অন্ধ চোখ পায় দৃষ্টি, বধির কানে সঞ্চার হয় শ্রবণের। মগজের সংকেত স্নায়ুতন্তু বেয়ে ওঠা-নামা করছে দেহের আপাতবিচ্ছিন্ন অংশে—এর ফলেই প্রাণ একটি সমন্বিত একক, নয়তো বুক, মুখ, হাত, পা নেহাতই শকুনের ভোজ। কেবল তো দৃষ্টির নয়, স্পর্শ ও পেশির অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেও তৈরি হয় বিষয়ীর নিজ দেহচেতনা। মস্তিষ্কের মধ্যেই রয়েছে সেই চেতনা সৃষ্টির কারখানা, রয়েছে ডানদিকের ‘সুপিরিয়র লোবিউল’-এর মধ্যে। নয়তো দৃষ্টিহীন মানুষের বোধে আপন শরীরের কোনও সংহত ‘চিত্র’ থাকত না। স্তবক শেষ হচ্ছে আবার এক খামতির, সীমাবদ্ধতার প্রসঙ্গ দিয়ে: ‘থাকার চেয়ে বেশি থাকে না প্রাণে।’ সদৃশ এক বাক্য দিয়ে শেষ হয়েছিল প্রথম স্তবকটি: ‘বাঁচার চেয়ে বেশি বাঁচে না প্রাণে।’ স্রেফ বেঁচে থাকার চিন্তা পেরিয়ে আমরা পৌঁছেছি প্রাণের আধেয়র প্রসঙ্গে। এবারে যেন প্রাণের তাৎপর্যটি আরও দুর্বল। বাঁচার মধ্যে তাও একরকমের গতি ছিল, অভিমুখ ছিল। কিন্তু ‘থাকা’, স্রেফ ভৌত উপস্থিতির মধ্যে আছে এক নির্জীবতা। স্নায়ুবিদ্যার অর্থে প্রাণের মধ্যে ‘আমার মানে’ কিংবা ‘আমির’ মানে খুঁজতে যাওয়া শকুনের অভিযানের মতোই বাধ্যত অবান্তর।
মানের সন্ধান পরের চরণগুচ্ছে আরও তীব্র, রীতিমতো মরিয়া। এবারের ছুট উন্মাদের ছুট, ত্রাণের আশায় সহজযানে সওয়ার হয়ে পরমার্থে পৌঁছোনোর চেষ্টা। এর পরের স্তবকে আফিমের কথা এসে পড়ায় মনে হতে পারে কবি অ্যালেন গিনসবার্গের ১৯৬১ সালের ভারত ভ্রমণের কথা স্মরণ করছেন। দিল্লির আফিমের ডেরায় তো কম ঘোরেননি গিনসবার্গ ও তাঁর সমকামী সঙ্গী পিটার অরলভস্কি। তাঁদের সংস্পর্শে এসে ‘বিভোর মাথা’-র ‘উন্মাদ’ বাঙালি কবিদের অনেকেই সহজযানের সাধনা করেছিলেন, যদিও তাঁদের প্রসঙ্গ টেনে আনার কোনও অনিবার্য হেতু নেই। বস্তুত, কবির মনে কী ছিল তা জানতে আমার আগ্রহ কম। কবিতা আমাকে কোথায় এনে ফেলছে, কীভাবে আমি তাৎপর্য নির্ণয় করছি, তথাকথিত পাঠ থেকে পাঠকের ‘আইডিয়েশন’-এর প্রক্রিয়া নিয়ে আমার কৌতূহল বেশি। কবিতার মানে আর জীবনের মানে এখানে এক অটুট জোড়, একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটিকে গড়ে তোলা একপ্রকার অসম্ভব, না মননে, না বোধে।
সহজযান। শব্দটি শুনলেই মনে হয় পরমার্থলাভের কোনও চটজলদি উপায়ের কথা বলা হচ্ছে, আফিমের মতো কোনও তাৎক্ষনিক মার্গ ধরলেই যেন বোধিপ্রাপ্তি ঘটবে, মিলবে অর্থসন্ধানের ক্লেশের থেকে ত্রাণ। আয়ু থাকতে মানুষ তার জীবনের অবিশ্লিষ্ট অর্থ খোঁজে, তাতে নিয়োজিত হয় তার বুক, মুখ, হাত, পা—কেউ কঠিন শানে খোঁড়ে মাথা, যেমন মাথা নিষ্ফল কুটেছিল রবীন্দ্রনাথের ‘প্রশ্ন’ কবিতায় উন্মাদ ‘তরুণ বালক’ কিংবা বিষ্ণু দের ‘অন্বিষ্ট’ কবিতায় ‘মরিয়া আবেগে’ ‘তরুণ কুমার’, কোনও কোনও ভীরু হাত আনে আফিম।
সহজযান বললে আবার অষ্টম শতকের তান্ত্রিক বৌদ্ধমার্গের কথা মনে আসে, মনে আসে চর্যার সন্ধাভাষার কথা। মহাযান বৌদ্ধপন্থার এই গুরুবাদী মার্গে তপশ্চর্যা নয়, সিদ্ধাচার্যদের শরণ নেওয়াই মুখ্য। অনুত্তর যোগে আস্থা থাকলেও এই মত অনুসারে ভোগে অনাসক্তি অহেতুক, কারণ জগৎ শূন্য, ফলে পাপ-পুণ্যেরও কোনও তাৎপর্য নেই। এটি যে বৌদ্ধ ভাবুক নাগার্জুনের (দ্বিতীয়-তৃতীয় সাধারণাব্দ) শূন্যবাদের ঈষৎ তরলীকৃত বিকল্প এমনও ঠিক নয়। নাগার্জুনের দর্শনে সত্যের দ্বিত্ব সুবিদিত। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুজগতে সংবৃতিসত্য আছে, তা নির্বাণের একরকম পথ, কিন্তু তাতে পরমার্থসত্য নেই। বস্তু ও ঘটনা মূলত নিঃস্বভাব, এবং স্বভাব ব্যতিরেকে তারা তাৎপর্যহীন, শূন্য। এহেন পরমার্থের অনুপস্থিতিই শেষ বিচারে অস্তিত্ব তথা অনস্তিত্বের ‘মানে’। এই মানে না থাকাই কি তবে ‘মানে’?
আবার বৌদ্ধ অভিধর্ম পরম্পরায় স্কন্ধ (বা পিণ্ড) পাঁচ রকম—রূপ, বেদনা, বিজ্ঞান, সংজ্ঞা, সংস্কার—ব্যক্তি অথবা ব্যক্তিত্ববোধের সূচক। কিন্তু এই পাঁচ স্কন্ধ বা পিণ্ডের যৌগ এক সংহত একক সৃষ্টিতে অক্ষম, কারণ পাঁচটি স্কন্ধই শূন্যগর্ভ। অর্বাচীন সর্বাস্তিবাদী সত্তাশাস্ত্রে যতই ‘ধম্মের’ বা অস্তিত্বের উপাদান সমূহের স্বতন্ত্র স্বভাব মেনে নেওয়া হোক, তা আদি বা সাধারণাব্দ-পূর্ব অভিধর্মবাদের পরিপন্থী। পঞ্চস্কন্ধ ব্যক্তিত্ববোধের হেতু হতে পারে, কিন্তু তারা কোনও বস্তুসমষ্টি নয়। অন্তিমে তারা অন্তঃসারহীন, রিক্ত, বা অভিধর্মের পারিভাষিক অর্থে তারা ‘দুঃখ’। এই শূন্যতাই কি কবিতার প্রশ্নের অন্তিম উত্তর তবে?
শূন্যবাদীর প্রতিপক্ষ মনে করতে পারেন যে, ব্যক্তিমানুষের জীবনে না হোক, সামূহিক মানবজীবনের এক গতিমুখ আছে, আছে এক প্রাক্নির্ধারিত গন্তব্য, যার কল্যাণে এই গ্রহে আমাদের ইহজীবন পূর্ণ হয়ে আছে এক অতিলৌকিক গূঢ় অর্থে। ঈশ্বরের এহেন অভিপ্রায়ে আমাদের বিশ্বাস বা অধিকার যদি না-ও থাকে, নিসর্গের কি কোনও চরম লক্ষ্য রয়েছে যার দিকে ধাবিত মানুষের জীবন, কোনও মহামানবের ‘বীজাণুপানে’ যাত্রার মধ্যেই কি আছে জড় থেকে চেতনার বিবর্তনের অভিমুখ, যা কিনা শেষ বিচারে ‘আমার মানে’ না হলেও ‘জীবনের মানে’ হয়ে দাঁড়াতে পারে? সেরকম এক বিশ্বাস শুনি নাকি আমরা ১৮৯৩ সালে লেখা রবীন্দ্রনাথের ‘সমুদ্রের প্রতি’ কবিতায়?
মনে হয়, যেন মনে পড়ে
যখন বিলীনভাবে ছিনু ওই বিরাট জঠরে
অজাত ভুবন-ভ্রূণমাঝে,— লক্ষকোটি বর্ষ ধরে
ওই তব অবিশ্রাম কলতান অন্তরে অন্তরে
মুদ্রিত হইয়া গেছে; সেই জন্ম-পূর্বের স্মরণ,—
গর্ভস্থ পৃথিবীপরে সেই নিত্য জীবনস্পন্দন
তব মাতৃহৃদয়ের—অতি ক্ষীণ আভাসের মতো
জাগে যেন সমস্ত শিরায়, শুনি যবে নেত্র করি নত
বসি জনশূন্য তীরে ওই পুরাতন কলধ্বনি।
দিক্ হতে দিগন্তরে যুগ হতে যুগান্তর গনি’
তখন আছিলে তুমি একাকিনী অখণ্ড অকূল
আত্মহারা; প্রথম গর্ভের মহা রহস্য বিপুল
না বুঝিয়া। দিবারাত্রি গূঢ় এক স্নেহব্যাকুলতা,
গর্ভিণীর পূর্বরাগ, অলক্ষিতে অপূর্ব মমতা,
অজ্ঞাত আকাঙ্ক্ষারাশি, নিঃসন্তান শূন্য বক্ষোদেশে
নিরন্তর উঠিত ব্যাকুলি। প্রতি প্রাতে উষা এসে
অনুমান করি যেত মহাসন্তানের জন্মদিন,
নক্ষত্র রহিত চাহি নিশি নিশি নিমেষবিহীন
শিশুহীন শয়নশিয়রে।
এমন অবিচল পরিণামবাদ আজ যদি বিশ্বাস্যও হয়, মানুষের পক্ষে এহেন নৈসর্গিক পরিকল্পনার কথা জানা কি সম্ভব? আফিম অথবা সহজযানে আকৃষ্ট মানুষ তো তেমন ভরসা জাগায় না: ‘জানে না বাঁচে কোন্ বীজাণুপানে’।
সহজযান এবং আফিমের আশ্রয়ে জীবনের মানে, আমার মানে, খোঁজার আকুল চেষ্টা গত শতাব্দীর ছয় ও সাতের দশকের কবিদের মধ্যে বিরল নয়, না বঙ্গদেশে, না পশ্চিমে। গিনসবার্গের বৌদ্ধ বিশ্বাসের কথা ভেবে এই কথা বলছি না। কোনও পরম নিঃশ্রেয়সের আশ্বাস না থাকলে জীবন অর্থহীন হতে বাধ্য—এমন মনে করেন হালের অনেক ভাবুক, যেমন বিলেতের দার্শনিক জন কটিংহ্যাম অথবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জেমস মোরল্যান্ড। এমন জীবন কেবলমাত্র অসংলগ্ন ঘটনার সমষ্টি, ইংরেজি লব্জতে ‘অ্যাবসার্ড’। সার্ত্র এবং তাঁর সহমর্মীদের মনে হয়েছিল মানুষের জীবনের যদি কোনও লক্ষ্য বেঁধে দেন ঈশ্বর তবে অর্থের সন্ধান মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়, গৌরবের তো নয়ই। একসময়ে আলব্যেয়ার কামুর উপন্যাস ও অ্যাবসার্ড নাটকের সুবাদে এই মতের পক্ষে-বিপক্ষে বেশ চর্চা হয়েছিল এই বাংলায়। ‘মানে’ কবিতাটিতে এই আবহেই লেখা হয়। রাজনীতিতে অতি-বামপন্থীদের আত্মত্যাগ ও তাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের নৃশংস প্রতিহিংসার পটভূমিতে এমন চর্চা বরঞ্চ কোনও কোনও সময়ে অ্যাবসার্ড বলে মনে হয়েছে আমার। তার চেয়ে ভাবা শ্রেয় যে, অতিলৌকিক নিশ্চয়তার অভাবেই হ্রস্ব ঐহিক জীবনে একরকমের হিতকাম, সত্যনিষ্ঠা ও প্রেমের তাগিদ আসতে পারে, উদ্রেক হতে পারে পৃথিবী এবং সমাজের ঋণশোধের নিরভিমান ইচ্ছা। ন্যায় ও সুনীতির সত্যমূল্যের কোনও বিষয়গত আশ্বাস নেই, এ কথা বলেন অনেকেই। এ-ও এক ধরনের শূন্যপন্থা, যা স্পষ্ট দেখা যায় সদ্যপ্রয়াত মার্কিন দার্শনিক কোয়েন্টিন স্মিথের লেখায়। এভাবে পড়লে কবিতাটিকে সমকালীন সাহিত্য, সমাজ ও রাজনীতির সঙ্গে নিঃসম্পর্ক বলে মনে হবে না। এ কথাও হয়তো প্রাসঙ্গিক বলে মনে হবে যে, ‘মানে’ কবিতা যে সংকলনটির অন্তর্গত সেটি কবি উৎসর্গ করেছিলেন দার্শনিক শচীন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে।
না থাকুক, তবু মানুষ মূল্যের উৎস হতে পারে। মহাবৈশ্বিক স্থানকাল অনিঃশেষ। মানুষের পক্ষে তাতে লেশমাত্র ‘অবজেক্টিভ’ মূল্য যোগ করা সম্ভব যদি বা না-ও হয়, মানবিক কিছু মূল্যের উৎসমূল হওয়ার মধ্যে এক নশ্বর মহিমা আছে বইকী। ‘মানবিক মূল্য’ লিখলাম। ঐতিহাসিক সমূহ তার নির্মাতা, দায়বদ্ধ ব্যক্তিমানুষ তার জামিন। এ বড়ো কঠিন দায়। তাতে আত্মবশ মননের গরিমা আছে, কিন্তু সমূহের স্বার্থ থেকে, প্রস্থানের পথ নেই। এই দায় এড়িয়ে নয়, বরং এর মারফত শোকগ্রস্ত রবীন্দ্রনাথ কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথের মৃত্যুর ঠিক কুড়িদিন পরে যুক্ত হতে চেয়েছিলেন ‘সবার সঙ্গে’, মুক্ত করতে চেয়েছিলেন ‘বন্ধ’। ‘অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে’ গানটির রচনামুহূর্তের আলোচনা রয়েছে শঙ্খ ঘোষের বটপাকুড়ের ফেনা বইতে।
কোনও প্রাক্নির্ধারিত মানে নেই বলেই এই স্বনির্মিত ‘আমার মানে’ আর ‘জীবনের মানে’ অচ্ছেদ্য, এবং এই কারণেই মানুষের প্রেম ও গোষ্ঠীজীবন শূন্য নয়, বরঞ্চ কানায় কানায় অর্থপূর্ণ। পাঠক প্ররোচিত হতে পারেন বাবরের প্রার্থনা (রচনাকাল ১৯৭৪-৬; প্রকাশকাল ১৯৭৬) সংকলনের ‘শূন্যের ভিতরে ঢেউ’ কবিতাটির কয়েকটি পঙ্ক্তি এই তথাকথিত ‘পরম’ শূন্যতা এবং তৎসহ সৃজিত অথচ আপতিক অর্থের বিরোধের কথা মনে রেখে।
কেননা পড়ন্ত ফুল, চিতার রুপালি ছাই, ধাবমান শেষ ট্রাম
সকলেই চেয়েছে আশ্রয়
সেকথা বলি নি? তবে কী ভাবে তাকাল এতদিন
জলের কিনারে নিচু জবা?
শূন্যতাই জানো শুধু? শূন্যের ভিতরে এত ঢেউ আছে
সেকথা জানো না?
মানে না-থাকা যে একরকম মানে হতে পারে এই নিয়ে তো লিখেছিলেন শঙ্খ ঘোষ। হরপ্রসাদ মিত্রের সঙ্গে পরাচৈতন্য অথবা পরম চৈতন্য বিষয়ে পত্রবিনিময় এবং সে সম্পর্কে হরপ্রসাদের অনুধ্যেয় চিন্তক শ্রীঅরবিন্দের ভাবনার নাতিদীর্ঘ আলোচনা আছে বটপাকুড়ের ফেনা বইতে। আলোচনাটি শেষ হচ্ছে প্রায় ‘মানে’ কবিতার সদর্থক শূন্যবাদের সমর্থন এবং লোকান্তরবাদী পরমার্থের প্রত্যাখ্যান দিয়ে। সিদ্ধান্তটি দার্শনিক তো বটেই, কিন্তু গাঢ় অর্থে রাজনৈতিক। পঙ্ক্তিকটি উদ্ধার করে আলোচনা শেষ করছি।
বিরাটের মধ্যে নিজের অস্তিত্বের তুচ্ছতাকে অনুভব করে কেউ ভাবতে পারে যে তার জীবনটার তবে কোনো মানেই নেই। আবার উলটোদিকে, সেই বিরাটের মধ্যে নিজেকে যুক্ত করে নিয়ে কেউ ভাবতে পারেন তিনি পেয়ে গেছেন তার সম্পূর্ণ মানে। কিন্তু এই দুটো অবস্থানই দৈনন্দিন থেকে মনকে সরিয়ে নিতে পারে, বিযুক্ত করে নিতে পারে জীবনপ্রবাহ থেকে। মানে না থাকাটাই যে জীবনের একটা মানে হতে পারে, সেইটে একবার মেনে নিতে পারলে হয়তো অস্তিত্বের মধ্যে জোর পাওয়া যায় অনেক বেশি।
কবিতার এমন আলোচনা সচরাচর চোখে পড়ে না। আলোচকের গদ্যের দীপ্তিও মনে রাখার মতো।
দীর্ঘ লেখাটি পড়লাম। ভালো লেগেছে। মাত্র একটি কবিতা নিয়ে এত গভীর বিশ্লেষণ বা আলোচনা সচরাচর দেখা যায় না।
স্বপন চক্রবর্তী খুব পছন্দের মাস্টারমশাই। লেখাটা অনেক ধৈর্য ধরে পড়ার। বিশেষ করে দর্শনে অনধিকারীদের কাছে দুর্ভেদ্য লেখা।
অসামান্য লেখা, স্বপন চক্রবর্তী স্নায়ুবিজ্ঞান থেকে রবীন্দ্রনাথ, অ্যবসার্ড থিয়েটার থেকে গৌতম বুদ্ধ পর্যন্ত বিস্তারকে তুলে এনেছেন। কনসাসনেসকে কতদূর পর্যন্ত স্নায়ুবিজ্ঞানের ভিতর দিয়ে দেখা সম্ভব সে নিয়ে বিতর্ক সম্ভবত কোনও দিনই শেষ হবার নয়। ব্ল্যাকমোরের দেখার রামচন্দ্রনের দেখার যোগ করলেও এর উত্তর পাওয়া যাবে না। সব থেকে মারাত্মক এই ডিসকোর্স নিয়ে গূঢ় প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন আসলে স্বপনবাবু। কিন্তু আমি শুধু ভাবছিলাম ওঁনার মৌল দর্শন কোথায় নিয়ে যাবে আমাদের এই সূত্র ধরে। সেটি একদম শেষে উঁনি জানিয়ে দিলেন – না থাকাটিও একটি থাকা। শঙখ ঘোষের কবিতা নিয়ে এমন লেখা বিরল, অবশ্য স্বপনবাবুর মতো চিন্তকও বিরল। অসামান্য একটি লেখা…
অসামান্য লেখা, স্বপন চক্রবর্তী স্নায়ুবিজ্ঞান থেকে রবীন্দ্রনাথ, অ্যবসার্ড থিয়েটার থেকে গৌতম বুদ্ধ পর্যন্ত বিস্তারকে তুলে এনেছেন। কনসাসনেসকে কতদূর পর্যন্ত স্নায়ুবিজ্ঞানের ভিতর দিয়ে দেখা সম্ভব সে নিয়ে বিতর্ক সম্ভবত কোনও দিনই শেষ হবার নয়। ব্ল্যাকমোরের দেখার সঙ্গে রামচন্দ্রনের দেখাকে যোগ করলেও এর উত্তর পাওয়া যাবে না। সব থেকে মারাত্মক এই ডিসকোর্স নিয়ে গূঢ় প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন আসলে স্বপনবাবু। কিন্তু আমি শুধু ভাবছিলাম ওঁনার মৌল দর্শন কোথায় নিয়ে যাবে আমাদের এই সূত্র ধরে। সেটি একদম শেষে উঁনি জানিয়ে দিলেন – না থাকাটিও একটি থাকা। শঙখ ঘোষের কবিতা নিয়ে এমন লেখা বিরল, অবশ্য স্বপনবাবুর মতো চিন্তকও বিরল। অসামান্য একটি লেখা…
REPLY
স্বপনদার ছাত্র হিসেবে জানি, তাঁর বোধের গভীরতা, সংবেদনশীল অনুভূতি, তীক্ষ্ণ বিচারশক্তি এবং বিদ্যার বিভিন্ন শাখায় তাঁর অবাধ বিচরণ-স্পৃহাই এমন একটি লেখার জন্ম দিতে পারে। সাহিত্য-সমালোচনার বিচারে নির্দিষ্ট একটি কবিতার ‘ক্রিটিকাল অ্যাপ্রিসিয়েশন’ ছাপিয়ে এই পাঠ-প্রতিক্রিয়া তার বিশিষ্ট স্বকীয়তায় হয়ে উঠেছে এক পূর্ণাঙ্গ স্বতন্ত্র রচনা। বিশেষ কোন কবিতার পাঠ যে চেতনাকে অর্গল-মুক্ত করে এভাবে বহুমুখী ভাবনার প্রস্রবনে পাঠককে সঞ্জীবিত করতে পারে, কবিতার শব্দ, পংক্তি, যতিচিহ্নের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে পাঠককে সযত্নে যে উপলব্ধির শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছে দেওয়া যায় তা এই রচনা পাঠ না করলে জানা হত না। শঙ্খবাবুর তুলনামূলকভাবে কম পরিচিত এই কবিতাখানি কিভাবে পড়তে হবে, নতুনতর অর্থ ও ব্যঞ্জনার কী অমিত সম্ভাবনা কবিতার শরীরের ভাঁজে ভাঁজে আত্মগোপন করে আছে আবিষ্কারের অপেক্ষায় সে ব্যাপারে পাঠকের চৈতন্য জাগিয়ে তুলেছেন স্বপনদা। প্রাণিবিদ্যা, জিনতত্ত্ব, স্নায়ুবিজ্ঞান ও দর্শনশাস্ত্রের আলোকে তিনি এই কবিতার সূত্রে ইতর প্রাণী ও মানুষের আত্মসচেতনতার অন্বেষণ করেছেন। ‘আত্মানং বিদ্ধি’র প্রসঙ্গ উস্কে দিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন, “সচেতনতার বিচারে মানুষ কি প্রকৃতিতে এক অদ্বিতীয় ব্যতিক্রম?” কবিতাকে কত ভাবে পড়া যেতে পারে, একটি কবিতা আরও কত নতুন পড়ার প্রেরণা হয়ে উঠতে পারে এও তো শেখার। তবে সুগভীর আলোচনার পরেও বিশেষ আকর্ষণীয় লেগেছে স্বপনদার এই রচনার শেষ বাক্যটি, “মানে না থাকাটাই যে জীবনের একটা মানে হতে পারে, সেইটে একবার মেনে নিতে পারলে হয়তো অস্তিত্বের মধ্যে জোর পাওয়া যায় অনেক বেশি।” সঙ্কটজনক সময়ে অস্তিত্বহীনতায় ভোগা অধিকাংশ মানুষের কাছে এর চেয়ে বড় সত্য আর কী!
স্বপনদার ছাত্র হিসেবে জানি, তাঁর বোধের গভীরতা, সংবেদনশীল অনুভূতি, তীক্ষ্ণ বিচারশক্তি এবং বিদ্যার বিভিন্ন শাখায় তাঁর অবাধ বিচরণ-স্পৃহাই এমন একটি লেখার জন্ম দিতে পারে। সাহিত্য-সমালোচনার বিচারে নির্দিষ্ট একটি কবিতার ‘ক্রিটিকাল অ্যাপ্রিসিয়েশন’ ছাপিয়ে এই পাঠ-প্রতিক্রিয়া তার বিশিষ্ট স্বকীয়তায় হয়ে উঠেছে এক পূর্ণাঙ্গ স্বতন্ত্র রচনা। বিশেষ কোন কবিতার পাঠ যে চেতনাকে অর্গল-মুক্ত করে এভাবে বহুমুখী ভাবনার প্রস্রবনে পাঠককে সঞ্জীবিত করতে পারে, কবিতার শব্দ, পংক্তি, যতিচিহ্নের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে পাঠককে সযত্নে যে উপলব্ধির শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছে দেওয়া যায় তা এই রচনা পাঠ না করলে জানা হত না। শঙ্খবাবুর তুলনামূলকভাবে কম পরিচিত এই কবিতাখানি কিভাবে পড়তে হবে, নতুনতর অর্থ ও ব্যঞ্জনার কী অমিত সম্ভাবনা কবিতার শরীরের ভাঁজে ভাঁজে আত্মগোপন করে আছে আবিষ্কারের অপেক্ষায় সে ব্যাপারে পাঠকের চৈতন্য জাগিয়ে তুলেছেন স্বপনদা। প্রাণিবিদ্যা, জিনতত্ত্ব, স্নায়ুবিজ্ঞান ও দর্শনশাস্ত্রের আলোকে তিনি এই কবিতার সূত্রে ইতর প্রাণী ও মানুষের আত্মসচেতনতার অন্বেষণ করেছেন। ‘আত্মানং বিদ্ধি’র প্রসঙ্গ উস্কে দিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন, “সচেতনতার বিচারে মানুষ কি প্রকৃতিতে এক অদ্বিতীয় ব্যতিক্রম?” কবিতাকে কত ভাবে পড়া যেতে পারে, একটি কবিতা আরও কত নতুন পড়ার প্রেরণা হয়ে উঠতে পারে এও তো শেখার। তবে সুগভীর আলোচনার পরেও বিশেষ আকর্ষণীয় লেগেছে স্বপনদার এই রচনার শেষ বাক্যটি, “মানে না থাকাটাই যে জীবনের একটা মানে হতে পারে, সেইটে একবার মেনে নিতে পারলে হয়তো অস্তিত্বের মধ্যে জোর পাওয়া যায় অনেক বেশি।” সঙ্কটজনক সময়ে অস্তিত্বহীনতায় ভোগা অধিকাংশ মানুষের কাছে এর চেয়ে বড় সত্য আর কী!