রূপশ্রী ঘোষ-এর গল্প

রূপশ্রী ঘোষ-এর গল্প

জাহ্নবীর তীরে…

ঠিক পুজোর আগে আগে। শরৎকাল। ঝকঝকে আবহাওয়া। কোথাও কোনো মেঘ নেই। বরং শরতের পেঁজা তুলোয় মনোরম একটা পরিবেশ। হালকা ঠাণ্ডা তখন থেকেই শুরু হয়। এমনই এক সকাল।
ভোরের দিকে টিনের চালে টুপটাপ শিশিরের আওয়াজও শোনা যায়। শহর কলকাতার থেকে গ্রামে সেটা আরও স্পষ্ট। শহরে রেললাইনের ধারের বস্তি বা বাইপাসের ধারের বা অন্য কোনো জায়গার ঝুপড়ির মানুষ কিছুটা এই আওয়াজ পেতে পারে। কারণ তাদের ছোটোছোটো ঘরগুলোয় টিনের ছাউনিই থাকে। তাও হয়তো মাঝরাতে। খুব ভোর থেকেই ট্রেন, বাস, ট্যাক্সি, প্রাইভেট গাড়ি তাদের গোঁঙানিতে দিন শুরু করে দেয়। শহরের নিস্তব্ধতার পরমায়ু খুব কম। অন্ধকার ছিঁড়ে আলো বেরিয়ে আসার আগেই গাড়ির গর্জনে তা খতম হয়ে যায়।
গ্রামে গাড়ি ঘোড়া পাড়ার ভিতর ঢোকে না। কোলাহল কম। শান্ত, নিস্তব্ধ জীবনেই অভ্যস্ত সবাই। এমন সময় নিস্তব্ধতা ভেঙে তনুময় দৌড়তে দৌড়তে এসে হাজির। দৌড়ের জন্য হাঁফও ধরেছিল। সে মেঘ নয়, বিনা মেঘে বজ্রপাত বয়ে আনল।
– হাঁপিয়ে হাঁপিয়েই হাঁউমাঁউ করে চিৎকার করছে আর বলছে, ‘ছোটোকাকি জানো শুকনো ডাঙায় গেসনু মুগ কলাই তুলতে। দুলেদের বৌগুলো মাচ ধরছিল, পারুলের জলে। তারা আমাকে ডেকে বলল, হাতড়ে হাতড়ে মাচ ধরার সময় হঠাৎ তাদের একজনের হাতে বড়োসড় একটা কি যেন ঠেকল। তুলে দ্যাখে একটা বাচ্চা। এইমাত্র হয়েচে এমন বাচ্চা। ব্যাটাছেলে। জলটা রক্তে ভেসে যাচ্চে। মনে হয় রাতে হওয়ার পরেই তাকে গলা টিপে মেরে পারুলের জলে ফেলে গ্যাচে।’
– দমকা হাওয়ার মতোই এক ঝটকায় কথাটা বলে তবে থামল। তার হাত পা থরথর করে কাঁপছিল।
– তাকে দেখে মনে হচ্ছিল, অপরাধটা সে নিজেই বুঝি করেছে, এক্ষুনি তাকে পুলিশে ধরে নিয়ে যাবে। তাই তার এত ভয়।
গাড়িবারান্দার নিচে দাঁড়িয়ে এসব যখন চলছে, দেবস্মিতা বই বন্ধ করে চুপ করে গেল। বারান্দায় বই নিয়ে বসেছিল দেবস্মিতা। রোজই বসত। ওখানে পড়তে বসলে পড়ার পাশাপাশি বাইরের নানান ঘটনায় আলাদা করে আর তাকে হাজির থাকতে হত না। ঘটনারা নিজেই এসে হাজির হয়ে যেত।
– দেবস্মিতা ভাবুক প্রকৃতির মেয়ে। পড়ার থেকে ভাবে বেশি। কোনো ঘটনা ঘটলে তো কথাই নেই, সেই ঘটনা তাকে কয়েকদিন আটকে রাখে। উদাস হয়ে সে ভাবতে শুরু করল…
– অপরাধ করলেই কী ভয় হয়?
– ভয়ঙ্কর ঘটনা ভয় ধরায় না?
– ঘৃণা, দুঃখ, হতাশা সবই তো হতে পারে…
সে তো জানে, ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে…’
– অন্যায় দেখে আসাটাও তো একই প্রতিক্রিয়া ঘটাতে পারে।
– তনুময় যা বলল, তা আসলে কী? বাড়িতে যে আসছে তার কাছেই চিৎকার করে করে বলছিল তনুময়। এ তো শুধু অন্যায় নয়। হালকা চালে উড়িয়ে দিয়ে স্থির থাকবে কী করে তনুময়? এ তো খুন। খুন কত বড়ো অপরাধ সে তো সবাই জানে।
দেবস্মিতার মাথায় সেই ছবিটাই ঘুরতে লাগল। একটা দুধের শিশুকে কীভাবে…
– সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই আবার বই খুলল দেবস্মিতা। কী কাকতালীয় ঘটনা, বই খুলতেই বেরিয়ে পড়ল
‘কর্ণ-কুন্তী সংবাদ’। হ্যাঁ ঠিকই, এটা ক্লাস নাইন-টেনের একসময় পাঠ্য ছিল। দেবস্মিতা স্তব্ধ হয়ে গেল।
– এই বাচ্চাটাই কী আজকের কর্ণ? কর্ণ না হলেও কানীন তো বটে। না হলে পৃথিবীর আলো দেখানো মাত্রই তাকে নিথর নিস্পন্দ করে দেওয়া হল কেন? একে পুত্র সন্তান, তায় বাড়িতে প্রসব। তার মানে তো তার জন্য শঙ্খ, প্রদীপ উলুধ্বনি ধ্বনিত হয়ে পাড়া মাতানোর কথা ছিল। তা না হয়ে নৃশংসভাবে একটা শিশুকে মেরে দেওয়া হল? কে মারল? কীভাবে মারল? মারার সময় সে কতটা চিৎকার করেছিল?
– যে পরিমাণ চিৎকারে একটা শিশু হাজির হয়। নাকি আরও বেশি। জন্মের সময়ের একটা লালটুকটুকে শিশু, যে পিটপিট করে তাকাতেও দ্বিধা করে, বহু বিরক্তিতে বুঝিয়ে দেয় আমি তোমাদের থেকে অন্য জগতে ছিলাম। কেন আনা হল আমাকে এত আলোতে? থুড়ি অন্ধকারে?
– অন্ধকারই তো। এ তো কর্ণ নয়। কেউ তো তাকে সাহারা দেয়নি। যার জন্য প্রস্তুত হল না কুরুক্ষেত্র রণভূমি, যার প্রয়োজন হল না কবচ কুণ্ডল, বুকের বর্ম। প্রয়োজনও হবে না তার মায়ের কাছে জবাবদিহির। মাকেও বলতে হবে না, তার জীবনের প্রথম প্রভাতের সঙ্গে পরিচয় ঘটানোর কথা। কারণ সে তো পারুলের জলে ডুবে থাকা নিথর একটা মাংসপিণ্ড। সেভাবেই তাকে হাতে পেল। কিন্তু তার মা কেনই বা এত ভয় পেল? কুন্তী তো পায়নি। নিজেই তো এসেছিল পরিচয় দিতে ত্যাগ করে ‘সব লাজ’। সমাজ কী তাহলে পিছিয়ে যাচ্ছে!
– অজস্র প্রশ্ন দেবস্মিতার মনে ঘুরপাক খেতে থাকে। সারাদিনই সেই ঘটনা তাকে পিছু ছাড়েনি। অজগরের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল সেই ভাবনা। ভাবতে ভাবতেই সব কাজ গুছিয়ে স্কুলের জন্যে তৈরি হয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল।

দেবস্মিতারা তিন বন্ধু হাঁটতে হাঁটতে স্কুলে যেত। পাশের গ্রামে স্কুল। দূরত্ব সাড়ে তিন কিলোমিটার। হাঁটতে লাগে একঘণ্টা। গতি যদি অ্যামিবয়েড হয় তাহলে তো কথাই নেই। গল্প করার সময় বেড়ে হয় সমানুপাত। একের পর এক পাড়া ছাড়িয়ে লাল মোরামের সেই রাস্তা চলে গেছে একঁকেবেঁকে। প্রথমে রজকপাড়া। রজক মানে ধোপা। যদিও এরা কেউই ধোপার কাজ করত না। বেশিরভাগই কাঠের কাজ করে, এখন তো অনেকে সরকারি বেসরকারি চাকরি। ঘিঞ্জি এলাকা। ছোটোবড়ো মিলিয়ে অসংখ্য বাড়ি যেন একে অপরের ঘাড়ে এসে পড়েছে। কোলাকুলিও বলা যায়। বাড়ি দেখে মনে হবে তাদের বুঝি একসঙ্গে মিলেমিশে বাস। ‘পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই’। একেবারেই তা নয়। ঘরের ঝগড়া, একে অন্যের সঙ্গে ঝগড়া রোজই রাস্তায় নেমে আসত। অবশ্য বিপদে আপদে সবাই ভাই ভাই। রাস্তার দুপাশে পুকুর আর বাঁশঝাড়ে ঘেরা বাড়িরগুলোর রোজকার বোঝাপড়ার সাক্ষী দেবস্মিতার মতো আরও অনেকেই। এ পাড়ায় ঢুকলেই দেবস্মিতার চোখে ভাসে বাঁদিকের লম্বা খালে একটা উল্টে যাওয়া ট্রাক্টর। যাকে বলে আপ সাইড ডাউন। যার তলা দিয়ে কেবল দেখা গিয়েছিল খয়েরি রঙের প্যান্ট পরা দুটো পা আর খাঁকি রঙের বুট।
এরপর উত্তরপাড়া। এ আর এক পাড়া। পাড়া মাথায় করে ঝগড়ার পাশাপাশি ঝাঁক ঝাঁক মানুষ, হাঁস মুরগি, গোরু ছাগল সব মিলেমিশে বাস। তাদের নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক যেমনই হোক না কেন, রাস্তার কোনো সাইকেল বা গাড়ি যদি একটা হাঁস মুরগিকেও চাপা দিত তারা দল বেঁধে এসে সেই লোকের থেকে খেসারত আদায় করে তবেই তাকে রেহাই দিত। কোনো দরকষাকষি নয় জ্যান্ত অবস্থায় বিক্রি করে যে দাম পাওয়া যেত সেই দামই রফা হত। সাইকেল, মোটর সাইকেল বা গাড়ি নিয়ে যারা ওই রাস্তায় কম বেশি যাতায়াত করেছে তাদের সবাইকেই প্রায় এই অভিজ্ঞতার মোকাবিলা করতে হয়েছে। কারণ বাছুর বা ছাগলছানারা বন্দী থাকতে চায় না আর হাঁস মুরগির ছানাগুলোও ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে রাস্তাতেই এসে পড়ে। দেবস্মিতার দেখতে ভালো লাগত যখন এক
মা-মুরগি তার ছোটোছোটো ছানাগুলোকে নিজের চারপাশে নিয়ে খড়ের গাদার কাছে গোলগোল করে ঘুরে ঘুরে খাবার খুঁটে খেত। আর কিচকিচ আওয়াজ করত।
কোনো বাচ্চা বা বাচ্চাদের মায়ের সঙ্গে দেখতেই বোধহয় সবাই ভালোবাসে।
এই পাড়া পেরিয়ে মাঝে শুনশান লম্বা রাস্তা। দুপাশে ধানখেত। দূরে স্যালো টিউবওয়েলটা মাঝেমাঝেই নীরবতা ভেঙে দিত। বকের সারি ঝাঁক বেঁধে বসে থাকত জমির আলে। কখনও বা লম্বা লম্বা পা ফেলে খুব সন্তর্পনে পোকা ধরতে এগিয়ে যেত জমির জলের দিকে। বকেরাও জানে চুপিসারে খাবার সংগ্রহের কথা। দূরে একা একটা বুড়ো অশ্বত্থ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। কতদিন বা ঘটনার সঙ্গী জানা নেই। যতদূর চোখ যায় দেখা যায় দিগন্ত বিস্তৃত আকাশ মাটিকেই ছুঁয়ে থাকে। দীর্ঘ রাস্তা।
বনানী, মাধুরী, দেবস্মিতার কত গল্পের বিনিময় ছড়িয়ে আছে এই রাস্তাজুড়ে।
– খুব স্বাভাবিক দেবস্মিতা সেদিন সকালের গল্পও বলার জন্য ছটফট করছিল। এক নিঃশ্বাসে বলা শেষ।
– মাধুরী ঘটনাটা শুনেই ঘটনার সূত্র বের করার চেষ্টা করে দিল।
মাধুরী মোটামুটি তাদের গ্রামের বি বি সি। গোয়েন্দাও বলা যায়। ডাকাবুকো একটা মেয়ে, কোনোকিছুতেই তার ভয় নেই। যে-কোনো পরিস্থিতির মোকাবিলা সে অনায়াসে করতে পারত। ছেলেদের সঙ্গে লড়াই, দৌড়, বড়ো সাইকেলে ধানের বস্তা চাপিয়ে সেই সাইকেল চালিয়ে যাওয়া সবই তার কাছে ছিল এক তুড়ির মামলা। জলভাত।
– মাধুরীর হাতেই যেন সব গল্পের লাটাইও থাকত। সময় বুঝে সুতোটা ছাড়ত কেবল।
– দেবস্মিতার কাছে সেদিনের সেই ঘটনা শুনেও
– মাধুরী শুরু করেছিল, ‘জানিস কদিন আগে পারুলের পাড়ে পাটবাড়ির ভিতরে একটা চাটাই পাওয়া গেছিল’।
দেবস্মিতা, বনানী অবাক হয়ে, ‘মানে’?
‘হ্যাঁ, সেটাই তো বলছি শোন’।
– ‘পারুলের পাড়ে গিরিদের জমিতে এবারে পাট চাষ হয়েছে। পাট গাছ কেমন হয় জানিস তো?’
– চাষবাসের ব্যাপারে মাধুরীর যত জ্ঞান দেবস্মিতা বা বনানীর তত নেই।
– ‘বিশাল লম্বা লম্বা গাছ। একটা বড়ো মানুষের ডবলের থেকেও বেশি। সেই খেতের ভিতর ঢুকলে মানুষকে দেখা যায় না। ওখানে ঢুকে যা খুশি করা যায়’।
– বনানী, দেবস্মিতার কপাল কৌতূহলে চওড়া হলেও তখনও কিছু ধরতে পারেনি।
– ‘যা খুশি’ তো একটা ভেগ কথা। স্পষ্ট করা দরকার।
– ‘ওই খেতের ভিতরে অনেকটা জায়গার পাটগাছ ভেঙে দিয়ে সেখানে কেউ চাটাই পেতেছিল, আমি দেখেছি, পরিষ্কার করে ঘর বানিয়ে ফেলার মতো। ওখানে গিয়ে অনেকক্ষণ নিশ্চিন্তে কাটানো যায়, কেউ টের পাবে না এমনভাবে করা’।
মাধুরীর মোটামুটি সব জায়গায় বিচরণও ছিল সহজ ব্যাপার। তার জীবনযাপন ছিল খুব স্বাধীন। বাড়ির বড়োদের কোনো চোখ রাঙানি তাকে কোনোদিনই সহ্য করতে হয়নি। ফলে তার ক্ষেত্রে বজ্র আঁটুনিও হয়নি ফোস্কা গেড়ো।
– ‘কী করেছিল চাটাই পেতে, কারাই বা করেছিল’? আবার কৌতুহল বা প্রশ্ন।
– মাধুরী স্পষ্ট করতে পারেনি নাম দুটো। কিন্তু পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিয়েছিল তার দুই পিছিয়ে পড়া সঙ্গীকে।

দেবস্মিতা স্কুল থেকে একাই ফিরছিল সেদিন। আপন মনে ফেরার পথে গাছপালা, ধান খেতের সবুজে মন ডুবিয়ে আবার ভাবতে শুরু করে, মাধুরী যে পাটবাড়ির গল্প শোনাল তাতে তো একটা ভ্রূণের বাচ্চায় পরিণত হয়ে পৃথিবীতে আসার সময়ের সঙ্গে ম্যাচ করছে না।
পাট তো চৈত্র-বৈশাখে চাষ শুরু করে বর্ষার জলেই পচতে দেয়। একটা ভ্রূণ সুস্থ বাচ্চায় পরিণত হতে কম করে সময় নেয় সাঁইত্রিশ সপ্তাহ। মায়েরা যে কথায় কথায় বলেন, ‘দশ মাস দশ দিন পেটে ধরে তবে তোকে এনেছি’। তাহলে কী করে সম্ভব? পাট চাষের পর পাট গাছ বড়ো হওয়া পর্যন্ত পাট খেতে ঢুকে…
দেবস্মিতার সব কেমন গুলিয়ে যেতে থাকল।
আবার বাচ্চাটার কান্না, কান্না নয় আর্তনাদ, হাহাকার তার কানে ভেসে এল…
– পাটগাছকে জলে পচিয়ে কাঠের পাটা দিয়ে অনবরত পিটিয়ে পিটিয়ে পাট আর প্যাকাটি আলাদা করতে হয়।
– বর্ষাকালে চাষিরা জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে ওই পাট তন্তু আর প্যাকাটি আলাদা করা কাজটা করে। কখনও বৃষ্টিতে ভিজে ভিজেও। অনেকটা সময় জলে থাকার জন্য তাদের হাত পা-গুলো সাদা হয়ে হেজে যায়। দেখতে ভালো লাগে না। দেখতে বাজে লাগার থেকেও বড়ো কথা কাজটা খুব কষ্টকর।
– দেবস্মিতা স্কুল যাওয়ার পথে বহুবার তা দেখেছে। তার মনে হল ওই পাট গাছকে পিটিয়ে পাটতন্তু আলাদা করার মতোই কী তাহলে বাচ্চাটাকে…
একটা লাল টুকুটুকে মুখ যাকে তোয়ালেতে জড়িয়ে আদর করে মুখে মায়ের দুধ দিতে হয় তাকে কী দেওয়া হয়েছিল?
– তার গলায় কী নুন ঢালা হয়েছিল?
– নাকি দুহাত দিয়ে তুলোর মতো নরম গলাটা কেউ…
– দেবস্মিতার মাথা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যেতে থাকল।
– একটা ঘোরের মধ্যে সারাদিন কাটল…
– সব জায়গায় দফায় দফায় একই আলোচনা একটা দুধের শিশু…

গ্রামে প্রায় সব পুকুরের একটা করে নাম থাকে। এরকমই ‘পারুল’ একটা নাম। সাত ভাইয়ের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। এ কেবল একটা পুকুর। জল ধরে রেখে মানুষের উপকার করে। মাছও চাষ হয়। এই পুকুর থেকে জল নিয়ে গাছে দেওয়া হয়, রান্না করা হয়। হ্যাঁ আগে গ্রামে পুকুরের জলে রান্না করা হত। বাসন মাজা হত। এখন হয় না। এখন সাবমার্সিবল সহায় ঘরে ঘরে। গ্রামের কত গরিব মানুষ এই পারুল থেকেই মাছ, গুগলি, থানকুনি, শুশনি, কলমি শাক সংগ্রহ করে দিন আনে দিন খায়। কিন্তু আজ সকালে পারুল এ কিসের সাক্ষী। আজও কি পারুল কচুরিপানায় ভরা ছিল?

পারুলের পাড়ে লোক ভর্তি হয়ে গেল। হইহই রব উঠল। কোন মেয়ের কাজ এটা, সেটা আবিষ্কারে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সবাই। ছেলেটা কে সেটা তো বোঝার উপায় নেই। মেয়েটাকে পেলে তাকে দিয়ে বলিয়ে নেওয়া যাবে। পুকুর পাড়ের কয়েকজনের পরামর্শে, বাচ্চাটাকে তুলে মাটি খুঁড়ে সরায় করে পুঁতে দেওয়া হল।

গ্রামে থানা পুলিশের বালাই নেই। শাস্তির কোনো গল্পও নেই। ধামাচাপা দেওয়াটাই সবার লক্ষ্য। বরং গুঞ্জন ছড়াতে লাগল এটা কোনো আইবুড়ো মেয়েরই কাজ হবে।
– এভাবেই সম্বোধন করা হয় অবিবাহিত মেয়েদের।
– যে মেয়ে এমন কাজ করেছে তার সম্বোধন কী হবে তা নিয়ে ভাবাই বা কেন।
– বিবাহিত মেয়ে যে নয় তা স্পষ্ট। সেটা তো জানাই আছে। তার জন্য শঙ্খ উলুধ্বনি বরাদ্দ হত।
– আইবুড়ো মেয়েদের মধ্যে কে ঘাপটি মেরে ঘরে বসেছিল এতদিন সেটা ভেবে ভেবে লোকে ঠিক বের করে ফেলল একদিন।

– পাড়ুইদের একটা মেয়ে। নাম বুঁচি।
দেবস্মিতার পাড়ার আর একজন মেয়ে অপর্ণা, অপু নামেই পরিচিত।
– অপু বলল, ‘হ্যাঁ তাই তো বুঁচিকেই তো অনেকদিন ঘর থেকে বাইরে বেরোতে দেখা যায়নে। সে স্কুলেও যায়নে অনেকদিন।’

বুঁচি বেশ শান্তশিষ্ট, হাঁদা গোবলা গোছের মেয়ে। কোনো কথা বললে বুঝতে পারত বলে মনে হয় না। কথা বলত ভাঙা গলায়। হাঁ করে মুখের দিকে যখন তাকিয়ে থাকত, তার জিভটা একটু বাইরে বেরিয়ে থাকত। একই ক্লাসে কতবার যে বুদ্ধি পাকিয়েছে তার কোনো হিসেব নেই। ক্লাসের এমন ছাত্রীর পড়াশুনো, হঠাৎ করে ঘরবন্দী হয়ে যাওয়া নিয়ে মাথা ঘামানোর কথা কারোর মাথাতেই আসার কথা নয়।
– দীর্ঘদিন অদর্শেন তাও এল।

– পাড়ার কাকিমা জেঠিমাদের বেশ চিন্তা। নিজেদের মধ্যেই বলাবলি করতে থাকল, ‘এবার ও মেয়ের বিয়ে দিবি কী করে? ছি ছি ছি! এমন কান্ড করল যে, গ্রামে আর মুখ দেখাতে পারবে গা? তার মা বাবাই বা কেমন? মা বুঝতে পারলুনি? একটা মেয়ের পেটে বাচ্চা এলে তার কত পরিবর্তন হবে। মুখে অরুচি হবে। বমি করবে। বুকের মাইগুলো দেখেই তো বোঝা যাবে, ভারি হবে তাতে কালো কালো ভেলা পড়বে। পাছা মোটা হবে। ছি ছি ছি। আমার মেয়ে হলে তো আমি গলায় বিষ দিয়ে মেরে ফেলতুম।’
– এরা যত সহজে আলোচনা করে, তত সহজে বিষ দিতে পারে বলে ভেবে নেওয়ার কোনো দরকার নেই।
– কয়েকদিন এসব বেশ চলতেই থাকল।
– যে-কোনো নাড়িয়ে দেওয়া ঘটনার চরিত্রই তো তাই।
– দেবস্মিতার এসব ভাষার চর্চা শুনতে মোটেই ভালো লাগত না। কিন্তু না শোনার উপায়ও ছিল না।

বুঁচির বাড়ি একটু দূরে। দু চারটে পুকুর, ধান জমির খেত, ঘাসবন, অর্জুন গাছের সারির জঙ্গল, পোড়ো শিব মন্দিরটা ছাড়িয়ে যেতে হয়। জামাকাপড়ে চোরকাঁটা লাগিয়ে তাই কেউ তার বাড়ি বয়ে গিয়ে তাকে ছি ছি করে না। গায়ে থুতু দেয় না। যা দেওয়ার সব দূর থেকেই। আর বুঁচির পাশের বাড়ির লোকরাও সরাসরি কিছু না বলে অন্য পাড়ায় গিয়ে গায়ের জ্বালা মেটায়।

বুঁচির বাড়ির লোকরাও বাইরে বেরোতে লজ্জা পেত। কাজে যেত সব মাথা নিচু করে। বুঁচির পাশের বাড়ির একটা মেয়ে দেবস্মিতাদের পাড়ায় এসেছিল। সে বলল, ‘বুঁচি সবসময় ওপরের ঘরে থাকত। ওকে ওখানেই খাবার দিয়ে আসত। নাইতো উঠুনে। বালতিতে জল তুলে। আর খুব মোটা হয়ে গেসলো। কিন্তু আজ আমি তাকে দেখেছি তাদের উঠুনে সে তেল মেখে মাদুরে শুয়ে আছে। পেটে রোদ খাওয়াচ্ছে। পাশে তার মা বসে’।

– বেশ কিছুদিন যাওয়ার পর আবার রটল, বুঁচিদের বাড়ির পাশে যে পাট-খেতটা ছিল, সেই ঘন, বড়ো বড়ো পাট খেতের ভিতরে অনেকটা অংশের পাটগাছ কাটা। ফাঁকা পরিষ্কার করা জায়গায় একটা চাটাই পাওয়া গেছে। তাতে একটু রক্তের দাগ। মাধুরী কোনো অংশে মিথ্যে নয় তা বোঝা গেল।
– দুই-এ দুই-এ চার করাই মানুষের স্বভাব। গোয়েন্দাগিরির স্পিড বাড়িয়ে দিয়ে গ্রামের লোকজন এও আবিষ্কার করে ফেলল, এ ঘটনার কয়েক মাস আগে থেকেই বুঁচির এক খুড়তুতো দাদা কোথায় যেন কাজে চলে গেছে। তখনও ফেরেনি। নামটা কেউ নিল না। অনুমান করে নিল।
– সে ছেলে আজও ফিরে আসেনি সেই গ্রামে। সবিতা বন্দনাও তো হবে না এর জন্য।
– তবে বুঁচির ভাগ্য ফিরে গেছে।
– সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধামাচাপা পড়ে ঘটনারা হয় ফিকে।
– এক্ষেত্রেও বুঁচির বাড়ির লোক সুযোগ বুঝে তার দিদির বাড়ি নিয়ে গিয়ে বুঁচির একটা গতি করে দিল।

গ্রামের সবার সামনে দিয়ে বুঁচি এখন দুই সন্তানের হাত ধরে বরকে নিয়ে প্রতিবছর জামাই ষষ্ঠীতে আসে।
– তনুময় এখন আর তাকে দেখে হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়ে গিয়ে কাউকে কোন খবর দেয় না।
– মাধুরীর বিয়ে হয়ে গেছে। তারও প্রথম সন্তান পৃথিবীর আলো দেখেই চলে গিয়েছে। মাধুরীর যন্ত্রণা আর বুঁচির যন্ত্রণা সমান হওয়ার কথা নয়।
– দেবস্মিতাও জানে শহরে ধাপার মাঠ বা নর্দমা থেকে উঠে আসা এমন কত শিশুই আজ প্রায় প্রতিটি কাগজের খোরাক।

সব কানীন কর্ণ হতে পারে না।

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes