রিনি গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প- ‘বাঘের বাচ্চা’
কাটারির এক কোপে মুণ্ডুটা ধড় থেকে আলাদা করে দিল সজল। বডিটা কয়েক সেকেন্ড ঝটকানি দিয়ে থেমে গেল। সজলের নিপুণ কাজ। গায়ে কোথাও রক্ত লাগেনি। এতো দ্রুততা ও সূক্ষ্মতার সঙ্গে সজল কাজটা করল যে ধড় আর মুণ্ডুটাও বোঝেনি যে আলাদা হয়ে গেল। নাঃ, এটা সজলের পেশা নয়। তবে নেশা বলাই যায়। দিনে – রাতে, সকাল – সন্ধে এই কাজটাই তো করে চলেছে সজল। মুণ্ডুটাকে বঁটির আগায় ধরে জাস্ট একবার বুলিয়ে দেওয়া। তারপর ছটফট করতে থাকা দেহটাকে পায়ের তলায় চেপে রেখে দেওয়া কয়েক সেকেন্ড। থেমে গেলেই ছাল ছাড়িয়ে নাড়িভুঁড়ি বার করে ফ্রেস মাংস পিস পিস করে কেটে কাস্টমারের হাতে ধরিয়ে দেওয়া। যার যেমন ডিমান্ড – কেউ হাড় সমেত মাংস, কেউ বোনলেস ,কেউ লেগ পিস, কেউ আবার চিলি পিস এইসব নানারকম।
সজল ছোটবেলা ওর মাকে দেখেছে। জ্যান্ত মুরগি বাজার থেকে কিনে এনে একটা বালতিতে রেখে দিত মা। তারপর ফুটন্ত গরম জল মুরগিটার ওপর ঢেলে দিয়ে ওকে ঢাকা চাপা দিয়ে দিত। খানিকটা বাদে মুরগিটা মরে গেলে ছাল ছাড়িয়ে নিত। কিন্তু সজল কাজ শেখার পর থেকে মাকে আর অতো কষ্ট করতে হয় না। সজলই পাকা হাতে নামিয়ে দেয়।
মুরগির ব্যবসাটা সজল যখন শুরু করে তখন ওকে কাজটা শিখিয়েছিল হুব্বা ওস্তাদ। কীভাবে মুরগিটাকে ধরতে হয়, কীভাবে গলায় পোঁচ মারতে হয়, ছাল ছাড়ানো, পেট পরিষ্কার সবই হাতে ধরে শিখিয়েছিল হুব্বা। প্রথম প্রথম সজলের যে একেবারে অসুবিধে হয়নি তা নয়। রাতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও সে মুরগি কাটার স্বপ্নই দেখত। গলায় পোঁচ মারতে হাত কেঁপে যেত। সেই সজল আজ একটা মানুষকে নামিয়ে দিল। মানুষ বললে ভুল হবে। ওটা একটা অমানুষ, খানকির ছেলে শালা।
বাঁড়া, আমার ওস্তাদের পোঁদে লাগতে এসেছে। আস্পদ্দা মাইরি।
সজল খুব তড়পাচ্ছিল হুব্বার ডেরায় বসে। হুব্বার সবে কলির সন্ধে হয়েছে। এখনও থম মেরে যাইনি। হুব্বা মিটিমিটি হাসছিল সজলের কথা শুনে।
তা কি করলি? পৈতে?
না ওস্তাদ, ফুটবল।
ছোঃ, পৈতে করলে বুঝতাম তোর কলজের জোর আছে। বাঘের বাচ্চা তুই।
সজল চুপ করে যায়। এই সময় ওস্তাদের মুখে মুখে কথা বলা মানা। ওস্তাদ পৈতে করে দেবে। ধীরে ধীরে দল থেকে একটু দূরে সরে আসে। ছিলিমে টান মারে। পটলা চেঁচিয়ে বলে, কি বে সজল! পৈতের ভয়ে উঠে গেলি!
সজল হাসিমুখে আবার ফিরে যায় হুব্বার পায়ের কাছে। আজকের মোচ্ছব তো তারই জন্যে। বিরাট একটা কাজ করেছে সে। এ অঞ্চলে পোল্ট্রির সাপ্লায়ার হুব্বা। হুব্বার এটা পুরোন ব্যবসা। হুব্বাও সজলের মতোই মুরগির দোকান দিয়ে শুরু করেছিল। একটা, দুটো করতে করতে পুরো অঞ্চলটাই দখল করে নিয়েছে। এখানে কোনো শালার ক্ষমতা নেই হুব্বা ছাড়া অন্য কারো কাছ থেকে পোল্ট্রির সাপ্লাই নেয়। সেখানে ব্যাটা কালকের ছোকরা রাম বলে কি না হুব্বার মাল নেবে না!
হুব্বার মাল ভালো না। দামও বেশি পড়ে। কাস্টমার কমে যাচ্ছে আমার।
আরে বাঁড়া, তুই চাপ নিচ্ছিস কেন! দোকানের সামনে ‘হুব্বা মিট’ লিখে ঝুলিয়ে দে। কোনো শালার ভাতার পোর সাহস হবে না কিছু বলে।
কিন্তু রাম এসব করবে না। সৎ পথে ব্যবসা করতে নেমেছে।
হুব্বা ওকে কয়েকটা দিন সময় দিয়েছিল। ভবি ভোলার নয়। অকালে গেল প্রাণটা। সকালে ওর দোকানের পাশের নর্দমা থেকে লাশটা পাওয়া গেল। আর মুণ্ডুটা খালপাড়ের মাঠের মাঝখানে পড়ে পড়ে বৃষ্টিতে ভিজছিল । ঠিক যেন ছেলেরা ফুটবল খেলতে খেলতে বৃষ্টি আসায় মাঠেই ফুটবল রেখে দৌড় দিয়েছে।
কয়েকদিন পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ চলল। পুলিশের একটা খেচরকেও এলাকায় মাঝে মাঝেই দেখা যেতে লাগল। ঠারেঠোরে সজলের দোকানের ওপর নজরদারি চালানো হলো। শেষে সেদিন রাত ২টোর সময় পুলিশ এসে বাড়ি ঘিরে ফেলল। সজল তখন বৌকে লাগাতে চেষ্টা করছিল। সেদিন মোচ্ছবের পর সজল এসে বৌকে জড়িয়ে ধরে একটা হামি খেয়েছিল। ওস্তাদ আজ তার জন্য পার্টি রেখেছিল। সজলের আজ রেলাই আলাদা। আজ তো মেয়েছেলে ছাড়া জমবেই না। কিন্তু বেশ কবার চেষ্টা করেও সজলের কিছুতেই দাঁড়াচ্ছিল না। নেশাটা আজ বেশি হয়ে গেছে। মেশিনটা কেমন নেতিয়ে আছে। হয়নি সেদিন কিছুই। ওপর থেকে খানিক খামচাখামচি করে বৌকে ছেড়ে দিয়েছিল সজল। আজও অল্প নেশা হয়েছে। আজ আর হামিটামি নয়, সোজা নিয়ে বিছানায় ফেলেছিল মাগীকে। বউটার রসও কম নয়। কিন্তু সজলের মেশিন কিছুতেই লোডেড হচ্ছে না। ঝুলে আছে এমন যে মনে হচ্ছে…. ঠিক কি মনে হচ্ছে বোঝার আগেই পুলিশ এসে হাজির।বউটাকে এলোমেলো রেখেই সজল পিছনে খাটা পায়খানার গর্ত দিয়ে খালে ডুব দিল।
কদিন আর সজলের পাত্তা নেই। তলায় তলায় হুব্বার সঙ্গে যদিও যোগাযোগ রেখে চলেছে সজল। ইতিমধ্যে এলাকার বাইরেই আরও দুএকটা কেস করে এসেছে সে। একটাকে তো এই জীবনে প্রথম পৈতে করে দিয়েছে। ডানদিকের কাঁধ থেকে বাঁ দিকের কোমর পর্যন্ত ফালা করে দিয়েছে। গরম রক্ত যখন মুখের ওপর ছিটকে এসে পড়ল সজলের তখন নিজেকে বাঘের cipf-es.org বাচ্চা মনে হচ্ছিল। জিভ দিয়ে খানিকটা রক্ত সে চেঁটে নিল। এইবার আর ওস্তাদ তাকে ল্যাওড়া বলতে পারবে না। এতোদিনে সে ওস্তাদের মনপসন্দ হয়ে উঠল। কিন্তু শালা আন্ডারগ্রআউন্ড থেকে আর কতদিন। মেয়েছেলে না হলে চলে। পুলিশ তো শালা সোনাগাছিতেও ওৎপেতে থাকে। সজল নিজে নিজে মেশিনে চার্জ দিতে চেষ্টা করেছিল। ঠিকমতো হয়নি। সজলের দিন কাটছিল রুখুসুখু।
কয়েক মাস পর হুব্বার সঙ্গে পুলিশের সাল্টিং হতেই এলাকায় খুনের ঘটনাটা খানিক ধামাচাপা পড়ল। সজল বাড়ি ফিরল। আজ বৌ জমিয়ে খাসি রান্না করেছে। ঝাল ঝাল। চেটেপুটে মেরে দিয়েই সজল বিছানা নিল। ভর দুপুরে চারদিকে রিক্সা, অটো, গাড়ির আওয়াজ। বস্তির ছেলেগুলো হৈ হৈ করছে। তার মধ্যেই সজল টান মেরে বউয়ের শাড়ি খুলে ফেলেছে। বউও দেরি না করে ব্লাউজটা ছিঁড়ে ফেলেছে। উউউফফফ, কত্তদিন পর… শালার মনে হচ্ছে ঢুকিয়ে ফাটিয়ে দিই। মাগী ঘষে ঘষে তোকে… কিন্তু কোথায় কি! বউ বাঁড়ায় হাত দিয়েই ছিটকে সরে গেছে।
কি ব্যাপার! বাঁড়া তো দাঁড়ায়নি! দাঁড়ায়নি কেন!
সজলের যেন জোঁকের মুখে নুন পড়ল। হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে ও দেখল বৌ বুক চাপড়াচ্ছে আর কাঁদছে!! এতদিন কি করেছিস বল!! কার সঙ্গে লাগিয়েছিস!!
সজল সজোরে মাথা নাড়তে থাকে। বলে, কারো সাথে না। বিশ্বাস কর। কারো সাথে না।
বউ এবার কান্না থামিয়ে ভুঁরু কুঁচকে সজলকে দেখে। তবে তোর দাঁড়াচ্ছে না কেন!
একথার উত্তর সজলের কাছেও নেই। বিচিটা ধরে দু চারবার নাড়াচাড়া করে সজল বৌয়ের দিকে তাকায়। বৌ ঝ্যাটকা মেরে উঠে চলে যায়।
কি হলো সজলের! সবে তো তার ২৬ বছর বয়েস। এর মধ্যেই তবে… তাই বা কি করে হয়…. কিন্তু তাহলে!! সজল কদিন গুম মেরে থাকে। হুব্বার দরবারেও নিজেকে গুটিয়ে রাখে। পরপর দুটো অ্যাকশন ছিল মালি পাড়ায়। সজল যায় না। অন্য ছেলেদের পাঠায়। হুব্বার নজর এড়িয়ে যায় না।
কি হয়েছে বলতো! বাড়িতে কোনো পবলেম?
সজল মাথা নাড়ে।
তবে, এমন ভিজে স্যাপস্যাপে পাউরুটি হয়ে আছিস কেন বে!
সজল আর সামলাতে পারে না নিজেকে। হুব্বার পা ধরে কেঁদে ফেলে।
সব শুনে হুব্বা বলে, আরে বাঘের বাচ্চা তুই। লাশ ফেলে দিস এমন করে যে পুলিশের বাপও বোঝেনা কে শালা লটকালো! তুই এসব নিয়ে ভয় পাবি! শোন, রাজার মতো বাঁচবি বুঝলি , রাজার মতো! তুই এখন হুব্বার ডান হাত। তোর এসব নিয়ে মটকা কিচাইন চলে!
সজল হুব্বার কথা শোনে। মনে মনে একটু জোর পায়। ভাবে, কদিন নানা কারণে হয়নি। আবার নিশ্চই হবে! বউ মাগীটা আজকাল আর কাছেই আসতে চায় না। বলে যার ধেনোই নেই, তার আবার রগড় কিসের। সজল রেগে ওঠে, চুলের মুঠি ধরে বলে, খানকি মাগী, আমি তোর মরদ।
বৌ ঝ্যাটকা মেরে চুল ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, ওরে আমার মরদের বাচ্চা রে। ধেনো লটকে থাকে ওনার। উনি এলেন মরদগিরি ফলাতে।
সজল তাড়াতাড়ি বৌয়ের মুখ চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। পারেনা। বৌ আরো জোরে চেঁচায়।
হুব্বা তাই সজলকে নিয়ে সোনাগাছিতে যায়।মেয়েছেলের অভাব রে! জানবি, ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না। ফেলো কড়ি মাখো তেল।
সজল অনেক আশা নিয়ে এসেছে। মনে মনে ভেবেছে, বৌটার ওপর আর টান নেই। তাই বোধহয় হচ্ছে না। এখানে তো একসে বড়কে এক। এখানে শালা বিচি দাঁড়াবেই।
কিন্তু কোথায় কি! হতাশ হয়ে ফিরতে হয় সজলকে। মাঝখান থেকে সোনাগাছির মাগীটাও সজলকে নিয়ে হাসাহাসি করে।
দলের কাজেও আজকাল আর মন দিতে পারেনা সজল। মনের মধ্যে সারাদিন একটাই কথা ঘুরপাক খায়। পায়খানায় বসে সে কতবার বিচিটাকে টানাটানি করেছে, মুচড়ে দিয়েছে। কিছুই হয়নি। রাগে ক্ষোভে এক একসময় মনে হয়েছে ব্লেড চালিয়ে দিই। কিন্তু পারেনি। সেই যে সে প্রথম খুনটা করল, তারপর থেকেই তার আর দাঁড়ালনা। এমন হয় না কি! খুন করার সময় তো সে বাঘের বাচ্চা। তাহলে!
ভাবতেই ভাবতেই দিন চলে যায় সজলের। বাড়ি থেকে এখন সে বেশি হুব্বার ডেরায় থাকে। অ্যাকশান থাকলে লাশ ফেলে দিয়ে চলে আসে। খানকির বাচ্চাগুলোর ওপরই সব রাগ উগড়ে দেয়। গোটা শরীর ফালা ফালা করে দেয়। কিন্তু ওইটুকুই। তারপর! হাতে এখন তার অঢেল পয়সা। হুব্বার কাছে শিল্পীর কদর আছে। প্রথম খুনটা ছাড়া আর কখনো পুলিশ সজলকে ছুঁতেও পারেনি। সজল নিপুণ কৌশলে পৈতে করে এসেছে। কিন্তু অন্ধকার দুনিয়ার তার যত নামডাকই হোক না কেন, পিছন ঘুরলেই সবাই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। ব্যঙ্গ করে বলে বাঘের বাচ্চা, মাঝের আঙুলটা ঝুলিয়ে বিচ্ছিরি ভাবে দেখায়। সজল সব শোনে, দেখে। উত্তর দিতে পারেনা। মাথা নিচু হয়ে যায় তার।
বউও সজলের দখলে নেই আর। তলায় তলায় কার সঙ্গে সাল্টিং করছে। সজল খবর পেয়েছে। ইচ্ছে করেছে বানচোদকে গিয়ে এক কোপে নামিয়ে দেয়! কিন্তু কজনকে! কজনকে মারবে সে! বউ তার কাল নাগিনী। আজ একে ছোবল মারে, কাল ওকে! মাগীর রস মেটে না।
সেদিন অ্যাকশনের পর হুব্বা আর সজল মাল টেনে বসেছিল। দলের ছেলেরা সব কাছে পিঠেই আছে। নিজেদের মতো নেশা করছে। সজল আজকাল খুব কম কথা বলে। চোখগুলো তার লাল টকটকে হয়ে থাকে।কিসে যে সে বুঁদ হয়ে আছে হুব্বাও বোঝেনা। দলের ছেলেদের হাসির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। আজকে যাকে খুন হতে হলো সে শালা ভয়ে হেগে ফেলেছিল। সেই নিয়ে হাসাহাসি। আরো নানা কথা ওরা বলছিল। সব হুব্বার কানে আসছেনা। সজল শুনছিল সব। দেখছিলও। সেটা ওরা খেয়াল করেনি। ন্যালা কথা হতে হতেই চোখ টিপে বজরকে মাঝের আঙুলটা নিয়ে আবার সেই বিচ্ছিরি ইঙ্গিতটা করল। সজল একমুহূর্তের মধ্যে হাতের খুড়টা ন্যালার গলায় চালিয়ে দিল। দলের বাকিরা থতমত খেয়ে সরে গেছে। সেদিনের মতো আসর ভেঙে গেল। পটলা লাশের ব্যবস্থা করতে বেরিয়ে গেল। হুব্বা যেমন বসেছিল, তেমনই বসে থাকল। সজলকে নিয়ে তাকে এবার কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শালা সানকি হয়ে গেছে। বলা যায় না কোনদিন হুব্বাকেই…. পটলার সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলবে।
পরদিন সকালে হুব্বা ডেরায় এসে দেখে সজল রাতে বাড়ি ফেরেনি। উবুর হয়ে মেঝেতে শুয়ে আছে।এমনটাতো ও এখন প্রায়ই করে। নাম ধরে বার দুয়েক ডাকার পরও সজল সাড়া দেয়না। হুব্বা গায়ে হাত দিয়ে ডাকতে গিয়ে দেখে মেঝে রক্তে ভেসে যাচ্ছে। গলায় খুড় চালানো হয়েছে। খুড়টা সজলের ডান হাতে ধরা।