রাহুল দাশগুপ্ত-র কবিতা
মাঝখানের গলি
একদিকে টি এস এলিয়ট, অন্যদিকে জীবনানন্দ দাশ
মাঝখান দিয়ে একটা সরু গলি চলে গেছে
সেই গলি দিয়ে সে হেঁটে চলেছে
দুদিকেই স্তব্ধতা, দুরকম, দুদিকেই অন্ধকার
আর নিরন্তর বৃষ্টির শব্দ
গলিটা সরু হয়ে আসতে চাইছে ক্রমশ
মিশে যেতে চাইছে একে অপরের সঙ্গে
দুপাশ থেকে এগিয়ে আসছে একটু একটু করে
চাপ বাড়ছে, টের পাচ্ছে সেই বেড়ে ওঠা চাপ
কেউ কথা বলছে ফিসফিস করে? কারা?
এলিয়ট কিছু বলতে চাইছেন জীবনানন্দকে?
জীবনানন্দ এলিয়টকে?
ভাষা নয়, তীব্র হয়ে উঠেছে শুধু ইশারা
দমচাপা পরিবেশ, ঘন অন্ধকার, মাঝে মাঝে ফুটে ওঠা ছবিরা
সমুদ্রের দিকে ওরা এগিয়ে দিয়েছিল একটা কাচের গ্লাস
আর বলেছিলো, এসো
সমুদ্রকে ওরা ঢেলে দিতে চেয়েছিল সেই গ্লাসে
আর সবাইকে দেখিয়েছিল গ্লাসভর্তি জল
বিভ্রম সৃষ্টি করতে চেয়েছিল ওরা
সমুদ্রকে তারা সমুদ্র বলে স্বীকার করতে চায়নি
হাতির কাছে গিয়ে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলেছিল, ছারপোকা
নিজেরা পোকা বলে ওরা শুধু পোকাদেরই দেখতে পেত
আর যখন ওদের চোখ–ধাঁধিয়ে যেত
ওরা অস্বীকার করতে চাইত যা কিছু মহৎ, উজ্জ্বল, বিপুল
যা কিছু ওদের চেয়ে বড়ো, তাকে
আর তাকে ঠেলে দিতে চাইত একটা গলির ভিতর
আর সেই গলির দুপাশে সে খুঁজে নিয়েছিল
এলিয়ট আর জীবনানন্দকে…
বারান্দার খোঁজে, হাসপাতালে
যেদিকে তাকাই শুধু হাসপাতালের দেওয়াল চোখে পড়ে
অথচ এখানে থাকার কথা ছিল একটা বারান্দা
একটা বারান্দার খোঁজেই আমি এতদূর এসে পৌঁছেছি
ওদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম,
বারান্দাটা কোনদিকে বলতে পারেন?
আর ওরা বলেছিল, সামনে এগিয়ে যাও…
আমি এগিয়ে এসেছিলাম আর ভাবছিলাম
অনেকদিন কোনও বারান্দা দেখিনি
কাল রাত্রে হঠাৎ একটা বারান্দার স্বপ্ন দেখলাম
ঘুম ভেঙে গেছিল আমার
আর তারপরই আমি সেই বারান্দার খোঁজে বেরিয়ে পড়ি
শৈশবে যাকে হারিয়েছিলাম
শৈশবের পর যাকে আমি আর দেখিনি…
কিন্তু এগোতে এগোতে যে গন্ধটা আমি পাচ্ছিলাম
তা একমাত্র কোনও হাসপাতালেই থাকে
যেন কোনও হাসপাতাল এগিয়ে আসছে আমার দিকে
কিন্তু আমি তো হাসপাতালকে এড়াতেই চাই
আমি এড়াতে চাই অ্যাম্বুলেন্সের শব্দকে
স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া রক্তমাংসহীন হাড়ের কঙ্কাল
তাহলে হঠাৎ এই অসুখের সম্মোহন কীসের
চারদিক থেকে যেন এগিয়ে আসছে চারটি দেওয়াল
আর ঘিরে নিতে চাইছে আমাকে
ওই দেওয়ালগুলো আমার চেনা, আমি দেখেই চিনতে পেরেছি
হাসপাতালকে পাহারা দিতে দিতে বিভ্রান্ত হয়ে ওরা
কখন যেন জড়ো হয়েছে আমার চারপাশে
আর পাহারা দিতে শুরু করেছে আমাকেই…
প্রভু
প্রভু তাঁর প্রিয় সন্তানকে ডেকে বললেন,
‘এই বাগানটা তোমার। যাও, গিয়ে লুটেপুটে নাও।’
প্রিয় সন্তান ঠিক তাই করল।
পৃথিবীর আর কোনও মানে নেই তার কাছে।
সে গান জানে না। সাহিত্য জানে না। সিনেমা জানে না।
প্রজ্ঞার আগুন তার কাছে অর্থহীন। সংস্কৃতি দেখলে সে মুখ ভ্যাংচায়।
পৃথিবী তার কাছে স্রেফ লুটেপুটে খাওয়ার জায়গা।
মানুষের রক্ত তার কাছে খুব সুস্বাদু।
সে কিছুদিনের মধ্যেই বাগানটাকে ডাস্টবিনে পরিণত করে ফেলল
আর ভাবল, এটাই তো স্বাভাবিক…
কারণ, প্রভু তাকে এই শিক্ষাই দিয়েছেন
শুধুমাত্র এই শিক্ষাই
শুধু লুটেপুটে খাও
তার জন্য মিথ্যা বলো, জোরজুলুম করো, হত্যা করো,
রক্ত ঝরাও, আগুন জ্বালাও
কিন্তু লুটেপুটে খাও
প্রভুর সন্তান অক্ষরে অক্ষরে সেই নির্দেশ পালন করে চলে
একদিন ঠিক সেই সন্তানের বয়সী
অবিকল তারই মতো দেখতে একটি ছেলে
প্রভুর সামনে এসে দাঁড়াল
আর বলল, অনেকদিন খেতে পাই না প্রভু
একটু খেতে দিন
তেমন হলে কাজ দিন, উপার্জন করেই না হয় খাব
ছেলেটি ভেবেছিল, প্রভু দয়াময়
সে তো প্রভুরই আর একটি ছেলে
তার সন্তানেরই মতো দেখতে, সমবয়সী, আর এক সন্তান
প্রভু তার দিকে অনুকম্পার হাত বাড়িয়ে দেবেন
কিন্তু প্রভু জানেন
কে তাঁর ছেলে আর কে তার ছেলে নয়
কার দিকে হাত বাড়িয়ে নেবেন আর কার দিক থেকে হাত গুটিয়ে নেবেন
তিনি মুচকি হেসে হুঙ্কার ছাড়লেন
আর ছেলেটি লুটিয়ে পড়ল, গড়িয়ে গেল ডাস্টবিনের দিকে
ধুলো হয়ে মিশে গেল ধুলোয়…
রাক্ষস
পাশের গ্রামে একটা রাক্ষস এসেছে
খবর নিয়ে এসেছে একটি লোক
মোড়ল সভা ডাকলেন
লোকটিকে ডেকে জানতে চাইলেন
‘কেমন সে লোক? বর্ণনা দাও।’
লোকটি বলল, ‘সেটাই তো কথা
দেখলে চিনতেই পারবেন না
মনে হবে সাধু–সন্ন্যাসী বোধহয়
সোজা হিমালয় থেকে নেমে এসেছে,
কিন্তু ওটা ওই রাক্ষসের ছদ্মবেশ।
আপনারা সাবধান হোন
রাক্ষসটা সাংঘাতিক
বড়ো বড়ো দাঁত, আর মানুষ দেখলে
সামলাতে পারে না
মানুষের রক্ত দেখলে
হামলে পড়ে একদম…’
‘ওর কোনও হৃদয় নেই?’
মোড়ল জানতে চাইলেন।
লোকটা হাসল। বলল, ‘হৃদয়?
যার হৃদয় থাকে
সে কখনও রাক্ষস হতে পারে?’
মোড়ল সরলভাবে জানতে চাইলেন,
‘তাহলে রাক্ষস হওয়ার দরকার কী?’
লোকটা পাল্টা জানতে চাইল,
‘যে রাক্ষস হতে চায়
তার মানুষ হওয়ার দরকার কী?’
লোকটা চলে গেল
আর সেদিন রাতেই গ্রামে ঢুকল এক সাধু
সোজা হিমালয় থেকে এসেছে
গ্রামের লোকেরা তাকে পুজো করবে বলে ডেকে আনল
কেউ কেউ সন্দেহের চোখে তাকাল বটে
কিন্তু একটা সামান্য লোকের কথায় কে আর কান দেয়!
সেই সাধু কথায় কথায় বাণী দেয়, অভয় দেয়, প্রতিশ্রুতি দেয়
শুধু হাই তোলার সময় চোখে পড়ে
তার মুখের ভেতর, সরু, লম্বা, ধারালো দাঁত,
আর দাঁতের গায়ে রক্তের রাগ…
জাহাজ
সমুদ্র অশান্ত হয়ে উঠেছে
আর টলমল করছে জাহাজটা
একবার ঢেউয়ের মাথায় উঠছে
আর একবার ঢেউ বেয়ে গড়িয়ে নামছে
শুরু হয়েছে তুমুল ঝড়, অঝোর বৃষ্টি, ঘন ঘন বজ্রপাত
‘ক্যাপ্টেন কোথায়? ক্যাপ্টেন?’
আর্ত হয়ে কেউ চেঁচিয়ে উঠল
আর তখনই বিদ্যুতের আলোয় দেখা গেল ক্যাপ্টেনকে
কে যেন বলে উঠল, ‘এ যে পাগল হয়ে গেছে
বদ্ধ উন্মাদ…
অন্য একটা স্বর চেঁচিয়ে উঠল:
‘আর কোনও আশা নেই।
এ জাহাজের ক্যাপ্টেন একজন পাগল।
এ জাহাজ ডুববেই।’
ফিসফিস করে কেউ বলল, ‘ফিরে যাবে?’
পাশ থেকে কেউ জবাব দিল, ‘কোথায়?
তোমার মনে নেই? সব ভুলে গেলে?’
ফিসিফিসিয়ে সে আবার বলল,
‘সে তো অতীত। অতীতটা জঘন্য বলে
জাহাজটাকে আমরা একটা পাগলের হাতে
তুলে দিতে পারি না, ভবিষ্যৎটাও তাহলে
একদম ঝরঝরে হয়ে যাবে…’
কেউ একজন চেঁচিয়ে বলল, ‘সামনে একটা
দ্বীপ দেখা যাচ্ছে। ওখানেই চলো,
ওখানে গেলে আমরা বেঁচে যেতাম…’
আবার একটা আর্তস্বর শিউরে উঠে বলল,
‘না, যেও না, ওই দ্বীপে খুনীরা থাকে
ওরা মানুষ দেখলেই কুপিয়ে মারে
অথবা মানুষকে উস্কানি দেয়
তারা নিজেরাই একে অপরকে কুপিয়ে মারে
ওদের কোনও দয়ামায়া নেই…’
জাহাজটা প্রবলভাবে দুলে ওঠে আবার, হঠাৎ
বিদ্যুতের ছ্যাঁকায় পুড়তে থাকে…
বারান্দার খোঁজে হাসপাতালে, জাহাজ খুব ভালো লাগলো। মাঝখানের গলি “তীব্র হয়ে উঠছে ইশারা” তে শেষ হোলে আমার আশ্চর্য কবিতা বলে মনে হতো, হলো না।
বারান্দার খোঁজে হাসপাতালে, জাহাজ খুব ভালো লাগলো। মাঝখানের গলি কবিতাটা “তীব্র হয়ে উঠছে” পরের স্তবকে “ইশারা” তে শেষ হোলে আমার আশ্চর্য কবিতা বলে মনে হতো, হলো না।
বারান্দার খোঁজে, হাসপাতালে কবিতাটা বেশ ভালো লেগেছে