বিশেষ কবিতা সংখ্যা
১ জানুয়ারি,২০২১
কবিতায় বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়, গৌতম চৌধুরী, দীপক রায়, গৌতম বসু, দুর্গা দত্ত, রাণা রায়চৌধুরী, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়, সর্বজিৎ সরকার, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুদীপ বসু, জয়দীপ রাউত, দীপঙ্কর বাগচী, সন্মাত্রানন্দ, যশোধরা রায়চৌধুরী, মৃন্ময় চক্রবর্তী, শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, অনিন্দ্য রায়, সোহেল হাসান গালিব, শ্রীদর্শিনী চক্রবর্তী, সব্যসাচী ভৌমিক, মণিশংকর বিশ্বাস, বেবী সাউ, রাজকুমার রায়চৌধুরী, অনিন্দিতা গুপ্ত রায়, কস্তুরী সেন, অদিতি বসু রায়, শুভম চক্রবর্তী, তিলোত্তমা বসু, সুপ্রভাত মেট্যা, পঙ্কজ চক্রবর্তী, ওবায়েদ আকাশ, বুবুন চট্টোপাধ্যায়, তৃষ্ণা বসাক, সৌমনা দাশগুপ্ত, অভিজিৎ বেরা, রণজিৎ অধিকারী, সন্দীপন চক্রবর্তী, রাহুল দাশগুপ্ত, কুন্তল মুখোপাধ্যায়, কৌশিক গুড়িয়া, বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়, চন্দন ঘোষ, রাতুল চন্দ রায়, শুভব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌরব চক্রবর্তী, তৃণা চক্রবর্তী, জাতিস্মর, মানসী কবিরাজ, পম্পা দেব, অরুণাভ রাহা রায়, ঈশানী বসাক, রিমি দে, সুপ্রভাত মুখোপাধ্যায়, সুবীর সরকার, শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী, সুদেষ্ণা ঘোষ, রুমা তপাদার, সরোজ দরবার, রিমি মুৎসুদ্দি, প্রগতি বৈরাগী একতারা, রাজর্ষি দে, রাজদীপ রায়, শ্রীজাতা গুপ্ত, সুমিতা সান্যাল, শীর্ষা, গৌরাঙ্গ শ্রীবাল, সৌভিক গুহসরকার, গৌতম গুহ রায়, শ্যামশ্রী রায় কর্মকার, স্বপন নাথ, এলা বসু, সুকৃতি, অয়ন চৌধুরী দীপকরঞ্জন ভট্টাচার্য এবং হিন্দোল ভট্টাচার্য
সহজ পাঠ
বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়
আজ হইতে সদা সত্য কথা
আলস্যে লাস্যে নাই রুচি
অদ্য হতে পূর্ণ নীরবতা
সুনির্মল হাস্যে হউক শুচি।
সূত্রধর কুমার কামার
সপুত্র সংসার সর্বলোক
কবি হোক ,দাস্যভাব আর
এই পদ্য শিশুপাঠ্য হোক।
পড় পদ্য সহজ সরল
প্রত্যন্তে প্রতি বর্ণে মিল
পত্রপুটে প্রস্ফুটিত দল
মিতাক্ষর পদ্ম ঘন নীল।
শর্ত রাখি বর্ণ পরিচয়
ঈশ্বরের প্রথম ভাগই দিও।
সন্ততিকে দ্বিতীয় ভাগ নয়
শিশুপাঠ্যে দ্বিত্ব বর্জনীয়।
দুইটি স্তবক
গৌতম চৌধুরী
১.
কতটুকু এই কলিজা। আর কতটুকুই বা মগজ। তাহা লইয়াই কত না রঙ্গ মানুষের। কতটুকুই বা মানুষ আর কতটুকু তাহার এই দুনিয়া। তুচ্ছ তুচ্ছ তুচ্ছ। তুচ্ছের ভিতরেই তবু ফেনায়িত ঘোর আলোড়ন। অণুকণিকার মঞ্চে তন্ময় শ্রমিকের নৃত্য অবিরাম। বীজের কুহরে বাজে যথাযথ বাঁশি। কাঁপে স্বপ্ন, উদ্দাম উড়াল। মেঘ বজ্র বাতাসের মিনার বহু নিচে। আবার অবতরণের মায়া। ওই তো অদৃশ্য রজ্জু অরণ্যের দিকে। প্রতিটি বৃক্ষই আজ প্রবক্তা। ব্যক্ত ও অব্যক্ত রহস্যগুলি উন্মোচিত হয় যদি আজ। স্নাতকেরা নতজানু উন্মুখ। সামান্য পুষ্পের ঘ্রাণে এই ধ্যান।
ঘুলঘুলির ছিদ্র দিয়া বিস্মিত শিশু কী দেখিতে কী দেখিল। তাহার জ্বর। ক্ষুদ্র প্রাণের উপর রাঙা রাঙা দৈত্যের কাহিনি। সে-ও দৈত্য হইবে, কালে। দুখিনী মায়ের কোলে আনিয়া দিবে ইনসাফ। শিশুরাই যাহা পারে।
২.
ছায়া ছায়া স্বপ্নগুলি জাগে, ফের উদাসীনভাবে মুছিয়া যায়! অসমাপ্ত বাক্যের স্পর্শ যেন,তন্দ্রার ভিতরে ঘোর ওষধির মতো। জাগরণ আর ঘুম। ঘুম আর জাগরণ। দোলক দুলিতেছে এখনও। তাহার পক্ষপাত কোনদিকে? বহু হাত শূন্যে উঠিল উত্তরটি জানা বলিয়া। তবু যে প্রশ্ন জাগে, তাহা হয়তো ছল, নিজেকেই। বা হয়তো মায়া, নিজেরই প্রতি। প্রতিটি মুহূর্ত কত না বায়বীয়, কেবলই ছড়াইয়া পড়ে, দিশা মিলে না। প্রতিটি মুহূর্ত পিচ্ছিল তরল, পুরা অস্তিত্বই আছাড় খাইয়া পড়ে, নাগাল পায় না। প্রতিটি মুহূর্ত জমাট বাঁধিতে বাঁধিতে কট্টর কঠিন। তাহার ভিতর ছিদ্র করিয়া ঢুকাইতে হইবে সূচ। সূচের পিছনে সুতা। সুতার পাকে পাকে জড়ানো থমথমে ছবিকথামালা। এই রহস্য এক আনন্দ। এই অসম্ভাব্যতা এক ভয়। দ্বৈরথের প্রান্তরে গড়ায় চাকা।
অস্পষ্টের সুন্দরতায় জাগে মৌন। চক্ষুই বাঙ্ময়। কারণ, বাক্য দৃষ্টিমান। যেখানে বদ্বীপ শেষ সেখানেই সমুদ্রের শুরু। যেখানে সমুদ্র শেষ সেখানেই বদ্বীপের শুরু। শেষ গিয়া মিলিতেছে শুরুতে। উভয়ত।
মৃতদের সঙ্গে বনভোজন
দীপক রায়
স্বপ্নের ভেতরে কাল মৃতেরা এসেছিল
বনভোজনের কথা হল ওদের সঙ্গে।
কারা আসবে কথা হল — কে আসতে পারবে না কথা হল ।
কেউ পরে আসবে — টিফিন করবে না
কেউ চলে যাবে দুপুরের পর
অনেক গল্প করার সময় পাবে না কেউ
ছেলে আসবে অনেক দিন পর।
দুপুরে কী খাওয়া হবে
সকালের টিফিন নিয়ে কথা হল
সামান্য তর্ক হল
মাংস খায় না কেউ
কেউ শুধুই নিরামিষাশী
কথা হল
শেষ পর্যন্ত হাসিমুখে চলে গেল ওরা …
স্কুলভ্যানের শব্দে ঘুম ভাঙল
নরহরির সমস্ত লুপ্ত টীকা
গৌতম বসু
নরহরির সমস্ত লুপ্ত টীকার সন্ধানে আমি ঘুরি।
মুখ কালো ক’রে, তোলপাড় করলাম সব চতুষ্পাঠী,
বাঁধাঘাটের পাঁচ নম্বর সিঁড়ি অবধি নেমে গেলাম ৷৷ ১
*
সমস্ত টীকা ও চিন্তাসূত্রের বেদনাহত নিজস্থান,
সমস্ত উদ্বেগ, বিরতিচিহ্ন ও বিজন পুকুরপাড়,
তোমাদের জানালাম, নরহরি আর ঘরে ফেরে নাই ৷৷ ২
*
তিষ্ঠ, ধ্বংসপথ। নরহরির জিহ্বা ব্যবহার ক’রে,
নরহরির ফেলে-যাওয়া পাদুকাযুগল স্পর্শ ক’রে,
আমি তোমায় নিষেধ ক’রে বললাম, তিষ্ঠ, ধ্বংসপথ ।। ৩
দুটি কবিতা
দুর্গা দত্ত
সন্দেহ করো
প্রতিটি মুহূর্তে তুমি দেখে শুনে পড়ে নাও পাঠ
তোমার গণ্ডীর কাছে কেউ-ই যেন গা ঘেঁষে না আসে
ছোটো করে বাঁচো দ্রুত, ছোটো করে নাও চারিপাশ
দূরে দূরে বাঁচো আর খাটো খাটো জীবনের প্রতিটি ইঞ্চিতে
সন্দেহের বীজ বুনে দাও
সুখ্যাত আড়চোখ আজ তবে সহবাসী কবচকুণ্ডল !
রক্তের ভেতরে শুধু সন্দেহের ঢেউ টেনে তোলো
সন্দেহ করো প্রিয় ঠোঁট নাক মুখ আর চোখের পল্লব
হাতের ওপরে হাত, সন্দেহ করো প্রতি শ্বাস
প্রতিটি পায়ের ছাপে প্রতিটি প্রণামে তুমি সন্দেহে থাকো অবিচল
সন্দেহ করো প্রতি বর্ণ ধ্বনি স্বর ও ব্যঞ্জন
প্রতিটি পতঙ্গ কীট পশু পাখি জীব ও উদ্ভিদ
সন্দেহ করো এই খুঁটে-খাওয়া, উঞ্ছবৃত্তি
বাসা বানানোর শ্রম, শাবক-লালন
প্রতিটি উড়াল, ডানা, প্রতিটি পালক
কাকলির কলস্রোত, সন্দেহ করো নির্বিকার
সন্দেহ করো এই পা-তোলা পা-ফেলার ভুবন
সন্দেহ করো চোখ, নিবিড় আহ্লাদ আর ছলছলে নোনাজল, ঘাম
মুখস্থ করো এই সন্দেহের ধারাপাত, নামতার পাতা
সন্দেহ করো এই ইতিহাস, পায়ের তলার এই মাটি
সন্দেহ করো এই প্রতি খণ্ডমুহূর্তের বেঁচেবর্তে থাকা
সন্দেহ করো ভালোবাসা
দংশন
কেন ভেঙে দিয়ে গেছ বল্মীকের স্তূপ নির্বিকার?
অযথা অহং শূন্যে, পতপত হাওয়ায় উড়িয়ে
মুচড়ে দিয়ে মগডাল, নিরাপদ উল্লাসে মেতেছো?
কেন প্রতি পদে-পদে পিষে দিয়েছ জমি ও জিরেত?
মাতাল ফুৎকারে কেন প্রতিদিন ধুলোঝড়ে নির্বিকার তুমি
উড়িয়ে দিয়েছো বাস্তু ঘটি-বাটি জন্মপরম্পরা?
যূথবদ্ধ বেঁচে থাকা ঢেকে দিয়েছ আগুনে, ধোঁয়ায়?
কেন প্রতি রাতে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে সব বনস্পতি? পিঁপড়ের সারি?
লোভে ও লালায় কেন ভিটেমাটি ভিজে গেছে পাতাল অবধি?
সমুদ্রে পাহাড়ে লালা, ফুলে ফলে শস্যের অন্দরে
পতঙ্গের ডানায় ডানায় কেন ছিটিয়ে দিয়েছো তুমি লালা অবিরাম?
নদীর সমস্ত হাতে বুকে পেটে কেন বলো শেকল বেঁধেছো?
প্রতাপে দোর্দণ্ড ধ্বজা চরাচরে আকাশ ফুঁড়েছে
মাথা ঘুরে পড়ে গেছে চিল, ছিঁড়ে গেছে শকুনের ডানা
কেউ কিছু কোনোদিন বলেনি বলেই
ভেবো না যে কেউ কোনোকিছুই বোঝেনি !
পার পেয়ে যাবে সব? কারও কোনোকিছুই হবে না?
বজ্রপাত? মরুর আগ্রাস? খরা? বন্যা? বানভাসি?
ওলাওঠা? মায়ের দয়া-য়? কারো কোনোকিছুই হবে না?
অধোমুখী সভ্যতার প্রতিটি মুহূর্ত জেনো দেখে রাখছে পোড়া মাটি
পিঙ্গলাক্ষি তেঁতুলের আধপোড়া ডাল —
পোড়া পৃথিবীর গায়ে ছাইপাঁশ হাওয়ায় উড়িয়ে
যদি এই কালসাপ শিয়রে দংশন ক’রে ঢেলে দিতে চায় সব বিষ
বুঝে নিতে চায় সবকিছু…
তাগা বাঁধবো কোথায়?
আড়ালে
রাণা রায়চৌধুরী
এই ঝড় কোথায় থামবে? এই জাহাজ কোন বন্দরে পৌঁছবে? মা তুমি, নারী তুমি, গর্ভাশয় তুমি আমাকে চায়ের কাপে দুলতে দুলতে নিয়ে যাচ্ছ দূরের কোনো অচেনা আমির কাছে। আমি, আমি নয়, আমি আসলে তুমি। তোমার শোক? আমাকে দাও। আমি কষ্ট পেতে চাই। ওগো লেক কালীবাড়ির পুরোহিত, তোমার সব বৈরাগ্য আমি সাইকেলে গ্রামে গঞ্জে পৌঁছে দিতে চাই। ওগো দোপাটি ফুলের বোন এসো গান শিখি। ওগো সোনাগাছির ধুলো আমাকে জটিল অঙ্গের অঙ্ক শেখাও। কে কাশছে? কে কাঁদছে? কে সম্পাদনা করছে ভ্রূণ সংখ্যা? তাকে ডাকো। তাকে গান আর মা দাও বৈশাখ দাও তাকে। চলো পুড়ি। বৈশাখে পুড়তে পুড়তে চলো মা-বন্দরের কাছে যাই।
দুটি কবিতা
চৈতালী চট্টোপাধ্যায়
তিরিশে ডিসেম্বরের জন্মদিনে, তোমাকে
ঋণ ছিল কোথায় না ছড়ানো!
প্রীতিতে, ইশারায় ও গুজব-ওড়ানো।
যারা পাড়া সামাজিকভাবে ঘিরে রাখে,
আতঙ্ক ছড়ায় বাঁকে বাঁকে
আমাদের কম-আলো-জ্বলা পথটির—
তারা তো সামান্য নয়!
তাদের অলোকসামান্য পরিচয়
শৈশবে দাগ ধরায়।
যৌবনে দাঁত বসায়।
সোনা-বাঁধানো শৃঙ্খল
কেউ-কেউ
হয়তো উপহার দেয়,
ভুলে যাই, ভুলে গেছিলাম।
সব ঋণ,
মার পেটকাপড়ের মধ্যে ঢেলে দিয়ে
আজ আমি ইতর হলাম
বড়দিন
ছোট-ছোট আলোদিন চরে।
বিষ খায়, কালো হয়ে মরে।
একেকটা পার্কস্ট্রিট যায়,
পালিয়ে বাঁচার আশায়।
উল্লাসে ডুবিয়েছে চোখ।
আলকাতরার মতো শোক
গড়িয়ে আসছে,ওরা জানে!
মাথা তোলে খুব সাবধানে।
আর, পোকাদের মেখে নেয়
গায়ে,যারা ঘুম ভেঙে উঠে
ক্যালেন্ডারের থেকে খুঁটে
বড়দিন তুলে ফেলে দেয়
স্বপ্নাদেশ বাজারের কোন কাজে লাগে
সর্বজিৎ সরকার
না। এটা ঠিকই যে আমি শুরুর বিন্দুটা খুঁজে পাচ্ছিনা।
আর আমি, মাথার দুপাশে হাত, রগ চেপে বসে আছি।
বিন্দুর আরেক নাম ঘর। ঠিক যেভাবে, ঘরের আরেক নাম চাওয়া।
ইঁটের গাঁথনি যেমন, তেমনই, কোনও ঘর উঠলে বোঝা যায়
শ্বাসের ওপর উঠে আসছে শ্বাস, বলছে , চাই চাই চাই চাই
‘আমি কি স্বপ্ন দেখছি?’ সে মাটি কবে যেন বলেছিল আরম্ভের দিনে।
যে কোনও শুরুতে তাই, বিন্দু থাকেনা, স্বপ্নাদেশ থাকে,
চাষি জানে, ধান রুইতে মিথ্যে লাগেনা, স্বেদ ও সমর্পণ লাগে
যে কোনও দিকেই পারে চলে যেতে, তবু
অতল নাভির তল ছুঁয়ে ফেলে কৃষকের সহজ আঙ্গুল।
ফসলের ক্ষেত, জ্যোৎস্না আলোকে, কোনদিন মিথ্যে বলেনা।
চাই চাই চাই চাই …
চাওয়া তবে ফুরায় কিভাবে!
শ্বাসের ওপর উঠে এসেছিল শ্বাস, বলেছিল,
চাই চাই চাই চাই,
চাওয়া তবে ফুরায় কিভাবে?
ফুরায় লেনদেনে। বণিকেরা এলে। বণিক বানিজ্য বোঝে। ছবি কাটে। সুর কাটে।
ফসলের নিড়ানো ক্ষেতে দমচাপা হাওয়া। একা কাঁদে। বণিক এসব বোঝেনা।
মজুত ফসল। চারপাশে বেড়া। লেনদেনে বৃদ্ধি ও আয়। বাড়ে, ‘এ ফসল
আমারই এখন’ বলবার সুখ। গোলাঘরে আড়তের ধান, তাই বৈধ।
মাটির নিবিড় চাওয়া, চাষিটির ছেঁড়াফাটা হাত, তার কাছে অবৈধ অসুখ।
রাত আরও দীর্ঘ হয় একদিন। বড় গোল চাঁদ এক, উঠে আসে তারার আকাশে।
মাটি কাঁদে? না কি কাঁদে না কখনো? হয়ত সে শর্তসাপেক্ষে বেঁচে থাকে।
দেখে, চাষিটিও বসেছে এসে একা, পৃথিবীর পারে, চাওয়া নেই কোনও।
বাজারে বিকিয়ে গেছে সব। মুদ্রার অধীন এই বিনিময়। উপচে ওঠা চাওয়া নেই
কোনও। মাটি চেয়েছিল কোনদিন, তার প্রেতস্বরটুকু শুধু বেঁচে আছে।
দুটি কবিতা
সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
আবহ
এই না-থাকার মাঝেই থাকা আনাচে-কানাচে
সমোচ্চশীল জল জানে, সে কোথায় গোপন আছে
বৃষ্টি পড়ে টাপুরটুপুর তন্তুস্নায়ুর মাঠে
কুমড়োলতার মুমূর্ষু প্রাণ বুকসাঁতারে হাঁটে
আধেক-দুয়ার বন্ধ বুকের আধেক-দুয়ার খোলা
রক্তধারায় বাণিজ্যপোত ছুটন্ত, পালতোলা
তুলোর ভারে ন্যুব্জ গাছের মৃত্যুটি মল্লারে
ডালের পাখির আনন্দস্নান বর্ষা-অভিসারে
মৃত্যু মানে হলুদ পাতায় সুফির দারাশিকো
জীবন মানে শেষ ফ্লাইটের অঞ্জনা ভৌমিকও
আয়ু
একদিন তাকে নিভন্তে ডেকে নিয়ে
বলে দাও, ভালবাসার অস্থিরতা
মৃত্যুর মতো অমোঘ তেমনও নয়
কারণ, জীবন ঘুরন্ত এক গ্রহ
যে ভাবে ঘোড়ার নালে নিভন্ত ঘাসে
আয়ুরেখা আঁকে স্বচ্ছ শিশিরকণা
সে ভাবে তাহার বেদনার পাশে বসে
শুদ্ধস্বরের সঙ্গীতে হাত রেখো
চাবুকের কোনও প্রেম নেই কেন, জানো
কারণ, বেচারা শাপ-অভিলাষী প্রাণী
পূর্বজন্মে প্রেমিকেরই ত্বক ছিল
দ্বন্দ্বে-শিকারে ম’রে সব বিস্মৃত
কী সুখ জীবন অপাঙ্গে স্থির করে
কী লাভ বাতাস নিক্তিতে মেপে নিয়ে
স্বপ্নের মতো সামান্য বেঁচে থাকা
গ্রিসের পাত্র, কিটসের হাতে আঁকা
দুটি কবিতা
সুদীপ বসু
রেড হান্ট
সাড়ে তিনটে বাজলেই
জানলাগুলো আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে যাবে
বাড়িভর্তি পাখি নিয়ে তুমি তখন কী করবে নিক স্যামুয়েল?
যখন চোখের সামনে ভেঙে যাবে সব
গুঁড়িয়ে যাবে
কাকে টেলিফোন করবে তুমি?
কাকে বলবে, ‘এই আমার রক্তনির্জন।
এই আমার লাল মৃগয়া।’
‘রেড হান্ট।’
রোজ রোজ অন্ধকার ভালো?
তাহলে স্বীকার করবে মেয়েটির প্রতি
নিষ্ঠুরতা
শীতরাতে
একসঙ্গে স্নান?
গানের ভিতরে গুমখুন
তাহলে মেনেই নেবে তুমি?
ভাবো নিক
ভাবো
সেই রাত
আছাড়ি পিছাড়ি জ্যোৎস্না
আবার শিকল ছিঁড়ে পালিয়ে গেছে মা
পাশের ঘরে, দরজা বন্ধ, অন্ধকার
বাবা আগুন নিয়ে খেলছে।
ট্র্যাপিজ
একটা অস্পষ্ট কেউ আমার সঙ্গে খেলতে চায়
একটা অসম্ভব কেউ আমার সঙ্গে খেলতে চায়
আমি না বলে দিয়েছি
এই যে কামড়াকামড়ি প্রেম
এই যে মুখে রক্ততোলা ভালোবাসা
এই এক ধার-করা জীবন
আমি হোটেলের সবুজ দরজায় নামিয়ে রাখলাম।
স্বপ্নে দেখি
চারপাশে কাঠমল্লিকার স্তব্ধ বন
চারপাশে অর্জুনের অন্ধকার
শীত করে
‘আমি যে কাঁদতেও পারি না অরিন্দম’
তুমি ফিসফিস করে বলো।
ভ্রমণ
জয়দীপ রাউত
বাবা কোনোদিন কোথাও যাবে না আর
আমি মাঝে মাঝে বিছানার
চাদরে পাহাড় আর পুরীর সমুদ্র এঁকে রাখি
আঁকি জগন্নাথ
আমার বাবার হাত
আমার হাতের ‘পরে থরথর করে কাঁপে
বাবার অনন্ত ইচ্ছে দূরে আরও দূরে
শেষবার বেড়াতে যাবার
বাবা যাবে,
শরীর ফুরিয়ে আসে তার
যোনি
দীপঙ্কর বাগচী
চুরাশি হাজার যোনি , আর আমি পেরোবো না জেনো ।
এই জন্ম শেষ জন্ম … আজ কতো শকাব্দের পর
কতো ইলাবর্ষ ধরে, পেরিয়ে এসেছি জলাভূমি —-
কতো পূর্ণ অন্ধকার
অযুত সহস্র বছরের ঘর।
প্রবাসী ঘরের খোঁজে, কেটে গেছে সমস্ত যৌবন
অসহ্য স্নায়ুর রোগে, পড়ে থাকি গৃহকোণে একা
আমি জানি সব ঘর প্রবাসের আলো মায়া ঘেরা,,,
এক– একটি দিন যায় ,বেলা যায়, দূরের শহরে , নামে ছায়া।
খেয়া ঘাটে মাঝি ডাকে ,চলে এসো , চলে এসো বাবু …
ফিরতি খেয়া আর তুমি পাবে না কো —– আজ রাতে — এখন বিশ্রাম।
আমার কানের কাছে মৃদু বাজে কিসের ও স্বর !!!!!!
কবি জন্ম শেষ জন্ম…… মায়া চাঁদ আকাশে আবার ।
দুটি কবিতা
সন্মাত্রানন্দ
অন্তরাল
কাকে লজ্জা করো তুমি, কাকে তুমি লজ্জা করো, নারী?
কেন এত কুণ্ঠা তাকে, যে জেনেছে সমস্ত তোমারই?
হত্যা কাকে করো তুমি? কাকে হত্যা করে এলে, নারী?
তোমার বিমুগ্ধ কোশে আমার মেধাবী তরবারি!
কাকে বা ডেকেছো বলো, কাকে বা ঢেকেছ তুমি, নারী?
ছায়ারাত গাঢ় হলে চোরা আলো সুদূরপ্রসারী!
স্মৃতিরিক্ত শূন্য মনে বলো আজ ছুঁয়ে আছ কাকে?
নদী তার পাড় ভাঙে, মরাস্রোত কিছু ধরে রাখে?
স্রোত
এসো, আজ স্রোতাপন্ন হবে।
নদী তো ডেকেছে কবে,
কেন তুমি পার ছুঁয়ে আছ?
পারাপারে হাট আছে,
আছে মনোহারী বিপণি-বিতান,
সেসব অনেক ঘুরে
নদীতীরে এই বটতলা,
এখানে বসেছ তুমি বহুকাল,
কপালের শ্রমজ সলিলে
নদীর বাতাস এসে আরামের সুখ হয়ে লাগে;
এও তো আসলে সুখ,
স্রোত আজও ডেকেছে তোমাকে।
তাকে আর কতদিন বলো তুমি
অনৃত ফেরাবে?
কেন আজও পার ছুঁয়ে আছ?
কেন আজও বৃদ্ধবটছায়া?
চলো তো, হিন্দোল, দেখি স্রোত কত নারী?
আমাকে ভাসাবে বলে যম ভুলে যমুনা এসেছে।
অস্তপথ
যশোধরা রায়চৌধুরী
এই ত আমাদের পতন রঞ্জিত অস্তপথ
এই ত আমাদের আপাত নিরীহতা, গভীর শঠ
এই ত আমাদের শব্দ জব্দের কী প্রকরণ
এই ত আমাদের অনন্তের দিকে ফিরে শপথ
তারপরেই আসে পতন আমাদের গভীর খাদ
তারপরেই আসে নীরব কাতরতা, উচ্চ নাদ
তারপরেই আসে যত না বেদনা , তা ফেরানো হাত
চিৎকারের হাতে নিজেকে ছেড়ে দেওয়া , পক্ষপাত
মেলাংকলি থেকে নিজেকে তুলে নেওয়া, কর্মময়
এইভাবেই জেন আমরা নিজেদের করি সময়
এইভাবেই যেন আমরা হয়ে উঠি সমর্থ
প্রতিটি জাগরণে প্রতিটি ঘুমে যেন অমর্ত্য
তিনটি কবিতা
মৃন্ময় চক্রবর্তী
তাড়ুয়া মন্ত্রী হবেন
পাখিদের মন্ত্রীশালায় গিয়েছেন কাকতাড়ুয়া
শালিকের জন্য তিনি সাজাবেন পান ও চুয়া
মাথাটি মন্ত্রণাময়, একদম ভাঁড়ুর মতো
লাল নীল সুযোগ বুঝে, আগেও যেমনি হতো।
তাড়ুয়া মন্ত্রী হবেন, কাকেরা দেশের রাজা
আমাদের ভোটের কাগজ, হাঁড়িতে কড়াইভাজা
চিবিয়ে দাঁত ভেঙেছে লালনীল বাছার খেলায়
পথেরা গোল্লাছুটে দিল্লির গাড্ডুমেলায়।
তিরকাঁড় যখন ছিল, ছন্দের সহজ বাগান
চাষারা সামলেছিল খিলানের সামান্য ধান
মলো যা ভাবনা কী সব, পালে কি বাঘ পড়েছে?
তাড়ুয়া মন্ত্রী হবেন, খোকারা গান ধরেছে।
আমাদের পা মারাদোনা সন্তান
এখনো কোথাও কাঁকড়াঢিলের মাঠ
নাড়ার গালিচা, ভিজে মাটি সম্বল
ঘোড়সওয়ার আবার বৃষ্টি আসে
পায়ের জোয়ারে ভেসে ওঠে ফুটবল।
জ্যোৎস্নায় দেখি ফুটবল জেগে থাকে
খালি পায়ে দাগ শামুকের আশাবাদ
মাঠজুড়ে গান মেক্সিকো মেক্সিকো
আমাদের প্রেমে নেই এতটুকু খাদ।
প্রতিটা বাঁকেই যেন ভগবান ছোটে
তিনকাঠি ছেঁড়ে যেন তারকার ঘ্রাণ
আমরা খেলছি সারাটা পৃথিবীজুড়ে
আমাদের পা মারাদোনা সন্তান।
অভিমন্যু ভারতবর্ষ
ছদ্মবেশী সপ্তরথী ঘিরে আছে সঘোর কৌতুকে,
প্রবেশের পথ জানো তুমি,
অহল্যাভেদী রামচাঁদ; ফিরিবার
পথ নেই যদিও সম্মুখে!
শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা
১
আমরা চামড়ার তলায় বহন করি
যা কিছু দেশ বলে অনুভূত তার দৈবে গচ্ছিত রাখা
কাগজের জিভ ও অ্যালুমিনিয়ামের ভাষা
সদ্য ভাঙা ওষুধ-ঘুমে গুঁড়ো হয়ে পড়ছে ধাতব বাতাস
জলের আশ্বাসেও জাগা যাচ্ছে না
শুধু বিস্মরণের উপদেশ
যেন স্নায়ুতে বিদ্যুৎ ছুঁইয়ে কেউ
সামনে মেলে ধরেছে সুগন্ধ
প্রিয় উন্মাদনা জুড়ে নামছে
সান্ধ্যপুষ্পের গ্রীষ্মতম সাদা
অথচ এখনও শোনা যাচ্ছে আক্রমণ ফাটল
যেন বা আগুনে কাগজ বা নুন ছেটানোর শব্দ
২
এ দেশ আমাকে চিবিয়েছে
সমস্ত সঙ্গীত জুড়ে কাঠবাদাম রঙের ছায়া
লাফিয়ে পড়ে আঁচড়ে দিয়েছে মাংস
আমাদের শেষতম অভিধানের পাতা
অভিযোগ অর্থহীন
শুধু দিনের জঠরে বড় হয়ে ওঠে
সাজানো পেয়ালা আবার স্টিল লাইফ
ফল ও শান্ত ছুরি
লোককাহিনিতে তুমি
অনিন্দ্য রায়
পড়শীর জানলায় দেখি, মুখোমুখি মাছের মোটিফ
বিছানাতে থইথই করছে জল আর জোলো কেলেঙ্কারি
দৃষ্টিকে ফাৎনায় বেঁধে ছুড়ে দিই আকাঙ্ক্ষার ছিপ
ওঠে না তাহাতে কিছু, হাত ক্রমে হয়ে ওঠে ভারী
অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ছিটেফোঁটা আহার জোটেনি
এভাবে দুপুর গেল, বিকেলও চৌপট তাড়াতাড়ি
অবস্থা এরম হলে চ্যাঁচামেচি আপনারা করতেনই
আমি আরও ধৈর্য ধরি, ভাবি, রাত্রে সুযোগ পাবো তো
হয়তো জলস্ফীতি হবে, চাঁদ উঠবে, ভিজে যাবে বেণী
লোককাহিনিতে তুমি আপাত নিশ্চল, অনাহত
কখনও গভীরে যাও, ভেসে ওঠো, খেলাও বাঞ্ছাকে
আমিও জলজ হলে আপদেবিপদে বেশ হত
আজ শুধু জানলা খুলল, পাব হয়তো কখনও দরজাকে
তারপর তোমাকে আর ঢাকতে পারে দেখব কত শাকে
মেঘ ও ফড়িং
সোহেল হাসান গালিব
১
পাপড়িগুলি আজও স্পর্শ করেও দেখি নি, পুষ্প জানে।
জ্ঞাতি-বোনেদের মৃদু শ্বাস ও শাসনে ডুবে থেকে
ঘ্রাণসিন্ধু কাকে বলে, এই প্রশ্ন কেবল তুলেছি।
পল্লবের কাছে গিয়ে কুসুমচয়ন না করেই
যারা ফিরে এসেছে, তাদেরই দলে আমি। ভুল কিছু
করেছি কি? তারা-মাছ হাতে নিয়ে জলেই দিয়েছি
ফের ছেড়ে—দেখেছি সে প্রত্যাবর্ত-ঢেউ নিয়ে দূরে
ভেসে গেছে। এতদিন ধরে শুধু ফুল তোলা হলো
কাপড়ের গায়। অর্থহীন অর্থে। নন্দন-প্রয়াসে।
এইবার দর্জির নিপুণ হাতে কেটে-ছেটে-নেয়া
পোশাকের কথা ভাবা যাক—অন্য কারো প্রয়োজনে।
আরো দিন আরো রাত্রি পার করে তবে, অনুমান,
সংগীত-মধুর হবে পানোৎসব—প্রত্যাশার চেয়ে
বেশি মিষ্টতার। কিছু গান শিখেছি যে। বৃষ্টি যদি
না আসে, না এল—আছে ফুলের ফোয়ারা। খরতাপে
কখনো আঠালো ফাঁদ নিয়ে তাই ছোট্ট ভাঙা ডালে
ঘুরি নাই ডানাঅলাদের পিছে, হে ফড়িং তুমি
বিকেলের রোদে নম্র হয়ে সেধে ধরা দেবে ব’লে।
২
মগ্ন হয়ে পড়ে থাকা সবার নিয়তি নয়—কিংবা
উদভ্রান্ত ভেসে যাওয়া। জ্বলেও উঠতে চায় কেউ—
আগুনে পুড়েই কিছু বীজে হয় অঙ্কুর-উদ্গম।
পাহাড়ের নিচে কিছু গাছ তাই ছড়ায় দাহ্যতা
প্রতিটি নিশ্বাসে। থাকে তারা অপেক্ষায়—উঁচু থেকে
খসে-পড়া কোনো পাথরের জন্য, সামান্য আঘাতে
যে ওড়ায় স্ফুলিঙ্গ-ফুলের রেণু মাথার ওপর।
এই রোদ, হাওয়া, ধূলি, জল—যাকে শুধু ছুঁয়ে দিলে
জেগে ওঠে শরীরে অনল, আছে সেই অণুজীবও—
পৃথিবীর উষ্ণ স্তর ভেদ করে শূন্যে উঠে গিয়ে
যারা হিম বাতাসের পারিজাতে চায় মৃদু গন্ধ।
কী আনন্দ এইসব জেনে আর ভেবে নিয়ে একা—
কোথাও সঙ্গতি নেই। তবু দ্যাখো, বৃষ্টি শেষ হলে
মেঘের কপালে রঙধনু হয়ে উঠবার চেয়ে
প্রকাশ-উন্মুখ মনে হয় বেঁচে থাকা। কোনো শ্বাস
জবাবদিহির প্রশ্নে বন্ধ হতে চায় না কখনো,
কোনো প্রেম। মউমাছিদের রানিটিরও জানা আছে
হত্যার হিংস্র নিয়ম, অমোঘ সংঘের জ্ঞান, মধু।
হেমন্তের কবিতা
শ্রীদর্শিনী চক্রবর্তী
১
আসলে বিচ্ছেদ ফিচ্ছেদ কিছু নয়,
শীত আসবে বলেই তোমাকে চলে যেতে হচ্ছে।
নাহলে এমন পদ্যসম্ভবাকে অদৃষ্টের হাতে কেউ ছেড়ে দিত না।
তাকে নেড়েচেড়ে, আঁটি ভেঙে শাঁস, অস্বস্তিতে পত্রমোচন –
এসবই ঘটছে এবং বারংবার ঘটে যাওয়া বিভ্রান্তিসমূহ।
শঙ্খের বোতাম বিজড়িত পাটভাঙা পাঞ্জাবীর দুরন্ত মেধা
কফি ব্লসমের মতো সাদা সাদা থোকা থোকা ফুটে থাকা ভুল;
ছুঁয়ে দিলে আজীবন পাথর পাথর।
ভূতে পাওয়া অপেক্ষা নিয়ে এখন সমস্ত ইতিকথা
না-খেয়ে ঘুমিয়ে পড়া সেইসব বসতির মতো
অন্ধকার জড়িয়ে শুয়ে আছে –
যাদের বিমানসেবিকারা কোনোদিন ঝুঁকেও দেখেনি।
২
পাতা ঝরবার তাই ঝরে
তাই নিয়ে কবিত্ব করেছ;
আলোয়ান ফুটো তবু হেমন্তরোদ্দুরে তাকে
ভরসার মতন মেলেছ।
মাসকাবারের ঋণ যতখানি অশান্তি আনে,
ততখানি সান্ত্বনামূল্য তোমার ওই ঝাঁপিতে নেই জেনেও;
চেষ্টায়, ক্লান্তিতে কখন কবিতায় ঘুম নেমে আসে।
হৃদয়ের একাংশকে দাহ করে ঘরে ফেরে
একাকার শোক যেরকম।
চেষ্টা করো, চেষ্টা করে যাও।
একদিন এসবই খুব স্বাভাবিক ভাবে নিতে পেলে,
হয়ত ওদের জন্য হাহাকারটুকুও থাকবেনা –
শুধু দুটো রুটির জন্যে মরে যাচ্ছে যেসব কবিতা।
আকস্মিক
সব্যসাচী ভৌমিক
১
বাতাসে আঁচল ওড়ে, ত্রিসীমানা ঢেকে যায়
অধীর বাউলও জানে, কোন গান কোন স্কেলে শেষ
আমি যার পথভুল, তাকে লিবিডোসন্ত্রাসে চিনি
গান শুরু, গান শেষ, মাঝখানে ইতিহাস
নিঃশর্তে মুক্তি চেয়েছে ।
বাতাসে আঁচল ওড়ে শুধু, আনন্দলোক ঢেকে যায় ।
এসময় সামান্য হিল্লোল
প্রলয়ের মতো, একা হ্যামলেট যেন
বাংলা কবিতাকে স্বপ্নে দেখেছে ।
২
দৈববাণী, কলাকৈবল্য, অন্যমুখ,
স্মৃতি, নির্ঝর, আলটুসি মোহ ,
অনামিকার অভিমান,
সব মুছে যায়, মুছে যায় ।
যদি ঢেকে দিই এই স্টেরয়েডহীন দাপট,
যদি ভেজা গায়ে অজ্ঞাতবাস ভুলে যায় কেউ,
আংশিক পথচলা স্বীকৃত হয় শিলান্যাসে
চেনা পদাবলী চুরি হয়ে যায়, আকস্মিক
যদি আবার মনে পড়ে তোমার ডাকনাম,
চৌকাঠের বাইরে পা রাখবো, আকস্মিক
দুটি কবিতা
মণিশংকর বিশ্বাস
সাবিহার জন্য-১
লক্ষ্মণ সেনের রাজত্বকালের মতো যৌন-সম্প্রীতি সেরে
নতুন বৌটি যায় স্নানের ঘরে
আমি ভালোবাসি সমুদ্রবিজ্ঞান আর রাতের আকাশ
কোথায় সে দ্বীপ স্মৃতিভ্রষ্ট মানুষের মতো জনহীন
আর শান্ত-বাতাস মহৎ এক কিম্বদন্তী
ঝাউবনের পাশের বাড়ি থেকে দেখি
গহীন ভ্রমর থেকে চাঁদ ওঠে স্থির, বাঁধা একটি নৌকার ’পরে
বৃষ্টি-ভেজা পাখির ঠোঁটের মতো মসৃণ করতল—
তবু তো শিকড়ে-বাকড়ে জড়িয়ে ধরে আছি—
নির্জন বেডসিট—অনুতপ্ত প্রাতরাশ—
এক-পৃথিবী মনখারাপ, সাবিহার—
ব্যবহৃত চিরুনির দাঁতের ভিতর দিয়ে নেমে আসা
একের পর এক, শাদাকালো দিন আর রাত
শৈলী
লুকিয়ে রেখেছি খাদের দিক—
অন্ধকার হবার পর সেদিকেই
অন্ধকার-কালো ভেবে চলে গেছে বহু অভিযাত্রী—
যদি থাকত কোনো লেখার দেবতা
তাকে আমি নিশ্চয়ই সম্বর্ধনা জানিয়ে বলতাম
আমাকে শিখিয়ো না লেখার কায়দা
বরং চেষ্টা জারি থাকুক—
যদি পা হড়কে কখনো পড়েও যাই খাদে
সেও তো বহুদূর যাওয়া হবে
অনন্ত বিজয়া
বেবী সাউ
( উৎসর্গ কবি বিজয়া মুখোপাধ্যায়)
১
” আমাকে আমার প্রভুর জন্য পবিত্র থাকতে দাও”
সহজ কথায় ভাসে পাখির পালক
যেন ভারহীন তুমি
লিখেছ মনের কথা, যে মন কুয়াশাহীন
যে মন ঘরোয়া তবু
ঘর থেকে বাহিরেও পা বাড়িয়ে আছে
একটি নারীর কাছে বন্ধ জানলা
দুর্লভ কপাট
একটি নারীর কাছে আছে তীব্র জড়োয়াসিন্দুক
নিপুণ ভাষার মধ্যে, যে ভাষায় পাখি উড়ে যায়
যে ভাষায় অত বেশি চাকচিক্য নজরে পড়ে না
যে ভাষায় শান্ত জল কুলুকুলু প্রাচীন আবহে
ভেসে যায় অন্তহীন
তবু সেই প্রভু তো আসে না
২
” কবিতা কাহাকে বলে – কী তাহার মাপ
আগামী সাক্ষাতে চাই তোমার জবাব”
আসেনি কি সে জবাব,- আসেনি কি পালকের মতো
নির্ভার ছন্দের দেশে যখন মনের পাতা ছিঁড়ে
দিগন্ত এসেছে কাছে,- কে তোমার প্রভু তবে বলো
সেও কি শিল্পের গৃহ? দেওয়ালবিহীন মাঠে
একা একা যে দৌড়
স্রোতের ভিতর ডুবে ডুবে
যে ছন্দ নিজের কাছে নিজের সঙ্গীত হয়ে আছে
তার কাছে দু দণ্ড জিরোন
তার কাছে বসে বসে একটি দুটি নিভৃত আলাপ?
৩
” কার হাতে মীমাংসার ভার, অধিকার
সে পুরুষ? ”
দুচোখ সলজ্জ নয় আর
দু চোখ তাকাতে জানে, শুধু পাখির মতন নয়।
প্রশ্নের ভিতরে ডুবে অন্ধকারে আলো
যে চোখ গহন হয়ে থাকে
সেই চোখ প্রশ্ন করে
প্রশ্নই উত্তর হয়
অনন্তসন্ধানে।
যে ভার সমাজ তার পাষাণে সমস্ত শ্বাস
রোধ করে আছে
সেই সব প্রশ্ন রাখা অত কি চিৎকারে শোনা যায়?
কখনো তো নীচু গলা
সত্যি কথা বলে।
৪
” সব কবিতাই পুনর্লিখিত কবিতা”
প্রবল ঝড়ের মধ্যে
একটি আড়াল ভেঙে পড়ে
আড়ালের কথা হলে জেগে ওঠে
পিতৃতন্ত্র তার
অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে।
সেই সব আড়ালের দেওয়ালেও লাগে তাপ
একটিই কবিতা, যেন লেখা হয়, একটি কবিতায়
তবুও আবার কেউ লেখে তাকে
বারবার লেখে
বারবার বদলে যায় যা কিছু দেখার
যা কিছু লেখার
ভাষার ভিতর থেকে উঁকি মারে অতিকায়
সময়ের কাঁটা
কে তাকে শুনেছে
কে তার অনন্ত
কে তার শূন্যের মধ্যে ঝাঁপ দেয়
কে তার বাহক
৫
” প্রসিদ্ধ গঙ্গার তীরে ভেঙে যায় অনন্ত বাদাম”
গাছের ভিতর দিয়ে হাওয়া যায় অন্ধকার ঠেলে
কোথায় মানুষ যায়, কোথা থেকে আসে
এই সব প্রশ্ন নিয়ে কে কোথায় মায়াপ্রবণতা
কাটিয়ে এসেছে বলো
কে কোথায় জানিয়েছে ট্রেন চলে গেলে। আবার নতুন করে ট্রেনের সিগন্যাল শোনা যায়
স্রোত বয়ে যায়, শুধু একটি ঘাট চেয়ে চেয়ে দ্যাখে
কত কী পালজ ভেসে গেল
জীবন, পালকসম
জীবন, বিদ্যুৎসম আসে আর যায়
অনন্ত বিজয়া যান বিজয়ায়, কবিতার খোঁজে।
অতর্কিত পদ্য
রাজকুমার রায়চৌধুরী
একটা বাড়ি চাই — নগ্ন হয়ে স্নান করবো গ্রীষ্মের সারা দুপুর জুড়ে। পাখি উড়ে নামবে শরীরের উপর, আমি গাছ হয়ে গাছের প্রাণটুকু নিয়ে উড়বো আকাশে… পাখি বড় হবে, চলাফেরার ভাষা শিখবে শরীরের খোলা অংশের মধ্যে। যৌনতা ফুঁসে উঠবে না — সে তো জানবে প্রকৃতিকে, প্রকৃতির মধ্যে ছোট বড় বলে কিছু হয় না। শুধু জীবনানন্দ দাশ রোজ ভোরে হাঁটতে হাঁটতে ভাষার মধ্যে হারিয়ে যান। তখনই পূর্বে ধীর লয়ে প্রবেশ করে আলোর ঝরনা। তার কিছুটা আলো ওনার পায়ের ওপর পড়ে থাকে প্রণামের নামে।
সমসাময়িক: এক
অনিন্দিতা গুপ্ত রায়
বহুবচনের গায়ে যে আলোটি তির্যক
নিজেকে আলাদা করে চিনে নেয় রোজ
তার কোনও ইতিহাস পুরাণ বা গাথা
কোনওখানে লেখা নেই, মুখে মুখে ফেরা নেই
ফলত তামাদী খুব, একঘরে বোকা!
অথচ পরম্পরা, ঘটনার স্রোত
তারই কাছে ঋণী থাকে
সেসবই অলক্ষ্যের নির্জনতার।
পিঠে ডানা পায়ে চাকা হাতের লাগাম
উড়ে এসে জুড়ে বসে
চোখ যাকে দেখেও দেখে না বহুকাল
ক্ষত ও ক্ষতির সীমা বুঝে নিতে নিতে
এফোঁড়ওফোঁড় খুব মরে যেতে যেতে
কোথাও আলোটি পোড়ে, ওড়ে ছাই বিপন্নতার
দ্বিজ
কস্তুরী সেন
হলদিয়া ওইদিকে, মোহনা এখান থেকে কাছে
কতটা সময় নষ্ট…
আজ রাত্রে থেকে যাই যদি?
কলকাতা ঘন্টাদুই,
আলাদা আলাদা পিনকোড —
সাতের কিছুটা স্বর্গ, চা খাবে তো
করে দিই বলো
তোমায় কি ভরসা আছে
একবার খুঁজে খুঁজে সেই পানিপাঁড়ে
সেবার ফুলিয়া তাঁত, বড়খোকা
জামালপুর দুবছর পরে
কলকাতায় বাসা হল, সম্বৎসর জমানো খরচ
সেই প্রথম! কী প্রথম পাটভাঙা লুকনো ভ্রমণ!
এ গান সেখানে সত্য
বি পি আর রেলওয়ে জংশন…
#দেবীপক্ষ২০২০
অদিতি বসু রায়
মণীষা বাল্মীকি যখন পুড়ে যাচ্ছে,
অন্ধকার চিরে আওয়াজ তুলছেন তনুশ্রী পান্ডে
‘ও কেয়া জ্বল রাহা হ্যায়?’
প্রতিমা মিশ্র যখন মণীষার মায়ের কাছে পৌঁছনোর জন্য ছুটছেন,
– তার আগেই নীলাঞ্জনা চট্টোপাধ্যায় ফিরে এসেছেন জবানবন্দী দিয়ে
সীমা কুশায়া যখন মণীষার কেস গ্রহণ করে অবরোধ পার হচ্ছেন,
তার আগে ইন্দ্রা নুয়ি জানিয়ে দিয়েছেন কিভাবে তিনি সাম্রাজ্য সামলান!
প্রতিমা মিশ্র, দৌড়োচ্ছেন –
বাংলা ছুটছে , দিল্লি ছুটছে মাথায় রোদ, পায়ের নীচে রক্ত
মণীষা বাল্মিকীর হাড় ছাই হতে হতে রয়ে গেছে
স্বরা ভাস্কর তখন যন্তর-মন্তরে গলা তুলেছেন –
ভারতবর্ষ এসে দাঁড়াচ্ছে ভিড়ে-পথে-মিনারে –
আমরা গলা তুলছি –
ভারতবর্ষ যখন বলছে – ‘ম্যায় চিল্লা নেহি রহি হুঁ, আওয়াজ বুলন্দ কর রহি হুঁ। আওয়াজ বুলন্দ করনে
কো চিল্লানে সে কনফিউজ মত কিজিয়ে’।
—- তখন আমরাই বলছি,
এবার চিৎকার করবো
প্রতিমা মিশ্র, সারাদেশকে আপনি দৌড় শেখাচ্ছেন
আমরা প্রস্তুত
ভারতবর্ষের হাতে দেশলাই –
আমরা শুরু করেছি –
on your mark – get – set – going –
দুটি কবিতা
শুভম চক্রবর্তী
ভাঙনের কিছু আগে
বৌদিকে দেখে এক অনির্বচনীয় মৈথুনে আমার মুখ ভরে উঠলো বুুুুদবুদফেনায়। বৌদির গোলগোল পায়ু, অনেকটা ছড়িয়া থাকা বনজ মতো যোনির মধুপ, খড়ের গাদার মধ্যে থসথস কেঁপে ওঠা জ্যান্ত দুটি অনাবিল স্তন আর মুহূর্তের চমকে ওঠা চোখজোড়া কামনার দামাল তাঁইশ। আমি তো ছটফট করছি, মৈথুনে ভরিয়ে তুলছি নাগিনীর বাঁক ও বাঁওড়। বৌদি-ই নাগিনী তার বিসর্পিল খাঁজে আমি, তলপেটে, তলিয়ে গিয়েছি। ভূমিকম্প হবে ঠিক। পেটে, প্লেটে ধাক্কা লেগে ভূমিকম্প হবে।
এই এক যাওয়া
আজ তিনদিন হ’ল। কাল দু’দিন হবে। একদিনও হতে পারে। তোমার মৃত্যুর। দিনেরা ইয়ার্কি মারছে। আথানেবিথানে কত লোক দ্যাখো পরম্পরাহীন। জলের ভেতর দিয়ে সাবমেরিনের মতো এই এক যাওয়া। উপরিতলের কোনো তেপায়ায় ভেসে থাকা। একটি পা চিতাঠ্যাঙানিয়া। জ্বলন্ত কয়লা আর কাঠ আর আঙারের নিভু নিভু ছাই, নেড়েঘেঁটে দেখা, যেন নির্জ্ঞানে ঝাপ দেওয়া, বহুজন্ম আগে। আগুন বেষ্টন ক’রে আমাদের মাংস ছিঁড়ে খাওয়া। বড় ক্লান্ত লাগে, এতদূর হেঁটে আসতে, বুনো বুনো দ্যোতনা ডিঙিয়ে। আকাশ ফর্সা হ’ল এইমাত্র দুধসাদা নিতম্বের মতো। আমরা কী কেউ নই, আমরা কী মনন ! মনন !
সোমনাথ
তিলোত্তমা বসু
কবিতা তো কতো পাখি রচে
কতো মাছ ছবি আঁকে জলে
সহজপথের প্রান্তে ওড়ে লাল ধুলো
আলপনা আঁকা কুঁড়ে ঘর
চাঁদ কেউ এঁকে রাখে ঘরের মাথায়
কোনো পাখি অথচ চাতক
কোনো মৎস অবতার স্বয়ং
চাঁদ বুঝি চায় তার রোহিনী নারীকে
চন্দ্রদোষ বলে একে , বলো ?
খুব কমে আসে আলো
নিশনাথ তীব্র অভিশাপে মৃতপ্রায়
কেঁদে উঠি
প্রেমে পড়ে গেছি চন্দ্রদেব আমি আপনার
মহামৃত্যুঞ্জয়মন্ত্র সকাতরে করে যাই পাঠ
ধীরে জোৎস্না ফেরে
তরল জরির রসে আচ্ছন্ন হয় ফের
নির্জনতা ধুনাগাছ আর গিরিরাজ
জোৎস্না তো আসলে চাঁদ আর রোহিনীর
একান্তই আলোর সমাজ
কাব্য পরমেশ্বর
সুপ্রভাত মেট্যা
ঈশ্বর জন্মের পর
কবিতা উদ্গিরন সন্ধ্যাবাতির তারায় আমার চোখ ,সে কী আলো দেখায় ?
সে কী সন্তান বাৎসল্যের সুর নিয়ে একাকী দুয়ার,রক্তিম গরল পথ দেখায় আমাকে পিছল ?
জল ছলছল শরীর ,
শ্রাবণ লেখার ভোর সমাগম গ্রামে অল্প আলো,নিভৃত যন্ত্রণা ,যথা-কিঞ্চিৎ ঘরবাড়ির কাদামাখা পথ,ধান্যধুলো,কবিতার ছন্দে ঘোলা হয়ে চলে যাওয়া স্রোতে সে কী আনন্দের অগ্নি স্ফূরন ? আমার বুকভরা শ্বাস ?
ঈশ্বর পরমেশ্বরের চোখে, কাব্যসমগ্রের
এক নতুন জগৎ হয়ে ওঠে ?
ছায়াকাহিনি
পঙ্কজ চক্রবর্তী
১.
তাহলে আপনি আসছেন
এই সন্দেহ নিয়ে তার পিছুপিছু ছুটে গেলাম
যারা ভাবছেন ঐশ্বরিক
তেমন কিছু নয়
ছাইগাদায় বেড়ে উঠছে অলস কচুপাতা
তার রঙের ভিতর আমার জানলার ছায়া
ভরদুপুর কুড়িয়ে রাখছে নিজের হাতে
২.
প্রশ্নকে আপনি ভেবেছেন
দুদিক থেকে কোনো সমাধান
মৃত কলসীর মতো এখনও পিপাসা
চৌমাথার মোড়ে অদৃশ্য সুতোয় চলেছে জাহাজ
একটি ভোর আর বন্দরের মাঝখানে
তার ছায়া ভাত বেড়ে দিচ্ছে নবম শ্রেণির রাতকে
৩.
পাললিক তুমি
মৃত নদীর বুকে ফিরে যাও
এই বুঝি আন্দোলিত জীবাশ্ম সংসার
দু-একটি ঘটনার ছায়ায় বসেছে বাজার
পাললিক আজ মনে পড়ছে তোমার ঢেউ
অন্দরমহলে ঝুঁকে রয়েছে সকাল নটার জল
৪.
বইয়ের প্রথম পাতায় চুম্বকের রাত
তাকে বলছি দূরে সরে যাও
উদাসীন আঁচলে ঝুলে আছে গান বাজনার সংসার
মধ্যরাত আর ভোরের চুমুক
বিছানায় গীতিকবির চোখের জল
ভাঙা রাজপ্রাসাদের নীচে বেজে উঠল স্থানীয় স়ংবাদ
নকশীকাঁথা
ওবায়েদ আকাশ
যতই আমাকে ডাকছ, গাছের আড়াল থেকে
অনুবাদ সাহিত্যের মতো
আমি ও আমার ছায়া মুখোমুখি বসে
পরস্পর চুমু খাচ্ছি, হুল ফুটিয়ে দিচ্ছি মৌমাছির মতো
এই বিষদাঁত পায়ের পাতা থেকে
আজকাল চোয়ালে আড়ালে রাজত্ব করে চলছেÑ
তোমার রাজত্বে এত গাছ, নদী, সবুজ পাতারা
আমার চারপাশের রাত্রির ভেতর বিশ্বাসের মতো জ্বলছে
যতবার আমাকে ডাকো
তোমার ঘরের উঠোনে দলবেঁধে কত হাতি-গরু আসে
আসমানের চন্দ্রতারাকে না ডাকলেও তোমার নিকট প্রতিবেশী
যতবার বলো উঠি, ময়ূরীর পেখম পলকে
জাপটে রেখে বলেÑ তোমার ঠোঁটের নিচে বয়ে চলেছে
মাছেদের সাঁতারের কলা; সজনেতলায় অপেক্ষা করছে
সেনবাড়ির ঘোড়া, বেতের সাজি, কুমার নদের সাঁকোÑ
বাঘের চামড়া, হরিণের ছাল, সিংহের দাঁত আর সর্ষে ফুলের নিচে
লালপেড়ে বিয়ের শাড়িতে আসছে
সদ্য বিবাহিত এক গ্রামীণ দম্পতি
এবার নিজেই নিজেকে সাজিয়ে রেখেছ ঢেঁকিতে ধান ভানার কাজে
আর ঘাটে এসে ডাকছে আহারে ছইওয়ালা নাও
দেখো হাতের নিচ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে পাখি
ছড়িয়ে পড়েছে ঢোলের বাজনা, মাটির পুতুল
নানা রঙের ঘুড়ি
আর সবই এক এক করে তুলে নিচ্ছ ওদের
আসা-যাওয়ার সমূহ চিত্রকলা
পাতার আড়াল থেকে ক্ষণে ক্ষণে উড়ে আসে তোমার ডাক
আর প্রণম্য আঙুলে বাজে আড়বাঁশের বাঁশি
রাত্রিজুড়ে শিয়রে ঘোরে তালপাতার পাখা
আর আমার মুখের দিকে বাড়িয়ে দাও বাতাসার সাঁচ
আমিরতির লাল আবার তালমিছরির ফল
অগত্যা নিশ্চিন্তে কিছু বিলঝিল ভেঙে লাল-সাদা শাপলার মালা
তোমার দিকে বাড়িয়ে দিতেই
নকশিকাঁথায় শেষ ফোঁড়ন তোলো
দুটি কবিতা
বুবুন চট্টোপাধ্যায়
ক্রান্তিলগ্ন
বিষাদ ঘন হলে বরফ পড়ে।
অনেকদিন আগে আমাকে এ কথা বলেছিলেন ফাদার।
বুড়ো ডলফিনের মতো অবসিত যাপন।
প্রান্তর জুড়ে ধুলো বরফ।
সেইসব শীতল ধুলো সরিয়ে তোমার কাছে আসা।
ওগো কর্কটক্রান্তি র মেঘ।
লাল, নীল সুতোয় আঁকা প্রাচীন টেপফ্রক।
হকার্স কর্ণারের হলদে গোলাপ।
আমাকে জন্মান্তরের কথা বলে।
সম্পর্ক
কিছু,কিছু সম্পর্ক সম্য বিশেষে পোষাকের মতো আঁট হয়ে যায়।
অনেক দিন পর আলমারি থেকে বেরোলে দেখা যায়
পৃথুল হয়েছে মন। গৌরবের মায়াজল জমে, জমে মোম।
ছড়িয়ে গেছে হৃদয়ে, মস্তিস্কের কোষে, কোষে।
শোক, মায়া,অভিমান, কালোজল নির্বাসিত।
সেইসব উদ্ভিদ টেকে বেশি।
এক্সপায়ারি ডেট পার হয়ে যায়।
যেন বিজ্ঞাপিত।
ঝাড়া হাত,পা নির্দায়ী ডিভোর্সী।
অথবা চাইনিজ টেরিলিন।
ছোটো হয় না।
বড়ো হয় না
রঙ ওঠে না।
মেঘ করে না।
এ কথা বুঝলাম মৃত্যুর কিছুকাল পরে।
পুরুলিয়া সিরিজ থেকে
তৃষ্ণা বসাক
মুরুগুমা বাঁধ
বাঁধের জল কি চমৎকারিণী,
একটা হাঁসের ছানা আটকে গেছে গুল্মের মায়ায়,
তাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসছে একটা সিপাহী বুলবুল,
মেয়েরা বুকে সায়া বেঁধে জলে নেমেছে,
ঘাটের পৈঠায় রেখে গেছে গন্ধতেল,
সেই গন্ধে গন্ধে একটা বাঘ এসে বসে আছে বাঁধের মাথায়,
যত গাড়ি যাচ্ছে, অবাক হয়ে বাঘটাকে দেখছে,
তার হলুদ কালো ডোরাকাটাগুলো ম্লান হয়ে আসছে অপেক্ষায়,
সূর্য মাথার ওপর উঠে এসেছে,
জলের ওপর হাঁসের মতো ভেসে থাকা স্তনগুচ্ছ,
বাঘটা নিজের থাবা চাটছে,
মুরুগুমা বাঁধ পেরোতে পেরোতে আমাদের বিকেল খসে পড়ল।
পাখিপাহাড়
একটা পাহাড় উঠে এসেছে আঁকার খাতা থেকে,
হিজিবিজি দাগ ছড়াতে ছড়াতে ডানা,
আমি তোমায় কী নামে ডাকব, পাখিপাহাড়?
সব পাহাড়ের একটা পাদদেশ থাকে, সেটাই আমি,
আমার শরীরে সুড়সুড়ি দিচ্ছে কচি সবুজ ঘাস,
তিন শতাব্দী আগে আমিই ছিলাম রাখাল,
এখানে নিয়ে আসতাম আমার ছাগলছানাদের,
তারা ঘাস খেত, আর তাদের খেয়ে যেত বাঘ,
আজকাল বাঘেরা বড় ক্লান্ত,
তারা দিনরাত জলের দিকে চেয়ে বসে থাকে
আর ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ফেলে,
তাদের নিঃশ্বাসে আমার ঘাসদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়,
এমনকি আমার রাখালজন্ম, ছাগলজন্ম
এমনকি আমার পাহাড়জন্ম-
ডানার লোভে লোভে আকাশের কাছে উঠে আসে।
দুটি কবিতা
সৌমনা দাশগুপ্ত
আরশি-সরণী
খুলে ধরছ ষোড়শকলা; বিম্বিত অধর
অলখ সাধুটি হেঁটে যায়
ভেসে গেল অভিমুখ হাঁসের ডানায়
ধারাপাত চেটে খাচ্ছে শৃগালের জিভ
খিস্তি ও খেউড়
কাঁড়া ও আকাঁড়া
গিঁট খুলি গিঁট দিই; প্রবাদ না প্রবচন
ওরা সব ধর্মতুতো ভাইবোন লাঙল চালায়
শব্দের খেতে খেতে জমে আছে মেঘের উত্তাপ
লাঠিটি অটুট আছে, সাপটিও ম’ল
মাথায় চড়েছে বিষ, তার ফোঁস ফোঁস
হারিয়ে ফেলছে পাখি শিসের ব্যঞ্জনা
উড়ছে কেতন যত, উড়ছে কেয়ূর
চলো তবে চলো যাই
দ্বাদশ শৃঙ্খল ছিঁড়ে বেদম ক্যালাই
পাখিটিকে
আনত বজ্রের ভারে পিঁজে গ্যাছে
ব্যাসবাক্য শব্দবন্ধ
কে কাকে ধনুকে জোতে, পরম ছিলায়
মায়াময় আরশির পথে পথে
আমাদের অন্নভোজ; চালগুঁড়ি আলাপন
এক পা এক পা করে নেমে যাই
স্রোতের করাতকলে
শিস্ দিতে দিতে উড়ে যাচ্ছে টুপি
শিস্ দিতে দিতে উড়ে যাচ্ছে সিগারেট
গানের পাশেই ছিল ঘর
ঝোলায় কুয়াশা নিয়ে চলে গেল
শীতের করলানদী
চাঁদ এক অমিমাংসীত ভ্রূণ
স্রোতের করাতকলে ভেসে যায়
দশমিক থেকে পুরো একঘর সরে বসল সংখ্যা
পারদ নাচছে
উঠোনে ছড়ানো আছে রবিফসলের দানা
মালসায় জল
ফিঙেপাখি, দুয়েকটা চড়ুইও ঢুকে গেছে
কে যেন রাত্তির পুষে রাখে হাতব্যাগে
দুটি কবিতা
অভিজিৎ বেরা
চিঠি
কাঁখে কোলের শিশু; ভাই।
আমি শিশুকে লজেন্স দিয়ে, চাই।
“জানালা খোলা রেখো রাতে
চিঠি দিতে হলে দিয়ো
বুনুদির হাতে”
একে একে নিভে গেছে আলো
ধুকপুক তারাটি
পশ্চিম আকাশে দাঁড়াল।
“বুনুদি আসেনি আজ।
ভোরে—
জল নিতে এসো টিউকলে”।
একটি রাত্রিকালীন দৃশ্য
একান্নবর্তী পরিবার—
দুটি ঘরে ঠাসাঠাসি মেঝে
নবদম্পতিটি খাটে
মশারি টাঙানো খুঁটে
উঠতি কিশোর ছেলে
ফাঁকে চোখ রাখে—
ছায়া যেন গিলে খায় অন্য ছায়াকে
এলোচুল মশারির মাথা ফুঁড়ে উঠে বসে
নিমীলিত চোখে বুঝি তাকে দেখে।
‘ন’টা বাজে।ওঠো’।
ঘুম থেকে তুলে নতুন কাকীমা হাসে—
‘রাতে ঘুমোসনি? বুড়ো’?
তারপর ওত পেতে থাকি।
রণজিৎ অধিকারী
শান্ত জলের ওপর দিয়ে সময় কীভাবে যায়?
আমি জানিনা, নিরেট পাথরের ভেতরে কেন
ঢুকে পড়ে সময়!
কীভাবে এবং কেন গোটা জগৎটাই আত্মসমর্পণ করে দিতে পারে সময়ের কাছে?
একটা গড়িয়ে পড়া নুড়ির ত্বরণ-কে জিজ্ঞাসা করি ,
— সে কোথায় সময়কে বয়ে নিয়ে যায়!
একটা মাকড়সার ফাঁদে আটকে যাই আর দেখি
ঝুলে আছে সময়ের চিহ্ন মরা কবিতার মতো!
সময় যেখানটায় পলেস্তারাগুলো খসিয়ে দেয়, আবার
উঁচু দেবদারুর ডোগাগুলো যখন ভোরের প্রথম আলোয়
লাল হয়ে উঠতে থাকে … আমি সেখানে ওত পেতে থাকি … কোথায়, কোথায় সময়!
এমনকি পাগলের মতো তীব্র আবেগে আমি যখন
তোমার ভেতরে প্রবেশ করি আর চুপ করে
কান পেতে থাকি…
ঠিক এই এখানটায় কীভাবে সে ঢুকে আসে!
আমি জানিনা কেন সময় এভাবে তছনছ করে দেয় সব!
একটা নিস্তব্ধ জায়গায় ঘাসগুলোকে মাথা দোলাতে দেখে বড়ো একটা পাথরকে
প্রাণপণে গড়িয়ে এনে চাপা দিয়ে দিই সময়টাকে …
মায়াবী ঈশ্বর
সন্দীপন চক্রবর্তী
১
গিরীশ যেমন ঠাকুরকে বকলমা দিয়েছিলেন
সেভাবে তোমাকে আমি বকলমা দিয়েছি ওগো
ভার্চুয়ালের মায়াবী ঈশ্বর,
আমাদের স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত তুমি
তুঁহু প্রাণ তুঁহু মম শ্যামসমান
আমাদের দেহ নেই, কেবল ঠিকানা
আমাদের এত আলো, দেখা যায় না কিছু
আমাদের হাতে হাতে তলোয়ার
আল্লা হো আকবর
আমাদের চোখে মুখে তলোয়ার
জয় জয় শ্রী রাম
আমরা নিজেকে খেয়ে ভাবি বেঁচে আছি
আমরা শুধুই দেখি, কাউকে চিনি না
বকলমা দিয়েছি ওগো ভার্চুয়ালের মায়াবী ঈশ্বর,
এখন নীরস আর ফিকে লাগে বাস্তবের মুখ
তোমার সুড়ঙ্গে আজ টের পাই গর্ভের আরাম
টের পাই মদ কত ঘন হয়ে আসে
হালকা নীল আলোর ভিতরে
ভেসে চলে আমাদের কলার মান্দাস
২
অর্থহীনের ইশারায় নেচে ওঠো
আমার ভিতর সরোবর পেতে রাখি
ভগ্ন দেউল, ফাটলে খরিশ সাপ —
মঞ্জির বাজে…আগের জন্ম নাকি?
গলে গলে যায় দৃশ্যের বর্ণালী
আজি যত তারা স্রোতের আকাশে ওঠে
তার কাছে শুধু চেয়েছি এইটুকুই —
দু’বেলা দু’মুঠো অন্নটি যেন জোটে
চুলখোলা এক তারা এসে তাকে বলে —
আমি তো তোমার চেয়েও অনেক ছোট,
আমার ভিতর সরোবর পেতে রাখি
অর্থহীনের ইশারায় নেচে ওঠো
একটা চেয়ারের কথা
রাহুল দাশগুপ্ত
একটাই জানলা, ফাঁকা ঘর, জানলার পাশেই
চেয়ারটাকে রেখেছিলাম
কেউ এসে বসেছিল চেয়ারটায়
সে উঠে চলে গেছে
কেউ এসে বসার কথা ছিল চেয়ারটায়
সে আসেনি
চেয়ারটা ফাঁকাই পড়ে আছে
কে এসে বসেছিল ওখানে, উঠে গেছে তারপর?
ওখানে কার এসে বসার কথা ছিল?
আমি জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়াই
একটা রাস্তা যা ক্রমেই ধূসর হয়ে গেছে
একটা দৃশ্য যা ঢেকে যাচ্ছে কুয়াশায়
কে এসে বসেছিল? কেন সে চলে গিয়েছিল?
ওই চেয়ার কী বসার যোগ্য ছিল না?
যে আসার কথা ছিল, সে কেন এল না?
ওই চেয়ার কী বসার যোগ্য ছিল না?
যে চলে গেছে, সে ফিরে এলেও
আমি তাকে ফিরিয়ে দেব
যে আসেনি, সে যদি আসতে চায়
তাকেও আমি ফিরিয়ে দেব
অতটা যত্নের ছাপ, তবু তারা ফিরেও তাকায়নি
দূরে কোলাহলে মিলিয়ে গেছিল তাদের কন্ঠস্বর…
একটা চেয়ারের কাছে যাওয়া অত সহজ নয়
একটা চেয়ারে গিয়ে বসা অত সহজ নয়
একটা চেয়ারের দাম বোঝা অত সহজ নয়
গোটা একটা হৃদয়ের ভার বহন করছে ওই চেয়ার
গোটা একটা হৃদয়ের উষ্ণতা
কান পাতলেই ওরা শুনতে পেত
সেই স্পন্দন, কম্পন আর উষ্ণতা…
আমি , তুই
কুন্তল মুখোপাধ্যায়
শহরের কিছু কিছু জায়গা আছে যেখানে আমাদের বন্ধুত্বের দেহ পড়ে আছে । আমি তোর মৃতদেহ অথবা তুই আমার মৃতদেহ নিয়ে যখন কান্নাভরা চোখ নিয়ে হাঁটছিলাম , তখন বিষ্ণুর চক্র এসে কেটে দিয়ে গিয়েছিল । শহরে যখন তুই হাঁটতে বেরোবি দেখতে পাবি ঠিক …
শহর থেকে যে রাস্তা ছুটতে ছুটতে দিগন্তের দিকে চলে গেছে , সেও বেঁচে থাকার জন্য শরীর পেয়েছিল কিন্তু চক্ষুদান করে দেয়নি কেউ … চক্ষু পেলে সে দেখতে পেত এক একটা শহর ক্লান্ত ফুলপাঞ্জা ট্রাকের মতো বয়ে বেড়াচ্ছে বন্ধুত্বের মৃতদেহ । আর আগলে রাখছে ক্ষতস্থান ।
তুই যত দূরেই চলে যাস বন্ধু যেকোনও পছন্দের গান শুনলেই হাজার হাজার মাইল দূরে থেকেও আমি তোকে পাই , তুই আমাকে
দুটি কবিতা
কৌ শি ক গু ড়ি য়া
এস্থেটিক
কেন্দুপাতা কুড়িয়ে, বুনো কুক্কুটের ডিম কুড়িয়ে বাড়ি ফিরেছে তার কালো-বাবা
এসে দেখে, ন্যাতা দেওয়া ফরসা দেওয়ালের বীভৎস ফাটল আর নেই
সে দেখে, আরও কালো মেয়ে তার, আল্পনা এঁকে ঢেকে দিয়েছে গৃহস্ত-ক্ষত
দেখে বাহায় সেজেছে কুটির, বর্ষা এসে সেচ করেছে জঙ্গলে
যেন সজারুর ফেলে যাওয়া কাঁটায় রনসজ্জা পেয়েছে ধামসা!
রনসজ্জা? কেন, কাকে, কে প্রতিহত করে এই বুনো এস্থেটিক্স?
সে হারায়,
প্রবাদপ্রতিম দু:খ আমাদের! হারায় বিচিত্র ক্ষত-সমগ্রের সাজানো সংসার…
হারায়, মনের মুকুরে জেগে থাকা সমুহ করুণার ক্লেদ।
ফিজিক্যাল
তোমাকে তিমিরের পাড়ে নিয়ে যাই, চলো
চেনাই, মোহ দিয়ে রচিত
আত্ম-এপিটাফ…
তোমাকে অহম শেখাই
শেখাই, ঢেউয়ের রাতে
কীভাবে বুকে আঁকড়ে রাখতে হয় গাঙ!
২.
চূড়া ও গিরিখাতের ভূগোল আলাদা
আলাদা, তাদের লতা কিংবা গুল্ম-বাহার।
স্ত্রী বা পুরুষ ভেদে শরীরের স্বাদও ভিন্ন যেমন,
গন্ধ ভিন্ন তাহাদের
কেবল বাসনার রতি মিলে যায়, পরতে পরতে
৩.
রতির আরতি থাকে হিম-ঝরা সন্ধ্যার মাঠে
তুমি-আমি অলীক মানব
দেখি মিথুন লেগেছে বৈঠাতে…
দুটি কবিতা
বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়
সবুজ টুপির গল্প
বিবস্ত্র রাজার মতো ম্রিয়মান রাস্তায় যখন
ফোনের সঙ্কেত থেকে,
টের পাই,তখন বিকেল
বাড়িতে ফেরার পথে, রাজপথে এল সেই ফোন
চতুর বিড়াল যেন, নেমে গেল পাঁচিলের দিকে..
এই রাস্তা মনোরম,এই রম্য বিকেলের লোভ
আমাকে ছুটিয়ে মারে প্রেসক্লাবে,ইডেনের ঘাসে
যেভাবে রঙিন ঘুড়ি,কাটবেই, তবুও আকাশে
ফেব্রুয়ারি প্রায় শেষ, সূর্য যেন এখনি বিলোপ।
স্মৃতির ভিতর মৃত মৌমাছির গুঞ্জরণ শুনে
জেনে বুঝে অতর্কিতে উঠে পড়ি মৌলালির বাসে
আকাশ মেঘলা দেখে বাড়ি ফিরি অকাল ফাল্গুনে
মোবাইল সুইচড অফ, অতএব,এই অবকাশে
নিজেকে প্রেজেন্ট করি,টুকে রাখা কিছুটা সময়
সবুজ টুপির গল্প,মনোগ্যামি,অসম্ভব ভয়।
অর্ধসত্য
অতিরিক্তের বাসনা ছিলনা মনে
রহস্যহীন জীবনের কানাগলি
জানি কারো করপুটে নেই অঞ্জলি
তবু লিখে রাখি খাতায় সঙ্গোপনে।
একটি ধূসর একতলা ছোট বাড়ি
দোলনার ছায়া সাবেকি বারান্দায়
ছিটেফোঁটা রোদ ছুটে এসে পড়ে গায়ে
দুলছে দুলুক নেদুপিসিমার শাড়ি।
বিড়ালটা এসে উঁকি দিয়ে যেত ঘরে
অতিরিক্তের বাসনা ছিলনা তারো
ককতো দেখেনি,পড়েনি সে সারামাগো
নির্মিত ঘরে সত্যের আলো পড়ে।
বাড়ি ভেঙে গেছে আর নেই কোনো ভয়
আমি যা লিখেছি সেটাই সত্য নয়..
অকবিতার দিনরাত
চন্দন ঘোষ
ঠিক কেমন ভাবে কবিতা লিখতাম ভুলে গেছি আজ
পাখিদের জ্যোৎস্নাবাগান মুড়ি দিয়ে বসে থাকা তন্দ্রারাতগুলো
গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে কোথায় যে মিলিয়ে যায়
আমি তার হিসেব রাখতে পারি না আজকাল
ঠিক কী ভাবে আমাদের গানগুলো গাইতাম মনে পড়ে না
শুশ্রূষাগানগুলো আর ধুতে পারছে না নিরাময়কামী দুপুরদের
গোষ্ঠীসংক্রমণের দিকে এগিয়ে চলেছে সব স্মৃতিমেদুর হাত
বাতাসে আর সেই লকডাউনগন্ধ নেই
ফিকে হয়ে আসছে সব ফনফনা লাউডগার সবুজ
কবিতার তাঁবু তুলে নাও
আহত সময় পার হয়ে রক্তঠোঁট চেটে
বহুদূর হেঁটে যেতে হবে।
দোস্ত
বিস্তর দরদাম করে কিনছি সুখ, হঠাৎ দুঃখের সঙ্গে দেখা নতুন মার্কেটে।
সেই থেকে দুই দোস্ত চৌরঙ্গীর মোড়ে বাদাম ছাড়াচ্ছি আর খাচ্ছি।
দুই পা ছড়ানো আর রোদ্দুর ঝিকোচ্ছে ওই বাদামের খোলার পাহাড়ে।
গাড়িঘোড়া থেমে গেছে। ট্র্যাফিক পুলিশরাও স্ট্যাচু হয়ে অপেক্ষায় স্থির।
দুঃখের বাদাম আর শেষই হচ্ছে না।
দুটি কবিতা
রাতুল চন্দরায়
ক্রিসমাস
যাকে তুমি শিখিয়েছ অপমান চিনে নিতে
শিখিয়েছ শোধ দিতে দেনা
শিখিয়েছ ক্রুশকাঠ… কাঁটার মুকুট… ক্ষত…
হায় প্রেম! যীশু শেখালেনা !!
নতুন বছর
হিম এসে ঘিরে ধরে ধ্যানমগ্ন প্রদীপ শিখাকে
অন্তরে অঙ্গার লিখে কে তোমাকে এভাবে জ্বালালো?
কোন সুখে হাসিমুখে পুড়ে যাও?
আলো দাও কাকে?
আগুন চঞ্চল হয়–
আলো হোক… আলো হোক… আলো…
দুটি কবিতা
শুভব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়
যেভাবে জেলখানায় হাত ঘুরতে ঘুরতে
প্রথম মুক্তি পেয়ে উড়ে যায় বই,
যত্নের যা-কিছু মোমচিহ্ন সব বারুদের মতো
ঠাসা থাকে ওই ডানায়
সেটাই আদর
বরফ ফাটিয়ে জেগে থাকে মার্জিনালিয়া
কবিতার শুকনো-রক্ত স্মৃতি
ছড়ানো ম্যাপ-এ উত্তর খুঁজতে খুঁজতে
আমার বইয়ে রেখে যায় অনাদরের ঘোর ভালবাসা
ভাতের সামান্য হলুদ
চায়ের ছলকে ওঠা তর্ক
ছেঁড়া দক্ষিণ মেরুদণ্ড
অধিক লালনে পুস্তক বিনষ্ট হইবার সমূহ সম্ভাবনা…
ঝড়ের বিজ্ঞাপনে সারকথা বুঝে
প্রিয় গ্রন্থকে একবার চিনিয়েছি নীল আগুনের আঁচ
প্রাণ পেয়ে তারা ফিরে গেছে কারাগারে
পরিচয়লিপি
যেদিন মায়ের পুরনো টেলিফোন থেকে
ধীরে ধীরে মুছে গেল সবকটা ছবি,
আমি প্রথমবার পড়েছিলাম ফিলোডেনড্রন শব্দটা
ফিলোডেনড্রন
তার আগে-পরে মৃতের যাবতীয় জুতো আর সিগারেটের খবর
আর একটি অক্ষরও মনে পড়ল না গত সাত মাসে,
শুধু আকাশ থেকে উড়ে এল গোলাপি ফতোয়া
সব কবিতার শেষে
সব কান্নার শেষে
“অজ্ঞাত” লেখা বাধ্যতামূলক করা হল
মেঘ ও চুম্বনের কবিতা
গৌরব চক্রবর্তী
১।
তখন খুব বৃষ্টি হয়েছিল
একটা-দুটো গরাদ চুঁয়ে জল
কাগজ দিয়ে নৌকো বানাই আমি
কাগজটুকু আমার সম্বল
কিছু কথার সাড়া দাও না তুমি
বার্তা কিছু একাই পড়ে থাকে
তোমার কাছে রইল কিছু ঋণ
কুড়িয়ে নিয়ো কালকে কোনও ফাঁকে
এখন আমি ধরা-ছোঁয়ার দূরে
তোমার থেকে, শহর থেকে… দূর
আমায় তুমি ডাক দেবে না, জানি
ফাঁকাই থেকে গেল হৃদয়পুর
অনেক ভালোবেসেছিলাম তবু
সেসব কোনও কাজেই লাগল না
আর কখনও শোধ হবে না, জানি
ছায়ার কাছে আলোর যত দেনা
তোমার কাছে একটিবার যদি
সামনে এসে তাকাই চোখে চোখ
তখন, বলো, ফিরিয়ে দিতে পারো?
বেশ! তাহলে সেটাই তবে হোক
ফেরার কোনও সম্ভাবনা নেই
যাচ্ছি চলে সবাই যেমন যায়
তোমার কোনও দোষ ছিল না, জানি
আমিও বড় ছিলাম নিরুপায়…
২।
শিশির যখন ভোরের কাছে ঋণী
কুয়াশা তখন হৃদয় বিছিয়ে রাখে
তোমায় এখন নিজের করে পেতে
আমার কেবল অপেক্ষাটাই থাকে
সূর্য আবার স্বাদ বদলে মৃদু
পাখপাখালির কলকাকলির ওমে
তোমার সঙ্গে কথা তো বলতে চাই
ফোন বা মেসেজ– যেকোনো মাধ্যমে
আলোর মতো কোরাস জানে কি কেউ?
কেউ কি বোঝে সময়ের ওঠা-নামা?
হঠাৎ আমায় স্পর্শ করো যদি
তাহলে আমার সকল কাজ তো তামাম!
কী জানি কখন! সকালে, রাতে বা ভোরে–
আমার সবটা নিয়েছ শূন্য করে…
দিনকাল
তৃণা চক্রবর্তী
খুব বেশি কথা ছিল না বলবার মতো
অরুনাংশু কেমন আছে বা বড়জোর কমলালেবু উঠেছে কিনা
কিছু খুঁজে না পেলেই
পাহাড়ের কথা তুলি থেকে থেকে
পথগুলো কী জটিল হয়ে উঠছে ক্রমশ
কবে কে কোথাও পৌঁছতে পারবে
কবে কে বাড়ি ফিরতে পারবে
এ সব নিয়ে কথা বিশেষ কথা হয় না
এ সব নিয়ে কাউন্সিল আছে
আমাদের কথা বলতে বিশেষ কিছু নেই
ওই বড়জোর
আজ বিকেলে মেঘ করেছিল কিনা
অথবা
বড় কোনও ঝড় আসার সম্ভাবনা কতটুকু
আত্মীয়
জাতিস্মর
পথের মতো আত্মীয়তা আর কারও সঙ্গে অনুভব করতে পারছিনা। খুব চড়া কোনো সুর উঠছে আবার প্রাণের মধ্যে পথের মধ্যে নেমে যাচ্ছে সুরের চলন। একে আমি শাসন বলতে ভালোবাসি। মস্তিষ্কের ওপর, সমস্ত নামী ও অনামী স্নায়ুর উপর শাসন করছে পথের ধুলো, পদচিহ্ন কিংবা নিরাকার যাত্রীনিবাস, কখনো বা অপেক্ষারত পথিক ও তৃষ্ণার জল। তবে ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ আমার চলতেই থাকবে। তবুও ছায়া আত্মীয়। পথ আত্মীয়। পথদুর্দ্দশা পরমাত্মীয়। এ যেন ব্রহ্মের সঙ্গে অব্রহ্মের চিরনূতন ও চিরদুর্গম আত্মীয়তা।
দুটি কবিতা
মানসী কবিরাজ
তালিম
রাজপথ অগ্রাহ্য করে
যে মুহূর্তে হেঁটে গেছি পুরনো গলিতে ,
আমার শহুরে ছায়া থেকে , গড়িয়ে নামছে
পার্লার-চর্চিত ঘাম
খুলে পড়ছে এথনিক ভব্যতা
সওদাগর ফিরিয়ে দিচ্ছে সেই পুরনো জাফরি দরজা
ফিরিয়ে দিচ্ছে সাবেকি শাপলা-পুকুরের ঘাট
জানি এখানেই , আলো ও ছায়ার কাটাকুটি হবে
একদিন
এখানেই একদিন
সুডৌল জোড়া গম্বুজে , জমা হবে বাঘবন্দি দুপুরের ছক
ঠিকানা বদলে ফেলেও
আবার ঠিক , এখানেই আসা যাবে ফিরে ।
এবং
একদিন আমার শহুরে ছায়াও ,
শিখে যাবে
কীভাবে দস্তানা ছাড়াই , ছুঁতে হয় বারান্দার
তুঁতরঙ মায়া
কীভাবে খোলস ফাটিয়ে
বেরিয়ে আসতে হয় শীত-ঘুম থেকে …
ঠিকানা………..
একলা প্রেমিকের মতো হেঁটে যায় দুপুরের ছায়া
নিষেধ ভাঙতে ভাঙতে , খুঁজে নেয়
চিলেকোঠা জাফরির ভাঁজ
দ্যাখে
উদাসীন ডোবা , চিৎ হয়ে শুয় আছে নির্লিপ্তি সাজিয়ে
পৃথিবীর সমস্ত ডিম মুখে নিয়ে স্রোতে ভাসে
ক্ষুদে পিঁপড়েরা
প্রেমিকের ছায়া হেঁটে যায়
হেঁটে যায়
একলা দুপুরের মতো
ছায়া ভাঙতে ভাঙতে, নিষেধ নেমে আসে
নীচের ডোবায়
চিলেকোঠা লিখে দ্যায় বর্ষার আগাম আভাস
কলসি – দড়ির ছকে, মুছে যায় জাফরির ভাঁজ
পিঁপড়েরা ঠাঁই বদলায়…
দুটি কবিতা
পম্পা দেব
লক্ষ্মীবিলাস
লক্ষ্মীমন্ত মেয়েরা ব্যালকনি থেকে উড়ে যায় বড় রাস্তার দিকে
পদ্মিনী জলের নিচে বিপুল সর্প এবং ভাঙা শামুকের সাথে যুদ্ধ করতে করতে ভেসে ওঠে
নারায়ণী।
উনুন আর লাইব্রেরির সামনে ক্রমাগত পুড়তে পুড়তে পুনরায় জন্মাতে থাকে।
অতঃপর উল্কা বৃষ্টি হয় , নক্ষত্র ঝড় ওঠে
আকাশের বুক চিরে নেমে আসে প্রাচীন প্রগতি
পার্ক স্ট্রিট থেকে পাথরপ্রতিমা ,
নবজাতকের গন্ধে রাস্তার দু’পাশে উপচে পড়ে ধান
তুমি তাকে উন্নয়ন বলে জানো।
লক্ষ্মীমন্ত মেয়েদের লুকোনো ডানা থেকে ঝরে পড়ে অচেনা আকাশ , দুষ্প্রাপ্য মুদ্রা , অর্জিত আত্মবিশ্বাস ,
চৌষট্টি কলার মধ্যে তারা খুঁজে নিতে পারে খেলাধুলার মাঠ। নদীবাঁধ, আর মৎস্যকন্যার সাঁতার।
জ্যোৎস্নার অলৌকিক থেকে তারা আলো আনে ,
সোনালি গমের থেকে আনন্দ ছড়ায়,
ধুলো থেকে জল থেকে অক্ষর গড়ে।
আলতা ধোয়া জলে লেখে সংসার।
ভালবাসা তার ডাকনাম।
ঘরছাড়া করে দাও যদি , ভাষার কুটির বানায়
হাতা খুন্তি থেকে তাদের তরবারি ওড়ে ,
জিভ কেটে দিলে ‘খনা’ জন্মে জেগে ওঠে পাড়া-
বেড়ি ভেঙে সমুদ্র নাবিক হয়ে ওঠে ।
পৃথিবীর সব লক্ষ্মীমন্ত মেয়েরা কোজাগরী রাতে
মায়াবিনী হয়ে যায়।
ছোটবেলার জামা
ছোটবেলার জামা মনে প’ড়ে ।
ছোটবেলার সোয়েটার।
কোনোটির লেস শন পাপড়ির মতো উড়ে যায়.. কোনোটার বোতামের গায়ে কবেকার আলো! আম্ব্রেলা কাট্ ফ্রকের মতো ঢেউ খেলে যাচ্ছে মনে।
সেলাই মেশিনের ঘড়ঘড় শব্দ থেকে ভেসে আসছে
একেকটা বয়স।
‘আমি এখন তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী ‘
‘এখন সপ্তম’ , ‘দ্বাদশীর মেয়ে’ ,
সেইসব জামার গন্ধ ভিতরঘরে বসবাস ।
তার গায়ে বহু পূর্ব উৎসব আমেজ ।
স্বপ্নের ডেতর সেলাই মেশিন চলে ।
সারা শরীরে অজস্র রঙিন সুতো।
সেইসব সুতো থেকে নানা মাপের ফ্রক , টিউলিপ
ভেসে বেড়াচ্ছে ।
ভাসতে ভাসতে…জন্ম জন্মান্তরের গল্প রেখে যাচ্ছে ।
সন্ততি
অরুণাভ রাহারায়
চোখের আড়ালে থাকে পুবের জানালা
হাতের পাতার যত্নে তোমাকে রেখেছি
তুমিও ভোরের সূর্যে ছোঁয়াও আঙুল
পাহাড়ের ধার দিয়ে বুনে চলো উল
তার কারুকাজে আমি আদর মেখেছি
মৃত মাছে ভরে আছে কত নদীনালা
আমার লেখারা আজও তোমার সম্মতি
পায়নি দারুণ! বুঝে নাও কবিতা-সন্ততি
দুটি কবিতা
ঈশানী বসাক
আলেয়া
বুড়বুড়ি কেটে আসা দুধের মধ্যে হাবুডুবু খেতে খেতে আসা শিশু ছুঁয়ে ফেলে আসন। পুজো আচ্চা ফেলে ছুটে আসে আঁতুড়। এভাবে নষ্ট করলি মুখপোড়া, হনুমান সব। দুধ গড়িয়ে যায়, গ্রন্থি বেয়ে মুখ নিয়ে যায় বাবা। মায়ের বুকে বাবা শুয়ে থাকেন নিরন্তর। যেখানে ছাতিম নেশা ঘোরে, আ আ ডাকে উথলে ওঠে শবর তার কাছে বালক বসে। মা নেই, জল নেই, নুন নেই। আঙুল কেটে বিক্রি করে আসে সোনার অঙ্গুরী সহ। বীরাচারী দেখে বিক্রেতা সাজিয়ে রাখে গলানো সোনার আঙুল। বালক জানেনা রক্ত আর দুধ মেশা শহরের শেষ চাঁদের গল্প। গোলাপি রঙের খাদ থেকে উঠে আসা বালির মাঝে এখনো আঁতুড় পাতা। মায়ের বুকে বাবা শুয়ে, ঘুমিয়ে গেছেন ছাদ। শবর ডাকে শিশুকে, আয় আয়। জল ভেঙে ফেলে যেসব ফুল তাদের দেখতে দেখতে উবু হয়ে দুজনে। মাথা নীচু হাঁটুর কাছে। আরো ছোটো, আরো ছোটো হতে হবে। যতটা ক্ষুদ্র হলে রক্তবীজ হতে পারে কেউ।
ফুটকি
ছোটবেলায় খাতার পাতার বিভিন্ন অংশে রাতের তারার মতো ফুটকি আঁকতাম। একজন একজন করে এসে একটা ফুটকি থেকে আরেকটা ফুটকি জোড়া দিতাম। এইভাবে পুরো আকাশ সেলাই করে ফেলতেই মনে হতো আমাদের এই সেলাই করা আকাশের কোনো চাঁদ , সূর্য নেই। মন খারাপ নেই , হাসি ঠাট্টা নেই। রোজ ভাবতাম খাতাটা ছাদের কোণে রেখে আসি। দেখুক এই খোলা নীল সমুদ্র তাকে আমি কিভাবে বেঁধে ফেলেছি। দাদু বলতো পূর্বপুরুষকে তাঁর ভাললাগার জিনিস দিয়ে মায়ায় বাঁধিস ক্যান ? এখনো দেখি সেই লালচে খাতার ফুটকিগুলো তাকিয়ে আমার দিকে। ব্যঙ্গ করে তারা বলছে আমরা জীবনভর জ্বলছি। পুড়তে পুড়তে মৃতদেহ হওয়ার পর ও আলো দিচ্ছি। তোমাদের সতীদাহ এখনো চলছে বলেই আমরা মহাকাল কে অমরত্ব থেকে মুক্তি দিতে পারছি। সেই আলোর মধ্যেই দেখি সেলাই কেটে পালাচ্ছে সবাই। ন কাকিমা , নিম পিসি, সেজ জেঠিমা, বড় মা , ছোট মামি, তোতাদি!! আমার ছাদ থেকে ওঁরা পালাতে চায়। ছাদ সত্যিই হাতে পায়ে লক্ষ্মী। পোড়ারমুখী কারোর সঙ্গে বনিবনা হয়না রে তোর। সব পেসাদ তোর একার!!!!
বাউল
রিমি দে
ওপারটি নামহীন
যে অপারটি বোধ ও বসন্ত নিয়ে
এগিয়ে এসেছিল,আমি তাকে
বাঘ বলে সম্বোধন করি
এসব সুর ও সুধা থেকে
অনন্ত কিছুটা ঝড় নিয়ে আসে
ঝড় কিছুটা ঝুঁকি ও জ্বর
ঝুলে থাকে বটের ঝুরির মতো
আমি ঝুড়ি ভরতেই থাকি
শূন্য হই ক্রমশ
মাথার ভেতরে আহত কবিতার লাশ চক্রাকারে ঘুরতেই থাকে!
পুনরাচমনীয়
সুপ্রভাত মুখোপাধ্যায়
সেই বাড়িটার খোঁজে আছি বহুদিন —
আল্পনায় আল্পনায় কুশল উঠোনে
‘ডোমনা ডুমনি’ খেলছে দিব্যি এক মনে
নিপুণ প্রকল্প খুঁজে আমি আমরণ যেন যৌবন বাউলে
কথা হয়। কথা সেই যে আলোকরঞ্জন সুরে, সুরে
কাদের বন্ধুর মতো আছি অক্ষয় বটের দেশে
বহুদূর বছরের ওই দূরপাল্লা সব ঘরে …
আমিই খুঁজেছি এক শামুক জীবন থেকে দূরে
কারা যে টেনেছে আজ পরিসর— শিকড়ে- বাকড়ে…
সুবীর সরকার
হরিপদ,দেশ ও সারি গান
হরিপদ বলেই চলেন পদ্ম বিলের কথা
আমরা দেখি বাইচের নাও,কাঠের
সম্পান
ঈদের মেলার মাঠে রাত নামছে
শীতের হাওয়ায় ভেসে আসেন হাসন
রাজা
দেশ মানে রূপকথা।
দেশ মানে পরণ কথা।
ফাঁকা বাজারের মাঝে দেশ হারানো হরিপদ
দেশের কথা বলেন
আমি দেখি সারিগান
আমি দেখি বেহুলা ভাসান
আর বিকেলের হাডুডু খেলার
মাঠ
দুটি কবিতা
শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী
শকট
প্রতিবার ফিরে আসি ভগ্নদেউল স্পর্শ করে
সে কথা বলিনি আজও
যেভাবে অঝোরধারা এলোকেশী হয়
একান্তযাপনের স্নিগ্ধ পরাগ মেখে
ভগ্নদেউলে অঞ্জলি অর্পণ করি
এপারে পাতার ঘর পাতার জীবন থাকে
ওপারে অট্টালিকা বহুতল কলতান
মাঝে খরস্রোতা নদী
কুলকুল সন্ধ্যাদেউল
পারাপার শকট সফরে
ভুল করে ফেলি কোন পাশে আছে যাপন আর
কোথায় নির্বাণ।
বাঁধ
পাথরে খোদাই করে রেখেছো আমার জন্মতারিখ
আমি সেইমতো বয়ে চলি
কাওয়াগোড়া ফলের প্রাসাদ ছুয়ে যাই
আমার বুকেতে বাঁধ
এপারে ওদের মরতে দেখি তিলতিল
লাঙল গলিয়ে ওরা চোখের জলের সরোবর
বাঁধের ওপারে বিদ্যুত
শীততাপ আলো জ্বলে সভ্যতার বুকে
ধিকিধিকি উনুনের আঁচ
দুচোখের আঙিনায়
ফিকে হয়ে আসে
শব্দরা ক্রমশ ফুরিয়ে আসে।কান্নারা জড়ো হয়
তারপর নদীবাঁধ
তুমি আসো সপরিবার ভোরভোর
আমি সরোবরে মিশে যাই।
দুটি কবিতা
সুদেষ্ণা ঘোষ
অবরোধ
আজকাল রাত হলেই অ্যাকোয়ারিয়ামের জল বাড়তে থাকে।
ঘুমের মধ্যে খালি ঠিকানা খোঁজে কারা…
ভিতু চাঁদ মেঘের মধ্যে ঢুকে যায়।
আর ভূগোল বইয়ের প্রবল সব গিরিখাতের
ভিতর ডুবে যেতে থাকো তুমি।
রাস্তায় সব হলদে মুখোশপরা লোক…
তারা এমন সব কথা বলে
যার মধ্যে সব কিছু মুছে গিয়েছে
শুধু ‘ঠাট্টা’ কথাটা ভাসতে থাকে গ্যাসবেলুনের মতো
আর এদিকে পুরোটা শুনব বলেই হাতড়াতে থাকি ভবিষ্যৎ
হাতড়াতে থাকি প্রচুর পেঁজা মেঘ
হাতড়াতে হাতড়াতে বের করতে চাই,
এত বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে -ভিজতে লোকটা কেন যাচ্ছে?
মুমূর্ষু ল্যাম্পপোস্ট জ্বলার বদলে নিভে যাওয়ার কথা ভেবে যায় সমস্ত রাত।
কেউ বলেছিল যতক্ষণ ওই বরফের দিন শেষ হবে না ততক্ষণ এই ফেরত আসাও।
কেউ বলেছিল যতক্ষণ এই ঘুম শেষ হবে না ততক্ষণ এই পাথর ভাঙাও।
কেউ বলেছিল, নিষ্পলক চোখের কথা তুমি কতটুকু জান? কতটুকু?
মনে পড়ে একটা শান্ত সাদা ঘুঘু অনেকক্ষণ বসে ছিল পাশের বাড়ির ছাদে।
মনে পড়ে একবার এক কাঠের বাড়িতে কফির গন্ধ আমাদের আগলে রেখেছিল গোটা বর্ষা।
কিংবা, সেই রংচঙে বল অনেকদিন কারনিসে পড়ে থাকার পর যার কথা কারও মনেই ছিল না।
সেই করুণ বিকেলের কথাও যখন একটার পর একটা ব্লক জুড়ে কেল্লা বানাতে গিয়ে ভেঙে ফেলেছ বারবার।
কয়েকটা সিঁড়ি উঠে গিয়ে কতবার নেমে এসেছি কেউ খোঁজ রাখেনি।
কিন্তু রাতবিরেতের চিৎকারে সবাই তটস্থ হয়েছে আর রাস্তার প্রত্যেক বাঁকে উঠে পড়েছে একই গাড়িতে।
একবার এক মাইককে কেউ অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও কথা বলাতে পারে নি বলে তুমি খুব খুশি হয়েছিলে
একবার এক অভিমানী বন্ধুকে সুড়ঙ্গে ফেলে পালিয়ে আসা ছাড়া কোনও উপায় ছিল না
একবার এক লেভেল ক্রসিং নির্দ্বিধায় মৃত্যুর কথা বলেছিল
একবার এক রাত খুঁজে পাওয়ার কথা…
একবার এক ট্রাকের ভিতর বিষণ্নতা লুকিয়ে দেশান্তরী হচ্ছিল
আর তুমি খুব মৃদুস্বরে বলছিলে জেগে ওঠার কথা।
খুব চেঁচিয়েছিলে তোমার কোনও চিঠি আসে না তাতে কিছু এসে যায় না।
খুব নিঃশব্দে কিছু বলতে গেছিলে কিন্তু স্লেট রঙের আকাশ খুব কঠিন অবরোধ জারি করল।
ইস্তেহার
ওয়াইপার যতবার কাচের উপর এগিয়ে আসে
ততবার আমার মনে হয় এবারই হয়তো শেষ নয়
আবার ভেসে উঠবে নীল বেলুনের ঝাঁক
আবার সেই কাঠের সিঁড়ি
আবার সেই গড়িয়ে আসা রুপোর বল
আবার সেই বহুদিন একা পড়ে থাকা একটা ফাঁকা চেয়ার
আর বলে উঠবে কেউ, একদিন কোনও কারণ ছাড়াই পৌঁছে যাব দেখে নিও।
বলবে আর এমনভাবে তাকাবে
এমন টোল ফেলে হাসবে যে
অকৃতজ্ঞ শব্দটা একদিন মেঘের ভিতর থেকে ছুটে এসেছিল খ্যাপা কুকুরের মতো
ভুলে যেতে চাইব প্রাণপণ।
ভুলে যাব রাতের ভিতর খাদের চোরা টান
আর ফ্যাকাশে হলুদ বালবের কথা
আর মিহি তুলোর মতো বৃষ্টি একটু একটু করে মিশে যাবে আজানে
মিহি তুলোর মতো বৃষ্টি অনেকক্ষণ থাকবে
কালো চশমা পরতে ভুলে যাবে
ভুলে যাবে অনির্দিষ্ট ক্ষোভ আর চুপচাপ ঝরে যাবে পুরনো দিনের গল্পের মতো।
এসবের লোভ দেখায় ওয়াইপার
আর অনেক ছোট ছোট বুদবুদের ভিতর থেকে স্বপ্নেরা কখনও মলিন চোখে তাকায়
কখনও দাঁতে দাঁত ঘষে বলে, সব নক্ষত্রের ষড়যন্ত্র।
কখনও জোরে শ্বাস নিয়ে সে…
না, ওয়াইপার এর বেশি সুযোগ দেয় না।
দুটি কবিতা
রুমা তপাদার
সম্ভাবনার মাটিতে
দেহটি পাথর হয়
নত হয়
ধীরে ধীরে মন ভারী হতে হতে
আদিম নক্ষত্র হয়ে যায়
গরম অথচ শক্ত পাথরের মতো চোখ থেকে
‘শেষ’ শব্দ ঝরে পড়ে
জলের ঈশ্বর নেমে আসে আলো-ধার নিয়ে
ভূগর্ভের লাভা-তাপ নিতে
কালপুরুষ আকাশ
দৃঢ় ঘূর্ণনের গতিপথ বোঝায় আবার ফিরে যায়
সম্ভাবনার মাটিতে…
ঝুরি নেমে এলে
শিকড় চিৎকার করে ওঠে
চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়া সামান্য জলের জন্য
গর্ত মেঘ হয়ে এলে
বড় গাছের ডালেরা আরও নত হয়
ক্রমশ আকাশ-ছোঁয়া পাতা
তাপ ছাড়া অন্য কিছু আনতে অপারগ
চিৎ হয়ে থাকে কাণ্ড
সবুজ জবাব আসে ‘দেখা যাক কতটা কী করা যায়’…
ধূসর ফাটল ধরে দেহটি চৌচির মৃদুস্বর হলুদাভ সাদা
ঝুরি নেমে এলে স্রোতের দেবতা জেগে ওঠে ফিসফিসে কান্নায়…
দুটি কবিতা
সরোজ দরবার
১.
ল্যাম্পপোস্টের মাথায় চাঁদ
কাল ছিল, আজ আর নেই
আলো যতভাবে নামে
শুশ্রূষা আর সুরক্ষাময়
এখন কি সাজে সংশয়
চাঁদের জন্য মনখারাপ
অন্তিম এই উৎসবে তবু
তীর্থ চেয়ে ফিরে যাচ্ছে কাক
২.
ভুলে থাকার সেই অপরাধ
একদিন এনেছে তোমায়
পরস্বাপহারী জ্যোৎস্নার ভিতর
এখন, দেখো কাটাকুটি আকাশ-
স্বদেশ তোমার
ভেঙে পড়ার আগে অচঞ্চল
জানাও অন্তত ভোলোনি তুমি
সেই ঘর, জানলা, সপ্তর্ষিমণ্ডল
দুটি কবিতা
রিমি মুৎসুদ্দি
তরুণ কবি
তরুণ কবি তোমার কোনও পরিচয় পত্র নেই।
হলুদ শাড়ি আর মিসিসিপির গান দিয়ে
যাঁরা গেঁথেছিল মালা
তাঁরা কখনও বলেনি,
‘তোমায় দিলাম আজ সমুদ্রের দুঃসাহস!
যাও, বালিপাহাড় থেকে তুলে আনো নুড়িপাথর,
গড়ে তোলো ঘর। বেঁচে থাকুক তোমার নিজস্ব স্বর!’
এখন হেমন্তমুখী সব প্রাণ,
ওদের ছিল না কোনও নরকের দ্বার,
ছিল না কোনও বিপথগামী পুরোনো কাঠের সিঁড়ি,
কেবল সাঁকো ভেঙে পড়ে যাওয়ার ঠিক আগেই
ওদের চোখ মুখ ছিঁড়ে নিতে
ছুটে আসে বাজপাখিদের উজ্জ্বল সব নখ!
এখন কাঁচা কবিতারা সব অরণ্যের মতো বিস্তীর্ণ,
সেখানে বহুপ্রাচীন গাছেদের সাথে জড়িয়ে আছে
বিচিত্র সব লতাগুল্ম, বন্য শ্বাপদ, বিষাক্ত সাপ, নম্র কপোত!
তবুও বুধগণ, যদি এসে পড়ো,
তাহলে বসো এ ছায়াতলে,
বরং বিভ্রান্তির মধ্যেই খুঁজে নিও
অগম্য সেই পথ, অনুচ্চারিত সব শ্লোক!
লুপ্ত নগরীর কথা
ঝিঁঝিঁ পোকার মতো উজ্জ্বল
শতাব্দী প্রাচীন এক লুপ্ত নগরীর প্রবেশদ্বারে লেখা ছিল,
‘শহিদ হয়ে গেলে কেউ সমবেদনাও জানায় না।’
চুপিচুপি গাছেরা নেমে আসে সে শহরে,
মৃত সেই নদীটার গালে চুমু দিয়ে বলে যায়,
‘মানুষ খিস্তি দেয় মানুষকে, অবজেক্টকে নয়।’
প্রতিটা প্রহরে নহবৎখানা থেকে ভেসে আসে সুর,
বাতাসে মেশে প্রশ্নেরা,
‘যত গোপন তত আপন ছিলাম কি?
শহরের যেকোনো দেওয়ালে কান পাতলে শোনা যায়,
মানুষের গাছ হয়ে যাওয়ার স্মৃতি!
দুটি কবিতা
প্রগতি বৈরাগী একতারা
শীতকালীন সংবাদ
প্রেম
ওই যে মহিলা, সংসার-সংসার করে
অসহ্য চিৎকার শুরু করেছে রোজকার মতো
তারপর, আমায় লিখতে বসতে দেখে
হলুদের হাত মুছতে মুছতে
নিঃশব্দে রেখে গেছে এক কাপ চা
নভেম্বর মাস –
আমার আবার সহজেই ঠান্ডার ধাত
পাখাটা দু-ঘর কমিয়ে দরজা ভেজিয়ে দিয়ে গেছে
আর আমি টেবিলে উপুড় হয়ে
কাগজে মুখ ভাসিয়ে দিচ্ছি
কালিজলে টাগরায় বিঁধিয়ে নিচ্ছি মোহনপুত্তলি
তোমার জ্যোৎস্নাছোপানো পৌর্ণমাসী শরীরে
ফুটিয়ে তুলছি উত্তুঙ্গ জোয়ার-ভাটা
ব্ল্যাঙ্ক স্পেস
সে আর নেই, ভেবে ফেলতেই
মাথার ভিতর থেকে ঝটপট উড়ে গেল একঝাঁক কবুতরী
এ কে ভারহীন সময় বলবে, না শূন্যতা!
ঠিক করতে করতে তোমার ঠোঁটের ফাঁকে
জমে যাচ্ছে আর একটা অর্থহীন চিখ
কী দিয়ে জড়াবে তুমি তাকে ?
বিশদ বুক চাপড়ানি
অথবা মাঠ চিড়ে বেরিয়ে যাওয়া ধুঁয়াধার হুইসেলে
ঠগ বাছতে গিয়ে মনে পড়লো বাঘ চাওয়া রাখাল ছেলেটি
সে মিথ্যুক না আত্মহত্যাপ্রবণ, বুঝতে পেরেছিলে কি?
চাইতে চাইতে একদিন ঘন হয়ে উঠবে
এমন তাজিমের জোর সবার থাকে না…
তাই সে সব থেকে দূরে, আমার ব্যাঙরাজকুমারী,
কথা শোনো, প্রাত্যহিক জলকাদায় মুখ ডুবিয়ে
ঘুমিয়ে নাও, আরো কয়েকটা ধোঁয়াগন্ধী শীতকাল
রাজর্ষি দে
শান্তি বলতে যেটুকু বুঝি
এক ঘুম থেকে আরেক ঘুমের দিকে চলে যায়
বিস্মৃতির চরৈবেতি
মাঝে শুধু সময়ের বালি ঝরে যায় কিছু
এলবাম হারিয়ে যায় আলমারির পেটে
নোঙর ছেড়া স্মৃতি ভেসে বেড়ায় স্মরণের এক আঙুল দূরে
আমি বলে পরিচিত দেহ মাংসে রোদ পড়ে মাঝে মাঝে
ঝড়-বৃষ্টিও নিয়ম মতন
অমোঘ নোনাগন্ধের টানে
ভেসে চলে গতজন্মের মৃত সরণী বেয়ে
ভেজা কাঠে ঘষে দিলে চকমকি ওম
তাপ পাই না, শুধু ধোঁয়া ঝাপট মারে
বহুদিন হল চোখে খুললে
স্বপ্নগুলো মনে পড়ে না আর
শান্তি বলতে এটুকু বুঝি
সুখ বলতেও
লং মার্চ
রাজদীপ রায়
সম্রাটের তৈরি রাস্তা পার হয়ে যাচ্ছি
লুকোনো পায়ের কষ্ট স্থির হয়ে আছে;
পেরেকের অনুভব প্রতি পদক্ষেপে
মনে করে দিচ্ছে তুচ্ছ যন্ত্রণার কথা।
তোমাকে কিছুতে আর বোঝাতে পারছি না
এইভাবে বেশিদিন থাকা যায় না আর,
পায়ের ভেতরে বিষ ক্রমাগত উঠে…
সারাদেহে অপমান ছড়িয়ে পড়েছে!
নিহত চটির নিচে পেরেকের মুখ
খোঁচা দিয়ে বন্ধ্যা রাস্তা পার করে দেয়।
জন্মের সময় এলে তুমি চেয়ে দেখো
কুয়াশার আস্তরণ শস্য ভেদ করে–
ছাঁটাই যুবক, তার ফেরা অভিমানে
ভেঙে দাও ব্যভিচারী–মানচিত্র ভুল
তলপেটে হাত রেখে তুমিও বুঝেছ
ঘরে-ঘরে ঋতুহীন হেমন্ত এখন…
*ল্যন্ড্রি-লাইন*
শ্রীজাতা গুপ্ত
বাতিল চাকরিগুলি কাচাকুচি হয়ে যায় সাতসকালে
খোলাছাদে মেলা থাকে দরখাস্ত; ভেনেশিয়ান বাতাস।
সাইলেন্ট ছায়াছবির স্ক্রিপ্ট মরশুমে মুখ বদলায়।
কাছাকাছি সামুদ্রিক ফেনা আছে
ধবধবে চাদর জুড়ে জোয়ারের ঢেউ
আটপৌরে তাঁত আর অপুষ্ট অন্তর্বাসের ফাঁকে
আদুরে বেড়াল
ঘুমোচ্ছে বেকারত্ব। রিগ্রেট লেটার।
লাইল্যাক সুবাসিত ফ্যাব্রিক-সফটনার
ইনকাম গ্রাফের সঙ্গে নামছে
ওয়াশিং পাউডার নির্মা-র যুগে। দূরদর্শনীয় নস্ট্যালজিয়া।
ক্যান্ডিডেটদের পরিচয়পত্র শুকোনো হবে প্রাচীরে। গয়নাবড়ির পাশে। রূপবান আচারের বয়ামের নীচে।
পারিবারিক চিহ্নধারী প্লাস্টিক ক্লিপ আঁকড়ে
সারাদিন রোদ্দুর খাবে।
কারুর পরনে কোনও পোষাকের খিদে নেই।
নাইলন দড়ি থেকে ঝুলে পড়ে একে একে।
সূর্যাস্তের দিকে পুলিশ-ভ্যান এলে
ভাঁজ গুনে সনাক্ত করে দেবে
কোন ঘরে ফিরে যাবে
আলোমাখা আনএম্পলয়েড লাশ।
ভগবানের সংগে দেখা হওয়ার মূহূর্তে
সুমিতা সান্যাল
আশ্চর্য ভগবান আমাকে
সময় দিয়েছিলেন।
ভোটের দিন এগিয়ে আসছে।
এবার তিনি কাউকে ফেরাবেন না।
আমি বলেছিলাম তিনি আমাকে ফিরিয়ে দিয়ছেন।
ঈশ্বর বললেন উপায় নেই ।
এখন কেবলই উচ্চাশা।
তুমি কি পারো না তাকে ফেরাতে? আমি?আমি?
না না আমি তো রাজনীতি।
এক সাথে সব দল করি।
আমি চিরকাল জিততে চাই।
এটাই আমার একমাত্রস্কই চাওয়া।
ফেরিওলার প্রতি যতটুকু নিমগাছ
শীর্ষা
১
ঘ্যানঘেনে একটা দুপুর
কান্না শুষে নিচ্ছে বেড়ালের –
আমাদের গার্হস্থ্য ফুটো করে
নুপুরের ছমছম
মৃদু হয়ে যাচ্ছে,
ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে,
আরও
আরও
আবছা ..
বাইরে এক ঘৃণ্য ফেরিওলার গামছা –
গামছার রং লাল
গামছার গন্ধ লাল।
আমাকে পেঁচিয়ে ধরছে, উঃ!
আমি সাপ হয়ে উঠছি
কুণ্ডলী হয়ে উঠছি,
উঠছি ওপরের দিকে
আকাশের দিকে –
মাটিতে আমার সুখ দুঃখ যৌন খিদের আঁশ!
সব ছেড়ে আমি উড়ে চলেছি
তাড়া করে চলেছি
ফেরিওলার লালকে –
একটা আধখেকো টক কমলালেবু-দুপুর
একটা ‘মুখে মধু’ প্রতিবেশী দুপুর
নাটক দেখছে দ্যাখো,
খ্যামটা দেখছে –
মারো, ওকে মারো,
ওকে ঝাঁটাপেটা করো
২
একটি আমিকে কিনে নিচ্ছে অজস্র
আমি। পায়ের পাতায় বুঁদ হয়ে
নেশা করছে শীতকালের খোলস, আর
ঢুলুঢুলু চোখ কেড়ে নিচ্ছে আমার
দৃষ্টিশক্তির আয়ু। তেলহীন খসখসে
চামড়ার ওপর দিয়ে ঘষটে ঘষটে
এগিয়ে যাচ্ছে জরাজীর্ণ সরীসৃপ দুপুর –
যার আঁশে তোমার চিরসবুজ ঘুড়িটি,
ঘর-ঘর খেলে আমার সঙ্গে;
হাসে-কাঁদে-কথা বলে,
বলতে বলতে হঠাৎ একদিন
উঠে যায় আমার মাথা ছাড়িয়ে –
অগুনতি ফেরিওলা আপেলঋতুর দেশে
দুটি কবিতা
গৌরাঙ্গ শ্রীবাল
ছাগল বাঁশি
ব্রজেন দাসের দুটি মেয়ের বিয়ের দিন ছিল এক
মিনিবাস এসেছিল বাজনাও বেজেছিল, আমার
বয়স তখন ন্যাংটাবেলা, ছেঁড়া প্যান্ট দিয়ে সব
দেখা যেত, আমিও সেদিন ওই সবের ভিতর থেকে
দেখেছিলাম অনেকগুলি কালো কালো বাঁশি।
সেগুলো ছিল ছাগল বাঁশি,
বর-বউ বিয়ে বরযাত্রী এসবের থেকে বেশি আকর্ষণ ছিল
সেই বাঁশি, ঠিক যেন চার ঠ্যাং উপরের দিকে তুলে
মরে যাওয়া সব কালো ধূসর ছাগল।
কী এক বাঁধনে বাঁধা পড়ে
কমলাকান্তের কথা মতো গোরু হতে চাইলাম, কিন্তু
ঘাস কুঁড়ো খড়ের অভাবে মনে হতে লাগল আস্ত
একটা ছাগল চরে বেড়াচ্ছি শূন্য গোয়ালে,
ভালবাসার জোরালো ফু-তে বেজে উঠছি
আনন্দ কী বেদনা কী, কখন কী বলি ঠিক নেই
কখন কী খাই ঠিক থাকে না, বুঝি না
কাকে বলে জীবনের গান। মলমূত্র
মদে ডুবে পড়ে থাকি, সেখানেও তোমার করুণা এসে
সব ছিদ্রে আঙুল বোলায়, শুনতে পাই ওই তো বাজছে সে বাঁশি
এবার আমার বিয়ে, বাহকেরা এসে দাঁড়িয়েছে
খুব শখ ছিল ব্রজ দাসের জামাই হব,
কত ক্ষুদ্র ইচ্ছা, কাউকে বোঝানো গেল না।
ধর্মের রক্ত
অর্থনীতি আর রাজনীতির উজ্জ্বল
নক্ষত্র হল তোমার দুটি স্তন, একে অপরের
পরিপূরক, এদের একটিকে বাদ দিয়ে আর একটির কথা
কল্পনা করা যায় না, রূপায়ন তো দূরের ভাবনা।
কল্পনা করলে যেটা দাঁড়াবে তা হয়তো বা
ক্যানসারে বাদ গেছে তোমার একটি স্তন এবং
অন্যটি নষ্ট হওয়ার আশংকায় বিষণ্ণ করুণভাবে ধুঁকছে।
তবুও তোমার ওই স্তনের কিছুটা নিচে
থেকে গেছে সনাতন ধর্ম, যা তোমার হৃদয়ের ধর্ম
বলে পরিচিত, এই পরিচিতিতে আমাকে
মানুষ বলে ভাব এবং নিজেকেও ভাব মানুষ, অথচ
হৃদয়ের মূল ধর্ম ভুলে শরীরের বহিস্থের রং দেখে
আমি তোমাকে ও তুমি আমাকে ভালোবাস, এ
ভালোবাসায় শরীর হয়ে ওঠে প্রচণ্ড গরম, জল ছায়া
বাতাস উপেক্ষা করে রক্তের পিপাসা শুধু তখন গভীরে।
হৃদয়ের ক্ষত থেকে নেমে আসা গাঢ় ঘি’র মতো পুঁজরস
পাথুরে দেবীর কাছে তুলে ধরে শব-সাধকের মতো
প্রত্যহ প্রার্থনা করি এই সত্য প্রমাণ করার জন্য:
অর্থনীতি আর রাজনীতির প্রচ্ছন্ন ভিত্তি হল
মর্মের ভিতর থেকে উঠে আসা সিঁদুরে মেঘের রক্ত,
এখানেই ধর্ম থাকে যা এখন তোমার স্তনের বৃত্তে জমা হয়ে আছে।
বশীকরণ
সৌভিক গুহসরকার
এই চাল ওর মন, আগুনে দিচ্ছি। এই সরষে ওর শরীর, দহনে দিচ্ছি। এই পদ্মবীজ ওর হৃদয়, হুতাশনে দিচ্ছি। ওঁ হ্রীং টিং ফট স্বাহা। একটা খড়ের পুতুলে সিঁদুর মাখাচ্ছি। ধূপ ধুনো ঘন্টা শাঁখ। ওকে আমার চাই।
আমার পায়ে আলতা। গলায় জবাকুঁড়ির মালা। নাকে নথ। কপালে টিপ। আমার কামকলেবর সাফল্যের জন্য বস্ত্রহীন। এলোকেশ উন্মুখ; পিঠ টানটান; জংঘা প্রস্তুত। আজ সমস্ত রাত বশীকরণ যজ্ঞ। আমার ওকে চাই।
আমার চোখের ফাঁকে ঘুম নেই; আমার শরীরের ফাঁকে শান্তি নেই; আমার আয়ুর ফাঁকে বিশ্রাম নেই। চাই আমার ওকে।
কিন্তু ওর যে বউ রয়েছে, সন্তান রয়েছে। কী হবে তাদের? কোথায় যাবে তারা? আরেকবার ভাবো!
কী বললি ছুঁড়ি, ও যাকে ভালবাসে তার কাছে থাকুক, আমিই তাহলে সারাজীবন পুড়ি?
দুটি কবিতা
গৌতম গুহ রায়
মাদুর
একটি গুটিয়ে রাখা বাদামী মাদুর আছে আমার,
একটি ব্যক্তিগত ছায়া, তোমারও আছে ।
সেই ছায়া ও মাদুরের গোপনে রাখা ছিলো একটি জংধরা ছোঁড়া,
আর একটি আদিরসাত্মক ছবির এলবাম ।
এই মাদুরেই সারাদিন ছায়ার দৈর্ঘ প্রস্থ মাপি,
এখানেই যৌন ছবির সঙ্গে রাত কাটাই, তুমি চুপ করে দেখো
একক ছোঁড়া ও স্খলনের নিজস্ব সুখ ।
টিকটিক করে হাসে আন্তরিক টিকটিকি,
ছায়াও তার মতো দেয়ালে লেপ্টে ওঠানামা করে ।
আমি দেখি সেই ব্যাক্তিগত গহ্বর, আত্মগোপন করে থাকা আদি কীট
দেয়ালের গোপন থেকে ডানা মেলে উড়ে আসে । ভয় পাও তুমি
ছায়া আর তুমি আলো হয়ে যাও, মাদুর আর আমাদের উষ্ণ আশ্রয় থাকেনা
ক্রমশঃ একটি মাংসপিণ্ডের মতো গহ্বর দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছো,
আর তোমার যাবতীয় আহংকার ছায়াদের গায়ে দাউ দাউ জ্বলে ঊঠেছে
চিয়ার্স
এই কাঁধ থেকে, বুকের ছাতির একটা দিক থেকেও কিছুটা মাংস কেটে নাও
টুকরো টুকরো করে তা গেঁথে নাও আয়রন স্টিকে,
লাল উনানের তাপে মালার মতো ঝুলিয়ে দিও সেই খন্ড খন্ড মাংস ।
আমার কাঁধ ও বুকের জমাট ঘাম আগুনের তাপে বাষ্প হবে প্রথমে
ভেতরের জমাট চর্বি টপ টপ করে গলে পড়বে,
বনভোজনের লালাভ স্মৃতি নিয়ে আপনারা
পরিচর্যা করবেন ক্ষুধার, আগুন ঘিরে আদিম মানুষের মতো
চামড়ার কৌপিন পড়ে ঘুড়ে ঘুড়ে নাচছেন ।
তিলে তিলে জমানো আমার দেহের চর্বি
ফোটা ফোটা করে আগুনের গায়ে এসে
উসকে দেবে আগুনের ভেতর, কাঠ ও কয়লার মধ্যের তাপ ।
মৃত, আদীম কোনো গাছের ভেজা বল্কল ছুঁয়ে কেউ হয়তো
পাখিদের উড়িয়ে দিয়েছিলে, দাবানলের আগে ।
আগুনের তেঁতে ওঠা ক্রূর সন্ধ্যায়, এই মাংসের পোড়া গন্ধে
আপনাদের মতো আমিও বলছি, ‘চিয়ার্স’
দুটি কবিতা
শ্যামশ্রী রায় কর্মকার
তবুও নতুন ক্যারোল
তোমাকে কী আর লিখি, বাইরের প্রাচীন গাছে
দাউদাউ কথাকুসুম, খাতাতে দাগ পড়ে না
অথচ শব্দ খুলে একদা আলোর নিখিল
বহতা নদীর মতন বইত, রূপকথারা
আজকাল ঋতুর নীচে জমছে দুঃখরাজির
পুরনো হলুদ পাতা, সেপিয়া স্মৃতির উঠোন
থইথই বর্ণমালা, মত্ত কারসাজিতে
শয়তান হাতের সুতো, আমরা কাঠপুতলি
তুমিও দেখছ তো আজ সরলের হরিণমতি
কীভাবে ভ্রান্ত পায়ে ছুটছে দিগ্বিদিকে
কীভাবে জটিল এখন হাসছে রাজার চালে
আমাদের পিঠের চালে সাবেকি ঢঙে দুপুর
উদাসী পায়রা ওড়ায়, ব্যথানীল শ্লেজগাড়িতে
কবেকার সান্তাবুড়ো, প্রিয় দুখ ভুলানিয়া
জ্বেলে দেয় আশার আলো, যদিও মোমেন্টারি
যদিও সবাই জানি, সব শেষ রাত পোহালে
একাকী ক্ষমার পুরুষ কত আর জ্বালবে আলো
তবুও বিজন দিনের বিকেলে যে দুটি হাঁস
শরীরে শঙখ বোনে, আমরাও তাদের মতো
তোমাকে কী আর বলি, কোন এক জাদু আশায়
এ পোড়া হৃদবিজনে জ্বালছি পবিত্র মোম
গাইছি নতুন ক্যারোল প্রতিদিন খুব গোপনে
আবহমান ও একটি সকাল
ফেরিওয়ালার ডাকে ম-ম করছে সকালের শরীর
মাছ আছে! লাল নীল মাছ!
পৃথিবীর সমস্ত জীবন তার হাঁড়ির ভিতর
খলবল করে উঠছে অভ্যাসের খেলায়
এও এক মাহেন্দ্রক্ষণ
একেকটি মাছ বিক্রি হয়ে গেলে
অন্য মাছেরা ভাবছে
ওই! ঈশ্বর মুখ তুলে তাকালেন
আমরা রক্ষা পেলাম
ওদিকে ঘন তমিস্রায় জ্বলে আছে ঈশ্বরের প্রথম আঙুল
তিনি নিবিষ্ট আছেন আবহমানের গ্রন্থ পাঠে
পৃথিবীর দিকে চোখ নামাতে পারছেন না
অপেক্ষা
স্বপন নাথ
দেখা গেল তোমার দুচ্ছাই আগুন ভষ্ম মেখে আমি-পেয়জল
কালের চোখমোড়া এক ভাঁজে
মেটামরফিক অপেয় হয়ে গেল
এবার নর্দমার শ্যাওলা নালিকীট
কিংম্বা বৃক্ষের ভ্রূণোজ বীজমুখে পরাগমুখর – – –
হৈমন্তিক এই তিরতির বেলায়
বাষ্প টেনে নেবে তাপ । অতঃপর কচুপাতার গা বেয়ে টুপটাপ
কিংম্বা দূর্বোর ডগায় হীরকদ্যুতি সূর্য ছুঁয়ে নেবে ।
স্পর্ধিত ডানায় আগুন নেভে , নেভে – – –
নিজেকে হারাতে চেয়ে
নিজেই দহনজল ছেঁচে নেবে শিরায় শিরায়
আগামীতে পাতন বর্ষা , অপেক্ষা – – –
হরিষে বিরষে আলো শুষে ধূসর হলে
শেকড়ের গর্ভমুখ রজরক্ত ডিম্ব ধারণ করে ।
শূন্য শূন্য দিন
এলা বসু
সকলেই অর্ধেক কথা বলে লাইন কেটে দিচ্ছে।
একদলা মাখনের মতন নরম আলো, গরম ভাতে পড়তে পড়তে দিক পরিবর্তন করে ফ্রিজে ঢুকে পড়ল
পশ্চিমের বারান্দা দিয়ে, বাবার হাত থেকে দুপুরের উচ্ছিষ্ট খেতে আসত যে বিড়াল দুটো, আজ দেখলাম তারা ইঁদুর কলে বন্দী।
প্রায়শই টের পাই, ব্যাকস্টেজ থেকে এক জোড়া চোখ,
মেপে চলেছে প্রতিটি হাইফেন, কমা,সেমিকোলনের ছন্দ।
শামুক জন্ম ভেঙে জলের তোড়ে ভেসে যেতে যেতে, খড়কুটোর মতন আগলে ধরেছি বৃক্ষ জীবন।
ডালপালা সমেত পূর্ণাঙ্গ এক বৃক্ষ মানুষ, শূন্যস্থান পূরণের জন্য ঝুঁকে পড়ছে নবজন্মের ওপর কোনও এক আমলকী বিকেলে
দুটি কবিতা
সুকৃতি
ডাক
দুম করে চলে যেতে হবে।
শরীরের কাশবন থেকে একদিন
তবুও উড়বে ফুল জেনে নিও। আজ
শিরায় বেদনা বাজে আর
স্নায়ুতে হরিণ বোধ নিয়ে
যতটা ডুবতে গেছি, জল
তারও বেশি উপচে পড়েছে।
মাঝখানে নদীর আসন…
আশ্চর্য সাবান বোধ আমাকে যতটা
স্নানের নিকটে এনেছিল
তারও বেশি ভিজিয়ে দিয়েছে।
এখন শীতের রেণু ভারি লাগে
যেন কেউ ভোরবেলা ডেকে
ঝাঁকিয়ে দিয়েছে হরমোন।
ভূতের শহরে
অবস্থান থেকে পরস্পর
সরে যাওয়া জরুরি এখন।
নতুবা বৃত্তের কেন্দ্র ভেঙে বিন্দু ছড়িয়ে পড়বে।
এক থেকে দুই এর মতো, দুই থেকে তিন,
চার… পাঁচ এর বেশি ছাড়াতে চাই না।
শীতের সামান্য চাওয়াগুলি
নিয়ে তবু ঋতু গুলি খেলে।
আমি ভাবি গোল গোল সব…
গ্যাসীয় খিদের চাপে সবই
সবিতার পরোটার মতো
ভালো লাগে শীতের সকালে।
ডাক ওঠা ট্রেন হুইসাল দিতে দিতে
ছুটে যায় পরের শহরে।
এখানে আপন কেউ নেই।
চাপ দিয়ে ভালোবাসা প্রমাণ করতে গিয়ে সেই
চাপে পড়ে যাওয়া…
ফলে আমি বেল চাই ভূতের শহরে।
যদিও নিয়তি মোরে একটি নারীর
নাড়ী থেকে ছিঁড়ে পাঁচ নারীর নাভিতে
করেছে বিলীন।
বোধ
অ য় ন চৌ ধু রী
বোধ, আগুন, মায়া ও তঞ্চক শার্সির কাচে ছায়া রেখেছিল।
তোমার বাহুতে লেগেছে লাজুক রোদ, কামনার ছিমছাম আলো
হে রুদ্র, তোলপাড় করো, ভেঙে ফেলো এইসব অপরাধী মন
দেহের ভিতরে দেহের মগজে কারফিউ লেগে আছে,
মগজে মগজে লেগে গেছে স্পর্শের দেহাতি কোকেইন
আমাকে শুদ্ধ করো দেহের কাছে, আমাকে নিংড়ে নাও পিপাসু আলো তবু অক্ষরকথার মতো আলগা কোরো না
আমি ভূত, আমি ভবিষ্যৎ, আমি আলো, আমিই অন্ধকার বাষ্পান্ধ এক পথিক
সমস্ত ঢালু জমিপথ পেরিয়ে নিমগ্ন বসেছি এক অন্ধ কূপের কাছে
শূন্য ও শূন্যের ভিতর তামাটে গোলার্ধ। খেলাঘর ও সূর্যের আলো শস্যের দানায় দানায় গুম হয়ে আছে
সংগীত কি এর চেয়েও মায়াময়?
জলের উতরোল ঢেউ এসে লাগে পাড়ে।
বালি জমে আছে তোমার কূপের কিনারে…
দুটি কবিতা
দীপকরঞ্জন ভট্টাচার্য
বিশ্বাস
বিশ্বাস নিদ্রিত পাত্র
সোমরস
ঢালে তবু ধীর
ঋতুভাবে ছুঁয়ে দেখে
ফসলের
পরম শরীর
বুকের জরুল হয়ে
একাকার
জীবনে জড়ায়
নারীমন ঘনবন
ক্ষয়ক্ষতি
কালে ভেসে যায়
জীবন
জলের ভিতরে ঝরে
মহাবীর্য
প্রকৃতি-হরিণী
গর্ভে নিয়ে পাড়ি দেন
তৃষ্ণাভ্রূণ
ঘুম ও আগুনে
পৃথিবী অলীক বাস
মুথাঘাস
শিশু ঋষি জানে
তবুও জীবনবোধে
খুঁজে নেয়
নদী ও রমণী
মৃৎফলকে লেখা
হিন্দোল ভট্টাচার্য
১
যেকোনও বাড়ির মধ্যে একটি নির্জন ঘর থাকে
হয়তো সবার চেয়ে দুঃখী বলে একটু আড়ালে
দেওয়ালে মা-কালী নেই, একটি ঘড়িও নেই কোনও
আর যে বাড়িতে নেই এমন নির্জন কোনও ঘর
সেখানে সংসার থাকে, অসুখেবিসুখে—
আচমকা হাওয়ায় সব দরজা জানলা হাট খুলে যায়
অনেক মৃত্যুর দুঃখ সহ্য করে দেওয়াল ক্রমশ
ক্লান্ত হয়ে যায়, তার রন্ধ্রপথে আসেন ঈশ্বর
কামুক ডাইনীর গলা শোনা যায় রাত হয়ে এলে…
তুমি কি দুঃখের কাছে একা একা থেকেছ কখনও?
নির্জন ঘরের কোণে, এক কোণে যেখানে জানলায়
অমল একাকী বসে শোনে পদধ্বনি, প্রহরীর!
২
আমাকে রহস্য ভেবে তুমি তার সমাধানে
খুঁজেছ হাতের ছাপ,
সিরিঞ্জের দাগ
ভেবেছ পাপের গন্ধ এভাবেই খুঁজে পাওয়া যাবে
তদন্তসূত্রের চিহ্ন আমিও তো ছড়িয়ে রেখেছি
একদিন খুঁজে পাবে ব’লে…
আমাকে পেয়েছ তুমি, আমিও তোমাকে;
বলিনি কখনও,-
সমস্ত ফিঙ্গারপ্রিন্টে এই ছিল আমার মোটিভ
আবহমানের এই সংখ্যার সকল কবির সমস্ত কবিতা পড়লাম। পৃথকভাবে কোনো একজন কবির কবিতা সম্পর্কে আলাদাভাবে বিশেষ ভালোমন্দ কিছু বলার নেই। সব কবিতাই বেশ সুন্দর। ভালো লাগার কবিতা। একটানে পড়ে শেখ করলাম। শুভেচ্ছা নেবেন।
কথাটা হবে পড়ে শেষ করলাম
আবহমান এর কবিতাগুলো পড়লাম।বেশ ভালো লাগল। অনেক নতুন আঙ্গিকের কবিতা রয়েছে।প্রচ্ছদগুলিও সঙ্গত সামঞ্জস্য পূর্ণ এবং খুব সুন্দর ।সমস্ত কবিকে শুভেচ্ছা ও সর্বোপরি সম্পাদকমণ্ডলীকে ধন্যবাদ জানাই এমন একটি পত্রিকা উপহার দেওয়ার জন্য ।সবাই ভালো থাকবেন। শুভ ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা রইলো।
আবহমান এর কবিতা গুলো পড়লাম।বেশ ভালো লাগল। অনেক নতুন আঙ্গিকের কবিতাও রয়েছে।প্রচ্ছদগুলিও সঙ্গত ,সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং খুব সুন্দর ।এমন একটি পত্রিকা উপহার দেওয়ার জন্য সম্পাদকমণ্ডলীকে ধন্যবাদ। সবাই ভালো থাকবেন। শুভ ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাই।
সম্পাদকমণ্ডলী “আবাহন”,
প্রথমেই জানাই নতুন সূর্যের আভাস্নান হৃদয়ের ঊষ্ণীষ অভিনন্দন ।পরে বলি বুড়ো সূর্যের আলোয় আবাহমান ওয়ালে টাঙিয়ে দিয়েছেন যে ভোর ( বিশেষ কবিতা সংখ্যা) তা এক কথায় অনন্য , স্মরণযোগ্য,সংরক্ষণযোগ্য, মুদ্রিত পৃষ্ঠার গন্ধমাখা আবেশ জড়ানো । এর মধ্যে দু তিনটি স্থানিক, ক্ষণিক চিত্তচাঞ্চল্যের প্রক্ষেপণ কিন্তু বাকীগুলোর অভিব্যক্তি অভিযোজন ব্যাপ্তির বিশালতায় মেধার পিপাসা সম্মত । পড়ে না ফেলা পর্যন্ত হৃদি টেনে যায় ;মেধা পিছিয়ে পড়ে ।অস্থির করে তোলে । আবহমান যখনই পড়ি এই ঘোরনিশি আমায় কুহক পরায় ।
এখন বুঝতে পারি শঙ্খ ঘোষ (জেঠু) র কথা “কবিতা আমি একটানা অনেক পড়তে পারি না ।” এই না পারা অজ্ঞতার নয় ।স্মৃতি বৈকল্যের নয় । ভালো না লাগার নয় ।এ আসলে কবিতার মানসলোকের পলে অণুপলের জারণ রসাযনে তলিয়ে যাওয়ার অবকাশ।তাই আবারো বলি, লেখনীতে ক্ষীর চাই , কিন্তু একলপ্তে এত ক্ষীর ই ম্যাগে ভালো নয়। এ জন্য এটির মুদ্রিত সংখ্যা হলে তারিয়ে তারিয়ে পড়া যায় । কারণ হিন্দোলের কথা মতো প্রতিটি কবিতার ঘরের ভিতরে অজস্র অন্দরমহল। আর আমার মতে প্রতিটি অন্দরমহলই পরাগ মুখর ।
আর একটা কথা ,এ পর্যন্ত “আবাহমান”যেটা মনে হয়েছে তা হলো -“আবহমান” লেখা প্রকাশের নিছক একটা প্ল্যাটফর্ম নয় ,বরং বিশ্বায়িত বিকাশ ধারায় সাহিত্যের অণুপুঙ্খ বিশ্লেষণের নতুন জানলা। আরিস্টটলীয্ পোয়েটিক্সের ভ্যারিয়েশন জনিত অভিব্যক্তিতে নবতর সংযোজন ।একটা আন্দোলন । চিন্তা চেতনার বৈভবী আস্বাদন।
পরিশেষে বলি,আবাহনের আহ্বানে মগজাস্ত্র শাণিত হোক।এ সংখ্যার কাব্যভাষায্ বাঙালী বেঁচে নেই টিকে আছে,বাঁচতে শেখাক আবাহন।
# # স্বপন নাথ
সুন্দর সুচিন্তিত সংখ্যা
কবিতা সংখ্যা মানেই বিশেষ সংখ্যা। সকলের লেখাই ভালো লেগেছে। সকলকে শুভেচ্ছা জানাই। এবং আবহমান-কে অনেক ধন্যবাদ।
খুব ভাল লাগল। প্রতিটি কবিতা নতুন কবিতা। ঝকঝকে চোখে দেখা নতুন অভিভব।
অনবদ্য কবিতা সংখ্যা। অনেক অনেক ভালোলাগা জানাই।